প্রিয়তম পর্ব-১৩

0
221

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

দিনদিন ইফাদের ওরকম নির্দয় আচরণ কষ্ট দিচ্ছিলো, মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছিলো রিতুকে৷ তবুও যোগাযোগ রক্ষার জন্য নানান বাহানায় ওকে ফোন দিতেই লাগলো। ইফাদ ব্যস্ততা দেখিয়ে প্রথম প্রথম কথা বলতো না, কিন্তু বেশিদিন এড়িয়েও যেতে পারলো না। ও যখন শান্তস্বরে রিতুর এ সমস্ত আচরণের পেছনে কারণ কী জানতে চাইতো রিতু সে সময়টুকুতে কিছুই বলতে পারতো না। আমতাআমতা করতো। অদ্ভুত এক লজ্জা, আড়ষ্টতা, সংকোচ সব একসাথে ভর করে ওকে চুপ করিয়ে দিতো। নিজের এরকম আচরণে নিজের প্রতিই রাগ হলেও মুখফুটে দুটো ভালোবাসার কথা বলতে ওর বাঁধতো। ওদিকে ইফাদ ওর সব কথা মনোযোগ দিতে শুনতো। আশা নিয়ে থাকতো কিন্তু বিশেষ কিছুই বলতো না রিতু। যারজন্য ইফাদ একপর্যায়ে আগের মতো যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। কত আর আশা নিয়ে থাকবে সে? এভাবে সত্যিই কোনো সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো যায়? রিতু কি একটুও বোঝে না?
ও কি না জানিয়ে বিয়ে করার শা-স্তি দিচ্ছে ইফাদকে?
.

ইফাদকে না বলতে পারলেও রিতু শেষ পর্যন্ত যার
কাছে নিজের আবেগ, অনুভূতি লুকাতে পারলো না সে হলো নাজিয়া ইসলাম। শ্বাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে একদিন খুব কাঁদলো। নাজিয়া ইসলাম পুত্রবধূর করুণ অবস্থা দেখে এবার নিজে ছেলেকে ফোন করে কঠোর গলায় জানিয়ে দিলেন অনেক হয়েছে, এবার যাতে ও রিতুর সাথে সব ঠিকঠাক করে নেয়। ইফাদ বরাবরই মা-বাবার বাধ্য ছেলে৷ ওদের কথা মেনে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু এবার রিতুর পক্ষ নিয়ে মায়ের কথা বলাটা পছন্দ হলো না ওর। রিতুর উপর রাগ হলো। মাকে দিয়ে বলাচ্ছে? ও কেন নিজের মুখে বলতে পারলো না? এই রাগে পেয়ে বসলো ওকে। আর ভাইয়ের এমন কঠিন আচরণে ইফতি প্রচন্ড ক্ষে’পলো৷ রিতুকে শাসন করলো। সব ভুলে নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বললো রিতুকে। পরীক্ষা এগিয়ে আসায় উপায়ন্তর না পেয়ে রিতু তাই করলো। ম্যাথের সাবজেক্টগুলোতে জোর দিলো, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে পরীক্ষায় বসলো। অদ্ভুত ভাবে রিতু খেয়াল করলো ডি’প্রেশ’নে ভুগে পড়ার কারণে ওর এবারের প্রস্তুতি আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।
এইচএসসি পাশ করলো মোটামুটি বেশ ভালো
একটা রেজাল্ট নিয়ে। তাতে কিছুটা আত্মবিশ্বাস বাড়লো ওর৷ এরপর বোট্যানি নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো৷ কিন্তু কিছুতেই নিজের মনের অনুভূতির কথা ইফাদকে রিতু বলতে পারলো না।

নাজিয়া ইসলাম বুঝে পান না কি করে দু’জনের মিল করবেন। ছেলে-মেয়ে দুটোর প্রতিই তিনি স্নেহ বোধ করেন। ছেলের অভিমান বুঝেন, রিতুর কষ্টও বোঝেন। মেয়েটা এতগুলো দিন কত কাকুতিমিনতি করেছে, নিজের ভুলগুলোর জন্য ইফাদের কাছে মাফ চেয়েছে। তিনি নিজেও কম বোঝান নি ছেলেকে। এরপরও যখন ছেলের মন গললো না, তখন তারই বা কি করার? শেষ পর্যন্ত ছেলে-বৌমার সম্পর্কের এই জটিল খবর এবার রউফ সাহেবের কানে গেলো। তিনি তো অবাক। তার আড়ালে এসব চলছে আর তিনি টেরই পেলেন না? ভীষণ চটে গেলেন রউফ সাহেব। তিনি সরাসরি ফোন করে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
— এটা বিয়ে নাকি ছেলেখেলা?
— বিয়ে।
— স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হয় তা তোকে হাতে ধরে বুঝিয়ে দিতে হবে? তুই কি বিচ্ছেদ চাস?
ইফাদের গলার স্বর ভারী হলো,
— ভাবলে কী করে?
রউফ সাহেব রাগী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
— তাহলে বৌমার সাথে যোগাযোগ করছিস না কেন?
এত অধপতন হয়েছে তোর? এত নিচে নেমে গেছিস? ওই দেশে কি কারো সাথে জড়িয়ে পড়েছিস নাকি? একটা কথা মাথায় রাখবি তুই নিজে কিন্তু বৌমাকে পছন্দ করে এনেছিলি।
ইফাদ এবার মনোক্ষুণ্ণ হলো,
— মা আর তোমারও মতামত ছিলো। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি চরিত্রহী’ন নই বাবা।
— তাহলে কী বউকে রেখে বিদেশে পড়ে থাকবি
আর মেয়েটাকে কষ্ট দিবি?
— ভাবিনি…
— কী চাস তুই?
ইফাদ ম্লানমুখে বলল,
— বউয়ের ভালোবাসা।
রউফ সাহেব থতমত খেলেন ছেলের কথা শুনে।
ছেলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও এতটা ফ্রি সম্পর্ক নয় তাদের। আর ইফাদ সবসময়ই স্বল্পভাষী। সেই ছেলে আজ তার মুখের উপর এসমস্ত কথাবার্তা বলছে? লজ্জা-শরম বিকিয়ে দিয়েছে নাকি? রউফ সাহেব ধমকে ওঠলেন,
— লজ্জা করে না বাপকে এই কথা বলিস?
ইফাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
— আগে করতো। এখন না। এখন আমি নিজেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। তুমি যদি ছেলে আর ছেলের বউয়ের সম্পর্ক নিয়ে বিচার বসাতে আসো তাহলে আমার তো সমস্যাটা জানানো উচিৎ তাইনা?
— কী সমস্যা?
ইফাদ অভিযোগের সুরে বলল,
— আমার প্রতি আমার বউয়ের ভালোবাসা নেই। থাকলে ও নিজে আমাকে ফোন করে আমি কী চাই তা জানতে চাইতো। কিন্তু না, ও শুধু মায়ের কান্নাকাটি দেখে, আমার ভাই-বোনরা আমাকে মিস করে সেটা দেখে। ওদের জন্য আমাকে দেশে ফিরতে বলে। বলো এই অবিচা’র কি ঠিক?
— তাহলে তুই বলে দিলেই হয়…
ইফাদ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
— আমি আর ওর কাছে ছোট হবো না বাবা।
রউফ সাহেব চটে গেলেন,
— তাহলে কি এভাবেই চলতে থাকবে সবকিছু?
বৌমার বাবাকে কি জবাব দেব আমি? আত্মীয়-স্বজনরা শুনলে কি বলবে? এসব শিক্ষা দিয়েছি আমরা তোকে?
— শ্বশুর মশাইকে যা বলার তা আমি বলবো। আর আত্মীয়দের শোনায়ই বা কি যায়-আসে?
— সমাজে বসবাস করি আমরা, ভুলে যাস না।
— আই ডোন্ট কেয়ার…

রউফ সাহেব প্রচন্ড রেগে গেলেন। তার হাত ধরে বেড়ে ওঠা ছেলেটা তার মুখের উপর বলছে ‘আই ডোন্ট কেয়ার?’ এত বড় সাহস? তিনি ঠিক করলেন ছেলের এই ত্যাড়ামো আচরণ কিছুতেই মেনে নেবেন না। বিয়ে কি ছেলেখেলা নাকি? ইচ্ছে হলো করলাম, এরপর আর সম্পর্ক রাখলাম না? এসব অন্যায় তো তার বাড়িতে চলতে পারে না। লোকে শুনলে কি বলবে? ছি ছি ছাড়া আর কিছু না। মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না যখন পাড়া-পড়শীরা শুনবে তাদের গুণধর পুত্র বিদেশ গিয়ে বউয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে না। রউফ সাহেব রিতুকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো এমন কুলা’ঙ্গার ছেলের জন্য যাতে রিতু আর আবেগ খরচ না করে। যাতে আর ছোট না হয়। এবার ওকে পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। রিতু চোখের জল মুছে, একবুক কষ্ট নিয়ে শ্বশুরের কথা মেনে নিলো।

এরপর রউফ সাহেব এটাও জানতে পারলেন ইফাদ রিতুর সাথে দূরত্ব বজায় রাখলেও নাজিয়া, তৌফ, রুফিদের কাছে ফোন দিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখে, মাস শেষে বউয়ের হাতখরচ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে দেয়। তবে বউয়ের সমস্ত দায়িত্ব পালন করছে। তাতে কী? যেখানে স্ত্রীর প্রতি মূল দায়িত্বটুকুই পালন করছে না সেখানে টাকাপয়সা দিয়ে দোষ ঢাকবার নাটক কেন? ছেলের উপর রেগে রউফ সাহেব নিজের স্ত্রী, তৌফদের বকাঝকা করলেন। ওয়ার্নিং দিয়ে দিলেন ওরা যাতে কোনোভাবেই ইফাদকে রিতুর কোনো খবরাখবর না দেয়৷ তৌফ, রুফিরা বড় চাচার কথার বাধ্য। কারণ এবার তাদেরও মনে হচ্ছিলো ইফাদ যা করছে তা এবার একটু নয় বেশিই বাড়াবাড়ি হচ্ছে। ভয়ে হোক, চাচার বাধ্য হয়ে হোক ওরা ঠিক করলো ইফাদকে আর কোনো খোঁজ দেবে না, অবশ্যই না।

এদিকে আচমকা সবার কাছ থেকে এরকম
আচরণ মোটেও আশা করেনি ইফাদ। এমনিতেই বউয়ের অবহেলা, প্রজেক্ট, রিসার্চ আর ল্যাবের চাপে পড়ে জীবন অতিষ্ঠ। এরমধ্যে যদি পরিবারের মানুষগুলোই ওর সাথে এমন নাফরমানী করে তাহলে কীভাবে মন-মেজাজ ঠিক থাকে? ইফাদ কারো কাছ থেকেই রিতুর খোঁজ না পেয়ে দিশেহারা বোধ করলো। চেষ্টার ত্রুটি রাখলো না, কিন্তু এ পর্যায়ে কেউই ওকে রিতুর খবর দিলো না। এরমধ্যে এক রাতে রিতুকে ফোন দিলে সে নিজের নাম্বারটি ব্লক দেখলো। এমন আচরণে ইফাদ হতবাক হলো। এতকিছুর পরও এই আচরণ? ও কার জন্য প্রতিনিয়ত ভাঙছে? এই মেয়েটার জন্য? যে ওকে ব্লক করে দিয়েছে? এইযে, রিতুর চিন্তায় ওর চোখমুখ শুকিয়ে গেছে, দুর্বল মন নিয়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে পড়ে আছে তাতেও মন গললো না ওর? এ ক’দিনেই হাঁপিয়ে গেছে? এদিকে বাড়ির সকলকে ওর ধর্ণা দেওয়া শেষ৷ সবার এক কথা, বউয়ের সাথে সব ঠিক করে নাও, নয়তো আমাদের কাছে ওর খোঁজ চাইবে না। আরে ইফাদ তো সব ঠিক করে নিতেই চায়। কিন্তু রিতু? ও তো ইফাদকে স্বামী হিসেবে ভাবেই না। একবারও মুখ ফুটে বলে না যে ‘স্যার আপনি আসুন, আমার জন্য আসুন। আমার আপনাকে চাই। আর কখনো অবহেলা করবো না,
দূরে ঠেলে দেবো না।’

কই আচরণে তো কখনো প্রকাশ করেনি এমন কিছু, ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও তো সে খুঁজে পায়নি। কখনো তো বলেনি। শুধু মিনমিন করে নিজের ভুলের জন্য সরি বলেছে। ওকে মিস করে বলেছে। পরিবারের কথা ভেবে দেশে ফিরতে বলেছে। ইফাদের কি শুধু ওই একটাই কারণ দেশে ফেরার? রিতুর সামনে থাকলে যে প্রতিনিয়ত ওর আচরণে ইফাদ পাহাড়সম কষ্ট পায় সেটা তো এতদিনেও রিতু বুঝলো না। সবার জন্য ওর চিন্তা, ইফাদের জন্যই না। রিতুর এসমস্ত একপাক্ষিক চিন্তাধারায় ইফাদের রাগের পারদ চক্রবৃদ্ধি আকারে বেড়েছে। যেখানে পা’ষ’ন্ডী বউটার কাছে ওর ফিলিংসের কোনো দাম নেই, যাকে এতদিনেও নিজের মনের অবস্থা বোঝাতে পারলো না, তার কাছে কেনই বা ফিরবে? তাই ওকে এবার কঠিন রাগ-জেদে ভর করেছে। যতদিন না রিতু নিজের শক্ত খোলস ছাড়বে, নিজে থেকে ওকে ডাকবে ততদিন সেও দেশে পা দেবে না। তবে একপর্যায়ে ইফাদ চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঠিক করলো এক্ষুণি টিকিট কেটে দেশে চলে যাবে। কিন্তু টার্ম কোর্সের জটিলতার কারণে বিপাকে পড়ে গেল। আর এ সময়টুকুতে এটাও ভাবলো সে যদি এভাবে নিজে থেকে রিতুর কাছে চলে যায়, তাহলে রিতু ওকে আবারও সস্তা ভাববে। কিন্তু ইফাদ কিছুতেই আর নিজেকে সস্তা বানাতে চায় না।

এভাবেই মান-অভিমান, রাগ-জে’দে কেটে গেলো
আরো কয়েক মাস। একদিন ক্লাস সেরে ফেরার পথে এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়ে গেলো রিতুর। রিকশা আর সিএনজির মুখোমুখি সং’ঘ’র্ষে ভীষণ আহত হলো। গুরুতর আহত অবস্থায় নেওয়া হলো হাসপাতালে। বাড়িতে খবর গেলো। সবাই ছুটাছুটি করে এলো। বেকায়দায় পড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চামড়া ছিলে গেছে রিতুর। ডান হাত ভে’ঙে গেছে। মাথায় সেলাই লেগেছে পাঁচটা। ইশিতা তো বোনের এ অবস্থা দেখে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। বাবুল মিয়া ভেঙে পড়লেন৷ রউফ সাহেব আর নাজিয়া ইসলাম গিয়ে তাদেরকে সান্ত্বনা দিলেন। ডাক্তাররা জানালেন চিন্তার কারণ নেই। নিয়ম মেনে সব করলে ঠিক হয়ে যাবে। সবাই এ কথা শুনে স্বস্তি পেলো। তিনদিন হসপিটালে থাকতে হলো রিতুর। এরপর বাড়ি ফিরে নিয়ে আসা হলো ওকে। পুরো এক মাস হাত দিয়ে কিছু তুলতে বারণ করা হলো। শরীর দু’র্বল থাকায় বেডরেস্ট দেওয়া হলো। ইশিতার কাছ থেকে এই খবরটা পেয়ে ইফাদ এবার সত্যিই ধৈর্য্য রাখতে পারলো না, দিশেহারা বোধ করলো৷ রাগ-জেদ ভুলে গেলো। রিতু পাষাণ হতেই পারে, কিন্তু ও তো ভালোবাসে মেয়েটাকে। ইফাদ দু-মিনিট চিন্তা করলো সবকিছু নিয়ে। এরপর রিতুর জন্য চিন্তায়, উদ্বি’গ্ন হয়ে সমস্ত কাজ ফেলে ও দু’দিন পরে প্রথম যে ফ্লাইট ছিলো সেটার টিকিটই বুকিং করে ফেললো।

______________

চলবে…