প্রিয়তম পর্ব-১৬

0
182

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১৬

রিতু প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে হাসলেও পরক্ষণেই
নিজের কান্ডে লজ্জিত হলো। এতবড় ছেলেকে তার বাবা শাসন করেছে গায়ে হাত তুলেছে, এটা নিয়ে
মজা করাটা নিশ্চয় ঠিক করেনি। ভীষণ দৃষ্টিকটু ঠেকলো ব্যাপারটা রিতুর কাছে৷ উফ! কি ছোটলোকি পনা করে ফেলল ও! ইফাদ নিশ্চয় ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি! রিতু তাই বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এলো। এরপর লজ্জিত কন্ঠে বলল,
— এভাবে বলাটা আমার উচিৎ হয়নি। সরি।
— ঘুমিয়ে পড়ো।
রিতু জিজ্ঞেস করল,
— আপনি ঘুমাবেন না? চলুন…
— একটু পরে যাচ্ছি। তুমি যাও…

রিতু ত্রস্ত পায়ে চলে গেল। ঘন্টাখানিকের মধ্যে
ঘুমিয়েও পড়ল৷ ইফাদ বারান্দায় বসে রইল মাঝরাত অবধি। ওর সব ভাবনাগুলো জমাট বেঁধে আছে। কি হচ্ছে এসব ওর বোধগম্য হচ্ছে না। রিতুর আচরণ দুর্বোধ্য। মনে হচ্ছে ইফাদের কোনো কিছুতেই ওর কিছু যায় আসছে না। আগে কখনো এরকম মনে হয়নি, কিন্তু এখন হচ্ছে৷ প্রথম প্রথম ফোন দিয়ে যেভাবে কান্নাকাটি করতো তখন ইফাদের মনে হতো রিতু পাল্টে গেছে। হয়তো আগের মতো অবুঝ ব্যবহার করবে না। কিন্তু এখন তো দেখছে ওর ধারণা ভুল। রিতু এখনো আগের মতোই আছে। তাহলে মাঝখানে ওকে এত ভেঙ্গে দেওয়ার মানে কি ছিল? রিতু নিশ্চয় বোঝে ইফাদ ওকে কতটা ভালোবাসে, কতটা চায়।

যে ইফাদ নিজে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে শক্ত থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই প্রতিজ্ঞাকে পর্যন্ত তোয়াক্কা করেনি রিতুর জন্য। বাবার শাসন, মায়ের শাসন, বোনের শাসন সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু রিতু কী করছে? অবজ্ঞা-অবহেলা। কেন এরকম ব্যবহার? ও কি এটারই যোগ্য? রিতু শুধু একবার সব স্বাভাবিক করে নিক, ইফাদ তো জীবনভর ওকে আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। মেয়েটা কি এটা বুঝতে পারে না? আচ্ছা, রিতু কি অন্য কাউকে ভালোবাসতো? ওর মনে অন্য কেউ ছিল? ইফাদ কি একবার জিজ্ঞেস করবে রিতুকে নাকি অহেতুক সন্দেহ করছে? দোটানায় পড়ে গেল ইফাদ। এই ভাবনাটা ওকে রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে দিলো না।

পরদিন ঘুম থেকে উঠার পর ইফাদকে পাশে দেখল না রিতু৷ রান্নাঘরে যাওয়ার পর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে জানতে পারল ইফাদ কোনো কাজে বেরিয়েছে। রিতু সারাটা দিন ওর জন্য অপেক্ষা করলো, সন্ধ্যায় পায়েস বানিয়ে রাখলো কিন্তু ইফাদ ফিরলো রাত দশটায়। এসে ফ্রেশ হয়ে, খেয়েদেয়ে ঘুম। রিতু পায়েস ফ্রিজে তুলে রেখেছিল, সেটা দেওয়ার মতো সুযোগও পেল না। মন খারাপ হয়ে গেল ওর। পরের ক’টা দিনও ইফাদ নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত ছিল। কাগজপত্রে কি একটা ঝামেলা হলো তা নিয়ে বেশ খাটাখাটুনি করতে হলো ওকে কয়দিন৷ রিতু সময়ই পেল না ওর সাথে ভালো করে একটু কথা বলার। এদিকে বড়ফুফু, ইশিতা ফোন করলেই রিতুকে শতশত জ্ঞান দেয়। একদিন তো বড়ফুফু সরাসরি কতগুলো আজগুবি কথা বলে লজ্জা দিলেন ওকে। আরেকদিন ফোন
করে বললেন,
— জামাই আসছে বিদেশ থেইকা, সুখবর টুখবর তো এহনো শুনাইলি না রে মা!
— কীসের সুখবর ফুফু?
বড়ফুফু নিচু স্বরে যা বললেন তা শুনে রিতু লজ্জায় লাল হয়ে গেল। পরক্ষণেই অভিমান নিয়ে বলল,
–আমি নিজেও জানি না ফুফু কখন তুমি নানু ডাক শুনবে…
— কেন? জামাই তোর, আর তুই কিছু জানোস না? পোলাডা দেশে আইলো আর তুই একটা ভালা খবর দিতে পারলি না…
রিতু বলল,
— ধুর, তুমি যে কী বলো না!
বড়ফুফু অবাক হলেন যেন,
— তুই ওমন মিনমিন করতাছোস কেন? এতদিন হইসে বিয়ার, আর তুই নতুন বউয়ের মতো নাটক করতাছোস, যেন কিছু হয় নাই তোগো মধ্যে…
রিতু অভিমানী গলায় বলল,
— আমি কিন্তু ফোন রেখে দেব, যাও…
বড়ফুফু এবার বললেন,
— ইশিতা না হয় জামাইয়ের কথায় পড়াশোনা শেষ কইরা বাচ্চা নিব, কিন্তু তুই? তোর জামাই নিশ্চয় এমন রুল দেয় নাই! জামাইরে হাতের মুঠোয় রাখতে শেখ। এহনো কচি খুকি সাইজা থাকলে সব হারাইবি!
রিতু এবার একটু নরম হলো,
— কী হারাবো?
— সব হারাবি। সব থেইকা গুরুত্বপূর্ণ যেইটা হারাবি, সেইটা হইলো জামাইয়ের মন। এই জিনিস হারাইলে কোটি টাকা গচ্চা দিয়াও পাবি না। তার আগেই একটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়া নে। জামাই আটকায় যাইবো! আমরাও নানা-নানি ডাক শুনমু…
রিতু আর্ত গলায় বলল,
— ইশ! থামো তো…
বড়ফুফুর সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেওয়ার পর রিতু অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। ফুফুর চিন্তাধারা মান্ধাতার আমলের। তার সব কথাতেই বাচ্চাকাচ্চার কথাই প্রায়োরিটি পায়। তবুও রিতু কথাগুলো ভেবে দেখল। অংক স্যারের কাছ থেকে সে আর দূরে থাকতে চায় না। ইফাদকে ও এখন মিস করে, ভালোবাসে। কিন্তু বোঝাতে পারছে না। সব ঘেঁটে দিচ্ছে। আর আজকাল তো এই লোকের দেখাসাক্ষাৎ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। ধরাই দিতে চাচ্ছে না ওকে। তবে রিতুর ধারণা ইফাদ ইচ্ছে করে এসব করছে, ঝগড়া না করে নিঃশব্দে নিজের রাগ মেটাচ্ছে ওর উপর। কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া যায় না!
.

ইফাদ সন্ধ্যার দিকেই ফিরল। হাতে অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করে এনেছে। বসার ঘরে সবাইকে ডেকে যার যার উপহার তাকে দিয়ে দিল, রিতুকেও দিল। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে, শ্বাশুড়িকে হাতে হাতে কাজ গুছিয়ে দিয়ে রিতু ঘরে ফিরে দেখল ইফাদ নিজের স্যুটকেস গোছাচ্ছে। রিতু একপাশে মন খারাপ
করে বসে রইল। ইফাদ দু-একবার দেখল ওকে।
একপর্যায়ে রিতু না পেরে জিজ্ঞেস করল,
–স্যুটকেস গোছাচ্ছেন কেন?
ইফাদ ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,
— হাতে প্রচুর কাজ। যাওয়ার আগে তেমন সময় পাব না, তাই গুছিয়ে রাখছি!

রিতু কথা বাড়াল না। ইফাদ গোছগাছ শেষ করে শুয়ে পড়ল। এদিকে রিতু নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করল।
কিন্তু ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দু-চোখের পাতা এক হলো না। কাঁদতে ইচ্ছে করল ভীষণ। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ইফাদকে দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল। এই নিষ্ঠুরটা ওকে কষ্ট দিয়ে নিজে আরাম করে ঘুমাচ্ছে!
যা হবার হবে। এই নিষ্ঠুরকে সে ছাড়বে না। কিছুতেই না। রিতু তড়াক করে ওঠে গিয়ে ইফাদের শিয়রে গিয়ে বসল। এরপর দু-মিনিট চিন্তা করে ওর বাহুডোরে ঢুকে শুয়ে পড়ল। ইফাদ তখনি নড়েচড়ে ওঠল। রিতুর বুক ঢিপঢিপ করছে, হাত-পা কাঁপছে। লজ্জা লাগছে। এদিকে ইফাদ ঘুমের ঘোরে, অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু নারী
অবয়ব টের পেল। আচমকা ঘাবড়ে গিয়ে শুধাল,
— কে? রিতু?
রিতু চুপ করে রইল। ইফাদ নড়েচড়ে উঠে বসতে
নিতেই রিতু মুখ খুলল,
— আমি ছাড়া আর কে থাকে আপনার ঘরে?
ইফাদ বড্ড অবাক হলো যেন,
— তুমি এখানে কী করছো?
— ঘুমাচ্ছি।
— এটা ঘুমানোর জায়গা?
— হুম।
ইফাদ ব্যথা পাচ্ছিল হাতে৷ তাই বলল,
— বালিশে শোও, আমার হাত ভেঙে যাবে
মনে হচ্ছে। সরো…
রিতু ওর মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
— সরবো না। আমি এভাবেই শোব। আপনিও
এভাবেই ধরে থাকবেন।
— মানে কী রিতু? আমি ঘুমাচ্ছি…
রিতু ছোটখাটো ধমক দিল,
— বউকে বোঝেন না আবার কথা বলছেন
আপনি? একদম চুপ!
ইফাদ চুপ থাকল। এই রিতুর কান্ডকীর্তি তো বেশ অদ্ভুত! ওর মজা লাগল। রিতু বলল,
— আপনি কি হাসছেন? আপনার শরীর এভাবে
দুলছে কেন?
— কই দুলছি? আমি তো স্ট্রেইট আছি। হাসছিও না।
এত রাতে কী হলো তোমার? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
— না।
— তাহলে?
— আপনার উপর রাগ হচ্ছে। আমার মাথায় হাত
বুলিয়ে দিন।
— তাহলে রাগ কমে যাবে?
রিতু ভার গলায় বলল,
— না ঘুম আসবে।
— আমার উপর সবসময় রেগেই থাকো তুমি?
— আপনি তো রাগার মতোই কাজ করেন।
— কী করলাম?
— মিথ্যে বলেন এবং তা লিমিটের বাইরে।
ইফাদের কপালে ভাঁজ পড়ল,
— মানে? কী মিথ্যে বললাম?
রিতু এবার তারস্বরে চেঁচালো,
— প্রজেক্টের কাজে আপনি দেশে এসেছেন তাইনা?
তো প্রজেক্টের কাজ ছিলো সারাদিন আমার খেয়াল রাখা? কখন খেলাম, ক’ঘন্টা ঘুমালাম, কখন উঠলাম, কী কী করলাম এসব নোট করা আপনার প্রজেক্টের কাজ? কেন এত মিথ্যা বলেন আমাকে? বললে কি হয় যে ‘রিতু আমি তোমার জন্য এসেছি?’
ইফাদ প্রথমে একটু ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই রিতুর মুখ চেপে ধরল। এত জোরে কথা বলছে! এই মেয়ে পাগল নাকি! এরপর ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,
— কারণ আগ বাড়িয়ে আমি সস্তা হতে চাইনি।
তোমার ইগো রোগ আমাকেও ধরেছিল। আচ্ছা,
তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল রিতু? যারজন্য আমার সাথে এমন কর?
রিতু আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। এরপর মাথা
নেড়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
— না।
— কখনো না?
— বললাম তো না, ছিল না। কখনোই না।
বলে রিতু গাঢ় একটা চুমু খেল ইফাদের ঠোঁটে।
এরপর কুঁকড়ে গেল ওর বুকের ভেতর। হতভম্ব
ইফাদ বলল,
— বিলিভ মি, তোমার আচরণ অদ্ভুত!
রিতু বলল,
— মোটেও না।
ইফাদ শুনলো৷ এরপর ফুঁস করে দীর্ঘশ্বাস
ছাড়লো। ক্লান্ত চোখে, ক্লান্ত গলায় বলল,
— ভালোবাসা শুধু নেওয়ার জিনিস না,
দেওয়ারও জিনিস।
রিতু সেভাবে থেকেই উত্তর দিল,
— কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ঘুমাতে চাই! প্লিজ…
— তিনদিন পরে আমার ফ্লাইট…
রিতু ঘুমঘুম স্বরে বলল,
— ক্যান্সেল করে দিন!

______________

চলবে…