#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ 💜
#মিমি_মুসকান
#সূচনা_পর্ব
কবুল বলার পরপরই বিয়ের আসর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো প্রান্তিক চৌধুরী। ফোনের ব্যস্ততা দেখিয়ে হনহন করে বিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে। বিয়ের আয়োজন ছোটখাটোই ছিলো কেবল ঘরের মানুষ। তবুও এই ঘরের মানুষে ঘরভর্তি লোক! তাদের সামনে থেকে হন্য হয়ে নতুন বর উঠে চলে গেল। কেউ আটকালো না তাকে! দাদাসাহেব একবার ডাকলেও প্রান্তিক যেন শুনতে পেলো না। এদিকে বর চলে যাবার পর থেকেই মৃদু গুঞ্জন শুনতে পাওয়া গেলো। এ কেমন বর! বউ না নিয়ে একাই চলে গেলো। বাইরে গাড়ির তীব্র শব্দে আরো নিশ্চিত হওয়া গেলো। পূরবী ছুটে ড্রয়িং রুম ছেড়ে আপার ঘরে গেল। হাঁ’পাতে হাঁ’পাতে বললো, “আপা! আপা! তোমার বর তো চলে গেলো! তোমারে নিবো না?” ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো মেয়েটার। বধূবেশে কি স্নিগ্ধই না দেখাচ্ছে তাকে! তবুও আঁত’কে উঠল সে। বুকের কাছে লাল টুকটুকে উড়না খা’মচে ধরল সে। কি আশ্চর্য! বর তাকে রেখে কেন চলে যাবে?
বিয়ে হলো সবে মাত্র এখনো বরের মুখখানি দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি মেয়েটির। দুপুরেই হঠাৎ বাবা বললেন আজ তার বিয়ে। প্রিয়তা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। হঠাৎ তার বিয়ে! কিভাবে? এক্সিডে‘ন্টের পর আজ কয়েক বছর হয়ে গেলো তার বাবা হাঁটতে পারে না। সংসার চলছে বেশ ক’ষ্টে। একে তো তারা চার বোন। প্রিয়তা সবার বড়! ভার যেন একটু বেশি তার উপরই। বড় তিন বোনের টিউশনির টাকায় সংসার চলে কোনোরকম! এদিকে বাবা সিদ্দিকুর রহমান আগে যেখানে কাজ করতেন সেখান থেকেও কিছু সম্মানি পেতেন। এই দিয়ে ঠেলেঠুলে সংসার চলে। এর মধ্যে এখন বিয়ের প্রস্তাব! এমন অসময়ে বিয়ের প্রস্তাব প্রিয়তার মন পি’সিয়ে দিল। বাবার এমন আবদার সে নাও করতে পারিনি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে বিয়ের সাজপোশাক হাজির। শাড়ি দেখেই তারা চার বোন তাজ্জব বনে গেল। মা মনসূরা বেগম আদুরে হাতে লাল টুকটুকে শাড়ি জড়িয়ে ধরলেন মেয়ের গায়ে। সেই শাড়ি এখনো তার গায়ে জড়ানো। বরের খোঁজ পেয়েছে। তাঁর বাবা যেই অফিস চাকরি করতেন তার মালিকের একমাত্র নাতি! বড়লোকের নাতি! এ থেকেই আন্দাজ করা যায় ছেলে কেমন বি’গড়ে স্বভাবের। বরলোকের ছেলে নিয়ে প্রিয়তা বেশ সন্দিহানই থাকে। মেজো বোন আমরিশা বলে উঠলো, “আপু! তোমার বর পালা‘লো নাকি?”
প্রিয়তা চোখ গরম করে তাকাল। সেজো বোন আরফিয়া ফিক করে হেসে উঠল। এদের কাছে ব্যাপারটা নিছক মজার মতোই লাগছে। প্রিয়তা বিরবির করল, “পালা‘নোর হলে তার কবুল বলার আগেই পালি‘য়ে যেত। এখন কেন পালা লো?” কি মনে করে পূরবীকে জিজ্ঞেস করল, “বিয়ে হয়েছে?”
পূরবী দাঁত বের করে বলল, “হ্যাঁ তো! তোমার বর কবুল বলার পরই পালিয়ে‘ছে!” তিন বোনের হাসির রোল পড়ে গেলো। এদের সবকিছুতেই মজা। বড় বোনের বর পালিয়ে‘ছে এতে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্য’থা নেই। মনসূরা বেগম এবার ধম’কে উঠলেন। পেছন ফিরে তারা দেখল দরজায় সামনে মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনজন চুপ’সে গেল। প্রিয়তার র’ক্তশূন্য মুখ দেখে মা ধম’কের সুরে বললেন,“সব কিছুতে তোদের বাড়া’বাড়ি! বর গেছে জরুরি কাজে। তার কোন বন্ধু নাকি এক্সি’ডেন্ট করেছে সেজন্য তড়িঘড়ি করে বের হলো। আর তোরা কি বলছিস এসব? মেয়েটার মন ন’ষ্ট করে দিচ্ছিস!”
তিন বোন আবারো মুখ টিপে হাসল। মনসূরা বেগম জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। প্রিয়তা তাকে আঁকড়ে ধরল। তার মনে এখন দমকা হাওয়া বইছে। কেবল বন্ধু না বিশেষ বন্ধু। আজকাল তো এসবই হচ্ছে। মনের বিড়’ম্বনাকে সে আটকাতে পারল না।
_________
প্রান্তিক চৌধুরী গাড়ি ছেড়ে নামতেই তার পিছন পিছন রাফি এসে দাঁড়াল। চোখের কালো সানগ্লাস নামিয়ে রেখে ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাফিকে বলল, “বিয়ের পর সকলে যায় বাসর ঘরে আর আমি এসেছি হাসপাতালে। এর কোনো মানে হয় রাফি?”
রাফি মাথা দুলিয়ে বলল, “বিয়ের আগেও আপনি হাসপাতালে ছিলেন স্যার।” প্রান্তিক চৌধুরী বিরক্তি প্রকাশ করল। কিন্তু রাফি ভুল কিছু বলেনি। বিয়ের আগেও সে হাসপাতালে ছিলো। দাদাজানের হঠাৎ হা’র্ট অ্যাটা’কের খবর শুনেই ছুটে গেছিলো। কিন্তু কে জানত এ সব কিছুই দাদাজানের ফাঁ’দ তাকে বিয়ে করানোর। ওই অবস্থায় বিয়ের সম্মতি দিতেই আগামী দু ঘন্টার মধ্যে প্রান্তিক চৌধুরীর বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। তার দাদাজান আসলেই একটা চি’জ বটে। তবুও এতো দিন ব্যাচেলর থাকার পরে এখন নিজেকে ম্যারিড মনে হচ্ছে না প্রান্তিকের। কেন? মাথায় এলো। এখনো তো বউকে চু’মু খেতে পারেনি। তাহলে সে ম্যারিড হয় কি করে? মাথায় দু’ষ্টু বুদ্ধি সবসময় খেলা করে। রাফির জন্য আর আগাতে পারল না। স্বপ্ন থেকে তাকে টেনে হিচ’ড়ে বের করে এনে বলল, “স্যার যাবেন না?”
ইচ্ছে করছে রাফিকে ধমক দিতে। দিলো না! থাক! সানগ্লাস আবারো চোখে পড়ে এগিলো গেল সে। হাসপাতাল সবসময় একটা ব্যস্ত জায়গা। এখানে কেউ দু দণ্ড বসে থাকতে পারে না। তবু একটা নার্সকে দেখতে পেয়ে সানগ্লাস নামিয়ে স্মিত স্বরে বলল, “মিস!”
শত ব্যস্ততার মাঝেও সে নার্স দাঁড়িয়ে গেল। চ’মকে তাকালো প্রান্তিকের দিকে। প্রান্তিক চৌধুরী ঠোঁট বাড়িয়ে হাসল। জিজ্ঞেস করল,“আরিনা শেখের রুম নম্বর কত বলতে পারেন?”
নার্স আমতা আমতা করতে লাগল। শুধালো,“কোন আরিনা শেখ?”
পেছন থেকে রাফি বলল, “স্যার সেটা রিসেপশনে গিয়ে জিজেস করতে হবে!”
প্রান্তিক চৌধুরী মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ তাই তো! স’রি মিস! আপনাকে দেখে সেই কথাই ভুলে গেছিলাম!” বলেই চোখে সানগ্লাস পরল। নার্স চোখ ঘুরিয়ে প্রান্তিককে দেখছে। কি মেয়ে’বাজ ছেলে! তবে ছেলেটা হ্যান্ডসাম! প্রান্তিক চৌধুরী হাঁটা ধরল আবার। রাফি বিরবির স্বরে বলল,“স্যার আপনি এখন ম্যারিড। নিজেকে সংযত করুন!”
প্রান্তিকের কানে সেই কথা পৌঁছাল না। তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বিয়ের দিনও সে এসেছে তার প্রাক্তন কে দেখতে। এসব কথা মানা যায় আদৌও?
কেবিনে নক করে সোজা ঢুকে পরল প্রান্তিক চৌধুরী। বিছানায় সাদা চাদরে শুয়ে আছে তার প্রাক্তন আরিনা শেখ! না ম’রে নি। বেঁচেই আছে। দেখতে সুন্দরী! হবেই না কেন? প্রান্তিক চৌধুরীর পছন্দ কখনো খারাপ হয়নি। আরিনার পাশেই তার প্রাণের বান্ধবী অপু দাঁড়ানো। প্রান্তিককে আসতে দেখেই চেঁ’চিয়ে উঠল সে। আরিনাও চোখ মেলে তাকাল। তাকাতে একটু কষ্টই যেন হচ্ছে। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রুর দেখা মিলছে। প্রান্তিক কে দেখেই মুখ সরিয়ে নিলো সে। অপু দ্বিতীয় ধাপে চেঁ’চিয়ে বলল, “কেন এসেছো এখানে?”
দুনিয়ার সকল মেয়ে প্রান্তিকের পছন্দ হলেও এই অপুকে তার অপছন্দ। পুরোপুরি তাকে এড়িয়ে চলতে চায়। পারল না। অপু আবারো শুধালো, “নাচতে নাচতে তো বিয়ে করতে চলে গেলে, আমার বান্ধবীর কথা তখন ভেবেছিলে একবারও? এখন এসেছো কি করতে।”
“চেক করতে আদৌও ম‘রে গেলো কিনা?”
“কি বললে তুমি!”
ফের চে’চালো। আরিনা বেশিক্ষণ মুখ সরিয়ে রাখতে পারল না। প্রান্তিক তার পাশ এসে দাঁড়াতেই ছু’য়ে দেখার চেষ্টা করল। প্রান্তিক ছিক’টে দূরে সরে গিয়ে বলল, “ডোন্ট টাচ্ মি! আই এম ম্যারিড নাও!”
“তুমি বিয়ে করে ফেলেছো প্রান্তিক!”
হতভম্ব স্বরে শুধালো আরিনা। অপু অবাক গলায় বলল, “তুমি বিয়ে সেরে এখানে এসেছো প্রান্তিক?”
প্রান্তিক চৌধুরী সোজাসুজি উত্তর দিল, “তো কি? শুভ কাজে কেউ দেরি করে নাকি?”
আরিনা সহসা মুখ ঘুরিয়ে নিল। দৃঢ় গলায় শুধাল, “তাহলে এখন এখানে কেন এসেছেন?”
প্রান্তিক চৌধুরী চেয়ার টেনে বসে পড়ল। বলল,“পরিচিত কেউ ম‘রে গেলে জা’নাযা দিতে আসতে হয়। এদিকে তুমি তো আমার বহুদিনের প্রাক্তন!”
অপু রেগে বলে উঠলো, “সব কিছুতে তোমার মজা করতে হয় প্রান্তিক। কেমন মানুষ তুমি? মেয়েটার অবস্থা দেখেছো? ডাক্তার কি বলেছে জানো?”
“না জানি না। জানতেও চাই না। আমাদের পথ আরো আগেই আলাদা হয়ে গেছে। এর পরেও তোমার এমন কাজ বাচ্চামো ছাড়া কিছু না। বিয়ের পর বাস’র ছেড়ে আমি তোমার কারণে হাসপাতালে এসে ঘুরছি!”
এমন সময় ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল রাফি। আরিনা চম’কে উঠে বললো, “তুমি এবার বাসরেও যাবে।”
“বিয়ের পর তো সবাই যায়,তাই না?”
অপু বলে উঠলো, “তোমার জন্য বাস’র আবার নতুন নাকি? এতো ঢাক ঠোল পি’টিয়ে বলছো যে!”
প্রান্তিক চৌধুরী ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলে উঠলো, “বিয়ের পরের বা’সর স্পে’শাল হয়। ওসব তুমি বুঝবে না!”
অপু বিরক্তে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আরিনা অভিমানী স্বরে বলল,“যাও! তোমার বউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে!”
প্রান্তিক উঠে দাঁড়িয়ে সহসা বলে উঠলো, “হ্যাঁ চলেই যাচ্ছি! তবে শোন এসব আর করো না। এসব করে তুমি ম্যারিড প্রান্তিক চৌধুরীকে আর পাবে না। গট ইট সুইট হার্ট!”
স্যারের কথাবার্তা শুনে রাফির মাথা ঘুরাচ্ছে। অপু ঘৃ‘ণ্য দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে তাকাল। প্রান্তিক চৌধুরী এতে বিন্দুমাত্র ভ্রু’ক্ষেপ না করে উল্টো চোখের সানগ্লাস নামিয়ে তাকে চোখ টি’প দিলো। রা’গে অপুর শরীর জ্ব’লে উঠলো। এদিকে প্রান্তিক বের হতেই রা’গে, যন্ত্রণা’য় আরিনা চেঁ’চিয়ে উঠল। ভাঙ’চুর করতে লাগলো সমস্ত কিছু। প্রান্তিক চৌধুরী পিছনে ফিরে তাকাল না। একবার ফেলা আসা জিনিস আর কখনোই ফিরে দেখে না সে। তার পিছন পিছন রাফি হেঁটে চলছে। আকস্মিক ইজান শিকদার সামনে এসেই ঘু’ষি মারল তাকে।সানগ্লাস মেঝেতে পড়ে গেলো। ঠোঁটের কাছে কে’টেছে কিছুটা। রাফি ছু’টে আসল থামানোর জন্য। প্রান্তিক চৌধুরী ইশারা করলো। ইজান শিকদার তার গলার কলা’র চে’পে ধরল। অশ্রা’ব্য ভাষায় গা’লি গালা’জ করতে লাগলো। এর মধ্যেই হাসপাতালে ভীড় জমে গেছে। ইজান শিকদার আবারো তাকে ঘু‘সি মারতে এগিয়ে এলে রাফি রুখে দাঁড়াল। প্রান্তিক চৌধুরী জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট চেখে দেখল। জ্বলছে খুব। ইজান রাফিকে সরিয়ে আবারো তে‘ড়ে আসল প্রান্তিকের কাছে। তবে প্রান্তিক এবার ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। উল্টো তার ক‘লার চে‘পে ধরল। শাসি‘য়ে দিল, “কার গায়ে হাত তুলছো জানো তো?”
ইজান শিকদার তাকে ধাক্কা মে‘রে পিছু হটে বলল, “না জানার কি আছে? চরিত্র‘হীন একটা ল‘ম্পট তুই। যার কস্মিনকালেও একটা দিয়ে ম‘ন ভরে না। নিত্য নতুন চাই!”
প্রান্তিক চৌধুরী আড়চোখে আশপাশ দেখল। সবাই তাকে দেখছে। হেসে উঠলো সে। বলে উঠলো, “তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার জন্য সুই‘সাইড করেছে এতে আমার কি দোষ! তুমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে সামলাও!”
ইজান শিকদারের চোখে মুখে যেন আগু‘ন জ্বল‘ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “তোকে আমি পুলিশে দেবো। সাবধান করছি তোকে। তোর জন্য আরিনার কিছু হলে আমি তোকে বাঁচ‘তে দিবো না!”
প্রান্তিক চৌধুরী তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে উঠলো। এগিয়ে এসে তার কানের কাছে বিরবির করে বলতে লাগল, “আই নো তোর জ্ব‘লছে কোথায়? আরিনা তোকে না ভালোবেসে আমায় ভালোবাসে। এইতো! দেখ ব্রো আমি ছেলেটাই এমন সবাই আমাকে চায়। আমি কি করতে পারি!”
ইজান শিকদার রাগে কাঁপছে। “ইউ ব্লাডি” বলে আবারো তার উপর হাম‘লে পড়লো। কিন্তু পারল না। হাসপাতালের গার্ড এসে তাকে থামালো। পরিস্থিতি শান্ত করার সবোর্চ্চ চেষ্টা তারা করছে।
_____
প্রিয়তা তাঁর শ্বশুর বাড়ি এসেছে। অথচ তাঁর শ্বশুর বাড়িতে শ্বশুর শাশুড়ি কেউ নেই। থাকার মধ্যে তাঁর স্বামী নামক অপদার্থ আর দাদাজান। এই দুজন মানুষের জন্য এতো বড় বাড়ি। শ্বশুর বাড়ি অন্যরা আসে স্বামীর সাথে। সে এসেছে দাদাজানের সাথে। সবই উল্টো পাল্টা হয়ে গেল। বাড়িতে কাজের লোকের কমতি নেই। একের পর একজন আসছে তাঁর সাথে দেখা করতে। হুলস্থুল কাণ্ড। কেউই জানত না বিয়ের কথা। তড়িখড়ি করে তাদের ঘরটাও ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিল। প্রিয়তা এখন তার ঘরে। বিয়ের পর কেবল বরের ঘরটাই কব্জা করতে পারল। এরা সবাই তাদের কাজে বেশ দক্ষ। তার বরের কি পছন্দ অপছন্দ খুঁতখুঁতিয়ে জানে। প্রিয়তা বেশ অবাক হয়ে দেখছে। স্যার কে তারা খুব ভয় পায়। বিয়ে হয়েছে বিকেল বেলা এখন রাত ১২ টা । এখনো তার বর মশাইয়ের দেখা নেই। লাঠির ঠক ঠক শব্দ। দাদাজান আসছে। তার হাতে একটা লাঠি থাকে। তিনি সবসময় লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁটেন। তিনি ঘরে আসতেই প্রিয়তা উঠে দাঁড়ালো। দাদাজানের পড়নে সাদা রঙের পাঞ্জাবি, গায়ের উপর চাদর জড়ানো। চোখে চিকন ফ্রেমের সোনালী রঙের চশমা। গোলগাল মুখ, সাদা দাড়িগুলো বুঝি মেহেদী দিয়ে রাখেন। বড্ড মিষ্টি গলায় প্রিয়তা কে তিনি মা বলে ডাকলেন। মেয়েটিকে প্রথম বার দেখেই তার বেশ পছন্দ হয়েছে। তাদের সংসারে এমন মেয়ে এখন খুব দরকার। বিশেষ করে তার অবাধ্য নাতি আর চৌধুরী বাড়ি দুটোকে গোছানোর জন্য মনের মতো নাতবউ তিনি পেয়েছেন। প্রিয়তা নরম গলায় শুধাল, “আপনি এখনো ঘুমান নি দাদাজান!”
“আমার গাধা যে এখনো বাড়ি ফিরল না মা। কি করব বলো?”
“আপনি ঘুমান। তাকে দেখার মতো এই বাড়িতে অনেক লোক আছে।
দাদাজান হেসে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন তো তুমি এসেছো। আমার আর চিন্তা কি! আমার গাধা কে মানুষ করে তুলো বুঝলে। এ বড্ড অপদার্থ। কারো কথা শুনবে না।যা মন চায় তাই করবে।”
“জি আমি বুঝেছি। আপনি ঘরে চলুন। ঘুমাবেন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার কথা আমি অমান্য করব না।” অতঃপর তার মাথায় হাত রেখে বললেন, “আমার বাড়িতে সব আছে শুধু আগলে রাখার মানুষ নেই বুঝলে তো মা এসব এখন তোমার দায়িত্ব। সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে নিজের মতো। পারবে তো!” প্রিয়তা মুচকি হেসে মাথা নাড়ল।
প্রান্তিক চৌধুরী এখনো বাড়িতে ফিরে নি। ক্লাবে বসে ড্রিংক করছে। তার মন মেজাজ দুটোই খারাপ। অতৃপ্ত বেদনা তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অন্য দিন তার আশেপাশে কতো শত রমনী ঘুরাঘুরি করে কিন্তু আজ সে সবাইকে বলে দিয়েছে কেউ যেন তার কাছে না ঘেসে। এখন থেকে সে ম্যারিড! প্রান্তিক চৌধুরী ম্যারিড! কথাটা বলেই হেসে উঠলো। হাসিতে কষ্ট লুকিয়ে ছিলো। রাফি খুব কষ্টে তাকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসাল। পেছনের সিটে প্রান্তিক চৌধুরী হেলান দিয়ে বসে বিলাপ করছে। “বুঝলে তো রাফি, যে আমায় বিয়ে করতে চাইলো তার সাথে বিয়ে হলো না। আমি যাকে চাইলাম তাকেও পেলাম না। এদিকে দাদাজান আরেক জনের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিল! কি মজা তাই না!” রাফি শুকনো মুখে বসে রইলো। প্রান্তিক স্যার হেলছে দুলছে । আজ অনেকগুলো বছর সে প্রান্তিক স্যারের সাথে আছে। স্যারের সাথে ঘটা প্রতিটা ঘটনার সাক্ষী সে। স্যারের কষ্ট কোথায় সে বুঝতে পারছে।
দরজার আড়াল থেকে প্রিয়তা দেখছে। তার বর মাতা‘ল হয়ে চিৎকার চেঁচা‘মেচি করছে। সবাই তাকে সামলাতে ব্যস্ত। নতুন বউয়ের কাছে এই ব্যাপারটা কি বিভীষিকা‘ময় সেটা কেউ টের পেলো না। প্রান্তিক চৌধুরী ক্ষে‘পেছে তার ঘর সাজানো দেখে। এখুনি এসব কিছু ফেলে দিতে বলছে। দরজার সামনে ঠাঁই দাড়িয়ে প্রিয়তা সব শুনল। তার বুক দুমড়ে মুচড়ে গেল। এ কোথায় এসে পড়ল সে। সবাই তড়িখড়ি করে সব খুলে ফেলছে। এরই মধ্যে একটা মেয়ে বলল, ম্যাম আপনার জন্য পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রাখছি। আপনি এদিকে আসুন!” প্রান্তিক এবার চেঁচিয়ে উঠলো। বলল, আমার ঘরে কেউ আসবে না। কোনো বউ আসবে না আমার ঘরে।” রাফি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বাইরে নতুন বউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গেল। প্রিয়তা সামনে ফিরে তাকাল। তার বরের সাথে এই প্রথম তার চোখাচোখি হলো। প্রথমবারের মত নিজ পুরুষ কে নিজের সামনে দেখে বিস্মিত হলো সে। কিন্তু পরক্ষনেই একরাশ বেদনা তাকে আকড়ে ধরল। দমকা হাওয়া মাথার ঘোমটা পড়ে গেল। সুশ্রী মুখখানি শীতল হয়ে উঠল। তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল। হইচই থেমে গেল। সকলে নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ হয়ে রইল। নিরবতায় ছেয়ে গেল চৌধুরী বাড়ি!
— চলবে…