প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব-১০+১১

0
1

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১০

প্রান্তিক চৌধুরী হার মানে নি। সে এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির দক্ষিণ দিকটায়। উপরে তাকালেই তাঁর বউয়ের ঘরের বেলকনি। বিয়ের পরেও বুঝি বর বউয়ের রুম আলাদা হয়। প্রান্তিকের জানা নেই। সে আনমনে গিটার বাজানো শুরু করল। তার দৃঢ় বিশ্বাস, গিটারের শব্দ শুনে তাঁর বউ ছুটে আসবে। ছুটে আসলো আসলেই। নিচে উঁকি দিয়ে প্রিয় পুরুষ কে দেখতে পেয়ে তাঁর চক্ষু ছানাবড়া। তাঁর বর তাঁর জন্য এখানে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। কি অদ্ভুত ভালো লাগা। ভেবে পায় না, এই মানুষটির উপর রাগ করে কিভাবে থাকবে সে।

প্রান্তিক সুর তুলে গান গাইছে। প্রিয়তা মুগ্ধ হয়ে গালে হাত রেখে গান শুনে যাচ্ছে। গানে কেবলই ভালোবাসার কথা। উপচে পড়ছে সমস্ত আবেগ! বর মশাইয়ের গানের গলা তো ভালো।

গান শেষে প্রান্তিক গিটার রাখলো মাটিতে ঠেসিয়ে। মুচকি হেসে বলল, রাগ কমেছে বউ!

প্রিয়তা মুখ ভেংচি কাটল। প্রান্তিক বলে উঠলো,
– নাও! দরজা খুলো এবার!
– না!
– না মানে? এতোক্ষণ ধরে গান গাইলাম তোমার জন্যে। তুমি দরজাটা খুলতে পারবে না ।
– না পারব না।
– না পারলে ফ্রি ফ্রি গান শুনতে কেন এলে?
– আপনি কেন গাইলেন? বলেছি গাইতে?
– কি আশ্চর্য! দয়ামায়া নেই তোমার?
– না নেই।
– দরজা না খুললে এখানে দাঁড়িয়ে থাকব কিন্তু!
– থাকুন দাঁড়িয়ে!

বলেই প্রিয়তা ঘরে ঢুকে গেল। তাঁর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। মূলত প্রান্তিক কে ভড়কে দেবার জন্যেই সে আলো নিভিয়ে ঘুমের ভান ধরল। কে জানত সত্যি সত্যি চোখ লেগে যাবে।

তখন মধ্যরাত! প্রিয়তা সেই কখন থেকে অনুভব করছে, একজোড়া বাহু তাকে নিজের দিকে টানছে। সে যতই চাইছে দূরে যেতে ততোই যেন নিজের কাছে ডাকছে। প্রিয়তার হুঁশ ফিরল! ঘুম ভাঙলো। এখানে কেউ আছে। সে চেঁচালো না। পারফিউমের তীব্র ঘ্রাণ নাকে আসছে। এই গন্ধ তার চেনা। অনুভব করেই বলে দিতে পারে প্রান্তিক তার রুমে। কিন্তু আসলো কি করে? দরজা তো বন্ধ!

চোখ গেল বেলকনির দিকে। ভুল করে দরজাটা খোলাই রেখে এসেছিল সে। প্রান্তিক এদিক দিয়েই এসেছে। দরজা এখনো খোলা। বাইরের চাঁদের আলো এসে জুড়েছে ঘরের মেঝেতে। চারদিক অন্ধকার। বরের মুখ দেখার জো নেই। কিন্তু সে অনুভব করতে পারছে বরের মুখ তাক গলার কাছে ডুবানো আছে। তার শীতল দেহের স্পর্শে প্রিয়তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। প্রান্তিকের ভীষণ বাজে স্বভাব উদাম গায়ে ঘুমানো। প্রিয়তা টের পাচ্ছে। প্রান্তিক তাকে ডাকছে তার বুকের দিকে। সেও লেপ্টে রইলো বুকের মধ্যে। অভিমান করল না, অভিযোগ করল না। অভিমান তো কবেই পড়ে গেছিল। তবুও দেখতে চেয়েছিল তার বর তাঁর জন্য কতোটুকু করতে পারে। প্রান্তিক বিভোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই তার গলার কাছে চুমু খেলে বসল। তার এমন কাজে প্রিয়তা আহম্মক বনে গেল!

———

আমরিশা আবারো এসেছে মান্নাতের শো রুমে। কিন্তু আজ মান্নাত নেই। কিভাবে স্টাফদের হাতে টাকা দিবে সেটাও বুঝে উঠতে পারল না। এসেই শো রুমে ঘুরাঘুরি করছে। আশায় আছে কখন মান্নাত চলে আসে। কিন্তু আসছে না তো। আধঘন্টা হয়ে গেল। এবার যে তাকে বেরুতে হয়। টিউশনি আছে তো। মান্নাতের আশা আজ প্রায় ছেড়েই দিল সে। হঠাৎ দেখতে পেল সেই পুরুষালি কণ্ঠ,

– পছন্দ হয়েছে এটা?

আমরিশা প্রায় চমকে উঠল। কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। খেয়াল করল তার হাত একটা ড্রেসের উপর। এই না আবার ড্রেসটা প্যাক করে দিয়ে দেয়। এর দাম দেখেও তার মাথা ঘুরাচ্ছে। এতো টাকা তার কাছে নেই। আজকের ৮ হাজার অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছে। আফরিনের থেকেও ধার করেছে কিছুটা।

– না না! আমি আপনাকে খুঁজছিলাম।
মান্নাত মৃদু হেসে বলল,
– আমাকে? হঠাৎ!
– হ্যাঁ, একটু দরকার ছিলো।
– বেশি দরকার পড়লে ও সমস্যা নেই।

আমরিশা কপাল কুঁচকে নিল। মান্নাত হেসে তার দিকে এগিয়ে আসছে। আমরিশা আশপাশ তাকাচ্ছে। কাউকেই দেখতে পারছে না। মান্নাত তো থামছেই না। হাঁসফাঁস করতে লাগলো এবার। মান্নাত থেমেছে। একটু ঝুঁকে গিয়ে বলল,
– এতো অপেক্ষা করার কি দরকার ছিলো? নাম্বার তো আমি দিয়েছিলাম। ফোন করে আসলেই তো পারতে!

চমকে উঠল আমরিশা। তাঁর কম্পিত কণ্ঠস্বর। চেপে ধরল ব্যাগটা। ড্রেসের ভেতরেই একটা চিরকুটে নাম্বার লেখা ছিলো। কিন্তু আমরিশা সাহস করে নি। তাই এখনো চিরকুটটি তার ব্যাগের কোণায় পড়ে আছে। বুঝতে পারছে না ফেলে কেন দিলো না সেটা।

মান্নাত অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে আরমিশার হাত চেপে ধরল। আমরিশা হতভম্ব! মান্নাত বলে উঠলো,
– উপরের তলায় আমাদের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে চলো!

জবাবের অপেক্ষায় থাকলো না সে। তাকে একপ্রকার টেনেই নিয়ে যাচ্ছে সে।আরমিশা বোকার মতো তার সাথে চলেও গেলো। শেষে মনে হল, এসব কি করছে সে?

ততোক্ষণে তাঁরা রেস্টুরেন্টের ভেতর চলে এসেছে। আমরিশা অবাক না হয়ে পারল না। এতো সুন্দর রেস্টুরেন্টে খুব কমই আসা হয় তার। মান্নাত তার হাত ছেড়ে এগিয়ে গেল।বলতে শুরু করল,
– আগামীকাল রেস্টুরেন্টের ওপেনিং। দেখে বলো তো ডেকোরেশন কেমন হয়েছে।
কেমন সহজ গলায় বলল। যেন সে আর আমরিশা কতোদিনের চেনা। অথচ তাদের পরিচয়ের আজ দ্বিতীয় দিন।

আমরিশা বিস্ময় স্বরে বলল, – ভীষণ সুন্দর!
মান্নাতের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসি। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে ইশারা করল সে। আমরিশা বসে পড়ল। মান্নাত চেয়ার টেনে তার পাশে বসে বলল, – আমাদের প্রথম কাস্টমার তুমি? বলো কি খাবে? খেয়ে দেয়ে রেটিং দিবা কিন্তু!

– না, আমি কিছু খাবো না।
কিসের কি? মান্নাত নিজেই জোর করে খাবার অর্ডার করল। প্রথমেই তাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস সার্ভ করা হলো। আমরিশা খেয়াল করল, এই লোকটাকে আজ আর তার বিরক্ত লাগছে না। সে দেখতে সুদর্শন! আজ যেন একটু বেশিই সুন্দর। কারন তার এলোমেলো চুল।মনে হচ্ছে কোথা থেকে ছোটাছুটি করে এসেছে। আমরিশার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, তিনি কিভাবে জানলেন আমরিশা এখানে? কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস কুলাল না। সে বেশ বুঝতে পারছে মান্নাত তার উপর লাইন মারছে।

– বলো? কি কাজে এসেছো?
আমরিশা ব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করে এগিয়ে দিল। মান্নাত সামান্য বিরক্ত!
– কিসের টাকা?
– ওই ড্রেসটার। আপনি প্লিজ দামটা রাখুন।

মান্নাত তার উরুতে একহাতে ভর দিয়ে আমরিশার দিকে এগিয়ে গেল। মিনমিন স্বরে বলল,
– কি? টাকা কি বেশি হয়ে গেছে তোমার?
– মানে?
– আমায় টাকা দেখাচ্ছো?
– না তো। আপনি ভুল বুঝছেন?

আমরিশা ভয় পাচ্ছে। কারন মান্নাতের কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। মনে হচ্ছে তিনি রেগে যাচ্ছেন।
– টাকা গুলো চুপচাপ ব্যাগে রাখো। তোমার কি মনে হয় আমি টাকার জন্য তোমাকে গিফট করেছি।
আমরিশা চাঁপা স্বরে বলে উঠলো,
– কিন্তু আপনিই বা এতো দামি ড্রেস আমায় কেন গিফট করবেন?
– সেটা আমার ব্যাপার। ওয়েটার আসছে টাকা ব্যাগে রাখো।

আমরিশা মুখ ফুটে বলতে যাচ্ছিল, না আপনি নিন। কিন্তু মান্নাত যেভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে আছে আর সাহস করল না। টাকা গুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। বুকের মধ্যে পিনপিনে ব্যাথা হচ্ছে। সে কি কেঁদে ফেলবে নাকি? কিন্তু কেন? এই ছোট কারণে কাঁদার মতো কি হলো? সে তো ছিচকাদুনি নয়। ওটা তো আফরিনের স্বভাব।

তারা খাবার দিয়ে গেল। মান্নাত দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো,
– আমি লাঞ্চ রেখে তোমার জন্য ছুটে এসেছি। প্লিজ খাওয়া শুরু করো।
আমরিশা মুখ ভেংচি কাটলো। চামচ হাতে নিয়ে ভাবতে লাগল, সে কেন লাঞ্চ ছেড়ে এসেছে। সে কি একবারও বলেছে আসতে? লাঞ্চ সেরেই আসতো। এত ঠেকা কেন পড়ল তাঁর। অদ্ভুত ভাবে খেয়াল করল, মান্নাতের সব কথা সে মানতে শুরু করেছে। কি আশ্চর্য!

– কিসে পড় তুমি? দেখে তো মনে হয় ভার্সিটিতে! কি ফাইনাল ইয়ারে নাকি?
আমরিশা কাশতে কাশতে বলল, – না না, ফার্স্ট ইযারে।দু মাস বাদে ফাইনাল এক্সাম দিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠব!
মান্নাত পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
– এমা! তুমি তো পিচ্চি! ভালোই হলো, কথা না শুনলে দু গালে দুটো অনায়সে দেওয়া যাবে।
আমরিশা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইল। মান্নাতের কথা শুনে তাঁর কাশিও থেমে গেছে। থমথমে কণ্ঠে বলল,

– আপনি কিসে পড়েন?
– আমি? আমার যখন পড়াশোনা শেষ হয়েছে তখন তো মনে হয় তুমি মাধ্যমিক ও দিতে পারোনি!
আমরিশা খাবার ভুলে হা করে মান্নাতের দিকে চেয়ে রইল। লোকটা কি বলল? লোকটা তার এতো বড় নাকি! তার মাথা ভনভন করছে। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে। তার আগেই ধারণা করা উচিত ছিলো, ভাইয়ার ফ্রেন্ড তিনি। বয়স তো বেশিই হবেই। কিন্তু আমরিশার চিন্তা ভাবনা তখনো এসব ছুঁতে পারেনি!

———–

প্রিয়তার এক বান্ধবীর বার্থডে। তাকে যেতেই হবে এমন ভাবে বলে দিয়েছে সে। শুধু তাকে না, বর সহ ইনভাইটেশন এসেছে। সেদিন প্রান্তিক ওদের ট্রিট দিলো যে, সেই ভদ্রতা বজায় রাখতে মেয়েটাও তাদের দাওয়াত করল। প্রিয়তার যাবার এতো শখ ছিলো না। ভেবেছিল তাঁর বর মশাই ও না করে দিবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বর মশাই তাকে যাবার পারমিশন দিলো। এমনকি বলল, তুমি সোজা গাড়ি নিয়ে চলে যেও। আমি অফিস থেকে চলে যাবো। প্রিয়তা হ্যাঁ না কিছু করেনি। চুপ থাকা তো সম্মতির লক্ষণ। বর যেতেই সে ঘর গোছাতে শুরু করে দিল। এখন সে প্রান্তিকের রুমে। এখানে থাকাটাই যেন পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। মেয়েগুলো ওঘর থেকে প্রিয়তার জিনিসপত্র এনে এই ঘরে সাজিয়ে রাখছে। নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছে। এদের ভাব বেশিদিন টিকবে না। আবার ঝগড়া হবে, অভিমান হবে। তখন আলাদা ঘরে চলে যাবে তারা। মেয়েদুটো আফসোস করছে। এদের কাজ কেবল এ ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে ওঘরে দিয়ে আসা!

প্রিয়তা নিজের ঘরকে নিজের মতো সাজালো। বেলকনিতে একটা দোলনা বসানোর বন্দোবস্ত করছে। বিকেলে সে দোলনায় বসে চা খাবে আর বই পড়বে। একটা বুকশেলফ ও আনবে। বেলকনি ভালোকরে পরিষ্কার করে রাখল। এদিকে ফুলের টব রাখবে সে। পুরো নিজের মনমতো সাজিয়ে রাখবে। নিজের পছন্দমত ঘরের চাদর থেকে পর্দা অবধি বদলে দিল সে। এমনকি নিয়ম করে বাগান থেকে ফুল এনে ঘরের ফুলদানিতে রাখছে। একটু বাদে বাদে তাঁতে সুবাস নিচ্ছে। নিজের সংসার গোছাতে পেরে আনন্দে তার চোখের কোণে অশ্রু জমে গেলো।

জন্মদিনে প্রিয়তা এসেছে থ্রি পিস পড়ে। গোলাপি রঙের হালকা কারুকাজ করা থ্রি পিস পরা সে। অনেকেই চলে এসেছে এর মধ্যে। যার জন্মদিন তার নাম হচ্ছে লামিয়া। লামিয়া তাকে দেখতে পেয়েই প্রান্তিকের কথা জিজ্ঞেস করল। প্রিয়তা মুচকি হেসে জানাল, সে আসবে।

সুমনা পাশেই ছিল। শুধু সুমনা না, যারা এসেছে সকলেই এখানে। সবাই প্রিয়তার বরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ! লামিয়ে তার থিতুনিতে হাত রেখে বলল,

– কি ব্যাপার প্রিয়তা? দিন দিন মনে হচ্ছে সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস! কারন কি? বরের সোহাগ নাকি?

সকলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। প্রিয়তা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার কানের কাছে গরম ধোয়া উড়ছে। সুমনা আড়চোখে এদিক তাকাচ্ছে। তার সমস্যা কোথায় প্রিয়তা বুঝতে পারছে না। লক্ষ করছে একটু। সুমনা সবার সামনেই বলল,

– পেলে মেয়েটার খোঁজ?
– কোন মেয়ে?
– যাকে তোমার বরের সাথে দেখেছিলাম তার কথা বলছিলাম। পাও নি? আজ আসছে নাকি। বুঝছি না, এমন একটা ক্যারেক্টার‘লেস ছেলেকে তুই জন্মদিনে দাওয়াত কিভাবে দিলি লামিয়া?

প্রিয়তার স্তব্ধ। তার সাথে বাকি সকলেও । কেউ কেউ সুমনা কে চুপ করতে বলছে। সুমনা ইচ্ছে করেই যেন বাড়াবাড়ি করছে। প্রিয়তা চোখ ঘুরিয়ে নিল। তাকাল সুমনার প্রেমিকা ইশানের দিকে। হেসেই বলল,

– শুনেছিলাম কিছুদিন আগে তোমরা টুরে গিয়েছিলে। তাও দুজন! বিয়ের আগেই প্রেমিকাকে নিয়ে এতো ঘুরছো? পরিবার জানে তোমার?

ইশান হতবাক হয়ে রইল। সবাই বুঝল প্রিয়তা রেগেছে। কেউ বাধা দিল না তাকে। সুমনা ফুসে উঠল।

– তুমি কি বলতে চাইছো? ইশানকে তুমি ক্যারেক্টার‘লেস বলছো নাকি?
– বিয়ের আগেই তুমি আর তোমার প্রেমিক ঘুরতে গেলে রাসলীলা আর বর গেলেই বুঝি ক্যারেক্টার‘লেস!
ইশান বাঁধা দিতে চাইল। প্রিয়তা তাকে থামিয়ে বলল,

– প্রথম দিনই তোমায় বলতে চেয়েছিলাম, বলিনি। ভেবেছিলাম তুমি বুঝদার। কিন্তু তুমি তো দেখছি ভারী অবুঝ মেয়ে। আমার বরের কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল এই নিয়ে তো তোমার খুব আগ্রহ দেখছি! কারন কি? তোমার আর ইশানের মাঝে কি কিছু হচ্ছে না! প্রেম করছো! বিয়ে তো করোনি। গ্যারান্টি কি ইশান আর তোমার বিয়েই হবে? বলো আমায়! কোন সাহসে আমার বরকে নিয়ে আলোচনার সাহস করো তুমি? হু আর ইউ? আমার বরকে জাজ করার তুমি কে?

এবার দু একজন মুখ খুলল। তারা প্রিয়তার হয়েই কথা বলল। সুমনার ভারী অন্যা‘য় হয়েছে। এখনকার যুগে অনেকেই প্রেম করছে। কিন্তু ক’জন তার প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পেরেছে আদৌও। সে নিজেও তো সেই দলের। লামিয়া প্রিয়তাকে শান্ত হতে বলল। প্রিয়তা হাঁফাচ্ছে। এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন সুমনাকে আস্ত গিলে ফেলবে সে। ইশান সুমনার হয়ে মাফ চাইলো। তবুও প্রিয়তার মন টিকলো না আর।

প্রিয়তা সোজা সেখান থেকে বের হতে যাচ্ছিল। তখনই প্রান্তিক চৌধুরী ঢুকল রেস্টুরেন্টে। প্রিয়তা তার কাছে আসতে দেখে সে স্মিত হাসল। কিন্তু প্রিয়তমার মুখে আধার জমতে দেখে চোখের সানগ্লাস খুলে ফেলল সে! কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রিয়তা তার হাত ধরে টেনে বেরিয়ে গেল। প্রান্তিক আদৌও বুঝতে পারল না কি হয়েছে?

প্রান্তিক গাড়ি চালাচ্ছে। তার পাশের সিটেই বসা প্রিয়তা। একদম ধম মেরে বসে আছে। কোনো কথা বলছে না সে। প্রান্তিক নিজ থেকেই আগ বাড়িয়ে বলল,

– কিছু হয়েছে?
– না। বাসায় চলুন।
– বাসায়ই তো যাচ্ছি। তুমি বলো? ওভাবে চলে এলে কেন? কেউ কিছু বলেছে।
প্রিয়তা জবাব দিলো না। কি বলবে? তারা তার বরের চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। ভালো শুনায় এসব। প্রান্তিক একা মনে বকেই যাচ্ছে।

– এতো রাতে ফিরে যাচ্ছি। খাওয়া দাওয়া কিছুই তো হলো না। খিদে পেয়েছে তোমার?
জবাব না পেয়ে আবার শুরু করল, – খিদেয় মনে হয় তোমার মাথা গরম। সামনে রেস্টুরেন্টে থামবো। খাবে কিছু?
প্রিয়তা নিশ্চুপ! সে আবারো বলল, কি হলো? খিদে পাই নি।
– চুপ থাকবেন আপনি? আর একটা কথা বললে আপনাকে আস্ত গিলে খাবো আমি!
প্রান্তিক তার দিকে ফিরে একগাল হেসে বলল,
– আমি রাজি! পেট ভরবে তোমার? পেট না ভরলেও মন ভরবে। ট্রাস্ট মি!
বলেই চোখ টিপ মারল। এখনো হাসছে লোকটা। প্রিয়তার বুকের মধ্যে জ্বলা দাউ দাউ আ‘গুন এখন বোধহয় নিভে যাচ্ছে। প্রান্তিক আবারো বলল,
– সামনের রেস্টুরেন্ট আমার পছন্দের। থামি বলো! আমার বউ না খেয়ে একদম শুকিয়ে গেছে। এভাবে থাকলে কি আমার সাথে আর রাগ করতে পারবে বলো!

প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে নিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে। এই লোকটা এমন কেন? তার একটু কথায় সে কেন গলে যায়। ধীরে ধীরে তিনি যেন তার দুর্বলতা হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে তো তাকে ছাড়া বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে!

#চলমান

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১১

প্রান্তিকের ভাব সাব ইদানিং অনেক বদলে গেছে। বিয়ের পর তার এমন পরিবর্তন কারো বোধগম্য নয়। সত্যি সত্যি সে এভাবে বদলাতে পারে। এখনো কিছু বন্ধু বান্ধবের মধ্যে আলোচনা হয়। কাছের বন্ধু গুলো স্বীকার করে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে। বন্ধুর এমন পরিবর্তনে তাঁরা অবাক আবার একই সাথে খুশি। সপ্তাহে একদিন কেবল প্রান্তিকের দেখা পাওয়া যায়। তাও ডেকে আনতে হয় জোর করে। ব্যাটা আসতে চায় না, ধরে আনতে হয়। এখন আর সামনে মেয়ে দেখলেও পাত্তা দেয় না। এতে ক্লাবের কিছু মেয়েরা মনক্ষুণ্ণ হয়ে আছে। প্রান্তিকের বিয়ের পর যেন সবচেয়ে বেশি লোকসান তাদেরই হলো।

আলফি বিয়ারের বোতলে চুমুক দিল। তার পাশেই বসে মান্নাত একের পর এক সিগারেট টেনে চলছে। কোন বাঁধা নেই। আশিক চুপসে একপাশে বসে আছে। তার গা ঘেঁষে আছে মৌনতা। বন্ধুদের ওসব খেতে দেখে তার তৃষ্ণার্ত মুখ শুকিয়ে গেল। কিছু করার নেই। মৌনতা জানলে মাথার একটা চুল ও থাকবে না। তাঁর জীবনের প্রথম ভালোবাসা হলো মৌনতা। সেই কলেজের প্রথম লাইফের ভালোবাসা। আর আগে কখনো প্রেম করেনি। মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলেই তার বুকের মধ্যে ধিমধিম করে যেন ড্রাম বাজতো। এতোই লাজুক ছিলো সে। অন্যদিকে স্কুল থেকেই মেয়েদের মধ্যে প্রান্তিকের জনপ্রিয়তা অনেক। প্রান্তিক বলতেই তারা পাগল। হবে নাই বা কেন? ছোট থেকেই প্রান্তিক সবদিক থেকে পারফেক্ট। হোক সেটা পড়ালেখা কিংবা গুড লুকিং। টাকাও আছে বেশ। সবাই তাকে চাইতো। কিন্তু স্কুলে থাকা কালে প্রান্তিক মেয়ে’বাজ ছিলো না। তারা কেউই ছিলো না। মেয়েরা কেবল এদের মৌমাছির মতো ঘিরে রাখতো। ব্যাপারটা এই চারজনই বেশ এনজয় করতো।

বড়লোকের দিক থেকে প্রান্তিকের অবস্থা তাদের থেকে ভালো। তারা ছেলেবেলার বন্ধু। মৌনতা এসে যোগ হয়েছে কলেজ লাইফে। শুরু থেকেই মৌনতা প্রান্তিককে ভাই ডেকে এসেছে। মেয়েটা তাদের থেকে দুই বছরের ছোট। তবে বন্ধুত্ব হলো কি করে?

তাদের কলেজের পাশেই ছিল একটা গার্লস স্কুল। সেখান থেকে নিত্যনতুন তাদের কাছে চিঠি আসতো। চিঠি আনার কাজ ছিলো মৌনতার। মৌনতা আগে বেশ মৌনই থাকত। কথাও বলতো অনেক লাজুক ভঙ্গিতে। এসব দেখেই তো আশিক পাগল হয়েছিল তার জন্য। প্রণয় জেগেছিল তাঁর জন্য। কিন্তু এই মেয়েটাকে বিগড়ে দিয়েছে প্রান্তিক। তাকে এমন কথা বলা শিখিয়েছে যে এখন প্রান্তিক ও তার সামনে কিছু বলতে ভয় পাই।

এদেশে কলেজ লাইফ শেষ করতে পারিনি প্রান্তিক। দাদাজান কাজের সূত্রে দেশের বাইরে গিয়ে শিফট হলেন। সাথে নিয়ে গেলেন প্রান্তিক কে। তাকে ছাড়া তাঁর দুদণ্ড চলে না। ছেলে ম’রার পর এখন নাতিই তার সব। তার একজীবনে এখন নাতিই একমাত্র সম্বল। শেষবারের মতো এয়ারপোর্টে তাদের বিদায় জানাতে গেল তারা। মৌনতা প্রান্তিক কে জড়িয়ে ধরে সেই কি কান্না। বার বলতে বলতে লাগলো, “ভাইয়া তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না!”
যেন সত্যিই তার ভাই চলে যাচ্ছে। কিন্তু প্রান্তিক তার কথা রাখতে পারে না। তারা চলে যাবার পরেও মৌনতা কান্না থামাতে পারেনি। তখন আশিক তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। সেই যে জড়িয়ে ধরল আজ ও ছাড়েনি। প্রান্তিক ও প্রায় বোন বলতে অজ্ঞান। তাদের মধ্যে ঝগড়া হলে প্রান্তিক সবসময় মৌনতার সাইড নিবে, এখন দোষ মৌনতার হলেও তার জন্য মৌনতা সবসময় ঠিক!

এরপর দীর্ঘ সময় কেটে গেল। প্রান্তিক যখন দেশে ফিরল তখন তাকে আর চেনা যায় না। সেই শান্ত, চুপচাপ ছেলেটা আর সে নেই তখন। পড়াশোনা শেষ করে মন দিয়েছে দাদা জানের বিজনেসে। তার সাথে আরেক নেশা ধরল তাকে। মেয়ে’দের নেশা। নিত্যনতুন তাকে দেখা যেত নতুন মেয়েদের সাথে। আশিক এরা অবাক না হয়ে পারল না। তবে মানিয়ে নিল। কারণ বন্ধু হিসেবে প্রান্তিক যেন আগের মতোই আছে। কিন্তু এতো গুলো বছর তার সাথে কি হয়েছিলো, কেন হলো এসব কেউ জানতে চাইলো না। জানতে গেলে যদি পুরনো ক্ষ’ত আবার জেগে উঠে। তবে আবার সেই আগের প্রান্তিক ফিরে এসেছে। তাঁর কলেজ লাইফের সেই বন্ধু। তার নিতান্ত কোনো আগ্রহ নেই মেয়েদের সাথে। কেমন নিরস মুখে কথা বলে তাদের সাথে। কৌতূহল নেই যেন! কারণ কি? তবে কি বউকে ভালোবাসতে শিখে গেছে ব্যাটা!

মান্নাতের কথা বলে লাভ নেই। সে হচ্ছে অন্য লেভেলের মানুষ। তার সব ঠিক হয় শেষে কেবল প্রেমটাই হয়ে উঠে না। প্রেমটা মাখো মাখো হবার আগেই আলাদা হয়ে যায়। এর কারণ আশিক জানে না। জানার ইচ্ছে নেই। দোষটা মান্নাতের মনের। কোনো মেয়েকেই তার ভালো লাগে না। শুরুতে ভালোলাগলেও শেষ অবধি সেই ভালোলাগা টিকিয়ে রাখতে পারে না। ভালোলাগা দিয়ে শুরু আবার ভালোলাগা দিয়েই শেষ। ভালোবাসা অবধি যায় না।

এদের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র হচ্ছে আলফি। তার জীবনে কাদাপানির কোনো চিহ্ন নেই। এর পুরো কারণই তার ফ্যামিলি। একটু বেশিই স্ট্রিক কিনা। এসব থেকে একটু দূরেই যেন থাকতে হয় তাকে। এছাড়া বেচারা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে ভীষণ বিশ্বাসী।

মৌনতা হেলেদুলে বলল, ভাবছি বিয়েটা এবার করেই ফেলি।
আশিক আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো ফিরে তাকাল। বহুদিন ধরে এটা চাইছিলো সে। কিন্তু মৌনতাকে বলার সাহস হচ্ছিল না। রাজনীতিতে ঢোকার পর মৌনতা কে যেন একটু বেশিই ভয় পেতে শুরু করেছে সে। প্রান্তিক মুচকি হেসে বলল,

– ভেবে নে। বাঁদরের গলায় একবার ঝুলে গেলে কিন্তু আর বের হতে পারবি না।
আশিক মুখ চোখ কালো করে প্রান্তিকের দিকে তাকালো। শয়তা’নটা চাইছে কি? নিজে তো ভালোই বিয়েশাদী করে স্যাটেল হয়ে গেছে। এখন তার সময় এমন শয়তা’নি করছে। আশিকের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। মৌনতা কে বাহুডোরে জড়িয়ে নিল সে। জোর গলায় বলে উঠলো,

– তোর মতো বন্ধু যেন আমার শ’ত্রুর ও না হয় শালা। ইত’রামি করিস? জানেমান তুমি বলো। বাবাকে কবে তোমার বাসায় পাঠাবো। তুমি বললেই আমি এক পায়ে রাজী।

মান্নাত বলে উঠলো, কেন? দুই পায়ে কি সমস্যা? লু’লা ছেলেকে কেউ কিন্তু মেয়ে দিবে না বলে দিলাম।

মৌনতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আশিক ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মান্নাত কে দেখছে। এই হাতে পেলেই খে’য়ে ফেলবে। আলফি সেই কখন থেকে চুপসে আছে। প্রান্তিক এবার না পেরে জিজ্ঞেস করেই উঠল,

“ব্যাপার কি তোর? চুপসে আছিস কেন?”
“আচ্ছা, আমার বিয়ের বয়স কি পেরিয়ে যাচ্ছে?
মৌনতা বলে উঠলো, “কেন? তোর কি মনে হচ্ছে? তোর বয়স কমে যাচ্ছে। শা লা মেয়েলী কথাবার্তা কেন বলিস? ছেলেরা যেকোনো বয়সেই বিয়ে করতে পারে!”
আলফি কিছু বলতে গেলো। কিন্তু পারল না। চুপসে গেলো। তার মনের কথা বেশিরভাগ সময়েই চুপ হয়ে থাকে। সবাইকে বলে না সে। মৌনতার নজর প্রান্তিকের দিকে।

“কিরে? কতোক্ষণ পর পর ফোনে চোখ বুলাচ্ছিস। কারণ কি?”
“বউ কল করবে বোধহয়!”
“কিরে প্রান্তিক? তোর বউকে কি দেখাবি না। ভাবী কে দেখব বললাম সেই কতোদিন আগে। তোর তো কোনো পাত্তাই নাই!”
“আমি সেদিন দেখলাম ভাবীকে।”
“কেমন দেখতে রে? ভীষণ সুন্দরী তাই না বল। নাহলে কি আমার ভাইকে এমন ঠান্ডা করতে পারে। নিশ্চিত মেয়েটা আ’গুন!”
মান্নাত কেবল হাসল। সে বলতে চেয়েছিল, প্রান্তিকের শ্যালিকাও কম না। কিন্তু থেমে গেল। প্রান্তিক এসব শুনলে তাকে আস্ত গি’লে খাবে!”

থমথমে মুখে প্রান্তিক উঠে দাঁড়াল। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো সে। সকলে একটু অবাক হলো। সিরিয়াস কিছু হয়েছে বোধহয়। সচরাচর প্রান্তিকের এমন সিরিয়াস মুখ কেউ দেখে না।

——–

মান্নাতের মন ভীষণ খারাপ। খারাপের কারণ একমাত্র আমরিশা। তিনদিন হলো মেয়েটার কোনো খোঁজ নেই। তার কথা ভেবে সে অস্থির হয়ে উঠেছে। সেদিন বোকার মতো কাজ করল। মেয়েটার নাম্বার নিয়ে রাখবে না। আর মেয়েটাও কি? একবার ফোন করলে কিইবা মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। ভুল হয়েছে। সেদিন কথাবার্তা বলে বাড়ির এড্রেস নেবার দরকার ছিলো। কি করলে সে? কোনো কাজই তো হলো না। তার পাশেই অন্যমনষ্ক হয়ে আলফি দাঁড়িয়ে। সে একের পর এক বোতল ম’দ গিলেই যাচ্ছে। এদিকে মান্নাত আমরিশার চিন্তায় দশ বারোটা সিগারেট শেষ করেছে। তাঁর কেনো জানি মনে হচ্ছে, তাদের দুই বন্ধুর মনের অশান্তির কারণ একটিই! সেটা হচ্ছে মেয়ে! কিন্তু আলফি কি প্রেমে পড়েছে? কই? সে তো জানে না। কিন্তু চেপে গেল সে। তাঁর নিজের ব্যাপারেও তো আলফি কে কিছু বলতে পারবে না। অতঃপর পাশ বেয়ে চলে গেল।

ফোনটা তার বেজে উঠল। আবার থেমে গেল। মিসকল? ফোনের স্ক্রিনে আননোন নাম্বার দেখে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো মান্নাতের। তার মন বলছে এটা আমরিশার নাম্বার। সময় নষ্ট না করে কল দিলো সে। অনেকক্ষণ পর ফোনটা রিসিভ করল কেউ। কিন্তু কথা বলছে না। মান্নাত কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো করার পর কেটে দিল। আবারো ফোন দিল। এবারও কথা বলছে না। মান্নাত রেগে গিয়ে ধমকের সুরে,

– দুটো থাপ্পর দিলে সব ফাতরামি বেরিয়ে যাবে। কথা বলছো না কেন? আমরিশা!

– হ্যাঁ, হুঁ আপনি আমায় চিনলেন কি করে?

– এমন ফাতরামি তুমিই পারো করতে? এতো দিন ধরে লাগে একটা ফোন করতে? তা কি ভাবছিলে এতোদিন ধরে? সময় কেন লাগল এতো?

আমরিশা আমতা আমতা করছে। জবাবে কি বলবে তার জানা নেই। তার কেমন ভয় ভয় লাগছে। বোকার মতো কাজ করেছে সে। ফোন দেওয়াই উচিত হয়নি। পেছন থেকে আফরিন তার গলা জড়িয়ে ধরতেই সাথে সাথে ফোন কেটে দিল সে। মান্নাতের রাগ এবার তু’ঙ্গে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটাকেই একটা আছাড় মারল সে। আলফি, মৌনতা, আশিক আহম্মক বনে গেল। সবাই আজ চেতছে কেন এমন করে?

———–

প্রিয়তা ফোন নিয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে। বর মশাইকে কয়েকবার কল পেরেছে। পাত্তা পায়নি। কোথায় গেলেন তিনি? তার ফোন ধরার সময়টুকু ও হচ্ছে না। এই শেষবার! এরপর আর কল করবে না সে। এবার ফোন বাজতে বাজতে সাথে সাথেই রিসিভ করল ফেলল সে।
প্রিয়তা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই প্রান্তিক থমথমে কণ্ঠে বলল, এসে গেছি!

বলেই কল কেটে গেল। প্রিয়তা তখন শুনতে পেলো বাড়িতে গাড়ি ঢুকছে। কি আশ্চর্য! এখনই বা কি দরকার ছিলো ফোনটা ধরার। অভিমান করে ঘরের মেঝেতে বসে রইল সে। এগিয়ে গেলো না। যাবেও না।

কারো তড়িঘড়ি করে উপরে আসার শব্দ পাচ্ছে সে। প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। তার ব্যাকুল মন বলছে প্রান্তিক উপরে আসছে। কিন্তু তার আসার ধরণ অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। ঘরের আলো নিভানো। মাথা ব্যাথা করছিলো বলে আলো নিভিয়ে ছিল। এবার আলো জ্বালানো দরকার। তিনি আসছেন তো!

আলো জ্বালানো হলো না। প্রান্তিক তার আগেই ঘরে ঢুকে গেল। সজোরে দরজা বন্ধের শব্দে প্রিয়তা কেঁপে উঠলো সামান্য। অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না। প্রান্তিক কিছু জিজ্ঞেস করছে না। তাঁরা দুজনেই চুপ। প্রিয়তার ভয় লাগছে এবার। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশেই ল্যাম্প শেডের আলো জ্বালালো সে। সাথে সাথে কেউ ছুটে এসে তার হাত চেপে ধরল। প্রিয়তা কিছু বুঝার আগে তাকে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড় করালো সে। অনুভূতি বলছে, এটা প্রান্তিক! কিন্তু আচরণ বলছে যেন অন্যকেউ। প্রিয়তা কুঁকড়ে উঠল ব্যাথায়। প্রান্তিক হাত ছাড়ল না। ল্যাম্প শেডের আধো আধো আলোয় প্রান্তিকের মুখখানা দেখে চমকে উঠল প্রিয়তা।

তাঁর দৃষ্টি থমকে গেল। এই প্রান্তিক কে সে চিনে না। এনি তার বর মশাই নন। এই চোখ যেন অন্যকারো। বিধ্বস্ত, হিংস্র। গলার স্বর ও বদলে যাচ্ছে কেমন। প্রান্তিক গম্ভীর স্বরে শুধালো,

– ভার্সিটিতে গিয়েছিলে আজ?
প্রিয়তা কি বলবে খুঁজে পেলো না। সে তো প্রান্তিক কে বলেই বেরিয়েছিল। তাহলে? প্রান্তিকের স্বর এবার থমথমে শোনাল।
– কথা বলছো না কেনো?
– হ্যাঁ গিয়েছিলাম!
– কেন গিয়েছিলে?
প্রিয়তা ঢোক গিলে বলল, ক্লাস ছিলো তো!

সাথে সাথে তার গাল চেপে ধরল প্রান্তিক। ব্যাথায় ছট’ফট করছে প্রিয়তা। প্রান্তিক ধমকের সুরে বলল, – মিথ্যে কেন বলছো তুমি? ক্লাস করতে গিয়েছিলে? ক্লাস করেছিলে? বলো কি ক্লাস করেছো?

প্রিয়তা জবাব দিতে পারছে না। তার গালে টনটনে ব্যাথা করছে। অশ্রুসিক্ত নয়ন দুটি থেকে যেকোনো সময় অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। প্রান্তিকের সেসবে যেন কোনো ধ্যান নেই। মূহুর্তের মধ্যে প্রান্তিক তার গাল ছেড়ে চুল ধরে টেনে ধরল। মুখটা তার সামনে নিয়ে শক্ত গলায় শুধাল,

– কথা বলছো না কেন?

প্রান্তিকের চোখের ভাব দেখে প্রিয়তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রান্তিকের এমন রূপ তার জানা ছিলো না। কেমন ভয়ানক লাগছে না। এই বুঝি তাকে শেষ করে দিবে। তার রাগী কণ্ঠ, চোখের হাবভাবে প্রিয়তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল। আর্তনাদ করে উঠলো সে।

– লাগছে আমার!

অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। প্রান্তিকের যেন হুঁশ ফিরে এলো। চুলের বাঁধন আগলা হয়ে আসছে। এক হাতে তার কোমর চেপে অন্যহাতে তার গালের কাছে
কাছে নিয়ে রাখল সে। শক্ত হাত নরম আর শীতল হয়ে উঠল। কণ্ঠের স্বর ও নরম হয়ে এলো।
– লাগছে? সরি সরি খেয়াল করিনি। খুব লেগেছে বউ!
আদুরে সুরে বলতেই প্রিয়তা ডুকরে কেঁদে উঠল। দু হাতে খামচে ধরে আছে প্রান্তিকের শার্ট খানা। কেঁদে কেঁদেই বলে উঠলো, – না আজ ক্লাস করিনি। আজ আমরা কফি শপে সবাই ছিলাম। কথা বলছিলাম!

– তুমি আর একটা ছেলে ছিলে তাই তো!

কণ্ঠে আবারো রুক্ষ’তার আগমন। প্রিয়তার কান্না থামেনি। সে মাথা দুলাল। প্রান্তিক প্রিয়তাকে বুকে টেনে বলল, এরপর আর ছেলেদের সাথে কথা বলবে না। ক্লাস করতে গেলে সেখানে শুধু ক্লাস করতেই যাবে। আমার কথা কি শুনছো বউ? তোমার সাথে অন্যকে দেখলে আমার বুকটা জ্ব-লে উঠে। আমি নিতে পারি না। তুমি শুনছো!

প্রিয়তা শুনতে পারছে কি না জানা নেই। তবে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। প্রান্তিক তার কান্না থামাতে পারছে না। দুই হাতে আচমকা তাকে কোলে তুলে নিল। প্রিয়তা তাজ্জব বনে হলো। প্রান্তিক তাকে বিছানায় বসিয়ে আলো জ্বালালো। প্রিয়তার মুখখানা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটু কাঁদতেই পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। লাল হয়ে আছে তার গাল দুটো। একটু আগেই যেখানে চেপে ধরেছিল হাতের ছাপ বসে গেছে সেখানে। প্রান্তিক অবাক হলো। প্রিয়তার কান্না দেখে তার বুকের মধ্যে ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। বড়ই অস্থির লাগছে তার। ছুটে এসে মেঝেতে তাকে পায়ের কাছে বসে পড়ল সে। প্রিয়তা চমকে উঠল। প্রান্তিকের মুখখানা দেখে তার কান্না থেমে গেল। চোখ গুলো লালচে হয়ে আছে বেশ। কেঁদে দিবে এমন ভাব। প্রিয়তা তার দোষ খুঁজে পেলো। প্রান্তিক হাঁটু ভেঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তার গাল চেপে ধরল। মুখে আজস্র চুমু খেয়ে বলল,

– সরি সরি বউ! সরি। তোমার খুব লেগেছে না। আমি আর করব না। প্লিজ কেঁদো না!

প্রিয়তা নিস্তব্ধ! এই প্রান্তিক কে সে চিনে না। শুরু থেকেই প্রান্তিক তার কাছে অন্যরকম একটা মানুষ ছিলো। তার কাজ কেবল অকাজ করা। কোনো কিছু নিয়েই সিরিয়াস না। সবকিছু তার জন্য মজা যেন। কিন্তু এই প্রান্তিক কে দেখে সে একটু ঘাবড়েই গেল। তার মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। প্রিয় জনকে হারিয়ে ফেলার ভয় তার দৃষ্টিতে।

পিন পিন নিরবতা। প্রিয়তার কান্না থেমে আছে। সে গুটিসুটি মেরে বসে আছে প্রান্তিকের কোলে। প্রান্তিক তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কিছু বলছে না। মনে মনে নিজেকে দুষছে সে। ক্লাস বাদ দিয়ে ছেলেটার সাথে কফি শপে যাওয়া তার মোটেও উচিত হয়নি। সে যেতোও না। ছেলেটা তাকে নোটস দিয়ে হেল্প করেছিলো বিধায় গেল। যাবার পর কথা বলে তাকে বসিয়ে রাখল। শুধু শুধু, এভাবেই। প্রিয়তা উঠতে চাইলেও উঠতে পারছিলো না। শেষে প্রিয়তা অধৈর্য হয়ে উঠে পড়ল। ক্লাস আর করা হলো না। সোজা বাড়ি ফিরে এলো। একটা ছেলের সাথে কফি শপে বসে কথা বলেছে বলে আজ কতোকিছু হয়ে গেল। ভাবতেই তার অবাক লাগছে।

প্রান্তিকের কণ্ঠ এমন অন্যরকম লাগছে। ভীষণ অন্যরকম। সে তার কানের কাছে চাঁপা স্বরে বলল,
– তুমি জানো, আমি খুব একটা ভালো ছেলে নই!
– হুঁ?
– হ্যাঁ তো। আমি খুব একটা ভালো না প্রিয়তা। আমি খুবই অবাধ্য আর অগোছালো। আমার জীবনে আমি এতো ভুল করেছি যে তখন সেই ভুল গুলোকে ভুল বলে মনে না হলেও আজ হচ্ছে। আজ ভুল না অপ’রাধ বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, তুমি কি এই অপরাধীর অপরাধের কথা জেনেও তাকে ভালোবাসবে!

প্রিয়তা হেসে উঠল বোধহয়। নরম স্বরে বলল, – কি করেছেন শুনি? মানুষ খু’ন নাকি?
প্রান্তিক হাসল। প্রিয়তা উঠে বসল। প্রান্তিকের দিকে ফিরে দুই হাতে যত্নে তাকে আগলে ধরল। তার কপালে একটু চুমু খেয়ে বলল, “আপনি যা কিছুই করেন না কেন? আমি তবুও আপনাকে ভালোবাসবো। কখনো ছেড়ে যাবো না!”

প্রান্তিক হাসল ফের। তাকে জড়িয়ে ধরে নিল বুকের মধ্যে। সে খুব জানে প্রিয়তা তাকে ক্ষ’মা করবে না। তাকে ভালোবাসবে না বরং ঘৃণা করবে। নারীরা তাদের প্রিয় পুরুষের সব ভুল ক্ষমা করতে পারেও একটা জিনিসই তো পারে না। সে কখনোই তার পুরুষের ভাগ অন্য কাউকে দিবে না। প্রিয়তার ভাবনায় এখনো সেসব যায়নি। তবে যাবে! প্রান্তিক সত্যকে আটকাতে পারবে না তবে প্রিয়তাকে আটকে রাখতে পারবে। প্রিয়তা যেতে চাইলেও তাকে দিবে না। সে যাই করতে হোক না কেন, প্রিয়তাকে সে দূরে ফেলতে পারবে না। কখনোই না!

#চলমান