#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৪
অনুষ্ঠান শেষ! এবার বাড়ি ফিরবার পালা। প্রিয়তা একটু ওয়াশ রুমে গেছে। প্রান্তিক দাঁড়িয়ে তার ফিরবার অপেক্ষা করছে। হঠাৎ ইজান শিকদারের আগমন তাকে ভাবিয়ে তুলল। সেও এসেছে অনুষ্ঠানে। প্রান্তিকের জানা ছিলো না তারা আসবে। তাহলে কি আরিনাও এসেছে?
জীবনে বহু মেয়ের সাথে প্রেম নিবেদন হয়েছে প্রান্তিকের। কাউকে মন না দিতে পারলেও তাদের মন নিয়ে অনেক ছিনিমিনি খেলেছে সে। সম্পর্ক ভাঙার পর সেসব কেউ মনে রাখেনি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সকলে। এতে প্রান্তিকের কিছু যায় আসে না। এরা কেবলই খেলনা ছিল। খেলেছে, মন ভরেছে ব্যস। এরপর কাউকে কি ভাবার সময় কি তার আছে আদৌও?
নিত্য নতুন জামাকাপড়ের মতো তার সম্পর্ক বদলাতো। এক মাস, দুই সপ্তাহ এরকমই চলতো সম্পর্ক গুলো। সঙ্গৎ দেবার জন্য কেবল একজন মানুষ। এরা সাথে থাকবে, সঙ্গ দিবে আর টাকা উড়াবে। মূলত এই কারণেই আসত। এসব সম্পর্ক কখনো গভীর অবধি যায়নি। যেতোও না। তার বিছানায় কোনো মেয়ে এসে হামাগুড়ি খাবে প্রান্তিকের এটা ভালো লাগত না। মেয়েরা কেবলই খেলনা। বাইরের জিনিস! ঘরে আনতে নেই। এই দম্ভ নিয়ে কি করে আরিনার সাথে তার সম্পর্ক জুড়লো তার জানা নেই। তবে আরিনার আকর্ষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার কথা সে ভুলে গেল। কেমন ভ্রম হয়ে দাঁড়াচ্ছে এখন সবকিছু! কিভাবে এতোবড় ভুলটা সে করল। আরিনা সুন্দরী! কেবল সুন্দরী নয়, খুব সুন্দরী! কোনো পুরুষ তাকে কাছে পেয়ে ছাড় দিয়েছে এসব কথা শুনলে সকলে সেই পুরুষের পুরুত্ব নিয়েই প্রশ্ন করত। এই যুগে মহাপুরুষ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। প্রান্তিক যে কোন লেভেলের মহাপুরুষ তা সকলেরই জানা আছে!
আরিনা সুন্দরী, চালাক চতুর মেয়ে। তার মায়াবী দৃষ্টি থেকে মুখ লুকানো মুশকিল। নজরকাড়া সেই চাহনি উপেক্ষা করতে পারছে না প্রিয়তাও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুতে গিয়ে কেবল নজর পড়ছে পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। মুখ দিয়ে কেবল একটা কথাই বের হচ্ছে, “মেয়েটা ভারী সুন্দরী!” তার ঠোঁট রাঙানো টকটকে লাল রঙ যেন তাকে আরো আবেদনময়ী করে তুলল। প্রিয়তা বেশ কয়েকবার আড়চোখে তাকাল। এমন ভারী সুন্দরী মেয়ে খুব কমই দেখেছে সে।
আরিনা শেষবারের মতো লিপস্টিক লাগিয়ে নিল। হাত দিয়ে আবারো ঠোঁট দুটো চেপে দেখল ঠিক আছে তো আদৌও। আড়চোখে চেয়ে দেখছে প্রিয়তা কে। এই মেয়েটা! প্রান্তিক এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে তাকে ছেড়েছে। এই মেয়েটাকে ভালোবেসে তার কথা ভুলে গেছে। মেয়েটার মধ্যে তাহলে বিশেষ কিছু তো আছে। কি তবে সেটা?
প্রিয়তা টিস্যু দিয়ে হাত মুছে চুলগুলো ঠিক করে নিল। এবার বের হতে হয়। তার বর মশাই নিশ্চিত অনেকক্ষণ ধরেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। পা বাড়াতেই কারো চিকন কণ্ঠ তার কানে এসে বাঁধল। বোধহয় ওই মেয়েটার! সে ছাড়া আর তো কেউ ছিলো না। আন্দাজ ঠিক ছিল। পিছন ফিরতেই আরিনা কে মুখোমুখি পেলো প্রিয়তা। মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনে দু সেকেন্ডর জন্য স্তব্ধা খেয়ে গেল প্রিয়তা। এতো সুন্দর কণ্ঠও হয় কারো।
আরিনা যথেষ্ট চেষ্টা করল স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করতে। পারল না। তার গলায় যেন কাটা বেঁধে যাচ্ছিল। কম্পিত স্বরে শুধায়,
“প্রান্তিকের বউ তুমি?”
প্রিয়তা জবাব দেয় না। কেবল মাথা নাড়ে। আরিনার মনে হলো মেয়েটা মায়াবী! তার দৃষ্টি দুটিতে কেবল মায়া ভরা। অথচ এসব কিছুই তাকে কাবু করতে পারছে না। মেয়েটার মাথা নাড়ানো দেখে তার শরীর পিত্তি সব জ্ব’লে গেল। হাসার চেষ্টা করল। বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যাথা। চারদিকের নিরবতা কাটিয়ে প্রিয়তা বলে,
“কিছু বলবেন আমায়?”
“কিছু! হ্যাঁ, বলবো তো। সংসার কেমন করছো?”
প্রিয়তার অদ্ভুত লাগলো। মেয়েটার কথা বলার ধরণ কেমন জানি। প্রথম দেখাতেই একটা অচেনা মেয়ে এসব কি জিজ্ঞেস করছে? তিনি কি প্রান্তিকের পরিচিত। তাই হবে! এখানে উপস্থিত সকলেই তো প্রান্তিকের চেনাজানা।
একটু অস্বস্তি নিয়েই জবাব দিল, “ভালো আপু!”
“ভালো! তুমি কিভাবে ভালো থাকতে পারো? অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকা যায় শুনেছ কখনো?”
প্রিয়তার এবার যেন একটু খটকাই লাগলো। আসন্ন বিপদ টের পাচ্ছে সে। চোখ মুখ সব শুকিয়ে যাচ্ছে তার। শাড়ির আঁচল খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়তা। আরিনা বোধহয় কিছু টের পেলো। হেসে উঠল। খানিক আগেও যেই মেয়ের প্রশংসায় প্রিয়তা পঞ্চমুখ ছিল এখন তাকেই তার ভীষণ অ’সহ্য বলে মনে হলো। মনে হচ্ছে মেয়েটার হাসার ধরণ ও এক প্রকার কু’ৎসিত!
“চিনো আমায়?”
“না!”
“আমি আরিনা। তোমার বরের প্রাক্তন!”
চোখ বন্ধ করে ঢোক গিলল প্রিয়তা। তার শান্ত মন অস্থির হয়ে উঠেছে এখান থেকে পালানোর জন্য। কিন্তু সে কেন পালাবে? কারণ এসব সে শুনতে পারবে না। তার বর অন্য একটা মেয়েকে ভালোবেসেছিলো, সেই মেয়ে এসেছে ভালোবাসার কথা শুনাতে। এসব কি সে শুনতে পারে? কখনো না!
“ভয় পাচ্ছো নাকি? আমার নাম কি শুনোনি? না শোনার কথা। প্রান্তিকের এতো প্রেমিকাদের লিস্টে আমার নামটা বোধহয় তোমার চোখে পড়েনি।”
“প্রেমিকাদের লিস্ট” চোখ কপালে তুলল প্রিয়তা। এই মেয়ে কি যা তা বলছে। আরিনা এবার শব্দ করে হেসে উঠল। এগিয়ে এসে তার গাল টেনে বলল, “আরে বাবা! খুকি নাকি তুমি? কিছুই জানো না দেখছি। বিয়ের আগে বরের খোঁজ নাও নি। কোথায় ছিল, কার সাথে ছিল, কার সাথে রাত কাটালো..
প্রিয়তার মাথা ঘুরছে! পায়ের কাছ থেকে বোধহয় মাটি সরে গেছে। কেমন নরম তুলতুলে জায়গা। সে কি দুলছে নাকি? নিজেকে সংযত করল। যতখানি শক্ত গলায় কথা বলা যায়। ততোটুকু ভাবেই বলে উঠলো,
“আমার বরের নামে এতো বাজে কথা কেন বলছেন? প্রাক্তন বলেই কি যা নয় তাই বলবেন?”
“তোমার বর! তোমার বর হবার আগেও সে আমার ভালোবাসার মানুষ, স্বপ্নের পুরুষ তা জানো!”
প্রিয়তা অবাক হলো। মেয়েটার কথাবার্তা শুনেই মনে হচ্ছে সে এখনো তাকে ভালোবাসে! আরিনা ফের বলে উঠলো, “এতো বোকা সেজো না। তোমাকে মানায় না।”
“আমি বোকা সাজছি না। আপনাদের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। তাই আপনি অযথা আমাদের মাঝে এসে দেয়াল হয়ে দাঁড়াবেন না। আর আমার বরকে নিয়েও বাজে কথা বলবেন না। আপনাকে আমি এতোখানি অধিকার দেয় নি।
স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিল প্রিয়তা। আরিনার রাগ হচ্ছে ভীষণ। সামলে নিল।
“এতো আমার আমার করো না। কতোটুকুই বা জানো। বিয়েই হলো দেড় কি দুই মাস। এর মধ্যেই এতো অন্ধ বিশ্বাস করছো। তোমার মতো কতো মেয়ে এলো আর গেলো। প্রান্তিক চৌধুরী কে এখনো চিনতে পারোনি তুমি। ফুল শুকিয়ে মুড়িয়ে যাবার আগেই তার ভালোলাগা শেষ হয়ে যায়। এসব ভালোবাসা, ভালোলাগা, সংসারের কোনো দাম নেই তার কাছে। এতো মেয়েকে ছাড়তে পারলে তোমাকে ছাড়তে বাঁধবে কোথায়?”
মেয়েটা বলেই যাচ্ছে। যতখানি পারছে তার বরকে অপমান করছে। এর হিসাব বরের থেকে নেওয়া যাবে। কিন্তু একটা মেয়ের সামনে কখনোই তার বরের অপমান সহ্য করবে না সে। চটপট বলে উঠলো, “কারণ আমি বউ! বুঝো তো? বিয়ে করা বউ। এসব নামিক সম্পর্ক কখনো স্থায়ী না। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে মানুষ একবার বেঁধে পড়লে বের হওয়া মুশকিল!”
আরিনা থামল। এই মেয়েকে ঘুরানো এতো সহজ না। সে খুব করে চাইছে মেয়েটা প্রান্তিকের জীবন থেকে সরে যাক। যতটা খোলাখুলি ভাবে বলা যায় বলছে। কিন্তু মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না। না চাইছে না! আরিনা এক পা এগিয়ে এলো। দুজন মুখোমুখি এবার। প্রিয়তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে এসেছে।
“বুঝতে পেরেছি। তোমার বরের অন্ধ ভক্ত তুমি। অবশ্য এটা হবারই ছিল। যেই প্রান্তিকের কাছে গিয়েছে তারাই অন্ধ হয়ে তাকে ভালোবেসেছে। দেখো আমিও আছি তাদের দলে। একটা সিক্রেট বলি তোমায়, শোন!
এগিয়ে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমার পিঠে কোমরের কাছে একটা তিল আছে। তোমার বরের সেটা খুব পছন্দ ছিল। কখনো সেখানে চুমু খেতে ভুল করেনি সে!”
প্রিয়তার মুখটা মূহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার রক্ত শুন্য মুখ থেকে আরিনার শান্তি লাগছে এবার। মুচকি হেসে বিদায় নিল সে। আরিনা কখন গেলো প্রিয়তা টের পেলো না। তবে তার আভাস এখনো আছে। এই যে প্রিয়তাকে জ্বা’লিয়ে দিয়ে গেল! প্রিয়তা জ্বল’ছে। দাউ দাউ করে জ্ব’লে পুড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য! অথচ কেউ খেয়াল করছে না, গন্ধ পাচ্ছে না! মেয়েটা তো জ্বলে’পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। মন পুড়ে ছাই হয়ে গেলে কেউ কি খেয়াল করতে পারে আদৌও!
———
তবে প্রান্তিক পেরেছিলো। কিছু তো একটা হয়েছে। তার বউ সেই কখন থেকে চুপসে আছে। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পর সেই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এতো দরজা ধাক্কানোর পরেও দরজা খুলেনি। সে এবার চিন্তিত। রাজশাহী থেকে দাদাজানের কল আসায় ব্যাপারটা তখন কিভাবে যেন চেপে গেল। দাদাজানের আসতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে। তিনি মূলত কিসব ফাইল নিয়ে কথা বলছিলেন। এসব ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়েই দু ঘন্টা সময় চলে গেল। প্রান্তিক এখনো নিজের ঘরে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে ফাইল ঘাটছে। জামাকাপড় বদলানোর সময়টুকু পায়নি। এখনো সেই সুই টাই। যদিও সুট বিছানার উপর। কিন্তু ভেতরের সাদা শার্ট এখনো ঘামে ভিজে একাকার। শার্টের হাতা ফোল্ট করে এলোমেলো চুল নিয়ে বসে আছে সে।
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো প্রিয়তা। প্রান্তিক বোধহয় খেয়াল করিনি। সবে ফাইলটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করল সে। বউয়ের রাগ ভাঙাতে হবে সেই খেয়াল তার আছে। প্রিয়তার অবস্থা অনেক খারাপ। তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। গায়ের শাড়িটা এখনো চেঞ্জ করেনি সে। মুখটা শুকিয়ে এতোটুকুনি হয়ে গেছে। ঠোঁট ফ্যাকাশে। চোখের কাজল লেপ্টে আছে! সে কি কেঁদেছিলো এতোক্ষণ!
“আসবো!”
প্রান্তিক চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “আসো আসো বউ! তুমি তো আর ঢুকতে দিবে না। কিন্তু আমার ঘরে ঢুকতে তোমার অনুমতি লাগবে না!”
চোখ মেলল। ফিরে তাকাল। তাকে দেখামাত্র সে চমকে উঠলাম। আকস্মিক ঘটনায় প্রান্তিক হতবাক! কিৎকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল কেবল। এগিয়ে যে ছুটে যাবে সেই বার্তা মস্তিষ্ক পাঠাতে বড্ড দেরি করে ফেলল। তারা তো ভালো ভাবেই এলো। হ্যাঁ বউয়ের মন খারাপ ছিলো। কিন্তু এতোই কি খারাপ ছিলো?
প্রিয়তা নিজেই এগিয়ে এলো। প্রান্তিকের বোধ হলো। ছুটে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল।
“কি হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন?” চিন্তার সুর ভেসে আসছে তার কণ্ঠ থেকে। প্রিয়তা আকুতির স্বরে বলে উঠল, “আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন!”
প্রান্তিক অবাক হলো বটে। তবুও তাকে জড়িয়ে ধরল। প্রিয়তা নরম কণ্ঠে শুধায়, “আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন!”
প্রান্তিক পুরোপুরি ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরল। লেপ্টে নিল বুকের মধ্যে। কম্পিত স্বরে বলে উঠল, “কি হয়েছে তোমার?”
প্রিয়তা জবাব দিল না সাথে সাথে। সময় নিল! নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া কেবল ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে ঘর থেকে। প্রিয়তা এবার ধীর স্বরে বলে উঠল, “আপনি বলতে পারেন পার্থক্য কোথায় আমার আর আপনার গার্লফ্রেন্ডদের মাঝে?”
প্রান্তিকের মাথায় বা’জ পড়ল যেন। কেবল শব্দ হলো না। হতভম্ব হয়ে দ্রুত প্রিয়তার মুখের দিকে তাকাল সে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। এই ভয়েতেই তো ছিল সে।
প্রিয়তার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট! কারণ প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিল। ছাড়িয়ে নিল তার থেকে। তাদের বাঁধন যে হালকা হয়ে গেল।
“ছেড়ে দিলেন! বাঁধন যে হালকা হয়ে গেল। আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারলেন না। বলতে পারলেন না এসব মিথ্যে!”
বলতে বলতে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠল সে। প্রান্তিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে কি করবে বুঝতেই পারছে না।
অপ্রস্তুত কণ্ঠেই বলতে লাগল, “এমন কিছু নয় প্রিয়তা। আমি একটু বলি, শোন!”
আবারো বুকে আঁকড়ে নিতে চাইল। কিন্তু প্রিয়তা আর থাকবে না সেখানে। ওই বুকে আর সে মাথা পাতবে না। আর শুনবে না তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ। তার অরুচি ধরে গেছে। ঘৃণায় জড়িয়ে যাচ্ছে পুরো দেহ। ওই দেহের ঘ্রাণ মাখায় এতোদিন উতলা ছিল সে। তবে আজ কেন এতো অস্বস্তি হচ্ছে। প্রান্তিক তাকে ধরে রাখতে পারছে না। তার চোখদুটো স্থির হয়ে গেছে। চোখের কার্নিশের ভেতর মনি দুটো স্থির কেবল। প্রিয়তার হাত সে ছাড়ছে না। এই ছাড়লেই বুঝি হারিয়ে যায়। বুঝানোর শতচেষ্টা চলছে পালাবদল করে। প্রিয়তা এবার চেঁচিয়ে বলেই উঠল,
“সব মিথ্যে! সব কি!” তার শার্টের কলার চেপে ধরল সে। চক্ষু স্থির করে দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল, “তার পিঠের তিল কি আপনার পছন্দ ছিলো না। হাজারো বার চুমু খাননি আপনি সেখানে। এসব কি মিথ্যে!”
প্রান্তিক নিস্তব্ধ! তার উত্তর দেবার মতো কিছু নেই। কিছু বাকি নেই আর!
#চলমান
#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৫
প্রিয়তা ওঘর ছেড়ে নিজের ঘরে ফেরত চলে এলো। তার পিছন পিছন আসছে প্রান্তিক। প্রিয়তা হাঁটছে আগে আগে। নিজের ঘরে ঢুকে এবার দরজা বন্ধ করল না প্রিয়তা। প্রান্তিক দরজায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থমকে গেল। তার পা থেমে গেছে। মুখশ্রীতে থমথমে ভাব। প্রিয়তা চোখের জল মুছে ব্যাগ হাতে তৈরি। প্রিয়তা তবে ঘরে বসে এই করছিলো। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। প্রিয়তা কি তবে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে!
ট্রলি ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রিয়তা এগিয়ে আসছে। প্রান্তিক দরজার গোড়ায় সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রিয়তা থমথমে কণ্ঠে বলল, “সরুন!”
মূহুর্তের মধ্যেই প্রান্তিকের কণ্ঠস্বর বদলে গেলো। এতোক্ষণ যেই পুরুষ আকুতিতে জর্জরিত ছিল এবার মূহুর্তেই সেই পুরুষ কেমন তেজী হয়ে গেল। তার কণ্ঠে রুক্ষতা পাওয়া যায়। বেশ ভারী আর মোটা কণ্ঠস্বর যেন। সিরিয়াসনেস ভাবটা একটু বেশিই। তার এই পার্সোনালিটি কেবল অফিসের স্টাফদের জন্য। এমন রুক্ষ আচরণ কি তবে এবার প্রিয়তার সাথেও করবে সে। বেশ ঠান্ডা গলায় শুধাল,
“কোথায় যাচ্ছো? তোমার হাতে ব্যাগ কেন?”
প্রিয়তা তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। তার গা এখন থেকেই শিউরে উঠছে। এই কণ্ঠ তার চেনা! ভীষণ রকমের চেনা। কোন এক রাতে এই কণ্ঠের অধিকারীকে ভ’য় পেয়ে কুঁকড়ে উঠেছিলো সে। আজও তার ভয় লাগছে না এমনটা নয়। মনে হচ্ছে এই এসে বাজ পাখির মতো প্রান্তিক হাম’লে পড়বে তার উপর। মনে একরাশ সাহস আর অভিমান জুগিয়ে বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি।”
”কোথায়?”
খানিকটা সময় নিয়ে বলল, “আমার বাড়ি!”
“বিয়ের পর এটাই তোমার বাড়ি!”
কেমন চটপট উত্তর দিচ্ছি। প্রিয়তার রাগ মাথায় চেপে উঠছে। আর কোনো জবাব দিলো না সে। প্রান্তিক ছো মেরে প্রিয়তার হাত থেকে ব্যাগটা কে’ড়ে নিল। শাসনের সুরে বলল, “কোথাও যাবে না তুমি?”
প্রিয়তা আশ্চার্যান্বিত হলো। হতভম্ব স্বরে শুধায়, “আপনি এতো বড় অ’ন্যায় করে আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছেন কোন সাহসে। নূন্যতম অপরা’ধবোধ কি নেই আপনার?”
প্রান্তিক ব্যাগটা রেখে দিল। দু হাতে তার বাহু আকড়ে ধরল। প্রিয়তার এবার চোখাচোখি হলো প্রান্তিকের সাথে। কি অদ্ভুত চাহনি! চোখ দিয়ে অর্ধেক শা’সিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “কোথাও যাবে না তুমি! কোথাও না। আমায় ছেড়ে তুমি যেতে পারবে না। যা হয়েছে আমরা কথা বলে নিব। তুমি যা বলবে তাই করব। কিন্তু তুমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। বুঝলে! আমি যেতে দিবো না!
প্রিয়তা কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। চারদিক শান্ত! ঝড়ের আসার পূর্বে যেমন শান্ত থাকে, ঠিক তেমন। সে এবার বলেই ফেলল, “তাহলে ডির্ভো’স দিন আমায়!”
প্রান্তিক তাকে ছেড়ে দিল। খানিকটা পিছিয়ে ব্যাগ হাতে তুলে বলল, “সম্ভব না। মরা’র আগ অবধি তোমার পরিচয় আমার বউ হয়ে থাকবে। বললাম তো কোথাও যেতে পারবে না।”
ঘর ছেড়ে প্রান্তিক বেরিয়ে গেলো। তার হাতের ব্যাগটা দোতলা থেকে সিঁড়ির কাছে ছুঁ’ড়ে ফেলল। এতোক্ষণ যারা কান পেতে শোনার চেষ্টা করছিলো, তারা এবার আরো ঘাবড়ে গেল। প্রান্তিক চৌধুরীর এই রূপের সাথে তারা পরিচিত। ঘর থেকে প্রিয়তা স্পষ্ট শুনতে পেলো। তার ব্যাগ গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ভে’ঙে ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এসব করছে যাতে সে এই বাড়ি থেকে বের হতে না পারে। বললেই হলো নাকি? থাকবে না সে! এখানে আর এক মূহুর্ত!
প্রান্তিক চৌধুরী আর প্রিয়তা! এরা রা’গের দিক থেকে কারো থেকে কেউ কম না। প্রান্তিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ভেতরে জিনিসপত্র ভাঙ’চুর করছে প্রিয়তা। প্রান্তিক তাকে বাঁধা দিচ্ছে না। যা ইচ্ছে করুক। রাগে অভিমানে তাকে খু’ন করে ফেললেও অসুবিধে নেই। কিন্তু প্রিয়তা তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। জীবনে ভালোবাসার মানুষগুলোকে নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেনি সে। বরাবরই এই ব্যাপারে আনাড়ি। যারা এসেছিলো নিজ থেকেই এসেছে, ভালোবেসেছে, জড়িয়ে নিয়েছে আবার নিজ থেকেই চলে গেছে। কিন্তু এরই মাঝে প্রান্তিক কে কতোটা নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে সেটা তাদের জানা নেই। প্রান্তিক কখনো তাদের আটকায় নি। বার বার মনে হয়েছে, সেদিন তাদের আঁটকে রাখলে আজ বুঝি তাঁরা তার সাথেই থাকত! কিন্তু সে রাখতে পারেনি।
কিন্তু প্রিয়তাকে যেতে দিবে না সে। যেভাবেই হোক আটকে রাখবে। এটা ভুল, দোষ, অন্যায় যা ইচ্ছে হোক, তবুও সে দ্বিধা করবে না। ব্যস! তাকে আটকে রাখতে গিয়ে সে খলনায়ক হলেও চলবে।
প্রান্তিকের মুখ গম্ভীর! প্রিয়তা থামছে না। এবার ঘরের ভেতরে ঢুকতে গেলো সে। এটা প্রত্যাশিত ছিলো না। প্রিয়তার হাতের ফুলদানি ছি’টকে এসে লাগল প্রান্তিকের ললাটে। মূহুর্তের মধ্যেই র’ক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রান্তিক টু শব্দ অবধি করল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। তার সাদা ধবধবে শার্ট রক্তে রঞ্জিত হতে সময় নিল না।
প্রিয়তা হতবিহ্বল! সে মোটেও ইচ্ছে করে এমনটা করেনি। করতে পারে না! হুট করে হয়ে গেল। সে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ! এগিয়ে এলো না। একবারও কাছে এসে ছুঁয়ে দিল না। অথচ তার মন ক্ষত’বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় যেন জ্বলে’পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কাঁটা বিধেছে গলার মাঝে। তাই তো মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারল না। মাথায় যখন রা’গ চেপে যায় তখন মানুষ এমন অনেক ভুল কাজ করে ফেলে যার জন্য শেষে কেবল আফসোস করতে পারে। প্রিয়তা কি তাই করছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইল।
গম্ভীরতা, নিস্তব্ধতার মাঝে প্রান্তিক কেবল চেয়ে রইল তার প্রেয়সীর দিকে। কিন্তু প্রেয়সী চোখ তুলে একবারও তাকালো না। একবারও তাদের চোখাচোখি হলো না। নিঃশব্দ পা ফেলে প্রান্তিক চলে গেল। প্রিয়তা বুঝতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল। সে তো এসব চায়নি। তার এতো সুন্দর সাজানো সংসার আজ নিজের হাতেই ভে’ঙে চুরমার করে দিলো সে। বুকের মধ্যে চাপা একরাশ কষ্ট আর ক্ষোভ! কি থেকে কি হয়ে গেলো।
———————-
সিগারেট খাবার বাজে অভ্যাস প্রান্তিকের নেই। কিন্তু আজ অবলীলায় সে একের পর এক সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে। খুব চেষ্টা করছে কষ্ট গুলো কালো ধোঁয়া হয়ে শূন্যে উড়ে যাক। তবে যাচ্ছে না। কষ্ট কমছে না। আরো যেন দ্বিগুন হয়ে উঠছে। দুঃখ কষ্ট যেন তার পিছু ছাড়েনা। ছাড়বেও না কখনো।
প্রান্তিক শার্ট বদলে ফের হলো। পরনে ছাই রঙের একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার। প্রিয়তার রুম একদম পরিষ্কার ঝকঝকে। এতোটুকু সময়ের মধ্যে তারা কাজ সেরে ফেলেছে। স্যার কে রুমে ঢুকতে দেখেই সকলে তটস্থ। কপালের ক্ষত জায়গায় রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে আপনাআপনি। কোনো রকমের ঔষধ মলম লাগায় নি। দরকার পড়েনি। কালকের মধ্যেই ক্ষত জায়গায় একটা দাগ পড়ে যাবে।
প্রান্তিক কে দেখেই দুজনে একসাথে বলে উঠল, “ম্যাম বাথরুমে!”
“কখন গেছে?”
“অ..অঅঅ..অনেকক্ষণ!”
তাদের কথা বলার ধরণে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে দরজার সামনে গেল। ভেতর থেকে ঝরণার পানি পড়ার শব্দ। দু বার দরজায় টোকা দিয়ে বলল, “প্রিয়তা! দরজা খোল!”
ওপাশ থেকে কোনো শব্দ নেই। পানি পড়াও বন্ধ হচ্ছে না। প্রান্তিকের টেনশন বাড়ছে। রীতিমতো দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সে। তবুও ওদিক থেকে কেবল নিস্তব্ধতা। প্রান্তিকের ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। মেয়ে দুটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই তবুও তারা নিরব দর্শক। মনের ইচ্ছাকে প্রশয় দিতে তারা বিশ্বাসী খুব! প্রান্তিকের গলার স্বর কঠোর থেকে কঠোর হচ্ছে। ভারী গলায় শেষবারের মতো বলে উঠলো, “তুমি বের হবে নাকি আমি দরজা ভাঙ’বো!”
তবুও ওপাশ নিশ্চুপ। পানি গড়িয়ে পড়ার শব্দ। আর এক মূহুর্ত নষ্ট না করে প্রান্তিক দরজা ধাক্কাতে লাগল। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে কিছুক্ষণ ধাক্কানোর পর দরজা ভেঙে গেল। আপনাআপনি খুলে গেল!
দরজা ভাঙার শব্দে নিচ থেকে ছুটে এলো রাফি। প্রান্তিক চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়ে দুটি আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছে। প্রিয়তা ঝরণার নিচে জবুথবু হয়ে বসে আছে। তার সর্বস্ব ভিজে একাকার। ঝরণার পানি অনবরত পড়ছে তার মাথার উপর। তবুও সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এখান থেকে একবিন্দু নড়বে না।
আচমকা তাকে টেনে কোলে তুলে নিল প্রান্তিক। প্রিয়তা চমকালো না। কোনো শব্দ করল না। যেমনি ছিল তেমনই রইল। বাথরুম থেকে তাকে নিয়ে বেরুলো সে। রাফি দরজার সামনে এসে এমন পরিস্থিতি দেখে চমকে উঠল। প্রিয়তার অবস্থা তার চোখে লাগছে বলে মাথা নিচু করে সরে দাঁড়ালো সে। মেয়ে দুটি এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। প্রান্তিকের নজর পড়তেই ছুটে পালালো যেন।
কাকভেজা প্রিয়তা কে খুব যত্ন করে বিছানার উপর রাখল প্রান্তিক। আর কিছু না হোক, তার কপালের কাটা অংশ ঠিকই চোখে পড়েছে প্রিয়তার। যতবারই এই ক্ষত দেখে ততোবারই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। প্রান্তিক নিজের ঘরে গেল। শাড়ি হাতে ফিরে এলো। বিছানার পাশে রেখে বলল, “বদলে নাও!”
প্রিয়তা এখনো নিশ্চুপ! যেমনি ছিল তেমনি। কোনো ভাবান্তর নেই। সে বোধহয় সংকল্প করেছে। তার বর মশাইয়ের সাথে কোনো কথা বলবে না। প্রান্তিক বুঝে নিল। এতে চিড়ে ভিজবে না। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো, “তাহলে কি আমি চেঞ্জ করিয়ে দিবো!”
প্রিয়তা শাড়িটা আঁকড়ে ধরল। রাগে ফুঁসছে কেবল। প্রান্তিক হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে বেরুল। যাবার আগে বলে গেল, “ঘরের দরজা বন্ধ করবে না বলে দিলাম!”
#চলমান