প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব-২৬+২৭

0
2

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৬

হাসপাতাল হচ্ছে সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা অথচ কোলাহোল কম। বিনা বাক্যে এখানে সবসময় চাপা অস্থিরতা কাজ করে। এই ডাক্তার ছুটছে, তো ওই নার্স। একেকটা জীবন ভীষণ দামী হয়ে উঠে এখানে। একপর্যায়ে নিজেকে যার তুচ্ছ মনে হয় তারা যদি একটিবার দেখত, তার জীবনের শেষ সময়ে কতো গুলো মানুষ ছুটছে অহর্নিশ। তাকে বাঁচিয়ে তোলার ব্যাকুল আবেদন। একটিমাত্রই তো জীবন, এতো তুচ্ছ*তাচ্ছিল্য করে লাভ টা কি? জীবন মূর্ছা গেলে আচমকা সকলের কাছে দামী হয়ে উঠার ব্যাপারটা আজও এক রহস্য। এই রহস্য প্রকৃতি পছন্দ করে দারুণ ভাবে!

আরিনা শেখের জ্ঞান ফিরেছে কয়েক ঘণ্টা হবে। ডাক্তার দুবার এসে চেকআপ করে গেছে। তৃতীয় বার খুব জলদি আসবেন। প্রথমে এসে দেখেছেন স্মৃতি শক্তি ঠিক আছে না, বেঁচে আছো তো? আবার জ্ঞান হারাবে না তো। পরের বার এসে দেখলেন শরীর নাড়াতে পারছে কি না। একটু কষ্ট হলো কিন্তু হাত নাড়াতে সক্ষম হলো। কিছুদিন হুইলচেয়ারে থাকার উপদেশ দিয়ে আপাতত বিদায় নিয়েছেন। তৃতীয় উপদেশ আসছে বলে।

জ্ঞান ফেরার পর ইজান শিকদারকে দেখেছিলো। এখনো সেই আছে। মাঝে একবার মা কে দেখল। এতো বি*রক্তি ঠেকল! কানের কাছে কান্নাকাটি। মেয়েটা সবে সবে চোখ মেলে তাকিয়েছে এখনি তার কান্নাকাটি করতে হবে। বি*রক্ত হয়ে আরিনা নিজেই বলেছে বেরিয়ে যেতে। যত কান্না আছে বাইরে বসে কাদুক। শেষ হয়ে এসে দেখা করা যাবে।

ইজান শিকদার বসে ছিল পাশে নিশ্চুপ ফুলগাছের মতো। তার ঘন কালো কেশ গুলো হাওয়ায় দোল খাচ্ছিল ফুলের ন্যায়। আগ বাড়িয়ে একটি কথাও বলেনি। কিছু জিজ্ঞেস করেনি। পাশে বসে রইল প্রহরের পর প্রহর। আরিনা বুঝতে পারে না, এই ছেলেটার এতো ধৈর্য হয় কিভাবে? ওমন ভালো একটা ছেলে লক্ষ্মী একটা বউ খুঁজে কবেই সংসার পেতে ফেলতে পারে কিন্তু বসে আছে তার আশায়। জীবনে এই প্রথম তার আফসোস হচ্ছে। কেন প্রান্তিক চৌধুরী? ইজান শিকদারকে ভালোবাসলে দোষের কি হতো?

ইজান শিকদার কিছুক্ষণ আগেই কক্ষ ছেড়ে বেরিয়েছে। বেড়িয়েছে ডাক্তারের উদ্দেশ্য। তার সাথে আলাপ আলোচনা করার ছিল। কিন্তু বেরিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দুটো চেনা পরিচিত মানবকে দেখে অবাক হলো না মোটেও। প্রিয়তা প্রান্তিকের হাত চেপে আছে শক্ত করে। সে কি ইজান শিকদারকে ভয় দেখাচ্ছে? ওসব প্রান্তিক চৌধুরীকে তোয়াক্কা করে না সে। এখন প্রান্তিক চৌধুরীর চেয়ে আরিনা ইম্পর্ট্যান্ট।

তাদের দু’জনের চোখাচোখি হলো। নিরব যুদ্ধ হলো দৃষ্টির মাধ্যমে। বিনা বাক্যে ইজান শিকদার পাশ‌ কাটিয়ে চলে গেল। ডাক্তারের সাথে দেখা করা জরুরি। শ্বাসরোধ এবার ছেড়ে দিল প্রিয়তা। মনে স্বস্তি মিলল। প্রান্তিকের সাথে তার কোনো কথাবার্তা হলো না। কেনো কিছু হলো না। ভয়ে’র কিছু নেই তো আবার?

রিসেপশনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে প্রিয়তা। এতোটুকু ব্যাপার থেকেই বোঝা যায় প্রান্তিক চৌধুরীর অবহেলা। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে এখানে জোর করিয়ে আনানো হয়েছে। সে নিশ্চুপে দেওয়ালের কোণায় ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রিয়তার আশেপাশে অনেক মহিলা দাঁড়িয়ে। তার দাঁড়ানো তো সম্ভব নয়!

আচমকা তীব্র সুগন্ধি এসে নাকে ঠেকল। অপরিচিত এই ঘ্রাণ উপস্থিতি , দিচ্ছে কোনো রমণীর। পাশেই দাঁড়িয়ে বোধহয়! টের পাচ্ছে খুব! কাছাকাছি দাঁড়ানো নাকি?
মাথা নিচু করে নাড়িয়ে যাচ্ছে। পায়ের জুতো জোড়া দেখে বুঝে ফেলল কোনো নার্স বোধহয়। তোয়াক্কা দিলো না তেমন। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। রিসেপশনের লোক ছেড়ে এবার ডাক্তারকে ধরেছে প্রিয়তা। আজ সকলের মাথা চিবিয়ে খাবে।

পাশের সুগন্ধি ঘ্রাণ আরো জোরালো হচ্ছে। তাকে মা’তাল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। নার্সের মেয়েটা এবার একটু গা ঘেসেই দাঁড়ালো। শরীরের সাথে শরীরের সংস্পর্শ আসতেই প্রান্তিক চৌধুরী এড়িয়ে দাঁড়াল। হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুক্তো ঝরে পড়ছে যেন। প্রান্তিক চৌধুরী আড়চোখে তাকাল। মেয়েটার হাসি তার চোখে পড়ল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, চোখের ইশারা দিচ্ছে অন্যকিছু। নার্স মেয়েটি ফিক করে হেসে বলল,

“ভয় পাচ্ছেন?”
প্রান্তিক দাঁত এক পাটি বের করে হাসল।‌ মাথা দুলিয়ে বলল, “জি বউকে অসম্ভব রকম ভয় পাই!”
আবারো হাসির শব্দ! প্রান্তিক হাসল ঠোঁট বাঁকিয়ে। মেয়েটার গলার স্বর অমায়িক! অনেক পাঠক বলবে আমি বানিয়ে বলছি কিংবা বেশি বলছি । না! যাহা হচ্ছে তাহাই! মেয়েটি অসম্ভব রূপবতী তা আমার মতামত। গুলিয়ে ফেলবেন না যেন?

“হ্যান্ডসাম ছেলেরা বউদের ভয় না পেলে ভালো লাগে না। একটু আধটু ভয় পেতে হয়।”
“আমি একটু আধটু না বোন, পুরোটাই পাই!”
“বোন বানিয়ে ফেললেন? ইশ সেবার না হাত ধরে বললেন আমি তোমার রোমিও তুমি আমার জুলিয়েট!”
হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি পাংশু’বর্ণ ধারণ করল মূহুর্তে। স্মৃতির পাতা নাড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মেয়েটিকে এখন চেনা চেনা লাগছে। বছরখানেক আগের কথা, তখন সেবার গাড়ি দুর্ঘট’নার পর হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছিল সে। তেমন গুরুতর কিছু না পায়েই একটু চোট পেয়েছিল। মেয়েটির সাহসের কারণে এতোক্ষণ বাদে প্রান্তিকের মাথায় ঢুকল। মলিন হয়ে যাওয়া হাসি আবারো ফিরিয়ে আনল। মিষ্টি সুরে বলল,

“কিন্তু আপনি তো প্রত্যাখ্যান করছিলেন! মনে আছে, বলেছিলেন আমি আপনার রোমিও না!”
মেয়েটির হাসির স্বর দ্বিগুণ হতে হয়ে চেপে গেলো। হালকা কেশে গলা শীতল করে নিল। মধুর স্বরে বলল, “তা রোমিও সাহেব নতুন জুলিয়েট জুটিয়ে ফেলেছেন দেখছি!”
“আমরা সকলেই তো রোমিও হতে চাই, জুলিয়েট পাবো না তা কি করে হয়?”
“কথার তেজ এখনো আগের মতন। শুধরে গেছেন দেখছি! তা অফার কি এখনো আছে?”
“এটা কি রেস্টুরেন্ট পেয়েছেন ম্যাম! সিজন সিজন নতুন অফার নিয়ে হাজির হবো!”
“ভালো কথা বলতে শিখে গেছেন।”
“আগেও বলতাম। আপনি কানে নেননি?”
“হুমম এখনো ফ্লার্টিং করছেন।”
“উহু ভুল বুঝবেন না। ( হাতের অনামিকা আঙুল দেখিয়ে বলল) সত্যি শুধরে গেছি।”
“মানতে কষ্ট হচ্ছে!”
“মেনে নিন। আমার বউ এদিকেই আসছে। এদিক থেকে ওদিক হলে আপনাকে সহ আমাকে জ’’বাই করবে। সাবধানে থাকুন ম্যাডাম!”

প্রান্তিক সামনে ফিরল। প্রিয়তা ততোক্ষণে তার কাছেই চলে এসেছে। নার্স আর তার বর মশাইয়ের আলাপ দূর থেকেই খেয়াল করছিলো সে। ভ্রু যুগল কুঁচকে নাক খাড়া করে রেখেছিলো। কান খাড়া করে শোনার আগেই প্রান্তিক ফিরে তাকাল। চালাক বটে লোকটা। প্রান্তিক এগিয়ে এসে তার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, কথা হয়েছে? খবর কি এখন?”

প্রশ্নের ভাজে প্রশ্ন ছুঁড়ল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে,
“মেয়েটা কে?”
“নার্স!
“আপনি চিনেন নাকি? এতোক্ষণ কি কথা বলছিলেন?”
“কিছু না এমনি?”
“অনেক তো হেসে হেসে কথা বলছিলেন আর বলছেন কিছু না? দাঁড়ান আমি জিজ্ঞেস করে আসি।”
“আরে আরে কি করো। বলছি বলছি, বছর খানেক আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম তখন মেয়েটির সাথে দেখা হয়েছিল!”
“এখনো কথা বলেন?”
“এটা জিজ্ঞেস করলে? কই ভাবলাম হাই হুতোশ করবে। জিজ্ঞেস করবে কি জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলাম আর তুমি কি না মেয়েটিকে নিয়ে পড়ে আছো? আমার ইম্পর্ট্যান্টস কি নেই তোমার কাছে?

প্রিয়তা কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে গেল। চক্ষু শীতল করে মেয়েটির দিকে ফিরল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে নেই চলে গেছে। ইনসিকিউরিটি ফিল সে করে না। প্রান্তিক নিশ্চিত এখন তাকে ভীষণ ভালোবাসে। মারাত্মক ভালোই না হয় বাসে। তবু ভয় হয়, এক অতীত নিয়েই কি ঝামেলায় আছে। আরেকটা এসে যদি আবার হাজির হয়। ভালোবেসে কি ফাঁদেই না পড়ে গেছে মেয়েটা।

দুজনে যাচ্ছে আরিনার কক্ষের দিকে। প্রান্তিকের হাতের মুঠোয় প্রিয়তার হাত। বেশ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তার কি বলল?”
“এখন সুস্থ আছে। কথাবার্তা বলতে পারে তবে হাঁটা চলা নিয়ে অসুবিধে হবে। স্ট্রে’স দেওয়া যাবে না একদম!”

প্রান্তিক ফট করে থেমে গেল। বলল, “তাহলে আমাদের যাবার দরকার নেই। আমাকে দেখেই ও উত্তেজিত হয়ে পড়বে।”
প্রিয়তা বি’রক্তি নিয়ে তাকাল। হাত টেনে বলল, “বাহানা রেখে সাথে চলুন। কতো কুকর্ম যে করবেন আপনি!”
“আমি কোনো কুকর্ম করিনি!”
“তো কি করেছেন? সাধু সন্ন্যাসী নাকি আপনি? পুজো করব এমন কাজ ও তো করেননি?”

প্রান্তিক মুখ বুজে শুনে নিল সমস্ত কথা। মুখ বুজে কথা শোনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ইদানিং খেয়াল করল, তার ধৈর্য ভীষণ বেড়ে গেছে।

দুজন দাঁড়িয়ে কক্ষের সামনে। প্রিয়তা হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “যান আপনি। আমায় দেখে হাইপার হয়ে যেতে পারে?”
“তা ঠিক, আমায় দেখে খুশি হয়ে চুমু টুমু খেলে তুমি কষ্ট পাবা!”
প্রিয়তা চমকে তাকাল। কি বলল লোকটা! প্রান্তিক দাঁত বের করে হেসে বলল, “চলো আমার সাথে, নজরে রাখতে পারবে!”
“এতো নজরে রাখতে পারব না। যার ভালো থাকার, সাথে থাকার এভাবেই থাকবে। শত নজরে রেখেও কোনো কাজ হবে না। যার থাকার ইচ্ছা এভাবেই থাকবে।”
“আমার তো সাধ জনম মরণের পরেও তোমার সাথে থাকার!”
“যা কার্যকলাপ করছেন মনে তো হয় না আমরা একসাথে থাকতে পারব।”
“এজন্য তো প্রায়শ্চিত্ত করতে এলাম।”
“যান এবার!”

প্রান্তিক দম নিল। দরজা খুলে পা বাড়াল ভেতরে। ঠান্ডা শীতল রুম, ফুরফুরে বাতাস ঢুকছে জানালা দিয়ে। পুরো রুম স্বচ্ছ, শুভ্র! মাঝে বিছানা পেতে শুয়ে আছে আরিনা। সাদা চাদরে আবৃত তার দুর্বল দেহ। দৃষ্টি জানালার দিকে! একপাশে কেবিনেটে কিছু ওষুধ পত্র পড়ে আছে অন্যদিকে মনিটরিং ডিভাইস। আইসিইউ তে ছিল গত ১৭ ঘণ্টা। জ্ঞান ফিরেছে ৫ ঘণ্টা আগে। এখন কিছুটা সুস্থই বলা যায়।

কানের কাছে খসখস পায়ের শব্দে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করল না সে। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে কপালে ভাঁজ পড়ল কিছুটা। বুকের হৃদস্পন্দন ছুটল তরঙ্গ বেগে। সত্যিই কি সে?

মুখ ঘুরিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখশ্রী দেখে তব্ধা খেয়ে গেল। কোটর থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল কয়েকটা। তবু চোখ মুখ শক্ত করে রাখল। প্রান্তিক চেয়ার পেতে এগিয়ে এসে পাশে বসল। ঘড়ির কাটা ঘুরছে আনমনে। মিনিট কয়েক পেরুনোর পর সে বলতে শুরু করল,

“এখন কেমন আছো?”
“ভালো!” কণ্ঠ শান্ত, শীতল, নিষ্প্রাণ! যেনো কোনো আগ্রহ নেই। প্রান্তিক ঠোঁট কামড়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। অপরিচিত পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগল বেশ। আরিনা চাইছে প্রান্তিকের উপস্থিতি ভুলে যেতে। কিন্তু নিঃশ্বাসের শব্দ বার বার উপস্থিতির জাগান দিচ্ছে। অতঃপর সে নিজে থেকেই বলল,

“তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ, তোমায় দেখতে এলাম!”
“নিজ থেকে হঠাৎ?”
“আসতে চাইনি। ও জোর করে নিয়ে এলো। বলছে এখান তোমার পরিস্থিতির জন্য একটু হলেও আমি দা’য়ী!”
আরিনা উপরে তাকাল। চক্ষুতে কেবল সাদায় আবৃত কংক্রিটের দেওয়াল। কণ্ঠে রুক্ষতা এসে ঠেকল।
“কেউ না, আমিই বুঝি দায়ী!‌ এখন বুঝছি কাউকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসতে নেই।”

কিছুক্ষণ দম নিয়ে বলেই ফেলল কথাটা।
“আমি তোমার কাছে মাফ চাইতে এসেছি।”
“ও তোমায় জোর করে আনল বলে?”
“না, আমিই বলছি!”
আরিনা ঘুরে ফিরল। বহুদিন বাদে তার চেহারা দেখল। ওই তো ঢেউ খেলানো চুল গুলো সাজিয়ে রেখেছে শক্ত করে। মুখে তার সবসময় দুষ্টুমি একটা ভাব থাকে। ভাব গম্ভীরতা বলতে কখনো ছিলো না। সবকিছুতে খেয়ালীপনা। বেপরোয়া ভাব, কোনো কিছুতে যায় আসে না যেন। বাদামী রঙের চোখজোড়া সর্বক্ষণ যেন কিছু বলার প্রয়াস করে। একটু বাদে বাদে ঢোক গিলে সে। চোখের পাতার বারংবার উঠানামা বোঝায় ভেতরে ভেতরে কতোটা অস্থির সে। মুখশ্রী তো একই, আগের মতোই! তাও কেন চিনতে কষ্ট হচ্ছে!

আরিনা মুখ ফিরিয়ে নিল। হেসে বলল, “তোমায় আমি চিনি না। এই প্রান্তিক চৌধুরী কে আমার বড় অচেনা লাগে!”
“সত্যিই বলছো। আজকাল আয়নাতে নিজেকে দেখেও চিনতে পারি না।”
“মশকরা করছো?”
“না করছি না। আরিনা, এই পৃথিবীতে কতো মানুষেরই বিচ্ছেদ হয়। বিরহ সবার থাকে। সব বিচ্ছেদ কি প্রতিহিং’সা দরকার?”
“জানি না। আমি জানতে চাইনি।”

প্রান্তিক উঠে দাঁড়ালো। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “আমি আসছি!”
বলে দাঁড়াল না। উল্টো পথে পা বাড়ল। আরিনা সহসা বলে উঠলো, “আমার মনে হয় আমি তোমাকে আর ভালোবাসি না প্রান্তিক!”
প্রান্তিক ফিরে তাকাল না। ওপাশ থেকেই বলে উঠলো, “ভালো। এটাই তো দরকার!”
“হ্যাঁ, তোমার খুব প্রয়োজন ছিল!”
“তোমার কি ছিলো না?”
“জানি না! আমরা অপ্রয়োজনীয় কাজ বেশি করে থাকি!”

সে হাসল বুঝি ঠোঁট বাঁকিয়ে। নরম স্বরে বলল, “খেয়াল রেখো!” অতঃপর বেরিয়ে গেল। আরিনা আবারো দৃষ্টি ভেরাল জানালার দিকে। ঠোঁট কামড়ে অশ্রু আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে খুব। কথা শুনলে হয়!

#চলমান

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_২৭

প্রান্তিক চৌধুরী হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে এলো। প্রিয়তা আগে থেকেই গাড়িতে বসা ছিল।‌ প্রান্তিককে গাড়ির কাছে আসতে দেখে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তাদের মধ্যে আদৌও কি কথা হলো? কতদূর হলো? এসব কিছু্ই জিজ্ঞেস করল না। প্রান্তিক ও আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। গাড়ি চলছে ধীর গতিতে। ফ্লাইওভারের উঠতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল হুট করে। প্রিয়তা তার বাহু আঁকড়ে চোখ বুজে নিল। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। গাড়ির গতি ফের কমিয়ে আনল সে। চোখ মুখ শক্ত নিল আচমকা। ঘাড়ের কাছের রগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে রাগে। ডান হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। বা হাতে ফোনটা নিয়ে কাউকে মেসেজ করছে বিদ্যুতের গতিতে। ইজান শিকদার এখনো হাসি খুশি আছে। সুস্থ আছে! সে এতো ভালো না যে তার সুস্থতা কামনা করবে। এসব চোখে দেখা যায় না!

————

ইজান শিকদার এসে ঢুকল আরিনার কক্ষে। আরিনা শেখ তখন ঘুমাচ্ছে। নিঃশব্দে টুল টেনে তার বিছানার পাশে বসল সে। প্রহর কাটল। আরিনার ঘুম ভাঙল। চেয়ে ফিরে তাকাল। প্রান্তিক কেই প্রথমে নজর পড়ল তার। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেখা দেখা গেল। ইজান শিকদার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

“কেমন লাগছে এখন?”

“ভালো! আমি আজ একটা কাজ করেছি জানো তো?”

“কি?”

“প্রান্তিককে বলে দিয়েছি আমি তাকে আর ভালোবাসি না!”

“সত্যিই কি তাই?”

আরিনা ঠোঁট চেপে ধরল। চোখ মুখ শক্ত করে বলল, “হ্যাঁ ওই। মানসিক চাপ আর নিতে পারছি না। হেরে গেছি আমি, খুব বাজে হেরে গেছি। নিজের কাছে নিজেই এতো নিচু হয়ে গেছি যে…

শেষ করতে পারল না। হাঁপানি উঠে গেল বোধহয়। হম্বিতম্বি করে ইজান শিকদার তার হাত চেপে ধরল।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে! জোর করে কিছু করার দরকার নেই। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে!”

বুক ভরে শ্বাস নিল আরিনা। ইজানের হাতটা শক্ত করে ধরে নিল। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিরে চাইল তার মুখশ্রীর দিকে। আবদার রাখল,

“তুমি ছেড়ে যাবে না তো আমায়?”

কণ্ঠস্বর কাঁপছে! মনে হচ্ছে অ*ন্যায় কোনো আবদার। ইজান শিকদার মুচকি হেসে উঠল। মুখ ফুটে জবাব দেবার দরকার নেই। চোখ যে মনের কথা বলে!

রাতে একটা জরুরী কাজে ইজান কে বের হতে হলো। যাবে আর আসবে। ততোক্ষণ আরিনার সাথে তার মা সাথে থাকবে। ইজান দ্রুত গতিতে পা ফেলে গাড়ির কাছে যাচ্ছে। ঢুকেই গাড়ি স্টার্ট দিল। তাড়াহুড়ো বেশ! সময় নষ্ট করার সময় যেন হাতে নেই। গাড়ির গতি বাড়িয়ে মেইন রাস্তার উঠে গেল।

মেইন রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে বাতাসের বেগে। আশেপাশে গাড়ি কম। ঢাকা শহরে এই চিত্র সহজে মিলে না। দূরের ল্যাম্পপোস্ট গুলোকে আকাশের তারার মতো মনে হচ্ছে। কাছে আসতেই মিলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার‌‌ আলো ঢেকে দিচ্ছে। সামান্য এই দ্যুতি অন্ধকার সরিয়ে দিতে ভীষণভাবে ব্যর্থ।

ইজানের বা হাতে ফোন। ডান হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে। চোখ সামনের দিকে। হঠাৎ দেখল সামনের দিক থেকে উল্টো পথে দ্রুত গতিতে গাড়ি তার দিকে ধে*য়ে আসছে।‌ সেকেন্ডের মধ্যে চমকে উঠল। কপালে ভাঁজ পড়ল। গাড়ির হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে গাড়ি সরিয়ে নিল। তখনি পেছন থেকে আরেকটা বড়সড় গাড়ি এসে ধা*ক্কা মার*ল তাকে। কিছু সেকেন্ডের জন্য কন্ট্রোল হারি*য়ে ফেলল সে।

বোধ হলো। শক্ত হাতে আবারো গাড়ির হ্যান্ডেল ধরে রাস্তায় এলো। গাড়ি সচল হলো ফের। পুরো রাস্তা এবার শান্ত আর নিরব। আরেকটু হলেই পাশের রাস্তায় গাড়ি উ*ল্টে যেত। বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। এই ভেবে দুমিনিট থামল।

কয়েক দফা শ্বাস প্রশ্বাস গাড়ি চালাতে লাগলো আবারো। আচমকা এরই মধ্যে দুটো কালো রঙের গাড়ি এসে হাজির। একটি তার পাশে আরেকটি পিছনে। দু জায়গা থেকেই ধা*ক্কা দেওয়া হচ্ছে পা*ল্লা দিয়ে। পাশের রাস্তার ব্লকে ধা*ক্কা খেয়ে দ্রুত ব্রেক কসল সে। গাড়ি দুটো এবার চলে গেছে। মাথায় চো*ট পেয়েছে ভীষণ। র*ক্ত পড়ছে গড়াগড়িয়ে!

সুনসান নিরব জায়গা। আশপাশ মানুষের অস্তিত্ব মেলা মুশকিল। বড় দুটো রাস্তা কেবল সোজা চলে গেছে জনসমাগমে। রাস্তার দু ধারে কেবল মাঠের চিহ্ন। এখানে তাকে মে*রে ফেলা খুব একটা মুশকিল কাজ নয়। কাজটা কার হতে পারে এই নিয়ে ভাবতে হবে না। প্রান্তিক তাকে ছে*ড়ে দিবে এই চিন্তা করাই যেন অ*ন্যায়। আজ তার চোখ দেখেই বুঝে গেছিল। সুযোগ পেলে মে*রে মাটি চাপা দিয়ে দিবে। মৃ*ত্যুকে সে ভয় পায় না। কিন্তু আরিনা! আরিনা কি হবে?

সিটে হেলান দিয়ে বসল। হাল কি ছেড়ে দিল তবে? চোখ মুখ করে মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে কেবল। শরীর ক্লান্ত ভীষণ। বিপদে পড়ে সমস্ত শক্তি যেন শুষে নিচ্ছে কোনো অদৃশ্য এক শক্তি। ঝাপসা চোখে সামনে তাকাল। গাড়ি আরেকটা আসছে। ছোট ট্রাক কি?

স্পষ্ট দেখছে এবার! ছোট ট্রাকই তো। তার বরাবর উল্টো পথে এদিকেই আসছে। কি করবে? গাড়ি ঘুরিয়ে নিবে? হাত রাখল হ্যান্ডেলে! গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ফের। পেছন পেছন ফসফস করছে। যেন সিংহের গর্জন। তার অন্তিম বার্তার আহ্বান!

কিন্তু হা*র মানবে না। এতো সহজে হা*র মানার পাত্র সে নয়। গাড়ির ইঞ্জিন আবারো চালু করল। প্রখর দৃষ্টি সামনের দিকে। শক্ত হাতে হ্যান্ডেল চেপে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনের গাড়িটাও তাকে অনুসরণ করছে। মুখোমুখি সংঘর্ষ হবার আগেই গাড়ি ঘুরিয়ে সাইড কেটে গেল। তবে শেষ রক্ষা বুঝি হলো না। ওদিক থেকেও যে আরেকটি ট্রাক…

শক্তিশালী এই ট্রাকের কাছে তার গাড়ি পে*ড়ে উঠবে না। তার শক্তির কাছে হার মেনে গাড়ি পেছনে ঠেলতে লাগল। রীতিমতো তাকে ধা*ক্কা দিয়ে গাড়ি পেছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যতই ইজান শিকদার চেষ্টা করুক কি না, গাড়ি সাম*নে আগাচ্ছে না।

ইজানের ঘাম ছুটে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বার বার পেছন দেখছে। গাড়িটা কি তবে খা*দে ফে*লে দিবে? হঠাৎ গাড়ির সামনের আয়না ভে*ঙে কতো গুলো রড ঢুক*ল হৃ*দয় ভে*দ করে। গাড়ির নরম শক্ত সিটের এফোঁড়*ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল। ভ*য়ার্ত আঁখি দুটি কেবল দেখছে স্থির দৃষ্টিতে। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল। ঢোক গিলছে বারংবার। পাশের সিটের এরকম হাল তারও হতে পারে। কি সাং*ঘাতিক হুম*কি!

চেতনা ফিরতে সময় লাগল। কিছুক্ষণ আগে ভয়ং*করভাবে গর্জে উঠা সময় আবারো নিশ্চুপ হয়ে গেল। ইজান শিকদার সিটে মাথা হেলিয়ে দ্রুত ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে। এ কি রকম সাপ সিঁড়ি খেলা। সে হচ্ছে একটা ইঁদুর। বড় বিড়াল ছানা‌ তাকে এই ধরে এই ছেড়ে দিচ্ছে। মে*রে ফেলছে না আদৌও। মৃ*ত্যুর মতো কঠিন আর ভারীবহুল শব্দটা আজ ভ*য় দেখাচ্ছে তাকে।

ফোন বেজে উঠল। চমকে উঠল সে। হাতরিয়ে নিচ থেকে ফোন তুলল। আননোন নাম্বার। কার হতে পারে সে জানে? সময় নষ্ট না করে তুলে নিল। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ। গলা ফাটিয়ে হাসছে কেউ। অন্ধকারে গা শি*উরে উঠা হাসি। ইজান শিকদার কানে ফোন চেপে আছে। হাসি থামল। ওপাশ থেকে বলল,

“বেঁচে আছিস? আছিস আছিস, নাহলে ফোন রিসিভ করলি কিভাবে?”

“তুই কি আমায় মা*রতে চাস?”

“আমি চাইলেই তা করতে পারি। ডেমো দেখলি কি না?”

ইজান শিকদার মাথাটা আবারো সিটে হেলিয়ে দিল। তাচ্ছিল্যের হাসি তার চোখে মুখে। প্রান্তিক চৌধুরী কি আর ওসব দেখতে পেলো নাকি? না পায়নি! তাই তো দ্বিগুণ উৎসাহে বলল,

“বেঁচে থাকিস! তোর কিছু হ*য়ে গেলে আমার বউকে আমি কি জবাব দেবো? ও একটু ভালো কি না! তোর কিছু হলে বলবে আমি করেছি। সাবধানে থাকিস!”

আবারো সেই কু*খ্যাত হাসির শব্দে ফোন কেটে দিল। ইজান শিকদার হেসে উঠল আচমকা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে একটা সিগারেট ধরাল। গাড়ির জানালা খুলে সিগারেট ধুয়ে শূন্য উড়িয়ে দিয়ে বিরবির করল,

“আমায় বাঁচিয়ে রেখে তুই যে কতো বড় ভুল করলি তা হাতে নাতে টের পাবি প্রান্তিক চৌধুরী!”

আবারো ঠোঁটের পাতায় সিগারেট রাখল সে। হাসি এবার তার চোখে মুখে!

#চলমান