প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব-০৯

0
2

#প্রিয়তে_তুমি_প্রাণ💜
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৯

প্রান্তিক লুঙ্গি পরে বসে আছে। যে সে বসা নয়। ভালোমতো গোছগাছ হয়ে বসে আছে। লুঙ্গি তার শ্বশুরের। শ্বশুর বাড়ি এসে আবার ফেরত যাবে বলে ইচ্ছে করে কোনো জামাকাপড় সাথে করে আনেনি। এখন গোসল করার পর মনে পড়ল সাথে তো কোনো জামাকাপড় নাই। কোনোমতে এখন শ্বশুরের নতুন লুঙ্গি আর শার্ট পরে বসে আছে সে। মুখখানা বেশ গম্ভীর! গালে দুই হাত দিয়ে সোফায় বেশ জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সে। শার্ট টি ঢিলেঢালা। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লুঙ্গি নিয়ে বিরাট সমস্যা। তাই এই ক্ষুদ্র জীবনে লুঙ্গি সে কখনোই পরেনি। ভেরি আনকমফোর্টেবল! এই মনে হচ্ছে লুঙ্গি পরে যাবে। দুই হাতে লুঙ্গির গোছা ধরে বসে আছে। শালিকা সাহেবা তিনজন হেসে কুল পাচ্ছে না। প্রান্তিক লাজুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে বউয়ের দিকে ফিরে চাইল। প্রিয়তা তাদের এখন ধমক দিয়ে বলল,

– চুপ করবি!

পূরবী হেসে বলে উঠলো, – আপা! ভাইয়া কি এতোই বড়লোক। আজ অবধি কখনো লুঙ্গি পরেনি?

প্রিয়তা আড়চোখে ফিরে বলল, – তুই শাড়ি পরেছিস কখনো?
পূরবী চুপসে গেল। আমরিশা হেসে বলে উঠলো, – কিন্তু ভাইয়া বেশি করছে। তাই বলে এভাবে বসে থাকবে! এটা হয় আদৌও!

প্রান্তিক এবার গলা ঝেরে কেশে উঠলো। বলল, শালিকা সাহেবা! আপনারা আমার কষ্ট বুঝতে পারছেন না।
– বুঝছি পারছি ভাইয়া। বলুন কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
– আপনাদের দৃষ্টির আড়াল করে। প্লিজ এভাবে তাকিয়ে থাকিয়েন না!
আরফিন মুখ টিপে হেসে বলল, আচ্ছা ভাইয়া।আমরা না হয় যাই এবার। পরে এসে আপনাকে একবার দেখে যাবো।
প্রিয়তা চাপাস্বরে বলল, – মশকরা করছিস!

হাসতে হাসতে তিনজন চলে গেল। প্রান্তিক বসে আছে বসার ঘরে সোফার উপর। একদম আঁটসাঁট বেঁধে।হাত দুটো লুঙ্গির গোছায়। প্রিয়তা এবার ভারী বিরক্ত হয়ে বলল,

– এমন কেন করছেন বলুন তো?
– তুমি আমার সমস্যা বুঝতে পারছো বউ!
– সমস্যাটা কি? লুঙ্গি তো আর খুলে পড়ে যাচ্ছে না।
– যাবে যাবে! আমার মনে হচ্ছে এই পড়ে যাবে। তখন আমার ইজ্জত বলে আর কিছু থাকবে না। এখানে প্রশ্নটা আমার ইজ্জতের!

বলেই মুখখানা লাল রইল বসে রইল। দরজার ওপার থেকে হাসির শব্দ আসছে। বোন তিনটে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ও হাসছে। প্রিয়তার এবার একটু কষ্টই যেন হচ্ছে বরের জন্য। ইশ! তার বর মশাই! বাড়িতে কি হালেই না থাকে। কখনো এসব পোশাক নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি। লোকজন আছে! তারা সময়মতো এসে শার্ট প্যান্ট সবকিছু ইস্ত্রি করে ঘরে রেখে যায়। সে কি আর বুঝবে এসব!

কলিং বেল বেজে উঠল। প্রিয়তা উঠে সেদিকেই গেল। তিন বোন আড়ালে থেকে উঁকি মারল। রাফি দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে। প্রিয়তা বলল,

– রাফি ভাই এসেছে। উঠে আসুন!
– আমি পারব না। তুমি জামাকাপড় নিয়ে আসো।

প্রিয়তা রাফির হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে প্রান্তিকের দিকে এগিয়ে দিল। প্রান্তিক লুঙ্গি গোছা ধরে সামলে উঠে ঘরের দিকে ছুটল। রাফি পিছন থেকে তাকে দেখেই চোখ কপালে তুলে ফেলল। স্যার লুঙ্গি পরে আছে! নাজেহাল অবস্থা একদম! আবারো একদফা হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল!

———

যেই শ্যালিকা তিনজন এতোক্ষণ হেসে হেসে ম‘রে যাচ্ছিল এবার তাঁরাই মুখ বন্ধ করে বিস্ময়ে সামনে চেয়ে রইল। তাদের ভাইয়া দেখতে এবার অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে। যে সে হ্যান্ডসাম নয়, মারাত্নক হ্যান্ডসাম। হা করে তাকিয়ে থাকার মতো। প্রান্তিক শার্টের হাতা কনুই অবধি গুঁজে ঘর ছেড়ে বের হলো। পরনে নীল রঙের পিচ্ছিল শার্ট ইন করা। ভেজা চুল গুলো কোনোরকম হাত দিয়ে পিছনে ফেলে রেখেছে। ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেখা। চোখে সানগ্লাস পরতে পরতে বলল,

– কি শ্যালিকারা। তৈরি তো!
পূরবী মুখ ফুটে বলেই উঠল, – আপনাকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে ভাইয়া।
প্রান্তিক তার গাল টেনে বললো, – আপনাকেও অনেক সুন্দরী লাগছে ম্যাম!

পূরবী লজ্জায় লাল হয়ে গেল। চৌদ্দ বছরের কিশোরী সে। আমরিশা দু হাত কোমরে রেখে বলল, – চলেন ভাইয়া। আজ তো আপনার পকেট ফাঁকা করে ছাড়ব।

প্রান্তিক বেপরোয়া ভঙ্গিতে জবাব দিল, – দেখা যাক। তার আগে দাঁড়াও , আমার বউ আসুক!

বলতে বলতে প্রিয়তা হাজির। ইচ্ছে করে মিলিয়ে নীল রঙের থ্রি পিস পরেছে সে। প্রান্তিক বুকে হাত রেখে বলে উঠলো, – আহ্! বুকে ব্যাথা করছে।

প্রিয়তা বোধহয় লজ্জা পেল। চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বোন তিনটে ভ্রু নাচিয়ে হাসছে। চোখ নামিয়ে ফেলল সে। থ্রি পিস পরার আরেকটা কারণ ও আছে। প্রান্তিকের একদম কড়া নিষেধ শাড়ি পরে বাইরে ঘুরাঘুরি করতে পারবে না সে। শাড়ি পরে তাকে দেখার অধিকার একমাত্র প্রান্তিক চৌধুরীর!

———–

বউ আর শালিকাদের নিয়ে প্রান্তিক চৌধুরী এসেছে মান্নাত ফফ্যাশনের শো রুমে। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটা মান্নাতের শো রুম। পুরো ঢাকাতেই তাঁর ৫ টা শো রুম আছে। ঢাকার বাইরে ও আছে বেশ কয়েকটা। তাঁর চিন্তা এবার দেশের বাইরে শো রুম খোলা। ব্যবসাটা কে বড় করতে হবে। তাঁর শো রুমে সবই মেয়েলী জিনিস। সবগুলোই তাদের নিজস্ব ডিজাইনার দিয়ে করা। এজন্য ব্যাপক চাহিদা।এবার ছেলেদের ব্যাপারটা নজরে রাখছে অবশ্য।

প্রান্তিক তাদের নিয়ে বন্ধুর শো রুমেই এলো। মান্নাত আগে ভাগেই জানত দেখে একটু ফিটফাট হয়ে আছে। প্রান্তিকের শ্যালিকারা আসবে বলে কথা। তারা ভিতরে ঢুকেই খানিকটা চমকে গেল। এতো বড় শো রুম। যেখানে তাকাচ্ছে রঙ বেরঙের পোশাক। প্রান্তিক একটু ভাব মিশিয়ে বলল,
– দেখো শালিকারা, চাইলে পুরো দোকান উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারো। না করব না!

আমরিশা হেসে বলল, – জো হুকুম ভাইয়া। আপনার কথাই শেষ কথা। আমরা আপনার বাধ্য শ্যালিকা। অমান্য কি করতে পারি বলুন!

মান্নাত এরই মধ্যে হাজির। প্রিয়তা কে দেখেই বড় করে একটা সালাম দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। প্রান্তিক ঠোঁট চেপে সেই হাত মিলাল। হাতটা শক্ত করেই ধরল। চোখ দিয়েই যেন বলছে, – হাত ধরবি শালা! তোমার গু‘প্ত জায়গায় এমন বারোটা বাজাবো না!

মান্নাত কোনোভাবে হাতটা ছেড়ে দিল। ব্যাপার খানা বুঝতে কারো বাকি নেই। আমরিশা বরাবরের মতো শব্দ করে হেসে ফেলল। এই মেয়ে আস্তে হাসতে পারে না। আফরিন গুঁতো দিয়ে তাকে চুপ করতে বলছে। মান্নাতের চোখ পড়ল তাঁর দিকে।

পরিচয় পর্ব শেষ হলো। মান্নাত জানতে পারল মেয়েটা প্রান্তিকের বড় শ্যালিকা। বেশ সুন্দরী! তাঁর চেয়েও সুন্দর তাঁর হাসির শব্দ। মান্নাত যেন প্রেম সাগরেই হেলদোল খাচ্ছে এখন থেকেই। সাথে দুজন মেয়ে কর্মচারী এলো। তারা সকলকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। মান্নাত সুযোগ পেয়ে প্রান্তিকের শ্যালিকাদের সাথেই গেলো। প্রান্তিক বউ কে নিয়ে গেল অন্যদিকে। বউকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এটাসেটা দেখাচ্ছে।

পূরবী আর আফরিন ড্রেস দেখতে ব্যস্ত। আমরিশা সেই কখন থেকে খেয়াল করছে একজোড়া চোখ তাঁর দিকে নজর দিচ্ছে। পাশের লম্বা, চওড়া ছেলেটা একটু বাদে বাদে তার দিকে চাইছে। খানিকক্ষণ আগেই জানতে পেরেছে লোকটা ভাইয়ার বন্ধু। তাই সাহস করে একটা ঝারি মার‘তে পারছে না। নাহলে এতোক্ষণে বুঝিয়ে দিত আমরিশা কি চিজ!

মান্নাত একটা থ্রি পিস আমরিশার সামনে ধরে বলল,
– মিস! এটায় আপনাকে ভীষণ মানাবে!

আমরিশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জামাটা সুন্দর। সাথেই এর দামটাও লেখা। ৮০০০ টাকা ড্রেসের নাম শুনে তার চোখ কপালে। বিস্ময় স্বরে বলল,
– এতো দাম!
– দাম নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না, মিস?
– মিস আমরিশা!
– আমরিশা! বাহ্ দারুণ নাম। তুমি এটা পরে দেখতে পারো। দারুণ মানাবে। দেখবে নাকি?

আমরিশা এবার চোখ মুখ কুঁচকে নিল। লোকটা হুট করে আপনি থেকে তুমিতে চলে গেল। কি মেয়েবাজ ছেলেরে বাবা। সে বলল,
– না না ভাইয়া। এতো পছন্দ হয়নি। রাখুন আরো কিছু দেখি।
ভাইয়া ডাকটা নেহাত পছন্দ হলো না মান্নাতের। কপাল কুঁচকে বলল, – প্লিজ কল মি মান্নাত। আমাকে তোমার ভাইয়ের মতো নাকি দেখতে?
– তা নয় তো কি? ভাইয়ের বন্ধু কে ভাইয়াই তো বলব তাই না।
– হ্যাঁ প্রেমে পড়ার আগে সব মেয়েরাই ছাইয়া কে ভাইয়া বলে। ব্যাপার না। চলো ওদিকে চলো।

আমরিশা কথাটা শুনে অসন্তুষ্ট হলো। এই লোক দিব্যি তার সাথে ফ্ল্যাটিং করে যাচ্ছে। কি অভদ্র!

পূরবী আর আফরিন বেশ অনেকক্ষণ ধরেই তাদের খেয়াল করছে। মাঝে মাঝে দুজন কথা বলে হাসছেও। মান্নাতকে দেখতে খারাপ না। দশজন পুরুষের মধ্যে একজন। তবুও আমরিশা তাঁর উপর চরম বিরক্ত।

আমরিশা জামা রেখে জুতো দেখছে। জুতোর কালেকশন সুন্দর। একটা জুতো পছন্দ করে হাতে নিল। অমনি মান্নাত তার হাত থেকে জুতোটা নিয়ে তাকে একটা টুলে বসিয়ে দিল। বেশ যত্ন নিয়ে তার পায়ে জুতোটা পরিয়ে বলল, – বাহ্! বেশ মানিয়েছে তো তোমার পায়ে জুতোটা!
আমরিশা এবার খুঁত খুঁত করছে। বলে উঠলো,
– না পছন্দ হয়নি?
– আচ্ছা বসো। আরেকটা দেখাই।
– না না দরকার নেই। এটিই দিন।
মান্নাত উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে বলল, একটু হেঁটে দেখো।

আমরিশা নিজেই উঠে দাঁড়ালো। একটু হেঁটে জুতোটা খুলে বলল, দিয়ে দিন।
মান্নাত ফিসফিসিয়ে বলল,
– তুমি কি রেগে আছো নাকি?
আমরিশা জবাব না দিয়ে এদিক ওদিক তাকালো। তার দুই বোনই দূরে দাঁড়িয়ে। কি অসভ্য মেয়ে দুটো। বোনকে একা ফেলে দূরে চলে গেল। মান্নাত আগ বাড়িয়ে আবারো বলল,
– মনে হচ্ছে তুমি খুব বিরক্ত হচ্ছো?
– জি, আপনি মুখটা বন্ধ করলে একটু খুশি হতাম।

মান্নাত মুচকি হাসল। সত্যি সত্যি আগ বাড়িয়ে সে আর একটি কথাও বলল না। আমরিশা তাজ্জব বনে গেল।

কেনাকাটা শেষে যাবার পথে প্রিয়তা আগে ভাগেই গাড়িতে গিয়ে বসে আছে। তারা আঁচ করতে পারল এদের মধ্যে আবারো অভিমান হয়েছে। এই ছোট ছোট অভিমান দেখে আমরিশার ভালো লাগছিলো। সে মিটি মিটি হাসছে ভাইকে দেখে। কতো কষ্ট করছে আপার রাগ ভাঙানোর জন্য। ইশ্, আপা কি লাকি!

এরই মধ্যে হাতের ছোঁয়া পেয়ে চমকে উঠল সে। তাঁর হাতে একটা প্যাকেট দেখা যাচ্ছে। মান্নাত প্যাকেট টা হাতে ধরিয়ে দূরে সরে গেল। বলল, – জামাটা সত্যিই তোমাকে ভীষণ মানাবে।

– কিন্তু আমার তো দরকার নেই।

– রেখে দাও। আমার তরফ থেকে ছোট একটা গিফট!

বলেই ভিতরে ঢুকে গেল মান্নাত। আমরিশা প্যাকেটের মধ্যে তাকাতেই চক্ষু ছানাবড়া। ছোট গিফট! ৮ হাজার দামের ড্রেস। লোকটার টাকা কি পাখনা গজায় নাকি। আমরিশা ভেবেই নিলো ফেরত দিয়ে আসবে। এরই মধ্যে সকলের ডাকাডাকি পড়ে গেল। সকলে গাড়িতে উঠে তাকে ডাকছে।

– কি গো শ্যালিকা! দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! আসেন এবার!

আমরিশা চলে এলো। ড্রেস আর ফেরত দেওয়া হলো না তার। ড্রেসটা তারও পছন্দ হয়েছে কিন্তু তাই বলে এভাবে নিয়ে নিবে না সে।কিছুদিন পর এসে টাকা দিয়ে যাবে। এই ভেবেই চলে গেল সে।

——–

প্রান্তিক চৌধুরী পড়েছে মহাবিপদে। দু’দিন ধরে বউ তার কথা বলছে না। কাছেও আসছে না। সব হয়েছে রিয়ার জন্য। সেদিন শো রুমে এতো গায়ে পড়ে কথা বলছিলো যে তাঁর বউ পাখি রেগে মেগে একদম ফা‘য়ার। আদর সোহাগ তো দূর, মুখে যেন কুলো পেতেছে। কোথায় ভেবেছিল শ্বশুর বাড়ি থেকে ফেরার পর বউ তাকে কাছে ডেকে নিবে কিন্তু না তা হচ্ছে না। ভাগ্য যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে। বাড়িতে আজ ঢুকতেই বউ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আছে। প্রান্তিক চৌধুরী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। কি করা যায় তাই ভাবছে। মনে হচ্ছে, বাকি জীবনটা তাঁর বউয়ের রাগ ভাঙাতেই যাবে।

#চলমান