#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১২]
~আফিয়া আফরিন
খালামণির বাসার সামনে এসে সামির বাইক থামাল। নাবিলা অনেকবার করে ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে আসতে বলল। সামির অবশ্য না বলে দিল। এখন মনে হয় ওর মন-মেজাজ ঠিক আছে। কথাবার্তা একটু আগের আবহাওয়ার সাথে মিল খাচ্ছে না। সামির ঘুরল, বিদায় নিয়ে একমুহূর্তে মিলিয়ে গেল অন্ধকার রাস্তায়। নাবিলা দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভাবছিল, এই মানুষটা আসলে কেমন? ওর সাথে সদ্য রাগারাগি করা সামির, আবার ওকেই নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া সামির… দুটো মানুষ, নাহ মানুষ একটাই কিন্তু দু’টো রূপ। তার সবকিছুই একরকম বৈপরীত্যে ভরা।
নাবিলার ভেতরে একটু খচখচানি রয়ে গেল। যতই ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে আসতে বলুক, মনে হয়েছিল, যদি সামির সত্যি ভেতরে আসত তাহলে সবটা একটু অন্যরকম হতো। কিন্তু না, সামির চলে গেছে। আর নাবিলা এক ফাঁকা অনুভূতি নিয়ে দরজার ভেতরে ঢুকে গেল। রুমে ঢুকেই বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। মাথার ভেতর নাগরদোলার মত একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছে, সামির। যতই নিজেকে বুঝিয়ে দূরে রাখতে চায়, ততই ছায়ার মতো ভর করে বসছে।
— “কেন ওর কথাই মাথায় ঘুরছে?” নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করল নাবিলা। উত্তর নেই। শুধু বিরক্তি জমে উঠছে ভেতরে। কখনও মনে হচ্ছে, সামির আসলেই একগুঁয়ে, একেবারে অসহ্য মানুষ। আবার পরক্ষণেই মনে হয়, তাহলে কেন ওর বাইকে বসে থাকা সময়টা এত আলাদা লাগছিল? কেন ওর চোখের সেই একঝলক দৃষ্টি এত ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল?
চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল নাবিলা। যতই চাইল মনটা শান্ত করতে, সামিরের কথাবার্তা, আচরণ, এমনকি গায়ের ঘ্রাণ পর্যন্ত একে একে ফিরে আসতে লাগল। নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।
— “কি হচ্ছে আমার? আমি কেন ওর কথা ভাবছি বারবার?” কথাটা বলেই বালিশ মুখের ওপর চাপা দিল। তবুও ভাবনাগুলো থামল না।
বাইক পার্ক করে বাড়ি ফেরার পথে সামির সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া টানার চেয়ে বেশি ধোঁয়া উঠছে মাথার ভেতর থেকে। সে ভেবেছিল আজ একটু বোঝাপড়া করা দরকার। যেহেতু একসাথে থাকতে হবে, তাই আগে থেকেই কিছু সীমারেখা জানিয়ে দেওয়া ভালো। তার ব্যক্তিগত জীবনে অন্য কেউ হস্তক্ষেপ করুক, সেটা সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না। এইজন্যই নাবিলাকে ডেকেছিল। ভালোভাবে কিছু কথা বলবে, একধরনের সমঝোতা তৈরি করবে। কিন্তু সেই শান্ত-ভাবনাই ভেস্তে গেল এক কথায়। কামিনী… নামটা শোনার পর থেকেই মাথার ভেতর রাগে আগুন ধরল।
সামির চাইলেই সবটা এক্সপ্লেইন করতে পারত। কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রয়োজনবোধ করল না। প্রয়োজন হলে একদিন বলবে, কিন্তু আজ নয়। কারণ সবকিছুর জবাব দেওয়া মানেই নিজের মতো করে তুলে রাখা দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলা। আর সে কেনই বা কৈফিয়ত দেবে? নাবিলাকে কেন তার অতীত নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে? এতটা গুরুত্ব সে এখনও সামিরের জীবনে পায় নাই।
কামিনী ওর জীবনের একটা বিরক্তিকর অধ্যায়। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আচমকা ওই সময়টা ধোঁয়ার সাথে কুণ্ডলী পাকিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল…
বছর দুয়েক আগে।
কামিনীর সাথে পরিচয়টা হঠাৎ। বন্ধুর জন্মদিনে প্রথম দেখা। সামির তখনও তেমনভাবে সিরিয়াস কিছু ভাবেনি কিন্তু মেয়েটার ভেতরে একধরনের দাপট, প্রাণোচ্ছলতা আর ঝকঝকে হাসি সামিরকে চুম্বকের মতো টেনে নিল। কামিনী হাসতে জানত, গল্প করতে জানত। একটু ভিন্নরকম প্রাণবন্ত মেয়ে; যা সামিরের কড়া, সিরিয়াস স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মেলে না অথচ মেলে না বলেই মনে হলো ওকে দরকার।
অল্প দিনেই দু’জনের কথাবার্তা একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়ল। দু’জনেই সমবয়সী। প্রথম দিকে সবকিছুই মিষ্টি ছিল। সামির পছন্দই করত কামিনীর খোলামেলা হাসি, মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার গুণ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ওই গুণটাই দুর্বলতায় পরিণত হলো। সামির একেবারে রক্ষণশীল। কারো সাথে অতিরিক্ত হাসাহাসি, অকারণ গল্প করা ওর ভালো লাগত না। আর কামিনী ঠিক উল্টো; বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা, অনর্গল গল্প, ছেলে-মেয়ের কোনো ভেদাভেদ নেই। প্রথমে সামির সামলানোর চেষ্টা করল। বলত,
— “তুমি একটু কম হাসতে পারো না? সবার সাথে এত খিলখিল করতে হবে?”
কামিনী ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসত। ধীরে ধীরে এটাই ঝগড়ার কারণ হলো। সামিরের রাগ, কামিনীর জেদ, দু’জনের ইগো প্রতিদিনই একটু একটু করে ফাটল ধরাচ্ছিল সম্পর্কটাতে। সামির এসব দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। তবুও সহজ থাকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আর কত? একদিন মাথা গরম করে বলেই ফেলল,
— “আমি হাজারবার বলেছি, আমি এসব পছন্দ করি না।”
কামিনীও থেমে থাকল না,
— “আমি কি তোমার স্বেচ্ছায় চালিত রোবট সামির? আমি নিজের মতো চলব। আমার হাসি-খুশি থাকা যদি তোমার কাছে সমস্যা হয়, তাহলে এই সম্পর্কের দরকার কী?”
কথাটা তীরের মতো বিঁধল সামিরের ভেতরে। উত্তর দেওয়ার বদলে শুধু বলল,
— “তাহলে থাকো তোমার মতো।” ওই ‘থাকো তোমার মতো’ কথাটা দু’জনের মাঝের সেতুটা ভেঙে দিল। আর কোনোদিন জোড়া লাগল না। সামির ভেবেছিল, হয়তো সময়ের সাথে ভুলে যাবে। আর যখন ভুলতে বসল তখন ওই মেয়েটা তার ভাইয়ের বউ হয়ে এলো। তাই নাবিলার মুখে যখন “মিসেস কামিনী” কথাটা শুনেছিল, তার মনে হয়েছিল কেউ পুরনো ক্ষত জাগিয়ে দিয়েছে। ওর রাগটা নাবিলার ওপর নয়, নিজের অতীতের ওপর। কামিনীর ব্যাপারে ও কখনোই কাউকে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, দেবেও না। নাবিলা হয়তো মজা করে খোঁচা মেরে বলেছে কিন্তু সামিরের কাছে ওই উচ্চারণটাই অসম্মান। এটা তার ইগো মেনে নিতে পারে না।
বাড়ির কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই সামির অন্বেষাকে দেখতে পেল কারো বাইকের পেছনে। হেলমেটের কারণে মানুষকার মুখ দেখা গেল না কিন্তু বাইকটা সামির ভালো করেই চিনে। এটা শাহিদ ভাই। উনার সাথে অন্বেষার কি?
নাবিলা কিংবা সামির, দু’জনের কেউ-ই জানে না তাদের সম্পর্কের গতিপথ কোথায় গিয়ে ঠেকবে। নাবিলা ভাবে, এই মানুষটার সাথে থাকা মানে অনিশ্চয়তার সাগরে ভেসে যাওয়া। সামির ভাবে, এইরকম কান্ড-জ্ঞানহীনের সাথে তার সারাটা জীবন চলবে কি করে? ভবিষ্যৎটা ঝাপসা। কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ জানে না; হয়তো আরও দূরে, হয়তো আরও কাছে।
.
নাবিলার পরীক্ষার পালা শেষ। এবার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। নাদিমকে রেখে এসেছে বাবার সাথে, ও আর থাকতে চাচ্ছে না একলা। আবার আসতেও পারবে না, পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়েছে। ঢাকায় কাটানো কয়েকটা দিন একেবারেই অন্যরকম ছিল। সকাল-বিকেল পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও, ফাঁকে ফাঁকে পরিবার-পরিজনের সাথে ঘোরাফেরা, আড্ডা, হৈচৈ; সবকিছুতে দারুণ সময় কেটেছে। প্রায়ই রেশমা আন্টি এসে দেখা করতেন। ওনার সাথে কথা বলতে গেলেই মনটা হালকা হয়ে যায়। কী সুন্দর করে, কী আন্তরিক ভঙ্গিতে উনি কথা বলেন! বারবার নাবিলাকে “মা” সম্বোধন করে ডাকেন, সে ডাকে একটা অদ্ভুত শান্তি আছে। মুহূর্তের জন্য হলেও নাবিলা ভুলে যায় তার ভেতরে কতটা দোলাচল, দ্বিধা আর অস্থিরতা। আজ বিকালেও আন্টির সাথে কথা হচ্ছিল। কথার একপর্যায়ে তিনি বললেন,
— “দেখো মা, তুমি আমার ছেলের জন্য একটা বিশেষ মানুষ। আমি তাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি দেখেশুনে রাখবে, ঠিক আছে?”
নাবিলা ইতস্ততবোধ করে বলল,
— “আমি চেষ্টা করব, আন্টি। যতটা সম্ভব ভালোভাবে…”
রেশমা আন্টি হেসে কাঁধে হালকা হাত রাখলেন,
— “আমি জানি তুমি করবে। এই সম্পর্ক শুধু আজ-কালের নয়। ফিরে গেলেও দুজনের মধ্যে যোগাযোগ রাখবে। তুমি যতটা খেয়াল রাখবে, ততটা সামির নিজের পথে ঠিকভাবে চলতে পারবে। সম্পর্ককে বোঝা, সময় দেওয়া এবং একে অপরের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া খুব জরুরি। কখনো কখনো ছোট ছোট ভুল বা মতপার্থক্য হতে পারে, তবে তা মেনে নিতে পারা, বোঝাপড়া করাই সম্পর্ককে শক্ত করে।”
— “বুঝেছি আন্টি।”
উনি জিজ্ঞেস করলেন,
— “আমার ছেলেটাকে কি খুব খারাপ লাগে?”
নাবিলা তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল,
— “না আন্টি, ঠিক আছে।”
— “সামিরের একটু মেজাজ গরমের ধাত আছে এটা আমি জানি। কিন্তু ওর উপর তুমি ভরসা রাখতে পারো, বিশ্বাস রাখতে পারো। কিছুটা হলেও ওকে পরিবর্তন করতে পারবে তবে সম্পূর্ণ নয়। কারণ, কেউ কারো জীবন সম্পূর্ণভাবে বদলাতে পারবে না কিন্তু একে অপরের সাথে চলার পথে সমঝোতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর শোনো সম্পর্ক মানে শুধু ভালো মুহূর্ত নয়, চ্যালেঞ্জও আছে। সবকিছু মোকাবেলা করতে হবে। বুঝেছ মা?”
নাবিলা অনেকটা অভিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ায়,
— “বুঝেছি আন্টি। আমি চেষ্টা করব সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে নেওয়ার।”
হুমম… নাবিলা চেষ্টা করতেই পারে। তবে তার চেষ্টা সফল হবে কিনা সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে সামিরের উপর। ও এখন কী ভাবছে কে জানে? ভালোভাবে তো কথা বলতেই জানে না। সবসময় নাকের ডগায় ইগো নিয়ে ঘোরে। এমন মানুষ চেষ্টার মর্ম বুঝবে? নাবিলার চিন্তা হয়…
নাবিলারা যেহেতু দু’দিন পর ফিরে যাবে, তাই আরেকবার অন্বেষাদের সাথে দেখা করার ইচ্ছে হলো। পরদিনই সময় আর জায়গা ঠিক হয়ে গেল। অন্বেষা, আয়ান, রায়হান আর হয়তো কামিনীও আসবে। সামির আসবে কিনা পরিষ্কার জানায় নাই।
সেদিন দুপুর নাগাদ নাবিলার ফোন বেজে উঠল। ওপাশে অন্বেষার জরুরী কণ্ঠ,
― “তোমার স্বামী এমন ভং ধরছে কেন? এত করে বলছি, তাও যাচ্ছে না।”
নাবিলা একটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
― “ওই এমনই। বেশি ত্যালালে পাত্তা দেয় না। তুমি রেখে চলে আসো। দেখবা, ঠিকই সুরসুর করে পিছে লাগবে।”
অন্বেষা হৈহৈ করে উঠল,
― “তুমি ঠিকই বলেছ। সামিরকে একমাত্র তুমিই ভালো চিনেছো।”
অন্বেষা সামিরের ঘরেই ছিল। ফোনও লাউড স্পিকারে দেওয়া ছিল। সামির সবটাই চোখ বন্ধ করে শুনলো। এই মেয়েটা প্রতি পদে পদে তাকে অপমান করছে। সামির ভুরু কুঁচকে বলল,
― “ঠিকই আছে, নিজে যেমন আরেকজনকে ওইরকম মনে করে।।” অন্বেষা ওর পিঠে ধুরুম করে একটা কিল বসিয়ে দিল।
বিকালের আসরে তখন জমজমাট পরিবেশ। অন্বেষা, আয়ান আর রায়হান মিলে এমন গল্প জমিয়েছে যে হো হো করে হাসি থামছেই না। এরইমধ্যে মাঝেমাঝেই নাবিলাও যোগ দিয়ে মজার মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে।
কিন্তু পুরো ঘরে দুটো মুখ আলাদা ছায়ার মতো বসে আছে। একদিকে সামির ইয়াসির, অন্যদিকে কামিনী। দু’জনের চোখে-মুখে টানটান গাম্ভীর্য, ঠোঁট বোধহয় সিল মেরে রাখা হয়েছে। মাঝে মাঝে কেউ কারো দিকে তাকালেও, দৃষ্টি মিলতেই সঙ্গে সঙ্গে সরে যাচ্ছে।
নাবিলা সেদিকেই বারবার তাকিয়ে নিজের হাসি চাপতে চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, হাসলে ভদ্রতার বাঁধন ভেঙে যাবে। ঠোঁট কামড়ে কোনোভাবে তা আটকাচ্ছে। এইমুহূর্তে ওদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে, ওদের একসাথে বসিয়ে রাখা মানে এক গ্লাস লেবু আর দুধ একসাথে মিশিয়ে দেওয়া। মানাবে না, মানাবে না… তবুও জোর করে মানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে সবমিলিয়ে সময়টা দারুণ কেটেছে। একটা দিক অবশ্য চোখে লেগেছে, সেটা হচ্ছে সামির। ভিড়ের মাঝেও আলাদা একটা রেখা টেনে রেখেছে সে। নাবিলার সাথে তো বিশেষ কোনো কথাই হয়নি।
কথা হবে কী করে? তার তো ভাবই আলাদা। মুখে হাসি নেই, কথায় উষ্ণতা নেই। নিজের চারপাশে দেওয়াল তুলে রেখেছে। ভাবের রাজা, একেবারে ভাবের রাজা। তবুও অদ্ভুতভাবে, সেই ভাবের দেওয়ালের ওপার থেকেও সামিরের উপস্থিতি নাবিলার চোখ এড়ায়নি। যতই সে উপেক্ষা করতে চেয়েছে, মনে হয়েছে মানুষটা তার ভেতরের কোথাও অদ্ভুত এক ছাপ রেখে যাচ্ছে।
.
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন… দিন না বলে মাস বলাই ভালো। সময় বয়ে চলে গেছে নদীর জলের মতো অথচ নাবিলা যেটা চায়নি, সেটাই ওর সাথে ঘটতে চলেছে। আসলে চায়নি তো বটেই, কিন্তু মনের অগোচরে না বলার পরও ভেতরে ভেতরে একটু একটু করে চেয়েছিলও। নিজের কাছে সেটা স্বীকার করতে লজ্জা লাগত।
জগন্নাথে ওর চান্স হয়ে গেছে। সবাই উচ্ছ্বসিত। এবার আর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই, পার্মানেন্টলি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পালা। বাসায় ইতোমধ্যে কথাবার্তা চলছে। বিদায় অনুষ্ঠানের তারিখও প্রায় ঠিক হয়ে গেছে।
এই কয়দিনে নাবিলার মাথায় একটাই মানুষ অযথাই ঘুরপাক খেয়েছে, তার ভাবের রাজা। কেন এমনটা হচ্ছে, তা নিজেও বোঝে না। যতই ভুলতে চেয়েছে, মনে মনে অজান্তেই ওকে টেনে এনেছে; একেবারে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে। প্রায় সময় মনে হয় ও না থেকেও থাকে, দূরে থেকেও কাছাকাছি।
ভুলবশত সেদিন সাবিহাকে ফোন দিতে গিয়ে সামিরকে ফোন দিয়ে ফেলেছিল নাবিলা। সাবিহার বদলে যে সামিরের কাছে কল চলে গিয়েছিল সেটা খেয়াল করল না। ওপাশ থেকে ভেসে এলো চেনা পুরুষালী কণ্ঠ। মুহূর্তেই বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। জিভ কেটে থমকে গেল নাবিলা। এটা কি করে হলো? ফোন করলো একজনকে আর গেল আরেকজনের কাছে? ম্যাজিক নাকি? ওয়েট ওয়েট… ওরা কি একসাথে আছে? কিন্তু কেনো? গোলমেলে ভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থায় সামিরের গমগমে কণ্ঠ আবার ভেসে এলো,
—“চুপ থাকার জন্যই কি ফোন করেছ?”
আচমকা ধরা পড়া ছাত্রীর মতো নাবিলা হকচকিয়ে গেল। অজান্তেই ঠোঁট নড়ে উঠল। তারপর কথা হলো… কীভাবে শুরু হলো, কখন শেষ হলো, নিজেও বুঝতে পারেনি। দু’জনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো, তবে সেটা কেমন ধরনের, কী কথা; পরে অনেক মনে করার চেষ্টা করেও কিছুই আর মনে করতে পারেনি। শুধু মনে ছিল সেই কণ্ঠের গম্ভীরতা, মাঝে মাঝে অকারণ হাসি আর স্বস্তি মেশানো অদ্ভুত টান।
দুই বাড়িতেই এখন উৎসবের আমেজ। সাজসজ্জা, অতিথিদের কোলাহলে চারপাশ মেতে আছে বিয়ের রঙে। তবে যাদের নিয়ে এই আয়োজন, সেই নাবিলা আর সামির পুরো ভিন্ন জগতে বিচরণ করছে। নাবিলা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প করছে, আড্ডা দিচ্ছে, কখনও খিলখিল হাসছে, আবার কখনও একপাশে চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে নতুন জীবনের কথা মাথায় আসে। নতুন পরিবেশ, নতুন পরিবার, মানিয়ে নেওয়া… কিন্তু সে পাত্তা দেয় না। ভাবে, “যা হবে দেখা যাবে।”
সামিরের অবস্থা আলাদা। বাইরে সে নির্লিপ্ত, চিরাচরিত ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে নাবিলাকে নিয়েই ভাবছে। তবে ভাবনাটা মোটেও ইতিবাচক নয়। এই মেয়েটা যে তার জীবন একেবারে তেজপাতা বানিয়ে ছেড়ে দেবে, এটা নিশ্চিত। মাঝে মাঝে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করে। তবে একটা জিনিসে সামির একটু স্বস্তি খুঁজে পায়, এক বছরের মধ্যেই সে দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তখন আর এসব অশান্তির ধার ধারতে হবে না। সে দেখতেও আসবেনা, জানতেও আসবেনা, বুঝতেও আসবেনা; থাকবে নাবিলা নিজের মত।
অবশেষে সেই বিশেষ দিনটা এসে গেল। চারপাশে গানের সুর, উচ্ছ্বাস, হাসি-কান্না, আতিথেয়তার ব্যস্ততা’সহ অন্যরকম পরিবেশ। নাবিলা শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে একমুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকাল। সামিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল কিছুটা দূরে। অফ-হোয়াইট শেরওয়ানি তার ব্যক্তিত্বকে পুরোপুরি মেলে ধরছিল, আর মাথায় পাগড়ি আরও গম্ভীর এবং আভিজাত্যপূর্ণ করে তুলেছিল। ভিড়ের মাঝেও সামির অস্বস্তিতে, কিন্তু চোখদুটো বরাবরের মত তীক্ষ্ণ ও স্থির। আজ ঠোঁটের কোণে অবশ্য সামান্য একটু হাসি আছে। এক পলকেই চোখে চোখে ধরা পড়ল দু’জন। নাবিলা দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলেও, সেই দৃষ্টি বুকের মধ্যে গিয়ে আটকে রইল। অকারণে বুক ধড়ফড় করতে লাগল। ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়ে উঠল নিজের উপর
—“আমি কেনো ওই ভাবের রাজার দিকে তাকালাম? ও তো এখন আমায় হ্যাংলা ভাববে।”
সামির থেমে নেই। ভিড়ের ফাঁক গলে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। মাঝেমাঝে নাবিলার চোখের কোণায় তার চোখ আটকে যাচ্ছে। নাবিলা যতই এড়িয়ে যেতে চাইছে, ততই সেই দৃষ্টি তাকে ঘিরে ফেলছে। কোনো কথা নেই অথচ অনেক কিছুই বলা হয়ে যাচ্ছে চোখে চোখে…
নাবিলা আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সামির ভ্রু সামান্য উঁচু করে খোঁচা মেরে বোঝাচ্ছে,
— “শখ করে সেজেগুজে এসেছো, তাই তো? দেখে নিও, আসল ঠেলা এখনো বাকি।”
নাবিলাও ঠোঁটের কোণ সামান্য বাঁকিয়ে চোখের দৃষ্টিতেই পাল্টা উত্তর দিল,
— “তুমিও শীঘ্রই বুঝবে কত ধানে কত চাল।”
সামির ভ্রুকুটি করল,
— “হাসো হাসো, যত পারো এখনই হেসে নাও। পরে সেই সুযোগ নাও আসতে পারে।”
নাবিলা ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি লুকিয়ে চোখে চোখে পাল্টা খেলায় নামল,
— “সামির ইয়াসির তুমি আমাকে এখনও চেনো নাই। তুমি কি ভাবছ, আমি কাঁদব বা ভয়ে কুঁকড়ে থাকব?”
সামিরের চোখে তখন একরোখা তাচ্ছিল্য। হালকা খোঁচা দিল,
— “না না আমি শুধু দেখব, কতদূর তুমি সহ্য করতে পারো।”
নাবিলা চুপচাপ সামান্য কাঁধের লাইন বরাবর চোখ বোলাল,
— “আমার সহ্য শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করা মানে নিজের বিশ্বাসের উপর আছাড় খেয়ে পড়া। পালটা ঠোকা দিতে আমি পিছপা হবো ভেবেছ?”
সামির অবশ্য আর কিছু বোঝানোর সুযোগ পেল না। তার আগেই আহির, নাদিম, শ্রেষ্ঠা এবং অন্যান্য কাজিনেরা দুলাভাই করতে করতে হামলে পড়ল। দু’জনকে পাশাপাশি দাঁড় করাল। লাল শাড়ি পরা নাবিলার পাশে দাঁড়িয়ে সামিরকে আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। রঙের বৈপরীত্য শুধু চোখে ধরা দিচ্ছিল না বরং বর-কনে দু’জনই সমানভাবে দৃষ্টি কাড়ছে।
বিদায়ের মুহূর্তে নাবিলা নিজের ভেতরের আবেগগুলো সুন্দরভাবে সামলে রেখেছিল। চোখে সামান্য জলের ঝিলিক ছিল কিন্তু চেহারায় কোনো ভারী দুঃখের ছাপ ছিল না। সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসে মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নিল, তারাও নির্দ্বিধায় মেয়েকে তুলে দিল। শান্ত চিত্তে রওনা হয়ে গেল শ্বশুরবাড়ি… যেখানে নিজের ইচ্ছার সঙ্গে পুরোপুরি এক হয়ে নতুন জীবনকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। ভাবের রাজার সাথে এমনটাই চুক্তি হয়েছিল তার।
ওই বাড়িতে গিয়ে বাসর ঘরে ঘটল আরেক কাহিনী। যেখানে স্বয়ং সামির ইয়াসির আর নাবিলা ইবনাত উভয়েই উপস্থিত সেখানে ঘটনা না ঘটলে আর কোথায় ঘটবে?
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৩]
~আফিয়া আফরিন
ঘটনাটা সত্যিই অন্যরকম। বাসর রাত, সবাই যেখানে একরকম টানটান উত্তেজনা নিয়ে থাকে, সেখানে নাবিলা ওর দুষ্টু মেজাজ নিয়ে অন্য প্ল্যান সাজাল। কুবুদ্ধিটা প্রথম এসেছিল অন্বেষার মাথা থেকে। কথাটা শোনার পর নাবিলা অবাক হয়েছিল, তারপর হেসে গড়িয়ে পড়ল। এরপর থেকে ওরমধ্যে একরকম সাসপেন্স কাজ করছে। কিন্তু মূল মুশকিলটা হলো, নকল বউ সাজানো। কাকে বসানো হবে নাবিলার জায়গায়? এই ব্যাপারে কাউকে রাজি করানো যুদ্ধের মতো কঠিন হয়ে গেল। নাকে তেল দিয়ে কেউ বসে নেই যে, হুট করেই বললেই শাড়ি, গয়না আর একহাতি ঘোমটায় সেজে বসে থাকবে। অনেক ঘ্যানঘ্যান, অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়েই অবশেষে এক মক্কেলকে রাজি করানো গেল। শর্ত একটাই, বাড়ির বড়রা কেউ যেন টের না পায়। আর ব্যাপারটাও মজা হিসেবে স্মৃতি হয়ে ওদের মাঝেই থাকবে।
আগত অতিথিদের বউ দর্শনের ধুমধাম শেষ হলো। চারদিকে হাসাহাসি, গল্পগুজব, শুভেচ্ছা বিনিময় সব শেষ করে ধীরে ধীরে সবাই যখন ঘুমের আয়োজন করছে, তখনই আসল নাটকের পর্দা উঠল। এতক্ষণ নাবিলা নিঃশ্বাস চেপে, হাসিমুখে সকলের সাথে কথা বলছিল। মনে মনে যে একটু বিরক্তবোধ করছিল না তা নয়… করছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। মা আসার সময় পইপই করে বলে দিয়েছেন,
— “খবরদার নাবিলা, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করবি না ভুলেও। নতুন বউ, সবাই দেখতে আসবে। মুখটায় হাসি রাখবি। আমি যদি উল্টাপাল্টা কিছু শুনেছি না তবে গিয়ে মাইর দিব।”
এদিকে সামিরকে ওর বন্ধুরা ইচ্ছে করেই আটকে রাখল। এমনভাবে আলোচনা করছে যে, খুব শীঘ্রই ওদেরও বিয়ে। এখন বন্ধুর কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়াটা বড্ড জরুরী। আর ওদিকে নাবিলা আর অন্বেষার ফন্দি চালু হলো। নাবিলা নিজের মুখ চেপে হাসি আটকাচ্ছে, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক। মনটা উচ্ছ্বসিত, কী প্রতিক্রিয়া হবে সামিরের? বোকার মতো চমকে উঠবে নাকি রাগে গর্জে উঠবে? সামির যে কী করবে? ওর মতিগতি বোঝা দায় তবে এই থ্রিলটাই নাবিলার মনে সবচেয়ে মজার মনে হচ্ছে।
রাত তখন একটা পার হয়েছে। স্বভাবতই আজকের দিনে সামিরের ঘরটা ফুলে সজ্জিত এবং তার নববধূ ঘরে অপেক্ষায় আছে। রাতের অন্ধকার সবমিলিয়ে ঘরটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সামির যখন দরজা খুলল, বিছানার উপর ছড়ানো শাড়ির আঁচল আর একহাত ঘোমটা দিয়ে বসে থাকা নাবিলাকে দেখল, চোখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৌতূহলে বড় হয়ে গেল। সামির স্বাভাবিকভাবে বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
— “আশ্চর্য, এরকম সেজে পাট রানীর মত আমার বিছানায় বসে আছো কেন? দেখতেই কেমন লাগছে। এত বড় ঘোমটা দিয়ে বসে থাকার কি মানে? তোমাকে আমি আগে কখনো দেখি নাই নাকি?”
ঘোমটার নিচ থেকে চিঁচিঁ কণ্ঠ বের হলো,
— “ওটা তো তোমার কাজ। এসে আমার ঘোমটাখানা তুলে দাও প্রাণপ্রিয় সোয়ামি।” কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে অল্প একটু লজ্জা আর অমোঘ দুষ্টুমি মিশে আছে।
সামির কৌতূহলবশত এগিয়ে এলো। চোখে চাহনি আর মুখে বিস্ময়, এটা কে? এভাবে কথা বলছে কেনো? গলায় কি হয়েছে? সামির জিজ্ঞেস করল,
— “তোমার গলায় কি হয়েছে?”
তার হাসিতে চেপে ধরা গলায় সামান্য কাঁপন,
— “বিয়ের অতি উত্তেজনায় গলা ভেঙ্গে গেছে।”
সামির তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
— “ভাগ্যিস কোমর ভেঙে যায় নাই।”
সে কথাটা বলতে না বলতেই কানে এসে ভেসে উঠল চিৎকারের মতো,
— “ছিঃ এসব কি বলো? বাসর রাতে রোমান্টিক কথা বলতে হয়, জানো না? বন্ধুরা শিখিয়ে দেয় নাই?”
সামিরের ঠোঁটের এককোণে ভাঁজ খেলে গেল। তারস্বরে চিৎকারের মতো বলল,
— “হোয়াট রাবিশ! তোমার সাথে আমি রোমান্টিক কথাবার্তা বলব? ইমাজিন’ই করতে পারছি না। অসম্ভব ব্যাপার-স্যাপার।”
নাবিলা ঘোমটা সামলাতে সামলাতে হেসে উঠল। ওর হাসির আওয়াজটা অন্যরকম। এইভাবে কি আগে কখনো হেসেছিল, কথাও তো বলে নাই। আজ কি তবে গলা ভেঙ্গে গেছে বলেই? হতে পারে… কিন্তু একটু আগেও তো ঠিকঠাক ছিল। ভাবতে ভাবতেই কণ্ঠস্বরটা বলে উঠল,
— “ইমাজিন করতে পারছ না কেনো? তুমিই ভাবো তো, আমি এইভাবে সেজে বসে আছি আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে। তোমার আমার খাতিরে আজ একটু প্রেমের আলাপ-সালাপ তো হতেই পারে। এইটুকু কি আমি তোমার কাছ থেকে আশা করতে পারি না?” বেশ কাঁদো কাঁদো শোনালো গলাটা।
সামিরের ভালো লাগলো না। মানে মতিগতি কীরকম যেন লাগছে। সে দ্রুত পা বাড়িয়ে নববধূর সামনে এসে দাঁড়াল। এক হাত বাড়িয়ে ঘোমটা তুলে দিল। ঘরের বাতাসে একমুহূর্তের জন্য স্থিরতা নেমে এলো। সামির হঠাৎ চমকে উঠল, চোখ বড় করে বিস্ময়ে তাকাল। সে বিস্মিত, হতবাক, বিস্ময়িত, হতচকিত, হতভম্ব, স্তম্ভিত… শেষ কবে এইরকম অবাক হয়েছে মনে পড়ছে না আদৌ কখনো হয়েছিল কিনা সেটাও ভাববার মত বিষয়। মনে মনে বলল, “এ কেমন কনফিউসিং নারী, যার গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।”
ঘটনার আকস্মিকতায় আয়ান হেসে উঠলো। সামিরকে এতক্ষণ বেশ ভালো বোকা বানানো গেছে। তার হাসির আওয়াজে ঘরের কোনা থেকে একজন, খাটের নিচ থেকে আরেকজন আর সবশেষে পর্দার আড়াল থেকে নাবিলা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। সবারই মুখে হাসি। সামির আচমকা আয়ানের কলার চেপে ধরে বলল,
— “তুমি শালা, ছোটো ভাইয়ের সাথে মজা নিলা।”
আয়ান অসহায় কণ্ঠে উত্তর দিল,
— “বিশ্বাস কর ভাই, সব তোর বউ আর আমার হিটলার বোনের আইডিয়া। ওদের ধর গিয়ে।” অন্বেষা আগেই সেফ জোন অর্থাৎ নাবিলার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সামির সত্যিকার অর্থে হতাশ… কাউকে কিছু বলল না। লাজ-লজ্জার দফারফা হয়ে গেল। প্রায় চব্বিশটা বছর নিজের সম্মান জিইয়ে রেখেছিল আর এই মেয়েটা মাত্র চব্বিশ সেকেন্ডে সেই সম্মান ধূলিসাৎ করে দিল? রাত দেড়টা নাগাদ ওরা সামির আর নাবিলাকে ঘরে আটকে বেরিয়ে গেল। নাবিলা এমন সাজ-সজ্জায় ইতস্ততবোধ করছিল। তারমধ্যে একটু আগে যা কাণ্ড ঘটল। বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করেছিল। নাবিলা বলল,
— “আপনি কি একটু বাহিরে যাবেন? আমি তাহলে কাপড় চেঞ্জ করতাম।”
সামির কোনো উত্তর দিল না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আলমারি থেকে কাপড় বের করে দ্রুত বদলে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল,
— “আমার ঘরে আমি কারো পরামর্শ মানতে রাজি নই।”
নাবিলা বিস্ময়ে হাঁ করে তাকাল। বিরক্ত হয়ে বলল,
— “আশ্চর্য! তবে আমি চেঞ্জ করবো কোথায়?”
— “সেটা তুমি জানো।” নির্দয় ঠাণ্ডা একটা উত্তর দিল সামির।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নাবিলা বিড়বিড় করে উঠল,
— “নিজের ঘর বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? আমি কাল এই ঘর ভাগ করব, দেখে নিয়েন।”
সামির চোখ বুঁজে বলল,
— “আসছে।”
নাবিলা এবার দাঁত চেপে বলল,
— “আসছিই। কাল আমার আসা ভালোভাবে টের পাবেন। ভেবেছিলাম, ভালোভাবে থাকব। কিন্তু আপনি তো তার উপায় রাখছেন না।”
সামির হেসে উঠল ঠাট্টার ভঙ্গিতে,
— “তুমি আর ভালো? হাহা, হাস্যকর।”
সেই মুহূর্তে সামিরের মুখে টানটান হাসি দেখে নাবিলার মনে হলো, এই হাসিটা যদি মুঠো করে চেপে ধরা যেত তবে দূরে কোথাও ছুঁড়ে ফেলত! রাত হয়েছে ভালোই, সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর আর তর্ক করার সায় দিচ্ছে না। নাবিলা নিজের কাপড়-চোপড় নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। পাশের একটা ঘরে গিয়ে কোনোরকম চেঞ্জ করে এসে দেখল ইতোমধ্যে সামির ঘুমিয়ে কাঁদা।
সামিরের ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে নাবিলা ভ্রু কুঁচকাল। মনে মনে শুরু হলো ওর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার, “কী আজব মানুষ! ঝগড়া করে নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছে। আমার মেজাজটা একদম নষ্ট করে দিয়ে নিজে দিব্যি স্বপ্নরাজ্যে ভেসে যাচ্ছে। স্বপ্নে একটা শাকচুন্নী আসুক।”
চোখ সরিয়ে নাবিলা বিছানায় উঠে একপাশে চেপে শুয়ে পড়ল। রাগের তাপে বুক ধুকপুক করছিল কিছুক্ষণ কিন্তু চোখের পাতার ভার সামলানো গেল না। অবশেষে সমস্ত অভিমান, বিরক্তি, খুনসুটি একপাশে রেখে সেও তার শশুরবাড়ির প্রথম রাতে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমের রাজ্যে।
.
সকালবেলা সামিরের ঘুম ভাঙল আগে। চোখ মেলেই দেখল, পাশেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন নাবিলা। মুহূর্তে মাথা কাজ করল না। ধাতস্থ হতে একটু সময় লেগে গেল। চোখ নামিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল ও। ভেতরে ভোঁতা বিরক্তি ছড়িয়ে গেল। তার কাছে মনে হলো এখন থেকে প্রতিটা সকালই অপ্রিয়, প্রতিটা সকালই অনিচ্ছার হবে। বোধহয় কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে জীবনের ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে সামিরের কাঁধে।
সকালটা নাবিলার জন্য অন্যরকম ছিল। চোখ মেলতেই নতুন পরিবেশের ছোঁয়া, অপরিচিত দেয়াল, অপরিচিত, মানুষ, ঘর অথচ এটাই নাকি এখন তার নিজের সংসার। পাশে তাকিয়ে সামিরকে দেখতে পেল না, এটা একটা স্বস্তির বিষয়। ওর চেহারা দেখলেই সাতসকালে ঠোকাঠুকি আর ঝগড়াঝাঁটি যে একদফা হয়ে যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, নাবিলা এখানে ভরসাও পাচ্ছিল। হয়ত সেটা রেশমা আন্টি এবং আঙ্কেলের আন্তরিকতার কারণেই। ঠোঁটের কোণে টুকটাক হাসি নিয়েই নাবিলা উঠে পড়ল। সকালের পরিবেশে ঘরে মিষ্টির ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনেরা নতুন বউকে নিয়ে গল্প, হাসি-ঠাট্টা করছে। নাবিলাকে একটা লাল-খয়েরী জামদানী পড়িয়ে মাথায় সবে শাড়ির আঁচল গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবাই যখন ব্যস্ত তখন রেশমার মুখে রাগের ঝড় বইল। চোখে-মুখে অসন্তোষ স্পষ্ট।
— “এই ছেলে মানুষ হয়েছে নাকি? নতুন বিয়ে, ঘরে বউ রেখে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে গেছে। হাতে-পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা উচিত ওরে। চুলোয় যাক সব।” রেশমার কণ্ঠে বিরক্তি আর ক্ষোভ গড়িয়ে পড়ছে। চারপাশে সবাই হেসে উঠল। তার রাগের কারণ হচ্ছে একমাত্র সুপুত্র। সামির সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই কাউকে কিছু না বলে বাহিরে বেরিয়ে গেছে বন্ধুদের সাথে। ফোন করা হয়েছিল। খুব ব্যস্ততা দেখাল। এখন বাড়ি আসতে পারবে না, জরুরী কাজ আছে… ইত্যাদি ইত্যাদি।
রেশমা নরম সুরে নাবিলাকে ডাকল,
— “নাবিলা মা, তুমি এসো তো। ওই ছেলে আমার আর দরকার নেই। ওরে আমি ত্যাজ্যপুত্র করলাম।” নাবিলা হাসল, বিজয়ের হাসি।
বৌভাতের অনুষ্ঠান পরদিন জাঁকজমক করেই শেষ হলো। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার ভিড় জমল। আবারও হাসি-ঠাট্টায় ভরে উঠল বাড়ি। নাবিলার মা-বাবা, ভাই সাথে অন্য আত্মীয়রাও সকাল সকাল চলে এলো। আর সেদিন নাবিলা-সামিরকেও যেতে হলো।
ঢাকা টু নাটোর আবার নাটোর টু ঢাকা, এইভাবেই চলল কয়েকদিন। টানা ব্যস্ততার পর অবশেষে যখন ঢাকা এসে পৌঁছাল, নাবিলা বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। বোধহয় একটা পাহাড় নামল কাঁধ থেকে। বিয়ে মানে কী ভয়াবহ প্যারা, সেটা এখন হারে হারে বুঝছে। নাবিলা যদি আগে জানত বিয়েতে এতো ঝক্কি তবে বিয়ে করার আশাই বাদ দিত। এরচেয়ে তো সামির ইয়াসিরকে চোখ বুজে সহ্য করে নেওয়া সহজ।
এত ব্যস্ততার ভেতরেও নাবিলা নিজের ভর্তি কার্যক্রম গুছিয়ে নিল। প্রথমদিন ওর পাশে ছিল নেওয়াজ আহসান আর সামির, দু’জনের মিলিত উপস্থিতি কোনোরকম ঝামেলা হলো না। নাবিলাও চুপ আর সামিরও। কিন্তু দ্বিতীয়দিন যখন শুধু সামির থাকল পাশে, তখনই শুরু হলো দু’জনের ‘যুদ্ধ’। এই যুদ্ধ মানে মারামারি নয়; কথার লড়াই, খোঁচাখুঁচি, ঠোকাঠুকি। সামির কোনো কথা বললেই নাবিলা উল্টো সুরে জবাব দেয়, আর নাবিলা কিছু বললে সামির এমন কটাক্ষ ছুঁড়ে দেয় যে গায়ে আগুন ধরে যায়। এখন দু’জন একসাথে মানেই ওই জায়গাটা মোটামুটি মানের একটা রণক্ষেত্রতে পরিণত হওয়া।
বিশ্বযুদ্ধ তো দুইটা হয়েছে এরপর কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ, গালফ ওয়ার; এসব তো ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু নাবিলা আর সামিরের ঝগড়াটা কোন সিরিজে পড়ে? হয়তো ইতিহাসের পাতায় আলাদা অধ্যায় খুলতে হবে, ‘নাবিলা বনাম সামির যুদ্ধক্ষেত্র’। তবে এই যুদ্ধ আর প্রতিটা কথার খোঁচাতেই ওদের সম্পর্কটা আরও বেশ বিয়ের দিন থেকে আজ অবধি অনেকগুলো মাস গড়িয়ে গেছে।
এখনো ঘর ভাগাভাগির কাজটা করা হয়নি। প্রতিদিনই সামির যখন রুমে ঢোকে, নাবিলার মনে হয় কোনো রাজা তার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করছে। দরজা খুলে ঢুকেই এমন একটা ভাবসাব যে; “এই ঘর আমার, এই বিছানা আমার, বাতাসও আমাকেই সালাম ঠুকছে, চারপাশ থেকে দাস-দাসীরা আমাকে ফুল দিয়ে অভ্যার্থনা জানাচ্ছে।” নাবিলা চোখ ঘুরিয়ে কাটাকাটা দৃষ্টিতে সবটা দেখে। এটাও বোঝে; এটা নিছকই প্রদর্শন, এটা যে সামিরের ঘর তা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। না চাইতেও গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে। সামিরকে বিয়ে করার পর থেকেই ও আগুনে তেতে আছে। আগুনটা কে? অন্য কেউ নয়, কিছু নয় বরং স্বয়ং সামির ইয়াসির নিজেই।
আজ হাতে অফুরন্ত সময়। বাড়িতে করার মতো কোনো কাজ নেই। আসলে কাজের তেমন কিছু থাকেও না কারণ বাড়ির মানুষ তো মাত্র চারজন; শ্বশুর-শাশুড়ি, সামির আর নাবিলা। আর যতটুকু করার থাকে, সবটাই রেশমা আন্টি নিজে করে ফেলেন। তাই নাবিলার কাজ মূলত তার সাথে আড্ডা দেওয়া আর গল্প-গুজবেই সীমাবদ্ধ।
আজ নাবিলা সিদ্ধান্ত নিল, ঘর ভাগাভাগি করেই ক্ষ্যান্ত হবে। তবে সেটা সামিরের সামনে। কারণ, সামিরকে না দেখিয়ে ঘর ভাগ করা মানে খেলা শুরু না করেই গোল দিয়ে দেওয়া। সে ধৈর্য ধরে সামিরের ফেরার অপেক্ষায় রইল।
অনেকক্ষণ পর নিচে সামিরের বাইকের আওয়াজে নাবিলা উঠে এসে দরজায় দু’হাত গুটিয়ে দাঁড়াল। চোখেমুখে এমন একটা হাসি যে কাউকে ফাঁদে ফেলার পর শিকারি যেভাবে হাসে, ঠিক তেমনই।
—“আসুন আসুন, হে মহারাজ!” নাবিলা মিষ্টি গলায় বলল, “আপনার জন্যই এতক্ষণ দরজায় প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছি।”
সামির ভ্রু কুঁচকালো,
—“কিসের জন্য?”
—“যোগ-বিয়োগের খেলা খেলবো বলে।” নাবিলা বলল হাসিমুখে।
—“যোগ-বিয়োগ আবার কীসের খেলা?” সামির গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল।
নাবিলা ঠোঁট টিপে হাসল,
—“এই নাবিলা যে কত খেলা জানে, তার আইডিয়া নাই আপনার। যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ সব হবে এইবার।”
—“যতসব ফালতু কথা।”
নাবিলা হাত কোমরে রেখে পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। সামির ওকে খেয়াল করল না, বিছানায় এসে আরামসে বসে পড়ল। নাবিলা বলতে শুরু করল,
— “শোনেন… দিনের প্রায় পুরোটা সময়টা যেহেতু আপনি ঘরে থাকেন না, আর আমি ইচ্ছেমতো ঘরটা সাজিয়ে-গুছিয়ে, পড়াশোনা বা বই পড়ে সময় কাটায় তাই পুরো সময় তখন এটা আমার রাজত্ব। কিন্তু সন্ধ্যার পর নিয়ম মানা শুরু, যেহেতু তখন আপনি বাড়ি ফিরেন। ঘরের জানালার দিকটা, যেদিকে আলো ঢোকে, সেদিকটা সবসময় আমারই। রাতের অন্ধকারেও। আপনার জন্য বরাদ্দ করা হলো ঘরের অন্ধকার দিক, যেখানে আলো কম পৌঁছায়। যদিও এইদিকে ঘরের অন্যসব আসবাবপত্র আছে তবে আমি স্যাক্রিফাইস করলাম। বিছানাটাও অর্ধেক ভাগ হবে। দিনের বেলা সম্পূর্ণটা আমার দখলে থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে অঘোষিত সীমানা টেনে দেওয়া হবে মাঝ বরাবর। আমি যে দিকটায় ঘুমাই, সেইদিক একচেটিয়াভাবে আমারই। অন্য পাশটা আপনার জন্য। রাতে যদি সীমানা অতিক্রম করেন তাহলে সেটার জন্য শাস্তি আছে।”
সামির সব শুনল, মনোযোগ দিয়েই। তবে সে কি চুপচাপ মেনে নেওয়ার পাত্র? তার ভঙ্গিটাই রাজসিক, একটু ব্যঙ্গ মেশানো, একটু বিরক্ত। বলল,
— “বাহ্, দিনের বেলা পুরো ঘর তোমার, রাতে আবার ভাগাভাগি? মানে আমি একরকম ভাড়াটিয়া হয়ে গেলাম। নিজের ঘরেই অতিথির মত। খুব সুন্দর হিসাব কষছো দেখছি। কিন্তু মনে রেখো, রাজা তার রাজ্যে চাইলেই আইন ভাঙতে পারে।”
— “আইন প্রণয়ন আমি করেছি তাই ভাঙ্গার হলে সেটা আমি ভাঙ্গব। আপনি যদি উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করেন তবে যুদ্ধ লাগায় দিব। এমনিতেই মামনি আমায় বলে দিয়েছে, সামির যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে সোজা আমায় এসে বলবে। তারপর ওকে আমি দেখব।”
— “মামনি কে?”
— “মাই ডিয়ার শাশুড়িমা।” নাবিলা সুন্দর করে হেসে বলল।
— “আমার মা, আমার বিপক্ষে চলে গেছে?”
নাবিলা হেসে চুল উড়িয়ে বলল,
— “ইচ্ছাকৃতভাবে যায় নাই, আমি টেনে নিয়ে গেছি।”
সামির বিষ্ময়ে অভিভূত, কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। নাবিলা একটা ‘কেয়ার করি না’ ভাব নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
—
সামিরের বড় আব্বুর বাসায় এখনো নাবিলার আনুষ্ঠানিক যাওয়াটা হয়নি। কারণ, সেই বাড়ির গৃহকর্ত্রী ইয়াসমিন অর্থাৎ সামিরের বড়মা বিয়ের সময় ছিলেন না। এক আত্মীয়ের অসুস্থতার কারণে তিনি বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। যদিও বাসায় তার মেয়ে আর ছেলের বউ ছিল তবুও তিনি স্পষ্ট জানিয়ে রেখেছিলেন,
— “আমি এসে একেবারে বউ দেখব।”
উনার বাসায় আজকে দাওয়াত। কিন্তু ভাবের রাজা সামির তার স্বভাবসিদ্ধ একরোখা ভঙ্গি ধরে রেখে জানিয়ে দিল, সে যাবে না। সে কারো অনুরোধ-উপরোধেরও তোয়াক্কা করল না।
আর কেউ না জানুক, নাবিলা ভালো করেই জানে সামিরের এই না যাওয়ার পেছনে আসল কারণটা কী। রেশমা চরম বিরক্ত ছেলের উপর। ইদানিং কী যে হয়েছে, দিন দিন ভীষণ বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে। নাবিলাকে বলে এই ছেলের লাগাম টেনে ধরতে হবে। নাবিলার মনেও একইরকম বিরক্তি তবে প্রকাশ করার মতো বোকামি ও করল না। শাশুড়িকে আশ্বস্ত করে বলল,
— “মামনি, তুমি চিন্তা করো না। তোমার ছেলেকে বোঝানোর দায়িত্ব আমার। আমি এখনই গিয়ে রাজি করাচ্ছি।”
ভালো মানুষীর চেষ্টা আর কী! আসলে তার ত্যাড়াব্যাকা, কাঁটা-কাঁটা রূপটা সে শুধু সামিরের জন্যই জমা রাখে। বাকি পৃথিবীর সামনে, বিশেষ করে শাশুড়ির সামনে, সে আদর্শ বউমা। সবাই তাকে দেখুক, জানুক; কী ভদ্র, কী শান্ত মেয়ে! শাশুড়ির ভালো বউমা হয়ে শাশুড়ির ছেলেকেই পদে পদে ভদ্রতার কাঠামোতে বেঁধে বেকায়দায় ফেলবে।
সামির ঘরেই ছিল। নাবিলা এসে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল,
— “সামির ইয়াসির, তুমি কি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে এখনো ভুলতে পারোনি? তুমি কি এখনও তার বিরহে কাতর? তারমানে এখনো পুরনো জায়গাতেই আটকে? সেই মধুর, মিষ্টি স্বপ্নে দিনাতিপাত করছো তাইনা? যাবে না তো যাবে না, আমার কী? তবে অন্বেষা আপু কিছুমিছু বললে তখন কিভাবে সামলাবে, সেটা একটু ভেবে রাখো। আমি তো…”
নাবিলা আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সামির এমনভাবে আগুন দৃষ্টিতে তাকাল যে চুপ হয়ে গেল। তবে কথাগুলো টনিকের মতো কাজ করলো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সামির বলল,
— “রেডি হও, যাচ্ছি আমি।”
নাবিলা হাসি চেপে রেডি হয়ে নিল। ওর সাজগোজের রঙচঙ দেখে সামির মুখ কুঁচকালো। তাড়া দিচ্ছিল, তার ঘরে এসব বেত্তমিজগিরি সহ্য হচ্ছিল না। নাবিলা নির্বিকার থাকল। এতক্ষণ তো যেতেই চাচ্ছিল এখন বোধহয় এক্সের টানে তাড়াহুড়ো করছে। নাবিলা ইচ্ছে করেই একটু তাল-বাহানা করল। সামিরের হাত ধরে ওই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। দরজা খুলল কামিনী… দরজা খুলেই দুজনকে একসাথে দেখে নাবিলার দিকে কীরকম একটা চাহনি দিল। নাবিলা বিড়বিড় করে বলল,
— “অসুখী… অসুখী… দাম্পত্য জীবনে ভয়াবহ রকমের অসুখী।”
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৪]
~আফিয়া আফরিন
ইয়াসমিন নাবিলাকে চোখ ভরে দেখছিলেন। মুখভর্তি হাসি নিয়ে কোনরকম ভণিতা ছাড়াই বলে উঠলেন,
— “ওমা! এ তো একেবারে বাচ্চা মেয়ে। কী মিষ্টি দেখতে! এটা কি সত্যি আমাদের সামিরের বউ? সুন্দর মানাইছে দু’জনকে, মাশাআল্লাহ। রেশমা, তুমি তো তোমার বাচ্চা ছেলের জন্য একটা বাচ্চা বউ খুঁজে এনেছো।”
নাবিলা লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল, তার চোখ-মুখে ছিল একরাশ আনন্দের ঢেউ। বড়মার মন্তব্যের ভেতর লুকিয়ে থাকা স্নেহটা ভীষণ ভালো লাগল। আজ অন্তত একবার, মানে প্রথমবার কারও কথায় সামির-নাবিলা জুটি সত্যি সত্যিই সুন্দর শোনালো।
অন্বেষা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে নাবিলাকে একপ্রকার লুফে নিয়ে গেল। এদিকে রেশমা আর ইয়াসমিনও মিলে নববধুকে ঘিরে গল্পে মেতে উঠলেন। নাবিলার প্রতিটি কথাবার্তা, ভদ্রতা সবকিছুতেই মুগ্ধতা খুঁজে পেল তারা। অন্যদিকে বসার ঘরে টিভির সামনে রায়হান, আয়ান আর সামির। খেলা চলছিল তবে ওরা তিনজনই গল্পে মত্ত… হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সামিরের চেহারায় তখন অন্যরকম দীপ্তি খেলা করছিল। ওকে খুব সুখী মানুষের ন্যায় মনে হচ্ছিল।
কিন্তু এই হাসি-আনন্দে যে খুশি হচ্ছে না, সে হলো কামিনী। ভেতরে ভেতরে হিংসেতে জ্বলে যাচ্ছিল। প্রকৃত অর্থে হিংসে হওয়ার কোনো কিছু নেই, কারণ তার নিজের একটা সংসার আছে; বেশ সুখী সংসার। তবে মন তো এতকিছু বিবেচনা করে না। নিজের ভাবি হওয়া সত্ত্বেও অন্বেষা কখনো নাবিলার মত করে তাকে আগলে নেয় নাই। শাশুড়িও তো তার প্রশংসা এত সুন্দরভাবে কোনোদিন করেননি। অথচ কামিনী দেখতে সুন্দর, কামিনী ফুলের মতই। নাবিলার সৌন্দর্যই কি সব? এত মাতামাতি করতে হবে কেনো ওকে নিয়ে?
তারপর চোখ গেল স্বামী-দেওরের দিকে। ওরা এখন কথা বলছে কী সুন্দর করে। অথচ তার সঙ্গে কথা বলার সময় সবসময় বেজার মুখ করে রাখে। আর সামিরের কথা তো আলাদা ভাবে বলার দরকারই নেই… বিয়ের পর থেকে ওর চেহারায় অন্যরকম একটা গ্লো এসেছে। কামিনীর সহ্য হচ্ছে না এসব। অথচ তার নিজের একটা সংসার আছে। খানিক আগেই যে মানুষগুলোর উপর দোষ দিল, তার দায় কি তাদের একার? উঁহু, সমান সমান দোষ কামিনীর উপরও বর্তায়। কেউ ওর সাথে কথা বলতে এলে ও বিরক্তবোধ করে। প্রথম প্রথম সকলেই আগ্রহ দেখিয়েছিল। পরে কামিনীর বিরক্তির কারণে সকলেই সেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কামিনী বোঝেই না কখনো, যতটুকু বোঝে সবটাই ভুল।
অন্বেষার সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ নাবিলার মনে হলো, সবাই তো নিজেদের মতো করে গল্প করছে। কিন্তু কামিনীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। নাবিলা বলল,
— “ভাবি কোথায়? একলা একলা কি করছে। আমি গিয়ে ডেকে আনি।”
কথাটা শুনে অন্বেষা বিশেষ আগ্রহ দেখাল না, আবার বাঁধাও দিল না। নাবিলা উঠে দাঁড়াল। ড্রয়িংরুমে এসে দেখল, কামিনী একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সোজা সম্মুখে নিবদ্ধ, যেখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিনজন পুরুষ। এদের মধ্যে কামিনী কাকে দেখছিল? নিশ্চয়ই নিজের স্বামীকেই।
— “ভাবি…” নরম গলায় ডাক দিল নাবিলা।
চকিতে পেছন ফিরে তাকাল কামিনী। তার চোখেমুখে ইতস্তত ভাব লক্ষ্য করা গেল। নাবিলা হেসে বলল,
— “আপনাকে খুঁজছিলাম। চলুন না, বসে গল্প করি। এখানে একা একা কী করছেন?”
এইসময় সামিরও নাবিলার দিকে তাকাল। অতি সূক্ষ্ম ইশারায় মাথা নেড়ে বোঝাল, “না।” হয়ত সে কামিনীর সাথে কথা বলতে মানা করছে।
কিন্তু নাবিলা মুচকি হেসে নিজের ইশারায় তাকে বুঝিয়ে দিল, “সমস্যা নেই।” তারপর কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে কোমলভাবে কামিনীর হাত ধরল। কামিনী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— “না, তুমি যাও। আমি আছি এখানেই। একটু মাথা ধরেছে।”
কথাটার মধ্যে স্পষ্ট এড়িয়ে যাওয়ার ভাব ছিল। নাবিলা বুঝতে পারল, ওটা নিছক অজুহাত। সে মিষ্টি হেসে জবাব দিল,
— “মাথাব্যথা থাকলে আরও বেশি আমাদের সাথে থাকবেন। গল্প করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে। একা থাকলে তো খারাপ লাগবে।”
কামিনী ফের নিজের পক্ষে কিছু বলতে গেল কিন্তু নাবিলা আর কোনো সুযোগ দিল না। দৃঢ় ভঙ্গিতে তার হাত টেনে নিয়ে গেল ভেতরের ঘরে, অন্বেষার কাছে।
ঘরে ভেতরে আড্ডার হুল্লোড় জমে উঠল খানিকক্ষণের মধ্যেই। অন্বেষা, নাবিলা, আর কামিনী তিনজনেই একসাথে। কিন্তু মধ্যমনি হচ্ছে নাবিলা। কী মিষ্টি, আদুরে হাসি, সহজ-সরল কথাবার্তায় হাসাচ্ছে, মিষ্টি ভঙ্গিমায় অন্বেষার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে আবার খোঁচায় মজার পাল্টা উত্তর দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়ছে, আর সেই হাসিটুকুই আনন্দের খোরাক। কামিনী চেষ্টা করছিল নির্লিপ্ত থাকতে। কিন্তু চাইলেও কানে আসা কথাগুলো এড়াতে পারছিল না। শুনতে শুনতে একসময় তার বুকের ভেতর অস্বস্তি জমাট বাঁধতে শুরু করল। ওর চোখে পড়ছিল নাবিলার রাখঢাকহীন ভদ্রতা, সহজাত মিশুক স্বভাব আর কমবয়সের প্রাণচঞ্চলতা। হয়তো এই কারণেই সবাই ওকে এত সহজে আপন করে নিচ্ছে। কিন্তু যাইহোক, কামিনী কখনোই সামিরের পাশে ওকে সহ্য করতে পারবে না। সামিরকে সে নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভেবেছিল। ও হয়তো কিছুটা একগুঁয়ে, হয়তো একটু বেশিই পজেসিভ কিন্তু খারাপ ছিল না কখনোই। একসময় সামির তো ছিল তারই জীবনে। তাহলে হঠাৎ এই নাবিলা মাঝখান থেকে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল? চিন্তার স্রোত কামিনীকে টেনে নিয়ে গেল হিংসার অতল গহ্বরে। এতটাই গভীরে যে সে ভুলেই গেল তারও তো আছে একটি সংসার, তাকে ভালোবাসে এমন একজন মানুষ আছে, আছে নিজস্ব একটা জগৎ…
.
নাবিলার ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু ও এখনও যাওয়া-আসা শুরু করে নাই। নাবিলার মনটা আটকে আছে। দু’দিন হলো ওর কিছুই ভালো লাগছে না। অকারণে চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কথা বারবার মনে পড়ছে। ফোনে মা-বাবার সঙ্গে কথা হয় বটে কিন্তু নাবিলার তৃপ্তি হয় না। ফোনের ওপাশটা আরও বেশি করে ওর শূন্যতা বাড়িয়ে দেয়।
সামির খেয়াল করল বিষয়টা। প্রথমে ভেবেছিল হয়ত সারাক্ষণ মুখ চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যখন দেখল ওর চোখেমুখে সেই স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস নেই আর ঝগড়াঝাঁটি বা খোঁচাখুঁচির বদলে নীরবতা, তখন সামির অবাক হলো।
নাবিলা ঝগড়া করছে না, কথা বলছে না, তর্ক জুড়ছে না এটা ওর পরিচিত স্বভাবের একেবারেই উল্টো। চুপচাপ বসে থাকা, চোখের না বলা ভাষা, এটা ওর চরিত্রের সঙ্গে যায় না। সামির নিজের অজান্তেই নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকল। প্রথমবারের মতো মনে হলো, ওকে বোঝা আসলে সহজ নয়। একরোখা মেয়েটার ভেতরে লুকিয়ে আছে অনেককিছু… হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উল্লাস, বিষাধ, উদাসীনতা; সবকিছুর মিশেলে অনেককিছুই। সামির আর কৌতূহল সামলাতে পারল না। কাছে গিয়ে বলল,
— “এনি প্রবলেম?”
নাবিলা একেবারেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “না।”
কিন্তু সামির সন্তুষ্ট হলো না ওর উত্তরে,
— “মনে হচ্ছে।”
নাবিলা ধীরস্থিরভাবে চোখ তুলে তাকাল। ঠাণ্ডা স্বরে উত্তর দিল,
— “মনের লাগাম টেনে ধরুন। আপনার মন যদি উল্টাপাল্টা সাক্ষ্য দেয়, তাতে আমার করার কিছু নেই।”
কথাটা হাওয়ায় এমনভাবে ভেসে রইল যে সামিরের চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অথচ তার কৌতূহল মেটল না বরং আরও বাড়ল। ফের বলল তবে গলাটা ভারী শোনাল,
— “তোমার মতো বকবক করা মানুষও যদি চুপচাপ হয়ে যায়, তাহলে সত্যিই কিছু না কিছু হয়েছে। আমার মন উল্টাপাল্টা সাক্ষ্য দেয় ঠিকই, কিন্তু কখনো ভুল করে না।”
নাবিলা নিশ্চুপ। বলার মত আহামরি কিছু ঘটে নাই। আর সামির হঠাৎ এতটা আগ্রহী? আগবাড়িয়ে এত কথা জিজ্ঞেস করছে? নাবিলা মুখে ফিরিয়ে নিল।
সামির কিছুক্ষণ নিরব কণ্ঠস্বর প্রায় নামিয়ে বলল,
— “কি হয়েছে, নাবিলা?”
নাবিলা আচমকা সামিরের দিকে তাকাল। চোখাচোখি হতেই মনে হলো, তার বুকের ভেতর কোথাও অদ্ভুত একটা অনুভব হচ্ছে। সামিরের কথাটা এমনভাবে কানে বাজছিল যে প্রতিটি শব্দের ভেতর কিছু না কিছু সত্যি লুকিয়ে আছে… কিন্তু কী? ওর গলা কীভাবে এত সুন্দর শোনাল? কণ্ঠস্বরের ভেতরে কী এক কোমলতা, দৃঢ়তা মিশে আছে! এটা কি সত্যিই সেই সামির? সেই একরোখা, উদ্ধত, ঝগড়াটে স্বভাবের ছেলেটা? অদ্ভুতভাবে প্রথমবারের মতো মনে হলো, সামির যদি চায় তবে খুব সুন্দর করে কথাও বলতে পারে। এত সুন্দর যে শোনার পর দীর্ঘক্ষণ ধরে নাবিলার ভেতরে ঝড় তুলতে পারে। ওর ভ্রু কুঁচকে আছে অথচ মনে ভেতরে হালকা কাঁপুনি দোলা খাচ্ছে। অবিশ্বাস্য, একেবারেই অবিশ্বাস্য লাগল নাবিলার কাছে। এরইমধ্যে সামির হঠাৎ বলে উঠল,
— “মন খারাপ বাদ দিয়ে হাসাহাসি করো। নয়ত তোমার শাশুড়ি যদি দেখে তাহলে উল্টো আমাকেই দোষ দিবে।”
এতক্ষণ নাবিলা একধরণের মুগ্ধতায় ডুবে ছিল। হঠাৎ ধাক্কায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল এবং মুগ্ধতার সেই নরম আবেশটাও। আচ্ছা… এটা তো সামির ইয়াসির। ও কেনো ভালোভাবে কথা বলবে? ওর কাছ থেকে ভালো কথা শোনার আশা করাই তো পাপ। নাবিলা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সামির পেছন থেকে বলল,
— “মাকে বলো তো, আমাকে এককাপ কড়া করে চা বানিয়ে দিতে।”
এককাপ চা নাবিলা নিজেই বানাতে পারে। তাই করল, চা বানাতে গিয়ে মনটা একটু হালকা হলো। সারাদিন হয়তো একলা থাকে বলেই মনটা ভার হয়ে থাকে। সবাই বলছে ক্লাসে যেতে, নতুন পরিবেশ উপভোগ করতে।
নাবিলা সামিরকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল। বলল,
— “কাল আমি ক্লাসে যাব।”
— “কথাটা কি আমাকে বলছো নাকি আমার কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছ?”
— “জানিয়ে রাখলাম।”
সামির হালকা মাথা নাড়ল,
— “আচ্ছা।”
নাবিলা বলল,
— “আপনি নিয়ে যাবেন?”
সামির ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আর?”
নাবিলা ভুরু কুঁচকাল,
— “আর কী হবে?”
— “আর কোন ডিমান্ড? আবদার?”
— “আগেভাগেই বলতে পারছি না। যখন প্রয়োজন হবে তখন বলব।”
সকালটা নীরবতার মধ্যে কেটে গেল। নাবিলা ভেবেছিল, সামির হয়ত বাহিরে বের হলে ঘরের মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে বসবে। কিন্তু তার সুযোগ হলো না। এমনি দিন বাড়ি থাকে না আর আজ বের হওয়ার নাম নিচ্ছে না। এখন নাবিলা কিছু বলতে গেলেই, নিজের ঘর ছেড়ে কেনো চলে যাবে; তা নিয়ে মস্ত এক ভাষণ শুনিয়ে দিবে।
নাবিলা অবশ্য আজকে একটু ভুল ভাবল। সামিরকে বললেই ও চলে যেত। কারণ সে কৌতূহলী। একাধিকবার চেষ্টা করেছিল, নাবিলার কাছ থেকে কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু নাবিলা ইচ্ছে করেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। সামিরের চোখে ব্যাপারটা খটকা লাগছিল ঠিকই তবে অন্যের মন খারাপের রহস্য খুঁজতে গিয়ে নিজের মাথা খারাপ করার কোনো মানে হয় না। সামির বিকালের দিকে বেরিয়ে গেল। তখন আর নাবিলার বিশ্রামের প্রয়োজন হলো না, মন খারাপ ভাবটা ইতোমধ্যে কেটে গেছে… অন্বেষা এসেছিল, একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং কথা শেয়ারও করেছে।
মনটা আরেকদফা ভালো করার জন্য সন্ধ্যার পর আহিরের ফোন এলো। নাবিলা প্রথমে মামা-মামীর সাথে কথা বলে আহিরকে বলল,
— “তোর সাথে শেষে কথা বলছি। তুই শ্রেষ্ঠাকে ফোন দে, জরুরী কথা আছে।”
অগত্যা ফোনটা শ্রেষ্ঠার হাসে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষে শ্রেষ্ঠা জিজ্ঞেস করল,
— “কেমন কাটছে নতুন জীবন? ভাইয়াকে কেমন মনে হচ্ছে?একটু অভিজ্ঞতা শেয়ার করো।”
নাবিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “জীবন কেমন কাটছে সেটা ঠিক বোঝাই যাচ্ছে না শ্রেষ্ঠা। নতুন একটা জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন নিয়মকানুন সবকিছুই অদ্ভুত ঠেকছে। গুছিয়ে নিতে গিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে। তারমধ্যে কাল আবার ক্লাসে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।”
— “আর ভাইয়া? সে কেমন?”
নাবিলা বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোনে কথা বলছিল। শ্রেষ্ঠার প্রশ্নে একটু উঠে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
— “ওর কথা আলাদাভাবে কী বলব? ও হচ্ছে ভাবের রাজা। এত পাট নিয়ে থাকে রে ভাই, ভাবের ঠেলায় মাটিতে পা পড়ে না।”
ওপাশে শ্রেষ্ঠা খিলখিল করে হেসে উঠল,
— “রোমান্টিক?”
নাবিলা চোখ বড় বড় বলল,
— “রোমান্টিক? আরে পুরোদস্তর খাট্টাস! ঝগড়া করেই কুল পায় না। সারাক্ষণ চিন্তা করে কীভাবে আমাকে ফাঁদে ফেলবে। মানে কোন কথায় খোঁচাবে, কীসে বিরক্ত করবে।”
শ্রেষ্ঠা আরো হাসল,
— “আমার কিন্তু ভাইয়ার চেহারা দেখে বরাবরই বেশ রোমান্টিকই মনে হয়েছে। মানে একটা ব্যাপার আছে তার মধ্যে। তুমি প্রতিদিন দেখছ তাই হয়তো বুঝতে পারছো না। বাইরে থেকে যখন দেখি, ভাইয়ার মধ্যে আলাদা একটা চার্ম আছে। একটা জোস জোস ভাইব দেয়।”
শ্রেষ্ঠার কথায় নাবিলা খানিক থমকাল। মনের ভেতর হালকা অস্বস্তি ঢেউ খেল। কিন্তু এই অস্বস্তি কীসের জন্য সেটা বুঝল না। অস্বস্তি কি সামিরের প্রশংসা করার জন্য হলো। নাবিলা তো আবার ওর গুণগান সহ্য করতে পারে না। নাকি অস্বস্তির কারণ অযাচিতভাবে অন্য একজন সামিরের অভ্যান্তরিণ একটা বিষয় নিয়ে কথা বলল বলে? কী জানি… নাবিলা সঠিক কারণ ধরতে পারছে না। ও ঠোঁট চেপে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ব্যপারটা উড়িয়ে দিতে গম্ভীর গলায় বলল,
— “রোমান্টিক মনে হওয়া আর আসলেই রোমান্টিক হওয়া; এই দুই জিনিস আলাদা। তুই না আমার জায়গায় থাকলে বুঝতিস। যাইহোক বাদ দেই। সামির হচ্ছে একরোখা, জেদি, একগুঁয়ে, একেবারে নিজের মত সিদ্ধান্ত নিবে, কারো ধার ধারবে না। ওকে নিয়ে ভালো কথা বলে লাভ নাই, ওকে নিয়ে ভালো কথা বললে ভালো গুণগুলোও লজ্জা পাবে।”
কথাটা বলেই নাবিলা হেসে উঠল। ওর হাসির ফোয়ারায় শ্রেষ্ঠাও হো হো করে হেসে উঠল। হাসির রোল ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সামির। প্রয়োজনে এসেছিল, শেষ কয়েকটা কথা ওকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। চেহারার ভঙ্গিটা হঠাৎ গম্ভীর হলো। শব্দগুলোতে মজা ছিল ঠিকই কিন্তু সামিরের কাছে তা কটাক্ষের মত মনে হলো। সামির কিছু বলল না, নিজের উপস্থিতি জানানও দিল না। শুধু নিঃশব্দে সরে গেল ঘর থেকে।
সেদিন রাতটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল। শ্রেষ্ঠার সাথে আড্ডা শেষ করে যখন নাবিলা ড্রয়িংরুমে সামিরকে টিভির সামনে বসে থাকতে দেখল। কথা বলল না। একেবারে চুপচাপ, নির্লিপ্ত ভঙ্গি। সামির মুখ ঘুরিয়ে রাখল, নাবিলার উপস্থিতি অনুভব করার প্রয়োজনবোধ করল না। কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো উত্তর নেই, এমনকি ন্যূনতম কৌতূহলটুকুও নেই। আচরণটা এতটাই শীতল যে নাবিলা ভেবেই পেল না, আসলে কী ঘটল?
নাবিলা প্রথমে ভেবেছিল সামির হয়তো ক্লান্ত, কিন্তু সময় গড়ানোর পরও যখন কথা বলল না তখন ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি কাজ করল। সামির তো এমন না। ও তো সবসময় খোশমেজাজে, খুনসুটিতে, ভাব দেখাতে ব্যস্ত থাকে। আজকের এই নির্লিপ্ততা সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষকে সামনে এনে দাঁড় করাল। নাবিলা বিস্মিত চোখে সামিরকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল, তারপর ধীরে ধীরে চুপচাপ নিজের বরাদ্দকৃত জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আজকে ওর সাথে একটা বোঝাপড়া করার ব্যপার ছিল তবে সেটা হবে না। সামিরের দিকে তাকাতেই কেমন একটা লাগছে। মাথার ভেতর শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল, ওর হঠাৎ কী হলো?
.
সকালটা বেশ ভারী লাগছিল নাবিলার কাছে। সামিরের গম্ভীর চেহারা ওর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছিল। সামিরের মুখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, ঠাট্টা নেই; শুধু অনভিপ্রেত অবস্থা। ওকে তো নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আদৌ নিয়ে যাবে কি? ভাবসাব দেখে তো মনে হচ্ছে না। খাটে বসে নাবিলা পা দোলাচ্ছিল। চোখের কোণ দিয়ে সামিরকে দেখছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চুলগুলো যত্ন করে ঠিক করল, হাতঘড়ি পড়ল। হঠাৎই কঠিন শোনাল তার গলা,
— “যদি ক্লাস করার ইচ্ছে থাকে তাহলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যেন নিচে নামা হয়। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না।”
কথাগুলো স্পষ্ট, তবে রোবটিক ধাঁচের। ও ইচ্ছে করেই ইনডিরেক্টলি বলল নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে, নাম না নিয়েই। দায়িত্ব থেকেই হয়ত বলা।
নাবিলা থমকে তাকাল। কেন এমন করে বলছে? একটা অদ্ভুত দ্বিধা ছড়িয়ে গেল বুকের ভেতর। তবুও চুপচাপ তৈরি হয়ে নিল, শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। সামির বাইক স্টার্ট করতেই সে চুপচাপ পিছনে বসল। বাইকের গতি যত বাড়ছিল, নাবিলার সংকোচ ততই তাকে গুটিয়ে ফেলছিল। নিজের অজান্তেই সে গাঁট হয়ে বসে রইল।
— “এমন কেন লাগছে? এ কেমন সামির? এত বেমানান?” প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরল। উত্তর নেই কোনো।
বাইক এসে গন্তব্য থামল। নাবিলা নেমে আশেপাশে তাকাল। চারপাশে তখন সকালবেলার ভিড়। কেউ ক্লাসে ছুটছে, কেউ আড্ডায় মেতেছে। সামির হেলমেটটা খুলে মিররে চুলগুলো ঠিক করে নিল, তারপর বাইকের চাবি পকেটে রাখল। মুখে কোনো বাড়তি ভাব প্রকাশ নেই। কেবল ছোট্ট করে বলল,
—“দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
নাবিলার নিজেকে ভীষণ অপরিচিত মনে হচ্ছে। সামিরের এই আচরণে সে অভ্যস্ত নয়। আর শ্রেষ্ঠা হুট করে বলে দিল ওর মধ্যে একটা জোস ব্যাপার আছে। কীভাবে বলল? পরক্ষণে নিজেই অবাক হলো নাবিলা। ভাবল, কবে থেকে সে সামিরের ভেতরে এমন দিক খুঁজতে শুরু করেছে? আশ্চর্য…
.
.
.
চলবে….