প্রিয়াঙ্গন পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
16

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৫]
~আফিয়া আফরিন

ক্লাসের এক ফাঁকে, করিডোর থেকে নাবিলা আরেকবার সামিরকে দেখতে পেল। মাঠে দাঁড়িয়ে আছে ওর কয়েকজন বন্ধুর সাথে। নাবিলা চেনে তাদের, একবার দেখা হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, ওদের সাথে সামির একেবারেই অন্যরকম।
সামিরের মুখে গাম্ভীর্যের রেখা নেই, নেই সেই খিটখিটে ভাব। বরং প্রাণখোলা হাসি, স্বতঃস্ফূর্ত অঙ্গভঙ্গি, কথার ছন্দে উচ্ছ্বাস সবকিছু মিলিয়ে আলাদা একজন মানুষ। নাবিলা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। যে ছেলেটা কয়েক ঘণ্টা আগে তার সাথে এতটা নির্লিপ্ত ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবী থেকে দূরে সরে গেছে, সেই এখন বন্ধুবান্ধবের মাঝে প্রাণবন্ত, খোলামেলা! কিন্তু নাবিলার সামনে ইচ্ছাকৃত দেওয়াল তুলে রেখে এত গম্ভীর হওয়ার কারণ কি? ও এখনও ঠিকঠাকভাবে বুঝে উঠতে পারছে না অথচ বোঝা উচিত। আজ সে যে সামিরকে দেখছে সেটাও নাবিলার না দেখা সামিরের অন্যরূপ।
ক্লাস শেষে নাবিলা ফিরছিল সামিরের সাথেই। বাইকের পেছনে বসে আছে, দুজনেই নিরব। সামির আগের মতোই গম্ভীর। কথাবার্তার ছিটেফোঁটা নেই। ঠিক তখনই রাস্তায় মাঝে দেখা হয়ে গেল অন্বেষার সাথে। অন্বেষা জরুরী গলায় বলল,
— “শোন সামির, কিছুক্ষণের জন্য তোর বউটা আমাকে ধার দে। একটু বাদেই ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।”

সামির কিছু বলল না। মুখটা একইরকম কাঠকঠিন। নাবিলাই এগিয়ে এলো। হেসে বলল,
— “চলো যাচ্ছি।”
সামির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বাইক স্টার্ট দিল। নাবিলা হাঁটতে হাঁটতে অন্বেষার সাথে এগোল। কিছুদূর যেতেই অন্বেষা নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “কি রে, সামিরের কী হয়েছে? বাংলার পাঁচের মত মুখ করে রেখেছে কেন?”

নাবিলা থমকে গেল। ওর বুকের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গতকাল থেকে নিজের মধ্যে গোপন রেখেছিল সামিরের নির্লিপ্ত আচরণ। কিন্তু এখন মনে হলো, অন্বেষার সামনে খুলে বললে ভালো হয়। হয়তো একটু হালকা লাগবে। চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল নাবিলা,
— “আমিও বুঝতে পারছি না আপু… ওর কী হয়েছে। হঠাৎ করে একদম চুপচাপ, নির্লিপ্ত। আমার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। মনে হচ্ছে আমি কিছু ভুল করেছি অথচ কী ভুল, সেটাও জানি না…” কথাগুলো বলার সময় নাবিলার গলায় হালকা কম্পন এলো। ও নিজেও বুঝতে পারছিল না এই কষ্টের কারণ। অন্বেষা ব্যপারটা হেসেই উড়িয়ে দিল। ছোটোবেলা থেকে এরা একসাথে বড় হয়েছে, একজন আরেকজনকে হারে হারে চেনে। তাই নাবিলার কথাটা অন্বেষার কাছে হাস্যকর ঠেকল বটে। বলল,
— “আরে এটাই তো সামির! ছোট থেকে ওর স্বভাব এমনই। মাঝে মাঝে চুপচাপ, মাঝে মাঝে খিটখিটে। আবার দেখবা, হঠাৎ করে খুব আপন হয়ে যাবে। আমরা ছোটবেলায় ভাবতাম সামির হিরো টাইপ কিছু একটা হয়ে যাবে। ওর ভাবসাব-ই আলাদা ছিল। আয়ান আর ওই খুব কাছের ছিল। আমি সামান্য একটু ছোটো তাই আমাকে এত্ত ক্ষ্যাপাতো, ঝগড়া করত। আমাকে খেলায় নিত না, জানো? আমি নাকি দুধভাত। আমি কান্না করতাম, তখন ওরা হাসতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও ভীষণ নরম। রেগে যায় তাড়াতাড়ি, আবার মনও গলে যায় তাড়াতাড়ি।”
নাবিলা চুপ। অন্বেষার আরেকটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। ও হেসে বলল,
— “আরেকটা কাহিনী শোনো, একবার আমার হাত কেটে গেল অনেকখানি। তখন আমাদের বয়স কত হবে? ওই সাত/আটের মাঝামাঝি। আমি মায়ের ভয়ে চুপ করে গেলাম। নিজের ব্যথা চেপে ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে আছি। ওই সময় সামির এলো। স্বভাববশত নিজের ঠাট্টামি শুরু করে দিছে। আমি কিছুই বলছি না। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল, আমার হাতের দিকে। ওমা… আমাকে আশ্চর্যের আসমানে পৌঁছে দিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তুমি বিশ্বাস করতে পারো, যে সামির সর্বক্ষণ আমায় নিয়ে মজা করে ও আমার হাত কাটা দেখে কাঁদতেছে। তুমি ওর ওই আহাজারি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবে না, নাবিলা।”

নাবিলা একটু হাসল। বলল,
— “বুঝলাম। তবে আমার সাথে রাগ করার কারণটা বুঝতেছি না।”
— “ওর রাগ বেশি। দেখো গিয়ে কার না কার সাথে রাগ করে সেটা তোমার উপর দেখাচ্ছে।”
— “উঁহু।” নাবিলা বেশ ভাবুক গলায় বলল।
— “তবে?”
— “সেটাই তো বুঝতেছি না আপু। এর আগেও অনেকবার আমি ওর সাথে উদ্ভট আচরণ করেছি। কিন্তু এতটা সিরিয়াস কখনো দেখি নাই। আমি আসলে ওকে ঠিক বুঝতে পারছি না।”

অন্বেষা বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
— “ওকে বুঝতে হলে তোমাকে মিস্টার বিন হতে হবে।” অন্বেষার কথা শুনে নাবিলা হেসে উঠল।
অন্বেষা আজ বেশ অস্থির। ভেতরে টেনশন কাজ করছে। নাবিলাকে আগেই বলেছিল, ওর জীবনে একজন আছে। নাম, শাহিদ। আজ প্রথমবারের মতো শাহিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। শাহিদ একসময় রায়হানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল। হঠাৎ একটা ভুল বোঝাবুঝিতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ভেঙে গেছে অনেক আগেই আর সেই ভাঙনের পর থেকে রায়হান নাম শুনলেই শাহিদকে এড়িয়ে যায়। মানে, দু’জন দু’জনকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। তবে শাহিদের অন্বেষাকে এড়ানোর উপায় নেই, ভালোবাসে তো।
অন্বেষা জানে, যদি বাসায় সরাসরি শাহিদের কথা বলে তবে রায়হান সরাসরি মানা করে দেবে। তর্ক-বিতর্কে উত্তপ্ত হয়ে আরেক কান্ড ঘটবে। বাড়িতে এখন টুকটাক ওর বিয়ের আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সবাই মাঝে মাঝে বিয়ের প্রসঙ্গ টেনে আনছে ফলে চাপটা আরও বাড়ছে।
এখন অন্বেষার একটাই চিন্তা, কীভাবে রায়হান ভাইয়াকে ম্যানেজ করা যায়? যদি কোনোভাবে ওর সম্মতি আদায় করা যেত, তাহলে ভাইয়াই সবটা করত। যেখানে ভাইয়ার সামলানো উচিত ছিল সেখানে ও নিজেই বাঁধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিষয়টা নিয়েই শাহিদের সাথে কথা বলতে যাচ্ছে। শাহিদের প্রতি ওর অনুভূতি যে কেবল মোহ নয়, সত্যিকারের টান; এই সত্যিটা অন্বেষা নিজের ভেতরে খুব আদর-যত্ন করে লালন করে।

শাহিদকে দেখে নাবিলার প্রথমেই ভালো লেগে গেল। চেহারার দিকে স্মার্ট, তারচেয়ে বড় কথা ওর চোখেমুখে যে আন্তরিকতা ফুটে উঠছে, সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল। অন্বেষা আপুর সাথে দাঁড়ানো অবস্থায় দু’জনকে একসাথে বেশ মানিয়ে গেছে। সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিকটাও নাবিলার চোখ এড়াল না। শাহিদ কেবল ভালোবাসে না, অন্বেষার ভালোমন্দের দিকটা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করে। এই মেন্টালি সাপোর্টটাই আসল। অন্বেষা যে ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তায় ভুগছে, সেটা শাহিদ খুব সহজেই বুঝে ফেলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে বারবার আশ্বাসের সুরে বলছিল,
— “এত চিন্তা করো না, অন্বেষা। আমি আছি তো। আমি থাকতে তোমার এত প্যারা নিতে হলে আমার থাকার মানেই বা কী? শোনো, যদি আমাদের কারণে রায়হানের সাথে আমাকে যোগাযোগ করতে হয়, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলব। সবকিছু একসময় ম্যানেজ হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না।”
অন্বেষা কষ্ট করে হেসে মাথা নাড়ল। শাহিদের কথায় তার ভরসা আছে কিন্তু এইমুহূর্তে নিজের ভাইকে ভরসা করতে পারছে না। নাবিলা দেখেছে প্রায় সম্পর্ক গুলোতে বড় ভাইয়েরা ভিলেনের রোল প্লে করে। ভাগ্যিস ওর কোনো বড় ভাই ছিল না। আর থাকলেও বা কি হতো? নাবিলা তো প্রেম করত না। ওর তো আচমকা বিয়েটাই হয়ে গেল… বিয়ের কথা মাথায় আসতেই সামিরের কথা মনে পড়ে গেল। নাবিলা ওখানে দাঁড়িয়েই একটা সিদ্ধান্ত নিল, সামিরের সাথে ওর মতই ব্যবহার করবে। পেয়েছে কি? সবসময় নিজের মর্জিমত চলবে? না, তা হবে না। নিজে সর্বক্ষণ এড়িয়ে চলবে আর আরেকজন ওর জন্য হেদিয়ে মরবে? উঁহু, তা হবে না।
ব্যপারটা এমন হলো যে; নাবিলা দেখিয়ে দিবে, ব্যাটা তুই কোন হরিদাস পাল? তারচেয়েও বড় হরিদাস পাল আমি।
.
টানা দুইদিন আড়ি-আড়ি খেলায় কেটে গেল। দু’জন দু’জনের দিকে ভুল করে তাকালেও চোখ সরিয়ে নেয় আর কথা বলা তো দূরেই থাক। একই ছাদের নিচে থেকেও দু’জন দুই ভুবনের মানুষ। একেকজনের ভেতরে একেকরকম হরিদাস পালগিরি চলছে; একজন নিজের অহং আঁকড়ে ধরে আছে, একজন দেখাচ্ছে নির্লিপ্তির মুখোশ।
আজ তৃতীয় দিন। নাবিলা মেজাজ গরম করে ক্লাসে বসে আছে আর সামিরও ক্যাম্পাসের ভেতরেই। লেকচারারের লেকচার শুনে মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছে। এইমুহূর্তে মাথার উপর একটা ডিম রেখে দিলে সিদ্ধ হয়ে যাবে নিশ্চিত।
একটু আগেই হুট করেই চোখে পড়েছিল, সামির লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছে। একা নয়, পাশে একটা মেয়ে। দু’জনেই হাসি-ঠাট্টায় মত্ত ছিল। মেয়েটার খিলখিল হাসি নাবিলার কানে বারুদ ধরাল। ওই মেয়েটার দাঁত কেলানো হাসি নাবিলার চোখে একরকম বেয়াদবি মনে হলো। মনে হচ্ছিল, এখনই যদি ছুটে গিয়ে কানের নিচে এক থাবড়া বসিয়ে দেওয়া যেত তবে ওর হাসির বাত্তি নিভে যেত মুহূর্তেই আর নাবিলাও মানসিক শান্তি পেত।
ও টের পেল, ওর ভেতরের হিংসেটা গলগল করে উপচে পড়ছে। সামির একবারও পেছনে ফিরে তাকায় নাই। এমন একটা ভাব ছিল যেন ওর চারপাশে কিছুই নেই। সেই মেয়েটার সাথে গল্পের স্রোতে ভেসে যাওয়াই ওর জীবনের মূল লক্ষ্য।

নিয়মিত ক্লাস করায় আর স্বাভাবিক মিশুক স্বভাবের জন্য অল্প সময়েই নাবিলার দুটো ভালো বান্ধবী জুটেছে। তাসনিম আজ অনুপস্থিত, তাই সঙ্গী হলো মাধুর্য। ক্লাসের ফাঁকে নাবিলা হঠাৎ বলল,
— “এই ক্লাসটা শেষ হলে আমরা লাইব্রেরীতে যাবো, ওকে?”

মাধুর্য মুখ ভার করে বলল,
— “আমি তো চাইতেছিলাম বাইরে একটু ঘুরতে। লাইব্রেরীতে আবার কী আছে?”

নাবিলা দুষ্টুমি ভরা রহস্য গলায় উত্তর দিল,
— “চোর আছে।”
— “কি? চোর? কই? কাকে বলছিস?”
— “বলতেছি, আগে চল।”
মাধুর্য অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। নাবিলার চোখেমুখে কেমন খুনসুটি খুনসুটি ভাব।
আসলে মাধুর্য জানে না, কেউ-ই জানে না যে নাবিলার বিয়ে হয়েছে। এটা এমন একটা সময়/বয়স, অনেকেরই বিয়ে হয়ে যায়। অনেকেই সংসারের ফাঁদে পড়ে যায়। তাই মাধুর্য জিজ্ঞেস করেছিল, নাবিলা হ্যাঁ/না তে উত্তর দেয় নাই। অদ্ভুত একটা মুখভঙ্গি করেছিল। তা দেখে মনে হচ্ছিল, “বিয়ে? সেটা আবার কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?” কিন্তু সত্যি হচ্ছে নাবিলার বিয়ে হয়ে গেছে আর ওর স্বামী মহাশয়ও এই একই ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনো লাইব্রেরীতে, কখনো বন্ধুদের সঙ্গে। নাবিলা এখনই কাউকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করছে না। জানিয়ে কি হবে?

লাইব্রেরীর নির্জন শান্ত পরিবেশে ঢুকতেই নাবিলার চোখ থেমে গেল এককোণে। সেখানে সামির বসে আছে। তার পাশে ওই মেয়েটা; চোখেমুখে অজস্র উচ্ছ্বাস আর কথার ঝর্ণা থামছেই না। সামিরও মন দিয়ে শুনছে, মাঝেমধ্যে মাথা নেড়ে জবাব দিচ্ছে। ওদের দু’জনের ভঙ্গিমা আলাদা করে চোখে পড়ার মতো না। তাই মাধুর্য পাশ কাটিয়ে বই বাছাই করতে লাগল। নাবিলা তা পারল না। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইল। গুজুরগুজুর, ফুসুরফাসুর লাগাম ছাড়া ট্রেনের মত চলছে। সামির নাবিলার উপস্থিতি টের পেল। চোখের কোণায় তাকাল। কোনো অভিব্যক্তি নেই, তারপর আবার পুরো মনোযোগ ফেরত গেল পাশে বসা মেয়েটির গল্পে।
নাবিলা পুরো দৃশ্যটা নিরবে লক্ষ্য করছিল। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা যে যার মতো বইয়ে ডুবে আছে, কেউ নোট নিচ্ছে, কেউ আবার প্রশ্নোত্তরে খাতায় মনোযোগী। অথচ এখানে বসা দু’জন ভিন্ন এক আবহ তৈরি করেছে নাবিলার মনে। সে যদি কোনোভাবে লাইব্রেরীর ইন-চার্জ তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দু’টোকে বের করে দিত।
মাধুর্য পাশ এসে দাঁড়াল,
— “ভাল্লাগে না, চল বাইরে যাই। লাইব্রেরীতে এখন আসে কপোত-কপোতীরা। ভাই, আমাদের কেউ নাই আর আমরাও কারোর না। বের হই।”

নাবিলা মাথা নাড়ল,
—“এখনই না।”
— “কেন? ওহ আচ্ছা, তুই বলেছিলি চোর ধরতে এসেছিস। কীসের চোর?”

নাবিলা ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলল,
— “দুনিয়ায় কত রকমের চোর আছে। আবার কতকগুলো তো আছে ছিচকে চোর‌… এরা কী কী যে করে।”

মাধুর্য চোখ কুঁচকে তাকাল,
— “লাইব্রেরীতে চোর?”

— “হুমম…” গম্ভীর শোনাল নাবিলার কণ্ঠ।
মাধুর্য আর কিছু বলল না। শুধু একবার নাবিলার মুখের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টি সরিয়ে নিল। হঠাৎই নাবিলা একটা বই তুলে নিয়ে পাতার ভেতরে মুখ গুঁজে বসল। দেখাদেখি মাধুর্যও পাশেই চুপচাপ বসে পড়ল।

সামিরের চোখ নাবিলাদের দিকে আটকে ছিল। কথোপকথনের ভাঙা ভাঙা শব্দগুলো ওর কানে পৌঁছাচ্ছিল। কী যেন ভাবছিল… হঠাৎ পাশে বসা মেয়েটার কণ্ঠস্বর ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিল।
— “চলো সামির, উঠি এখন। বাসায় যেতে হবে। দেরি হয়ে গেছে। তুমি একটু পৌঁছে দাও না। রিকশায় গেলে অনেকটা সময় লাগবে।”

সামির ছোট্ট করে বলল,
—“চলো।”
ওরা দুজন বেরিয়ে গেল। যাওয়ার পথে নাবিলা চুপচাপ তাকিয়ে রইল সামিরের দিকে। তাকানোটা তীক্ষ্ণ নয়, আবার একেবারেই নিরাবেগও নয়; মিশ্র কিছু। হুহ, একেবারে দাতা হাতেম সেজেছে।

সামির ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে নাবিলার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও নাবিলাকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দূর থেকে ওকে মূল ফটক পেরোতে দেখে সামির অবাক হলো। স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গেল। নাবিলার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেই সে থমকে গেল। সামিরের থমথমে গলায় শব্দ উঠল,
— “কি সমস্যা তোমার?”

নাবিলা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— “আমাকে বললেন? সরি, বাট আমি তো আমার কোন সমস্যার কথা আপনাকে বলি নাই।”

সামির একবার ওর দিকে তাকাল, আরেকবার চোখে রাস্তার পাশের দৃশ্য। তারপর জিজ্ঞেস করল,
— “একা একা কোথায় যাচ্ছো?”

নাবিলা সরাসরি তাকিয়ে বলল,
— “বাড়ি যাচ্ছি। এখন নিশ্চয়ই বলবেন না যে, আপনার বাড়িতে আমি যেতে পারব না। তাই বলে দিচ্ছি, আমি আমার শ্বশুড়বাড়ি যাচ্ছি।”
— “বেশি কথা বলো না।” সামিরের খিটখিটে কণ্ঠ।

নাবিলা খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— “এভাবে আমার পথ আটকে রেখেছেন কেনো? সরে দাঁড়ান।”
সামির ওর হাত চেপে ধরল। ধীরে ধীরে নয়, বেশ একপ্রকার টেনেই বাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
— “আমার সাথে বেশি দাদাগিরি দেখিও না।”

নাবিলার চোখে বিস্ময়। চোখে অস্থিরতা। থমথমে গলায় বলল,
— “আমাকে জোর করছেন কেনো?”
— “প্রয়োজন মনে করেছি তাই। উঠো।”

নাবিলা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— “আপনার প্রয়োজনের ধার ধারি না। আমি আপনার সাথে যাব না। কিছুতেই না।”

সামির কারণ জিজ্ঞেস করল না। সে শুধু ধমক দিয়ে বলল,
— “নখরা করো না।”

নাবিলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনার সাথে কেনো যাবো?”

সামির স্বর সংক্ষেপে উত্তর দিল,
— “আমি বলেছি তাই।”

নাবিলা ক্ষেপে গেল,
— “আপনি বললে আমার কি?”

সামির স্পষ্ট কণ্ঠে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উচ্চারণ করল,
— “জরুরী কাজকর্ম ফেলে আমি তোমাকে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কেনো করছিলাম? আমার কিসের ঠেকা পড়ছিল?”

নাবিলা চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
— “আমি তো আপনাকে বলি নাই। আমি রাস্তা চিনি।”

সামির চোখ গরম করে তাকাল। কিছু না বললেও নাবিলা তার চোখের ভাষা থেকে বুঝতে পারল, সে কী বলতে চায়। নাবিলা খানিকটা থমকে তারপর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
— “ঠিক আছে। যেহেতু অপেক্ষা করেছিলেন, আমি ঋণ রাখব না। আজ যাচ্ছি, তবে কাল থেকে অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এটুকু রাস্তা আমি একলা যাতায়াত করতে পারি।”
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে নাবিলার মনে একটা মিশ্র অনুভূতি জাগছে। সামিরের কথা শোনার সময় তার হৃদয় একটু দ্রুত স্পন্দিত হয়েছিল। নাবিলার কি একটু ভালো লাগছে? সামির যে ওর সাথে কথা বলল? মনে হয় লাগছে। রাগ লাগছে না তো আর।

নাবিলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সামির ফের বেরিয়ে পড়ল। নাবিলা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হলো, খাওয়া-দাওয়া করল। ওর মনটা এখন ফুরফুরে। কেনো যেন মনে হচ্ছে, হরিদাস পালের ভাবটা আর বেশিক্ষণ নিজের ভেতর ধরে রাখতে হবে না। সন্ধ্যার পর নিজের বইগুলো গুছিয়ে রাখছিল। পড়ার টেবিলের একটা ড্রয়ার লক করা। একটু কৌতূহলী দেখাল নাবিলাকে। সে কৌতুহল থেকে আশেপাশে চাবি খুঁজছিল। অন্য ড্রয়ার, চাবি যেখানে যেখানে থাকে সবখানে খুঁজল। প্রয়োজন ছিল না কিন্তু নাবিলার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল অন্যান্য ড্রয়ারগুলো খোলা থাকলেও এটা বন্ধ কেনো?
নাবিলা চেয়ার নিয়ে তাতে পায়ের আঙুলে ভর করে দাঁড়িয়ে আলমারির উপর উঁকি দিল। ঠিক তখনই সামির ঘরে এলো। নাবিলাকে বাদড়ের মত ঝুলতে দেখে পেছনে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল,
— “এখানে কি করছো?”

অপ্রস্তুত চমকে উঠল নাবিলা। শরীরটা ভারসাম্য হারাল। কেঁপে উঠল। পা ফসকে যাচ্ছিল… যেতে যেতে পড়ে যেতে উদ্যত হলো। পড়ে যাওয়া ঠেকাতে সামির এক ঝটকায় হাত বাড়িয়ে ওকে আঁকড়ে ধরল। নাবিলার অর্ধেক শরীর ইতোমধ্যেই কাত হয়ে গিয়েছিল, সামিরের হাতে আটকে না থাকলে ধপাস করে মেঝেতে পড়ত। দু’জন একমুহূর্তেই একেবারে কাছাকাছি চলে এলো।
চোখ বড় বড় করে তাকাল নাবিলা, শ্বাসও অনিয়মিত হয়ে গেল। সামিরের হাত এখনো শক্তভাবে তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। নাবিলার বুকের ভেতরে ঢেউ খেলে যাচ্ছে আর সামিরের চোখ আটকে আছে নাবিলার চোখে। সেই চোখে প্রথমবার সামির দেখল, দ্বিধা আর ভঙ্গুরতার সংমিশ্রণ।
মুহূর্তের জন্য চারপাশের সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। রয়ে গেল কেবল দু’জনের নিঃশ্বাসের শব্দ আর কাছে আসার অপ্রত্যাশিত টান। ঘটনা সামলে সামির নাবিলাকে ছেড়ে দিল। নাবিলা চোখ ফিরিয়ে নিল, গাল লালচে হয়ে উঠল। সামির হাত সরিয়ে নিলেও চোখ সরাতে পারল না। নাবিলা অস্বস্তি নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “আমি তো শুধুমাত্র খুঁজছিলাম…”
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৬]
~আফিয়া আফরিন

সামিরের হাত থেকে নিজেকে আলগা করে নিতেই নাবিলা দ্রুত পাশ ফিরল। কিছু হয়নি এমন ভান করল কিন্তু বুকের ভেতর তখনও ঢাক বাজছে। মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল। সামিরের গম্ভীর চেহারার আড়ালেও তাহলে অন্য একজন মানুষ লুকিয়ে আছে যে হঠাৎ করে হাত বাড়িয়ে ঠিক সময়ে তাকে ধরে ফেলে।
— “কী?” সামিরের কণ্ঠে নাবিলার হুঁশ ফিরে আসে।

চমকে উঠে ধরা খাওয়া ছাত্রীর মতো নাবিলা ধীরে ধীরে পিছনে ঘুরল। সামিরের চোখে চোখ পড়তেই থতমত খেয়ে ফেলল।
— “কীসের কী?” গলা শুকিয়ে এলো নাবিলার, কথাগুলো এলোমেলো হয়ে বেরোল।

সামির ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “কি খুঁজছিলে ওইভাবে?”

হাত-পা গুলিয়ে গেল নাবিলার।
— “ইয়ে মানে… কিছুনা।”

সামিরের ঠাণ্ডা স্বরে ব্যঙ্গ মেশানো অভিব্যক্তি ভর দিল,
— “কিছুনা?”
— “না।” ঠোঁট কামড়ে ধরল নাবিলা।

সামির ভুরু কুঁচকে হালকা গম্ভীর সুরে বলল,
— “বেশ! বাইরে থেকে দেখতে তো খুব সাহসী মনে হয়, অথচ ভেতরে এত ভীতু? সামান্য ডাকেই এমন পড়ে গেলে? এভাবে যদি সর্বক্ষণ দিনে দুপুরে মানুষের গায়ে উল্টে পড়তে থাকো, তবে তো বহুত সমস্যা।
নাবিলা চমকে চোখ বড় বড় করে সামিরের মুখের দিকে চাইল। কথাটা শুনে কান গরম হয়ে উঠল। ঠোঁট কামড়ে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু শুনতেই পায়নি এমন ভাব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেমন ধকধক করে উঠল।
এমন সময় হঠাৎ রেশমার ডাক আসে, তিনি নাবিলাকে ডাকছেন। এক ডাকেই নাবিলা প্রায় দৌড়ে গেল অস্থির ভঙ্গিতে। হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে পড়ল দরজায়। একবার পেছন ফিরে চাইল। চুলগুলো কপালের সামনে নেমে এলো। নাবিলা তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে নিয়ে বলল,
— “অন্বেষা আপু আপনার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল।” সামির ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল। ঠোঁটের কোণে খেলা করল অব্যক্ত হাসি, তবে সেটা নিজের কাছেই সীমাবদ্ধ রাখল। চোখে-মুখে কোনো বিচলন নেই। তারপর কেমন অবহেলার সুরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— “হুম্… ড্রামা না করলে বোধহয় দিনটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।” এরপর সামির নিজের মতো ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। একটা জরুরী কাজ আছে। জরুরী কাজ… মনে হতেই মনে পড়ে গেল, আজ দুপুরে নাবিলা দেখেছে সামিরকে তানিয়ার সাথে। মাথার ভেতর খচখচ করে উঠল। নাবিলা কি ভেবেছে? উল্টাপাল্টা কিছু? কিন্তু ব্যপারটা তো সেরকম নয়। একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে? ওহ হ্যাঁ, নাবিলা ওর বান্ধবীর সাথে কীসের চোর ধরার কথা বলছিল। এটা তো জিজ্ঞেস করা যেতেই পারে। হুম…

নাবিলা শাশুড়ির সাথে বসে গল্প করছিল। রেশমা ওর চুল বেঁধে বিনুনি করে দিচ্ছিলেন যত্ন করে। নাবিলার মনে হলো, মা-ও ঠিক এইভাবে আদর মাখিয়ে চুল আঁচড়ে দিত। তিনি সামিরের ছোটবেলার মজার ঘটনা শোনাচ্ছিলেন।
— “সামির… ওর ছোটোবেলা থেকেই এমন ছিল।”
— “ও কি দুষ্টু ছিল?”

রেশমা মুচকি হেসে বললেন,
— “একেবারে দুষ্টুও না আবার একেবারে ভদ্রও ছিল না। কখনো রাগত, হাসত, মেজাজ দেখাত আবার মাঝখানে সবই।”
— “ওর সেই ছোটোবেলার দুষ্টুমি আজও আছে।”

রেশমা একটু চতুর চোখে জিজ্ঞেস করল,
— “তোমার সাথেও করে?”

নাবিলা বুঝে উঠতে পারল না,
— “কী?”
— “দুষ্টুমি।” রেশমা হেসে বললেন।
নাবিলা আনমনা হয়ে গেল। ভেবেছিলো ও সামিরকে ভালো মতো চিনে গেছে। কিন্তু এখন মনে হয়, ওকে চেনা মুশকিল। উত্তর দেওয়ার আগেই সামির এসে হাজির। দু’জনকে হেসে-গল্প করতে দেখে চোখ পিটপিট করে চেয়ে বলল,
— “সারাদিন এত হাহা-হিহি কীসের?”

দুজনেই সামিরের দিকে ঘুরে তাকাল। রেশমা কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু নাবিলা হুট করে বলল,
— “কেনো হিংসে হয়?”

সামির খানিক অবাক,
— “আশ্চর্য হিংসে হবে কেনো?”

নাবিলার চোখেমুখে একরকম নীরব অভিব্যক্তি,
— “তবে? নিজে তো সারাক্ষণ মুখটা বাংলার পাঁচের মত করে রাখছে। আর অন্যের হাসা সহ্য হয় না।”
— “তোমাদের হাসাহাসি আমার ঘর পর্যন্ত কেনো পৌঁছাবে?”

দু’জনের মাঝখানে রেশমা বলে উঠলেন,
— “সামির, এত হিংসে করছিস কেনো? তুইও আয় না। আমার কত দুঃখ ছিল একটা মেয়ে নিয়ে। সারা ঘর হেসে খেলে বেরাবে, লাফালাফি করবে। সেই স্বপ্ন তো মাত্র পূরণ হলো। আর তুই কিনা? যা তো বাবা, ভালো না লাগলে বাইরে যা। আমাদের বিরক্ত করিস না।”
মায়ের কথার পরে সামির মুখ গোমড়া করে ফেলল। মা এই মেয়েটার জন্য তার একমাত্র আদরের ছেলেকেই কিনা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলছে? সামির নাবিলার দিকে চোখ গরম করে তাকাল। দেখল, ওর চোখে ঠাট্টা আর লাজ মেশানো। নিজের গরিমার সঙ্গে হঠাৎ লাফানো বাচ্চার মতো আনন্দ খেলা করছে।
সামির বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “কথা আছে।” এটুকু বলেই সে চলে গেল। নাবিলা বুঝতে পারল, সামির কথাটা ওকেই বলেছে। কিন্তু পাত্তা দিল না। রেশমা কয়েকবার বলল যাওয়ার কথা। নাবিলা “যাব, যাব” করছিল। সামির খুব তো কয়েকদিন পাট নিয়ে থেকেছিল, এইবার নাবিলাও থাকবে। ডাকলেই যেতে হবে নাকি? তিনি তো নিজের মতোই ঘোরে, নিজের মতোই সময় কাটায়। আর আজ তো একেবারে কোন একটা মেয়ে সাথে… হাসাহাসি, গুজুরগুজুর; সেটা মনে করে মৃদু ঈর্ষার মতো একটা অদ্ভুত অনুভূতি বুকের ভেতরে এখনও খচখচ করে উঠছে। নাবিলার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই মেয়েটার হাসিমুখ সাথে সামিরেরও। ওই ঘরের দিকে এগোতেই বুকের মধ্যে কম্পন ধরে গেল আর চোখের কোণ ভিজে আসলো কিছুটা অপ্রকাশিত অনুভূতির কারণে।
নাবিলা অচেতনভাবে তার মনকে সামলাতে চেষ্টা করল। চোখে মিশ্র অনুভূতি। একটা অংশে সামিরের জন্য ক্রোধ, অন্য অংশে আকর্ষণ আর একটু ঈর্ষা; সব মিলেমিশে ঝলমল করছে। সে চোখের কোণে সামিরকে দেখল।
নাবিলা গভীর শ্বাস নিল। নিজের মনকে বোঝাতে লাগল,
— “এটা কি হচ্ছে? আমি কেনো ওকে ভাবছি? আমার তো ভাবার কোনো কারণ নেই। ও নিজের মত থাকুক না। কার সাথে কী করছে তাতে আমার কি? আমার সহ্য শক্তিতে কবে থেকে এমন ভাটা পড়ল?” তারপরেও ওর চোখে সামিরের ছায়া ভেসে উঠল, বুকে অজানা উত্তেজনা আর অস্বস্তির জোরালো স্পন্দন। সে নিজের অনুভূতির তোলপাড়কে ঠেকাতে চেষ্টা করল কিন্তু যতই নিজেকে বোঝায়, হৃদয় ততই ওর বিপরীতে চাপ প্রয়োগ করছে। ভীষণ চেঁচিয়ে বলছে, “নাআআ, তুমি একদম নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।” নাবিলা ঘরের মধ্যে না ঢুকেই দরজায় দাঁড়িয়ে আবোলতাবোল ভাবছিল। তার এই প্রশ্নের উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া ভীষণ জরুরী। না হয় শান্তি পাবে না। কার কাছে যাবে? অন্বেষা আপু! হ্যাঁ, সে ঠিকঠাক উপায় বাতলে দিতে পারবে।

নাবিলা যেহেতু অনেকক্ষণ ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল সামির ওকে লক্ষ্য করল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? অনেকক্ষণ আগে তোমায় ডেকেছিলাম।”

নাবিলা নিজেকে সামলে নিল,
— “বলুন।”

সামির মুখ ঘুরিয়ে নিল। গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
— “এখন তো বলব না।”
— “তবে ডেকেছিলেন কেনো?”
— “তখন বলতে চেয়েছিলাম তাই ডেকেছি। তুমি যেহেতু তখন আসো নাই, তাই এখন বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।” সামিরের গলায় একধরনের বিরক্তি।
— “একটা কাজ করছিলাম। তাই…”

সামির কটমট করে তাকাল,
— “আমিও এখন কাজ করছি। যাও।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল নাবিলা। তারপর নরম স্বরে বলল,
— “আপনার সাথে আমার কথা ছিল।”
সামির কোনো বাক্যব্যয় করল না। ভেতরে ভেতরে ওর ভ্রু আর চোখের ভাঁজে অদৃশ্য টান পড়ল। এইমুহূর্তে মেপে মেপে যতটুকু বলতে চেয়েছিল, ততটুকুই বলেছে সে। বাকিটা মুখে আনেনি। নাবিলা যদি তখনই চলে আসতো, হয়তো নিজের দিকটা স্পষ্ট করে বলেই দিত। কিন্তু কেন বলত? আদৌ কি ওর কাছে কিছু পরিষ্কার করার প্রয়োজন আছে? এই প্রশ্নটা হঠাৎ মাথায় এলো সামিরের। ভাগ্যিস ও তখন আসে নাই, আর ঠিক সেই কারণেই মনে মনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে নাবিলাকে ধন্যবাদ দিতেও ভুললো না।
নাবিলা ইতস্ততবোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এক অন্যরকম দ্বিধা ওকে জাপটে ধরেছে। বলবে কি বলবে না, এ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে। মনে হলো, সম্পর্কের নিয়মে আর লিখিত আয়োজনে কিছু প্রশ্ন করার অধিকার তার আছে। কিন্তু এই অধিকার কি সবকিছু নিশ্চিত করে? এই অধিকারেই কি প্রতিটা উত্তর মেলে? নাকি কিছু উত্তর অধিকার চাওয়া ছাড়াই নিজেরাই জন্ম নেয়?
দু’জনের মাঝখানে ভারী নীরবতা জমে উঠল। সামির চোখ নামিয়ে কাজে মন দিল। নাবিলা নিঃশ্বাস ফেলল, বুকের ভেতর জমে থাকা কথাগুলো ঠেলে বাইরে আনতে চাইল কিন্তু ঠোঁটের আগায় এসে আবার থমকে গেল। শেষমেষ আমতা আমতা করে বলল,
— “আপনার সাথে আজ ওই মেয়েটা কে ছিল?”

সামির ভুরু কুঁচকাল অথচ গলায় স্বাভাবিক ভান নিয়ে এলো,
— “কোন মেয়ে?” সামির ইচ্ছে করেই এমন ত্যাড়া উত্তর দিল।
নাবিলার ভেতর রাগ চেপে উঠল। দিনে কত মেয়ের সাথে ঘোরে সে? ছিঃ। উত্তরটা জানতে না পারলেও প্রশ্নটা বুকের ভেতরে গেঁথে রইল। ঠোঁট শক্ত করে সামিরের দিকে এক তির্যক, অচ্ছুত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। সামির ঠোঁটের কোণায় বিদ্রূপ টানল, যেনো কিছুই যায় আসে না তার।
আর ঠিক তখনই নাবিলা ঘুরে দাঁড়াল রাগে, কষ্টে, অপমানে। কোনো শব্দ না করে তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ঘরে একা বসে রইল সামির। চারপাশ হঠাৎ শুনশান মনে হলো।
সামির খুব ধীরে নিজের কপালে হাত রেখে একটু চাপ দিল, দীর্ঘশ্বাস আটকে আবার টেবিলের দিকে ফিরল। মুখে এমন ভঙ্গি, যে নাবিলার রাগ-অভিমান তার কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন। কিন্তু ভেতরে কোথাও একটা হালকা শূন্যতা গুমরে উঠল, মাথা চাড়া দিয়ে উঠল অসহ্যকর অনুভূতি। মনের গহীনে কিছু একটার খচখচানি হচ্ছে, অথচ সেটা স্বীকার করতে পারছে না। এমন সহজ স্বীকারোক্তির মানুষ হয়ত সামির নয়। তাই ফের কাগজপত্রে চোখ রাখল, কলমে ঘোরাতে লাগল আঙুল। কিছুই হয়নি, সব স্বাভাবিক।
.
দু’দিন চোখের পলকে কেটে গেল সামিরের। সকাল থেকে রাত অবধি সাখাওয়াত হোসেনের সাথে কাজে ছোটাছুটি। সবমিলিয়ে পুরোপুরি দমবন্ধ করা ব্যস্ততা। দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটত বাইরে, রাত দেড়টা কিংবা দুইটার আগে ঘরে ফেরাই সম্ভব হতো না। ফেরার পর মাকে বসে থাকতে দেখত। ছেলেকে খাওয়ানোর পরই তিনি ঘুমাতে যেতেন। নাবিলার ঘরে তখন নিশ্চুপ আলো, ভেতরে ঘুমে ডুবে থাকা মুখ। দু’দিন প্রায় কোনো কথাই হয়নি তাদের মধ্যে, চাইলেও হয়ে উঠেনি। নাবিলা চেয়েছিল কিনা কে জানে? আর সামির? ও চাইলে সময়কে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসে কথা বলতেই পারত।
আজকের দিনে অতিরিক্ত দৌড়ঝাঁপ নেই, মাথার উপর চাপটাও কম। সন্ধ্যা নামতেই বাবার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথেই সামির একটা স্বস্তি টের পেল। মোবাইল বের করে নম্বর ডায়াল করল। একে একে বন্ধুদের খবর দিল, আরাম করে বসে আড্ডা দেওয়া হবে আজ।
চারজনের আসতে দেরি হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই হাজির, তারপর পাঁচ মাথা এক হয়ে বসলো পাড়ার পুরনো চায়ের দোকানে। এলাকাটা এমনিতেই সবসময় সরগরম থাকে, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা ভিড় আর কোলাহলের রঙটা একটু গাঢ় হয়।

সামির মাত্রই একটা সিগারেট ধরাল। এক টান দিতেই দূরে শাহিদ ভাইকে এগিয়ে আসতে দেখল। দু’টো ঝটপট টান মেরে হাতের সিগারেট ইশরাকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করল, “বাঁশ খা শালা।”
ইশরাক তখন রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছিল। হাতে সিগারেটটা ধরা আছে কিন্তু খেয়ালই করেনি। এরই মধ্যে শাহিদ ভাই সামনে এসে দাঁড়ালেন। বড় ভাই হওয়াতে সবাই তাকে বেশ সমীহ করে চলে। সামির বন্ধুকে পচানোর সুযোগটা মিস করতে রাজি নয়। বলে উঠল,
— “আরেহ, এত সিগারেট টানিস ক্যান সারাদিন?”

ইশরাক প্রথমে কিছুই বুঝল না। তারপর হাতের দিকে তাকাতেই চোখ কপালে। মুখটা এমন হলো যে হঠাৎ পরীক্ষার খাতায় শূন্য দেখে ফেলেছে। বাকরুদ্ধ অবস্থায় বসে থাকতে হেসে ফেলার উপক্রম হলো বাকিদের। শাহিদ ভাই হাসলেন। ইশরাকের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
— “কী রে? কার বিরহে এত ধোঁয়া উড়াচ্ছিস?” ইশরাক তখন পুরোপুরি বেকায়দায়। প্রথম কথাটা নিহাদ বলল,
— “ভাই বিরহে না, ওয় প্রেমে পড়লে ধোঁয়া উড়ায়। কারে ভাবিস এত? ক্লাসের ফর্সা মেয়েটারে? তোর না গার্লফ্রেন্ড আছে?”

ইশরাক শুকনো গলায় বলল,
— “তুই চুপ থাক।”
এইবার সবাই একসাথে হট্টগোল শুরু করল। কেউ বলল, নতুন প্রেমের নেশায় ধোঁয়া বেশি লাগে। কেউ আবার ইশরাকের মুখের ভঙ্গি নকল করে গলা কাঁপিয়ে বলল, প্রিয়তমা, তোমার জন্যই আমি নিঃশেষ হচ্ছি!
হাসির রোল উঠল দোকানজুড়ে। শাহিদ ভাইও মাথা নেড়ে হেসে ফেললেন। সামিরও সুযোগটা ছাড়ল না। চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “ভাই, দয়া করে একদিনে এত সিগারেট টানিস না। এখন তো লুকায় লুকায় ভালো লাগে। কিন্তু যখন বিয়ে করবি, তখন বুঝবি আসল কাহিনি। বউ বসে থাকবে তুই সিগারেটের ধোঁয়া উড়াবি, কল্পনা করতে পারিস? প্রথমদিনেই তোরে তোর ঘর থেকে বের করে দিবে।”

সাকিব টেবিল চাপড়ে বলল,
— “কারেক্ট, সামিরের মুখে একেবারে বিবাহিত জীবনের সতর্কবাণী!”

শাহিদ ভাই হেসে যোগ করল,
— “তোর অভিজ্ঞতার ঝুলি তো দিন দিন ভারী হচ্ছে সামির।”

সামির যখন দেখল মজার প্রসঙ্গ ধীরে ধীরে ওর দিকেই ঘুরেফিরে আসছে, তখন হাত নাড়িয়ে বলল,
— “আরে ভাই, তেমন কিছু না।”

ইশরাক তাতে থেমে থাকল না। কোমড় বেঁধে ঝগড়া করা কুচুটে মহিলাদের মত এসে বলল,
— “না না, বললেই হবে না। বিয়ে প্যারাদায়ক, ভাই। আমি জীবনেও এসবের মধ্যে নাই।”
— “কেন?” শাহিদ ভাই বলল।

ইশরাক আরও গম্ভীর হয়ে সামিরের দিকে চেয়ে বলল,
— “দ্যাখতেছেন না ভাই, সামির কথাটা বলল কী? যা রটে, তার কিছু তো বটে। আমি আমার স্বাধীন জীবনে হস্তক্ষেপ চাইনা।”

শাহিদ ভাই হাসি ধরে রাখতে পারল না। বলল,
— “বিয়ে প্যারাদায়ক না ভাই, জীবনের একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রান্না, ঝগড়া, মুখ ঝামটানি, আদর-যত্ন, ভালোবাসা, ভালোলাগা, মান-অভিমান, সম্মান, হাসি-ঠাট্টা সবই একসাথে। মানে পুরো একটা দিনে সারাজীবনের প্যাকেজ। তবে ঝগড়ার আগে একটু চিন্তা করা উচিত। মাত্রা লঙ্ঘন করলেই সমস্যা।”

ইশরাক চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,
—“ভাই, সত্যিই এমন?”

শাহিদ ভাই গম্ভীর চেহারায়, চোখে দুষ্টু ঝিলিক দিয়ে বলল,
—“দেখবি, তারপরও মজা আছে। নাহলে কে বেঁচে থাকে এই ঝগড়ার মাঝে? দায়িত্ব সামলানোর আর বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকলে তুই বিবাহিত জীবনে সুখী। এক্সারসাইজের মত একটা ব্যাপার। এক হাতে খাবার ধরো, অন্য হাতে ঘড়ি দেখো আর তৃতীয় চোখ দিয়ে বউয়ের রাগ নোট করো। বউয়ের রাগ-অভিমান নিজের দায়িত্বে বুঝে নাও। না হলে হ্যাপিনেস ইনডেক্স একদম নেমে যাবে।”
—“ভাইয়ের দেখি অনেক অভিজ্ঞতা। কী ব্যপার ভাই? আজকাল কিছুমিছু হচ্ছে নাকি?” ইশরাকের কথা শুনে অন্যরাও কৌতুহলী হয়ে শাহিদ ভাইকে চেপে ধরল।
ঠিক সেইমুহূর্তে সামিরের দৃষ্টি অন্যরকম আর মন মৃদু নরম হয়ে এলো। কিন্তু বাইরের দুনিয়ায় সে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাতেই ব্যস্ত। চারপাশে বন্ধুরা হেসে গল্প করছে কিন্তু সামিরের মনে নাবিলার কথা ঘুরছে; একটু লুকানো চিন্তায়, একরাশ মিশ্র অনুভূতি নিয়ে।

সেদিন সামির বাড়ি ফিরল নয়টার মধ্যেই। কিছুক্ষণ মায়ের সাথে বসে গল্প করল। নাবিলাকে আশেপাশে দেখা গেল না। বোধহয় ঘরে আছে। ঘরে এসেই প্রথমে চোখে পড়লো নাবিলার অনুপস্থিতি। ওর খোঁজে একবার বারান্দায় উঁকি দিল। নেই। তবে গেল কোথায়? কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মায়ের কাছে গিয়ে জানতে চাইল,
— “নাবিলা কোথায়?”

রেশমা কপাল চাপড়ে হেসে বললেন,
— “তোকে তো বলতেই ভুলে গেছিলাম। আজ নেওয়াজ ভাই এসেছিল, নাবিলা ওর বাবার সঙ্গে নাটোর গেছে।”

সামিরের মুখটা কালো হয়ে গেল। চোখে হতাশা আর কিছুটা রাগ মিলেমিশে পড়ল।
— “কবে আসবে?” কণ্ঠে অবরুদ্ধ ভাব।

— “আসবেই। গেল তো একটু আগেই। তুই বরং গিয়ে কাপড়চোপড় পাল্টে নে। তারপর এসে খাওয়া-দাওয়া কর।”
সামির মনে মনে খাওয়া-দাওয়ার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ঘরে এলো। ঘরটা একেবারে শূন্য মনে হলো, নাবিলার উপস্থিতির স্পর্শই যে এখন অনুপস্থিত। ঘরটা সারাদিন নাবিলার ছোট ছোট হাতে সাজানো থাকে, আজ কিছুটা খালি এবং অচেনা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সামির তাকিয়ে দেখল বইগুলোর পাশে কুশনগুলো একটু এলোমেলো আর বাতাসেও নাবিলার আয়ত্তের মিষ্টি সুবাস নেই। নাবিলা যেদিন থেকে এই ঘরে পা রেখেছে তখন থেকেই ঘরটা মেয়েলি মেয়েলি শান্ত নিস্তব্ধতায় ভরে গেছে। বই-পত্রগুলো, নিখুঁতভাবে সাজানো আলমারি আর দেয়ালের পাশে রাখা ছোট্ট ফুলদানি; সবকিছুই নাবিলার স্পর্শহীন, নীরব উপস্থিতি প্রকাশ করছে।
নাবিলা কি রাগ নিয়ে গেল? নিজের অজান্তেই সামির বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। আশ্চর্য, সে কি নাবিলাকে মিস করতে শুরু করেছে?
.
.
.
চলবে….

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-১৭]
~আফিয়া আফরিন

অনেকদিন পর নিজের বাড়িতে এসে নাবিলা অন্য দুনিয়ায় ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকতেই মায়ের ডাক শুনে বুকটা ভরে উঠল। কতদিন পর সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর, সেই ছুটে এসে বুকে টেনে নেওয়া; সবকিছু একেবারে আগের মত। এতদিন নাবিলা নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকে নাই। কোনো আত্মীয়ের বাসায় গেলে দুদিনের বেশি থাকে নাই। নাদিম তো একেবারে পাগলপারা। দরজা খুলতেই ধাক্কা দিয়ে বোনের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নাবিলা থাকাকালীন রিমোট নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হতো। সেই মুহুর্তে নাদিম একটু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
— “তুমি না আসলে আমার কারও সাথে ঠিকঠাক গল্পই হয় না আপু। এইবার যতদিন আছো, টিভির রিমোট তোমার।”

রাতের খাবারের টেবিলেও একরকম আনন্দ উৎসবে পরিণত হলো। মা খাইয়ে দিচ্ছে, বাবা মজা করছে। নাদিম একটুও হিংসে করছে না বরং ওর আনন্দ সবচেয়ে বেশি। অনেকদিন পর নিজের ঘরে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ওর মনে হলো, বাবা-মায়ের কাছে থাকাটাই আসল শান্তি। সামিরের সাথে যে মনখারাপ, ভুল বোঝাবুঝি, নীরব অভিমান জমে ছিল; এখানে এসে সেসব একে একে মুছে যেতে লাগল। হঠাৎ করে মনে হলো, ওর কষ্টগুলো তত বড় কিছুই নয়।
রাতে ঘুমানোর সময় মাকে জড়িয়ে ধরে কী দারুণ একটা ঘুম হলো। মা মাঝখানে, একপাশে নাদিম আর নাবিলা। নীতু ছোট্টবেলার মত নাবিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, টুকটাক গল্প করছিল। ওই বাড়ির গল্প শুনছিল। নাবিলা সবার কথাই বলল। শেষে রাখঢাক রেখে সামিরের কথাও বলল।
সকালবেলায় অন্বেষার ফোনে নাবিলার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ ঝাপসা, মাথা হালকা ঘোরে থাকা অবস্থায় সে ফোনটা ধরল। কথার প্রথম মুহূর্তে নিজে কিছু বলার আগেই অন্বেষার কণ্ঠ ভেসে এলো। ঝরঝরে ও একটু উৎকণ্ঠাপূর্ণ,
— “এই তুমি কখন গেছো? আমাকে বললা না তো? হঠাৎ করে উধাও। তোমার খোঁজ নিতে আসছি। এসে তো দেখি অবস্থা খারাপ।”

নাবিলা ধীরে ধীরে উঠে বসল। শরীরটা এখনও ঘোলাটে ভাবে ভাসছে। কণ্ঠটা ভীত আর অস্থির,
— “কি হয়েছে, আপু?”
— “তোমার স্বামী…” অন্বেষার কণ্ঠে থমথমে ভাব ভেসে এলো। নাবিলার বুকের মধ্যে এক ধাক্কা লেগে গেল, অচেনা অস্থিরতা জেগে উঠল। হৃদয়টা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেল। সামির? ওর কি হয়েছে?

— “কি হয়েছে, আপু?” ভীত, কণ্ঠস্বর খানিকটা কম্পমান। অন্বেষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাবিলার চোখে তখনও উৎকণ্ঠা। সে ফের বলল,
— “আপু, বলো তো?”

অন্বেষা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
— “কি হবে আবার? মরার মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে। তোমার শোকে হয়তো এতক্ষণ ঘুমাচ্ছে। কতবার ডাকলাম, পাত্তা দিল না। তুমি ওকে ফোন দাও তো। আমার এদিকে জীবন-মরণ সমস্যা আর এই ব্যাটা ঘুমায়।”

নাবিলা শুকনা মাটিতে আছাড় খেল, বুকের ভেতর ধাক্কা লাগল। শব্দগুলো কানে গুঞ্জরিত হতেই মনের মধ্যে হতবাক আর অসহায়তা তৈরি হলো। অন্বেষা এমনভাবে বলছিল, ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। নাবিলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ধীর স্বরে বলল,
— “আপু, ওর গায়ে এক জগ পানি ঢেলে দাও।”

অন্বেষার চোখে তখন একঝলক হাসি ফুটল,
— “গুড আইডিয়া।”
নাবিলা ফাজলামি করলেও অন্বেষা কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই সত্যিই সামিরের মাথায় পানি ঢেলে দিল। সামির একেবারে ধরফরিয়ে উঠে বসল। প্রথমে চোখ উপরে ছাদের দিকে উঠে গেল। ছাদ কি ফুটো হয়ে গেছে? বৃষ্টি কোথা দিয়ে পড়ছে?
কিন্তু পরক্ষণেই চোখ পড়ল পাশে দাঁড়ানো অন্বেষার দিকে। তার এক হাতে ফোন, আরেক হাতে পানির জগ। সামির বিস্ময়ের আকশ-বাতাস এফোড় ওফোড় করে চেঁচিয়ে উঠল,
— “সকালবেলা কি তামাশা শুরু করেছিস?”

সামিরের চিৎকার শুনে ফোনের এপাশে নাবিলা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। আয়হায়! অন্বেষা আপু এসব কি পাগলামি শুরু করল? ও ভীত আর চোখের আতঙ্কের মিশ্রণে আরেকটা চিৎকারের অপেক্ষায় রইল। ওপাশ থেকে অন্বেষা ধমক দিয়ে বলল,
— “এত ঘুমাস কেন?”

সামির অচিন্তিতভাবে মুখ ফুলিয়ে বলল,
— “তাতে তোর কি? তোর ভাগের ঘুম ঘুমাইছি। ”
— “তোকে ডাকতেছি না অনেকক্ষন ধরে।”
— “ডাকিস কেন?” সামির চরম বিরক্ত।

অন্বেষা জুলজুল চোখে হেসে বলল,
— “ভাবলাম তুই বোধহয় তোর বউয়ের শোকে কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ছিস।”

সামির চটিয়ে বলল,
— “আমার বউয়ের শোকে আমি যা ইচ্ছে করি, তাতে তোর সমস্যা?”
অন্যপাশে, নাবিলা সব শুনছিল। তার চোখ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বড় হয়ে গেল, হঠাৎ করেই এই সকালটা আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। সামিরের কণ্ঠে “বউ” শব্দটা এমন উষ্ণ, উত্তপ্ত, স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং মৃদু কোমলতার সঙ্গে ভরা, যে নাবিলার কানে বাজছে আনন্দের সুর। সামিরের কথার সহজাত স্নেহ আর অপরিচিতি ভাবটা নাবিলাকে খুব কাছ থেকে আলিঙ্গন করছে। ইশশশ, ও যদি সবসময় এমন ডাকত! নাবিলা আবার কথোপকথনে মনোযোগ দিল। অন্বেষা মিনমিন করে বলল,
— “বউয়ের হয়ে বলছিস। ভাই, তোর বউ-ই আমায় বলেছে তোর মাথায় পানি ঢালতে।”

সামির চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে মুখ বেজার করে উঠে দাঁড়াল। ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে গায়ে পড়ছে, চোখে-মুখে বিষন্ন ভাব ফুটে উঠলেও কণ্ঠে একধরনের অভিনয়-গম্ভীরতা,
— “আশ্চর্য! এতদূর থেকেও কলকাঠি নাড়তে হবে কেন?”

অন্বেষা হাসতে হাসতে বলল,
— “ভাই, তোর বউ মনে হয় তোর উপর অনেক রেগে আছে। ঝগড়া করেছিস তাইনা? গিয়ে মিটমাট করে ফেল। ঘুমের চেয়েও ভালো কাজ দিবে।”

সামির চোখ কুঁচকে তাকাল,
— “তুই কি আমার বউয়ের উকিল? ওকালতি শেষ হলে চলে যা। সকাল সকাল আমায় বিরক্ত করিস না।”

অন্বেষা ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল,
— “ওম্মা, এগারোটা বাজে! এটা আবার কোন সকাল? সারারাত কি করলি?”

সামির গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
— “ঘুম আসে নাই।”

অন্বেষা চোখ সরু করে কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল,
— “কেন? নাবিলাকে মিস করছিলি নাকি?” বলে দুষ্টুমি করে চোখ টিপে দিল।

সামির চুপ করে গেল। হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। তার দৃষ্টিও ফাঁকা হয়ে উঠল, ভেতরের একটা কথার ভার হালকা করে ফেলে দিল ছোট্ট একটা স্বীকারোক্তি দিয়ে।
— “হুমম…”

অন্বেষা দারুণভাবে হেসে বলল,
— “আরিব্বাস… তোর মনে তো লাড্ডু ফুটছে। এটা নাবিলাকে বলতে হবে।”

সামিরের মুখ থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো,
— “আরে…”
ঠিক তখনই ফোনের ওপাশের নীরবতা আরও নীরব হয়ে গেল। অন্বেষা খেয়ালই করে নাই, নাবিলা এখনও ফোনে রয়েছে। নাবিলা ফোনটা কেটে দিল। ওর, উনিশ বছর বয়সের পক্ষে যতটুকু শোনা সম্ভব, যতটুকু সহ্য করা সম্ভব, ততটুকু পর্যন্তই শুনে নিয়েছে। তারপর আর কানে নিতে পারল না।
নাবিলা বিছানায় চুপ করে বসে ছিল। ফোনটা নামিয়ে রাখার পরও কানে বাজছিল সামিরের কণ্ঠ, “আমার বউয়ের শোকে আমি যা ইচ্ছে করি…” তারপর সেই ছোট্ট স্বীকারোক্তি, “হুমম…” উনিশ বছরে ওর মনে একটা তোলপাড় শুরু হলো। বুকের ভেতরটা এলোমেলো হয়ে উঠল। এতদিন ধরে বইয়ের পাতায় পড়া, সিনেমায় দেখা অনুভূতিগুলো হঠাৎ বাস্তবের রূপ নিল। প্রথমবার কারো জন্য এমন অস্থিরতা, কারো একটি কথায় গলায় আটকে আসা নিঃশ্বাস; সবকিছু অচেনা, তবুও কেমন মধুর।
সে নিজে বুঝতে চাইছিল,
— “এমন কেন হচ্ছে? কেন ওর প্রতিটা কথা মনে গেঁথে যাচ্ছে? আমি তো কখনো কাউকে নিয়ে ভাবিনি এভাবে…”
তবুও অস্বীকার করা গেল না; এই যে বুক ধড়ফড় করছে, এই যে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা হালকা, চারপাশটা অন্যরকম উজ্জ্বল, এগুলো সব সামির ইয়াসিরের জন্যই।
মনে হলো, উনিশটা বছর ধরে সে হয়তো শুধু এই একটা অনুভূতির অপেক্ষাতেই ছিল। আর আজ সেই অনুভূতি এসে তার ভেতরটা একেবারে উলটপালট করে দিচ্ছে।
.
অন্বেষার খোঁচাখুঁচি, ঠাট্টা আর প্রশ্নে সামিরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। গুমরে গুমরে উঠে দাঁড়াল সে। দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে গেল,
— “দেখিস, তোর বিয়ে হবে না। মানুষকে যে পরিমাণ যন্ত্রণা দিস, বিয়ে করে কার কপাল পোড়াবি তুই?”
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে সামির দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল। অন্বেষা আসলে এসেছিল শাহিদের প্রসঙ্গ তুলতে। কিছু আলাপ-আলোচনা ছিল, নিজের ভয়-আতঙ্ক ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু সামিরের হম্বিতম্বি তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল।

সামির অন্যরুমে গিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টে নিল। বাইরে বের হতেই দেখল মাথার ওপর ভারি মেঘ জমে আছে। বাতাসে অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, বৃষ্টি নামতে আর বেশি দেরি নেই। বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে নেই। কিন্তু ঘরে বসেও দম আটকে আসছে। সে সত্যি নাবিলাকে মিস করছে। অথচ একটু আগেই অন্বেষাকে ভুলবশত কথাটা বলেই এড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ ভেতরে ভেতরে সত্যিটা অন্যরকম। স্বীকারোক্তিটা সহজে জিভে আনে না কিন্তু মনে মনে মেনে নিয়েছে। আসলে মনে স্বীকার করলে কী আসে যায়? কেউ তো আর তার ভেতরে ঢুকে চোখে দেখে যাবে না।
সিঁড়িঘরে এসে দাঁড়াল সামির। ছাদের ফাঁক গলে আকাশের কালো মেঘ দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, ওকে একটা ফোন করা যায়।
অবশ্য নাবিলাকে ফোন করার জন্য অজুহাত তার হাতে আছে। এতক্ষণে একটা ছুঁতো ঠিকই মিলেছে।
মনে হচ্ছিল, আঙুলটা যদি এখন ফোনের কিপ্যাডে গিয়ে নাবিলার নম্বরে ডায়াল করে দেয়, তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজটা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই প্রথম ধাপটা নেয়ার সাহসটাই পাচ্ছে না। আশ্চর্য, সামির কবে থেকে দুর্বলচিত্তের অধিকারী হলো?

অবশেষে দ্বিধা ভেঙে সামির ফোনটা কানে তুলল। রিং বাজতে লাগল। অন্যপ্রান্তে নাবিলার বুক ধড়ফড় করছে। হঠাৎ সামিরের ফোন? অবিশ্বাসে আঙুল কেঁপে উঠল তার। ফোন ধরতেই সামির চুপ। নাবিলা কেঁপে কেঁপে বলল,
— “হ্যালো…”
— “হ্যাঁ।”
এত সামান্য, এত সাধারণ একটা শব্দে নাবিলার মনে হাজার রঙিন প্রজাপতি ডানা ঝাপটাল। বুকের ভেতর টুকটুক শব্দে লাফিয়ে উঠল হৃদয়। কথাটা যতই সহজ হোক না কেন, নাবিলার কাছে মনে হলো সামির তাকে বলছে, “তুমি কেমন আছো? আমি তোমায় ভাবছি।”
নাবিলা হেসে ফেলল, যদিও সে হাসি ফোনের ওপাশে গোপনই রইল।
নরম গলায় উত্তর দিল,
— “হুম… হঠাৎ ফোন করলেন?”

সামির আসলে ঠিক করেছিল নাবিলাকে একবার ঝাল ঝেড়ে জিজ্ঞেস করবে, “তুমি আবার অন্বেষাকে কেন বললে আমার মাথায় পানি ঢালতে? এভাবে তুমি কেনো কলকাঠি নাড়বে?” কিন্তু গলায় এসে থেমে গেল কথাটা। ওই বাসি বিষয়টা টেনে এনে ঝগড়ার ছলে আলাপ শুরু করতে মন চাইল না। সামান্য ভয় হলো, অনেক কষ্টে শুরু করা এই কথোপকথনটা আবার ভেঙে না যায়? তাই ঠোঁটে জমে থাকা প্রশ্নটা গিলে ফেলল। তৎক্ষণাৎ কথাও বলতে পারল না। নীরবতার ভেতর দিয়ে শুধু নাবিলার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে গেল। মনে হলো, ওটাই তার জন্য যথেষ্ট।
অনেকক্ষণ নীরবতার পরে সামির শেষমেশ বলল,
— “হঠাৎ চলে গেলে? বাসার সব ঠিকঠাক?”

নাবিলা তার কথার আড়ালে চুপচাপ। একমুহূর্ত থেমে তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “হুম, বাবা নিতে আসছিল।”
— “ওহ, আচ্ছা। কেমন আছো?”

নাবিলা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দীর্ঘশ্বাস শুধু ক্লান্তির নয়, মনে ভাসমান কিছু অনুভূতিরও আভাস দিচ্ছিল। বলল,
— “এইটুকু বলতেই ফোন করেছেন?”
— “আরে না…” সামির থেমে যায়। বাকি কথাটুকু আর আসছে না। তার বয়স কত? প্রায় চব্বিশ। এই বয়সে তো একটা মানুষের জীবনে কিছুটা আত্মবিশ্বাস, কিছুটা কূটকৌশল আর অনেকটা আত্মনিয়ন্ত্রণ আশা করা হয়। সামিরের আত্নবিশ্বাস সম্পর্কে তার বেশ ভালোরকম একটা ধারণা ছিল। আজ সেই ধারণা মিথ্যা মনে হচ্ছে, ভুল মনে হচ্ছে, সব বানোয়াট, অনর্থক, অসঙ্গতি, ত্রুটি। কেননা আজ সে নিজেকে সেই নিয়মের বাইরে, অচেনাভাবে অস্থির অনুভব করছে।
নাবিলার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে ছোট্ট দুলকা নাচছে। সে অনুভব করছে, একরাশ অচেনা কোমলতা, হঠাৎ উদ্দীপনা আর কিছুটা দ্বিধা; যা সে নিজের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। চব্বিশ বছরের ছেলের জন্য এমন অনুভূতি দ্বিধার কারণ। মনে হয় নিজের ভেতরের সব নিয়ম ভেঙে, নিয়মেরা বেশ আনন্দ পাচ্ছে। সামির বুঝতে পারছে, সে নাবিলার জন্য যে উদ্দীপনা অনুভব করছে, তা শুধু আকর্ষণ নয়। এটা গভীর মানসিক মিশ্রণ, যেটা তাকে নিজের পরিচিত “চব্বিশ বছরের” নিয়মের বাইরে টেনে নিয়ে গেছে।
নাবিলা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সামির কখন আবার কথা বলবে? কিন্তু বলছে না দেখে সুপ্ত কণ্ঠে নিজেই বলল,
— “আমি ভেবেছিলাম, আপনি আমার কথা ভাবেন হয়ত।”

সামির থমকে গেল। ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। এত সোজাসাপটা কথা আশা করেনি।
— “ভাবি তো…”
— “হুম খুব ভাবেন। আমি জানি তো আপনি কী কী ভাবেন।”
— “কী কী?”

নাবিলা বলল,
— “এইতো আমি নাই, আপনি ভাবছেন যাক আপদ বিদায় হয়েছে। আপনি ভাবছেন, আপনাকে অযথা বিরক্ত করার কেউ নাই। মনে মনে শান্তি পাচ্ছেন। আর, আর…”
— “আর কী?”

নাবিলা একটু থেমে, নিঃশ্বাস নিল। তারপর বলল,
— “সে নাই যে লম্ফঝম্প করে হুটহাট পড়ে যাবে আর আপনাকে এসে কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।”

নাবিলা ভেতরে অনড় ভাব নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার কণ্ঠে ছিল ধরনের মৃদু সতর্কতা, নাবিলাকে বেশি ভাবিয়ে দিতে চাচ্ছে না আপাতত।
— “নাবিলা, তুমি একটু বেশি বুঝলে। যাইহোক, বিশ্রাম নাও। মাথা ঠান্ডা হবে।”

নাবিলা হতচকিত হয়ে বলল,
— “কি বোঝাতে চাইলেন আপনি? বিশ্রাম নেব মানে? মাথা ঠান্ডা হবে মানে? আমি কি পাগল? আপনি কি তা বোঝাতে চাইলেন?”
— “না। যা বোঝাতে চেয়েছি, তা বোঝার বয়স তোমার হয় নাই। রাখছি আমি, বাইরে যাব।”
সামির ফোন রাখতেই নাবিলা দপ করে নিঃশ্বাস ফেলল। একটা পৃথিবীর, একটা দেশের দু’প্রান্তে, দুটি ভিন্ন জায়গার, দুটি ভিন্ন বয়সের মানুষ একই অনুভূতি নিয়ে তাপড়াচ্ছে।
উনিশে পা রাখা নাবিলা; যার চোখে কৌতূহল আর ভেতরের অস্থিরতা, হৃদয় লাফিয়ে উঠছে সামিরের কথায়, ছোটো ছোটো অদৃশ্য সেতু দিয়ে তার অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। চব্বিশের দোরগড়ায় উপস্থিত সামির; যে জীবনের ব্যস্ততা আর নিজের অহংবোধ টিকিয়ে রাখতে ব্যস্ত। সে হঠাৎ করে অনুভব করছে কেউ তাকে খুঁজছে, কেউ তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, সেই অনুভূতিটা নরম কিন্তু শক্তিশালী অনুভব জাগাচ্ছে।
.
ফটাফট পাঁচটা দিন কেটে গেল। দিনের সূর্য ঠিক ২৪ ঘণ্টার নিয়মে উঠেছে, ম্লান আলো থেকে ঝকঝকে রোদে, রাতের নিস্তব্ধতা থেকে চাঁদের নরম আলো; সবকিছু ঠিক সময় মাপা অনুযায়ী। কিন্তু মানুষের কাছে সময় সবসময় সমানভাবে প্রবাহিত হয় না। কিছু মানুষের কাছে ঘড়ির কাঁটা দৌড়ের মতো দ্রুত, কারো কাছে কচ্ছপের মতো ধীর।

নাবিলার দিনগুলো যাচ্ছে না। ঘরে বসে কতক্ষণই বা অপেক্ষা করতে পারে? তাই সে আজ বান্ধবীদের সঙ্গে বেরিয়েছে শহরের ব্যস্ত রাস্তায়, ক্যাফের নরম আলোতে, পার্কের পাতার মৃদু গুঞ্জনে, শহরের রঙিন চিত্রে, চা-কফির আড্ডায় সময়কে একটু দ্রুত করতে পারার প্রলাপ। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে, বালিশে মাথা রাখতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো। কিন্তু যদি এখন ঘুমিয়ে পড়ে, রাতের ঘুমে বিঘ্ন ঘটবে। ঠিক তখনই মা এলো ঘরে। মায়ের উপস্থিতি মুহূর্তেই ঘুমের মনকে অন্যদিকে টেনে নিল।

রাত তখন বারোটা। নাবিলা ঘুমাতে আলসেমি করছিল। প্লে-লিস্ট ঘেঁটে প্রিয় একটা গান ছেড়ে দিল। “তোমার একুশ বছর বোধহয়…” গানের তালে তালে নাবিলাও গুণগুণ করছিল। প্রিয় এই সময়টাতে হঠাৎ প্রিয় মানুষের মেসেজ এলো,
— “ফ্রি আছো?”

নাবিলা নিজেকে জিজ্ঞেস করল, “এই রাত-বিরেতে কি আমার মানুষের ক্ষ্যাতে কামলা দেওয়া উচিত? ফ্রি থাকব না তো কি করব?” তবে টাইপ করল,
— “হুম।”

তারপর ছোট্ট একটা রিপ্লাই এলো,
—“ওকে।”
—“কেনো, কি হয়েছে?”

ওপাশ থেকে সহসা রিপ্লাই এলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো নাবিলাকে। তারপর মেসেজ এলো,
—“তোমার ঘরের জানালার এখানে আসো।”
নাবিলা দৌড়ে জানালার কাছে এল। দ্রুত পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। মূল ফটকের কাছে অন্ধকারের মধ্যে একটা অবয়ব ধরা দিল। রাস্তার মৃদু আলোয় সামিরের মুখটা নরম হালকা ছায়ায় ঢেকে ঝাপসা হয়ে উঠল। অন্ধকার আর আলো মিশে এক রহস্যময় আবহ তৈরি করেছিল। নাবিলা মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কি বাস্তব, না স্বপ্নের খেলা? হৃদয়টা দ্রুত ধড়ফড় করতে লাগল, চোখে অজানা আনন্দ আর আশ্চর্যের মিশ্র অনুভূতি ভরে গেল। পেছনে গানটা তখনও বাজছে,
“তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়
আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়
লজ্জা জড়ানো ছন্দে কেঁপেছি
ধরা পড়ে ছিল ভয়….”
.
.
.
চলবে….