#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২১]
~আফিয়া আফরিন
সামির দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এইমুহূর্তে কারো হিহি–হাহা দেখার শখ নেই। ঘুরে তাকাতেই সাখাওয়াত হোসেন ধীর গলায় আবার বললেন,
— “তোমার সংসার হয়েছে, এখন স্থির হতে শিখো।”
শব্দগুলো হাওয়ায় ভেসে এসে সামিরের বুকের ভেতরে আঘাত করল। এতদিন সে ভেবে এসেছে, তার বিয়ে হয়েছে। একটা সামাজিক চুক্তি, সবার চোখে একটা স্বীকৃতি, কিছু দায়িত্ব; এই তো বিয়ে। কিন্তু সংসার?
বিয়ে শব্দটা এত ভারী মনে হয় না। সহজ, সাবলীল, পরিচিত। কিন্তু সংসার, শব্দটা বোধহয় অদৃশ্য এক দায়িত্বের ভার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার মত মনে হচ্ছে। সংসার মানে তো শুধু ছাদ আর চারটে দেয়াল নয়। সংসার মানে দু’জন মানুষের একসাথে পথ চলা, মায়া–ভালোবাসা, অভিমান–মান, রাগ–দুষ্টুমি, লড়াই–ঝগড়া সবমিলিয়ে এক নতুন জগৎ।
সামির চুপচাপ ভাবল,
“তাহলে কি নাবিলা আমার সংসারের সঙ্গীও? ওর হাসি, ওর কান্না, ওর ছেলেমানুষি, এমনকি আমার ওপর রাগ করাটাও কি তবে এই সংসারেরই অংশ? কিন্তু সংসার তো আমার একার না যে তার দুনিয়ার রাগের দায়ভার আমি নিব। আমারটা কে নিবে? অন্যকেউ?” মূলত নিজের ভেতরকার চাপা রাগ থেকেই কথাগুলো মাথায় এলো। কিন্তু এত সিরিয়াস রাগ করার প্রয়োজন ছিল না। সামির খোঁজ নিয়ে দেখেছিল, ওই ছেলেটার সাথে ওরা কেবলমাত্র প্রেজেন্টেশন আর এসাইনমেন্টের জন্যই কথাবার্তা বলে; বিশেষ কিছু নয়। তবে নাবিলার তখন এড়িয়ে চলে যাওয়ার বিষয়টাই হচ্ছে রাগের কারণ। ওই পুঁচকে মেয়েটার এত বড় স্পর্ধা বিয়ে করা স্বামী, সংসারের সঙ্গীকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দিল!
সামির ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল। ভেতরে এখনও রাগ আর অভিমানের বসবাস। হঠাৎই দরজায় একটা ছায়া এসে তার পথ আটকে দিল। নাবিলা…
সামির থমকে দাঁড়াল, জিগাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। নাবিলার ঠোঁট বাঁকানো হাসি, চোখে মিশে আছে দুষ্টুমি। নিজের চুলগুলো হাতের আঙ্গুলে পেঁচিয়ে বলল,
— “কোথায় যাচ্ছেন?”
সামির ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “দেখতে পাচ্ছো না?”
নাবিলা চোখ সরু করে মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল,
— “পাচ্ছি তো। মনে আছে, ঘর ভাগাভাগির সময় দরজার এই অংশটুকু আমার ভাগে পড়েছিল? তখন আপনি আমার সাথে কথাবার্তা বলেছিলেন বলে ছাড় দিয়ে আপনাকে যাতায়াতের সুযোগ দিয়েছিলাম। এখন আর দিব না।”
তারপর গম্ভীর ভান করে দু’হাত মেলে দরজার পুরোটা আগলে দাঁড়াল ও। সামির কিছু বলার আগেই ফের বলল,
— “অন্যদিক দিয়ে ঘরে আসতে পারলে আসেন, মানা করব না।”
সামির সামান্য মাথা কাত করে তাকাল,
— “খুব তাই না?”
— “হ্যাঁ। খুউউউব বেশি।”
সামির হাত দুটো বুকে আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে দাঁডাল,
— “আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছো না? সবকিছুর দখলদারিত্ব চলে গেল তোমার হাতে?”
নাবিলা চুল নাড়িয়ে গম্ভীর সাজে বলল,
— “নিজের ঘর দাবি করছেন অথচ নিজের ঘরে আপনাকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। দেরি করে ঘরে আসার জন্য কি শাস্তি দেওয়া যায় বলুন তো?”
— “এই শাস্তি কার জন্য?”
— “অবশ্যই আপনার জন্য।”
— “বাহ, আইন বানানো শুরু করে দিয়েছো দেখছি।”
নাবিলা মুচকি হেসে উত্তর দিল,
— “চেষ্টা করছি। আইন প্রণয়নকারীও আমি আর জজও। আমার আদালতে কিন্তু অপরাধীরা ছাড়া পায় না।”
— “তাহলে আমি এখন অপরাধী? শাস্তিটা কী হবে শুনি?”
নাবিলা একচুলও না সরেই দারোগার মত দাঁড়িয়ে রইল,
— “শাস্তি… এখনই বলা যাবে না।”
— “তোমাকে আর শাস্তির ব্যাখা করতে হবে না। তুমি ধরার আগেই অপরাধী ফুড়ুৎ করে নাগালের বাহিরে চলে যাবে।”
— “মানে?”
সামিরের কীরকম আঁকাবাঁকা দৃষ্টিতে তাকাল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখেই বলল,
— “পাশের ঘরে যাচ্ছি।”
নাবিলা চুলচেরা হাসি দিয়ে বলল,
— “পালাচ্ছেন?”
— “উঁহু, ময়দানেই আছি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জানাতেও হবে না তার আগেই চলে আসব। আপাতত তোমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি।”
নাবিলা একটু ধীরে হাসি দিয়ে বলল,
— “আমার থেকে দূরে থাকতে চান? মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন, আমার থেকে পালানোটা আপনার জন্য খুব একটা সহজ কাজ হবে না।”
— “কেন?”
— “এখন আমার ব্যাখ্যা দিতে ইচ্ছা করছে না।”
সামির ঠাট্টা মিশ্রিত হাসি দিয়ে ধীরে পায়ে ওই ঘরের দিকে এগোলো। বাড়িতে মেহমান না এলে এই ঘরটা ফাঁকাই থাকে। নাবিলা পিছু ডাকল। দায়সারা ভাবে বলল,
— “মামণি যদি প্রশ্ন করে, তাহলে সোজা আপনার কথা বলব। আমি দায়ভার নিতে পারব না। আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছেন। পরে আমাকে কেউ কিছু বলতে পারবে না।”
সামির থেমে নাবিলার দিকে ফিরে দেখল। নাবিলা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সামির বলল,
— “আমারটা আমাকেই বুঝতে দাও।”
সামিরের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়াটা নাবিলা সহজে মানতে পারছিল না। এখন আটকাবে কি করে? নিজের ঘর ছেড়ে… উমম, নাবিলাকে একা রেখে কেন চলে যাবে? এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়? ও বলল,
— “এটা কিন্তু আপনি ঠিক করছেন না।”
— “আমি এটাই ঠিক করছি। তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে। তুমি যখন তখন এসে আমার উপর হামলে পড়ো। ভয়ঙ্কর ব্যাপার।”
নাবিলা মুখ কালো করে, ঠোঁট বেঁকে, কপালের চুলগুলো হাতের সাহায্যে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বলল,
— “তো? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? নাকি আমার ওজন আপনি বহন করতে পারছেন না?”
সামিরের মুখে চওড়া হাসি ফুটল।
— “তুমি বাঘও না, ভাল্লুকও না। রক্তে-মাংসে গড়া মানুষই। আর ওজনের কথা বললে? তোমাকে তো ফুঁ দিলেই যেকোনো সময় উড়ে যাবে। তবে তোমার কাজকর্মগুলো সত্যিই উদ্ভট, কখন কোনদিক থেকে আক্রমণ করো বোঝা যায় না।”
ওহ আচ্ছা, এখন যত দোষ সব নাবিলার কাঁধে চাপিয়ে নিজে খুব সাধু সাজা হচ্ছে? ঠিক আছে, তুমি যাও। নাবিলা একলাই একশ। ও একা থাকতে পারে। তুমি থাকো তোমার প্রতিরক্ষা নিয়ে। তবে নাবিলার যখন আক্রমণ করা দরকার তখন সে ঠিকই করবে। যখন প্রয়োজন তখন তোমাকেও এমন বাঁধনে বাঁধবে যে সহজে ছুটে বের হতে পারবে না। ও নাবিলা, যে সহজে হার মেনে নেয় না।
সামির চলেই যাচ্ছিল কিন্তু নাবিলার ফের পিছু ডাক শুনে সে থেমে গেল এবং বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল। আশ্চর্য এই মেয়ে এত ডাকে কেনো? এখন এত ডাকছে আর যখন বান্ধবীদের সাথে থাকে তখন তো চেনেও না। সামিরের ঠোঁটে কী একটা খেয়াল ধরা হাসি উপচে পড়ছে।
নাবিলা এতকিছু পাত্তা না দিয়ে বলল,
— “শুনুন… সামির ইয়াসির।”
— “বলো।”
— “আপনি… নিষ্ঠুর, পাষাণ, আর ভীষণ বাজে।”
সামিরের কপালে পরপর কয়েকটা সুক্ষ্ম ভাঁজ দেখা গেল। একটা ধাঁধায় পড়ে গেল। তারপর বলল,
— “ঠিক আছে, নিষ্ঠুর… বাজে… তবে আমার পক্ষে থেকেও অঙ্গীকার রইল।”
— “অঙ্গীকার? কীসের?”
নাবিলা তখন সামিরকে যেভাবে জবাব দিয়েছিল সামিরও ঠিক ওইভাবেই বলল,
— “এখন আমার ব্যাখ্যা দিতে ইচ্ছা করছে না।”
অতঃপর দুজনেই চুপ। যে যার পথ দেখল। নাবিলা মুখ কালো করে বই আর নোট গুছিয়ে নিল। পরীক্ষা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। যদিও পরীক্ষা নিয়ে কখনোই চিন্তা ছিল না। এখনও নেই, এখন নাবিলার চিন্তাভাবনা সব সামির ইয়াসিরকে কেন্দ্র করে। কোনোকিছু নিয়ে ভাবতে গেলেও সে চলে আসে, হাসতে গেলেও, কাঁদতে গেলেও, সুখে-দুঃখে, স্বপ্নে সবখানে সে এসে উপস্থিত হয়।
.
নাবিলাদের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সকালবেলায় বেরোবার আগে ব্যাগের ভেতর বইখাতা গুছিয়ে নিতে গিয়ে ওর ভেতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা খেলে যায়। বিগত কিছুদিন আগেও প্রতিদিন সামিরকে পাশে পেত, একসাথে যাওয়া আসা হত, রাস্তায় অল্প কথাবার্তাই হোক, তবুও মনে হতো পাশে আছে। এখন নাবিলা একলাই যায়, একলাই ফেরে।
সামির প্রতিদিনই যায় কিন্তু ক্লাস করতে নয়, তার কোনো নির্দিষ্ট কাজও থাকে না। শুধু নিত্যনতুন কাহিনী দেখতে আর নিজের অজুহাত বানাতে যায়। অবশ্য আরেকটা কারণও আছে সামিরের অযথা আসা-যাওয়ার, যেটা নাবিলা জানে না।
ফেরার সময় নাবিলা ইচ্ছে করেই একটু থেমে থাকে। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচ-দশেক অপেক্ষা করে। মনে মনে ভাবে, সামির হয়তো আসবে। এসে বলবে, চলো আজ একসাথে যাই। কিন্তু সে আসে না। ক্যাম্পাসেই থাকে, চোখের সামনেই থাকে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় অথচ নাবিলার প্রসঙ্গ এলে কত দূরের মানুষের ভান ধরে। নাবিলা তবুও অপেক্ষা করে, যদি আজ কোনো ব্যতিক্রম হয়। কিন্ত ব্যতিক্রম আর হয় না।
আজও সামির দূরে দাঁড়িয়েই দেখছিল, নাবিলা নিজেই ছুটে চলে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর কেমন গুমোট লাগে। তবু নিজেকে বোঝায়; যে একা চলতে পারে, তাকে তো জোর করে বহন করার প্রয়োজন নেই। তারপরেও নিজ থেকে আগ্রহ দেখালে বিষয়টা ভালো দেখায় না।
অন্যদিকে নাবিলাও গোপনে ভাবে; যদি সত্যিই নেওয়ার মত থাকত, তবে ঠিকই এগিয়ে আসত।
দু’জনেরই চোখে চোখে খোঁজাখুঁজি আছে কিন্তু ঠোঁট অবধি এসে কথারা আটকে যায়। নীরবতার মধ্যেই গড়ে উঠছে রাগ, অভিমান আর একরাশ না-বলা কথা।
পরীক্ষার শেষ দিন। নাবিলার বন্ধু-বান্ধবরা আগেই ঠিক করেছিল, পরীক্ষা শেষে সবাই মিলে হলে সিনেমা দেখতে যাবে। নাবিলা যাওয়ার জন্য রাজি হলো না। ইচ্ছেও ছিল না আর থাকলেও এইভাবে যাওয়া যেত না। ভেতরে ভেতরে দ্বিধা কাজ করবে। মামণিকে না বলে, অনুমতি ছাড়া এভাবে একা একা জায়গায় বেরিয়ে পড়াটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বলেছিল,
— “তোরা যা, আমি আজ বাসায় যাবো। অন্য একদিন একসাথে যাব।”
ওরা আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। নাবিলার বেরোতে দেরি হয়ে গেল খানিকটা। সকাল থেকেই আকাশটা ভারী হয়ে ছিল। বৃষ্টিও ছিল না কিন্তু হঠাৎ করেই কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো মাথার উপর। পরক্ষণেই বিদ্যুৎ চমকালো, আর সেই সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝড়ো বৃষ্টিতে রূপ নিল। এইরকম আবহাওয়ার মধ্যে বের হওয়া যাবে না। তাই নাবিলা দোতলায় উঠে ওখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতে লাগল। আশেপাশে কিছু চেনা পরিচিত মুখ রয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে হঠাৎ নিজের নামটা শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকাল। তৎক্ষণাৎ আদনান এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল,
— “বাড়ি যাবে কখন?”
প্রশ্নটা শুনে নাবিলার ভ্রু কুঁচকে গেল। আজব! এই ছেলে কি দেখছে না বৃষ্টির জন্যই ও দাঁড়িয়ে আছ? মনে মনে বিরক্তি ফুটল। তবে স্বাভাবিক গলায় বলল,
— “এই তো, বৃষ্টি কমুক।”
আদনান মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,
— “কেন, বৃষ্টি ভাল্লাগে না?”
প্রশ্নটা শুনেই নাবিলা ভেতরে ভেতরে আবার বিরক্ত হলো। আবার এই আজাইরা প্রশ্ন! দুনিয়াতে বৃষ্টি ভালো লাগে না এমন মানুষ কয়জন আছে? কিন্তু ভালো লাগলেই তো আর ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরতে হবে না। তবে মুখে বলল,
— “নাহ, ভালো লাগে না। কেমন স্যাঁতস্যাঁতে, রাস্তাঘাটে কাদা জমে, হাঁটাচলা কষ্ট… ভীষণ বিরক্তিকর আর বাজে।”
আদনান চোখ বড় করে অবাক ভঙ্গিতে বলল,
— “কী বলো তুমি! আমার তো বৃষ্টি ভীষণ ভালো লাগে।”
— “ওহ আচ্ছা।”
সংক্ষিপ্ত জবাব দিল নাবিলা। ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলল, কারণ ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ কাউকে জানাতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া এইমুহূর্তে আদনানের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ারও ইচ্ছে হচ্ছে না। তাই একটা অজুহাত খুঁজে নিল,
— “ভাইয়া, নিচে আমার একটা বান্ধবী ওয়েট করছে। আমি যাই আচ্ছা।”
কথাটা বলে সে আর আদনানকে কথা বলার কোনো সুযোগই দিল না। দ্রুত সিঁড়ির দিকে চলে এল। সিঁড়িতে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, বৃষ্টি একটুও কমে নাই। মাঠে পানি জমে ছোট ছোট হ্রদের মত তৈরি হয়েছে। বাতাসে খুব সুন্দর একটা ঘ্রাণ। মাটির গন্ধ, গাছ-পালার গন্ধ কী সুন্দর। নাবিলা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সিঁড়ির ধাপে।
বৃষ্টি চারদিক ঢেকে ফেলেছে। সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিলা আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল এই বৃষ্টি আর থামবেই না। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে চমকে উঠল। দ্রুত ঘুরে তাকিয়ে থমকে গেল, সামির। ভিজে চুপচুপে অবস্থা, কপালে চুল লেপ্টে আছে। সামির কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল,
— “অনেকক্ষণ ধরে ডাকছিলাম। শুনতে পাচ্ছো না?”
নাবিলা দ্বিধায় বলল,
— “কোথায়? শুনলাম না তো।”
সামির মৃদু বিদ্রূপ মিশিয়ে উত্তর দিল,
— “ঠিকই আছে। আরেকজনের সাথে হিহি করলে আমার কথা শুনবে কেন?”
নাবিলা বুঝল সামির আদনানের কথা বলছে। হয়ত কথা বলতে দেখেছে কোনোভাবে। ও ঠোঁট বাঁকিয়ে প্রতিবাদ করল,
— “আমি মোটেও হিহি করছিলাম না। এমনিতেই কথা বলছিলাম।”
— “ভালোই। কথা কি আরও বাকি নাকি বাসায় যাবে?”
নাবিলা এবার খেয়াল করল সামিরের অবস্থা। একেবারে ভিজে চুপচুপে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কোথা থেকে এলেন এইভাবে ভিজে ভিজে? প্রতিদিন এমনে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে, জ্বর হবে।”
সামির হালকা তির্যক হাসি দিল,
— “বাব্বাহ! আমাকে নজরে পড়ল? আমি তো ভেবেছিলাম আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি।”
নাবিলা বিরক্ত হয়ে বলল,
— “ফালতু কথা বলেন কেন? সবসময় ঝগড়া বাঁধানোর মুডে থাকেন?”
— “ঝগড়া আমি বাঁধাই? তুমি কথাই এমন এমন বলো যে, মাথা ঠান্ডা রাখা মুশকিল।”
— “আগে বলেন, এইভাবে ভিজেছেন কেনো?”
সামির কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল,
— “খোঁজ নিয়ে আমায় ধন্য করেছ তবে এত বলতে পারব না। চলো।”
নাবিলা কিছু বলার আগেই সামির হাত বাড়িয়ে দিল, ভিজে আঙুলের ঠাণ্ডা স্পর্শে নাবিলার বুক কেঁপে উঠল।
অনেকগুলো দিনও নয়, দশ/বারো দিন পর নাবিলা সামিরের সাথে পথ চলছে। এই কয়েকটা দিনকে এইমুহূর্তে কয়েক যুগ মনে হচ্ছে। বাইকের পেছনের সিটে বসে অভ্যাসবশত হাত দুটো নিজে থেকেই সামিরের কাঁধে গিয়ে থামল।
বৃষ্টি বাতাসকে ঝাপসা করে দিচ্ছিল। রাস্তার দুইপাশে দোকানপাটের শাটার আধা-নামানো, রাস্তাঘাটে পানি জমে আছে। বাইকের চাকায় পানি ছিটকে গায়ে লেগে যাচ্ছিল কিন্তু নাবিলার তাতে খেয়াল নেই। তার খেয়াল অন্যদিকে। সামিরের দিকে, সামিরের প্রতি; তার ভেজা হালকা রঙের শার্ট, ভেজা চুল, ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে কাঁধ বেয়ে পিঠে পড়ছে। নাবিলা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিল, তবুও চোখ বারবার বেহায়ার ন্যায় তার দিকেই ফিরে যাচ্ছে। এই ভাবের রাজার সাথে বৃষ্টির সময়েই নাবিলার অনুভূতি অন্যরকম খেলা খেলে। অন্যরকম এক জগতে দায়িত্ব নিয়ে প্রবেশ করায়। চারপাশে কোলাহল থাকলেও তখন কানে কেবল সামিরের নীরবতা বাজে। ওর ভেজে চুপচুপে শরীর, ভেজা চুল, গভীর দৃষ্টি; সবটাই হৃদপিন্ডে চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে দেয়।
এইরকম মুহূর্তে নাবিলার মনে হয় এই বৃষ্টি, এই ভিজে যাওয়া, এই নীরব হাঁটাচলা সবই ওদের দু’জনের জন্য তৈরি। কোনো কথা নেই অথচ প্রতিটি দৃষ্টিতে, প্রতিটি পদক্ষেপে হাজারটা না-বলা শব্দ জমে আছে। সামিরের পাশে হাঁটার সময়, সে পাশে থাকলে, নাবিলার বুকের ভেতরটা মৃদু কাঁপতে থাকে, তবুও সেই কাঁপনই অসীম স্বস্তি। এই কাঁপনটা আগে ছিল না, আজকাল হুটহাট হচ্ছে… খুব হচ্ছে।
আজও সামির পাশে থাকায়, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আর সুখী মানুষ মনে করছে নাবিলা। এই মুহূর্তটা জীবনের সব দুঃখ কাটিয়ে দিচ্ছে আর সুখের রঙে রঙিন করে রাখছে। হঠাৎ নাবিলার খেয়াল হলো সামির বাড়ির রাস্তা ছাড়িয়ে এসেছে।
— “বাসায় যাবেন না?” নাবিলা ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল।
সামির চোখ না ঘুরিয়েই বলল,
— “সবসময় বাসায় ভালো লাগে না। আজ ফিরতে ইচ্ছে করছে না।”
— “মানে? বাড়ি যাবেন না?”
— “যাবো, কিছুক্ষণ পর। তাড়া আছে?”
— “না।”
সদরঘাট পেরিয়ে আসতেই নদীর ঘোলাটে জল চোখে পড়ল। ঘাটে কয়েকটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে ভেজা দড়ি আর ভেজা কাঠের তক্তা থেকে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ ভেসে আসছিল। ভেজা গাছপালার গন্ধ বাতাসে ভাসছে। বৃষ্টির মৃদু ফোঁটা নদীর জলে পড়ে ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি করছে, দূরে হুইসেল বাজলো এক লঞ্চের। সুন্দর লাগছে চারপাশের সবকিছু। নাবিলা শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে চারপাশে তাকিয়ে আক্ষেপের সুরে বলল,
— “এই যা! বৃষ্টি কোথায় চলে গেল?”
সামির কৌতূহল মিশ্রিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “বৃষ্টি ভালো লাগে?”
নাবিলা দেরি করল না। দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত করে, পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে এমন ভঙ্গিতে চোখ বুজে গভীর নিঃশ্বাস নিলো। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি খেলে উঠল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল,
— “খুউউব…”
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিলা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেল। ওর পরনে আকাশি রঙের জামা, বৃষ্টির ধোয়া মেঘলা আকাশ আর নদীর ঢেউ খেলানো পানির রঙের সাথে মিশে গেছে। হাত দু’টো প্রসারিত করে চোখ বুজে দাঁড়ানো নাবিলাকে দেখে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি তার ভেতরের উচ্ছ্বাসকে প্রজাপতির মত ছড়িয়ে দিয়েছে। সামির মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। সত্যি, নাবিলা কি শুধুই মানুষ? মেয়ে? নাকি বৃষ্টির পর প্রকৃতির আঁকা একটুকরো চিত্র; যার গায়ে আকাশের রঙ, নদীর স্রোতের ছোঁয়া, আর হৃদয়ে লুকানো একরাশ শিশুসুলভ আনন্দ।
বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু তার বুকের ভেতরে আরও জোরে বৃষ্টি নামছে। এতদিন যত রাগ, জেদ, অভিমান জমিয়ে রেখেছিল মুহূর্তেই সব গলে পানি হয়ে নামল। নাবিলার এই সরল আনন্দ সামিরকে হার মানাল। সে বুঝতে পারল; যতই এড়াতে চায়, যতই দূরে সরে থাকতে চায় আর পারবে না। সে পথ হারিয়েছে, এই মেয়েটা ছাড়া তার কোনো পথ নেই। নাবিলাকে বলবে? বললে এইমুহূর্তে ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? না, এখন বলা যাবে না। তবে শতভাগের মধ্যে আংশিক স্বীকারোক্তি তো নাবিলাকে দেওয়াই যায়।
সামির চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর ওর ঠোঁট নড়ল। স্বরটা নরম একটু ভারী,
— “আমি হেরে গেলাম…”
নাবিলা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকালো। কপালের ভেজা চুল সরিয়ে তাকিয়ে বলল,
— “কী বললেন?”
সামিরের চোখে গভীর টানাপোড়েন। ধীরে ধীরে নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমি আসলে হেরে যাচ্ছি। অনেকটা দূরে থাকতে চেয়েছি, পারিনি। এখন এসে বুঝলাম… এই হারা-টাই আসল জেতা।”
নাবিলা নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সামিরের দিকে। ওর কথা বুঝতে পারল না। চেষ্টাও করল না। সামিরের কাজই হচ্ছে, না বোঝার মত কথা বলা। বুঝতে গেলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবে মনে হচ্ছিল, সামিরের মত হারা-জেতার খেলায় ও নিজেও বাঁধা পড়ে গেছে। এমন একটা বন্ধনে আটকে পড়েছে যা ভাঙার নয়…
বাড়ি ফিরে এসে সামির একটু বিশ্রাম নিল। ভিজে শরীরের উপর আড়ম্বরী তৃপ্তি মিশে ছিল, ঘুম ধরছে। ফোনটা হাতে তুলে নিল সে। ফোন করল ইশরাককে।
— “শোন, ছেলেটার নাম আদনান। থার্ড ইয়ার। খোঁজ নে একটু।”
— “কি খোঁজ নিব?”
— “সবকিছু।”
ইশরাক একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল,
— “সবকিছু মানে? কখন খাচ্ছে? কয় বেলা খাচ্ছে? কখন বাথরুম যাচ্ছে? কয়বার যাচ্ছে? সব? ভাই, আমি কেমনে ওর ভেতরের খবর জানব?”
— “ফাজলামি করিস না, আমি সিরিয়াস।”
— “ওহ আচ্ছা। কিন্তু মামা, ব্যাডা মানুষের খবরা-খবর দিয়ে কি করবা? তারচেয়ে একটা মাইয়া মানুষের খবর চাইতা, ইজিলি দিয়া দিতাম।”
সামির মুখ কালো করে বলল,
— “মেয়ে মানুষে আমার কাজ নাই।”
— “ওহ সরি, তোমার তো বউ আছে।”
সামির কাঁধ উঁচিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— “হুম, আছে… বউ আছে, সংসার আছে, শান্তি আছে।”
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২২]
~আফিয়া আফরিন
সামির আরও দু’দিন নীরবে অপেক্ষা করল। বাইরে থেকে শান্ত দেখালেও ভেতরে শান্তি ছিল না। আদনানের প্রতিটি পদক্ষেপ তার চোখে আটকে থাকত। দূর থেকে লক্ষ্য করছিল, দু’দিনে নাবিলার সঙ্গে দু’একটা কথাবার্তা হয়েছে। কথাগুলো তেমন কিছু না, সাধারণই। তবু সামিরের চোখ এড়াল না আদনানের চোখেমুখে সেই অস্বস্তিকর উচ্ছ্বাস, অকারণ ঝলকানি, অতিরিক্ত আগ্রহের ছাপ।
এইসব তুচ্ছ কারণ-ই যথেষ্ট সামিরের ভেতর ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য।তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস হলো; নিজের মানুষকে নিয়ে অন্যকারও অতিরিক্ত আগ্রহ, অন্যকার প্রগলভতা। সেটা যতই তুচ্ছ হোক, ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
একটা সময় কামিনী ছিল। ওর গল্প, আসা-যাওয়া,হাসাহাসি সবটাই সহ্য করত। শুরুতে মনে হতো বিরক্তিকর, তারপর ধীরে ধীরে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গা সওয়া জিনিসও যেকোনো সময় পিছলে যেতে পারে। সেসময় জীবনের সবকিছঅভ্যস্ত শব্দ মনে হত… মানে যেটা হওয়ার সেটা হবেই, দায়সারা ভাব, অনুভূতির আলাদা ওজনই নেই।
কিন্তু নাবিলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা। ওর সাথে একেক দিন একেকরকম। ওর ক্ষেত্রে সহ্য করার জায়গা নেই, গা সওয়া হওয়ারও উপায় নেই। নাবিলার প্রতি অন্যকারও আগ্রহ, সামিরের ভেতরে বাঘের থাবার মতো আঘাত হানে। কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে। হয়তো এজন্যই, কামিনীর আগ্রহ ছিল অন্যকারও প্রতি, নিজের ইচ্ছেতে। আর নাবিলার নেই। নাবিলা একটুও এগোয় না। তবুও অন্যকারও চোখে তার প্রতি সামান্য টান, সামান্য আগ্রহও সামিরকে ভেতর থেকে ঝাঁকুনি দেয়। ভেবেছিল কোনোদিন হঠাৎ পরিচয় হয়ে যাওয়া একটা মেয়ের জন্য মনের এমন কঠিন অবস্থা হবে?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সামির একটু থমকাল। নিজের প্রতিবিম্বের চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল,
— “সবার অন্যদিকে ঝোঁক সহ্য করতে পারি। নাবিলার নিজের আগ্রহ না থাকার পরেও অন্যকারো ওর ব্যপারে আগ্রহ সহ্য করতে পারছি না কেনো? কেনো এমন লাগছে?”
আয়নায় সামিরেরই প্রতিবিম্ব জবাব দিল,
— “কারণ অন্যকেউ তোমার বাইরের দুনিয়ার মানুষ। তার বা তাদের ভেতরের আগ্রহ অন্যদিকে গেলে, তুমি আঘাত পেয়েছিলে ঠিকই কিন্তু আসল মালিকানা তোমার ছিল না।”
সামির কপাল কুঁচকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— “তাহলে নাবিলা? ও তো স্পষ্ট করে আজ পর্যন্ত কিছুই বলে নাই, বলার কিছু আছে কিনা তাও জানিনা। তবু কেনো বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠছে?”
প্রতিবিম্ব মৃদু হেসে বলল,
— “কারণ নাবিলা তোমার মানুষ, মনের মানুষ, প্রিয় মানুষ। ওর চোখে অন্যকারও প্রতি সামান্যতম ঝিলিকও তোমার কাছে বিশ্বাসঘাতকতার মতো লাগে। ওর নীরবতা, ওর নিরীহ কথাও তোমাকে বিদ্ধ করে।”
সামির একমুহূর্ত চুপ করল। চোখ নামিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল,
— “মানে, আসল সমস্যাটা আমার ভেতরেই?”
প্রতিবিম্ব ধীরে মাথা নাড়ল,
— “হ্যাঁ, আসল সমস্যাটা হলে তুমি। বুঝতে পারছো, নাবিলাকে হারাতে পারবে না, সহ্যও করতে পারবে না। আর সেই জন্যই তুমি আজ পর্যন্ত যতবার হেরেছো, তার সবকটা হার মিলে গেছে এই এক হারে।”
সামির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
— “হুঁ, মনে হচ্ছে ঠিকই বলেছ তুমি।”
— “আমি সবসময় ঠিকই বলি। আমার কাজই হচ্ছে তুমি ভুল করলে সেটা শুধরে দেওয়া। তুমি কোনোকিছু না বুঝলে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া।”
সামির হঠাৎ আয়নার ভেতরের নিজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
— “তাহলে… এটাকেই কি ভালোবাসা বলে?”
প্রতিবিম্ব ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “উত্তর অন্যকারো কাছ থেকে পেতে চাইছো কেনো? নিজেই তো ভেতরে ভেতরে জানো হয়ত ইতোমধ্যে তা লালন করতে শুরু করে দিয়েছ।”
— “তুমি আমি কি আলাদা?”
— “আমি তোমার ভেতরে বসবাস করি। তুমি আমাকেও নিয়ন্ত্রণ করো। যেই তুমি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছো সেই তুমি নিজের মনের খবর জানো না? তা কি হয়? অবশ্যই তুমি জানো।”
সামির অস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, চোখে দ্বিধা।
— “আমি জানি?”
আয়নায় সে-ই মানুষ আবার মৃদু স্বরে বলল,
— “হ্যাঁ, জানো। অনুভূতির নাম দেওয়া লাগে না। বুকের ভেতর যা ঝড় তুলছে, প্রতিটি ভ্রুকুটি, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি শ্বাস যেখানে নাবিলা; ওটাই তোমার উত্তর।”
উত্তরটা এ মুহূর্তে মিলল না। কিন্তু ভেতরে একটা অস্বস্তি তাকে অশান্ত করে রাখল।
সামির ইশরাককে বলেছিল আদনানের খোঁজখবর বের করতে। ইশরাক এই কাজটা ভালোভাবেই করল। সামির আরেকটা দিন আদনানকে দেখল। তারপর সেদিন বিকালে আদনানকে পাড়ার ক্লাবটায় ডেকে পাঠাল। অন্যদিন ক্লাব বেশ জমজমাট থাকে। চারপাশে ছেলেপেলেরা আড্ডা দেয়, টেবিল টেনিস খেলে, কেউ তাসে মশগুল থাকে; আজ অবশ্য শাহিদ ভাইকে বলে ক্লাব ফাঁকা করিয়েছে।
কিছুক্ষণ পর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আদনান। চুলে হাত বোলাতে বোলাতে চারপাশটা একবার দেখে নিল। সামিরকে দেখে খানিকটা অবাক হলেও মুখে একচিলতে হাসি রাখল। হামিদের ইশরায় ধীরে এগিয়ে এসে সামনের চেয়ার টেনে বসল।
— “ডেকেছেন?” আদনান জিজ্ঞেস করল। কিন্তু বুঝতে পারছে না, ভার্সিটির কোনো সিনিয়র তাকে কেন ডাকবে? আজ কিছুক্ষণ আগে ইশরাক নামের একজন ফোন দিয়ে বলল। তারই ভিত্তিতে এখানে আসা, তবে কারণ এখনও জানে না।
সামির একটু সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল,
— “তুমি থার্ড ইয়ারে, তাই না?”
আদনান মাথা নেড়ে বলল,
— “জ্বি…”
— “ভালোই। পড়াশোনা কেমন চলছে?”
— “আলহামদুলিল্লাহ, খারাপ না।”
সামির খুব সামান্য হাসল। তীক্ষ্ণ চাহনি এবং ঠান্ডা গলায় বলল,
— “শোনো, পড়াশোনা চালিয়ে যাও। খারাপ পথে যেয়ো না। যেটা বলার জন্য ডেকেছি, তুমি যেসব মানুষকে নিজের চারপাশে টানার চেষ্টা করছ তারা কিন্তু তোমার খেলার মানুষ না।”
আদনান বিভ্রান্ত হয়ে গেল,
— “মানে?”
— “মানে একদম সোজা। কারো প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখানোর আগে ভেবে নিও, সেই মানুষটা কার। ভুল জায়গায় হাত দিলে কি হয় জানো তো? হাত পুড়ে যায়, বুঝলে?”
আদনান কিঞ্চিৎ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
— “আপনি সিরিয়াসলি কী বলতে চাইছেন?”
— “আমি নাবিলার কথা বলছি। এক কথা বারবার বলব না। একবার শুনে, মনে রেখো। নাহলে মনে করিয়ে দিতে আমার বেশি সময় লাগে না।”
নাবিলার নামটা শুনে আদনান নড়েচড়ে বসল। হঠাৎ নাবিলা কোথা থেকে এলো? ওর কাজ কি এখানে? আদনান খাবি খাওয়া মাছের মত প্রশ্ন করল,
— “আপনি নাবিলার কথা বলছেন? আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না।”
— “তোমার কিছু বোঝার দরকার নেই। শুধু দূরত্ব বোঝার চেষ্টা করো। আমার সহ্যের সীমারেখা খুব ছোট। আর এক পা বাড়ালেই সেটা ভেঙে যাবে।”
— “কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি।”
— “ভালোই তো। করো না। এটুকুই চাই।”
আদনান একমুহূর্ত চুপ করে রইল। সামিরের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রশ্নগুলো গিলে ফেলল। সামির বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, আদনান কিছু বলতে চায়। তাই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অচঞ্চল দৃষ্টিতে ছেলেটাকে দেখে বলল,
— “বলো, কী বলতে চাচ্ছো?”
আদনান কিছুক্ষণ গালভরা নীরবতায় বসে রইল। তারপর দ্বিধা গিলে ফেলেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল,
— “নাবিলা কে হয় আপনার? আপনি হঠাৎ এত উঠেপড়ে লেগেছেন কেনো?”
সামির একটুও সময় নষ্ট না করে উত্তর দিল,
— “শী ইজ মাই ওয়াইফ।”
আদনান আচমকা চেয়ার থেকে পিছলে পড়ে যাবে এমন অবস্থা। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। ওয়াইফ? মানে… নাবিলা? না না, ওকে তো দেখতেই বাচ্চা মেয়ের মতোই লাগে। কীভাবে… মানে, ওর বিয়ে কবে হলো? সামির মৃদু ঠোঁট বাঁকিয়ে একচিলতে হাসি ফুটাল। আদনান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল সামিরের দিকে। ও যে কথাটা বিশ্বাস করতে পারে নাই তা বেশ ভালো করে বোঝা যাচ্ছে। আদনান জোর গলায় বলল,
— “আপনার কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। ও বিয়ে করেছে, জানলাম না।”
সামির চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। প্যান্টের পকেটের হাত গুজে বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “জানার কি দরকার? বিয়ে করেছে, বিবাহিত এই ট্যাগ কি নিজের পিঠে লাগিয়ে ঘুরবে? শোনো, আমি তোমাকে যা বলার একবারই বলে দিয়েছি। বারবার রিপিট করা সামির ইয়াসিরের কম্ম নয়। ওর কাছ থেকে দূরে থেকো।” সামিরের কন্ঠে যে কর্তৃত্ব এবং সীমার অটলতা রয়েছে তাতে বিতর্কের অবকাশ নেই। সামির চলে গেল, আদনান ওখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। সত্য-মিথ্যার যাচাই করতে হলে, নাবিলার সাথে কথা বলতে হবে।
পরদিন ক্যাম্পাসের ভিড় একটু পাতলা হলে আদনান সুযোগ খুঁজে নাবিলার কাছে এলো। হঠাৎ করে পাওয়া উড়ো খবরটা ওর মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল, কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।
অবশেষে নিশ্চিত হওয়ার জন্য নাবিলার কাছে জানতে চাইল। নাবিলা প্রথমে বিস্মিত হলো, এমন প্রশ্ন আদনানের কাছ থেকে আসবে আশা করেনি। কেনই বা করল, তাও বুঝতে পারল না। নাবিলা কোনো বাড়াবাড়ি ছাড়া, কোনো অতিরঞ্জন না করে ওর যে সত্যি বিয়ে হয়েছে আর সামিরের সাথেই হয়েছে, তা বলে দিল।
আদনানের চোখেমুখের অবস্থা দেখে মনে হলো ভয়াবহ কিছু শুনে ফেলেছে। স্পষ্ট হতবাক ভাব। কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বোঝা যাচ্ছিল, এমন উত্তর আশা করেনি সে। তার কল্পনার নাবিলা হঠাৎ করেই অন্য এক বাস্তবতায় মিশে গেছে, যেখানে তার কোনো স্থান নেই।
শেষ পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে, নিঃশব্দে সরে গেল। তবে ভেতরের ধাক্কাটা ওর ভঙ্গি, ওর দৃষ্টিতে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। নাবিলা বুঝতে পারল না, কী থেকে কী হলো। বোকার মত আদনানের গমন পথে তাকিয়ে রইল। এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেনো করল? অথচ নাবিলার কাছে ব্যাপারটা একেবারেই স্বাভাবিক। একজন মানুষ বিয়ে করেছে, এতে অবাক হবার কি আছে? পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার মানুষ বিয়ে করছে, সংসার করছে। তবুও আদনানের এমন চমকে ওঠা, হতভম্ব হয়ে যাওয়া নাবিলার কাছে অদ্ভুত লাগল। নাবিলা আরও বেশি বিভ্রান্ত হলো। বোঝা গেল না, কারো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্য কেউ এতটা আলোড়িত কেন হবে?
সামিরকে জিজ্ঞেস করা যায়। অন্তত তার কাছ থেকে কিছু জানা যাবে। কিন্তু আজকে সারাদিন ক্যাম্পাসে সামিরের দেখা পাওয়া গেল না। একবারও নয়। ক্লাসে আসেনি, লাইব্রেরিতেও দেখা যায়নি, আড্ডার জায়গাগুলোও ফাঁকা ছিল। কেন আসেনি? নাবিলা হাঁটতে হাঁটতে নিজের ভেতরে ভাবল,
— “যাই হোক, আজ বাড়ি গিয়েই ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। আদনানের সাথে ওর কোনোভবে কথা হয়েছে? হলে কী কথা বলেছে তারা?”
অজান্তেই ওর মনে কৌতূহল আর দুশ্চিন্তা জমল। দিনভর উত্তর খুঁজতে না পেরে, সব প্রশ্ন গিয়ে জমল সামিরের কাছে।
সামিরকে বাড়িতেও খুঁজে পেল না নাবিলা। অপেক্ষা করল সন্ধ্যা পর্যন্ত। এতক্ষণ একনাগাড়ে সে কখনোই বাড়ির বাইরে থাকে না। ফোনও করতে ইচ্ছে হলো না। শেষমেশ মামনির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন,
— “আজকে তো ওকে রাতের আগে পাবে না মা। তোমাকে বলে যায় নাই? তোমার শশুরের সাথে গাজীপুর গেছে।”
— “ওহ আচ্ছা… আমি জানতাম না।”
মামণি বিরক্ত স্বরে বললেন,
— “আক্কেল আছে ছেলেটার? একবার তোমাকে বলবে না? আসলে আমি বকে দেব।”
নাবিলা তড়িঘড়ি মাথা নাড়ল।
— “না না, কিছুই বলতে হবে না। আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম। কিছু বলার দরকার নেই, মামণি।”
— “আচ্ছা।”
নাবিলা একটু দম নিয়ে ছাদে উঠল। সন্ধ্যার আকাশে আলো-আঁধারি মিশে আছে অথচ সময় কাটছিল না ওর। এই সময়টায় মনটা খারাপ হয়ে যায় অকারণেই। কিচ্ছু করতে ইচ্ছে করে না। না গল্প করতে ভালো লাগে, না ফোন, না টিভি, না পড়াশোনা; সামির বাসায় থাকলে অবশ্য তার মুডি কথাবার্তা আর নাবিলার আজাইরা আলাপেই সময় কেটে যায়। আজ তো সামিরও নেই। মনে হচ্ছিল চারপাশের সবকিছু শূন্যতায় আটকে আছে। অন্বেষা আপু থাকলেও হতো, কিন্তু সে তো তার মামাবাড়িতে। অন্বেষার বিয়ের কথাবার্তা সেইদিন থেকেই চলমান তবে রায়হান এখনো মানতে নারাজ। তার দিকেই পুরো পরিবার তাকিয়ে আছে। সে মানলেই সবকিছু সহজে গড়িয়ে যেত।
.
রাত গভীর। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। করিডোরের শেষপ্রান্তে ম্লান আলো জ্বলছে শুধু। ঠিক তখনই সামির নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। মামণি বোধহয় এখন পর্যন্ত খেয়াল করে নাই তার সুপুত্র আলাদা থাকছে। খেয়াল করলে নিশ্চয়ই কিছু বলত। সামির ওই ঘরে গিয়ে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে নিজের ঘরের ফিরে এলো। নাবিলা ঘুমাচ্ছে। সামির কোনো শব্দ না করার চেষ্টা করছে কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। খুটখাট শব্দে নাবিলার ঘুম ভেঙে গেল। আধো ঘুমে চোখ মেলে দেখল সামিরকে। উঠে বসে জিজ্ঞেস করল,
— “কখন এসেছেন?”
— “আধাঘণ্টা আগে।”
— “এই ঘরে কি করছেন?” নাবিলা বিস্মিত।
সামির কাগজপত্র গোছাচ্ছিল। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
— “আমার ঘরে আমি থাকব না, আজব।”
নাবিলা খানিকটা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— “আপনি নিজেই তো চলে গিয়েছিলেন।”
— “আবার ফিরে এলাম।”
— “আপনার মর্জি কবে ঠিক হবে?”
— “হবে না।” সামির গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল। তারপর বিছানার দিকে এগিয়ে এলো, “আমার জায়গা দখল করেছ কোন দুঃখে? ওইদিকে চেপে যাও।”
নাবিলা নিরুপায়ভাবে সরে যেতে যেতে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “ঘুমাবেন?”
—“হুম… মাথা ধরেছে।” বলেই সামির তাড়াহুড়ো করে শুয়ে পড়ল।
ঘরের ভেতর নীরবতা নেমে এলো। নাবিলা পাশ ফিরে শুয়ে থেকেও কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর আস্তে করে বলল,
— “আপনার সাথে আমার কথা ছিল।”
সামির চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিল। কণ্ঠে ক্লান্তি ঝরে পড়ছে,
— “আমি জানি কী বলবে। সকালে শুনি, আচ্ছা? এখন ঘুমাই। তুমিও ঘুমাও। সরি… কাঁচা ঘুম ভেঙে দেওয়ার জন্য।”
নাবিলার চোখে আসছিল না ঘুম। ঘরটা নিঃশব্দ হলেও বাতিটা তখনো জ্বলছে। সামির এসে শুয়ে পড়ল কিন্তু আলোটা আর নিভায়নি। ঘুম না আসার আরেকটা কারণও সামির। সে বারবার এপাশ ওপাশ করছে, যেন কোনো অস্বস্তি তাড়া করছে।
নাবিলা উঠে বসল। তাকিয়ে দেখল, সামির শুয়ে আছে কপালের ওপর হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে। মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “মাথাব্যথা কি খুব বেশি? মাথা টিপে দিব?”
সামির চোখ না খুলেই সংক্ষেপে বলল,
— “ইচ্ছে।”
নাবিলা হাত বাড়িয়ে সামিরের কপালের উপর হাত রাখল। চুপচাপ আঙুলের ডগা দিয়ে ম্যাসাজ করে দিল। সামির ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা বুঝতে পারছে না। কথাবার্তাও বলছে না… বোধহয় ঘুম। নাবিলাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে নাবিলার হাত ধরে হঠাৎ বলে উঠল,
— “নাবিলা, ঘুমাও এখন।”
নাবিলা একটু চমকে উঠল,
— “এখন ভালো লাগছে?”
— “হুমম।”
— “আচ্ছা। হাতটা ছাড়ুন, আমি লাইট অফ করে দিয়ে আসি। আলো জ্বালানো থাকলে ঘুমাতে পারবেন না।”
— “যাও।” সামির হাত ছেড়ে দিল। নাবিলা লাইট অফ করে এসে আবার সামিরের মাথায় হাত রাখল। সামির বলল,
— “আর লাগবে না।”
— “আপনি ঘুমান। আমার সমস্যা নেই।”
— “তুমি ঘুমাবে না?”
— “আরেকটু পর। আপনি ঘুমান।”
— “আমার ঘুম নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছো কেনো হঠাৎ?”
— “আমার মনে হচ্ছে, আপনার জ্বর আসবে। গা গরম গরম লাগছে। এই কয়েকদিন যেভাবে বৃষ্টিতে ভিজলেন।”
— “কিছু হবে না।”
— “ঘুমিয়ে পড়ুন না!” নাবিলার কণ্ঠে অনুরোধের সুর ঝড়ছিল। সামির আর কথা বলল না। ক্লান্ত লাগছিল ঠিকই তবে বেশ লাগছিল। নাবিলা পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে… আবেশেই ঘুম এসে পড়ছিল।
ঘরের আলো আধো অন্ধকারে দোল খাচ্ছিল। নাবিলা সামিরের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল কতটা শান্ত, কতটা অপ্রকাশিত অনুভূতি ওর ভেতরে জাগছে। ভেতরে অদ্ভুত টান জাগাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আরও একটু কাছে যাই, আরও একটু পাশে বসি।
সে নিজেকে সামলাতে চাইল, কিন্তু অসচেতনভাবে হাতটা সামিরের কপাল থেকে গালে গিয়ে ঠেকল। চোখ আটকে গেল সামিরের দিকে। ঘুমিয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে। চোখ বুঁজে থাকা, মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাস, ঠোঁটের উপরে সামান্য, খুব সামান্যই একটা গোঁফের রেখা যা দেখতে খুব সূক্ষ্ম, অল্পবয়সী ছেলেদের মতো। থুতনিতেও মৃদু দাড়ি।
নাবিলা মনোযোগ দিয়ে দেখছে, প্রতিটি ছোট ছোট রেখা, চোখের ভিতরের অস্থিরতা, মুখের শান্তি, সব মিলেমিশে একটা ঐন্দ্রজালিক অনুভূতি তৈরি করছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সামির অচেতনভাবে এই নীরব মুহূর্তে নিজেকে প্রকাশ করছে, আর নাবিলা নিজের হৃদয়ের মধ্যে সেই স্পর্শকে অনুভব করছে… নাবিলা নিজেকে সামলাল, কিন্তু হৃদয়টা উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠছিল।
ধ্যাৎ… নিজের মাথায় একটা গাট্টা মেরে ইচ্ছে এবং ভাবনার লাগাম টেনে ধরল। তারপর শুয়ে পাশ ফিরল কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
সকালটা বেশ ফুরফুরে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই নাবিলা সামিরকে দেখছিল। অতঃপর সোজা জিজ্ঞেস করল,
— “মাথা ব্যথা ভালো হইছে?”
সামির কোনো উত্তর দিল না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরেসুস্থে নিজস্ব ভঙ্গিতে চুল আঁচড়াচ্ছিল। নাবিলা আবার বলল,
— “আপনার সাথে একটা জরুরি কথা বলব বলেছিলাম।”
তবুও কোনো জবাব নেই। নাবিলা কাবার্ডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। সামির পুরোদস্তুর রেডি হয়ে নিল। শার্টের বোতাম লাগিয়ে পেছন ফিরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
নাবিলা অবাক,
— “কীভাবে?”
সামির ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি টেনে বলল,
— “আমি বলব? তোমার তো বোঝা উচিত। একটা ছেলে মানুষ শার্ট চেঞ্জ করছে, তাও তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুষ্টু দৃষ্টিতে দেখছো। ছিঃ… বাদবাকি নাই বললাম।” কথা শেষ করেই হাতের পারফিউম স্প্রে করে গায়ে দিল।
নাবিলা ফোঁস ফোঁস করে উঠল,
— “ফাজলামি করেন? আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি আমি।”
সামির কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,
— “ওহ আচ্ছা। বাইরে যাব এখন।”
— “কোথায়?”
— “জায়গার অভাব আছে?”
নাবিলা খানিকটা গলা চড়াল,
— “আমিও যাব, নিয়ে যান।”
সামির তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল,
— “আমাকে পাহারা দিতে?”
— “না, আপনার মতিগতি দেখতে। হাবভাব ভালো ঠেকছে না। কেনো চক্কর চলছে নাকি?”
সামির নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “হুম, চলছে তো।”
— “কোথায়?” নাবিলার রাগ জমাট বাঁধতে লাগল।
সামির শান্ত গলায় বলল,
— “চলো, সেখানে নিয়ে যাই।”
সামির নাবিলাকে নিয়ে বের হলো। আজ ভার্সিটি যাবে না। কিন্তু বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে, তাই সামিরকে পাকড়াও করল। ওরা মোড়ের দোকানের সামনে এসে থামল। সামির একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল, ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে দিল অবহেলায়।
নাবিলার চোখমুখ সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে গেল। গন্ধে ভ্রু কুঞ্চিত করে একপাশে সরে দাঁড়াল। সামির ওর বিরক্তি টের পেয়ে পাশে এলো। সিগারেটটা নাবিলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
— “এক টান দিয়ে দেখো।”
নাবিলা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করল,
— “আপনি কি সিগারেট খেতে বলছেন?”
— “হুম। খারাপ না।”
— “ছিঃ! তাই বলে…” নাবিলা নাক সিঁটকালো।
— “ভালো জিনিস।”
— “তাই বলে আমাকে খেতে বলবেন? আপনার উচিত আপনার বউকে বাজে কাজ করা থেকে আটকানো। সেখানে উল্টো উসকাচ্ছেন? আপনি সত্যিই স্বামী না আসামি?”
সামির শান্ত গলায় বলল,
— “বউকে নিজের মত বানাচ্ছি।”
নাবিলা চারপাশে তাকাল। দোকানের সামনে বেশ ভীড়। অস্বস্তি হচ্ছিল। ও সামিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল একটু নিরিবিলি কোণায়। তারপর সামিরের হাত থেকে সিগারেটটা নিল। হালকা দ্বিধায়, কৌতূহলে একটা টান দিল। মুহূর্তেই ধোঁয়া চোখেমুখে ছড়িয়ে গেল। কাশতে কাশতে ওটা ছুঁড়ে ফেলল। মুখ বিকৃত করে বলল,
— “ছিঃ! কী বাজে জিনিস!”
সামির হেসে ফেলল,
— “হলোই না। এইভাবে হয় নাকি? আর দু’একদিন প্র্যাকটিস করলে ঠিক হয়ে যাবে।”
নাবিলা কপাল চাপড়ে বলল,
— “এইজন্যই লোকে বলে; সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, স্বামী সঙ্গে সর্বনাশ।”
.
.
.
চলবে……
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৩]
~আফিয়া আফরিন
নাবিলার মুখে “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, স্বামী সঙ্গে সর্বনাশ” শুনে সামির হো হো করে হেসে উঠল। নাবিলা অনেক অনেকদিন পর সামিরের এমন মন উজাড় করা হাসি দেখল। মনটা একনিমিষেই ভালো হয়ে গেল। হাসি থামিয়ে সামির খানিক গম্ভীর হয়ে বলল,
— “তুমি এখনও সর্বনাশ দেখো নাই নাবিলা। স্বামী সঙ্গে আসল সর্বনাশ তো ঘরেই হয়, বাইরে না।”
নাবিলা তৎক্ষণাৎ কথাটার মানে উদ্ধার করতে পারল না। ভুরু কুঁচকে তাকাল,
— “মানে? কী বললেন? ঘরে আবার কী সর্বনাশ হয়?”
সামির মুখটা ওইরকম গম্ভীর করে বলল,
— “তুমিই তো বলেছিলে, স্বামীর সঙ্গে সর্বনাশ। বাইরে তো কেবল ট্রেলার, আসল সিনেমা হয় ঘরের ভেতর।”
নাবিলা বুঝতে পেরে একমুহূর্তে অবশ হয়ে গেল। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল, গাল লাল হয়ে উঠল অজান্তেই। হাত দিয়ে ওড়নার কোণা মুচড়ে ধরল। চোখ নামিয়ে ফেলল, সামির ইয়াসিরের কাঁটাকাঁটা দৃষ্টি একমুহূর্তও সহ্য করতে পারছে না। ঠোঁট শুকিয়ে এলেও হালকা কাঁপা গলায় বলল,
— “চুপ করেন… কোথায় কি বলছেন? এটা রাস্তা। এভাবে কেউ বলে নাকি?”
— “ওহ, ঘরে বলতে হবে নাকি? আচ্ছা এরপর থেকে ঘরেই বলবনি।”
সামিরের মুখে এমন তালছাড়া কথা শুনে নাবিলা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সামিরের হাসি শুনতে পাচ্ছিল আর ওর নিজের ভেতরে কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। নাবিলার লজ্জামাখা মুখ দেখে সামিরের অনেকদিন ভেতরে চেপে থাকা টানাপোড়েন, অস্থিরতা সব স্বস্তি হয়ে নেমে এলো। নাবিলা আর গেল না। উল্টোপথে বাড়ি ফিরে এলো। সামিরটা খুব পাজি… দেখে বোঝা যায় না কিন্তু মিচকা শয়তান।
নাবিলা বাড়ি ফিরতেই দেখল, ড্রয়িংরুমে মামণি আর কামিনী পাশাপাশি বসে গল্প করছে। কামিনীর দিকে চোখে চোখ পড়তেই ও মৃদু হাসি দিল সৌজন্যবশত। কিন্তু কামিনী সেই হাসিটাকে ফিরিয়ে দিল না, চোখের কোনে একরকম নির্লিপ্ততা রেখে শুধু একবার তাকাল তারপর আবার গল্পে মনোনিবেশ করল। মামণি নাবিলাকে দেখে বলে উঠলেন,
— “কোথায় গেলে? এখনই ফিরলে যে? সামির চলে গেছে?”
— “হ্যাঁ।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল নাবিলা।
মামণি মাথা নেড়ে বললেন,
— “আচ্ছা, তুমি বসো এখানে। তোমার ভাবির সাথে গল্প করো। কামিনী তো আসে-ই না, আজ এলো হঠাৎ।”
নাবিলা মৃদু তালে মাথা নেড়ে বলল,
— “মামণি, একমিনিট আসছি আমি।”
এটুকু বলেই ও এক দৌড়ে দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হতে হবে। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে দু’হাতে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে নিলো। মুখের ভেতর এখনও সেই উটকো গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। সামির কেনো যে এই জিনিস খায়? ওর হাতে ধরা সিগারেট, ধোঁয়ার তীব্রতা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আবারও বিরক্তি চেপে ধরল। মনে মনে ফোঁস করে উঠল, “কী বাজে জিনিস, ছিঃ! এটা আবার মানুষ শখ করে খায়? দিনে দশটা খায়? আর উনি আবার বলে কিনা, দু’একদিন প্র্যাকটিস করলেই ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ!”
নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এলো নাবিলা। কামিনীর উল্টোদিকের সোফায় বসে পড়ল নিঃশব্দে। মামণি আর কামিনী সাংসারিক আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। গালে হাত দিয়ে বসে নাবিলা শুধু শুনছিল। মাঝেমাঝে আশ্চর্য লাগে, মানুষ সংসার নিয়ে কত কথা বলতে পারে। কার স্বামী কোথায় ঘুরতে নিয়ে গেল, কী উপহার দিল, উইকেন্ডে কী করল, নানান বাহারের অসংখ্য গল্প। অথচ ওরও তো সংসার আছে। তবু কারও সামনে ও কখনো বলে না, বড়াই তো দূরের কথা।
বলবে-ই বা কী? স্বামী একখানা আছে বটে কিন্তু তার সাথে কেমন সম্পর্ক, সেটাই তো এখনো নিজে বোঝার চেষ্টা করছে। বাইরে থেকে যেমন দেখায় সেটা আলাদা, সবাই যা মনে করে তা তো পুরোপুরি ঠিক না, ওদের ভেতরের ছবিটা একেবারেই ভিন্ন। এমন মানুষকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে “ভাবের রাজা” ছাড়া কিছুই আর মুখে আসবে না। নীরবতা ভেঙে নাবিলা হঠাৎই বলল,
— “মামণি, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি?”
মামণি মিষ্টি গলায় বললেন,
— “আচ্ছা যাও, তবে সাবধানে।”
নাবিলা উঠে দাঁড়াল, রান্নাঘরে দাঁড়াল। চায়ের পানি ফুটতে দিতেই নাবিলা ফোনটা হাতে নিল। বান্ধবীদের কয়েকটা মেসেজ পেন্ডিং-এ ছিল সেসবের উত্তর দিল। তারপর সামিরকে এক লাইন লিখে পাঠাল, “আমার না-হওয়া সতীন এসেছে বাসায়।”
মেসেজ পাঠানোর পর নিজেরই ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটল। সামিরের রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা করল, তবে তৎক্ষণাৎ ওর রিপ্লাই পাওয়া গেল না।
এরপরও কিছুক্ষণ স্ক্রল করল, এদিক-সেদিক দেখে ফোনটা রেখে দিল। চা-ও তৈরি হয়ে গেছে প্রায়। নাবিলা কাপগুলো সাজিয়ে নিল, চা ঢালল, তারপর ট্রে সাজিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে হাঁটল।
চায়ের কাপগুলো ট্রে থেকে টেবিলে সাজিয়ে রাখতেই মামণি বললেন,
— “তোমরা গল্প করো, আমি একটু আসছি।” এটুকু বলে উনি ভেতরের দিকে চলে গেলেন।
নাবিলা এক কাপ নিয়ে কামিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল। সৌজন্যমূলক ভঙ্গিতে বলল,
— “নিন ভাবি।”
কামিনী কাপটা হাতে নিলেও তার মুখে হাসির রেখা ফুটল না। শুধু শুকনো গলায় বলল,
— “থ্যাঙ্ক ইউ।”
নাবিলা হাসি টেনে জবাব দিল,
— “ওয়েলকাম ভাবি। খেয়ে বলেন তো, কেমন চা বানালাম।”
কামিনী কাপটা ঠোঁটে নিয়ে একচুমুক খেয়ে আবার সেই শুকনো ভঙ্গিতেই বলল,
— “নতুন নতুন শিখছো নাকি?”
— “হুম, চেষ্টা করছি।”
— “ভালোই।” সামান্য থেমে কামিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার বর কোথায়? ক্লাসে নাকি?”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নাবিলা বলল,
— “হ্যাঁ, মনে হয়।”
কামিনী ভুরু কুঁচকে বলল,
— “মনে হয় কেনো? খবর রাখো না? আমার সাথে যখন ছিল তখন সব খবরাখবর রাখতাম।”
কথাটা আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো এসে গেঁথে গেল নাবিলার ভেতর। মুহূর্তেই ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল। সত্যি কথাটা জবাবে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হলো, “সব খবরাখবর রাখতে পারলে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারো নাই কেনো?” কিন্তু মুখ খুলল না।
কামিনী কাপটা নামিয়ে রেখে সামান্য কটাক্ষ করল,
— “সংসারই করতে জানো না এখনো, তবুও বিয়ে করে ফেলেছো? ছেলেমানুষকে এতটা ছেড়ে দিলে চলে? বেঁধে রাখতে হয়, নাহলে হাতের মুঠো থেকে ফসকে যাবে।”
নাবিলা শান্ত গলায় উত্তর দিল,
— “বেঁধে রাখলে কি মানুষ থাকে?”
কামিনী বিদ্রুপের হাসি দিল,
— “থাকবেই। বুঝেছি, তুমি অনেকটা গা ছাড়া স্বভাবের। এমন করলে সংসার হবে নাকি? দেখো, ক’দিন তোমার বরকে ধরে রাখতে পারো। সামিরের জেদ তো দেখেছো নাকি এখনও যথাযথ জেদ সম্পর্কে ধারণা পাও নাই? ও নিজেকে ছাড়া আর কাউকে প্রায়োরিটি দিতে জানে না। আমি হারে হারে বুঝেছি, ওর সাথে জড়ানো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।”
নাবিলা মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “এভাবে বলছেন কেন? এক সময় তো আপনি তাকে ভালোবেসেছিলেন।”
কামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “হুম, ভালোবাসা? সামির ভালোবাসা বোঝে? আমাদের সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল কিনা এখনো বুঝি না। আসলে হয়তো আমার আবেগ ছিল, আর সামিরের একরোখা জেদ। কে জানে?”
নাবিলা নীরব। শুধু চুপচাপ শুনছিল। কামিনী আবারও বলল,
— “তুমি তো সবকিছু জানো না। জেদ করেই ও সম্পর্ক শেষ করেছিল। আমিও মেনে নিয়েছিলাম। সামির নিজেই বলেছিল, আমি যেন আর কোনদিন তার সামনে না আসি। আমিও আসিনি। আমার তো বয়েই গিয়েছিল! ওর ওই উগ্র স্বভাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত কেউই টিকতে পারবে না। তুমি পারবে ভেবেছো? একদিন তুমিও সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবে, দেখে নিও।” বলেই একটা নিশ্বাস ফেলল কামিনী।
নাবিলা চমকে উঠল। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলল,
— “কি বলছেন আপনি?”
কামিনী নির্লিপ্ত মুখে তাকাল,
— “সত্য কথাই বলছি। তোমারও গিলতে কষ্ট হচ্ছে, সামিরেরও হয়েছিল। সত্যি কথা তো আর সবার হজম হয় না। সময় হলে মিলিয়ে নিও।”
নাবিলার বুকের ভেতরটা আবার ধড়াস করে উঠল। সামিরের নামে এসব কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সহ্য হচ্ছিল না। সামিরকে সে চেনে… জানে… ইদানিং বোঝারও চেষ্টা করছে। ওর জেদ, রাগ সব ঠিক আছে কিন্তু কামিনীর ধারণা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। নাবিলা কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি ওকে সত্যি ভালোবাসতেন?”
কামিনী ঠোঁট উল্টাল,
— “কী জানি। তবে এটা সত্যি, মনে মনে চেয়েছিলাম ওকে।”
নাবিলা গভীর শ্বাস ফেলল,
— “তাহলে ও যেসব অপছন্দ করত, সেসব না করলেই হতো। সব সমস্যা তো মিটে যেত। ওর জেদের সাথে সমঝোতা করতে পারতেন। ওর রাগ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন। আমি তো কখনোই সামিরকে কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে দেখি নাই। ওর নিজের যেমন আলাদা জগত আছে, আরেকজনের আলাদা জগতকেও ও সম্মান করে।”
কামিনী চোখ বড় বড় করে নাবিলার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়েই থাকল, নিজের কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল। তারপর শীতল কণ্ঠে বলল,
— “এই যুগে দাঁড়িয়ে তুমি এরকম টিপিকাল কথা কিভাবে বলছো? সামির যেগুলো অপছন্দ করত, সেগুলো সব বাদ দিলে জীবনটাই তো মিস হয়ে যাবে। জানো, ওর অপছন্দের লিস্ট কত বড়?”
নাবিলা চুপচাপ মাথা নাড়ল। কামিনী হেসে তিক্ত স্বরে যোগ করল,
— “আমার ছেলেফ্রেন্ডদের সহ্য করতে পারত না। সামান্য কিছু হলেই সন্দেহ। একটা না একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে দিত। বলো তো, এইভাবে মানিয়ে নেওয়া যায় নাকি?”
নাবিলা একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
— “আমারও আছে বন্ধু। কিন্তু সে তো কিছু বলে না।”
কামিনী নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকাল। ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁক এনে বলল,
— “তাহলে নিশ্চিত তোমাকে ভালোবাসে না। যাকে ভালোবাসে, তার প্রতি কতৃত্ববোধ থাকেই। সামির আমাকে ভালোবাসত… তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাড়াবাড়ি আমার সহ্য হয়না।”
নাবিলার বুকের ভেতর আগুনের মতো জ্বলে উঠল। মনে হলো, কামিনীর একেকটা কথা তার বুক বিদ্ধ করছে। সামির এতটা ভালোবাসল অথচ ও ভালোবাসার কোনো মূল্য দিল না? ভালোবেসেও যদি শেষে হারিয়ে ফেলে, তবে সেই ভালোবাসার দাম কোথায়? সামির কি আসলেই এতটা ভালোবাসতে পারত। নাবিলার প্রতি এতটা ভালোবাসা, এতটা কতৃত্ববোধ থাকলে; ও সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিত। দরকার নাই জীবনের ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার। এক সামির ইয়াসিরকে নিয়েই সে সারাজীবন থাকতে পারবে।
কিছু প্রশ্ন নিজের ভেতর উঁকি দিচ্ছিল, “তাহলে আমার দোষ কোথায়? আমি কি করেছি? আমার মনের মধ্যে যে অদ্ভুত টান, সেই অচেনা শিহরণ, প্রতিদিনের অস্থিরতা; এগুলো কি দোষ করল? কেনো সামির নিজের ভালোবাসা উজাড় করল এমন এক মানুষের কাছে, যে শেষমেশ তাকে বোঝেনি?”
চোখ নামিয়ে নিল নাবিলা। বুকের ভেতর এক চাপা কষ্ট জমে উঠল। মনের মধ্যে ভালোলাগা-ভালোবাসা, সত্যি-মিথ্যা, প্রেম-অপ্রেম, আবেগ-অনুভূতি সব একসাথে ঢাল তলোয়ার চালাচ্ছে। কামিনীর দিকে তাকিয়ে শেষে মনে হলো, অপাত্রে ভালোবাসা দিলে তার তীব্রতা যতই হোক না কেন শেষমেশ সেটাই বিষ হয়ে যায়।
.
কামিনী চলে গেল, কথাবার্তা আর বিশেষ কিছু বলল না। তবে যেটুকু বলেছিল, তার রেশ ঘরের দেয়াল পর্যন্ত লেগে গিয়েছিল। নাবিলার বুকের ভেতরটা ভারি হতে লাগল। সারাদিন ওর মুখে কোনো হাসি দেখা গেল না। ঘরের ভেতর উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি করল, কখনো জানালার ধারে দাঁড়াল, কখনো আবার বিছানার কোণে বসে থাকল। মন খারাপের ছায়া চোখ-মুখজুড়ে স্পষ্ট।
তখন দেওয়া মেসেজের রিপ্লাই সামির দিয়েছিল, “কে এসেছে? না হওয়া সতীন মানে?”
মেসেজটা পড়ে নাবিলা ইচ্ছে করেই ফেলে রাখল। উত্তর দেবে না সে। মনের ভেতরের দমবন্ধ করা অস্বস্তিটা ব্যাখ্যা করার মতো ভাষা নেই। সন্ধ্যেবেলা সে এলো। তার স্বাভাবিক ভঙ্গিমা। নাবিলা বইয়ে মুখ গুঁজে ভেবেছিল, হয়তো খেয়াল করবে মুখের বেজার ভাব। কিন্তু সামির কিছু টেরই পেল না।
সে নিজের মত করে জামাকাপড় পাল্টে যেই না কিছু বলবে ওমনি নাবিলা মামণির ঘরে চলে গেল। সেখানে বসে দিনভর জমে থাকা নানান কাহিনী উজাড় করে বলা শুরু করল। মামণির সাথে খুনসুটি, সোজাসাপ্টা আলাপ… যেটা দরকার নেই, সেটাও বলল।
রাতের খাবারের সময় দু’জনের আবার মুখোমুখি হতে হলো। নাবিলা চুপচাপ খাওয়া সারল, সামিরও অপ্রয়োজনীয় কথা বলল না। টেবিলে যদিও মা-বাবার গল্প চলছিল, কিন্তু ওরা দু’জন নীরব। খাওয়া শেষ হতেই নাবিলা বিনাবাক্যে উঠে পড়ল। সোজা নিজের ঘরে চলে এলো। কামিনীর কথাগুলো এখনও মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদে সামিরও ঘরে এলো। নাবিলাকে চুপ থাকতে দেখে কৌতূহল আর উদ্বেগ মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? সিগারেটের ডোজ বেশি হয়ে গেছে নাকি?”
নাবিলা হালকা কণ্ঠে উত্তর দিল,
— “আমি ঘুমাব। কথা বলবেন না।” বলেই উল্টোদিক ঘুরে শুয়ে পড়ল। সামির চোখ বড় করে তাকাল। ওর আচরণটা অপ্রত্যাশিত ছিল। মায়ের কাছ থেকে শুনেছে, কামিনী এসেছিল। ওকে উদ্দেশ্য করেই কি তখন নাবিলা মেসেজটা পাঠিয়েছিল? কিন্তু এখন কেন মুড অফ? কামিনী কি কিছু বলেছিল? কারণ সকাল পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাক ছিল। হাসতে হাসতেই বাড়ি ফিরছিল নাবিলা। এরমধ্যে সামিরের সাথে আর কোন কথা হয় নাই যে তার অবাঞ্ছিত কোন কথার কারণে মন খারাপ থাকবে। সামির ওকে জিজ্ঞেস করতে এগিয়ে এলো। ওমা, মেয়ে তো ঘুমিয়েই কাঁদা…
সামির ডাকলেও নাবিলা সাড়া দিল না। চুপচাপ উল্টোদিকে তাকিয়ে রইল। একরকম এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গি। সামির দু’একবার ডাকল, তারপর নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নিজের দিকে মন দিল।
নাবিলা চোখ মুছে বিছানায় শুয়ে থাকল। ভেতরে ভেতরে ভাবতে লাগল, “আমি কেনো এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি ওকে? কী দরকার এত মন খারাপ করার? আমার না হওয়া সতীন কি না কি বলে গেল, তাই নিয়ে এত ভেবে যাচ্ছি? সামির তো এখন আর ওকে ভালোবাসে না।” আবার ভেতরের অন্যদিকটা ফুঁসে উঠল,
“কত্ত বড় সাহস তার! আমাকে কিনা বলে বসল, সামির আমাকে ভালোবাসে না। আচ্ছা, না বাসলে নাই। সামির যদি আমাকে ভালো না বাসে, তাতে কী? আমি কি অন্য কারো ভালোবাসা চাইতে গেছি?” নাবিলা উঠে বসল। সামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— “এত ডাকাডাকি করছেন কেনো?”
সামির পিছন ফিরে তাকাল,
— “তুমি জেগে? ডাকলাম শুনলে না কেনো?”
নাবিলা মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিল,
— “যারা আমাকে ভালোবাসো না তাদের কথা শুনি না।”
— “মানে?”
— “মানে আপনাকে ব্যাখ্যা করে দিব?” নাবিলা বিরক্ত।
— “এই ভালোবাসা উদয় হলো কোথা থেকে?”
নাবিলা গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালহ
— “সেটা তো আমার জিজ্ঞেস করা উচিত? একসময় তো খুব ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন, কী হলো তাতে? টিকলো? এখন তো আরও আজেবাজে কথাও বলে।”
— “তুমি কামিনীর কথা বলছো?”
— “তো? কয়টা ছিল আপনার? আর কার কথা বলতে পারি?” নাবিলার কণ্ঠ তেতে উঠল।
— “কামিনী কি বলেছে তোমাকে?”
নাবিলা বলল সবকিছুই। একটা শব্দও বাদ রাখল না। শেষে এটাও বলল,
— “সে বলেছে আপনি নাকি আমাকে ভালোবাসেন না।”
সামির ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল,
— “তাই বলেছে?”
— “হুম। এটা আমি মানতে পারছি না। কেনো বলবে আমাকে?”
— “ভুল বলেছে নাকি?”
নাবিলা একটা বালিশ সামিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
— “না বলুক। বলল কেনো, এটাই আমার প্রশ্ন। আমি কি ওর স্বামীর ভালোবাসা চাইতে গেছি।”
সামির দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। দরজার দিকে এগিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। বলল,
— “ছিঃ ছিঃ এসব কি বলে। তুমি আবার ওর কথা ধরতে গেছো কেন? কথাই বা বলতে গেছো কেনো?”
— “আচ্ছা আপনি এখনও তাকে ইগনোর করেন।”
— “হুম।”
— “কেনো করেন?”
— “কারণ নেই… এমনিতেই। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি আমাকে ওর পিছু পিছু ঘুরতে বলছ?”
নাবিলা রেগে গিয়ে আরেকটা বালিশ সামিরের দিকে ছুঁড়ে দিল। সামির সেটা ক্যাঁচ করে হেসে উঠল। এগিয়ে এসে বিছানায় বসে বলল,
— “কি করতে বলছো?”
নাবিলা গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
— “আমি যা বলব সেটা আপনি শুনবেন?”
সামির একমুহূর্ত ভেবে শান্ত গলায় বলল,
— “হুম।”
— “রাস্তাঘাটে দেখা হলেই ভাবি ভাবি বলে চিল্লানি দিবেন। যাইহোক, আপনি তো দেওর তাইনা।”
সামির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
— “আচ্ছা, তাহলে তুমি খুশি?”
নাবিলা একটু তব্দা খেল। খটকা লাগল, ওর খুশি-অখুশিতে সামিরের কি যায় আসে? সামান্য মাথা নেড়ে বলল,
— “হুম।”
— “তাহলে ঠিক আছে। তুমি খুশি থাকলেই হলো।”
— “আমার খুশিতে কি যায় আসে?”
— “কিছুই যায় আসে না বুঝি?”
নাবিলা উত্তর দিল না। নিঃশব্দে সামিরকে বোঝার চেষ্টা করছিল। কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সামির বলল,
— “আসলে অনেক কিছু, না আসলে কিছুই না।”
— “বুঝলাম না।”
— “বুঝতে হবে না। এক কাজ করো, সেদিনের মত করে মাথা টিপে দাও তো একটু।”
নাবিলা ভুরু কুঁচকে বলল,
— “আজকেও মাথাব্যথা?”
— “না। এমনিতেই।”
— “বাতি নিভিয়ে দিন। আমি আর পরে উঠব না।”
সামির কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। বাতি নিভিয়ে দিয়ে আবার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। ঘরটা মুহূর্তেই আধো অন্ধকারে ডুবে গেল।জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো মৃদু রেখা এঁকে রেখেছে দেয়ালে। সামিরের চুলে আঙুল ছুঁয়ে দিতেই সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা ফিরে এলো। তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা নাবিলার কানে এসে লাগছিল। নাবিলার হাতের পরশে সামির একটু সরে গেল যাতে ওর সুবিধে হয়। নাবিলা ভাবল, হয়ত সামিরের সমস্যা হচ্ছে তাই নিজেও সরে গেল। তবে বেশি যেতে পারল না। তার আগেই সামির বলল,
— “কেন এমন দূরে সরে যাচ্ছো, নাবিলা?”
নাবিলার হঠাৎ কান্না পেল। কিন্তু কাঁদল না। কিছু বললও না। নিঃশব্দে চোখ বুজে নিল। শুধু ঠোঁটের কোণে মৃদু কাঁপন খেলে গেল।
.
দুদিন পর…
সকালের রোদ ঝাঁপসা হয়ে উঠেছে। সামির বাইরে বের হচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার ওপাশে চোখে পড়ল কামিনীকে। থেমে গেল সামির। নাবিলার বলা কথাটা মনে পড়ল। সামিরের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল। সে মৃদু চিৎকার করে ভাবি ডাকের সহিত সালাম দিয়ে এগিয়ে এলো। রাস্তার কয়েকজন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। কামিনী থমকে দাঁড়াল, চোখ বড় বড় করে সামিরের দিকে তাকাল। সামির হাত নাড়ল, মনে হচ্ছে গলায় গলায় পিরিতি এমন কোনো আত্মীয়কে ডাকছে। মুখে হাসি লেগেই আছে। কামিনীর সামনে এসে পুরান ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে বলল,
— “ভাবিজান কেমন আছেন? এই ক’দিন তো আর দেহাই পাইতাছি না। ভাইজান ভালো তো? বিয়ার পর তো একদিনো চা’য়ের দাওয়াত দিলেন না। ভেরি ব্যাড! যাইহোক, বউ নিয়া আজকা আইতাছি। আপ্পায়নে কোনো ত্রুটি কইরেন না ভাবিজান।”
.
.
.
চলবে……