#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৪]
~আফিয়া আফরিন
কামিনী হাঁ হয়ে গেল। রায়হানের সাথে বিয়ে হয়েছে এতদিন হয়েছে, আজ পর্যন্ত সামির কথা বলা তো দূরে থাক ইচ্ছেকৃত তাকায়ও নাই। আর আজ নিজের থেকে ডাক দিয়ে কথা বলছে। আবার ভাবি ডাকছে। কামিনী বিস্ময়ে এতটাই অবাক হয়ে গেল যে, কথাই বলতে পারল না। তার নিজেরও ক্লাস ছিল। সেখান থেকেই ফিরছিল। ওরা এখন বাড়ির সামনের রাস্তায়। সামিরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
— “ভাবিজান, বোধহয় দাওয়াত কবুল করছেন না?”
— “ফাজলামি হচ্ছে?”
সামির মজা চালিয়ে গেল,
— “আরে আরে, আপনি ফাজলামি করার সুযোগ কোথায় দিচ্ছেন? আর আমি ভাবিদের সাথে এত ফাজলামি করতে পারি না। আমার সব ফাজলামি তো আমার বউয়ের জন্য!”
কামিনী ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলল,
— “আমাকে কেনো ডেকেছো?”
— “ওমা! বড় ভাইয়ের বউকে মানে আমার ভাবিজানকে আমি ডাকতে পারি না নাকি?”
কামিনীর চেহারাটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল। হতভম্ব, বিরক্তি আর অবিশ্বাসের মিশেলে অদ্ভুত ভাব। সামিরের কাছে এটাই সবচেয়ে মজার। সে সত্যি উচ্ছ্বাসিত। কামিনী চোখ-মুখ শক্ত করে জবাব দিল,
— “আমাকে ভাবি ডাকবে না।”
সামির হেসে বলল,
— “তাহলে কি বলি আপনাকে? ভাবি ডাকলে রাগ, তবে আন্টি ডাকব?”
কামিনী সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় করে তাকাল,
— “আন্টি? আমি এত বুড়ি তোমার চোখে?”
সামিরের হেসে গড়িয়ে পড়ার জোগাড়,
— “আরে না না। আমি তো মজা করছি। তবে আপনি ওতটাও জোয়ান নয়, সেই হিসেবে তো আন্টি বলাই যায়। দেখুন আমার কোনো দোষ নাই। আপনিই তো ভাবি ডাকতে মানা করে দিলেন। আমার কথার অনেক গুরুত্ব আমার কাছে।”
কামিনী বিরক্ত ভঙ্গিতে ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বলল,
— “তুমি একদমই বদলাওনি।”
সামির মাথা নাড়ায়,
— “বদলাইনি বলেই তো চিনতে পেরেছেন। বদলানো তো আমার স্বভাব না। বদলানো গিরগিটির স্বভাব। আপনি যদি গিরগিটি দেখতে চান, তবে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান ভাবিজান।”
এই কথা বলেই সঙ্গে সঙ্গে সামির জোরে হেসে উঠল। হাতের চাবিটা আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে ধীরে ধীরে পিছু হঁটল।
কামিনী এতক্ষণে পুরো স্তব্ধ। অবাকের চেয়েও অবাক চাহনিতে শুধু তাকিয়ে রইল সামিরের দিকে। বিশ্বাসই করতে পারছে না, সামির এইভাবে তার সাথে কথা বলছে। কথা তো নয়, সরাসরি অপমান।
সামির আবারও একচিলতে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। কামিনীও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল।
সামির মনে মনে স্বস্তি পেল। এতদিন তার কাছে কামিনীকে এড়িয়ে চলাই ছিল একমাত্র সমাধান। অথচ আজ বুঝতে পারল, এড়িয়ে যাওয়ার আর প্রয়োজন নেই। কেনই বা এতদিন ওকে এড়িয়ে চলেছে, সেই প্রশ্নই এখন মাথায় ঘুরছে।
কামিনী এখন আর সেই পুরোনো মানুষ নয়, সে এখন বড় ভাইয়ের বউ। সম্পর্কে ভাবি, ইয়েস ভাবিজান। এই পরিচয়ের ভেতরেই তার অস্তিত্ব সীমাবদ্ধ। সামির মনে মনে হাসল। ভাগ্যিস নাবিলা ওকে বলেছিল, ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিল। না হলে হয়তো এভাবে সারাজীবন একটা অশান্তির ছায়া লুকিয়ে থাকত, চোখের আড়ালে থেকেও মনের ভেতর ঝড় তুলত।
ভাবতে গিয়ে সামিরের বুকের ভেতর উষ্ণতা জমে উঠল। সত্যিই, নাবিলাটা না অদ্ভুত! একেবারেই অদ্ভুত। সবার থেকে আলাদা। যে মেয়েটা সাদামাটা আচরণের বাইরে যায় না, সেও অদ্ভুতভাবে মানুষের ভেতরের গিঁট খুলে দিতে পারে। ও ভীষণ মিষ্টি, অদ্ভুত রকমের আদুরে আর প্রিয়…
.
সময়টা তখন বছরের মাঝামাঝি। দিনগুলো কেমন নিরিবিলি, শান্ত; না ঝড়ঝাপটা আছে, না বাড়াবাড়ি কিছু। অতিরিক্ত সাধারণ এক ছন্দে কেটে যাচ্ছে।
নাবিলা তার মতো করে পড়াশোনায় মন দিয়েছে। মাঝেমধ্যে ক্লাস, গ্রুপ স্টাডি, আবার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা। পরীক্ষার চাপ আছে, তবে সেই চাপটা পড়াশোনার স্বাভাবিক গতির অংশ। তাই কিছু মনে হয় না।
এই সময়টাতে আদনানের সাথে দেখা হয় প্রায়ই। সামিরের কাছ থেকে যা জানার ছিল, নাবিলা জেনে নিয়েছিল আরোও আগেই। মনে পড়লেই একদিকে ভীষণ হাসি পায়, আবার অন্যদিকে বেচারার জন্য দুঃখও লাগে। প্রেজেন্টেশন বা কোনো প্রজেক্টের ঝামেলায় পড়লেই নাবিলা নির্ভর করে আদনানের উপরই। আর আদনানও বিনা দ্বিধায়, আন্তরিকভাবে হেল্প করে দেয়।
সামিরের দিনকাল ইদানীং ব্যস্ততার ভেতর দিয়েই কাটছে। ব্যস্ততা শুধুই পড়াশোনা নিয়ে। সামনে ফাইনাল, হাতে এখনো তিন মাস বাকি কিন্তু এই সময়টাও চোখের পলকে ফুরিয়ে যাবে বলে মনে হয়। মাথার ভেতর মাঝেসাঝে জট পেকে যায়। এই ব্যস্ততা কিংবা ক্লান্তি লগ্নে অবশ্য একটা সুখবর আছে। সামির স্কলারশিপের জন্য যে আবেদন করেছিল, তার রেজাল্ট এসে গেছে। এখন ফাইনাল পরীক্ষার পর শেষ কাগজপত্র জমা দিলেই পথ একেবারে খোলা। পাখির মত ফুড়ুৎ করে উড়াল দিবে আকাশে।
খবরটা শুনে মা-বাবা ভীষণ খুশি হয়েছে, গর্বে বরাবরের মতই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আর নাবিলা? ও খুব সংক্ষেপে, শুধু অভিনন্দন জানিয়েছে। খুশি কিংবা অখুশির কোনো রেশ ওর মুখে টের পাওয়া যায়নি। ইচ্ছে করেই আবেগগুলো আড়াল করে রেখেছে। সামির চলে যাবে, এটা কখনোই ওর জন্য খুব ভালো খবর হতে পারে না। তবে সামিরের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর।
নাবিলার নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া সামিরের চোখ এড়ালো না। বাইরে থেকে কিছু বোঝাল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা খোঁচা খেল। এত বড় একটা খবর, যা মা-বাবা শুনে খুশি হলো। পরিচিত সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে, হৈচৈ করছে, সেখানে নাবিলা শুধু সামান্য একটা অভিনন্দন বলেই থেমে গেল। আর কিচ্ছু বলে নাই, একটা শব্দও না। চোখে-মুখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, কোনো বিশেষ ঝলকও নেই। এই বিষয়টা বাদ দিলেও নাবিলা আগের মত নেই, অনেক বদলে গেছে। পরিবারের আর কেউ এই বদল টের পাচ্ছে না কারণ সবার সাথে নাবিলা নিজের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা বজায় রেখেছে। শুধুমাত্র সামিরের বেলায়ই আলাদা…
নাবিলার মুখ দেখে আজকাল মনে হয়, সামিরের জীবনের কোনো বিষয়ে ও বিশেষ সম্পর্কও রাখে না। ভেতরে ভেতরে সামিরের অস্বস্তি জমতে লাগল দিনকে দিন। মনের গভীরে একটা কৌতূহল আর একটু অভিমান রয়ে গেল, “ওর কাছে আমি আসলেই কতটুকু? সবটুকুই কি স্বাভাবিক, সাধারণ, গুরুত্বহীন নাকি ইচ্ছে করেই ও নিজের আবেগ গোপন করছে?”
সামির যখন খবরটা জানাতে এসেছিল, তার বলার ভঙ্গিতেই অনেকখানি উচ্ছ্বাস লুকানো ছিল, তা নাবিলা বুঝেছিল। অথচ তখন মুখ থেকে শুধু সামান্য একটা শব্দ বেরিয়েছিল, আর কিছুই না। আসলে খুশি তো হয়েছিল, বুকের ভেতরটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। তবু সেই আনন্দটা মুখে প্রকাশ করতে পারল না। কারণ জানে, সামির এমনিতেই ওর আবেগের ওজন মাপতে চায় না। তাই আর আনন্দ প্রকাশের চেষ্টা করে নাই। মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নাবিলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে বাহিরে তাকিয়ে ছিল। বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসছে। চোখ নামালেই মনে হচ্ছে, কেমন শূন্যতা এসে ভর করছে চারপাশে।
মন বারবার খারাপ হচ্ছিল। কারণ, সামির তো সত্যিই চলে যাবে। পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ, সবমিলিয়ে সে পাখির মতো উড়ে যাবে নিজের স্বপ্নের আকাশে। আর ওর কি হবে? এই ভালোবাসাটা কি শুধু বুকের ভেতরেই বন্দি থেকে যাবে সারাজীবন? মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
“আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছি, সেটা ও জানেই না। ওই ব্যাক্কল নাকি আমার ভালোবাস, না আমি? আমিও বোঝাতে পারছি না এতদিনে, ও নিজেও বুঝতে পারছে না। ও তো আর ভালোবাসে না যে বুঝবে!”
বুকের গভীরে গোপনে জমে থাকা অনুভূতিটা একরকম জেদ করেই রয়ে গেল। যতই না বোঝে, যতই দূরে চলে যাক; সামিরের সত্ত্বার সাথেই নাবিলার জীবনটা বাঁধা পড়ে গেছে। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া এই বন্দীত্ব কতদিন বরণ করা যায়? ইশশশ, একটু যদি ভালোবাসা পাওয়া যেতো… এত ভয়ঙ্কর কষ্ট নাবিলার কখনো হয় নাই। বাবা বকলেও না, মা খুন্তি দিয়ে একটা বাড়ি দিলেও না, নাদিমের সাথে ঝগড়া হলেও না। জীবনে কষ্ট যতটুকু পেয়েছে, সবটা এই সামির ইয়াসিরের থেকেই।
সম্পর্কের গতিতে যে খানিকটা অদল-বদল এসেছে তার প্রমাণ হচ্ছে আজকের এই দিনটা, এই মুহূর্তটা। ঘরটা চুপচাপ। এককোণে নাবিলা বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে আছে, আরেক কোণে সামির ফোনে চোখ আটকে রেখেছে। দু’জনের মধ্যেই একটা অদৃশ্য দূরত্ব কিন্তু সেটা ভান, লোক দেখানো অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না। নীরবতা ভেঙে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। দু’জনেই সজাগ হয়ে তাকাল দরজার দিকে। সামির বলল,
— “দরজা খোলা।”
অন্বেষা উঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ল। সামিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “দরজা খোলা রেখে কি করিস তোরা?”
সামির বলল,
— “দেখতে পাচ্ছিস না?”
অন্বেষা মুখে লঘু হেসে বলল,
— “হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। দু’জনই ঘরের দু’কোণায় বসে আছিস। আমি আরও ফর্মালিটি করে দরজায় নক করলাম। অভদ্রের মতো না ঢুকে ভাবলাম, ঘরে স্বামী-স্ত্রী যদি রোমান্টিক অবস্থায় থাকে তো আমি কাবাবের হাড্ডি কেন হবো? কিন্তু এখন তো দেখি কাহিনী উল্টো। অসীম দুরত্ব বজায় রেখে দুজন বসে আছিস। অ্যাই, তোদের কি ছোঁয়াচে রোগ নাকি?”
— “ফালতু কথা বলিস না। আর তুই তো অভদ্র-ই। কথাবার্তার কী ছিরি। তোর কী কাজ এখানে?”
নাবিলা অন্বেষার দিকে তাকিয়ে রইল। কথাবার্তা যা বলার সামিরই বলছে। অন্বেষা একটু এগিয়ে এসে বলল,
— “আমার কাজ পরে। আগে বল, তোদের কাহিনী কি?”
— “কী কাহিনী?”
অন্বেষা ধমকের সুরে বলল,
— “একজন বিরহে বিরহিনী হয়েছে, আরেকজন শোকে পাথর। দু’টোর কোনো পাত্তা নাই কেনো? খুব লায়লি-মজনু হয়েছিস তাই না? আমাদের ভুলে গেছিস?”
সামির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,
— “আমি তো কিছুই করি নাই।”
অন্বেষা নাবিলার দিকে তাকাল। নাবিলা ঠোঁট উল্টে বলল,
— “আমিও কিছু জানি না।”
অন্বেষা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকাল। নাবিলার মন খারাপ ও টের পেয়েছে। বয়স একই না হলেও অনেক বেশি তফাত নেই ওদের মধ্যে। অন্বেষা আর সামির তো একই বয়সি। এই বয়সের খাতিরে বোঝে, নাবিলার বয়সি একটা মেয়ের কী কী কারণে মন খারাপ হতে পারে। ওর জীবনে কোনোদিক থেকে কোন চাপ নেই, চিন্তা-ভাবনা নেই; তাই বোঝা আরও সহজ হয়েছে। অন্বেষা শুনেছে, অনেকবার শুনেছে, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ওদের বিয়ে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, ওরা কী পরিস্থিতিতে পড়েছিল… সব জানে। আর জানে বলেই প্রথম থেকে চেষ্টা করেছে নাবিলার সাথে থাকার, ওকে ভরসা দেওয়ার। সেখানে সফল হয়েছে। নাবিলার সাথে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যেখানে নাবিলা মোটামুটি সবকিছু অন্বেষার সাথে শেয়ার করে। ইদানীং নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়েছে। বলার আছে অনেককিছুই কিন্তু বলে না।
অন্বেষা সামিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— “তুই বাইরে যা। নাবিলার সাথে আমার কথা আছে।”
— “আমার সামনেই বল।”
অন্বেষা খ্যাক করে উঠল,
— “অ্যহহহ, শখ কত!”
— “বহুত শখ।”
— “যা ভাগ। তোর বউকে কিডন্যাপ করব না।” অন্বেষা মৃদু ধমক দিয়ে এগিয়ে এসে নাবিলার দিকে তাকাল,
— “মন খারাপ কেন তোমার?”
সামির কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। নাবিলাকে জিজ্ঞেস করল,
— “মন খারাপ নাকি তোমার?”
নাবিলা তৎক্ষণাৎ হেসে বলল,
— “কই না তো।”
সামিরও হেসে উঠল,
— “দেখলি, কোথায় ও মন খারাপ করেছে।”
অন্বেষা তার কটমট দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকাল। সামির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেরোতে বেরোতে মুখে বারবার বিড়বিড় করে বলল,
— “মাইয়া মানুষের মন বোঝা চাট্টিখানি কথা না।”
অন্বেষা নাবিলার পাশে বসতেই ও সামান্য অস্বস্তি অনুভব করছিল। যদিও মুখে প্লাষ্টিক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আপু কী বলবে কী বলবে, ভাবতে ভাবতেই অন্বেষা বলল,
— “মুখের হাসিটা কিন্তু অতিরিক্ত হয়ে গেছে নাবিলা।”
নাবিলা তৎক্ষণাৎ হাসি থামাল। কিঞ্চিত অবাক হয়ে বলল,
— “মানে?”
— “মানে তুমি যে আমাকে দেখানোর জন্য হাসছো, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি।”
নাবিলার মুখটা কালো হয়ে গেল। লাজ আর অস্বস্তির মিশ্রণ। অন্বেষা ফের বলল,
— “আমাকে বলো তো কি হয়েছে তোমার?”
নাবিলা মৃদু শ্বাস নিয়ে বলল,
— “কিচ্ছু হয় নাই। দেখো, আমি ঠিক আছি। আসলে পড়াশোনার এত চাপ চলছে, তাই আর কী।”
অন্বেষা ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল অন্যকিছু। ধীরে ধীরে বলল,
— “উঁহু, সেটা না। অন্যকারণ আছে। সামির কিছু বলেছে?”
— “না।”
অন্বেষা মন খারাপের চাহনিতে বলল,
— “তো? ও চলে যাবে দেখে মন খারাপ?”
নাবিলার বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল। বুক ভেঙে সমুদ্র সমান কান্না ছুটে আসতে চাইছে। চেপে রাখার কষ্টে পুরো শরীরটা ভারী হয়ে উঠল। হালকা চালে মাথা নাড়ল, কিছু বলল না। অন্বেষা নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
— “ভালোবেসে ফেলেছ, তাই না?”
নাবিলা মাথা নামিয়ে রাখল। ঠোঁট কাঁপছিল, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছিল না। স্বীকার করেও অস্বীকার করতে চাইছে। অন্বেষা আবার বলল,
— “তাহলে সামিরকে জানিয়ে দাও।”
নাবিলা হঠাৎ মাথা তুলে তাকাল। চোখে জমে থাকা জল চিকচিক করছিল। প্রায় কাঁপা কণ্ঠে অনুরোধ করল, অন্বেষা যেন ভুলেও সামিরকে কিছু না বলে। বোঝার হলে ও নিজেই বুঝবে। আর না হলে… নাবিলাই বলবে কোনো একদিন, কোনো একসময়। আপাতত না জানুক। নাবিলা অন্বেষাকে দিয়ে কথা দিয়ে নিল, এই ব্যাপারটা শুধুমাত্র ওদের দুজনের মধ্যেই থাকবে। নাবিলা নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে রাখার এক অব্যক্ত প্রতিশ্রুতি নিয়েছে এখন সেই প্রতিশ্রুতির সঙ্গী করেছে অন্বেষাকেও। অন্বেষা তাকিয়ে রইল; ছোটোবোনের মত এই মেয়েটার নিঃশব্দ প্রেমে, যে প্রেমে স্বীকারোক্তি নেই, আছে শুধু এক অন্তহীন অপেক্ষা।
অন্বেষা বেরিয়ে আসার সময় দরজার কাছে সামিরকে দেখল। ওকে আপাদমস্তক দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “তোর বয়স আর আমার বয়স একই অথচ আমি যা বুঝি তার সিকিভাগও তুই বুঝিস না। নিজের মানুষের ভেতরটা বুঝতে শেখ, জানতে চেষ্টা কর। এত ছন্নছাড়া কেনো তুই? সবসময় দেখেছি, যেটা তোর সেটা শুধুই তোর; মানে বলতে চাচ্ছি, সেই জিনিসটার ভালো-মন্দ সবটাই তুই খেয়াল রাখিস। এইবার চুপ কেনো? গায়ে লাগে না? আশেপাশে একটু তাকা। সবাই মুখে যা বলে, যা দেখায়; ভেতরে তা থাকে না। কেউ কেউ মন খারাপ লুকাতে বড্ড ওস্তাদ।”
অন্বেষা আর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে সোজা চলে গেল। সামিরের উত্তরের অপেক্ষাও করল না। কিন্তু ওর কথা শুনে সামিরের বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল। মনের অবস্থা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মন কিছু বুঝতেও চায় না, মানতেও চায়… এই বোকা মন নিয়ে কী করবে সে?
.
নাবিলা বাড়ি যেতে চাচ্ছিল। কতদিন বাবা-মাকে দেখে না। ইচ্ছের কথা এখনও কাউকে জানায় নাই। মামণিকে বললে তিনি আপত্তি করবেন না বরং হাসিমুখেই সামিরকে বলবে পৌঁছে দিতে আর এখানেই নাবিলার যত আপত্তি। সামিরকে বিরক্ত করতে চায় না সে। ছেলেটা কত ব্যস্ত, কত চাপের মধ্যে; ওকে আসা-নেওয়ার ঝক্কি দিতে মন চায় না। কি হবে এত ঝামেলা করে? থাক, ও নিজের মত করে। বুকের ভেতরে জমে থাকা অভিমানটা সামিরের উপর না, নিজের উপর।
নাবিলা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় গোছাচ্ছিল। গোছানো বললেও ভুল হবে, একই জামাটা দু’বার ভাঁজ করে আবার মেলে দেখল, তারপর আবার রেখে দিল। অনেকক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখে-মুখে মনোযোগ আছে ঠিকই, কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে মনটা ঘুরছে অন্য কোথাও।
ঠিক তখনই সামির ঘরে ঢুকল। নাবিলাকে এভাবে ডুবে থাকতে দেখে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে এসে একেবারে ওর সামনে দাঁড়িয়ে গেল। নাবিলা চমকে তাকালো, তারপর পাশ কাটিয়ে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু সামির এক হাত ঠেস দিয়ে আলমারির পাশের দেওয়ালে রেখে ওর পথ আটকাল।
— “কই যাচ্ছো?” সামির নিচু গলায় বলল।
— “সরুন। কাজ করছি।”
— “কাজ না নাটক। আলমারির ভেতরে কি লুকিয়ে রেখেছো, বলো দেখি?” সামির ঠোঁটে হালকা দুষ্টু হাসি নিয়ে এগোল। নাবিলা চোখ নামিয়ে নিল। সামিরের এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে বুকের ভেতর অদ্ভুত শব্দ হয়।
— “কিছু না।”
— “কিছু না হলে তুমি এত গম্ভীর কেন? তোমার মন খারাপ, আর তুমি সেটা লুকাতে চাইছো।”
নাবিলা এবার সত্যিই অস্বস্তিবোধ করল। ও পাশ কাটাতে চাইল, কিন্তু সামির একদমই সরল না। বরং চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল,
— “শুনো নাবিলা, আমি জোর করে হলেও আজ তোমার কথা শুনব। তোমাকে আমি এইরকম কখনো দেখি নাই। এইটুকু মানুষ তুমি, তোমার কি হয়েছে বলবে?”
নাবিলা নিঃশ্বাস আটকে সামিরের দিকে তাকাল। মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু আলমারির হালকা খোলা দরজায় হাত রাখল। ওর কপালের কাছে কয়েক গোছা চুল পড়ছিল, বারবার চোখে এসে লাগছিল। সামির কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর ফুঁ দিল। চুল সরল না বরং গাল ছুঁয়ে গেল।
নাবিলা তড়িঘড়ি সরে যেতে চাইল, কিন্তু সামির এতটা কাছে যে আর যাওয়া হলো না। সামির হাসল মৃদু, তারপর হাত বাড়িয়ে খুব আস্তে করে নাবিলার কপালের চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। আঙুল ছুঁয়ে গেল, নাবিলার বুক কেঁপে উঠল অজান্তে। সামির বাতাসের মতো আলতো করে আদুরে ভঙ্গিতে নাবিলার গালে হাত রাখল। অন্য হাতে নাবিলার হাত ধরল।
নাবিলার বুক দ্রুত ধুকপুক করতে থাকল। সামিরের যে কী হয় মাঝেমাঝে? হৃদয় এইভাবে স্পন্দিত হলে তো একদিন ও হৃদয় হেঁটেই মারা পড়বে। নাবিলার ইচ্ছে করছিল সামিরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দেবে, একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ইচ্ছের লাগাম টানলো। সব ইচ্ছে কি পুরণ হয়? নাবিলা জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি এইরকম করছেন কেনো?”
— “আগে তুমি বলো, তোমার মন খারাপের কারণ?”
কিছুক্ষণ নীরবতার পর নাবিলা স্বীকার করল,
— “আপনি।”
— “আমি? কেনো, ভালোবাসি না বলে?”
— “ধুর, আপনার ভালোবাসা চেয়েছি আমি?” নাবিলা বোধহয় চরম বিরক্ত।
— “না তো। ওই যে ভাবিজান সেদিন বলল…”
— “ওটা তার কথা। আমার কী?”
— “কিছুই না?” সামির ভুরু নাচালো।
— “না।” নাবিলা মাথা নেড়ে উত্তর দিল।
সামির মুখে মৃদু হাসি রেখে বলল,
— “তবে কাঁপছ কেনো? তোমার হৃদপিন্ডের শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি।”
— “আমার হৃদপিন্ড আপনাকে সরে যেতে বলছে।”
সামির নেতিবাচক মাথা নাড়ল,
— “উঁহু, তাই বলছে না। আমি অন্যকিছু শুনতে পাচ্ছি।”
— “আমি বলছি, সরুন। আপনার যাওয়ার ডেট কবে? তাড়াতাড়ি যান তো। বিরক্তিকর একটা।”
সামির ফিসফিসানি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “আমি গেলে ভালো হবে?”
নাবিলা নির্বিকার ভঙ্গিতে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলল,
— “নিঃসন্দেহে।”
— “মন থেকে ভেবে বলছো?”
— “আলবৎ।”
সামির সরে গেল। নাবিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখে বিষণ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জানত, এমনই হবে। সামির চলেই যাবে। তবুও বোকা মনটা চিৎকার করে বলছিল, “আপনি থেকে যান না, প্লিজ! যাবেন না, কোথাও যাবেন না। আমি আপনার অবর্তমানে থাকতে পারব না। বিশ্বাস করুন, আমার ভালো লাগবে না। আপনি বিহীন আমি শীতকালের শুকনো ঝড়া পাতার ন্যায়।”
মুখে একটা শব্দও আসল না। মনে মনে বিরক্তি নয়, কেবল নীরব আকুতি। সামিরের কি উচিত ছিল না ওর অনুভূতির নরম দাগগুলো বুঝে নেওয়া? ও তো তার তিন কবুলের অধিকারীনি, তাও বোঝে না কেনো?
.
.
.
চলবে……
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৫]
~আফিয়া আফরিন
সামির বাইরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল খানিকক্ষণ। একবার ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করছিল। তবে যে তার চলে যাওয়াতে খুশি হবে, তার দিকে ফিরে তাকিয়ে লাভ কি? নাহ, মনের সাথে যুদ্ধ করে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। কিছুক্ষণ পর সামির আবার ফিরে আসে, দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। নাবিলা চমকে তাকায়। চোখে লুকানো কান্নার ছাপ। সামির হালকা গলায় বলে,
— “আমার চলে যাওয়াতে যদি তোমার ভালোই হয়, তবে তাই হবে। কিন্তু যদি কোনোভাবে তোমার মন খারাপের কারণ আমি হই… তবে আমি সেটা জানার অধিকার রাখি।”
নাবিলা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। ওই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ বলল,
— “আমি বাড়ি যাবো।”
সামির ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
— “কিন্তু তুমি তো বাড়িতেই আছো।”
এবার নাবিলা সত্যি বিরক্ত হলো। গলাটা একটু কড়া করে বলল,
— “আমাদের বাড়ি।”
— “নাটোর?”
নাবিলা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,
— “জি।”
সামির গম্ভীর গলায় বলল,
— “আপাতত যাওয়া হবে না।”
— “কেনো?” নাবিলা বিস্মিত চোখে তাকাল।
— “আমি বলেছি তাই।” সামির সোজাসুজি জানাল।
নাবিলা ঠোঁট কামড়ে ধরল,
— “আমি কিন্তু আপনার অনুমতি চাইনি। যেহেতু একসাথে থাকছি সেই খাতিরে জানিয়ে রাখলাম জাস্ট।”
এই বলে নাবিলা ঝটকা দিয়ে উঠে চলে গেল। সামির মাথায় হাত চাপড়াল। এটলিস্ট সে না যাওয়া পর্যন্ত নাবিলাকে কোথাও যেতে দেওয়া যাবে না, তাই দেরি না করে নাবিলার পিছু পিছু দৌড়ে গেল। নাবিলা করিডর ধরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সামির পেছন পেছন দৌড়ে এসে ডাক দিল,
— “এই নাবিলা! দাঁড়াও তো, শুনো!”
নাবিলা একবারও ফিরল না। আরও দ্রুত হাঁটতে লাগল। সামির আচমকা এক লাফে সামনে এসে দাঁড়াল। হাত তুলে পথ আটকিয়ে বলল,
— “স্টপ! নাটোর যাওয়ার ভিসা এখনো মঞ্জুর হয়নি। কোথায় দৌড়াচ্ছ?”
নাবিলা অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল,
— “আপনি আসলেই অসহ্য।”
সামির মিষ্টি হেসে মাথা কাত করল,
— “হ্যাঁ, আমি অসহ্য। আর ক’দিন সহ্য করে থাকো, তারপর নাটোর থেকে নোয়াখালী, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, নদী থেকে সাগর, আকাশ থেকে পাতাল যেখানে খুশি যেও।”
নাবিলা এক পা এদিক ওদিক করে পাশ কাটানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সামির আলতো করে তার কব্জি ধরে টেনে নিল কাছে। নাবিলা আঁতকে উঠল,
— “ছাড়ুন! মামণি আছে।”
সামির গম্ভীর গলায় ফিসফিস করে বলল,
— “তাতে কি আসে যায়? তোমার মামণিকে কি আমি ভয় পাই? দাঁড়াও, ডাকছি।” নাবিলা কিছু বলার আগেই সামির গলা উঁচিয়ে ডাক দিল, “মা, মা।”
নাবিলা আঁতকে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই সামিরের মুখ চেপে ধরল দুহাত দিয়ে।
— “চুপ! পাগল হয়েছেন নাকি? মামণি এলে…”
সামিরের ঠোঁটে চাপা হাসি খেলল। মুখ ঢাকা অবস্থায়ই অস্পষ্ট গলায় বলল,
— “তাহলে তুমি ভয় পাও?”
নাবিলা নিজের হাত সরিয়ে নিল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
— “সবসময় এত ফাজলামি করেন কেনো?”
সামির মৃদু গলায় বলল,
— “ফাজলামি করছি না… আটকাচ্ছি। তুমি যদি যেতেই চাও, তবে আগে আমার অনুমতি নিতে হবে।”
নাবিলা প্রায় অনুনয় ভঙ্গিতে বলল,
— “প্লিজ, এবার ছেড়ে দিন…”
সামির ঠোঁটে আধখানা দুষ্টু হাসি নিয়ে আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক ওইসময় রেশমা এসে দাঁড়ালেন। সামিরের খেয়াল-ই ছিল না মাকে ডেকেছে। হঠাৎ দেখে চমকে উঠল। নাবিলার হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল, নিজের হাত গুটিয়ে নিল। নাবিলাও তাড়াহুড়ো করে একপাশে সরে গেল, অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে আছে। রেশমা দুজনের কারবারে কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললেন,
— “কি হয়েছে, আমাকে ডাকছিস কেনো?”
সামির খুকখুক করে কাশল। গলা পরিষ্কার করে বলে উঠল,
— “আমিই ডেকেছি। দেখো, এটাকে আদরে পুরো বাদড় বানিয়ে ফেলেছো। এখন আমার মাথার উপর চড়ে নাচছে। কী না কী উল্টাপাল্টা বলছে। উঁহুম… সামলাও তুমি। আমি গেলাম।”
নাবিলা জোর করে হেসে নিজের পক্ষে বলল,
— “হ্যাঁ, মানে আমি-ই… না আমি বাদড় না। কোন উল্টাপাল্টা কথাও বলি নাই। আমি তো শুধু যেতে চাচ্ছিলাম।”
রেশমা ভুরু কুঁচকে নাবিলার দিকে তাকালেন,
— “কোথায় যেতে চাও?”
ততক্ষণে সামির চলে গেছে। এমনভাবে চলে গেল যেন কিছুই হয় নাই। অথচ এই নাটকীয় পরিস্থিতির মাস্টারমাইন্ড সে।
নাবিলা একটু ইতস্তত করে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে দিল। কথাটা শেষ হতেই রেশমা এক লহমায় রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বোধহয় আগেই ভেবে রেখেছিলেন, শুধু নাবিলার মুখ থেকে শুনতেই দেরি ছিল। মিষ্টি গলায় জানালেন, যাওয়া তো অবশ্যই হবে তবে আজও না কালও না। তার একটা জরুরি কাজ আছে, তাই দু’দিন পর রওনা হবেন। আর তিনি নিজেই নিয়ে যাবেন নাবিলাকে।
নাবিলার মুখে ফুটে উঠল এক নিখাদ বিজয়ের হাসি। মনে হচ্ছিল, কোনো যুদ্ধ জিতে গেল। হ্যাঁ যুদ্ধই তো, সামির ইয়াসিরের সাথে যুদ্ধ। মামণি যেখানে অনুমতি দিয়ে দিয়েছে সেখানে সে আর কী করবে? নাবিলা মিটিমিটি হেসে সামিরকে সুসংবাদ দিতে গেল। শুনে সে মুখ কালো করে ফেলল। জীবনের প্রতি আর কোনো আশা রইল না তার। তার এই অবস্থা দেখে নাবিলা হেসেই কুটিকুটি হলো। নাবিলা হাসছে, তারমানে ওর মন আর খারাপ নেই। বাহ, বেশ তো। এই নীরব যুদ্ধে সামিরও জয়ী হলো। নাবিলার মন খারাপের রেশ কাটাতে পেরেছে, ও মন খুলে হাসছে। সামিরের এইরকম বেহাল অবস্থা দেখে যদি নাবিলা সর্বক্ষণ হিহি করে হাসতে পারে তবে তার কোনো আপত্তি নেই মুখখানা বাংলার পাঁচের মত করে রাখতে!
অবশেষে নাবিলার মনটা একটু ঠিক হলো। এতদিন ধরে অকারণ এক অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসেছিল। কী যেন খুঁজে পাচ্ছিল না, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। নিজের বাড়ি যাওয়ার আনন্দেই বোধহয় ফের আগের মত উচ্ছ্বাস ওকে ঘিরে ধরল।
যাওয়ার আগেরদিন। সকালটা বেশ শান্তভাবেই শুরু হয়েছিল। নাবিলা মামণির সাথে বের হয়েছিল অন্বেষাদের বাড়ির উদ্দেশ্য। যাওয়ার আগে একবার দেখা করে আসবে।
ওরা যখন মোড়ের মাথায় পৌঁছাল, তখন রেশমার পরিচিত একজন এগিয়ে এলো। সেখানেই দুজন কথাবার্তা বলছিল। আশেপাশে নাবিলার চোখ হঠাৎ থমকে গেল। গলির মাথায় পরিচিত চায়ের দোকান, সবসময় ভরপুর থাকে আড্ডায়। আজও ব্যতিক্রম নয়। কয়েকজন ছেলেরা গল্পে মশগুল। আর তাদের মধ্যে সামিরও রয়েছে। সামিরের হাতের ওই উদ্ভট জিনিসটাও চোখ এড়াল না। নাবিলা মামণির দিকে তাকাল। তিনি তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন, গল্পে মশগুল। কিছুই খেয়াল করেননি।
যখন ইয়াসিরকে বাঁশ খাওয়ানোর সুযোগ আসে, তখন কি নাবিলা সেই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে পারে? সামির তো ওদের খেয়ালই করে নাই। সে এখন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডার জগতে ব্যস্ত। রেশমার সাথে পরিচিত উনার কথাবার্তা শেষ হতেই নাবিলা মুখ কালো করে ফেলল। ঠোঁট কামড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রেশমা অবাক হয়ে বললেন,
— “কি হলো মা? হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে গেলে কেনো? চলো, দেরি হয়ে যাবে।”
নাবিলা আর দেরি করল না। এই অপেক্ষাতেই ছিল। হাতের ইশারায় সামনের চায়ের দোকানটা দেখিয়ে দিল।
— “মামণি দেখেছ, ওখানে কে বসে আছে? ওই যে তোমার আদরের বাবু! ভদ্রলোক সেজে পড়াশোনার অজুহাতে কতো জ্ঞান দেয় আমাকে আর এখানে নিজে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের কাপে দুনিয়া উল্টে দিচ্ছে।”
রেশমা চোখ কুঁচকে সামনের দিকে তাকালেন। সত্যিই ওখানেই সামির, খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসছে, কথা বলছে। ওমা! আবার হাতে সিগারেটও আছে। নাবিলাকে কিছু বলতে হলো না, ওটা তিনি নিজেই দেখতে পেলেন। তিনি একমুহূর্ত দেরি না করে সোজা এগিয়ে গেলেন। পা টিপে টিপে ঝড়ের মতো ঢুকে পড়লেন চায়ের দোকানে।
— “এই সামির!”
মায়ের কণ্ঠস্বরে সামির চমকে উঠল, হাত থেকে কাপ প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে গেল, চোখ বড় বড় করে তাকাল মায়ের দিকে। মুহূর্তেই নজর গেল পাশে দাঁড়ানো নাবিলার দিকে, মুখে মুচকি হাসি। তখনই সামির হাতের সিগারেটটা ফেলে দিল আর মাথায় বাজ পড়ার মতো মনে হলো, “ঘরের শত্রুই বিভীষণ!”
মায়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে সামির তোতলাতে তোতলাতে বলল,
— “মা, আসলে আমি… আমি না… ইশরাক! ইশরাকই টেনে এনেছে আমাকে।”
পাশে বসা ইশরাক হতভম্ব। মুখ হাঁ হয়ে গেল,
— “আরে আমি? আমি নাকি টেনেছি?”
রেশমা চোখ কটমট করে বললেন,
— “হাতে কী ছিল? সিগারেট! সামির, তুই আজকাল এইসব ছাইপাশ খাচ্ছিস নাকি?”
সামির একেবারে থ হয়ে গেল। কাশি আটকাতে গলা খাঁকারি দিল, তাড়াতাড়ি বলল,
— “মা, আমি? না, না! এটা আমার না।”
রেশমা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— “তাহলে হাতে ধরেছিলি কেনো?”
সামির মরিয়া হয়ে বন্ধু ইশরাকের দিকে আঙুল তুলল,
— “মা, আসলে ইশরাকের। আমি তো শুধু ধরছিলাম, ধরতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম।”
ইশরাক চোখ কপালে তুলে বলল,
— “আরে ধুর! আমার তো হাতে তখন চা ছিল, সিগারেট তোর হাতে কেন গেল?”
রেশমা অনেকক্ষণ নীরবে তাকিয়ে রইলেন সামির আর ইশরাকের দিকে। বোঝাই যাচ্ছিল, দু’জনই ভেজাল পাকাচ্ছে। শেষমেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “সামির, তোর বাবাকে বলতে হচ্ছে।” সাথে সাথেই ইশরাকের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, “বন্ধু বিপথে গেলে তুমি কি সুপথে চলবা বাবা? মমতাজ আপাকেও বলতে হবে। দাঁড়াও, ফোন করি।”
নাবিলা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
— “থাক মামণি, কাউকে কিছু বলতে হবে না।”
রেশমা চোখ কুঁচকে বললেন,
— “তাহলে তুমি তো কিছু বলতে পারো এই পাজিটাকে? তোমার কাছে তো ওর সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছি আমি। মানুষ করার চেষ্টা করো।”
নাবিলার মুখ কালো হয়ে গেল,
— “আমার কথাই তো শোনে না।” সামির তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে ইশারায় নাবিলাকে চুপ করতে বলল। কিন্তু নাবিলা পাত্তা না দিয়ে বলে গেল, “আমি কিছু বলতে গেলেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়।”
রেশমা বললেন,
— “শোন বাবু, শেষবার সতর্ক করছি। আবার যদি তোকে এভাবে দেখি; হাতে সিগারেট, উল্টাপাল্টা কাজ, তাহলে আর আমার কিছু বলার নাই। আর ইশরাক, তোমাকেও বলছি। এগুলা কি ভালো অভ্যাস?”
ইশরাক আর সামির দুজনেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিল। না না, এটা একদম ভালো অভ্যাস না। খুব খারাপ, খুব বাজে। আশেপাশে লোকজনও তখন উৎসুক হয়ে তাকাচ্ছিল। রেশমা নাবিলাকে আসতে বলে নিজেও এগিয়ে এলেন। নাবিলার হাসি থামছিল না। পুরো দৃশ্যটা সে খুব মজা করে মন দিয়ে উপভোগ করেছে। সামিরের পাশে এসে খুবই শান্ত গলায় খোঁচা দিল,
— “পাপ কাজ সেরে এবার ধর্মের পথে আসো, বাবু। বয়স তো কম হলো না।”
— “তুমি-ই মাকে নিয়ে এসেছো, তাইনা? হুদাই এই কাজটা করলা। দরকার ছিল কোনো? আমার সাথে ঝগড়া করতে হলে, আমাকেই বলতে পারতে। মাঝখানে মাকে টানার কি দরকার ছিল? ঠিক আছে, যাও এখন। ঝগড়ায় তুমি জিতছো।”
নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে চুপ করে রইল। উত্তর না দিয়ে শুধু এমন ভঙ্গি করল যে মুখে না বললেও তার চোখ-মুখের ভাবই সব বলে দিচ্ছে। তারপর চলে গেল। যা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। যেমন কর্ম, তেমন ফল। নাবিলা চলে যাওয়ার পর ইশরাক অসহায়তার মিশ্রণে বিড়বিড় করে বলল,
— “ভায়া, মাইয়া মানুষের সামনে টিকাই তো থাকা মুশকিল। আমি তো জীবনেও বিয়ে করব না।”
— “করিস না।”
— “এরা এমন প্রজাতির প্রাণী ক্যান?”
— “এরা কোনো জাতের প্রাণীর মধ্যেই পড়েনা। ভাই শোন আমি তো বলছি, শান্তিতে থাকতে চাইলে বিয়ে করিস না। নিজের ইচ্ছা, স্বাধীনতা, আর জীবন সব আমার মত হয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছিস, জীবন আমার অথচ নিয়ন্ত্রণ কে করছে? কতদূর থেকে দাঁড়িয়ে কলকাঠি নাড়ছে? আজ মাকে নিয়ে এসেছে, দুদিন পর আমার চৌদ্দগুষ্টিকে নিয়ে আসবে। সুখে আছিস, সুখেই থাকার চেষ্টা কর। হুদাই দৌড়াইতে দৌড়াইতে ভূতের কিলানি খাইতে যাস না।” সামির বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে সিরিয়াস ভাবে কথা খানা বলল। ইশরাকও বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে সায় দিল।
পরদিন সকাল সকাল রেশমা নাবিলাকে নিয়ে রওনা দিলেন। বাড়িতে রয়ে গেল বাপ-ব্যাটা। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর অন্বেষা ফোন করল সামিরকে। সামির ফোন তুলতেই শুরু হলো দীর্ঘ কথোপকথন। তবে সাধারণ ভাই-বোনের কথাবার্তা নয়। কথার বিষয়? তার নিজের ভাই। হ্যাঁ ঠিক, ভাই! এবং আরো মারাত্মক আঁতকে উঠার মত বিষয় হচ্ছে, অন্বেষা চাইছে নিজের ভাইকে খু’ন করার পরামর্শ! সব শুনে সামির হাঁ হয়ে গেল। কী বউ, কী প্রেমিকা মাইরি? বড় ভাই প্রেম, বিয়ে মেনে নিচ্ছে না বলে সোজা খু’ন করার পরিকল্পনা? বাহবা দিতে হয়। শাহিদ ভাইয়ের কপালের কথা ভেবে নিজের কপালের জন্য আফসোস হচ্ছে। আহা তার বউটা… পাত্তাই দিচ্ছে না।
আরো হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, সামির নিজের মনে ভেবে কুল পাচ্ছে না, সে মাস্তান নাকি? নাকি সিনেমার মতো সুপারি নিয়ে খু’ন করে? ঘরের মহিলাগুলো তাকে কি মনে করছে? সে কি ধূর্ত মাস্টারমাইন্ড?
সামির অন্বেষাকে ধামকিধমকি দিয়ে থামাতে চাইল। কিন্তু অন্বেষার প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ উল্টো। থামল না বরং কান্নার ঝড় তুলল। এখন অন্বেষার একমাত্র লক্ষ্য, শ্বশুরবাড়ি যাওয়া। বহুবছর বাপের বাড়ি থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছে। প্রতিদিনের সকাল, প্রতিদিনের রাত, সবই একই রুটিনে আটকানো। তাই এখন পরিবর্তনের তীব্র প্রয়োজন। কিন্তু বাংলা সিনেমার বড় ভাইদের মত রায়হান সব আটকে দিয়েছে।
সামির রায়হানের সঙ্গে কথা বলতে চাইল, এখন তাকে পাওয়া যাবে না। সন্ধ্যার পর যেতে হবে। মাঝের এই ফাঁকা সময়টুকু কাটাতে সামিরের অনেক সময় লাগল। বাবাও বাড়িতে নেই। ঘরে একা থাকার অভ্যাস আছে তবুও যে নিঃসঙ্গতা অনুভূত হচ্ছে, তা শুধু শূন্যতার নয় বরং কিছুটা অদ্ভুত উদাসীনতারও। নিজের দেশে, নিজের এলাকায়, নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে বসেই এই অবস্থা; বাহিরে গেলে তখন কী করবে? কাটাবে কীভাবে দীর্ঘ বছরটা?
.
রায়হানকে সন্ধ্যার দিকে পাওয়া গেল। সামির বাড়ির গেটে আসতেই দেখতে পেল। পাশে কামিনীও ছিল। অভ্যাসবশত সামির ভাবি সম্বোধন করে সালাম দিল কিন্তু কামিনী চোখ সরিয়ে নিল, কিছু বলল না। সে রায়হানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
— “ভাইয়া কি বাইরে যাচ্ছো?”
— “না, এলাম মাত্র।”
সামির বলল,
— “তাহলে চলো। কথা আছে।”
দু’জন ঘরে এলো। সামির মনে মনে ইতিমধ্যেই সবকিছু সাজিয়ে রেখেছিল, কী কী বলবে। গভীর শ্বাস নিয়ে প্রথমেই বলল,
— “ভাইয়া, অন্বেষা তোমাকে খু’ন করতে চায়।”
রায়হান চেয়ারটা একটু এগিয়ে বসে হেসে উত্তর দিল,
— “সেটা তো আমি জানি। আমাকে ২৪ ঘন্টায় ২৪ বার বলে। নতুন কী?”
— “তাহলে তুমি মেনে নিচ্ছো না কেনো?”
রায়হান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— “এটা কি মেনে নেওয়ার মতো বিষয় হলো? তারমধ্যে পালিয়ে বিয়ে করে আরেক আকাম করল। এই শালা শাহিদ গর্দভটা জীবনেও ভালো হইলো না। প্রেমও করল গোপনে, বিয়েও। এসব মানতে পারব না।”
— “তোমার বোন আমারে পাগল বানাচ্ছে। ভাই, আমার কি দোষ?”
রায়হান হেসে কাঁধ উঁচু করল,
— “পাগলের পাগলামিতে তাল দিস ক্যান?”
সামির গম্ভীর মুখে রায়হানের দিকে তাকাল,
— “তোমাদের মধ্যে যা ঝামেলা হয়েছে তা ভুলে যাও। ওরা ওদের মতো থাকুক। দেখো, অনেক বছর প্রেম করেছে। তখন কিন্তু তোমার সাথে শাহিদ ভাইয়ের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল। এই বাড়িতে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়েই ওদের প্রেম হয়েছে।”
রায়হান কপাল ভাঁজ ফেলে বলল,
— “হুম। আমার নাকের ডগায় বসে প্রেম করল, আমিই জানতে পারলাম না।”
— “তাহলে দেখো, মূল দোষী কিন্তু তুমি হইলা। এখন সব মেনে নিয়ে অপরাধবোধ থেকে নিজেকে মুক্তি দাও।”
— “আমার দোষ কেনো?”
— “কারণ যত দোষ নন্দ ঘোষ।”
— “ফালতু বকিস না সামির। তুই বাচ্চা ছেলে, সবকিছু বুঝবি না।”
— “ভাই প্লিজ, আমারে বাচ্চা বইলো না।”
রায়হান হো হো করে হেসে উঠল,
— “ওহ হ্যাঁ, তুই তো এখন আর বাচ্চা নেই। বিয়ে করেছিস। যেকোনো মুহূর্তে বাচ্চার বাপ হয়ে যাবি।”
সামির চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে বলল,
— “কথা ঘুরিও না। আমার কথা শোনো।”
— “শুনলাম তো। ভেবে দেখি। অনেক বিষয়বস্তু আছে, সব যদি মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারি তবেই মেনে নিব।”
সামির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ধরে রেখে বলল,
— “ঠিক আছে। অঙ্ক না মেলাতে পারলেন আমাকে বইলো। আমি অঙ্কে যথেষ্ট ভালো।”
— “এই অঙ্ক সেই অঙ্ক না রে পাগলা, এই অঙ্ক হচ্ছে সম্পর্কের অঙ্ক।”
সামিরের নিশ্চিত মনে হলো, রায়হান সম্পর্কটা মেনে নিবে। অন্তত মুখাভিনয় আর কথার ছন্দে তো তাই মনে হয়। এতদিনে মেনেও নিয়েছে বোধহয়। তবে হ্যাঁ, ইগোটা এখনও তাকে কিছুটা চেপে রেখেছে তাই মুখে সরাসরি স্বীকার করতে পারছে না। সে কারণেই সম্পর্কের অঙ্কের হিসাব কষতে বসে পড়েছে।
এই বাড়ির রাতটা আজ বেশিই নিস্তব্ধ। সামির টিভির সামনে বসে, পর্দায় ফুটবল খেলা চলছে। কিন্তু কোনোকিছুতেই মন নেই তার। শূন্য দৃষ্টিতে আঁধার ঘর জুড়ে আলো-ছায়ার নাচন দেখছে শুধু।
এমন সময় সাখাওয়াত হোসেন এলেন। বাবার সাথে গল্পগুজব করে একটু ভালো সময় কাটল। হঠাৎ সাখাওয়াত হোসেনের ইচ্ছে হলো ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরে ছোটখাটো কিছু করার। গলায় আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে বললেন,
— “চল, আজ একটু আমরা রান্না করি।”
— “মা তো সব আগেই করে রেখে গেছে।”
— “করুক। আমরা আমাদেরটা করে নিই।”
সামির হেসে বলল,
— “মা যদি শুনে তুমি তার সাজানো সংসারে হাত দিয়েছো, তাহলেই খতম।”
সাখাওয়াত হোসেন হাসলেন,
— “আরে জানবে না, আয় তো।”
বাবার সাথে হাসাহাসিও হলো, আবার কাজও হলো। কতদিন পর এমন একটা মুহূর্ত এলো! আগে তো এ রকম সময় প্রায়ই আসত, এখন কেন আসে না? হয়তো দিনকাল বদলে গেছে, হয়তো সে নিজেও অনেক বড় হয়ে গেছে কিংবা বাবার ব্যস্ততা বেড়েছে। যেটাই হোক না কেন, তবে এই সামান্য হাসি-খুশির মুহূর্তটা বুক ভরে অনুভব করল সামির। আজকাল সবকিছু এত ভালো লাগছে কেনো? কিছুদিন বাদে চলে যাবে বলে নাকি মনের মধ্যে আটকে রাখা ভালোলাগার দরজা খুলে দিয়েছে বলে?
.
.
.
চলবে……
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-২৬]
~আফিয়া আফরিন
রায়হান অবশেষে রাজি হয়েছে। অন্বেষা খুশিতে অবাক হতেও ভুলে গেল। বহুদিনের আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা আজ মুক্তি পেয়েছে। সকাল সকাল খবরটা হাতে পেয়ে এমন খুশি হলো যে, মনে হলো আকাশের চাঁদ নামিয়ে হাতে তুলে দিয়েছে কেউ। নাচতে নাচতে ফোনটা হাতে নিয়ে অর্ধেক বরকে খবর দিল। পারিবারিক আলোচনা হচ্ছে, শাহিদের পরিবারের সাথেও শিগগির বসতে হবে। সকলের কথার ফাঁকে অন্বেষা সামিরকে একটা ধন্যবাদ জানাল। সামির শুকনো মুখে হালকা ব্যঙ্গের সুরে বলল,
— “থ্যাংকসের দরকার নাই। বিয়েতে দাওয়াত দিয়েন, ভাবি।”
অন্বেষা হেসে উঠল,
— “আমিও ভাবি?”
— “শাহিদ ভাইকে তো ছোটবেলা থেকে ভাই বলে ডাকি। তো তুই ভাবি, বোন; সবই হবি।”
অন্বেষা মাথা নাড়ল,
— “নাবিলাকে বলেছিস? কবে আসবে কিছু বলেছে? তিনদিন তো হয়ে গেল।”
সামির কাঁধ ঝাঁকাল,
— “এত তাড়াতাড়ি আসবে না।”
— “আচ্ছা থাকুক আর কদিন। আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকলেই হলো।”
শুধু অন্বেষা নয়, বাড়ির বাকি সবাইও বেশ খুশি। সামির স্বস্তি পেল। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, বাড়ির সবাইকে একসাথে মিলেমিশে থাকতে। হুট করে কেউ মন খারাপ করলে, অভিমান করলে, ভালো দেখায় না; কারো কাছেই ভালো লাগে না। অন্বেষাকে এতদিন পরে হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগছে। অনেকদিন হলো মেয়েটা মনমরা হয়ে ছিল।
বড় আব্বু, রায়হান ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করে সামির ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। ইদানীং শেষ কয়েকটা ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই নাবিলার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। ওরা প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিল, “নাবিলা কবে আসবে?” “এতদিন ক্লাস বাদ দিয়ে কী করছে?”
সামির ধীরে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল। ওরা এখন সবাই সামিরের কথা জানে… মানে, নাবিলার যে বিয়ে হয়েছে এবং সেটা সামিরের সাথেই হয়েছে সেটা আর অজানা নেই। মূলত আদনানের ওই ঘটনার পর নাবিলা নিজেই সবটা বলেছিল সবাইকে।
.
গত কয়েকদিনের বেশিরভাগ সময়ই সামির কাটিয়েছে অন্বেষাদের বাড়িতে। বিয়ের দিনক্ষণ সামনের মাসের প্রথম শুক্রবার ঠিক করা হয়েছে। সময় যত এগিয়ে আসছে, ততই নিত্যনতুন আলোচনা জমে উঠছে। আজও ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিল কামিনী আর অন্বেষা। ওদের যাঁতাকলে ফেঁসে গেছে রায়হান, আয়ান আর সামির। অবস্থা এমন, উঠে চলে যেতেও পারছে না আবার এতসব কথাবার্তা হজম করাও কঠিন। আলোচনার মূল বিষয় সেই চিরন্তন নারীসমস্যা, গায়ে হলুদের শাড়ি কোনটা হবে? বিয়ের দিন কোনটা পড়বে? বৌভাত, মেহেন্দি, রিসেপশনের রঙের সঙ্গে মিলবে তো? শাড়ি হবে নাকি লেহেঙ্গা? তর্ক-বিতর্ক চলছে জমজমাট। মাঝখানে ভিডিও কলে নাবিলাকেও যুক্ত করে নিয়েছে। তিন মাথা এক হয়ে বিশ্লেষণ করছে কোনটা কেমন দেখাবে, কোনটা ছবি তোলায় ভালো আসবে। সামির চুপচাপ বসে ভাবছে কামিনীর সঙ্গে নাবিলার এত ভাব হলো কবে? আর কেনই-বা হলো? রায়হান তো এরমধ্যেই বিরক্তির চরমে। হঠাৎ ধমক দিয়ে বলল,
— “হয় এসব আলোচনা নিজেদের ঘরে গিয়ে কর, নয়তো বিয়েটাই ক্যান্সেল!”
অন্বেষা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। বিয়েশাদী কিছুতেই আর ক্যান্সেল করা যাবে না। একবার খালি শ্বশুরবাড়ি যাক, জিন্দেগী ভাজা ভাজা হয়ে গেলেও আর বাপের বাড়ি আসবে না। অন্বেষা ফোঁস ফোঁস করে বলল,
— “কথায় কথায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করো কেন ভাইয়া? বিয়ে ক্যান্সেল মানে কী? বিয়ে তো আমি আগেই করেছি। তোমরা জাস্ট বিদায় দিবা!”
রায়হান মুখ খোলার আগেই কামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
— “চলো তো। এই বোকাচন্দ্র এসবের কিছু বোঝে নাকি? নিজের বিয়েতে কী করেছিল মনে আছে? শেরওয়ানি না পরে নরমাল পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চলে এলো। পারলে বোধহয় গালি গায়ে বিয়ে করতে চলে আসতো, চক্ষুলজ্জা ছিল বলে পারে নাই।” কথাটা বলে সে অন্বেষার হাত টেনে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রায়হান হেসে মাথা নাড়ল,
— “দ্যাখ আয়ান, এইডাই হইলো মধুচন্দ্রিমার আগের জ্বালা। এখন তো শাড়ি-লেহেঙ্গা, মালা আর পাউডার, ফাউন্ডেশন নিয়া মিটিং বসাইতেছে। এর পর শুরু হইবো আসল মহাযুদ্ধ। গলায় মালা পড়লে টের পাবি আসলে মালা পড়ল নাকি অন্যকিছু?”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে মজা করে বলল,
— “তাহলে আমি এখনো বেঁচে আছি কারণ আমার ঘাড়ে মালা পড়েনি, তাই তো?”
রায়হান হেসে উঠল,
— “একদম! বিয়ে না করলেও জ্বালা, করলেও জ্বালা।”
সামির হেসে তার মেলাল,
— “বাবা সবসময় বলে, বিয়ে হচ্ছে দিল্লিকা লাড্ডুর মত। না খেলে তো মাস্ট পস্তাতে হবেই আর খেলে তো কথাই নাই। তখন বুঝবা লাড্ডুটা মিষ্টি না বিষমিষ্টি ছিল।”
রায়হান হো হো করে হাসল,
— “সত্যি কথা। আগে মিষ্টি, পরে চিবাইতে চিবাইতে দাঁত খুইলা যায় ভাই।”
আয়ান চোখ বড় বড় করে তাকাল দু’ভাইয়ের দিকে। বলল,
— “আমি তবে এখনও নিরাপদ দূরত্বেই আছি। বাই দা ওয়ে, আমাকে অবলা পেয়ে দু’জন মিলে ভয় দেখাচ্ছো নাকি?”
সামির পাশ থেকে বলল,
— “ভয় নারে ভাই। নিজেই বোঝার চেষ্টা করতেছি। বিয়ে না করলে গল্প হয়, করলে উপন্যাস হয়। গল্পের শেষ থাকে, কিন্তু উপন্যাসের শেষ পেতে পেতে বুড়ো হওয়া লাগে।”
তিনজনেই হেসে উঠল। রায়হান সামিরের পিঠ চাপড়ে হো হো করে উঠল,
— “আরেব্বাস! বিদেশ-ভুঁইয়ে যাবার আগেই সামির দেখি বিয়ের উপরে পিএইচডি কইরা ফেলছে। চালাইয়া যা, চালাইয়া যা! শোন আয়ান… নেহ, সামিররে নিজের গুরু বানা। আমারও মনে হয়, মাঝেমাঝে টুকটাক শিক্ষা নিতে হবে।”
সামির মৃদু হেসে কাঁধ ঝাঁকাল। সে এখনও নিজের বিয়ের জটলা পুরোপুরি খুলতে পারল না আবার আরেকজনের গুরু হবে? কী দরকার?
.
নাবিলাকে ছেড়ে অন্বেষার একদম কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করছিল না। দু’দিন অপেক্ষা করল, হয়তো ও আসবে। কিন্তু নাবিলা আসলো না। চাচিও ওর সঙ্গে থেকে যাচ্ছে। যার কারণে এইদিকে চিন্তার কারণ নেই। আর সেই কারণেই ওখান থেকে তাদের ছাড়ছে না। নাবিলা জানাল, অনেকদিন পর এসেছে আরও কিছুদিন বাসায় থাকবে। মা-বাবা ছাড়তে চাইছে না। তবে কথা দিয়েছে, অনুষ্ঠানের আগেই চলে আসবে।
নাবিলার মন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরা। ওদের সঙ্গে আনন্দ করতে ইচ্ছে করছে, হাসি-গল্পে মেতে থাকতে মন চাচ্ছে। আবার এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না, এটাও সত্যি। মামণি সেদিন বলেছিলেন,
—“থাকুক তো, বাপ-ব্যাটা একা একা কয়দিন। বউ ছাড়া থেকে দেখুক দিন-দুনিয়া কেমন লাগে। সামনে থাকলে তো এরা আবার পাত্তা দিতে জানে না।”
নাবিলা উত্তরে হেসেছিল। কথা সত্য, একশ শতাংশ। সামিরের সাথে কথা হয়, তবে বেশিরভাগ রাতেই। দিনে সময় পাওয়া মুশকিল, সবাই ব্যস্ত। আর রাতটাই ওর কাছে কথা বলার সেরা সময়। চারপাশ নিস্তব্ধ, ব্যস্ত দিনের পরে স্বস্তি আসে, আবেগের গভীরতা থাকে, আরাম আরাম একটা মুহূর্ত তৈরি হয়; আর তখনই তারা কথোপকথনে সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যদিও প্রেম ভালোবাসার কথা না, আবেগ-অনুভূতির কথা না, সারাদিনের অতি সাধারণ কথোপকথন। ওইটাই অনেক… ওইটুকুই ক’জন পায়? ক’জনের ভাগ্যে জোটে প্রিয় মানুষের এই সামান্য সময়টুকু।
—
আজ সকাল থেকে একটানা দুপুর পর্যন্ত সামিরের ফোনটা বিশ্রাম পেল না। একেরপর এক কল; কখনো রায়হান, কখনো আয়ান, আবার কখনো অন্বেষা। ফোনটা টেবিলে রাখা মাত্রই কেঁপে উঠছে, স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠছে, আবার নিভে যাচ্ছে। কিন্তু সামির একবারও রিসিভ করল না। ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছিল। কারণ আছে, মুসিবতের কারণ। গতরাতে অন্বেষা হুড়মুড় করে কথার মাঝে বলেছিল, কাল সকালে তারা শপিংয়ে যাচ্ছে। সামিরও যেন ওদের সাথে যায়। কারণ সকালে রায়হান, আয়ান কেউ বাড়িতে থাকবে না। তারা শপিং করতে গেলে সঙ্গে তো একজন ছেলেমানুষ প্রয়োজন। বলির পাঁঠা বানাল সামিরকে। সে অবশ্য তখনই জানিয়ে দিয়েছিল,
— “আমার ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে কাল। ক্লাস বাদ দিয়ে তোদের সাথে যাওয়া সম্ভব না।”
সকাল সকাল সামির যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা সৈনিকের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। জানত, আজ বাড়িতে থাকলে আর রক্ষা নেই। অন্বেষা তো ঢাল-তলোয়ার নিয়ে আসবেই। সাথে রায়হান আর আয়ানও মহিলা সমাজের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য তাকে টেনে নিয়ে যাবে শপিং-যাত্রায়। তাই ভোরবেলাতেই গা ঢাকা দিল। ফোন একেরপর এক বেজে উঠছে, কিন্তু সামিরের ফোন সাইলেন্ট মোডে। মনে মনে হাসছিল, “বাজুক, বাজতেই থাকুক, আমি ধরছি না।”
দিনভর বাইরে ঘুরেফিরে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে সময় কাটাল। ভাবল, এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা বিরক্ত হয়ে নিজেরাই গিয়ে কেনাকাটা করে ফেলেছে। তাই সন্ধ্যার পর আরাম করে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরল। মনে মনে তৈরি হয়েই এসেছে, অন্বেষার ঝারি খাওয়া আজ অবধারিত। এমন একটা ভাব নিয়ে ভেতরে গেল, যেন সামরিক কোর্ট মার্শালের সামনে দাঁড়াবে। কিন্তু বিস্ময়টা ঘটল তখনই। ঝারি তো নয়ই, বরং অন্বেষা একগাল হেসে এগিয়ে এল। সেই হাসিতে একটুখানি দুষ্টুমি, একটুখানি ষড়যন্ত্রের ঝিলিক।
— “এই তো সামির! এতক্ষণে আসার সময় হলো তোর? চল চল, এখনই বের হব।”
সামির স্তব্ধ। মুখে ফিক্সড হাসি আনার চেষ্টা করল কিন্তু মনে মনে কেবলই গালি দিচ্ছিল নিজের ভাগ্যকে। ভেবেছিল ঝারি খেয়ে মুক্তি পাবে, কিন্তু হায় এখানে তো অন্য কাহিনী…
সামির ভেবেছিল, আজকের দিনটা মোটামুটি এখানেই শেষ। কোনোভাবে নিজের পেটব্যথা, মাথাব্যথা, পা-ব্যথা না হয় শরীর ব্যথার অযুহাত দিয়ে ঝামেলা এড়িয়ে যাবে। কিন্তু তার জন্য যে বাড়তি “চমক” অপেক্ষা করছে, তা আঁচই করতে পারেনি।
হঠাৎই চোখে পড়ল, নিজের মাকে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, রেশমা ছেলের এমন করুন অবস্থা নিজের চোখে দেখেও কিছু বললেন না। বোধহয় সামিরককে দেখেননি এমন ভাব। চারপাশে হৈচৈ, লিস্ট, কে কোথায় যাবে, কোন দোকান থেকে কী কিনতে হবে; এইসব নিয়েই তিনি ব্যস্ত। ছেলেকে স্রেফ বাতাসের মতো পাশ কাটিয়ে গেলেন।
সামির হতভম্ব। এইটা কী হলো? সে কি বাইরে থেকে ভাড়া করা ড্রাইভার? কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।
আচ্ছা থাক, লাগবে না পাত্তা। কিন্তু মা এসেছে, সাথে কি নাবিলাও এসেছে? সামির আশেপাশে তাকাতেই আরেকটা ধাক্কা। নাবিলা… ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে, ভঙ্গিটাই এমন যে পুরো দৃশ্যটার পরিচালক ও। অথচ একবারও জানাল না, আজ আসবে। চোখাচোখি হতেই নাবিলা মৃদু হাসি দিল। সামিরের বুকের ভেতর ধপাস করে কিছু একটা পড়ল। নাবিলার হাসিটা চোখে লাগল। সত্যি, আজ ওকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মনে হলো সব রঙ বেরঙের আলো শুধু নাবিলার দিকেই ছুটে যাচ্ছে, বাকিরা সব স্রেফ ব্যাকগ্রাউন্ড।
রায়হান আর আয়ান ভেবেছিল, বাড়িতে ঢুকে তারা নিষ্পত্তি পাবে। কিন্তু না, তাদের ভাগ্যে তা লেখা নাই। সামিরের মতো তারাও একেবারে বোকা বনে গেল। দেখল, ঘরে আগুন জ্বলছে; মানে শপিং-প্রস্তুতির আগুন। ব্যাগ, লিস্ট, প্ল্যান, কনফার্মেশন, সবকিছু চলতেছে এমন শৃঙ্খলায়, যে আগামীকাল যুদ্ধ আর আজ সেনাদের ট্রেনিং। তারা না গেলেই বা কী? একবার চেষ্টা করেছিল। রায়হান গলা খাঁকারি দিয়ে মিনমিন করে বলল,
— “আমি কিন্তু বলতেছি, আমাদের এভাবে টানাটানি করলে কিন্তু বিয়েশাদি ক্যান্সেল…”
কথা শেষ করার আগেই একঝলক চোখরাঙানি। তাদের মা চাচিদের দৃষ্টি একই সাথে এক জায়গায় গিয়ে আঘাত করল। সেই দৃষ্টির মানে খুব স্পষ্ট, “তোরা যাবি না, তোদের বাপ যাবে।”
রায়হান তোতলাতে তোতলাতে সামিরের দিকে তাকাল,
— “এরা আমাদের নিয়ে কি শুরু করলো ভাই?”
আয়ান মাথা ঝাঁকাল,
— “এমন বেকায়দায় পড়তে হবে জানলে বাড়িতেই আসতাম না।”
সামির বলল,
— “বেচারা শাহিদ ভাইয়ের কপাল খুব খারাপ দেখা যাচ্ছে। এমন ষন্ডা-গুন্ডার মত বউ নিয়ে ওই আলাভোলা সংসার করবে কীভাবে, আল্লাহ ভালো জানে। তারচেয়ে আমার বউ ভালো আছে। তখন থেকেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। টু শব্দ করে নাই।”
মেয়েদের স্লোগান একসাথে উঠল,
— “চলোওওওওও… চলোওওওওও…”
অগত্যা তিন ভাইকে একই ট্র্যাপে পড়তে হলো। হাস্যকর অবস্থা, মেয়েদের টিম বুলডোজার হয়ে গেছে আর তারা তিনজন একেবারে রোডের ইট-খোয়া।
.
ওরা গাড়ি করে বের হলো বসুন্ধরা সিটির দিকে। মেয়েগুলো গাড়ির মধ্যেই হৈহৈ শুরু করে দিল। রেশমা আর ইয়াসমিন দুই জা গল্পে মশগুল। আর বাকি তিনজন ওদের গল্পে হতবিহ্বল হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। মল-এ ঢুকতেই মেয়েরা উল্লাসে “আহা, আহা” করে ছুটে গেল।
রায়হান বিরক্তিতে কটমট করে তাকাল। ওরা প্রথমেই শাড়ির দোকানে এলো। অন্বেষা একটার পর একটা শাড়ি হাতে নিল, পরলো, আবার রেখে দিয়ে অন্যটা নিল। নাবিলা শুধু ওদেরকেই দেখছিল। ওর শাড়ির দিকে এত ঝোঁক নেই। সাধারণ কুর্তি, কামিজ, থ্রি-পিসেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শাড়ি পড়তেও পারে না, শখও নেই। সামির দূর থেকে নাবিলার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর হাসি, চোখের চাহনি, চলাফেরা সবই সামিরের দৃষ্টি আটকে রাখছিল। তখনই চোখ গেল একটা শাড়ির দিকে; হালকা গোলাপি রঙের, রেশমি ঝলক। সামিরের মনে হলো, এটা নাবিলাকে অসম্ভব মানাবে।
কিন্তু আয়হায়, সেই শাড়ি কামিনীর হাতে! ও নিজের গায়ে জড়িয়ে আয়নায় দেখছে। সামির দূর থেকে মনে মনে বলল, “না না, এই শাড়িটা তোমার জন্য নয়, এটা তোমার রং নয়। দয়া করে রেখে দাও।” তৎক্ষণাৎ রায়হান এগিয়ে গিয়ে কামিনীকে একটা লাল শাড়ি এগিয়ে দিল।
— “লাল ছাড়া কি আর কোনো রং চোখে পড়ে না তোমার?” কামিনী অভিমান করল।
রায়হান হেসে উত্তর দিল,
— “পড়ে তো, কিন্তু তোমার জন্য লালের বাইরে আর কিছু দেখি না।”
কথাটা শোনার পর কামিনী গোলাপি শাড়িটা ছেড়ে দিল আর সামির বুক ভরে নিঃশ্বাস ফেলল, — “বাঁচলাম!”
কিছুক্ষণ পর, সবাই যখন ব্যস্ত অন্য শাড়ি পছন্দ করতে, সামির নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে গোলাপি শাড়িটা কিনে নিল। কাউকে বুঝতে না দিয়ে সরাসরি গাড়িতে গিয়ে রেখে এলো। মনে হলো, নিজের বুকের ভেতরে একটা গোপন সুখ জমা করে রাখল। তারপর উপরে এলো। সবাই এখন শাড়ি কেনা শেষ করে গয়নার দোকানের দিকে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় সিঁড়িতে একটু পিছিয়ে পড়ল নাবিলা। আর সেই সুযোগে সামির তাকে একা পেল। পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “আজ আসবে বলোনি কেনো?”
নাবিলা সামিরের উপস্থিতি আগে থেকেই টের পেয়েছিল। তাই ঘুরে না তাকিয়েই বলল,
— “আমার আসা-যাওয়ায় কার কি আসে যায়? আমি তো কোনো সেলিব্রেটি না যে আগে থেকে বলতে হবে। আমার আসা তেমন জরুরিও না।”
সামির দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিল। বলল,
— “এটা তুমি ঠিকই বলেছ।”
নাবিলা ক্লান্ত স্বরে বলল,
— “হাতটা ধরেন তো, পা ব্যথা হয়ে গেছে।”
সামির এগিয়ে এসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করল,
— “লিফটে গেলে না কেনো?”
— “অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমার পায়ের গতি তারচেয়ে বেশি।”
— “এক্সিলেটর ছিল।”
— “ওটা ভয় লাগে।”
সামির এবার নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “পা বেশি ব্যথা করেছে?”
— “দেখতে পাচ্ছেন না? আর এক কদমও উঠতে পারছি না।”
সামির গমগমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “কোলে নেবো?”
এইবার নাবিলা সরাসরি সামিরের চোখের দিকে তাকাল। সামির সম্পূর্ণ নির্বিকার। নাবিলা ভেবেছিল, হয়তো রসিকতা। তাই না ভেবেই বলল,
— “আচ্ছা।”
চারপাশে সিঁড়িতে ভিড় খুব একটা ছিল না। মানুষজন থাকলেও এইদিকে নজর দিবে না। সবারই ব্যস্ততা। আর সেই ফাঁকেই সামির সত্যিই নাবিলাকে কোলে তুলে নিল।
নাবিলা থমকে গেল। চোখ দুটো বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। ওর ঠোঁট নড়ে উঠল কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। ভিড়ের মাঝে, লোকজনের সামনে, সামির এমন কিছু করবে; তা নাবিলা একেবারেই ভাবতে পারেনি। মুখ শুকিয়ে গেল, শ্বাস আটকে এলো। চাপা গলায় বলল,
— “এটা কি করছেন?”
সামির নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল,
— “তুমিই তো বললে।”
— “আরে আমি তো ফাজলামি করেছি!”
— “ওহ আচ্ছা, আমি তা তো বুঝি নাই।”
— “নামান এক্ষুনি।”
সামির একটুও তাড়াহুড়ো না করে নাবিলাকে আরও তিনতলা পর্যন্ত নিয়ে এলো। তারপর নামিয়ে দিল। গন্তব্য এখানেই। নাবিলা চারপাশে তাকিয়ে থাকল অসহায় দৃষ্টিতে; কেউ কিছু দেখল কি না, কেউ বুঝল কি না! মুখ লাল হয়ে উঠল লজ্জা আর বিরক্তির মিশ্রণে। সামির মুচকি হেসে বলল,
— “এত দেখার কিছু নাই। মানুষজনের এত সময় নাই যে আরেকজনের পার্সোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করবে।”
নাবিলা ক্ষীণস্বরে ফিসফিস করে উঠল,
— “আপনি কি করলেন এটা!”
সামির শার্টের হাতা গুটিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,
— “তুমিই বলেছিলে। আমার কি দোষ?”
তারপর কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সোজা সামনে হাঁটতে শুরু করল। নাবিলা মুখ কালো করে, চোখে ক্ষোভ-লজ্জা-হতবাকের মিশ্রণ নিয়ে পিছু পিছু এলো। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আর একটা শব্দও দু’জনের মুখ থেকে বের হলো না। নাবিলা লজ্জায় চুপ করে রইল আর সামির ওকে অস্বস্তিতে ফেলবে না বলে।
.
.
.
চলবে……
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]