প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩০

0
14

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩০]
~আফিয়া আফরিন

সামির গত দু’দিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেছে নাবিলার সাথে কথা বলার জন্য। কখনো মা, কখনো অন্বেষা, কখনো আয়ান, আবার একবার রায়হান ভাইয়াকে পর্যন্ত বলেছিল, “নাবিলার সাথে একটু কথা বলাও।” কিন্তু প্রতিবারই নাবিলা ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছে। তবে এড়িয়ে চলার খেলাটা ভোরের শান্ত সকালেই বোধহয় হঠাৎ ভাঙতে চলল। নাবিলা বাড়িতে ফিরে আসতেই দেখল ডাইনিং টেবিলে সকালের নাস্তায় ব্যস্ত মামণি-বাবা। নাবিলা অপ্রস্তুতবোধ করে সরে পড়তে চেয়েছিল তার আগেই সাখাওয়াত হোসেন মৃদু স্বরে বললেন,
— “আম্মা, সামির ফোন করেছিল একটু আগে। অনেকক্ষণ কথাবার্তা বললাম। তোমার সাথে নাকি কোনোভাবেই কথা হচ্ছে না? রাগ করেছো নাকি মা? যাও, রাগ-অভিমান কোরো না। নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নাও। আমাকে ফোন করে তোমাকেই চাচ্ছিল। তখন তো তুমি ছিলে না। আমি এখন ফোন দিয়ে দিই, মা?”

সম্মানিত শ্বশুড়ের মুখে এমন কথা শুনেই নাবিলার গাল লাল হয়ে উঠল। বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করতে লাগল। এমন লজ্জা! নিজের বাবার কাছেও ফোন করেছে সামির? ছিঃ ছিঃ, আর কত কাহিনী দেখতে হবে নাবিলাকে? নাহ, যাইহোক সামিরের সাথে ও কথা বলবে না। শশুর মশাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আত্মসংবরণ হারিয়ে ফেলল। কোনোমতে ঠোঁট নাড়ল,
— “বাবা… আমি কথা বলছি।”

সাখাওয়াত হোসেন খুশি হয়ে উঠে বললেন,
— “হ্যাঁ হ্যাঁ, এক্ষুনি বলো। রাগ করে থেকো না মা। এখন তো কাছাকাছি নাই যে, রাগ ভাঙানোর সুযোগ পাবে। শোনো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা তো খুব নাজুক। একে অন্যকে এড়িয়ে চললে চলে? কথা বলো, তোমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ছেলেটা যে কত কষ্ট পাচ্ছে, শুনেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।”
নাবিলার কানে এইবার গরম ধোঁয়া উঠতে লাগল। কী ভয়ংকর বিব্রতকর মুহূর্ত! আর একমুহূর্তও দাঁড়াতে পারল না। একরকম দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে এখনো বাবার হাসিমাখা কণ্ঠ ভেসে আসছে, ভেতরে নাবিলার বুকের ভেতর ঢাকের মতো বাজছে।
নাবিলা বিছানায় বসে ফোনটা শক্ত করে ধরে আছে। সব নোটিফিকেশন চেক করেছে। সামির ওকে ফোন করা তো দূরে থাক, সামান্য টেক্সট করে নাই। অথচ দুনিয়া সুদ্ধ খুঁজে বেরাচ্ছে। মাথার ভেতর ঝড় বইছে নাবিলার।
কেনো চাইছে সামির কথা বলতে? কী আছে ওর কাছে বলার? যাওয়ার আগে তো এমন অপমান করে গেল যে মনে হয়েছিল, একেবারেই শেষ! তবুও কেনো থামছে না? সাধ মেটেনি নাকি? এখন আবার বাবার কাছে পৌঁছেছে? ছিঃ! সামির একেবারে বেহুদা নাটক করে যাচ্ছে। কোন মানেই হয় না এসবের। আজ বাবার কাছে পৌঁছেছে, কাল কি করবে কে জানে? তবুও নাবিলার কাছে ফোন করছে না। অজুহাত দিচ্ছে, অনুমতি ছাড়া ফোন করব না। শরীর ভর্তি এত ইগো নিয়ে একটা মানুষ রাতে ঘুমায় কেমনে?
যেখানে খুশি যাক, যা ইচ্ছে করুক; নাবিলা নিজের জীবন নিজের মত চালাবে, ওর জন্য থেমে থাকবে নাকি? তবু ভেতরে ভেতরে দমবন্ধ করা রাগ আর লজ্জা একসাথে খচখচ করছে। যদি বাবা আবার কিছু বলেন তো নাবিলা সরাসরি জানিয়ে দেবে, “আপনার ছেলের আমার চেহারা দেখতে চায় না, আমি যে আশেপাশে থাকি সেটাও চায় না। এই কথাগুলো নিজের মুখে আমাকে যাওয়ার আগে বলে গেছে। তারপরও যদি আপনাদের মনে হয় কথা বলা উচিত তাহলে বলেন আমাকে, আমি কথা বলব।”
এই কথাগুলো তো নাবিলা মনে মনে বলল ঠিকই। তবে মুখ ফুটে যে কখনো বলতে পারবে না সেটা জানা আছে। সামির থাকাকালীনও শান্তিতে থাকতে দেয় নাই, চলে যাওয়ার পরেও না।

এখন নাবিলার সাথে হুট করে কারো দেখা হলেও ভয় লাগে। কে কখন চেঁচিয়ে বলে উঠে, “সামির তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে নাবিলা” বলা যায় না। সেদিনও রাস্তার মধ্যে অন্বেষা চেঁচিয়ে উঠেছিল,
— “তোমাদের দু’টোকে খুন করে আমি জেলে যাব। তোমরা শান্তিতে থাকো, নয়তো আমাকে থাকতে দাও।”

এমনকি শাহিদ ভাইও বাদ যায় নাই। উনি যখন বলেছিল তখনও নাবিলাকে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হয়েছিল। সেদিন তিনি হঠাৎই নাবিলাকে দেখে বললেন,
— “এই নাবিলা, শুনলাম তুমি নাকি সামিরের সাথে কথা বলো না?”
— “কে বলল?”
— “কেউ না, ও নিজেই তো বলে বেড়াচ্ছে। তুমি ব্যস্ত, তাই নাকি ফোন ধরো না। এ কী ব্যাপার?”

নাবিলা ভড়কে গিয়ে বলল,
— “আরে ভাইয়া না না, আমি তো… মানে… ক্লাস, পড়াশোনা এই জন্য…”

শাহিদ ভাই হেসে বললেন,
— “হ্যাঁ, বুঝছি। ব্যস্ত পড়াশোনার মেয়েদের তো হঠাৎ শাড়ি, গয়না, সাজগোজ এসবেও দেখা যায়। স্বামী যেহেতু আছে, খোঁজ-খবর তো নিতেই হবে তাইনা? বেচারা এমনিতেই দূরে আছে, তোমাকে মিস করছে। তুমিও বোধহয় রাগ করেছ ও চলে যাওয়াতে?”

নাবিলা লজ্জায় গলা ভারী করে বলল,
— “আপুদের মতো আপনিও না…”
— “আরে বোকা, মজা করলাম। তবে সিরিয়াসলি বলি, সামির তোমার খবর নিয়ে ভীষণ অস্থির। তুমি একবার হলেও কথা বলো, প্লিজ।”
— “আপনারাও না, একদম ওর দলে। সব দোষ আমার ওপর চাপিয়ে দিবেন। সামির কি খুব ভালো নাকি?”

শাহিদ ভাই মজা করে বললেন,
— “তা না, তবে তোমার পেছনে ভালো মানুষের মতোই ঘুরছে।”

নাবিলা মুখটা লাল করে দ্রুত বলল,
— “ভাইয়া, আমি এসব শুনতে চাই না। আপনার কাছে যদি আবার খবর পাঠায়, বলবেন আমি ব্যস্ত। খুবই ব্যস্ত।”
তারপর কেটে পড়ল দ্রুত। মুখে শক্ত ভাব দেখালেও বুকের ভেতরে কেমন এলোমেলো লাগছিল। ইশশশ, প্রায় একমাস হতে চলল। কতদিন ওকে দেখে না, ওর কথা শোনে না, কথা বলে না; বলবে কি করে? সামির তো নিজেই সেই পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছে।
.
শুক্রবারের সকালটা শুরু হলো বিরক্তির সাথে। কলিংবেলের সাথে কে জানি যুদ্ধ বাজিয়ে দিয়েছে, একটু থামছে আবার বাজছে। নাবিলা বিরক্ত মুখে আড়মোড়া ভেঙে উঠল, চোখ আধোঘুম, মাথা ঝিমঝিম।
ঘড়ির কাঁটায় দেখল মাত্র আটটা। এলোমেলো চুলগুলো হাতখোপা করে উঠে দরজার দিকে এগোল।
দরজা খুলেই হতভম্ব। সামনে কেউ নেই। একদম ফাঁকা, শুধুমাত্র বাতাসের তালে তালে টবের ছোটো ছোটো গাছের পাতাগুলো দোল খাচ্ছে। মুহূর্তেই বিরক্তি চরমে উঠল, সাতসকালে এসে কে এমন ফাজলামি করে যাচ্ছে? কার এত বড় সাহস? কিন্তু ঠিক তখনই চোখ আটকাল নিচে রাখা চারকোনা প্যাকেটটার দিকে। সাধারণ, কিন্তু তাতেও একটা আটপৌড়ে সৌন্দর্য রয়েছে। নাবিলা পা টিপে এগিয়ে গেল। একপাশ থেকে উঁকি দিল, কেউ নেই তবে এ জিনিসটা কে রেখে গেল? কার জন্য?
রেশমাও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
— “এভাবে কলিংবেল বাজায় কোন অভদ্র? থামাথামির কোনো নাম নেই। একেবারে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। কে এলো?”

নাবিলা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “জানি না মামণি… কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু এখানে একটা প্যাকেট রাখা।”
— “প্যাকেট? কীসের, দেখো তো।” রেশমা অবাক হয়ে এগিয়ে এলেন।

নাবিলা শিউরে উঠল।
— “মামণি… যদি কোনো বোমা হয়? খুললেই ঠাস্ করে উড়ে যাব।”

রেশমা ঠোঁট কামড়ে হাসলেন,
— “কি যে বলো! কার আবার এমন শত্রুতা আছে আমাদের সাথে? দাও দেখি।”
নাবিলা দেখতেই দিবে না। সত্যি যদি বাজে কিছু হয়? কেউ শত্রুতামি করেও তো এইরকম কাজ করতে পারে। কিন্তু রেশমা শুনলেন না। নাবিলা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইল, রেশমা পাত্তা না দিয়ে খুলে ফেললেন প্যাকেটটা। ভেতর থেকে বেরোল চকচকে নতুন একটা শাড়ি। নরম, মোলায়েম, দৃষ্টিনন্দন। রেশমা মুচকি হেসে সেটা নাবিলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন,
— “এই যে বোমা। এখন এটা পড়বে নাকি এটা দিয়ে ঘরবাড়ি উড়াবে?”

নাবিলা একটু লজ্জা পেয়ে হাসলো। তারপর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— “কিন্তু মামণি, এটা কে দিল? আমাদের এখানে কেনো রেখে গেল?”
— “এটা তোমাকে দিয়েছে।”
— “আমাকে? কীভাবে বুঝলেন? আর কে দিল?” নাবিলা অবাক।

রেশমা শান্ত স্বরে বললেন,
— “কে দিয়েছে সেটা জানি না। তবে যেভাবে দরজার সামনে রেখে গেছে, বোঝাই যাচ্ছে এই উপহার তোমার জন্যই।”
মামণি শাড়িটা দিয়ে চলে গেলেন। নাবিলা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মামণির শেষ কথাটা কেমন রহস্যময় লাগল। নাবিলার মনে হলো, তিনি সব জানেন। কে শাড়ি দিয়েছে… নাবিলা আরেকবার দেখল, অফ-হোয়াইট রঙের শাড়িটা হাতের ছোঁয়াতেই নরম ঝিলমিলে কাপড়ের মতো খুলে গেল। শাড়ির গা জুড়ে সাদা স্টোন বসানো, বাইরে থেকে রোদের আলো পড়তেই ঝিকিমিকি করে উঠছে। নাবিলা শাড়িটা নিয়ে ঘরে এল। খুঁটিনাটি দেখতে গিয়ে পুরোটা খুলতেই ভাঁজের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা চিরকুট পড়ে গেল মেঝেতে। থতমত খেয়ে নিচু হয়ে কাগজটা কুড়িয়ে নিল। সাবধানে খুলতেই ভেতরে মাত্র এক লাইন,
“তোমার কাছাকাছি, দূরে থেকেও জড়িয়ে আছি!”
হাতের লেখা চিনতে পেরে নাবিলা চিরকুটটা শক্ত করে হাতে চেপে ধরল। মাথার ভেতর ঝড় বইতে শুরু করল। সামির? কিন্তু সে তো দূরে, হাজার মাইল দূরে! তাহলে এই লেখা এখানে এল কীভাবে? অজানা অস্বস্তি অকারণ চিন্তা মিশে মাথা আরও ঘুরে উঠছে।

বিকেলে অন্বেষা নাবিলাকে টেনে বাইরে বের করল। মুখে রহস্যময় হাসি। আজ ওরা আয়ানের পিছু নিবে। একটু আগেই আয়ানকে রেডি হয়ে ফুলবাবু সেজে বাইরে বের হতে দেখেছিল। দু’জনেই দৌড়াল। চৌরাস্তার মোড়ে গিয়েই আয়ানকে পেয়ে গেল। পিছু করতে করতে দক্ষিণ পাড়া পর্যন্ত চলে এলো। এখানেই পড়শীদের বাসা। অন্বেষা আর নাবিলা কৌতুহল চেপে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পড়শী এসে হাজির। কোনো অভিবাদন নেই, সরাসরি হাঁটতে হাঁটতে কথা শুরু করল দু’জন।
অন্বেষা দৌড়ে যেতে চাইছিল। নাবিলা দ্রুত হাত টেনে ধরল। এইভাবে দৌড়ালে যেকোনো মুহূর্তে ওদের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু অন্বেষার চোখ জ্বলজ্বল করছে ভাইয়ের অজানা প্রেমে। ভাবতেই পারছে না… আয়ানের মত শান্তশিষ্ট মানুষ প্রেমে পড়তে পারে। এইজন্যই আগ্রহ একটু বেশিই। নাবিলা বারবার আটকাচ্ছে, কানের কাছে ফিসফিস করছে,
— “শান্ত হও আপু, একটু দূর থেকে দেখো। ভাইয়া যদি পিছনে ফিরে তাকায়, তবে আমাদের দুটোর জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যাবে। তুমি বড় ভাইয়ের প্রেমে তদন্ত করার আসামি হবে আর আমি ভাসুরের প্রেমে তদন্তের আসামি হব।”

কে শোনে কার কথা? নাবিলা অন্বেষাকে আটকাতে পারলেও, অন্বেষার কৌতূহল আটকানো গেল না। অবশেষে যখন আয়ান আর পড়শী প্রকাণ্ড বটগাছের ছায়ায় থামল, অন্বেষা টেনে নিয়ে এলো নাবিলাকে আরও কাছে। অতিমাত্রায় সাবধান ওরা দু’জনেই। কান পাতল, ‌গাছের ফাঁক দিয়ে ভেসে এলো দু’জনের গলা। অস্পষ্ট, তবে কিছু কিছু শব্দ কানে বাজল স্পষ্টতার মত। আয়ান বলছিল,
— “তাহলে বোধহয় বলে দেওয়া ভালো।”
— “কী জানি?”
— “তুমি কি চাও?”
— “আমার চাওয়া-পাওয়া কি অনেক বড় কিছু আয়ান? আমার মা-বাবা তো মূল্য দিচ্ছে না। কিছু বোঝার চেষ্টাও করছে না।”
— “প্লিজ, পড়শী।”

পড়শীর কণ্ঠটা কেঁপে উঠল,
— “আমি ভাবছি অন্য কথা… আমার চিন্তা হচ্ছে।”

আয়ান এক নিঃশ্বাসে জবাব দিল,
— “চিন্তা করো না, পড়শী। আমি আছি তো… সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ান আর পড়শীকে পেছনে ফেলে বাড়ির পথে হাঁটা দিল দু’জন। ওদের যতটুকু জানা দরকার ছিল ততটুকু জানা হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। অন্বেষা রিকশা নিতে বলল, নাবিলা বারণ করে দিল। এই রাস্তায় হাঁটার আলাদা মজা আছে। সন্ধ্যার হাওয়া, হালকা অন্ধকার, গাড়ির হর্ণ কমে গেছে… মনে হচ্ছে মনটাই শান্ত হয়ে যাচ্ছে। ওরা ধীর পায়ে হাঁটছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলাপ জমে উঠল বেশ। অন্বেষা হঠাৎই মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল,
— “ওরে নাবিলা আমার ভাইয়া যে ডুবে ডুবে জল খেতে জানে, আমি জানতামই না। সারাজীবন দু’ভাইকে তো আলাভোলা ভেবেই এসেছি।”

নাবিলা ভুরু কুঁচকে তাকাল,
— “আলাভোলা?”
— “হ্যাঁ।”
— “রায়হান ভাইয়ার তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।”
— “বিশ্বাস করো, ভীষণ রোমান্টিক ভাইয়া। ভাবিকে নিয়ে যা করে… এখন আয়ান ভাইয়াও দেখছি কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে।”

নাবিলা হাঁটা থামিয়ে অন্বেষার দিকে তাকাল,
— “কীভাবে বুঝলে?”
— “দেখো নাই কীভাবে পড়শীকে বলল, ‘আমি আছি তো… সব ঠিক হয়ে যাবে।’ একদম সিনেমার ডায়লগ। আমি তো পুরাই অবাক। রায়হান ভাইয়াও ঠিক এইভাবেই ভাবিকে বলে।”
— “কে বলেছে? ভাবি?”

অন্বেষা ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— “ভাবিই বলেছে। সব শেয়ার করে। ভাইয়াকে দেখলে মনে হয় কী ভাবওয়ালা গম্ভীর মানুষ, অথচ ভেতরে ভেতরে… হিহি! ভাবি বলে, সবার সামনে এমনভাবে হাত ধরবে কেউ বুঝতেই পারবে না। সবার সামনেই রোমান্টিকতা এতটাই সূক্ষ্ম থাকে যে কারো চোখেই পড়ে না। বেশি কিছু না বলি, নিজের ভাই বলে কথা।”

নাবিলা একটু থেমে হাতের কাজ থামিয়ে বলল,
— “ভাবি, সামিরের সম্পর্কে কিছু বলে না?”
— “ভালো কিছু জীবনে বলে না। যা বলে সবটাই দুর্নাম।”
— “ওহ আচ্ছা।” এমনভাবে বলল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ও।

অন্বেষা চোরা চোখে তাকাল,
— “নাবিলা, ইউ ফিল জেলাস?”

নাবিলা দ্রুত বলে উঠল,
— “না না, এমনিই জানতে চাইলাম।”

অন্বেষা একটু ঘেঁষে এসে কৌতূহল বাড়িয়ে বলল,
— “ওয়েট, সামিরের সম্পর্কে তো তোমার কাছ থেকে শুনব। বলো, ও কী কী করে?”

নাবিলা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে বলল,
— “ছিঃ… ওর সম্পর্কে কিছু বলতে পারব না। একেবারে শয়তান!”
মুখে একথা বললেও মনে মনে সামিরকে ঠিকই ভেবে নিল ওর নিজস্বতায়। সামিরটা না একদম আলাদা। কখনো এমন নজর রাখে যে একমুহূর্তও চোখ সরাতে পারে না নাবিলা। কিছু বলে না শুধু দেখেই হৃদয়টা আন্দোলিত হয়ে যায়। কখনো কখনো এমনভাবে স্পর্শ করে, যা কল্পনাতেও ভাবা যায় না। ওই স্পর্শে নাবিলার সাজানো-গোছানো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে যায়। ওর হাত, ওর ছোঁয়া… সবই মনে করিয়ে দেয়, কতটা যত্নে সে রাখে। সে কেবল কথা বলেই থেমে থাকে না। তার চাহনি, তার হাসি… সবই মনে করিয়ে দেয় কতটা প্রিয়। হাহ, সে এমন একজন যাকে ভাবলেই শরীরেও ঝরঝর অনুভূতি আসে। সেই অনুভূতিতে প্রিয়তা আছে, মায়া আছে, ভরসা আছে, বিশ্বাস আছে, ভালোলাগা আছে, যত্ন আছে; বোধহয় শুধু ভালোবাসাটাই নাই।
.
আজ ২ তারিখ, রবিবার। নাবিলার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে অনেকদিন হলো। আজ ও বাড়ি যেতে চাচ্ছিল। বাবা আসবেন দুপুরের পর, আর এসে ওকে নিয়ে যাবে। হাতে এখন অফুরন্ত সময়। সারাদিন শুয়ে বসেও এত সময় কাটানো যায় না। কিন্তু এই বাড়িতে মন খুলে গল্প করার কেউ নেই একজন ছাড়া। মামণির সঙ্গে কথা বললেও সবকিছু বলা সম্ভব নয়।
তাই নাবিলা সময় কাটানোর জন্য ঘরের মধ্যেই গুটুরগুটুর করে কাজকর্ম করে। আজ সকালে উঠেই নাস্তা রেডি করল। এই কাজটা ও একাই করল, নিখুঁত মনোযোগ দিয়ে। ডাইনিং টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে রাখতেই কলিংবেল টানাটানা করে বেজে উঠল, বারবার। নাবিলা দ্রুত ওড়নায় হাত মুছে দরজার দিকে ছুটল। দরজা খুলতেই অবাক, সেখানে কেউ নেই। তবে আগেরবারের মতোই একটি প্যাকেট রাখা।‌ নাবিলা পেছনদিকে তাকাল, এখনও মামণি-বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। তারপর প্যাকেটটা তুলল, ব্যস্ত ভঙ্গিতে খুলতে লাগল। প্যাকেটের ভিতরে ঝরে পড়ল আকাশী রঙের শাড়ি। শাড়ির কাপড় নরম, কোমল এবং সূক্ষ্মভাবে বোনা; ছোঁয়াতেই মনে হয় আকাশের নীলিমার স্পর্শ। এই রহস্যময় উপহার ওর জন্য? নাবিলা দরজা লাগিয়ে ঘরে গেল। শাড়িটা খুলতেই ছোট ছোট জ্যামিতিক ডিজাইনগুলো রূপকথার আভাস দিল। আর এইবারও একটা চিরকুট মেঝেতে ঝাঁপ দিল। নাবিলা চিরকুটটা তুলল, খুলল। সেই একই গোছানো হাতের লেখা। ও নিশ্চিত এই কাজ সামিরের। তবে এতদূর থেকে এই অনুভবে কীভাবে জড়িয়ে রাখছে তা বুঝতে পারছে না। নাবিলা বিছানার এককোণে বসে লেখাটা পড়তে শুরু করল,
“তুমি নেই। অথচ তোমার স্পর্শ, তোমার হাসি, তোমার নিঃশ্বাস সবই আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অদৃশ্য ছায়ার মতো। সকাল হোক, সন্ধ্যা হোক বা রজনী, প্রতিটিক্ষণ তোমার অবর্তমান উপস্থিতি অনুভব করছি। মনে হয় তুমি আছো, শুধু চোখে দেখা যায় না, ছুঁয়ে দেওয়া যায় না। সময় থেমে যায়, বাতাসও তোমার নাম নেয় আর আমার হৃদয় চুপচাপ তোমার খোঁজে অচেতনভাবে ঘুরে বেড়ায়। প্রত্যেকটি নিঃশ্বাসে, প্রত্যেকটি পদক্ষেপে তোমার অনুপস্থিতি আমাকে বেঁধে রাখছে অথচ আমি জানি, এই খালি জায়গায়ও তোমার অস্তিত্ব মৃদু আলো হয়ে ঝলমল করছে। আমি তোমাকে খুঁজে ফিরি অজানার পথে যেখানে শুধুই তোমার স্মৃতি আমার হাত ধরেছে আর মেঘেরা ফিসফিস করে বলে, তুমি এখানে নেই। তবে আমি তোমাকে খুব অনুভব করি।”
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ২১৮০