প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
15

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩১]
~আফিয়া আফরিন

সেদিন বিকেলেই নাবিলা বাবার সাথে রওনা হয়েছিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। দীর্ঘদিনের পড়াশোনা, ক্লাস, চিন্তা-চেতনা আর দৌড়ঝাঁপের পর নিজের বাড়ি ফেরার আনন্দটা আলাদা। অনেকটা স্বস্তি আর প্রশান্তির আবহ ছড়িয়ে ছিল যাত্রার পথে। আজ বাড়িতে ফিরেছে এক সপ্তাহ হতে চলল। দিনগুলো কেটে গেছে আত্মীয়-স্বজনের সাথে গল্পে, মায়ের কাছে খুঁটিনাটি বলায় আর নিজের ঘরে অলস দুপুর কাটিয়ে। হঠাৎ আজ সকালে মামার ফোন এলো, তারা বেড়াতে আসতে চাচ্ছেন। তাদের আসার কথা শুনে নাবিলা আর নাদিম তৎক্ষণাৎ দুটো লাফ দিল ছোটোবেলার মত।
নাবিলার মনটা আনন্দে ভরে উঠল। কতদিন হলো দেখা হয়নি শ্রেষ্ঠার সাথে, আহিরের সাথেও কথা হচ্ছে না কয়েকদিন। সব ঘটনা তো ওদের ওখান থেকেই শুরু হয়েছিল। তারপর নিজেদের টানাপোড়েন, একেকজনের পড়াশোনা, সংসার, দায়িত্ব; সবমিলিয়ে সময় বের করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
সকাল থেকে মিনিটগুলো থেমে গেছে। নাবিলা বারবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাচ্ছে। অপেক্ষার কোনো শেষ নেই। শ্রেষ্ঠার সাথে কিছুক্ষণ আগেই ফোনে কথা হয়েছে। জানিয়েছে, ওরা রাস্তায় আছে। ভিড় না থাকলে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
সেই কথাটা শোনার পর থেকেই নাবিলার মনটা আর স্থির হচ্ছে না। ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করছে, বারবার জানালার বাইরে তাকাচ্ছে। কখনো দরজার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। অবশেষে বিকেলের একটু পরেই কলিংবেলের শব্দে চমকে উঠল নাবিলা। কোনো দেরি না করে দৌড়ে দরজার দিকে গেল।
.
অন্বেষা নিজের বাড়িতেই আছে, কয়েকদিন ওখানেই কাটাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এরমধ্যে শাহিদের সাথে একদফা ঝগড়া হয়ে গেছে। শাহিদের যুক্তি স্পষ্ট,
“নিজের বাপের বাড়ি আর বউয়ের বাপের বাড়ি পাশাপাশি হলে এরচেয়ে বড় বিপদ আর কিছু নেই। এতে বউকে কাছে পাওয়া যায় না, বারবার হাতছাড়া হয়ে যায়।”
তার কথায় ক্ষোভও আছে, অভিমানও। শখ করে বিয়ে করেছে, ভেবেছিল বউকে সারাক্ষণ পাশে রাখবে, একটু-আধটু আদিখ্যেতা করবে। অথচ বউ কিনা প্রায়ই গিয়ে বসে থাকে বাপের বাড়িতে। শ্বশুর-শাশুড়ির অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও শাহিদ খুব একটা যায় না শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে গেলে বরং অস্বস্তিই বাড়ে। রায়হানের সাথে পুরোনো ঝামেলা পুরোপুরি মিটে যায়নি, তবে সৌজন্যের খাতিরে কথাবার্তা চলে। কিন্তু মুখোমুখি হলে একটা বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি হয়। তাই এড়িয়ে যাওয়াকেই নিরাপদ পথ মনে হয়। শাহিদ ফের অন্বেষাকে ফোন করল। ফোন করে বলল,
— “তুমি যদি আরও কয়েকদিন ওখানেই থাকো, তবে আমি ভাড়াটে বউ খুঁজে নেবো।”

অন্বেষা হেসে ফেলল,
— “ওহো, এত তাড়াহুড়া কিসের? একটা বউ সামলানোই যেখানে দুষ্কর, তুমি আবার দুটো সামলাবে? তাও ভাড়াটে বউ? বাব্বাহ, এত বড় বুকের পাটা?”
— “আমি যথেষ্ট সিরিয়াস অনু। কবে আসবে বলো?”

অন্বেষা খুনসুটি ভরা ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
— “আর দুটো দিন সময় দাও লক্ষীটি। একটা গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত করছি, এসে তোমায় বলব। তারপর কথা দিচ্ছি, তোমার কাছেই থাকব। তোমাকেই দেখব। মানুষ নাকি বউ ছাড়া খুব শান্তিতে থাকে? তুমিও থাকো প্লিজ।”

শাহিদ বিরক্ত অথচ আদুরে গলায় বলল,
— “শান্তির বদলে আমার অশান্তি হচ্ছে। এসো তাড়াতাড়ি, অপেক্ষায় রইলাম।”
অন্বেষা আসলে চোরের উপর বাটপারি করার জন্য এখানে আছে। আয়ান আর পড়শীর কথা ভাবতে ভাবতেই আবার ফোন বেজে উঠল। এইবার ফোন করেছে সামির। অন্বেষা ভুরু কুঁচকাল। এই আরেক প্রেমিক পুরুষ… না না, বিরহে কাতর পুরুষ। অন্বেষা রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে সামির বলল,
— “আমার বউ কোথায় আপু? তোমাকে বলেছিলাম না, কথা বলিয়ে দাও।”

অন্বেষা মুচকি হাসল। সামির ইদানিং ওকে খুব সম্মান দেখিয়ে আপু সম্বোধন করছে। পটিয়ে তাও যদি অন্তত বউয়ের হদিস পায়! অন্বেষা উত্তর দিল,
— “বউ? কোন বউ? তোর তো অনেক বউ-প্রার্থিনী আছে! ইদানিং পাড়ার অলিতে গলিতে তোকে প্রার্থিনীরা খুঁজে বেরাচ্ছে। তুই ঠিক কাকে খুঁজছিস, নাম বল।”

সামির হাঁপ ছেড়ে বলল,
— “আপু, আমি সিরিয়াস। নাবিলা কোথায়?”

অন্বেষা ফাজলামি বাড়াল,
— “ওহো, তাহলে অফিসিয়াল বউ খুঁজছিস? ভেবেছিলাম নন-অফিসিয়াল লিস্ট থেকে কেউ গায়েব হয়েছে।”
— “বাচ্চা ছেলেদের সাথে সিরিয়াস বিষয়ে ফাজলামি করতে হয় না আপু।”

অন্বেষা হেসে বলল,
— “শোন, তোর বউ এখন মহাব্যস্ত। আমার সাথে মুভির হিরোদের রূপ নিয়ে আলোচনা করে সর্বক্ষণ। তোর জন্য ওর একটুও সময় নাই।”
— “হঠাৎ চলে গেল কেন?”

অন্বেষা কটমট করে উঠল,
— “তো নিজের বাড়িতে যাবে না নাকি? শ্বশুরবাড়িতে কি চিরকাল বসে থাকবে? তাও স্বামী নাই, সংসার নাই।”

সামির গম্ভীর স্বরে বলল,
— “শ্বশুরবাড়িতে কি জায়গা কম পড়েছিল? আমার পুরো ঘরটাই তো দিয়ে এসেছি।”
— “শোন সামির, তুই শুধু ঘর দিয়ে এসেছিস, নিজেকে না। নিজেকে যেদিন সত্যি করে দিবি সেদিন এসে এভাবে ডায়লগ মারবি।”

সামির ইতস্তত স্বরে বলল,
— “নিজেকে তো দিয়েই দিয়েছি…”

অন্বেষা থতমত খেয়ে হেসে উঠল,
— “বলেছিস সেটা ওকে?”
— “না।”
— “গাধার হাড্ডি! ও কি তোর মনের মধ্যে গিয়ে বসে আছে নাকি? তুই না বললে বুঝবে কেমন করে? মেরে তক্তা বানিয়ে দেবো তোকে।”

সামির দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— “নাবিলা যদি একবার বলত, থেকে যেতে… আমি ভুলেও এই পথে পা বাড়াতাম না।”
— “পা যখন বাড়িয়েছিস তখন সামলাতে শিখ। নাবিলাকে আজ পর্যন্ত কোনো পজিটিভ কথা বলেছিস তুই? বাচ্চা একটা মেয়ে। নিজেও কষ্টে আছে।”

সামির কাতর গলায় বলল,
— “কিন্তু ও সবসময় বলে, আমি চলে গেলেই শান্তি।”

অন্বেষা চেঁচিয়ে উঠল,
— “গাধা! আবার মুখে এসব বলছিস? লজ্জা নাই তোর? ছোট্ট বাচ্চা তুই! খবরদার, আমাকে আর ফোন করবি না। আমি বসে থাকি তোর এইসব উল্টাপাল্টা কথা শুনতে?”
— “আপু, তুমি শুধু একবার নাবিলাকে বলো… আমার সাথে কথা বলুক।”

অন্বেষা বিরক্ত গলায় বলল,
— “আমাকে কি প্রেম–পিরিতির কুরিয়ার বানাতে চাস?”
— “আপু, প্লিজ… একবার। একবারই…”

অন্বেষা দপ করে নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। তারপর ভাঙা গলায় বলল,
— “আচ্ছা…”
ফোন রেখে অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই দূরত্বটাই তো দরকার ছিল ওদের জন্য। কাছে থাকলে কোনোদিন বুঝতে পারত না একে অপরকে। এখন ঠেলা খাবে; একা একা, আলাদা আলাদা। আর এই ঠেলাই শিখিয়ে দেবে কিভাবে সামলাতে হবে নিজেদের। তবে নাবিলাকে মেসেজ পাঠাল, “সামিরের সাথে কথা বলো না কেনো? আমার ভাইটাকে কষ্ট দিয়ে কী পাচ্ছো? কতদিন হয়ে গেছে! এইবার আমি তোমাকে বকবো বলে দিচ্ছি। এক্ষুনি ফোন করবে, মনের সাধ মিটিয়ে কথা বলবে। বুঝলে?”

নাবিলার মনে হঠাৎ কষ্টের একটা ঢেউ এলো। শ্রেষ্ঠার সাথে গল্প করতে করতে মনটা একদম অন্য জায়গায় ছুটে গেল। অন্বেষার মেসেজটা আবার পড়ল। “আমার ভাইটাকে কষ্ট দিয়ে কী পাচ্ছো?” এই কথাটাই ওর কানের ভেতরে বাজতে লাগল, চোখে আটকে রইল। সামির কি সত্যিই কষ্টে আছে? নাকি ওর নিজের অহেতুক অহংকার, রাগের ছায়া? নাবিলা বুঝতে পারছিল না। মনের ভিতরে সামান্য দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে এলো। শ্রেষ্ঠার হাসি, গল্পের মিষ্টি ঝাঁঝটা কিছুতেই মন ভরাতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, সামিরের অবস্থা জানা ছাড়া নিজেরও আনন্দ অসম্পূর্ণ।
চুপচাপ বসে নাবিলা মোবাইলটা দিকে তাকাল, মাথায় চিন্তার ঘূর্ণি। মনটা বলছিল এটা সামলাতে হবে, নিজেরও শান্তি দরকার। একবার কি তাকে ফোন করা যায়? হ্যাঁ করা যায়। তবে এখন না, এখন মন খারাপ হয়ে গেছে। যখন মনটা ফুরফুরে থাকবে, তখন ঠিক ফোন করবে।

নাবিলা আর শ্রেষ্ঠা গল্পে মগ্ন। অনেকদিন পরের গল্পে হালকা-পাতলা কাহিনী, ছেলেবেলার স্মৃতি, কলেজের আড্ডা, কে কেমন আছে; সবকিছুই উঠে এলো। এমন সময় আহির এলো। ওদের পাশে বসে বলল,
— “কী রে, একলা একলা গল্প করছিস?”
— “তুইও আয় না, ডেকে এলাম তখন।”
— “তোদের সাথে এখন আর কী বলব? তোরা বড় হয়ে গেছিস। একজন আবার বিয়েও করে ফেলল। ভাবীর আসনে গিয়ে বসেছে। তা ভাবী, ভালো আছেন? খবরাখবর ভালো? ভাইজান ভালো তো?”

নাবিলা মজা করে আহিরের পিঠে এক গাট্টা মেরে বলল,
— “ফাজলামি করিস না।”

শ্রেষ্ঠা জিজ্ঞেস করল,
— “হ্যাঁরে, সামির ভাইয়া কেমন আছে? আমি তো ভুলেই গেছিলাম আমাদের ওয়ান এন্ড অনলি দুলাব্রো-র কথা।”

নাবিলা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
— “ভালো আছে।”
— “তোকে বিয়ে করে ভালো আছে, এতো চিন্তার বিষয়।”

আহিরের কথা নাবিলা ফের ওকে মারতে উদ্যত হলো। আহির অবশ্য সরে গেল না। উল্টো হেসে বলল,
— “যেদিন পালিয়ে গেছিলি, সেদিনই কীভাবে ফাঁসলি তোরা? ওই দৃশ্য মনে পড়লে, হাসতে হাসতে দমবন্ধ হয়ে যায়। সামির ভাইয়াকে সাইড ক্যারেক্টার মনে করে পালিয়ে গেলি, শেষে কি হলো? আবার ফিরে এসে তাকেই হিরো হিসেবে বরণ করতে হলো!”

নাবিলা শুধু হাসল। কিছু বলল না। আহির ফের বলল,
— “আমি বড় হয়ে একজন ডিরেক্টর হবো দেখিস। প্রথম যে ফিল্ম বানাবো সেটা তোদের নিয়ে। নাম দিব ‘পলায়নপর প্রেমিকের প্রত্যাবর্তন’, ঠিক হলো না? একটা সুপারহিট গান থাকবে, ‘চলে গেলাম, আবার এলাম, শেষমেষ ধরা খেলাম, ওহো… লা লা লা!’ সুন্দর না? দেখিস এই সিনেমা বাংলাদেশের ইতিহাসে সূর্যের মত জ্বলজ্বল করবে। দেশের ইতিহাস বদলে যাবে। মানুষ বলবে, প্রেমের নামে যত সিনেমা হয়েছে সব ফেইল, শুধু এটাই উজ্জ্বল নক্ষত্র!”

শ্রেষ্ঠা গম্ভীর স্বরে বলল,
— “আরে শুধু নক্ষত্র না, এটাতে জাতীয় পুরস্কারও আসবে। পরিচালক হিসেবে আমিও নাম তুলব।”

নাবিলা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল,
— “তুই আবার পরিচালক? তুই তো রান্না করতে গিয়ে তরকারি পুড়িয়ে ফ্যালিস। সিনেমা সামলাবি কীভাবে?”

আহির দুজনকে থামিয়ে বেশ ভাব নিয়ে বলল,
— “শোন তোরা দুজন আমার আইডিয়া চুরি করে বড়লোক হতে চাস না। ফিল্মের পরিকল্পনা যেহেতু আমি করেছি তাই সবকিছুতেই আমি।”
— “ভিলেন কে হবে ভাইয়া?”
— “উমমম, এটা ভাবার বিষয়। যাকে-তাকে ভিলেন বানানো যাবে না।”

নাবিলা আর শ্রেষ্ঠা দুজনেই উৎসুক দৃষ্টিতে আহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, বিষয়টা নিয়ে তারা দুজনেই আগ্রহী। আহির একটা হাততালি দিয়ে বলল,
— “ইউরেকা, পেয়ে গেছি। ভিলেন হলো পুরো পাড়া কারণ সবাই ওদের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে বেড়িয়েছে। পালিয়ে যাওয়া মেয়েদের নাকি বিয়ে হয় না, তাদের কেউ বিয়ে করে না। অথচ তোরা ওদের মুখে ঝামা ঘষে করে দেখাইছিস!”
ওরা একসাথে হেসে উঠল। আসন্ন ফিল্ম নিয়ে আহির আরো অনেক পরিকল্পনা করল। হোক বা না হোক, ভাবতে তো আর দোষ নেই। ভাবতে ভাবতে নাবিলার মন হঠাৎ করে ছুটে গেল অনেকটা পেছনে, সেই রাতে…
কিশোরগঞ্জের আকাশে তখন মৃদু চাঁদের আলো, চারপাশে মৃদু শীতের আমেজ। ব্যস্ত রাস্তা দিনের কোলাহল মুছে শান্তভাবে ঘুমিয়ে ছিল। একটা ছোট্ট চায়ের দোকান, টিনের চালা, সামনে কাঠের বেঞ্চ। সেখানে বসেছিল সামির আর নাবিলা। আশেপাশে কেউ ছিল না। দুজনেই ছিল চাপা আতঙ্কের মধ্যে, বর্তমান-ভবিষ্যতের ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল। ভৈরবের সেই সকাল নাবিলার মনে আজও স্পষ্ট। সামিরের হাসি, কাপে ধোঁয়া ওঠা চা, টুপটাপ চায়ের চুমুক আর ভাজা বাদামের ঘ্রাণ। তারপর ফেরার পথে ডাকাতের খপ্পড়ে পড়ে সমস্ত দুনিয়া থমকে যাওয়া, সামিরের পাশে থাকা। তারপর বাড়ি ফিরে এসে সোজা তিন কবুলে আবদ্ধ হওয়া… কতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে অথচ চোখ বন্ধ করলে মনে হয়, সবেমাত্র ঘটে গেল। এইমুহুর্তে নাবিলার মনে হচ্ছে, ওই রাতটা তাদের দু’জনের জন্যই তৈরি হয়েছিল।
নশ্বর পৃথিবীর সবকিছুই অস্থায়ী। সন্ধ্যার আকাশের রঙ, বাতাসের গন্ধ, প্রিয় মানুষের হাসি, চোখের পলক; সবই ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু প্রিয় মুহূর্ত, ভালোবাসা, সেই অনুভূতি, অর্থাৎ মনকানন মনোভাবের সবটাই অবিনশ্বর।
.
নাবিলা এখন পুরোপুরি পরিবার ঘিরে আবদ্ধ। মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে প্রতিদিনই ছোট্টো আনন্দময় পৃথিবী হয়ে উঠেছে। সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুরের খাবার, বিকেলের চা আর সন্ধ্যার আড্ডা, সবকিছুতেই ওর মন খুশি থাকে। কাজিনদের সাথে ঘোরাফেরা, গল্প, হাসি-মজা, প্রতিটি মুহূর্তে নাবিলা অনুভব করে এই সহজ জীবনের ছোট ছোট আনন্দ কত বড় কিছু।
কয়েকদিন ধরে ও জীবনের সব না পাওয়া, অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা, অচেনা ব্যথা, একপাশে সরিয়ে রেখেছে। এখন শুধু নিজেকে পাওয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। একজনের থেকে ইস্তফা নিতে চাইলেও আশেপাশের মানুষজন তা হতে দেয় না। আরেহ, আশেপাশের মানুষজন কেন হতে দিবে? নিজের মনটাই বেইমানি করে। দূরে রেখেও এই একজনের থেকে ও নিজের মানসিক শান্তি খুঁজে নেয়।
এদিকে সামির আর নাবিলার খোঁজ করে নাই। আর করলেও তা এখনও ওর কানে পৌঁছায় নাই। ও স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নিজের তরফ থেকে ফোন করবে না। যে মানুষ যাওয়ার আগেরদিন সবচেয়ে নিষ্ঠুর কথা শুনিয়েছিল, তার সাথে আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করার কোনো মানে নেই। নাবিলার সহ্যশক্তি অনেক। ধীরে ধীরে, নিজের নিয়ন্ত্রণে সবকিছুই ও সামলে নিতে পারে।
ও প্রতিনিয়ত নিজের অনুভূতির সঙ্গে একাকী লড়াই করছে, দেওয়ালের মতো অচল সীমার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রতিটি স্পন্দন, প্রতিটি চিন্তা চেপে রাখছে। যাতে নিজের ভিতরের আগুন অন্যকাউকে স্পর্শ করতে না পারে। সামিরের প্রসঙ্গে এই অদম্য জেদ তার সহায়ক। কতদিন এই জেদ তাকে ধরে রাখতে পারবে, কে জানে? কিন্তু একদিন সেইদিন আসবেই, যেদিন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে। তখন আর কোনো বাঁধা থাকবে না। সেদিন, নাবিলা সব আঁকড়ে রাখা অনুভূতি খুলে দিয়ে সরাসরি ভালোবাসার কথা বলবে। এরপর যা হবে, যা হওয়া উচিত, তাতে কি আসে যায়; দুনিয়ার নিয়মই উল্টে গেলেও ও প্রস্তুত। হয়ত, সেই একমুহূর্তেই সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে যেতে পারে কিংবা এতদিনের ভয়, সব সংকোচ, সব চুপচাপ অন্তরের আবেগ একত্র হয়ে নিখাদ সত্যে রূপান্তরিত হতে পারে।

সামির যাওয়ার আগে নাবিলা একটি লজ্জাজনক অকাজ করেছিল। কতটুকু কী কিংবা কাজটা কতটুকু ঠিক ভুল, নাবিলা তা জানে না। মনে করার সঙ্গে সঙ্গে এখনও লজ্জা জেগে ওঠে, একরকম গা কাঁপানো অনুভূতি সমস্ত শরীরকে আচ্ছন্ন করে। কাজটি বাস্তবায়নের সময় ভয় পায় ধরা পড়ে যাবে কি না! আশেপাশের চোখগুলো তাকে বিচার করবে। এই চিন্তায় হৃদয় দুলে ওঠে… তবুও লজ্জার অনুভূতিকে কিছুটা পেছনে সরিয়ে দিয়ে, নাবিলা গভীর এক নিঃশ্বাস নেয়। নিজের ভেতরটাকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। আজও করছিল… ঠিক সেই মুহূর্তে, ফোন বেজে ওঠে। অন্বেষা ফোন করেছে। নাবিলা ফোন তুলে সাধারণ কথাবার্তা সেরে জিজ্ঞেস করল,
— “আয়ান ভাইয়া কি এখনও ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে, আপু?”

অন্বেষা বলল,,
— “হুম, সে তো পুরো সিনেমার নায়কের মতো প্রেম করছে। প্রেমের মাঠে গড়াগড়ি করে এখন ভাইয়া শাকিব খানের চরিত্রে পরিণত হয়েছে।”

নাবিলা হেসে ফেলল,
— “বিয়ে করায় দাও, আর কি!”
— “আরে, বাসায় তো কিছুই বলে না। শুনো কাহিনী, পড়শী এসেছিল গতকাল। আমি একটু টেকনিক খাটিয়ে ভাইয়া আর ওকে বসার ঘরে আলাদা রেখেছিলাম প্রায় দশ মিনিটের জন্য। ওরে লজ্জা! দু’জনেই একটা কথাও বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখাচোখি পর্যন্ত না। আমি পর্দার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দেখে হেসেই খুন!”
— “ইশশশ, মিস করে গেলাম।”

অন্বেষা বলল,
— “আমি ভাবছি ওরা বাসর রাতে কি করবে?”
— “ছিঃ ওদের রাত, তুমি ভাবছো কেনো? ওদের নিজেদের রাত, কাটাবেই একরকম করে। তোমাকে ভাবতে হবে না। আয়ান ভাইয়া, তোমার নিজের ভাই।”

অন্বেষা সেসব কানেই তুলল না। ঠোঁট কামড় হেসে বলল,
— “হায়! আমি তো ভাবছি, ওরা পুরো রাত একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকবে নাকি মাথা নিচু করেই কাটাবে? অ্যাই যদি, ঘুমিয়ে পড়ে?”
— “একে অপরকে চুমুও তো খেতে পারে, তাইনা?”
— “থাক, এত ইমাজিন না করি। আমরা বরং বিয়ের পরদিন পড়শী ভাবিকেই ধরব। কী কী কান্ড ঘটালো এ টু জেড শুনব।”
— “এটাও তো ইমাজিন। বিয়েই হলো না, আমরা পড়শী আপুকে ভাবি বানিয়ে ফেলছি। ওদের বাসর রাত কল্পনা করে ফেলছি। ছিঃ, কী বাজে।”

অন্বেষা হেসে উঠল। নাবিলা ফের বলল,
— “এত রাতে ফোন দিলে যে? ভাইয়া বাসায় নাই বুঝি?”

অন্বেষা লাজুক হাসল,
— “একটু পর আসবে।”
— “লজ্জা পাচ্ছো নাকি? তোমার লজ্জা দেখলে আমার সত্যি হাসি লাগে। মানে যে মানুষটা সবসময় আরেকজনকে পঁচায়, উল্টাপাল্টা কথা বলে, সে মানুষটা শাহিদ ভাইয়ার প্রসঙ্গে একজন লজ্জাবতী হয়ে যায়।”
— “ঠিক হচ্ছে না কিন্তু নাবিলা। আমি তোমার বড় আপু…”
— “আচ্ছা বড় আপু, ক্ষ্যামা দিন।”
— “যাও যাও ঘুমাও, মেয়েটা খুব ফাজিল হয়ে গেছে।”
নাবিলা ফোন রেখে কতক্ষণ হাসল। তারপর উঠে গিয়ে আলমারি থেকে ওই দুটো কাগজ বের করল। ও একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, প্রথম শাড়িটা পেয়েছিল ০২ তারিখে এবং দ্বিতীয় শাড়িটাও ০২ তারিখে। ০২ তারিখে কি কোনো বিশেষ দিন? নাহ, এইমুহুর্তে বিশেষ কিছুই মনে পড়ছে না। আজ মাসের ২৯ তারিখ। আসছে ০২ তারিখেও কি এমন কিছু ঘটবে? নাবিলা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল…
.
.
.
চলবে…..

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩২]
~আফিয়া আফরিন

কানাডার সবচেয়ে ব্যস্ত, রঙিন আর বহুজাতিক নগরী হচ্ছে এই টরেন্টো। চারদিকে কাঁচের উঁচু দালান আর সেখানে রাত নামলেই আলোয় ঝলমলে রাস্তা অন্য এক জগৎ।
সামির থাকছে টরেন্টো শহরের এক শান্ত এলাকায়, ডাউনটাউন থেকে একটু দূরে। আশেপাশে বড় বড় গাছ, শীতের হাওয়ায় পাতার রঙ ফিকে হয়ে ঝরে পড়ছে। সাইডওয়াকের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, পুরো পৃথিবীটা সোনালি রঙে রাঙানো। যখন তার খুব নিঃসঙ্গ অনুভব হয় তখন প্রায়শই সময় পেলে লেক অন্টারিওর ধারে গিয়ে বসে থাকে। নীল পানির গভীরে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ; কোনো শব্দ নেই, শুধু ঢেউয়ের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।
সামির তিন বেডরুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকছে। ওর সাথে দু’জন রুমমেট রয়েছে। একজন ভারতীয়, নাম অর্জুন সাহা; এর সাথে সামিরের মোটামুটি বেশ ভালো সম্পর্ক যেহেতু বাঙালি। অর্জুন সবসময় সরগরম। রান্নাঘরে ঢুকলেই বিরিয়ানি, রাজমা-চাওল; ঐতিহ্যবাহী কিছু না কিছু একটা নিজ হাতে তৈরি করবেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রিকেট আর বলিউডের গল্পেই বেশি মশগুল থাকে।
আরেকজন হচ্ছে চেন, সে চায়না নাগরিক। অর্জুনের একেবারেই বিপরীত। শান্ত, স্ট্রিক্ট, নিজের কাজে ডুবে থাকা। সবকিছু গুছানো, মিনিমালিস্ট। খাওয়া-দাওয়ায় খুব একটা আগ্রহ নেই, বেশিরভাগ সময় নুডলস বা স্যুপেই পুরো দিনটা কাটিয়ে দেয়। তারপর ল্যাপটপে মুভি দেখে।
ওদের সাথে সম্পর্কটা ভালই। মাঝে মাঝে অর্জুনের বকবক আর চেনের ঠান্ডা শান্তি, দুটো মিলে তার একাকীত্ব অনেকটা ঢেকে দেয়। তবুও, মাঝরাতে যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে টরন্টোর ঠান্ডা হাওয়া বুক ভিজিয়ে দেয় তখন সামিরের মনে পড়ে শুধু বাংলাদেশের কথা, নাবিলার কথা…

সামিরের ইউনিভার্সিটিতে আজ একটা ক্লাস ছিল। শীতের সকাল, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বরফঢাকা রাস্তা পেরিয়ে, মেট্রো ধরে, ক্যাম্পাসে গিয়ে দুই ঘণ্টার লেকচার শুনে ক্লান্ত হয়ে ফিরল। শরীর জমে গেছে ঠান্ডায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই বুঝল, বাসাটা ফাঁকা। ঘরটা একেবারে নীরব। এত নীরবতা সামিরকে শান্তি দেয় না। একা একা লাগে। ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে সে বারান্দার দরজা খুলল। বরফে ঢাকা ছাদগুলো একটার পর একটা সাদা কম্বলের মতো বিছানো। দূরে ট্রামের ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। মোবাইলটা পকেট থেকে বের করল সামির। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখল, কোনো নতুন মেসেজ নেই। বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা টের পেল। চুপচাপ বারান্দার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সামির ভাবল,
“ওরা নেই, তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যে সত্যিই নেই, যে আমার দিনশেষের হাসি, রাগ, অভিমান আর শান্তির মানুষ, সে তো বহুদূরে। অর্জুন বা চেন ফিরে এলে ঘরের আবহাওয়া জমবে, আপাতদৃষ্টিতে আমার একাকীত্ব ঘুঁচবে, হাসি-ঠাট্টায় মুখরিত হবে। কিন্তু বুকের ভেতরের এই ফাঁকা জায়গাটা? সেটা কে ভরাবে? আমার সমস্ত দিনের শেষে যে মানুষটাকে চাই, সে তো আমার থেকে সমুদ্রের ওপারে। ও কি আমায় একটুও মিস করে? নাকি আমার মতো সেও জেদ করে সবকিছু চেপে রাখছে?”

কিছুক্ষণ পরেই দরজাটা ঠেলেই ভেতরে ঢুকল অর্জুন। মুখ ভরা হাসি, হাতে মিষ্টির প্যাকেট। ঢুকতে ঢুকতেই সে গলা ছেড়ে হেসে উঠল।
— “ব্রাদার, ফাইনালি! এত বছর ধরে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা কথাটার উত্তর পেয়ে গেছি। বিশ্বাস করো, মনে হচ্ছে বুক থেকে এক পাহাড় নেমে গেছে।”
— “মানে? কী বলছো তুমি?”

অর্জুন গর্বের ভঙ্গিতে টেবিলের ওপর প্যাকেটটা রাখল,
— “মানে হলো, আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে আই লাভ ইউ বলেছি অনেকদিন আগে আর সে আজ হ্যাঁ বলেছে। ব্যস! এখন তো মনে হচ্ছে, এই গোটা পৃথিবীটাই আমার।”
কথা বলতে বলতে অর্জুন মিষ্টির প্যাকেট খুলল। টুপ করে একটা মিষ্টি সামিরের মুখে পুরে দিল। সামির একচিলতে হাসি ফুটাল। অর্জুন কত সহজে বলে ফেলল! এত বছর লুকিয়ে রাখা অনুভূতিটা আজ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর সে? সামিরের বুকের ভেতরও তো হাজারো কথা জমে আছে, কিন্তু সে এখনও বলতে পারেনি। মিষ্টির শেষ টুকরোটা মুখে তুলতে গিয়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,
“ইশ! আমিও যদি এত সহজে বলে দিতে পারতাম নাবিলাকে…”

অর্জুন তখনো লাফালাফি করছে। ঠিক তখনই দরজাটা খট করে খুলে ভেতরে ঢুকল চেন। তার হাতে একটা ব্যাগ। ঢুকেই অবাক হয়ে দু’চোখ বড় বড় করে তাকাল অর্জুনের দিকে।
— “হোয়াট হ্যাপেন্ড ব্রো? তুমি নাচো কেনো? লটারি জিতেছ নাকি?”

অর্জুনের থামার নাম নেই। ব্যাগ চেনের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে টেবিলে রাখল,
— “লটারি না ভাই, প্রেম! মাই লাভস্টোরি ফাইনালি সাকসেসফুল।”
— “লাকি ডে ব্রো!”
তারপর অর্জুন নিজের লাভস্টোরি শোনাল। সে অনেকদিন আগে বলেছিল ‘আই লাভ ইউ’। কিন্তু মেয়েটার কাছ থেকে ‘আই লাভ ইউ টু’ পৌঁছাতেই আড়াই বছর লাগল! তারপর বাকি বন্ধুদের লাভস্টোরি শোনার জন্য মরিয়া হয়ে পড়ল। চেন হেসে বলল,
— “আই হ্যাভ অ্যা গার্লফ্রেন্ড।”
— “আর সামির?”

সামির হেসে বলল,
— “আই’ম অলরেডি ম্যারিড।”

ওরা হতবাক হয়ে তাকাল। এটা জানা ছিল না। অর্জুন বিষ্ময় নিয়ে বলল,
— “আরে, সত্যি? তাহলে তো তোমার লাভ স্টোরি আমাদের জন্য ফাইনাল অ্যাডভেঞ্চার! লাভ ওর অ্যারেঞ্জ? কাহিনী শুনাও।”
— “এখন একটু ব্যস্ত, শোনাব কোনো একসময়।”
— “ওকে।”
ওদের সাথে কথা বলে সামির ফোন করল মাকে। দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা হলো। রেশমা প্রায়ই কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ে। সামির দূর থেকে বোঝায় কিন্তু মায়ের মন তো, এতকিছু বোঝে? আজ অবশ্য তিনি কান্নাকাটি করলেন না, ঠিকঠাক কথা শেষ করল। সামিরের একটা কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ, সেটা সমাধা করতেও নিজেও বের হলো।
.
শীত নামার আগমনী বার্তা নিয়ে হিমেল হাওয়া বইছে চারদিকে। বিকেলের শেষে নাবিলা একটা পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে ছাদে উঠেছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, বাতাসের ঝাপটায় দাঁত পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপছিল। ঠান্ডার দাপট বেশি বলে নিচে নেমে এলো।
ড্রইংরুমে ঢুকতেই চোখে পড়ল, নেওয়াজ আহসান সোফায় হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। পাশে বসতেই তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন।
— “কি খবর মা?”

নাবিলা রিমোট হাতে নিয়ে বলল,
— “এইতো, তোমাদের চোখের সামনেই তো আছি।”

উনি হেসে মাথা নাড়লেন।
— “হুম… ক্লাস কবে থেকে শুরু?”
— “এই মাসের শেষে।”
— “তাহলে এখানে আর কিছুদিন আছো তো, তাই না?”

নাবিলা মুখ ফুলিয়ে তাকাল,
— “তুমি কি আমাকে চলে যেতে বলছো, বাবা?”

নেওয়াজ আহসান তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন,
— “আরে না মা! শুধু জানতে চাইলাম।”
— “আমি এখানেই আছি। যখন যেতে ইচ্ছে হবে যাব। সেটা ক্লাস শুরু হওয়ার আগেও হতে পারে, আবার পরেও।”

নেওয়াজ আহসান পত্রিকার ভাঁজ গুটিয়ে পাশে রেখে বললেন,
— “হ্যাঁ, আজ দুপুরে সামির ফোন করেছিল। তোমার খবর নিচ্ছিল।”

নাবিলা চমকে উঠে বাবার দিকে তাকাল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি আবার টিভির দিকে সরিয়ে নিল। ঠোঁটে একরকম কৃত্রিম হাসি খেলল,
— “আমার খবর? মানে?”
— “ও বলল, অনেকদিন তোমার সাথে কথা হয়নি, তাই খোঁজ নিল। আমি বললাম, তুমি ঠিক আছো।”

নাবিলা চোখ নামিয়ে রিমোট নিয়ে অকারণে বোতাম চাপতে লাগল। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখল,
— “আসলে আমার ফোনটা বন্ধ ছিল বাবা। হয়তো তাই সরাসরি আমাকে না পেয়ে তোমার কাছেই খোঁজ করেছে।”

নেওয়াজ আহসান মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। চোখে কোমল দৃষ্টি। নাবিলা ভড়কে গেল। চটপট উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— “আমি কথা বলছি।”

রিমোটটা টেবিলে ফেলে রেখে তাড়াহুড়ো করে ঘরে চলে এল নাবিলা। পেছনে বসে থাকা নেওয়াজ আহসান শুধু তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের মুখের অস্বস্তি উনি স্পষ্টই টের পেলেন, কিন্তু আর কিছু বললেন না।
ঘরে ঢুকেই নাবিলা দরজা ভিজিয়ে দিল। সবার সামনে হঠাৎ করে সামিরের নাম উচ্চারিত হওয়ায় ওর অস্বস্তি হলেও, ভেতরে ভেতরে একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। সামির তার খোঁজ নিচ্ছে, এইটুকুই ওর হৃদয়কে নরম তুলোর মতো করে দিল। অকারণে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল, যদিও ও সেটা চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। মনের ভেত ফড়িং ডানা ঝাপটায়, প্রজাপতির ডানার রঙিন নকশা উড়ে বেড়ায়। অস্বস্তির আড়ালে লজ্জামাখা স্বাচ্ছন্দ্য, যে স্বাচ্ছন্দ্য শুধুমাত্র সামিরের নাম শুনলেই নাবিলার ভেতরে জেগে ওঠে।

আজ ০২ তারিখ। সকাল থেকে নাবিলা একরকম অপেক্ষায় বসে ছিল, ভেবেছিল মামণি হয়তো ফোন করবে। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলেও কোনো খবর এলো না। একপ্রকার মনক্ষুণ্ণ হলো ও। বিকেলের দিকে হঠাৎ করেই এই বাড়ির কলিংবেল তারস্বরে বেজে উঠল। বোধহয়, কেউ অস্থির হয়ে কাউকে ডাকছে। নাদিম দৌড়ে এগিয়ে গেল দরজা খুলতে কিন্তু নাবিলা বাঁধা দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
— “তুই যা, আমি দেখছি।”
— “কেনো? তোমার কাছে কেউ এসেছে নাকি?”
— “কানের নিচে থাবড়া খাবি। তর্ক করিস না।”

নাদিম বিরক্ত হয়ে মুখ কালো করে পাশে সরে দাঁড়াল। নাবিলা দরজা খুলল। আগেরবারের মতই এবারও কাউকে দেখা গেল না, তবে দরজার সামনে রাখা একটা চারকোণা প্যাকেট ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। নাবিলার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল, তবে ঠোঁটের কোণে অচেতনভাবেই হাসি ফুটে উঠল। নাদিম এগিয়ে এসে কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল,
— “এটা কি আপু?”

নাবিলা প্যাকেটটা বুকে জড়িয়ে ধরল, কোনো গুপ্তধন পেয়েছে এমন ভঙ্গি। তারপর হেসে বলল,
— “এটা যাদুর বাক্স, ভালো থাকার টনিক।”
নাদিম ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। তার বোঝার ক্ষমতার বাইরে এই যাদুর বাক্সের রহস্য। কিন্তু নাবিলার চোখের দৃষ্টি বলছিল, ওর ভেতর আসলেই কোনো যাদু লুকানো আছে।
শাড়ির চেয়ে নাবিলার মনোযোগ পড়ল চিরকুটের দিকে। এই শীতের মধ্যেও হাতের তালু ঘামে ভিজে আসছিল, বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে লাগল। ধীরে ধীরে প্যাকেট খুলল। ভাঁজে ভাঁজে একখানা হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি চোখে পড়তেই মূহূর্তের জন্য থমকে গেল। কাপড়টা গোধূলির নরম আভা নিয়ে ঝলমল করছে, তার ফাঁকে লুকানো ছোট্ট কাগজের টুকরোটা ওকে আহ্বান জানাচ্ছে। নাবিলা একবার চারপাশে তাকাল। ঘর খালি, কেউ নেই। ঠিক তখনই হাত বাড়িয়ে শাড়ির ভাঁজ থেকে চিরকুটটা তুলে নিল। তখন গোটা পৃথিবীটা থেমে গেছে, কেবল ওর সাথে ওই কাগজের নীরব কথোপকথন চলছে…
“তুমি আমি দু’জনেই যথেষ্ট বেকুব, বুঝেছ?” চিরকুটের লেখা প্রথম লাইনটা পড়ে নাবিলার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল। অথচ হাসির আড়ালে কেমন অচেনা শিহরণ গড়গড় করে উঠল ভেতরে। কথাটা এত সোজাসাপ্টা… বেকুব আসলে দু’জনই। কারণ কেউই কাউকে খোলাখুলি বলে উঠতে পারছে না। চোখে জল এলে তা আড়াল করছে, বুকের ভেতর হাহাকার জমলেও হাসি দিয়ে ঢাকার চেষ্টায় মত্ত। নাবিলা নিজের মনে বলল, “আমরা বেকুব, কারণ আমরা দু’জনেই বোকার মতো ভালোবেসে যাচ্ছি।”
তারপর ফের পড়ায় মনোযোগ দিল,
“তুমি আমি দু’জনেই যথেষ্ট বেকুব, বুঝেছ? কেনো জানো? আমি কিন্তু জানি। তুমিও জেনে নিও। নিজেকে প্রশ্ন করলে উত্তর পাবে।‌ আমি কীভাবে বুঝেছি তা শোনো, কেউ একজন নিঃশব্দে এসে অদ্ভুত কৌশলে হৃদয়ের অন্দরে একটা কোণ দখল করে নিলো। কখনো হাওয়ার মতো, কখনো আলোয়ের মতো; আমি টেরই পেলাম না,
কখন থেকে হৃদয়ের অন্দরে ওর নাম লেখা হয়ে গেছে। হৃদয় তো তালাবদ্ধ ছিল তবু আশ্চর্যভাবে জায়গা তৈরি হয়ে গেছে অথবা ও তা তৈরি করে নিয়েছে। ও অনাহূত অথচ সবচেয়ে আপন অতিথি। এই অনুভূতিটা আমি বুঝতে পারি, নিজের ভেতর লালন করতে পারি কিন্তু বলতে পারি না তাই আমি বেকুব।”

চিরকুটের অক্ষরগুলোতে আঙুল বুলাতে বুলাতে নাবিলার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বেকুব, এই শব্দটাই কানে বাজতে লাগল। সামিরের হাতের লেখা, সামিরের স্বভাবসুলভ ঠাট্টা, আবার সেই না-বলা অভিযোগ; সবকিছু ওকে আঁকড়ে ধরল। ওর মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর আটকে থাকা সব কথা এই চিরকুটেই লেখা আছে। ভালোবাসাটা দু’জনেই অনুভব করছে, তবুও কেউ বলছে না।
নাবিলা মনে মনে হেসে ফেলল,
“আমরা সত্যিই বেকুব… ভালোবাসি অথচ ভালোবাসি না বলার মতো পাগল।” প্রজাপতি উড়ছিল বুকের ভেতর, কিন্তু ডানার শব্দটাও কেমন ব্যথা দিয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে… অসংখ্য ভোর, অসংখ্য রাত, চুপচাপ দীর্ঘশ্বাসের পাহাড় টপকে একদিন নাবিলা ফোনটা হাতে নিল। আঙুল কাঁপছিল অস্থিরতায়। কতবার লিখে মুছেছে, পাঠানোর আগে আবার থেমে গেছে। তবুও আজ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। হাজারো অপ্রকাশিত কথার ভিড় থেকে মাত্র কয়েকটা শব্দ তুলে নিয়ে সামিরকে একটা মেসেজ দিল,
— “আমাকে খুঁজতে বুঝি সারা বাংলার মানুষকে জানাতে হয়? নিজে থেকে খুঁজে বের করার বুদ্ধি হারিয়েছেন নাকি?”

বুকের ভেতর জমে থাকা বিশাল বোঝা হালকা হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ ফোন করল অন্বেষাকে।
অন্বেষা তখন চোর-পুলিশ খেলছিল। অর্থাৎ আয়ান আর পড়শীকে ফলো করে তাদের পেছনে পেছনে ঘুরছে। হঠাৎ, তার ফোন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই সে চমকে উঠল। সামনে থাকা দু’জনও ঘুরে তাকাল।
ব্যস, ধরা পড়ে গেল। ফোন করা ব্যক্তির পিন্ডি চটকে হাসল। আয়ান অবাক হয়ে এগিয়ে এলো।
— “তুই এখানে?”
— “ইয়ে… মানে, ভাইয়া… আমি একটা কাজে এসেছি।”
— “কী কাজ?”
— “বলা যাবে না।”

পড়শী বোধহয় লজ্জা পেয়েছে অন্বেষাকে দেখে। সে “আমি আসছি” বলে চুপচাপ চলে গেল। আয়ান পাকড়াও করল বোনকে, নিশ্চিত বুঝতে পেরেই অন্বেষা সোজাসুজি তার পিছু নিয়েছিল। অন্বেষা অবশ্য তৎক্ষণাৎ স্বীকার করল না। এমন সময় ব্যাগের মধ্যে ফোন আবার বেজে উঠল। অন্বেষা বলল,
— “ভাইয়া, জরুরী কল আসছে। আমি যাই।”
— “না, দাঁড়া। এখানেই কথা বল।”

অন্বেষা ফোন বের করে দেখল নাবিলা কল করছে। কী করবে সে? ইচ্ছে করছে আচ্ছা করে বকুনি দিতে। অসময়ে ফোন দিতে হলো? ফোন রিসিভ করল না। আয়ান ফের বলল,
— “তুই আমাদের ফলো করছিলি?”
— “ছিঃ ছিঃ, আমি তো তোমার ছোটো বোন না!”
— “ছোটো বোন হলে কি হবে?”
— “ইয়ে… মানে, চলো ভাইয়া, আমরা বাসায় যাই।”

আয়ান বলল,
— “না, আমি এখন বাড়ি যাব না। তুই যা। আর শোন, ভালো হ। ভালো হতে পয়সা লাগে না। বিয়ের পর এমন পাড়ার কুচুটে কাকিমা হয়ে গেছিস কেন? লজ্জা নাই? শাহিদ ভাইকে একেবারে বলে দিব।”

অন্বেষা দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। আয়ান চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে অন্বেষা চেঁচিয়ে বলল,
— “শোনো ভাইয়া, তুমিও বিয়ে করো। বিয়ে করতে কিন্তু একশজন লাগে না। এভাবে ছোকরাদের মতো চুপিচুপি প্রেম করছ কেনো? লজ্জা নাই? মা-বাবাকে একেবারে বলে দিব।” অন্বেষার চোখে খুনসুটি, মুখে হাস্যরসাত্মক। আয়ান হাত নেড়ে আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। নাহ, এইবার সত্যিই তাকে বিয়েটা করে ফেলতে হবে।

আয়ানের চলে যাওয়া দেখে অন্বেষা হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। নাবিলাকে ফোন করেই পাগলের মত হাসতে হাসিতে অন্বেষা বলল,
— “শোনো, আজকে তো আমি হাতে-নাতে ধরে ফেললাম আয়ান ভাইয়াকে! এটা অবশ্যই তোমার জন্য সম্ভব হয়েছে।”

নাবিলা চমকে উঠল,
— “কী বলো?? কীভাবে ধরে ফেললে? আমি কি করলাম?”
অন্বেষা সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলল। এমনকি পড়শী লজ্জা পেয়ে কীভাবে দৌড়ে পালাল, তাও বলল। অতঃপর নাবিলা বলল,
— “তুমি না একদিন ফাঁসবে বুঝলে আপু।”

অন্বেষা ফোনের এপাশে নাটকীয় ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
— “আমি না, ফেঁসেছে তো ওরা। বিয়ের দিন দেখে নিও, আরও কী ফাঁস খাওয়াই। এখন তো প্রেমের মধ্যে সিসি ক্যামেরা হয়েছি এরপর বাসরঘরের ক্যামেরা হব‌।”

নাবিলা হেসেই গড়িয়ে পড়ছিলো প্রায়,
— “তুমি না, পুরা গুপ্তচরের কাজ করছ! একদিন পড়শী আপুর কাছে ধরা খেয়ে ননদ-ভাবিতে মিলে চুল টানাটানি হবে।”

অন্বেষা সঙ্গে সঙ্গে একটু ভাব নিয়ে জবাব দিল,
— “ধরা খাবো কেন? আমি তো শার্লক হোমস।”

নাবিলা হেসে কটাক্ষ করল,
— “শার্লক হোমস না, তুমি একেবারে কুচুটে ননদিনী।”
— “হ্যাঁ, মাঝে তুমি শুধু নীরব দর্শক হয়ে মজা নাও।”
— “তাই করব। আমি অন্তত কারো প্রেমকাহিনীতে মশা-মাছির মত বসি না।”
— “নাবিলা…”
নাবিলা হাসাহাসি করে কথা শেষ করল। অন্বেষার অদ্ভুত কান্ডকারখানা সবসময় ওর মন ভালো করে দেয়। হাসতে হাসতে ফোনটা হাতেই রেখে দিল। সামির যদি এইমুহূর্তে রিপ্লাই দেয়! বুকের ভেতরের টানটান উত্তেজনা নিয়ে সোফায় হেলান দিল, চোখটা বারবার স্ক্রিনে গিয়ে আটকে থাকল।

সামির বাহিরে বের হয়েছিল। তাড়াহুড়োর কারণে ফোনটা ঘরেই রেখে এসেছিল। ফিরল গায়ে-মাথায় একগাদা বরফ নিয়ে। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই চক্ষু চড়কগাছ! নাবিলা… এতদিন পর! সূর্য কোনদিকে উঠল আজ? সামির ঝটপট রিপ্লাই দিল,
— “দূরত্বের দেয়াল ভাঙতে গিয়েও ভাঙতে পারিনি এতকাল,
তাই বাংলার মানুষকে জানানোর চেষ্টা করলাম।
অনেকদিন বাদে তোমায় চেয়ে পেয়েছি, হয়েছি টাল-মাতাল
তোমার একটুখানি ডাকেই ফের না বলে বাঁচতে এলাম।”
.
.
.
চলবে…..

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৩]
~আফিয়া আফরিন

মোবাইলের স্ক্রীনর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, সামিরকে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে নাবিলা। অথচ সে কত দূরে! কেমন হাঁসফাঁস অনুভূত হচ্ছে। দিন-দুনিয়া সব আলাদা করে রেখে নাবিলা দ্রুত হাতে টাইপ করল,
— “ভালোই শায়েরী লিখছেন আজকাল।”

সামির ছোট্ট উত্তর দিল,
— “টুকটাক চেষ্টা করি।”
— “আগে করতেন না?”

সামির বোধহয় কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর লিখল,
— “না।”

নাবিলা ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। আঙুল কিবোর্ডে থেমে গেল একমুহূর্ত। অবশেষে লিখল,
— “কেন? আগে তো প্রেম ছিল।”
— “হুম, ছিল তো। কিন্তু প্রেমে পড়লেই মানুষ শায়েরী লেখে?”

নাবিলা হতভম্ব ভঙ্গিতে লিখল,
— “আমি তাই জানতাম।”
— “ভুল জানতে। মানুষ শায়েরী লেখে ভালোবাসলে, মানুষ কবিতাও লেখে ভালোবাসলে। ভালোবাসা আর প্রেম দু’টো এক নয়, নাবিলা।”

নাবিলা সামিরের মেসেজগুলো পড়ে একেবারে চুপ করে গেল। শব্দের পর শব্দ ওর ভেতরে ঢুকে হৃদপিণ্ডের পাশে বসে পড়ল। ঠোঁটের কোণে অচেনা পাগলপারা হাসি এসে থমকে দাঁড়াল। সামিরের সাথে কথা বলছে ও… তাও এতক্ষণ! নাবিলা অতিপ্রাকৃতির মত জিজ্ঞেস করল,
— “ভালোবাসা কী তবে?”
— “শুধু জানার জন্য জানতে চাও নাকি মন খুলে অনুভব করতে চাও?”
— “ইয়েস, আমি অনুভব করতে চাই।”
— “তাহলে শোনো… ভালোবাসা মানে প্রতিনিয়ত কথা না বলে থেকেও সেকেন্ডে সেকেন্ডে মনে পড়া। ভালোবাসা মানে হাতে হাত রাখা নয়, দূরে থেকেও একে অপরের হাত ধরে থাকার মত অনুভূতি। ভালোবাসা মানে ঝগড়া, হাজারও রাগ-অভিমানের মাঝে মনের ভেতর একটুখানি দেখার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠা। ভালোবাসা কিন্তু পাওয়ার লোভ নয়; প্রিয় মানুষটা যাতে দিনশেষে ভালো থাকে, শান্তিতে থাকে, হাসি-খুশি থাকে; তা রাখতে পারার অব্যক্ত লোভ। প্রেম তোমার বাহ্যিক দিক দেখবে আর ভালোবাসা অভ্যন্তরীণ। প্রেম চোখের দৃষ্টি বোঝে, কিন্তু ভালোবাসা আত্মা বোঝে। আর যা আত্মাকে বুঝতে পারে তার পক্ষে চোখের দৃষ্টি বোঝা নস্যি! প্রেম ক্ষণস্থায়ী ঝড়, ভালোবাসা স্থির নদীর মতো; গোপনে বয়ে চলে, কখনোই থেমে যায় না। ভালোবাসা শাশ্বত, অমর।”

নাবিলা তন্ময় হয়ে পড়েছিল সামিরের কথায়। প্রতিটি শব্দ ওর ভেতরের অস্থিরতাকে শান্ত করছিল। বিশ্বাসই হচ্ছে না এখনও। কিছু স্বপ্ন যখন সত্যি হয়, তখন নিজের অনুভূতিগুলোও কাজ করতে ভুলে যায়। মনে হচ্ছিল, সামির এইমুহূর্তে পরোক্ষভাবে একটা সত্যি বলছে। কোনো দর্শন বোঝাচ্ছে না, কোনো বড় বড় জ্ঞান দিচ্ছে না… ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসার কথা বলছে। সামিরের ভালোবাসা, কবিতা, শায়েরী, অমরত্ব; এইসব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু আসলে একটাই। আর সেটা অন্যকিছু নয়, অন্যকেউ নয়… নাবিলা নিজেই! নাবিলা চোখ বুজল। চোখ খুলতেই দেখল, সামির আবার কিছু টাইপিং করছে।
— “ভালোবাসার ক্ষেত্রে কারণ হলো তুমি; যার জন্য কেউ প্রতিদিন বেঁচে থাকবে, যার হাসি তাকে শান্তি দিবে। প্রমাণ হলো সেই কেউ একজন; যে প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি বাক্যে, প্রতিটি মুহূর্তে শুধু তোমার দিকে মনোনিবেশ করবে।”

নাবিলার চারপাশে অদৃশ্য কেউ ফিসফিস করে বলল বোধহয়,
— “তুমি-ই সেই কারণ, আমি-ই সেই প্রমাণ।”

সামিরের সাথে এরপর নিত্যদিনের টুকটাক কথাবার্তা চলল। নাবিলা অনেকদিন বাদে ভেতরটা হালকা অনুভব করছিল। আনন্দের সঙ্গে আয়ান ভাইয়ার প্রেমের খবরটাও জানিয়ে দিল। আজ আবার অন্বেষার কাছে ধরা খেয়ে গেছে, সেটা বলতেও ভুললো না। সামির শোনার পর প্রথমে চুপ করে রইল। মন খারাপ করেছে বোধহয়। তবে বোঝা গেল না, ও সত্যিই মন খারাপ করেছে নাকি শুধু ভান করছে। তবে একটা অভিযোগ ছুঁড়ে দিল; এক ভাই প্রেম করছে, বোন সেটা জানে অথচ তাকে জানানো হলো না? কেউ জানানোর প্রয়োজনবোধ করল না। এত তাড়াতাড়ি পর হয়ে যাচ্ছে সে?
সামিরের সেসব ছেলেমানুষি কথাগুলো শুনে নাবিলার ভীষণ ভালো লাগল। ওকে সান্ত্বনা দিল না বরং মুখ টিপে হেসে সব শুনল। এরপর নাবিলা হঠাৎ শাড়ির প্রসঙ্গ তুলল। ও নিশ্চিত ছিল, এই পরিপ্রেক্ষিতে সামির হয়ত কিছু বলবে। কিন্তু সামির সটান উত্তর দিল,
— “না না! আমি কেন দিব? শাড়ি-ফাড়ি দেওয়া আমার কম্ম নয়। একবার তো দিয়েছিলাম। তারপর সাধ, শখ, আহ্লাদ সব মিটে গেছে। আবার দেব নাকি? বাপরে! দেখো তোমার কোনো আশিক যদি দেয়।”

নাবিলা হো হো করে হেসে উঠল। সামিরের মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করেনি মোটেই। হাসি সামলে উত্তর দিল,
— “আমি তো আরও ভাবলাম, আপনি পাঠিয়েছেন। এখন দেখি, খুঁজতে হবে কে করছে আমার জন্য এসব! আহা, দুনিয়াতে আমাকেও এত ভালোবাসার মানুষ আছে তাহলে।”

সামির রিপ্লাই দেওয়ার আগে কিছুক্ষণ থেমে গেল। তারপর লিখল,
— “ফিরে যাও নাবিলা। আমার ঘর এখনও তোমার জন্য খালি পড়ে আছে। ঘরের ইট, সিমেন্ট, দেওয়াল সবকিছু তোমার পদচারণার অপেক্ষায়। ওরা আমাকে বলেছে, তোমাকে মিস করছে! জানালার পর্দা হাওয়ায় দুলে ওঠে, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই কারণ তুমি এসে দুলাওনি। বিছানার বালিশ নিঃশব্দে পড়ে থাকে, ওরা এখনো তোমার ঘ্রাণ খুঁজছে। বুকের ভেতরের মতোই আমার ঘরটাও শুনশান, অপূর্ণ। তুমি ফিরলেই তাতে আলো জ্বলে উঠবে, শ্বাস নিতে পারবে, বেঁচে উঠবে। নাবিলা, তুমিহীনা ওই ঘর কেবল দেওয়াল আর ছাদের স্তূপ। আবেগ আর ভালোবাসায় গড়া ওটাই আমার সাজানো পৃথিবী। সেখানে আমার সব স্বপ্ন জমা আছে। যত্নের দায়িত্ব আমি তোমার হাতে ন্যস্ত করলাম। তুমি দেখে রেখো যেন কোনো ভাঙচুর না হয়, কোনো ধুলো না জমে। আমি না থাকলেও সেখানে আমার শ্বাস, আমার অস্তিত্ব মিশে আছে। তুমি শুধু সেসব আগলে রেখো, তাতেই আমি নিশ্চিন্ত।”

সামির কথায় এমন একটা টান‌ ছিল যা পরদিন নাবিলাকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ছাড়ল। নেওয়াজ আহসান অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা তো এতদিন ফেরার নামই নিচ্ছিল না, এখন হঠাৎ কী এমন হলো! তবে তিনি প্রশ্ন করলেন না, মেয়ের চোখের ঝলকই সব বলে দিল। নাবিলা ফেরার সাথে সাথেই অপ্রস্তুত আনন্দ নিয়ে রেশমা ছুটে এলেন। জড়িয়ে ধরে কপালে মিষ্টি চুমু এঁকে বললেন,
— “অবশেষে ফিরলে মা? এতদিন বাড়িটা খাঁ খাঁ করছিল। এখন আর সহজে যেতে দেব না।”
— “আমিও আর সহজে যাচ্ছি না।”

গল্পে গল্পে মগ্ন হলো সবাই। নাবিলার মন টানছিল অন্য কোথাও, নিজের ঘরের দিকে। চুপিসারে উঠে গেল সকলের মাঝখান থেকে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই বুক ভরে শ্বাস নিল। যেভাবে রেখে গিয়েছিল, সব ঠিক সেইভাবেই আছে। প্রতিটা কোণায় আকাশ উজাড় করা নীরবতা অথচ তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সামিরের স্বস্তি-অস্বস্তি, নিশ্চয়তা, অপেক্ষার নিঃশ্বাস।
নাবিলা দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে এই ঘর এভাবেই থাকবে। কেউ এখানে হাত দেবে না। এমনকি কাজের মেয়েকেও ঢুকতে দেবে না। কারণ এই ঘরে সামিরের গন্ধ আছে, তার অস্থিরতা মিশে আছে। নাবিলা না থাকাকালীন তার দখলদারিত্ব ছিল এই ঘরে। যদি ভুলেও কেউ সেসব স্পর্শ করে ফেলে, নাবিলার মনে হবে সামিরকে কেউ কেড়ে নিচ্ছে। ওর অস্তিত্ব কেউ সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে!
.
বউ শাশুড়ি মিলে তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। রেশমা রান্নাবান্না করছিলেন, নাবিলা সাহায্য করছে। কখনো হাসাহাসি করছে কখনো পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখ জ্বালাপোড়া করছে। রেশমা অনেকবার বলেছে, সরে যেতে। নাবিলা আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
— “মামণি, তুমি আগে থেকেই রান্নাবান্না করতে পারো নাকি পরে শিখছো?”
— “আগেই পারতাম। তবে পরিপক্ক ছিলাম না। শাশুড়ি হাতে ধরে শিখিয়েছে সব। তারপর থেকে আমিই করি, রান্না করতে ভালোও লাগে।”

নাবিলা হাঁসফাঁস করে বলল,
— “ভালো লাগে? আমার কাছে বিরক্ত, অসহ্য, যন্ত্রণা লাগে।”

মামণি হেসে মাথা নাড়লেন,
— “এই ব্যাপারটা আসলে অনেককিছুর উপর নির্ভর করে, বুঝেছ। মানুষকে খাওয়ানোর আনন্দই আলাদা। যার জন্য রান্না করবা, সে তৃপ্তি নিয়ে খেলে, তখন মজা লাগবে। ঘেমেনেয়ে কষ্ট করে রান্না করে যে বিরক্তবোধ করেছ, তা মনেই থাকবে না। তার মুখ থেকে প্রশংসা শুনলে মনে হবে, যাই আরও কিছু রেঁধে নিয়ে আসি।”
— “তাই? তাহলে আমিও শিখব।”

মামণি হেসে বললেন,
— “তোমাকে এখন শিখতে হবে না মা। সামির আসুক, তখন শিখিয়ে দিব।”

নাবিলা লজ্জা পেল। ইশশশ, মামণি বুলটিনের মতো খবর ধরে মনের ব্রেকিং নিউজ পড়ে ফেললেন! নাবিলা অবশ্য অস্বীকার করার চেষ্টা করল না।
— “হ্যাঁ হ্যাঁ। আগুনের তাপে মেয়ের মুখ লাল হলো নাকি লজ্জায়, হুম?”
নাবিলা মুখে হাত দিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড় দিল। বাচ্চা একটা মেয়ে ও, এত পাকা পাকা কথা বলে কেউ? আহা, শাশুড়িটাও হয়েছে একেবারে! বউমা-র সাথে থাকতে থাকতে ওর ধাত নিজের মধ্যে বরন করে নিয়েছে। নাবিলা দৌড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠল। সেই আওয়াজে ও থমকে দাঁড়াল। বলল,
— “আমি দেখছি, কে এলো।”
দরজা খুলতেই ভেতরে প্রবেশ করল ইয়াসমিন আর কামিনী। তাদের দেখে নাবিলা মৃদু হাসি দিয়ে সালাম দিল। থিতু হয়ে বসতে দিয়ে মামণিকে এসে বলল। বড় জা আসায় রেশমা রান্নাবান্না ওখানেই সমাপ্ত রেখে চলে এলেন। ইয়াসমিনের আসার উদ্দেশ্যে হচ্ছে, আয়ান। আয়ানের বিয়ে নিয়ে বাসায় কথাবার্তা তুলতে চাচ্ছেন। দু’একজন মেয়ে নজরে আছে। দেখতে যাবে, তারপর কথাবার্তা হবে।
নাবিলা আড়াল থেকে চুপচাপ সব শুনছিল। তারমানে, পড়শীর কথা এখনো কারো জানা নেই। আয়ান ভাইয়া এখনো বলে নাই। পরে আলোচনার ধারা শুনে বুঝল, তাদের বাড়িতেও বিয়ের ব্যাপারে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কেউ করে নাই। এমনকি আয়ানকেও জানানো হয় নাই। রেশমা বললেন,
— “আয়ানকে কখন জানাবেন ভাবি। ওর যদি পছন্দ-অপছন্দ থাকে তো?”

উত্তরটা দিল কামিনী। নির্লিপ্তভাবে বলল,
— “কোন পছন্দ নাই, কাকি। থাকলে আমরা হয়তো কোন না কোনভাবে বুঝতাম। আমাকে অন্তত বলত।”
নাবিলা আড়াল থেকে মুখ ঝামটা দিল। বড়রা কথা বলছে, আর ও মাঝখানে মাঞ্জা মারছে। অভদ্র কোথাকার! দেখে আসছে, পছন্দের কেউ নাই। বলে দিল আন্দাজে একটা কথা। আয়ান ভাইয়া বোধহয় তার পছন্দের কথা জনে জনে বলে বেড়াবে। আর ও এমন কী ভাবি আসছে যে ওকে বলতেই হবে? যত্তসব। নাবিলা কামিনীকে ডেকে অন্য ঘরে নিয়ে এলো। নয়ত এই মহিলা বকবক করতেই থাকবে। ও কামিনীর দিকে তাকিয়ে মৃদু ঠোঁটকুনি হাসি দিল। মনে মনে স্বাগতিক্ত করল, “আমার না হওয়া সতীন, কুচুটে কাকিমা কোথাকার! সবসময় আগ বাড়িয়ে কথা না বললে পেটের ভাত হজম হয় না। এত কুচুটেগিরি করার শখ থাকলে নিজের জীবনে গিয়ে করো না, ভাই! আরেকজনের জীবনে ছুঁকছুঁক ঢুকে পড়ার দরকার কী?”
তবে মুখে একটা প্লাষ্টিক হাসি ঝুলিয়ে রাখল। কামিনীর সাথে তেমন কোনো কথাবার্তা হলো না। ওকে আটকে রাখাটাই লক্ষ্য। বড়রা কথা বলছে, তারমধ্যে আমার কিছু একটা বলে বসবে! ম্যাডাম তো আবার কান ভাঙ্গানি দিতে ওস্তাদ। যদিও ভাবা উচিত নয় কিন্তু থেকে থেকে নাবিলার মনে হয়, অন্বেষা আপুর বিয়েতে রায়হান ভাইয়ের প্রথম অমতের ক্ষেত্রে শাহিদ ভাইয়ার সাথে ব্যক্তিগত কারণ ছাড়াও কামিনীর কোন না কোন ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে।

নাবিলা যা শুনল সবটাই গড়গড় করে অন্বেষাকে বলে দিল। অন্বেষাও জানে না, মা ভাইয়ার বিয়েশাদীর কথা ভাবছে। তবে মায়ের উপর রাগ তখন লাগল যখন শুনল, কামিনী সব জানে অথচ সে কিছুই জানে না। নাবিলা শান্ত করল। এখন রাগারাগি না করে ওদের উচিত সরাসরি আয়ানের সাথে কথা বলে পড়শীর কথাটা বাসায় জানানো। একবার যেহেতু বিয়ের কথা উঠছে তবে বিয়ে হয়েই দম নিবে। নাবিলার ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল, তারপর থেকেই এই বিষয়ে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা নেই।
.
আয়ান তখন টিভির সামনে পা ছড়িয়ে বসেছিল। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল, ডিসপ্লেতে ভেসে উঠল সামিরের নাম। ফোন ধরতেই সামির একেবারে ঝড়ের গতিতে সব রাগ একসাথে উগরে দিয়ে আয়ানের চৌদ্দগুষ্টির উদ্ধার অভিযান শুরু করে দিল।
— “তুই কি মনে করিস, আমি কোনো খোঁজখবর পাব না? তোর হাঁড়ির খবরও আমার জানা আছে। লুকাইয়া প্রেম করিস, আর আমাকে জানাস না! আগে তো খুব বলতি, আমি কোনোদিন প্রেমই করব না। করলেও তোকে আগে জানাব। এই তার নমুনা? আমি তোর ভাই, না প্রতিবেশী?”

আয়ান কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
— “ভাইরে, প্রতিবেশী হলে অন্তত চা-নাশতা খাওয়াত। তুই ভাই বলেই ধমক খাচ্ছি। আমারে যে এমনে বললি, তোরও তো গায়ে লাগল তাইনা?”

সামির ভুরু উঁচু করে বলল,
— “আমি নিজেকে সেফ রেখে তোরে বলতেছি… শালা মীর জাফর!”
— “মীর জাফর? আমি? তাহলে তোরে একদিন পলাশীর ময়দানে টেনে…”

এমন সময় হাসাহাসির আওয়াজ শোনা গেল। হাসতে হাসতে কেউ এদিকে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তেই দরজার পর্দার ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিল নাবিলা আর অন্বেষা। অন্বেষা এগিয়ে এসে বলল,
— “ভাইয়া প্রেম করছো?”

আয়ান বাঁচতে গিয়ে ফোনটা নাবিলার হাতে গুঁজে দিল। ইশারায় কানে দিতে বললে ও দ্বিধা নিয়ে ফোন কানে দেয়। ওপাশ থেকে সামির গম্ভীর গলায় বলেই যাচ্ছে,
— “হ্যালো… মীর জাফর শোন, তোরে আমি দেখে নিব। তুই প্রেম করবি, আর আমারে জানাবি না? বিশ্বাসঘাতক! মীর জাফরের নাম শুনলে এখন থেকে সবাই তোরে মনে করবে। ইতিহাসের বইতে আমি তোর বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে নতুন অধ্যায় রচনা করব। আমি বইয়ের পাতায় তোর বিশাল বড় একটা ছবি দিয়ে লিখে দিব, ‘মীর জাফর দ্য লাভ গুরু!’ তারপর সেটা তোর বাচ্চাকাচ্চা পড়বে, তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পড়ে তোকে থুথু দিবে।”
নাবিলা হতবিহ্বল হয়ে তাকাল। অন্বেষা এগিয়ে এসে ফোন লাউড স্পিকারে দিল। বলল,
— “ভাইয়া আসলেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে রে সামির।” ব্যাস, সামির নিজের কথা থামিয়ে অন্বেষাকে ধমক দিতে উদ্যত হলো। এটাও আরেক নষ্টের গোড়া। বলল,
— “তুই আরেক ঘসেটি বেগমের নাতনি।”
— “ভাই বিশ্বাস কর আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।”
— “নির্দোষ আর তুই? প্রেমে ডুবে ভাই-ব্রাদার ভুলে যাস!”

এদের ঝগড়াঝাঁটির মধ্যে নাবিলা চেঁচিয়ে উঠল,
— “এই যে, থামবে তোমরা? মীর জাফর, ঘসেটি বেগম, নির্দোষ এগুলো ইতিহাসের ক্লাসে রাখো। এখানে প্রেমের ক্লাস হচ্ছে বলে যা ইচ্ছে বলবে? শুধু মজা-মশকরা না, একটু ভদ্রতাও লাগে।”

এতক্ষণ সামির নাবিলার উপস্থিতি টের পায় নাই। এইমাত্র ওর কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল। এর আগে তো শুধুমাত্র মেসেজে কথা হয়েছিল, কণ্ঠ শোনা হয় না কতদিন! এ তো একেবারে মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মত। সামির হেসে হেসে বলল,
— “ওফ্‌, বিচারক মহাশয়াও হাজির দেখছি!”

আয়ান নাবিলাকে বলল,
— “তুমি বাঁচাইলা! না হলে তোমার স্বামী আমারে মীর জাফর বানায় বইয়ের পাতায় বিক্রি কইরা দিত আর পোলাপান সেই পাতায় ঝালমুড়ি রাইখা খাইতো। ভাবতেই কষ্টে বুক ফাইট্টা যাইতেছে।”

সামির ঠাট্টা করে বলল,
— “আগেই ফাইট্টা যাস না প্লিজ। ভাবি জানলে ভাববে, তুই হার্টের রোগী। তখন আরেক সমস্যা। যেদিকে তার জায়গা পাওয়ার কথা ছিল সেদিকে আগেই রোগ-বালাই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।”

সামিরের কথা শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আয়ান চোখ রাঙিয়ে বলল,
— “এইজন্যই তোরে ফোন দে্ইই না। সিরিয়াস কষ্টের কথা বললেও তুই জোক বানাস।”
— “সিরিয়াস কষ্টের কথা ভাবিরে বলবি, আমাকে না। আমি তোর কাউন্সেলর না ভাই।”
আয়ান কপাল চাপড়াল। অন্বেষা আর নাবিলার হাসি থামছিল না। হাসতে হাসতে এতক্ষণে পেটে খিল ধরে গেছে। অন্বেষা বিছানার কোণে বসল আর নাবিলা টেবিলের সাথে হেলান‌ দিয়ে দাঁড়াল। ওপাশ থেকে সামির শেষ গর্তটা খুঁড়ে দিল,
— “ভাই, আমি আসার আগে কিন্তু বিয়ে করিস না। আমার বাসররাতে যে কাহিনী করে তুমি সব পন্ড করছো তাই কিন্তু ভুলি নাই। প্রতিশোধ নিব, প্রতিশোধ।”
— “সেটা কী রকম?”

সামির কাণ্ডজ্ঞানী ভঙ্গিতে হেসে বলল,
— “যখন নিব তখন‌ দেখবাই। প্রতিশোধ তো প্রতিশোধই!” রুমে কেউ চলে আসায় সামির “বাই বাই” বলে ফোন রেখে দিল। নাবিলা আর অন্বেষা সুযোগ পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলল আয়ানকে। বাড়িতে যেহেতু একবার বিয়ের কথা উঠেছে তাই এখন পড়শীর কথা বলে দেওয়া উচিত। আয়ান চুপচাপ শুনে খানিক চিন্তিত হলো। তবে মুখে অবিচলিত ভঙ্গি রেখে বলল,
— “ঠিক আছে, আমি নিজেই সামলাতে পারব। তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না।” মনে মনে ব্যপারটা নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেই পরিকল্পনা সাজিয়ে নিল।
কিন্তু দুই নাছোড়বান্দা সবকিছু নিজের হাতেই রাখতে চাইছে। অর্থাৎ ঘটকালিও ওরা করবে, পুরষ্কারও ওরাই নিবে। ওদের জোরাজুরিতে শেষমেষ আয়ান বাধ্য হলো রাজি হতে। ঠিক হলো, দু’জন মিলে পড়শীর সঙ্গে কথা বলবে। এরপর নাবিলা আর অন্বেষা হাসিমুখে একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে নাচতে নাচতে গাইতে শুরু করল,
— “আয়ান ভাইয়ার বিয়ে,
টোপর মাথায় দিয়ে!
বউ আসবে পালকি বেয়ে,
মধুর হাসি দিয়ে।
ঘরে বাজে গান আর নাচের ঝংকার,
আনন্দে ভরে উঠবে তাদের রঙিন সংসার!”
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]