#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৭]
~আফিয়া আফরিন
আজকের দিনে নাবিলার হাতে এসে পড়ল ১৪ নম্বর চিরকুট। ও ইচ্ছে করলেই এই রহস্যটা ভেদ করতে পারে। খুব সহজেই জানতে পারে, এসব বাড়ির সামনে কে রাখছে। কিন্তু, মাঝেসাঝে নিজেকে চমকে দিতে নিজেরই ইচ্ছে করে। এছাড়া মামনিও বোধহয় বিষয়টা জানে, তাই তো উচ্চবাচ্য কিছু করে না। নাহয় কেউ তার ছেলের বউকে দিনের পর দিন এসে শাড়ি, চিঠি দিবে আর সে একদম নিশ্চুপ থাকবে, তা তো হতে পারে না।
চিরকুটের সংখ্যা গুনলে নাবিলা নিজেই অবাক হয়। মনে হয়, এই তো সেদিন প্রথম চিরকুটটা হাতে পেয়েছিল, কতটা উচ্ছ্বাস আর কৌতূহল ছিল তখন! তারপর থেকে একেকটা দিন, একেকটা ঋতু, একেকটা মেজাজের ভেতর দিয়ে এতগুলো চিরকুট জমে গেল। প্রতিটাই সামিরের নিঃশব্দ স্পর্শ, প্রতিটাই তার অদৃশ্য উপস্থিতি।
সামিরের ফেরার সময় কি এসে গেল না? কতদিন হলো, শুধু কাগজে কলমেই কথা বলছে অথচ মানুষটা সামনে এসে বসবে; এ আশা করাই বোধহয় ভুলে গেছে। জিজ্ঞেস করলে সামির কিছু বলে না।
“আসব।” এইটুকু বলেও না। “আসব না।” এটাও না। শুধু কেমন করে মাথা ঘুরিয়ে দেয়, কথাটা হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়।
আজকে একসাথে দু’টো চিরকুট পেয়েছে। এমন ঘটনা আগে ঘটে নাই তাই অবাক হলো ও। প্রথমটিতে ছোট্ট একটা গান লেখা। চেনা সুর, চেনা পঙক্তি:
“হে—হে… আ—হা—আ—হা—হা
হো… তোমাকে ছেড়ে আমি কী নিয়ে থাকব?
ভালোবেসে যাব ওগো যত দিন বাঁচব
হেসোনা হেসোনা তুমি, জেনে রাখো তা,
বলেতো দিয়েছি আমি হৃদয়ের কথা।
হে—হে… আ—হা—আ—হা—হা
হে—হে… আ—হা—আ—হা—হা
হো… তোমাকে ছেড়ে আমি কী নিয়ে থাকব?
ভালোবেসে যাব ওগো যত দিন বাঁচব
হেসোনা হেসোনা তুমি, জেনে রাখো তা,
বলে তো দিয়েছি আমি হৃদয়ের কথা।
চাঁদেরও আলো দিয়ে মুখ খানি দেখব
পেয়ো নাকো লজ্জা, খুব কাছে রাখব,
হো… চাঁদেরও আলো দিয়ে মুখ খানি দেখব
পেয়ো নাকো লজ্জা, খুব কাছে রাখব!”
নাবিলা চোখ বুলিয়ে গেল, হঠাৎ করে গানটার ভেতরের লুকোনো মর্মটা একঝলকে খুলে গেল ওর সামনে। চুপচাপ গানটা বিড়বিড় করে মনে মনে গাইতে লাগল। গান শেষ হতেই বুকের ভেতর কেমন এক উষ্ণ কম্পন টের পেল। আজকাল সবকিছুই বুঝতে পারছে। সামির এমনভাবে ইঙ্গিত করে লিখে দেয় যে, না বুঝে থাকা আর সম্ভব হয় না। নাবিলা অবাক হয়, একসময় এই চিরকুটগুলোতে সে শুধু শব্দ দেখত। আজ সেখানে অর্থ দেখে, অনুভব করে। হয়তো সত্যি সত্যিই সামির ওকে বুঝবার মত করে দিচ্ছে সবকিছু।
দ্বিতীয় চিরকুটটা খুলতেই নাবিলা হেসে ফেলল। ছোট্ট এক টুকরো কাগজে সামির লিখেছে,
“তুমি এখনও আমাকে ‘আপনি’ করে ডাকো। ভাবো তো, আজ্ঞে-সজ্জা দিয়ে কতদিন চলবে? সত্যিই কি আমরা এখনো এতটা দূরের? মানে হ্যাঁ… দূরেই আছি। কিন্তু মনের দূরত্ব কি স্থানভেদের দূরত্বের চেয়েও অনেক বেশি? এই ‘আপনি’ শব্দটা তোমার সাথে মানায় না বরং দেয়াল টেনে দেয়। অথচ আমি চাই, তোমার প্রতিটি শব্দ আমার কাছে হোক একেবারে নিজের মতো।”
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মুখ। ঘরে কেউ নেই, তবু মনে হলো কেউ দেখে ফেলবে। কাগজটা বুকের কাছে চেপে ধরল। “আপনি”… শব্দটা তো এতদিন ওর অভ্যাসে ঢুকে গেছে। কিন্তু সামিরের কথাগুলো সেই অভ্যাস আর ভদ্রতার দেয়াল ভেঙে ফেলতে উঠেপড়ে লাগল। সত্যিই তো, আপনি-আজ্ঞে দিয়ে কি ভালোবাসা আটকে রাখা যায়? ভালোবাসা কি কখনো দূরত্ব চায়? ভালোবাসা তো খামখেয়ালি হয়, উদ্দাম হয়, কখনো কখনো একেবারে অভদ্রও হয়। ভালোবাসা যদি ভদ্রতার চৌকাঠে আটকে যায়, তাহলে সেটা আর ভালোবাসা থাকে না।
.
সামির বলেছে, খুব শীঘ্রই আসবে। তারপর থেকে কলিংবেলের আওয়াজ শুনলে নাবিলার বুকের মধ্যে ধক করে উঠে। এই বুঝি এলো! কিন্তু আসে না… অপেক্ষায় অপেক্ষায় কত ঋতু পেরিয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রকোপ এইবার বড্ড বেশি। ভারি কাপড়েও শীত মানছে না। ও টানা কয়েকদিন জ্বরে ভোগার পর এখন মোটামুটি সুস্থ। তবে ঠান্ডা আছেই, গলা বসে গেছে। রেশমা প্রতিক্ষণে এসে আদা চা দিয়ে যাচ্ছেন। চোখেমুখে এখনও অসুস্থতার ভাব। সামির মাকে ফোন করে জ্বালাচ্ছে। নাবিলা হুট করে অসুস্থ হলো কেন? তোমরা দেখে রাখো নাই? ওষুধপত্র না খেলে সেটার বদলে নিয়ম করে মাইর খাওয়াবা, দেখবার ঠিক হয়ে গেছে। মাইরের উপর কোনো ওষুধ নাই… উফফ, ছেলের যন্ত্রণায় মা বেদিশা।
ওদিকে নীতু নাদিমের পরীক্ষার কারণে আসতে পারছে না। দূরে থেকে তার পরাণ পুড়ছে মেয়ের জন্য। কথা হচ্ছিল মা-মেয়ের মধ্যে। নাবিলা অতিরিক্ত চিন্তা করতে নিষেধ করল। নীতু হঠাৎ কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কিরে, তুই আসবি না আর?”
নাবিলা হালকা করে মাথা নাড়ল। মুখে অদ্ভুত হাসি,
— “হুম, মা।”
মা আবার চোখ মেলে তাকাল। গলায় মৃদু গম্ভীরতা নিয়ে বললেন,
— “আয়। সামনে মোহনার বিয়ে। কথাবার্তা চলছে, খুব তাড়াতাড়ি দিন-তারিখ ঠিক হয়ে যাবে। তোকে ছাড়া হবে না কিছুই। তাছাড়া অনেকদিন তোকে দেখি না, নাবিলা।”
— “তোমরা আসতে পারো না? আমি নাহয় যাই না আমার এখানে ক্লাস আছে। তোমাদের আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না, তাই তোমরাও আসো না।” নাবিলার কণ্ঠে অভিমান ঝড়ে পড়ছিল।
— “সময় মিলাতে পারি না মা। সামিরের কি খবর? আসবে কবে, বলেছে কিছু?”
— “তোমরা শুনে নাও। আমাকে বলে? শুধু বলেছে, হুট করে একদিন এসে হাজির হবে।”
নীতু হাসলেন। জামাই বোধহয় সারপ্রাইজ দেওয়ায় ব্যাপক আগ্রহী। তিনি নাবিলাকে জানালেন না কিছুই। সামিরের সাথে সেদিনই কথা হয়েছে, আসবে খুব শীঘ্রই।
অন্বেষার সাথে প্রায় পড়শীর কথা হয়। তবে ওর খবর কখনোই অন্বেষা ভাইকে দেয় না। এমনিতেই আয়ান এখনো আপসেট। চোখেমুখে দেবদাসের ছায়া ভেসে বেড়ায়। আগের মত কথাবার্তাও খুব একটা বলে না, হাসাহাসি তো দূরেই থাক। সে এখনো তার হারানো প্রেমের স্মৃতিতে ডুবে আছে। অন্বেষার আজ বিকেলেও পড়শীর সাথে কথা হচ্ছিল। মায়ের পছন্দ করা মানুষটার সাথে মেয়েটা একদম ভালো নেই। কাঁপা কণ্ঠে বলছিল,
— “আপু আমার দিন কাটছে না। আমি শুধু একবার ওর সামনে দাঁড়াতে চাই। আর কোনোদিন নয়, শুধু একবার… ওর কাছে ক্ষমা চাইব। এই সুযোগটা কি আমায় দেওয়া যায়?”
কথাগুলো এমনভাবে বলল যে, অন্বেষার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সোজাসুজি না করতে পারল না। ফোনটা নামিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল, কী করবে বুঝতে পারছে না। নাবিলাকে জানাল ব্যাপারটা। দু’জন অনেকক্ষণ ধরে পরিকল্পনা করল, কীভাবে দেখা করানো যায় যাতে বাড়ির কেউ টের না পায়। শেষমেশ ঠিক হলো, একটা নিরপেক্ষ জায়গায় আয়ানকে ডাকবে। জানানো হবে না সেখানে কার সাথে দেখা হবে। সেই জায়গায় আগে থেকেই পড়শী এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। নাবিলা আর অন্বেষা কাছাকাছি কোনো ক্যাফে বা বেঞ্চে বসে থেকে দূর থেকে নজর রাখবে। সবকিছু ঠিকঠাক। পড়শীর ভেজা কণ্ঠ শুধু অন্বেষার কানে বারবার বাজছিল, “শুধু একবার, আপু। শুধু একবার ওর সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে চাই। আমি যা সহ্য করার, তাই করব। আমি জীবন মানিয়ে নিয়েছি। ওকেও মানিয়ে নিতে বলব। ওকে নিদারুণ একটা উপায় শিখিয়ে দিব, ভালো থাকার।”
অন্বেষা আর নাবিলা দু’জনের মনেই একই চিন্তা, এইবার হয়ত পুরনো ক্ষতটাকে একেবারে শেষ বিদায় দিয়ে একে অপরের পথ আলাদা করে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করবে। হোক, একবার দেখা হোক!
নিয়মানুযায়ী ওদের দেখা হলো। প্রকাণ্ড সেই বটগাছটার নিচে দুপুরের রোদ ছায়ায় হারিয়ে গিয়েছিল। আয়ান এসে দাঁড়িয়েই থমকে গেল, কয়েকমাসের ব্যবধানে পড়শীকে চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল। মেয়েটা শুকিয়ে একেবারে পাটকাঠি, চোখের তলায় কালি, মুখে ক্লান্তি। আয়ান ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ভাঙা গলায় বলল,
— “তোমার জামাই খাওয়ায় না? বিয়ের পর নাকি মেয়েরা মোটা হয়… তোমার তো উল্টা হাল হয়েছে।”
কথাটা ঠাট্টার সুরে বললেও, ভেতরে তীব্র কষ্ট আর ক্ষোভ জমে ছিল। পড়শীর চোখ জলে ভরে উঠল। ও সামলে নিয়ে বলল,
— “সব মেয়ের কি হাসি-খুশি সংসার হয়? আমার তো হয় নাই। কষ্ট হচ্ছে। তোমাকে কষ্ট দিয়ে গেছি। কিন্তু আজ এসেছি শুধু ক্ষমা চাইতে।”
আয়ানের বুকটা হাহাকার করে উঠল। চাপা হাসি টেনে বলল,
— “কষ্ট? কষ্ট কাকে বলে তুমি জানো পড়শী? কষ্ট হচ্ছে, যার ভেতরে প্রতিদিন একটা শূন্যতা জেগে ওঠে… আমার ভেতর শূণ্যতা নাই যে কষ্ট পাব। আমি পেয়েছি দুঃখ। এই দুঃখটা তুমি আমাকে দিলে, সেটা নিয়ে আজীবন বাঁচতে হবে।”
— “তুমি কেন দুঃখ পাবে? আমার পাওয়া উচিত। যা করার আমি করেছি।”
আয়ান এবার ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। বলল,
— “না পড়শী, ভুল বলছো। দুঃখ শুধু ভুল করা মানুষের প্রাপ্য নয়। যাকে ভুলের আঘাত সহ্য করতে হয়, তারও প্রাপ্য। তুমি করেছিলে, আমি পেয়েছি। তুমি নিজের শাস্তি পেয়েছো সংসারে আর আমি পেয়েছি নিঃসঙ্গতায়। দু’জনার দু’ধরনের দুঃখ।”
পড়শী ভেঙে পড়ল, চুপচাপ মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল। আয়ান চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে,
— “তবে একটা জিনিস বুঝে রাখো… আমি তোমার ওপর কোনো রাগ পুষে রাখিনি। ভালোবেসেছিলাম, তাই দুঃখ পেয়েছি। আর আজ যদি তুমি এসে ক্ষমা চেয়ে তোমার শূন্যতা আমার ভেতর থেকে মুছে দিতে চাও, তা কখনোই পারবে না।”
পড়শী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আয়ান কেবল দাঁড়িয়ে রইল, মনে হলো বুকের ভেতরে কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। সে গভীর একটা শ্বাস টেনে চোখ ফিরিয়ে নিল পড়শীর ভেজা মুখ থেকে। কণ্ঠ নরম হলেও দৃঢ়,
— “চলে যাও পড়শী। এটা তোমার বাপের বাড়ির এলাকা। কেউ যদি দেখে ফেলে, তোমারই সমস্যা হবে। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার জীবনে আরও ঝড় উঠুক।”
পড়শী কান্না সামলাতে পারল না। আয়ানও একবারের জন্য পেছনে তাকাল না। দূরে বিশাল বটগাছের ছায়া কেবল দীর্ঘ হতে থাকল, যা দু’জনার কষ্টকে আরও লম্বা করে মাটির সাথে বেঁধে রাখল। পড়শী কাঁদতে কাঁদতে বটগাছের গোড়ায় বসে পড়ল। চোখের পানি থামছে না, নিজেও কাঁপছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতেই আবার চোখ অশ্রুতে টাইটুম্বুর হয়ে আসছে। এতটা শক্ত ছিল আয়ান? ওকে ক্ষমা করল না? আয়ানকে কখনোই এত শক্ত মানুষ বলে মনে হয় নাই।
অন্বেষা দৌড়াল আয়ানের পিছে, নাবিলা দৌড়ে গিয়ে পড়শীর কাঁধে হাত রাখল। গলাটা ভিজে এল ওর,
— “আপু, এভাবে ভেঙে পড়ো না। ভাইয়া যতই কঠিন কথা বলুক, নিজেও ভেঙ্গে পড়েছে বলে ওইভাবে বলেছে। তুমিই তো বলেছ, ভাইয়ার ভালোবাসা সাগরের মতো গভীর। এই আঘাতটা এত বড় ছিল যে এখন মানতেই পারছে না।”
পড়শী মাথা নাড়ল, কিন্তু কান্না থামল না। নাবিলা ওকে বুকের কাছে টেনে নিল, হাত দিয়ে মাথা চাপড়ে দিলো ঠিক ছোট বোনকে শান্ত করার মতো।
অন্বেষা এদিকে এগিয়ে এসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আয়ানের পিছু পিছু গিয়েও লাভ হয় নাই। উল্টো আয়ান এমনভাবে তাকিয়েছিল যে অন্বেষা ভয়েই পিছু হটেছে। ওরা দুজন মিলে পড়শীকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। তারপর অর্ধেক পথে এসে শাহিদ ভাইয়া অন্বেষাকে নিয়ে গেল। নাবিলা নির্জন পথে দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে ভাবতে লাগল, “ভালোবাসা জিনিসটাই কী অদ্ভুত! এই পৃথিবীর বুকে মাত্র কিছুক্ষণ আগে দু’জন ভালোবাসার মানুষ বিচ্ছিন্ন হলো। আবার এইমাত্র দু’জন পরিপূরক হয়ে গেল। হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম। পৃথিবী কখনোই শূন্যস্থান রাখে না। কোনো না কোনোভাবে, কারো না কারো মাধ্যমে সেই জায়গা পূরণ করেই দেয়।” একমুহূর্তের জন্য নাবিলা নিজের হৃদয়ের দিকেও তাকাল। সামিরের নামটা অজান্তেই মনের ভেতর গুঞ্জন তুলল। মৃদু হাসি ফুটল ঠোঁটের কোণে। বাড়ি এসে সামিরকে একটা মেসেজ পাঠাল,
— “ইয়ে মানে শোনো, একটা কথা ছিল।”
এখন নাবিলা সামিরকে তুমি সম্বোধন করে। কিন্তু নাবিলার জন্য এটা সহজ ছিল না। প্রথম প্রথম কোনো সম্বোধন ছাড়াই কথা বলত। যেমন-
“খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?” “দিনকাল কেমন যাচ্ছে?” “মামণির সাথে বোধহয় আজ কথা হয় নাই। এত ব্যস্ততা? মামণি ফোন করতে বলেছে।”
সামির ব্যাপারটা খেয়াল করে বলেছিল, এভাবে পর হয়ে দূরের মানুষের মত কথা বললে তার সাথে কথা বলার দরকার নেই। এ কথায় নাবিলা আর অভিমান করে নাই। অনেক হয়েছে অভিমানের পর্ব। তারপর থেকে সামিরকে তুমি বলেই আসছে। তবে ইদানীং সে আবার ঢং শুরু করছে। নাবিলাকে আপনি সম্বোধন করছে। বলেছে, প্রায় তিনটা বছর নাবিলা ওকে আপনি-আজ্ঞে করেছে, এইবার সামিরের পালা। সে মেসেজের পাল্টা রিপ্লাই দিল,
— “জি ম্যাডাম, বলুন।”
— “ভালো লাগছে না।”
সামির সাথে সাথেই উত্তর দিল,
— “কেনো? কি করতে পারি বলুন?”
— “কি করবে জানো না? একটু কথা বলো আর একটু সময় দাও এখন।”
— “শুধু সময় চান? আমাকে না?”
নাবিলা খানিক ইতস্ততবোধ করে লিখল,
— “তুমি তো আমারই আছো, তা আমি জানি। শুধু সময়টাই মাঝে মাঝে আমার কাছে কম পড়ে।”
— “আমাকে আসতে বলছেন না কেনো নাবিলা? আপনি কি জানেন, আমি আপনাকে যতটা মনে করি, ততটা মনে করাকে কোনো ভাষায় বোঝানো যায় না। আমার চারপাশে মানুষ থাকে কিন্তু আপনাকে ছাড়া সবকিছু ফাঁকা লাগে। আপনি একবার বলেন, ‘এসো’, আমি সব ফেলে আসব। আমি চাই না আপনি একা এই অভিমান, এই অপেক্ষা নিয়ে থাকেন। আমি এসে আমার নিজস্বতা প্রকাশ করতে চাই।”
নাবিলা অনেকক্ষণ চুপ থেকে লিখল,
— “আসো তবে।”
— “তাই? বলছেন? আসব?”
— “হুম।”
— “হুম না, ম্যাডাম। ভালো করে বলেন, ইয়েস ওর নো। পরে আবার আফসোস কইরেন না।”
নাবিলা কাঁপা হাতে শুধু একবার না, পরপর কয়েকবার লিখল,
— “ইয়েস… ইয়েস… ইয়েস…”
— “আমি এলে আমাকে কিন্তু আর ফেরাতে পারবেন না।”
— “আমি তো ফেরাতে চাই না।”
— “কী চান?”
— “তোমাকে।” নাবিলার সহজ এবং সবচেয়ে সুন্দর স্বীকারোক্তি। সামিরের ঠোঁটে হাসি ফুটল। এইটারই অপেক্ষায় ছিল সে। অবশেষে এত অপেক্ষা, প্রতীক্ষার পর নাবিলা সুস্পষ্টভাবে তাকে চাইল! ভেতরের অস্থিরতা চেপে আবারও মেসেজ দিল,
— “আচ্ছা এলে কি হবে শুনি? আমার এই বুকের ভেতর এতদিন জমে থাকা কথা, জমে থাকা ভালোবাসা যদি একসাথে ঝরে পড়ে, সামলাতে পারবেন?”
ইতোমধ্যে নাবিলার চোখ ভিজে উঠেছে। দেহ-মন একসাথে বিদ্রোহ করছে,
— “সব পারব।”
সামির চোখ টিপি ইমোজি দিয়ে লিখল,
— “সবই পারবেন? বাড়াবাড়িও?”
— “বাড়াবাড়ি মানে?”
— “থাক, যখন আসবো তখন বোঝাবো। এখনো ছোট বাচ্চা রয়ে গেছেন তাইনা?”
নাবিলা দ্রুত লিখল,
— “আসলেই বুঝিনি।”
সামির ছলে জানিয়ে দেয়,
— “হুম, ইনোসেন্ট! বাট পরে রাতের ঘুম হারাম হলে আমাকে কিছু বলতে আইসেন না।”
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে নাবিলার গাল লাল হয়ে গেল পাকা টমেটোর মত। লিখল,
— “অসভ্য!”
সামির মনে মনে বেশ হতাশ হলো,
— “অসভ্যতামি তো করলামই না। করলে কি বলতেন?” তার প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্টভাবে দুষ্টু মেজাজ আর লাজুক হাসি মিলেছে। এদিকে ক্রমশ নাবিলার হৃদয় উষ্ণ হয়ে উঠছে। নাবিলা হেসে লজ্জায় চোখ মেলে মেসেজ লেখে,
— “তখন বলতাম অসভ্য স্কয়ার! ভালো হয়ে যাও সামির ইয়াসির।”
সামির অল্প হেঁসে রহস্যময় ভঙ্গিতে জবাব দিল,
— “আরেকটু অসভ্যতামি করেই ভালো হয়ে যাব, প্রমিস। বয়সটা তো বুঝতে হবে তাই না!”
সামিরের মন এখন নিশ্চুপ আনন্দে ভরে গেছে। হঠাৎ বন্ধু অর্জুন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— “কী ব্যাপার ব্রো? কী কাহিনী চলছে?”
— “কিছু না, শুধু একজনকে মনে পড়ল।”
— “ওহ, তোমার ওয়াইফকে?”
— “বলব না।” সামির হেসে কপালে হাত দিল।
নাবিলার সঙ্গে কথোপকথনের শেষে সবটা হঠাৎ করে শিথিল হয়ে গেল। অশান্তি, দ্বিধা, অবিশ্বাস, অস্পষ্টতা, ভুল বোঝাবুঝি সবই দূরে চলে গেছে। মনে হচ্ছে যেসব দুরুত্ব, কষ্ট, মান-অভিমান এতদিন দু’জনকে অচেনা দূরত্বে আটকে রেখেছিল, তা এখন ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে। সামিরেরও সমস্ত অবরোধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। নাবিলা এবং সে; দুটি মন একসাথে, এক সুন্দর সুরে মিলে গেছে নতুন জীবনের আশায়।
.
ওই ঘটনার পর থেকে বাড়ির সবাই কামিনীর প্রতি মনক্ষুণ্ণ। সবাই ওর সঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছিল। আয়ান তো কথাই বলে নাই আর। শাশুড়িও যতটা সম্ভব দূরে ছিলেন। রায়হানের মেজাজ এখনও স্থির হয়নি; কষ্ট, ক্ষোভের মিশ্রণে সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। অন্বেষা মাঝে মাঝে আসে। ইচ্ছে হলে কথা বলে, না হলে না।
কামিনীও শান্ত থাকতে পারছে না। মাঝেমাঝে হঠাৎ মন খারাপ লাগে। মনে হয়, হয়ত সত্যিই ভুল করেছে। কিন্তু স্বীকার করতে বা ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে না। আড়ম্বরহীন দুঃখ মিলেমিশে তার ভেতরে চাপা অনুভূতি তৈরি করেছে। কিন্তু ও চায় না, কেউ তাকে দেখুক এমন ভঙ্গিতে; ও যে ভেতরের এই মনস্তাপের সঙ্গে একাকী লড়াই করছে, এটাও কাউকে জানাতে চায় না।
আজকে শরীরটা খারাপ। আচমকা মাথাটা ভারী লাগছে। এক-দু’বার মাথা ঘুরে বসেও পড়ল বিছানায়। রায়হান খেয়াল করে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে? এমন করছ কেন?”
কামিনী চোখ বুঁজে মাথা ধরে বলল,
— “এমনিতেই মাথাব্যথা করছে…”
রায়হান একটু কটাক্ষের সুরে বলল,
— “সারাক্ষণ মাথাটা যদি অন্যের ব্যাপারে খাটাও, তাহলে ব্যথা তো করবেই!”
কামিনী বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকাল। গলাটা দুর্বল শোনাল,
— “সবকিছুতেই খোঁটা দিতে হবে? আমি কি ইচ্ছে করে অসুস্থ হচ্ছি নাকি?”
রায়হান দেখল, কামিনীর মুখটা আজ কেমন অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে। চোখদুটোও ভারি লাগছিল। শীতল উদ্বেগ তার বুকের ভেতরে জমা হতে শুরু করল, যদিও মুখে প্রকাশ করতে চাইছিল না। রায়হান এগিয়ে এসে হাত রাখল কামিনীর কপালে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— “জ্বর তো নেই। হয়তো দুর্বল লাগছে… খেয়ে-দেয়ে একটু রেস্ট নাও।”
তারপর অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। দুপুরের কিছু পরেই ইয়াসমিনের ফোন এল। কণ্ঠে এক ধরনের তাড়াহুড়ো নিয়ে রায়হানকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলল। কামিনী নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। রায়হান তৎক্ষণাৎ কোনোকিছু না ভেবে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। ডাক্তার নিয়ে সোজা বাড়ি এলো। চেকআপ করে ডাক্তার জানাল,
— “চিন্তার কিছু নেই। উনি প্রেগন্যান্ট।”
ইয়াসমিন প্রথমেই মুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন,
— “আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ্র রহমত।”
রায়হান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এতদিন ধরে ভেতরে জমে থাকা অভিমান, রাগ সবকিছু মুহূর্তেই কোথাও মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে অজান্তেই হাসি ফুটল। সবাই চলে যাওয়ার পর কামিনী রায়হানকে বলল,
— “আমি কি তবে একটা সুযোগ পেয়েছি, তোমার থেকে ক্ষমা পাওয়ার।”
রায়হান সরাসরি উত্তর দিল না। শুধু হাত বাড়িয়ে কামিনীর হাত চেপে ধরল। ধরা হাতের ভেতরেই সব উত্তর লুকানো ছিল।
খবরটা শোনার পর নাবিলাও খুশি হলো। যতই মনোমালিন্য থাকুক, দোষ-অভিমান থাকুক, একটা নতুন জীবনের আগমন তো সবার জন্যই আশীর্বাদ। যা-ই হোক, এমন খবরে মুখ কালো করে রাখা যায় না। জীবন তো এরকমই; একদিকে দুঃখ, অন্যদিকে আবার নতুন আশা।
পরের মাসেই নাবিলা নিজের বাসায় চলে এলো। অনেকদিন পর ফিরেছে, তাই আসার সাথে সাথে বাড়ির বাতাসটাই অন্যরকম হয়ে উঠল। মোহনা হচ্ছে ওর চাচাতো বোন। ওর বিয়ে নিয়েই হুল্লোড় লেগে আছে। মোহনার হাসি, লজ্জা, উচ্ছ্বাসে ঘর-বাড়ি মুখরিত। নাবিলা কয়েকদিনের জন্য ওদের বাড়িতেই থেকে গেল। বিয়ের হুল্লোড়ের মাঝেও নাবিলার চোখ বারবার অন্যদিকে ভেসে যাচ্ছে। ঘরে, উঠোনে, বারান্দায় যত জোড়া জোড়া কাপল চোখে পড়ছে, ততই ওর মনে শুধু সামিরের ছবি ভেসে উঠছে।
সেই থেকেই রাতে অন্ধকার ঘরে শুধু ঘড়ির নিঃশব্দ টিকটিকি এবং দূরে বাতির ফিকে আলোয় নাবিলা কাগজে কলম চালাচ্ছে। ব্যস্ততা নেই শুধু অনুভব রয়েছে। কোনো ফাঁকি নেই, কোনো ভান নেই। লিখে চলছে অবিরত,
“তুমি আমার জীবনের সবকিছু। তুমি যখন পাশে থাকো, এই পৃথিবীর সব শব্দ নীরব হয়ে যায়। তোমার হাসি, তোমার ভ্রু কুঁচকানো, তোমার নীরব উপস্থিতি সবই আমার কাছে অমূল্য। আমি মনে মনে সেই বাইকের পেছনের মুহূর্তগুলো মনে করি, যেখানে বাতাসে তোমার গায়ের ঘ্রাণ আমার সঙ্গে মিশে যায়। তোমার কাঁধে হাত রাখলে মনে হয়, পৃথিবীর সব শব্দ থমকে গেছে। তোমার জড়িয়ে ধরার সেই মুহূর্তগুলো, যেখানে তুমি আমার কাছে ছিলে আর আমি তোমার কাছে; সেই অনুভূতি আমার হৃদয়ে চিরস্থায়ী। এই মুহূর্তগুলো চিরকাল মনের গহীনে থাকবে, কাগজেই কোনভাবেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। তুমি যা, আমি তাই। আমার সময়, খাওয়া-দাওয়া, অভিমান, অনুভূতি, শ্বাস-প্রশ্বাস, স্পর্শের তীক্ষ্ণতা; সবই তোমার। অতঃপর আমার আমি শুধু তোমারই।”
.
.
.
চলবে….
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৮]
~আফিয়া আফরিন
সকালের রোদ জানালা দিয়ে হাওয়ার সাথে ঘরে ঢুকছিল। নাবিলা তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল। বিরক্ত ভঙ্গিতে চোখ কুঁচকে তাকাল। স্ক্রিনে অন্বেষার নাম ঝলমল করছে। পুরোপুরি ঘুম ভাঙ্গতেই কল কেটে গেল। বাজখাঁই আওয়াজ বন্ধ হওয়ায় নাবিলা ফের বালিশে মাথা রাখল। কিন্তু শান্তি নাই। অন্বেষা ফের ফোন করেছে। ফোনটা কানে নিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলল,
— “হ্যালো… বলো আপু।”
— “ঘুমাচ্ছো এখনও? বারোটা বাজে!”
নাবিলা হাই তুলে মৃদুস্বরে বলল,
— “কাল রাতে তো ঘুমাইনি… কিছুক্ষণ আগে ঘুমালাম।”
অন্বেষা কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— “কি করছো এত রাত জেগে? সামিরও তো নেই। সে থাকলে তো রাত জাগা সার্থক।”
নাবিলা আঁতকে উঠে বসে পড়ল। কপাল চাপড়ে হেসে বলল,
— “ধুর আপু! কাজিনদের সাথে অনেকদিন পর আড্ডা জমেছিল। গল্প করতে করতে রাত কেটে গেছে।”
অন্বেষা হেসে নিস্পৃহ স্বরে বলল,
— “ওহ আচ্ছা।”
— “তুমি বলো, কি হয়েছে?”
— “সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
অন্বেষার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে নাবিলা চমকে উঠল। চোখ মেলে সতর্ক গলায় বলল,
— “কি হয়েছে আপু?”
ফোনের ওপাশে অন্বেষা একদম চুপ। কথাগুলো মুখের ভেতর আটকে গেছে। উসখুস করছিল। অনেকক্ষণ পর নাবিলা বিরক্ত হয়ে বলল,
— “আপু, এইভাবে চুপ করে থাকলে তো আমার হার্টফেইল হবে। আসলে কি হয়েছে? প্লিজ বলো।”
অন্বেষা গলা খাঁকারি দিয়ে আবার থেমে গেল।
— “আসলে ব্যাপারটা… মানে, কীভাবে বলব বুঝতেছি না।” ওপাশ থেকে মৃদু নিঃশ্বাস ভেসে এলো। তারপর অন্বেষা ধীরে বলল, “আই’ম প্রেগন্যান্ট।”
নাবিলা কয়েক সেকেন্ড একেবারে বোবা হয়ে গেল। তারপর আচমকা হুঁশ ফিরে আসতেই অবিশ্বাসে চিৎকার দিয়ে উঠল,
— “কি! আবার বলো, আপু… কী বললে তুমি?”
অন্বেষা একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
— “হুম, যা শুনছ ঠিকই। শাহিদ বাবা হতে যাচ্ছে।”
নাবিলা দু’হাত মাথায় দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল, ঠোঁটের কোণে অনিয়ন্ত্রিত হাসি।
— “ওহ মাই গড! সিরিয়াসলি আপু? সত্যি? কবে জানলে?”
— “আজ সকালে টেস্ট করে নিশ্চিত হলাম।”
— “আলহামদুলিল্লাহ! এ তো দারুণ খবর! আমি তো এক্সাইটমেন্টে কাঁপতেছি।”
নাবিলা বিছানা ছেড়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সকালটা তার কাছে একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল। অন্বেষার সাথে প্রথম থেকেই ওর সম্পর্ক ভালো, ওকে একদম ছোট বোনের মত ট্রিট করে। তাই হয়ত নাবিলার বুকের ভেতরটা উথালপাথাল হয়ে যাচ্ছিল। ফোনের ওপাশে অন্বেষার গলাটা একদম নিচু, কুণ্ঠিত হয়ে এলো,
— “আমার না লজ্জা লাগছে। কেউ এখনও জানে না। তোমার ভাইয়াও না।”
নাবিলা চোখ কপালে তুলল।
— “ওমা! বলো নাই এখনও?”
অন্বেষা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু ইতস্তত করে বলল,
— “না। কীভাবে বলব? বললেই তো সবাই এখন আমাদের কাহিনী জেনে যাবে।”
নাবিলা ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
— “কি কাহিনী?”
— “ইয়ে মানে… আমাদের কাহিনী।”
নাবিলা হেসেই ফেলল,
— “আরে, তুমি এসব নিয়ে লজ্জা পাচ্ছো? এতদিন না নিজেই সবাইকে লজ্জা দিতে!”
অন্বেষা হুঁ হুঁ করে উঠল,
— “তা ঠিক আছে, কিন্তু আমার কি হবে? এখন আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছি, ভাবতেই কেমন অস্বস্তি লাগছে।”
— “ধুর, বাচ্চার আগে তার মা নিজেই বাচ্চা হয়ে বসে আছে। শোনো, এটা গর্ব করার বিষয়; অস্বস্তির না। তুমি নতুন একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনতে চলেছ, এটাই তো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর খবর। যাও গিয়ে ভাইয়াকে বলো। আর নাহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার ভান করো।”
অন্বেষা চিন্তিত হয়ে বলল,
— “হবে না। হাসি আসবে।”
— “তাহলে এমন কিছু করো যাতে তোমার শাশুড়ির চোখে পড়ে। তিনি যেনো বুঝতে পারেন। এই ধরো, বমি করা কিংবা তিনবেলার জায়গায় ছয়বেলা খাওয়া।”
— “তাই করব?”
— “হুম। আর শোনো, সাবধানে থাকো। আমি মামণিকে ফোন দিয়ে বলছি। ও হ্যাঁ, মামণিকে বললেই তিনি সবাইকে বলে দিবে। তোমার কষ্ট করতে হবে না। ওয়েট করো, ওকে?”
নাবিলা মামণিকে ফোন করে খবরটা জানাতেই ওপাশ থেকে আনন্দ বিস্ফোরণ ঘটল। একসাথে দু’দুজন নতুন অতিথি আসছে পরিবারে। বাড়ির সবাই খবরটা শুনে খুশিতে আত্মহারা। ইয়াসমিন খুশি মনে সবার জন্য দোয়া করলেন। নাবিলাও খুব খুশি তবে দুঃখ একটাই। এই সুখবরের মিষ্টি খাওয়া হলো না। তবে আনন্দটা ভাগাভাগি করতে পারছে কিন্তু সরাসরি ছুঁতে পারছে না।
.
গত কয়েকদিন যাবত নাবিলার সাথে সামিরের কথাবার্তা কম হচ্ছে। সামির নিজেই বলে দিয়েছিল, একটু ব্যস্ত থাকবে। এরমধ্যে সুযোগ মেলাতে পারলেই কথা হবে। তাই হচ্ছে। কথাগুলো হচ্ছে ছাড়া-ছাড়া, মাঝেমাঝে হঠাৎ করেই। আগের মতো প্রতিদিনের প্রতিটি ছোটখাটো ঘটনা শেয়ার করা বা রাতভর গল্প করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবুও নাবিলার মনখারাপ হয় না। কারণ ও জানে, সামিরের কথা সত্যি। ব্যস্ততা যে আসলেই আছে, সেটা বোঝার মতো বোধবুদ্ধি ওর হয়েছে। আগের নাবিলা হলে হয়তো অভিমান করত কিন্তু এখন আর করে না। এখন সে বুঝে গেছে, ভালোবাসা মানে শুধু সারাক্ষণ পাশে বসে থাকা নয়; বিশ্বাস করে পাশে থাকাও একধরনের ভালোবাসা।
নাবিলা আগের সেই কথায় কথায় মুখ ভার করে থাকা মেয়েটা নেই। বয়সের কাঁটা কুড়ি পেরিয়ে এসে এখন ২২ ছুঁয়েছে। বয়সের সাথে সাথে অনেকটাই বদলে গেছে। কিশোরীর আবেগপ্রবণতা ছেড়ে এক ধরনের পরিণত ভাব এসে গেছে ওর চোখেমুখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও আগের মতো অবহেলা নেই। মাঝে মাঝে ক্লাস বাদ দিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার অভ্যাস এখনো আছে বটে, তবে সেটা একদম বেপরোয়া পর্যায়ের নয়।
নাবিলা সবচেয়ে বড় হয়েছে মননশীলতায়। এখন ও সহজে ভেঙে পড়ে না, ছোটখাটো তর্ক-বিতর্কে জেদ ধরে বসে থাকে না। বরং চুপচাপ শুনে যায়, বোঝার চেষ্টা করে। জীবনের প্রতি ওর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি পরিষ্কার। তবুও এই বড় হওয়ার মাঝেও নাবিলার ভেতরে আলাদা শীতলতা আছে। ওর হাসিটা এখনও আগের মতো নির্মল, লাজুকতা এখনও ওর চাহনির কোনে লুকিয়ে থাকে। পার্থক্য শুধু এই, এখন ও জানে কাকে নিয়ে লাজুক হবে আর কাকে নিয়ে সাহসী!
বয়স বাড়লেও, ভালোবাসার গভীরতায় ও এখনও সেই ছোট্ট মেয়েটাই যে প্রথম চিরকুট পেয়েছিল, আর বুক ভরে বুকের গহীনে তা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল।
আজ মোহনার বিদায় ছিল। গাড়ি বেরিয়ে গেছে আরও কিছুক্ষণ আগেই। বাড়ির উঠোনে এখনও মৃদু হাহাকার, কান্নার সুর তবে তা প্রায় মিলিয়ে যায় যায় অবস্থা… গুমোট একটা শূন্যতা চারপাশে বসে আছে। নীতু আজকের দিনটা এখানে থেকে কাল বৌ-ভাতের অনুষ্ঠানের পর সরাসরি বাড়ি ফিরবেন বলে জানিয়ে দিলেন। নাবিলাও মেনে নিয়ে ড্রইংরুমে এলো। এখানে মুরুব্বিরা উপস্থিত। প্রতিবেশী আন্টি, অন্যান্য আত্মীয়রা হাসি-ঠাট্টা করছে, নাবিলা অংশগ্রহণ না করলেও এসে বসল। ভদ্রতা বলেও একটা কথা আছে, কাকি অনেকক্ষণ যাবৎ ওকে মেহমানদের সাথে কথা বলতে বলছিলেন।
চা-বিস্কুটের প্লেট ঘুরছে এক হাত থেকে আরেক হাতে। হঠাৎই পাশের চেয়ারে বসা এক আন্টি নাবিলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
— “কি খবর নাবিলা? জামাই কবে আসবে? তুমি তো জামাইয়ের কোনো খবরই দিলে না।” বলেই হো হো হেসে উঠলেন।
নাবিলা মাথা নিচু করে ছোট্ট উত্তর দিল,
— “আসবে।”
— “শুনছিলাম তো দেড় বছরের কথা। তা তো কবেই পার হয়ে গেছে।”
— “হ্যাঁ। সবকিছু গোছগাছ করতে তো সময় লাগে আন্টি। তাছাড়া বললেই তো আসা হয় না।” নাবিলা কথাটা ঠাণ্ডা গলায় বললেও ওর মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি ছিল।
আন্টির থামার নাম নেই। এবার একরকম বকেই উঠলেন,
— “তোমাকে নিয়ে গেলেই পারত। ছেলেমানুষের ওরকম একলা একলা বউ রেখে বাইরে থাকা ঠিক না।”
নাবিলা শক্ত কণ্ঠে বলল,
— “আমাকে নিয়ে কি করবে? আমার পড়াশোনা হচ্ছে এখানে।”
সকাল থেকে… আসলে না, এখানে আসার পর থেকেই এদের অনেকভাবে এড়ানোর চেষ্টা করছিল। অবশেষে এখন এসে ঠিক জাপ্টে ধরেছে। এইরকম অবস্থাই চলছে, মানুষজনের কথার শেষ নেই। আরেকজন পাশ থেকে যোগ করল,
— “জামাই ছাড়া বোনের বিয়েতে আসছো? অন্ততপক্ষে বিয়ের জন্য জামাইকে আসতে বলতা। কয়েকদিন এসে বেরিয়ে যেতো।”
নাবিলার মুখ কালো হয়ে গেল। সামির কি শুধুমাত্র যাওয়া-আসা করবে বলেই গেছে নাকি? ও যখন ফিরবে, তখন একেবারেই ফিরবে। নাবিলার ভাবনার মাঝেই আরেকজন মুখ টিপে হেসে বললেন,
— “মন খারাপ করো না বাপু। ছেলে মানুষকে এত উড়তে দিলে কিন্তু চরিত্র নষ্ট হয়। এই যে, বাইরে একা থাকে। কে জানে না জানে, কি করছে! চোখকান খোলা রেখো। দুনিয়া বিশ্বাস করা যায় কিন্তু ছেলে মানুষ না। তোমার ভালোর জন্যই বললাম। তুমি তো এখনও অনেক ছোটো, এসব বিষয়ে এত জ্ঞান নেই।”
নাবিলা আঁকড়ে ধরল নিজের ওড়নার প্রান্ত। বুকের ভেতর কেমন ধকধক করতে লাগল। তবে মুখে কড়া একটা হাসি ফুটাল। হেসে হেসে জবাব দিল,
— “আন্টি, ছেলে মানুষকে উড়তে দিলে চরিত্র নষ্ট হয়, এই কথাটা শুনে অবাক লাগছে। চরিত্র যদি এত সস্তা হতো, তাহলে আপনাদের বাড়ির ছেলেদেরও তো আটকে রাখা উচিত। কাছে থাকুক অথবা দূরে, চরিত্র নষ্ট হলে নিজেদের চুলকানি স্বভাবের কারণেই নষ্ট হয়। বিশ্বাসটা জিনিসটা খুব বড় আর আমি আমার স্বামীকে বিশ্বাস করি।”
একজন মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— “বিশ্বাস করলে ভালো, কিন্তু অন্ধ হলে তো বিপদ।”
নাবিলা আর দমল না। শান্ত দৃঢ় স্বরে বলল,
— “অন্ধ হলে বিপদ, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সন্দেহে জীবন চালালে তারচেয়ে বড় বিপদ নেই। আমার স্বামীকে আমি যতটা চিনি, ততটা আপনারা কেউ চেনেন না। তাই এ নিয়ে আর কোনো আলোচনা না হলে ভালো লাগবে।”
ঠোঁটের কোণে কড়া হাসিটুকু বজায় রেখেই নাবিলা ভেতরে চলে গেল। কানে তখনো বাজছে লোকজনের গুঞ্জন কিন্তু আর কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না।
দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নীতু। মেয়ের প্রতিটি কথা তিনি শুনেছেন। একটু চিন্তায় ছিলেন কিন্তু পরিস্থিতি নাবিলা যেভাবে সামাল দিল তাতে গর্বই হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে, এই তো আমাদের সেই মেয়েটা… ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে কিছু বললে মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে প্রতিবাদ করতে জানে। মুখে একরাশ তৃপ্তির ছাপ নিয়ে নীতু ঘরে ঢুকলেন। আর নাবিলা তখন নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে বিছানায় বসল। ও যাই বলুক না কেন, মনের মধ্যে রাগের আগুন জ্বলে উঠেছিল। রাগে ফুঁসছে রীতিমতো।
কানাডায় সামিরের শিক্ষাজীবন সম্পুর্ণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা, প্রজেক্ট, ল্যাবরেটরি সব শেষ। এখন তার ব্যস্ততা অন্যদিকে। কাজের পরিকল্পনা, চাকরি সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে মনে হলো, এখানে আর ভাল্লাগছে না। যা করার সবটা দেশে ফিরে গিয়ে করবে। তবে ফিরে গিয়ে যেন কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়, তাই সব ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত।
আজকের ব্যস্ততা তুলনামূলক কম। সকালটা ঘরে বসে হালকা কাজে কাটিয়েছে, তারপর বাড়িতে কথাবার্তা বলে একটু অবসর নিয়েছে। কফি নিয়ে সামির বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। এই শহরের প্রতি বোধহয় একটু মায়া পড়ে গেছে। প্রথমদিকে সবকিছু নতুন লাগত, আজকাল নিজের শহরের মতই মনে হয়। ট্রানজিটের আওয়াজ, আকাশছোঁয়া বিল্ডিং, রাস্তাঘাটে ব্যস্ত মানুষের ভিড়; সবই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
সামির কোলাহল পছন্দ করে না খুব বেশি। তাই শহরের একেবারে ডাউনটাউনের ভিড়ভাট্টার মাঝখানে নয় বরং থাকার জন্য একটু নির্জন, শান্ত এলাকা বাছাই করেছে। এখান ট্রানজিটের সহজ সুবিধা আছে কিন্তু জানালা খুললেই গাছপালা, খোলা আকাশ আর পাখির ডাক পাওয়া যায়। সকালে হালকা শিশির জমে থাকে ঘাসের গায়ে আর বিকেলের রোদটা বড় মোলায়েম, গায়ে লাগলে শান্তি লাগে। এখন তো আবার গাছের পাতাগুলো ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে; সবুজ থেকে হলুদ, লাল, কমলা হয়ে উঠে পুরো শহরটাকে একটা রঙিন ক্যানভাসে পরিণত করেছে। সামিরের প্রকৃতি বিলাসের মাঝে অর্জুন পাশে এসে দাঁড়াল, ওর হাতেও কফির মগ। চেন বর্তমানে এখানে নেই, স্বদেশে ফিরে গেছে।
অর্জুন কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
— “ এই শহরটাকে এখন আর আগের মত লাগে না। প্রথম যখন এসেছিলাম তখন কত বড় লাগত। এখন মনে হয় সবই চেনা-পরিচিত, সবই ছোট।”
সামির হেসে মাথা নাড়ল,
— “হ্যাঁ, অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু জায়গা এখনও টানে… এখনও ডাকে।”
— “মানে?”
সামির কফির মগটা পাশে নামিয়ে রাখল,
— “মানে… যেখানেই থাকি, কিছু না কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এখানে থেকে গেলে অন্যকিছুর অভাব লাগে, আবার না থেকেও পারা যায় না।”
অর্জুন হেসে উঠল,
— “তাহলে মন অন্য কোথাও পড়ে আছে বুঝি?”
সামির কপালে ভাঁজ ফেলে বাইরে তাকাল। রাস্তার গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে,
— “আসলে মন অন্য কোথাও পড়ে আছে তা না, মনটা ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানেই থাকা যায়, আবার না থাকলেও চলে। দেশে ফিরব, না ফিরলেও চলবে না; চরকির মত ঘুরতেছি।”
— “যাইহোক, আমাদের দেখা তো হতেই থাকবে।”
সামির মৃদু হাসল। অর্জুন বেশিক্ষণ থাকল না, একসপ্তাহ পর ওর ফিরতি ফ্লাইট। কিছু কাজকর্ম আছে, সামিরকে বলে বেরিয়ে গেল। এরইমধ্যে নাবিলার মেসেজ এলো,
“তুমি যদি সঠিকভাবে আমাকে না বলো কবে আসবে, তাহলে এরপর আর মেসেজ দিবে না বলে দিলাম। ফাজলামি পাইছো? তোমার এই ফাজলামি দেখার জন্য আমি বসে নেই।” মেসেজটা পড়েই সামির হো হো করে হেসে উঠল। এই যে আরেকজন… বড্ড টানে। মুখে বলে না কিছু কিন্তু ওর না বলা কথা, শব্দ, রাগী ঝাঁজ, হাসিখুশি কাজকর্মের ভেতরেই এমন টান লুকিয়ে থাকে যে পালিয়ে থাকা যায় না। সামিরও পারে না তবুও সারাজীবন পাশে থাকার জন্য কিছু সময় পালিয়ে থাকতেই হচ্ছে। সামির বেশ গুছিয়ে রিপ্লাই দিল,
“শোনেন নাবিলা, আমি আগামী ৪৮ ঘণ্টা নেটওয়ার্কের বাইরে থাকব। মানে, এই দু’দিন আপনার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হবে না। কিছুটা চাপে আছি। ব্যস্ততা সেরে উঠলেই যা জানতে চাইবেন সব বিস্তারিত জানিয়ে দিবো।”
রাগে-দুঃখে নাবিলার ব্রক্ষতালু জ্বলে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁপা হাতে কী-বোর্ডে টাইপ করতে লাগল। প্রথমে কিছু কাটাকাটি করল, আবার টাইপ, আবার মুছে ফেলল, শেষমেষ স্থির হলো এক বাক্যে, “তোমার ব্যস্ততা তুমি তোমার পকেটে রাখো। আমাকে দেখাতে আসবে না। তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না।”
সামিরের সাথে দু’দিন কথা না হলে মনটা যে সত্যিই শূন্য হয়ে যাবে, সেটা নাবিলা জানে। তাই রাগ লাগছে। রাগের মাত্রা আরও বাড়ল তখন, যখন সামিরের রিপ্লাই এলো না।
ভেতরের রাগটা চেষ্টা করেও সামলাতে পারছিল না। ইচ্ছেমত কাউকে দোলাই-মচড়াই করলে ভালো লাগত! উঠে গেল, ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল নাদিমকে। ও ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে হইচই করছে। নাবিলা গলা চড়িয়ে একটা রামধমক দিল,
— “সারাক্ষণ তোর বান্দরের মতো লাফালাফি করতে হয়? পড়াশোনা করা লাগে না? সারাদিন কি শুধু খেলাধুলাই করিস? বেয়াদব, যা গিয়ে বইখাতা নিয়ে বস।”
কথা বলেই ঘুরে চলে গেল নাবিলা। নাদিম থমকে দাঁড়িয়ে রইল। কী হলো এটা? সে তো এসেছে মোহনা আপুর বিয়েতে, আনন্দ করার জন্য! বইখাতা কি সঙ্গে বেঁধে নিয়ে আসছে? সবাই মজা করছে, খেলছে, সে-ও তাদের সাথে, এতে দোষটা কোথায়? ক্ষণিকের জন্য একদম চুপসে গেল কারণ ছোটো বাচ্চারা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বিষয়টা নাদিমের মানে লাগল। ছোট হলেও, সম্মানটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেল।
.
পড়শীর সংসারটা একরকম নিঃশব্দ যুদ্ধক্ষেত্র। বাইরে থেকে সবকিছু ঠিকঠাক, সাদামাটা রুটিন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিশাল শূন্যতা। স্বামী মহাশয় নিজের জগতে ডুবে থাকে। সবকিছুর জন্য সময় আছে, কিন্তু পড়শীর জন্য কিছুই নেই। একই ঘরে, বিছানায় থাকা হলেও কথাবার্তায় উষ্ণতা নেই, নেই মনের টান।
বর্তমানে ওদের সম্পর্কটা বিশাল সমুদ্রের মাঝখানে একখানা ভেলার মতো। ভেলা আছে ঠিকই, কিন্তু ভাসমান আর অস্থির। হাল ধরার মতো কেউ নেই। যেকোনো মুহূর্তে ঢেউ এলে সেটা ভেসে যেতে পারে। পড়শী আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে না শুধু চুপচাপ সয়ে যায়। প্রায়শই ছোটখাট কথা দিয়ে ওকে তাড়া করা হয়, এমনকি মারাত্মক শারীরিক চাপও সহ্য করতে হয়। এই চাপ ওর হৃদয় ভেঙ্গে খানখান করে ফেলে। রাতের নিঃশব্দ অন্ধকারে ওর বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে। ভাবে, “এটাই কি তবে বিয়ে? এটাই কি সংসার? ভালো থাকা কি এতটাই দুর্লভ, অবাস্তব?” আয়ানের সাথে বিয়ে হলেও কি সংসারটা এমন হতো? মাঝেমাঝে অন্বেষার সাথে কথা বলে আয়ানের খোঁজ নেয়। নাবিলার সাথেও কথা হয় তবে সেসবের মধ্যে তৃতীয়পক্ষ থাকে না। নাবিলার সাথে শুধু হাসিঠাট্টা হয়… মনখারাপ হলেই নাবিলাকে ফোন দেয়। আজও দিল,
— “নাবিলা, আমার আজ মনটা খারাপ।”
— “কান্না করো, মন ভালো হতে বাধ্য। কান্না করে চোখের পানি জমা করে তোমার স্বামীকে তাতে হাবুডুবু খেতে বলো। বেচারা বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেতে পারছে না…”
— “আমি সিরিয়াস।”
— “হ্যাঁ জানি তো, তাই আমি মজা করছি। দুজন সিরিয়াস হয়ে গেলে কেমন দেখায়? আমি আমার ফর্মে ঠিক আছি। নাহলে তোমার মরা-কান্নায় আমার কানের পর্দা ছিঁড়ে যাবে।”
পড়শী হেসে বলল,
— “আহারে, আমি এত সুন্দর করে কাঁদি!”
— “হ্যাঁ, এত সুন্দর যে শুনলেই চারপাশের বাতাসও নাচতে শুরু করে।”
— “উফফফ, কী মারাত্মক কথাবার্তা! সামির ভাইয়া সহ্য করে কেমনে?”
নাবিলা হেসে ফেলল। আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ফোন রেখে গোসলে গেল। মা অনেকক্ষণ যাবত চেঁচামেচি করছে। এইবার না গেলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। সামিরের সাথে নাবিলার আর কথা হয় নাই। ওর তথাকথিত ৪৮ ঘন্টা আজকে শেষ হবে। নাবিলা গোসল শেষে আয়নার সামনে দাঁড়াল। চুল মুছতে মুছতে ধীরসুরে গুণগুণ করে একটি গানও ধরল,
“ভুল করিয়া এই পথে আর আমি যাব না,
আর কারো সাথে প্রেম করিয়া ধরা খাব না।”
পরের লাইন গাওয়ার আগেই দরজা থেকে কেউ একজন কণ্ঠ মিলিয়ে উঠল,
“আমি তোমার সাথে মন মিলাইয়া পড়ছি বড় বিপদে,
বোঝো নাকো ভালোবাসা, ফালাইছো প্রেমের ফাঁদে।”
নাবিলা তাকাতেই বিস্ময় ও চমকের মিশ্রণে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। হাত থেকে তোয়ালে মেঝেতে ছিটকে পড়ল। অজান্তেই ওর পা সামনের দিকে হেলছিল এবং ও নিজেকে স্থিতি দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে ধীরে ধীরে আগন্তকের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ, অপ্রত্যাশিত স্নায়ুবিক চাপে নাবিলা কাঁপছিল। একটা বৃত্তে বন্দী হওয়ার মত অবস্থা। পায়ের আঙ্গুলে ভারসাম্য রাখতে না পেরে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে, আগন্তক দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ওকে আঁকড়ে ধরল পরম আদরে।
.
.
চলবে।
#প্রিয়াঙ্গন❤️ [পর্ব-৩৯]
~আফিয়া আফরিন
সামির ইয়াসির… নাবিলা এখনও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিল না। সামির আসলেই এখানে, তার চোখের সামনে, তার হাত ওকে বন্দী করেছে। কেমন স্বপ্নের মতো মুহূর্ত। ধীরে ধীরে ও সামিরের দিকে তাকাল, কীভাবে এলো সে? স্বপ্ন নয়তো? নাবিলার চোখ ঘুরে গেল সামিরের দিকে। সামিরের পুরো ভঙ্গিটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে যেখানে ছোট, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর হালকা ভ্রু-কুঁচকানো রূপ দেখতে পেত, এখন সেখানে দাঁড়ি খানিকটা বড়, চেহারায় এসেছে স্থিরতা আর নিখুঁত ধার। ব্ল্যাক শার্টের তন্তু হালকা মসৃণ, শরীরের সঙ্গে নিখুঁত ফিট, ব্রাউন প্যান্ট, হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়ি ঝলমল করছে; সবমিলিয়ে দুই বছরের ফারাক স্পষ্ট।
সামির নিজেও কি হকচকিয়ে গেল না? অবশ্যই, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত আলো তার চারপাশে জড়িয়ে গেছে। নাবিলার চুলে হালকা ঢেউ, চোখে অমলিন উজ্জ্বলতা, ঠোঁটের এককোণে অস্থিরতা, বারবার ঠোঁট কামড়ে ধরা; এমন এক নাজুক সৌন্দর্য, যা হৃদয়কে ছুঁয়ে দেয়। এই ছোট্ট মুহূর্তেই নাবিলার উপস্থিতি সামিরের সমস্ত ধ্বংসাত্মক ক্লান্তি, চাপ, দুশ্চিন্তা মুছে দিয়েছে। সামির ধীর কণ্ঠে বলল,
— “আপনি অনেক বড় হয়ে গেছেন নাবিলা।”
সামিরের কণ্ঠে মিশে থাকা গভীর স্নেহ, ভালোবাসায় নাবিলা নিজের সমস্ত বঞ্চনা, অব্যক্ত অনুভূতি খুঁজে পেল। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ভুলে, ও ঝলসানো অনুভূতিতে সামিরের বুকে জাপ্টে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠ ভাঙছিল। সামির নাবিলার ভেজা চুলের ওপর আলতো করে হাত বুলাল। প্রতি স্পর্শে জলবিন্দু ঝরে পড়ছে… সামিরের হাতের তাপে নাবিলা আরও কম্পমান হয়ে উঠল। ওর পৃথিবীতে এইমুহূর্তে কোনো দুঃখ বা বিভ্রান্তি নেই। সামির মৃদু কণ্ঠে বলল,
— “এভাবে কান্নাকাটি করবেন জানলে আমি আসতাম না।”
নাবিলা সামান্য লজ্জায় মুখ তুলে সামিরের দিকে তাকাল। চোখে ভিজে থাকা কেঁদে ওঠার ছাপগুলো এখনও ম্লান হয়ে যায়নি। একটু সরেও গেল। কিছুক্ষণ সামিরের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ওর চোখে অজস্র প্রশ্ন জমে আছে, অথচ ঠোঁট নীরব। সামির মৃদু হাসল, সেই হাসিতে ছিল খানিকটা অভিমানও। সে ধীরে ধীরে বলল,
— “এতদিন তো কান্নাকাটি করেন নাই, আমি এসেছি আর এত দুঃখ আপনার? যদি জানতাম, তবে আসতামই না।”
এই কথায় নাবিলা থমকে গেল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল, অশ্রু ফোঁটা আবারও ভেঙে পড়তে চাইছে। এতদিন ও নিজেকে আটকে রেখেছে। ভেবেছে, কাঁদলে যদি সে দূর থেকে টের পায়? আর আজ কাছে এসেছে বলেই বুকের ভেতরের সব দুঃখ বেরিয়ে আসছে… সামির কি তা বোঝে না? নাবিলা নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল,
— “হঠাৎ করেই আসা হয়েছে?”
— “না। শুধুমাত্র আপনার সামনে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছি।”
নাবিলা বিস্মিত হয়ে বলল,
— “তারমানে সবাই জানে?”
সামির মাথা নাড়ল,
— “হ্যাঁ।”
নাবিলা ভাঙা কণ্ঠে বলল,
— “আমি যে সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, তাও আমাকে বলা হলো না কেনো?”
— “সারপ্রাইজ দিবো বলে।”
নাবিলা খুশিতে খেই হারিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ সামিরের ফিরে আসা স্বপ্নের মতোই লাগছিল। কিন্তু তার কথাগুলো শুনতেই বুকের ভেতরটা খচখচ করে উঠল। দুনিয়ার সবাই জানল, আর সে-ই জানল না! একবারও কেউ ওকে বলেনি? চোখে অভিমানের ছায়া নেমে এলো। কটমট দৃষ্টিতে তাকাল সামিরের দিকে। ইচ্ছে তো করছে… যাইহোক, নিজেকে সামলে নিল। ঠোঁট আঁট করে চেপে শুধু তাকিয়েই রইল। সামির থমকানো গলায় বলল,
— “রাগ করেছেন? জানি, রাগ করার পুরো অধিকার আপনার আছে। কিন্তু আমি এতদিন বাদে এলাম আর আপনি রাগ করে থাকবেন, তা ঠিক না।”
নাবিলা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
— “আমাকে রাগানোটাই কি আসল উদ্দেশ্য?”
— “সেই সাধ্য কি আছে আমার? কয়েকবছর আগে রাগিয়ে কতদিন ফল ভোগ করলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে, রাগিয়ে খারাপ করি নাই।”
— “খুব তাইনা!”
— “তাহলে আমি কি আপনাকে আরেকটু রাগাতে পারি?”
নাবিলা হেসে ভ্রু উঁচু করে বলল,
— “রাগাতে পারো কিন্তু মনে রেখো, প্রতিদান আমারও থাকবে।”
সামির হেসে ফেলল। নাবিলার জন্য ওই হাসিটা অন্যরকম। ও মুহূর্তটা মনে মনে চিহ্নিত করল। আপাদমস্তক সামিরকে অচেনা রূপে চোখ ঝলসানো চেনা মানুষ মনে হচ্ছে। তখন একবারের জন্য চোখ তুলে দিকে তাকাতে পেরেছিল কিন্তু পরের মুহূর্তে, ভেতরে ভেতরে কেমন ঘাবড়ে যাওয়া লাজ এলো আর চোখ তুলে দেখবার সাহস পেল না।
সামির বলল,
— “প্রতিদান থাকুক, তবে আমি শুধু চাই আপনিও থাকুন।”
— “দূরে থাকো!” বলেই দৌড়ে পালালো। নাবিলার চোখেমুখে কিশোরীর ন্যায় আনন্দ ফুটে উঠেছে। চোখে ঝিলিক, গালে মৃদু লালিমা; দুনিয়া জুড়ে সুখের প্রতিচ্ছবি।
সামিরের ফিরে আসা ওদের পুরো পরিবারের এক মিষ্টি চক্রান্ত, যার কেন্দ্রবিন্দুতে কেবল নাবিলা আর তার অবাক হয়ে যাওয়া চোখদুটো। মাস দু’এক আগেই সে জানিয়ে রেখেছিল, কিন্তু একটাই শর্ত—নাবিলা যেন একটুও টের না পায়। সবাই নাবিলার মুখে হাসি ফোটাতে সেভাবেই বুকের ভেতর মুঠো করে চেপে রেখেছিল এই আনন্দের সংবাদ। মা-বাবা থেকে শুরু করে শ্বশুর-শাশুড়ি, কেউ একমুহূর্তের জন্যও মুখ ফসকে বলে ফেলেননি।
এয়ারপোর্ট থেকে নেমে সামির সোজা চলে গিয়েছিল খালামনির বাসায়। সেখানে মা-বাবা আগে থেকে উপস্থিত ছিল। দীর্ঘদিন পর ছেলেকে পেয়ে তাদের চোখে আনন্দের আভা, মুখে হাসি, বুকের ভেতর জমে থাকা আবেগ একসাথে বেরিয়ে এসেছিল। মুহূর্তগুলো শ্বাসরুদ্ধকর উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছিল। অল্প কিছুক্ষণ সেখানেই কাটিয়ে সামির আর দেরি করেনি। দেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর থেকেই নাবিলার জন্যই যে অদ্ভুত টান কাজ করছিল সেটাই তাকে নাটোর পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে। এখন পর্যন্ত নিজের বাড়ি যাওয়াও হয়নি। বাকিদের সাথেও দেখা হয়নি, কাল-পরশু ফিরে গিয়ে সকলের সাথে দেখা হবে। তবে বিকাল নাগাদ রেশমা আর সাখাওয়াত হোসেনও চলে এসেছেন। সকালেও যে বাড়িটা খালি খালি লাগছিল সেই বাড়িটা হুট করে একমুহূর্তে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
.
সামির আসছে শুনে সবার মত এই বাড়ির সবাইও আনন্দে মাতোয়ারা। অন্বেষা শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে। কিন্তু রায়হানের কপালে ছোট্ট দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। সামির তার ছোটো ভাই, স্বাভাবিকভাবেই খুশি কিন্তু কামিনীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কথা মাথায় আসতেই হঠাৎ কেমন দ্বিধা কাজ করে। যদিও সামির বিষয়টা গভীরভাবে নেয় নাই, স্বাভাবিক এবং সহজভাবেই নিয়েছে। তবু রায়হানের মন থেকে অস্বস্তি কাটছে না। কীভাবে সামিরের মুখোমুখি দাঁড়াবে তাই ভাবছে। কামিনী রায়হানের এই অবস্থা খেয়াল করে বলল,
— “তুমি চিন্তায় আছো, তাই না?”
রায়হান মাথা নেড়ে উত্তর দিল,
— “না না। কিছুই না।”
— “আমি জানি, তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি।”
— “তেমন সিরিয়াস না। তোমাকে ডাক্তার রেস্ট নিতে বলেছে। ঘরে যাও। এইভাবে ঘুরঘুর করতে দেখলে মা রাগারাগী করবে।”
কামিনী পাশে বসে একটু নরম কণ্ঠে বলল,
— “আমি বরং সামির আর নাবিলার কাছে থেকে ক্ষমা চেয়ে নিব। আমার জন্য তুমি মুখ ছোটো করে রাখবে, এটা ভালো দেখায় না। প্লিজ।”
— “বাদ দাও ওসব কথা। তুমি ঘরে যাও।”
কামিনী উঠে ঘরে যাওয়ার পথে দেখল অন্বেষাকে। দেখে মনে হলো, পৃথিবীর কোনো দুঃখ ওকে স্পর্শ করে না। সর্বদা ঠোঁটের দু’প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাসি, চোখের উজ্জ্বলতা; সবকিছুতেই একধরনের শান্তি এবং আনন্দের ছোঁয়া। কামিনী অবাক হয়ে ভাবল, এই মেয়েটা এত সুখী কেনো? শুধুমাত্র ভালোবাসতে জানে বলে কি? সত্যিই কি মানুষকে এতটা ভালো রাখার শক্তি আছে ভালোবাসার? মনের মধ্যে কৌতূহল নিয়ে কামিনী ঘরে এলো।
.
বাড়ির সবাই আহ্লাদে আটখানা অথচ সবচেয়ে অদ্ভুত অবস্থায় আছে নাবিলা। এতদিন ধরে যেই প্রতীক্ষা, যেই অভিমান, যেই চিঠি–চিরকুট সবকিছু মিলিয়ে যে মানুষটার জন্য এত অপেক্ষা, আজ সেই সামির একেবারে চোখের সামনে। অথচ বুকের ভেতর কী এক অদ্ভুত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিজেকেই নিজের মধ্যে দেয়ালচাপা লজ্জায় ঢেকে রাখছে। মা–বাবার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগছে। সামিরকে নিয়ে রাগ–অভিমান, অভ্যন্তরের লুকোনো টান; এসব বোধহয় সকলের চোখে ধরা পড়ে যাবে, এই ভয়ে নাবিলা মাথা নিচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সামিরের সামনে পড়ার ভয়ও ওকে কাবু করে রেখেছে। লজ্জায় বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে, হাত-পা কেঁপে উঠছে, চোখ নামিয়ে রাখছে। যতবারই মনে হয় হঠাৎ করে সামনে এসে পড়বে, ততবারই ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকে। নাবিলা নিজেই বুঝতে পারছে, এই লজ্জা কোনো সাধারণ লজ্জা নয়; এ প্রেম আর আকাঙ্ক্ষার অচেনা ভার, যা ওর সমস্ত দেহমনকে কাবু করে ফেলেছে।
সকাল থেকে তো নাবিলা অদৃশ্য অস্বস্তির ভেতরেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সামির এসেছে, এটাই যথেষ্ট ওকে ভেতর থেকে টালমাটাল করে দেওয়ার জন্য। অথচ আশেপাশের মানুষজনও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে, এই লজ্জাকে আরও বাড়িয়ে দিতে। রেশমা হঠাৎ বললেন,
— “সামির ঘরে না? ওর কাছে যাও। এখানে কি করছো? তোমার জন্য তো পাগল হয়ে গেছিল। আসার পর থেকে শুরু করেছে, ‘মা, আমাকে যেতে হবে। নাবিলার সাথে দু’দিন কথা হয়নি। আবার রাগ করবে।’ যাও মা, ওর কাছে যাও।”
কথাটা শেষ হতেই মুখখানি লাল টুকটুকে হয়ে গেল নাবিলার, হৃদপিণ্ড ধপধপ করতে লাগল। ছিঃ, কী লজ্জার কথা! এর মধ্যে আবার পাশে মা। মায়ের উপস্থিতিতেই এমন কথা… নাবিলা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি বলে উঠল,
— “নাদিমের সাথে গল্প করছে বোধহয়।”
এড়িয়ে গেল না কেউ। নীতু তৎক্ষণাৎ নাদিমকে ডাক দিলেন। গজগজ করতে করতে বললেন,
— “সবসময় ছেলেটার বাড়াবাড়ি। সামির এসেছে জার্নি করে, একটু বিশ্রাম করতে দে বাপু। নাবিলা, তুই যা। নাদিমকে এখানে আসতে বল।”
নাবিলা একেবারে হতবাক। তারা সবাই ওকে কী ভাবছে? সামির এসেছে মানে কি ও গিয়ে তার কোলে বসে থাকবে? শুধু তারা না, অন্বেষাও ফোন করেছিল। ও স্বভাবই হচ্ছে, বেফাসে কথা বলা। বললও তাই। সামির যে এসেই কারো সাথে দেখা না করে সরাসরি এখানে চলে এসেছে সেটা নিয়ে এত মুখরোচক কথা শোনাল! সব হচ্ছে মারাত্মক লেভেলের ভয়ংকর কথা, নাবিলা সেসব আর ভুল করেও মনে করতে চায় না।
ও মন শক্ত করে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে সামির নাদিমের সাথে কথা বলছে। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে নক দিল।
— “আসব?”
ভেতর থেকে সামিরের গম্ভীর গলায় উত্তর এল,
— “না, আসবেন না। আমি ব্যস্ত।”
নাবিলা রাগে গজগজ করে চলে আসবে ভেবেই দরজার কপাট ঠেলে দিল। আর তখনই, “ধাম” নাদিম লাফ মেরে ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। মুখে বড়ো একটা স্টাইল মেরে বলল,
— “ভাইয়া ডাকছে, যাও।”
— “তোর ভাইয়াকে বলে দিস, আমি এখন ব্যস্ত যেতে পারবো না।”
— “তো নিজেই বলো না।”
নাবিলা কিছু বলল না। ওখান থেকে সরে পড়ল। সামিরের সাথে সেদিন সবার গল্প, হাসি, ঠাট্টায় পুরো বাড়িটাই জমজমাট হয়ে উঠল। রাত আটটার দিকে বাড়ির পুরুষ মানুষেরা সব একজোট হয়ে বেরিয়ে গেল। এদের আনন্দ আর ধরছে না। রাত এগারোটার দিকে তারা বাড়ি ফিরল। তারপর খাওয়া-দাওয়া সারতে সারতেই বারোটা বেজে গেল।
সাধারণ দিনে এই সময়ে বাড়ি প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে যেত। একেকজনের চোখে ঘুম নেমে আসে। অথচ আজকে সেই ঘুম মহাশয় পালিয়েছে। আবারও শুরু হলো আড্ডা। ক্রিকেট, ফুটবল, দেশের খেলা-ধুলা, রাজনীতি নিয়ে গোল টেবিলে জমজমাট তর্কবিতর্ক শুরু হলো। সবকিছুর মধ্যেমণি হচ্ছে সামির। নাবিলা পাশ থেকে দেখছিল, সামিরকে নিয়ে সবাই কতটা মেতে আছে। অথচ ওর দিকে একবারও তাকাচ্ছে না কেউ। আর সামিরও, চেনেই না বোধহয়। ভাবের রাজার ভাব দেখানো শুরু হয়ে গেছে! একরকম অভিমান নিয়েই সে উঠে গেল মা-শাশুড়ির কাছে। তারা তখন ঘরোয়া আলোচনায় মশগুল। নাবিলা গালে হাত রেখে বসে রইল। কান খোলা থাকলেও মন একেবারেই সেখানে নেই। মনের মাঝে বিরক্তি জমেছে, ঠোঁটে অনিচ্ছুক হাসি।
সামিরের চোখে সবকিছু ধরা পড়ছিল। নাবিলার গাল ফুলিয়ে বসে থাকা, চোখে-মুখে স্পষ্ট অভিমান। কারও সাথে কথাবার্তাও বলছে না। সামির ভেতরে ভেতরে হাসছিল শুধু। ইচ্ছে করেই তো একটু দূরে রেখেছে ওকে, দেখতে যে কতটুকু রাগ জমা করতে পারে প্রতিদান দেওয়ার জন্য। আর রাগলে ওকে দেখতেও বেশ মিষ্টি দেখায়। অভিমানী চোখ, থেমে থাকা ঠোঁট, আর সেই অস্বস্তি; সবকিছুই নিঃশব্দে উপভোগ করছিল সামির। এই রাগের খেলা আর বেশিক্ষণ চালানো যাবে না। নাদিমকে ডেকে ফিসফিস করে নাবিলাকে ডেকে আনতে বলল। ওইদিকে নাবিলা বসেই ছিল। নাদিম এসে বলল,
— “ভাইয়া কী জানি খুঁজে পাচ্ছে না, তাই তোমাকে ডাকছে।”
নাবিলা ঘরে গেল, ভেতরে ঢুকেই চারপাশে তাকাল। কোথাও সামির নেই। কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবল, “এতক্ষণ ডাকাডাকি করছিল, এখন আবার কোথায় গেল?” হঠাৎ পেছন থেকে দু’টো শক্ত হাত আলতো করে এসে ঢেকে দিল ওর চোখ।
— “কি হচ্ছে?” চমকে উঠলেও মুহূর্তেই বুঝে গেল। সামিরের হাত সরিয়ে নিল চোখ থেকে। উল্টে তাকাতেই দেখল সামিরকে। গম্ভীর কন্ঠে ফের প্রশ্ন করল,
— “কি খুঁজছিলেন?”
— “আপনাকে।” সামির উত্তর দিল বিন্দুমাত্র দেরি না করে।
— “মিথ্যা কথা।” নাবিলা গাল ফুলিয়ে বলল।
— “আমি কি ছিঁচকে চোর যে মিথ্যা কথা বলব?”
সামির নাবিলার হাত আলতোভাবে ধরল, তার দৃষ্টি সরল ও অপ্রকাশিত। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বিছানায় বসাল, নিজের অবস্থানও সামঞ্জস্য করে মুখোমুখি বসলো। চোখে চোখ রেখে বলল,
— “ইচ্ছে করেই দূরে থেকেছি। আপনার প্রতি সব বলার আগে, ঠিক এইমুহূর্তটা বেছে নিয়েছি। যখন সবটা জানবেন আপনি আর জানাবেন আমাকে।”
নাবিলা বেশ কিছুক্ষণ থেমে ধীরকণ্ঠে বলল,
— “আমাকে এতদিন অন্ধকারে রাখলে কেন? যদি সবটা বলতে চাও, তবে আগেই বললে না কেন? আমি শুনতে চাই, তোমার সব কথা।”
সামির নাবিলার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকাল,
— “কারণ… আমি চাইনি তাড়াহুড়ো করে বলি। কিছু কথা সময়ের আগে বললে তার দাম থাকে না, নাবিলা। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমায় এভাবেই শুনো, যখন তোমার চোখে শুধু আমিই ভাসবো। যখন তুমি আর আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিছু থাকবে না। তাই দূরে থেকেছি, কষ্টও দিয়েছি। যেন আজকের এইমুহূর্তটা আমাদের কাছে অমূল্য হয়ে থাকে।”
নাবিলা হঠাৎ খেয়াল করল, সামির এখন আর আপনি বলছে না। সরাসরি তুমি সম্বোধন করছে। ও কিছু না বলে চুপচাপ সামিরের কথায় মনোযোগ দিল।
— “প্রথমত, আমি তোমাকে সমস্যায় ফেলতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম যখনই আসব, তখন তোমার সামনে পুরোপুরি স্থিরভাবে দাঁড়াব। বলতে পারব, ‘আমি ফিরেছি’ নিশ্চিন্ত মনে। আমি ঝটপট সিদ্ধান্ত নিলেই ভুল করে ফেলি। তাই সময় নিয়েছি, খুঁতগুলো আঁচ করে ঠিক করার জন্য। দ্বিতীয়ত, আমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করছিল। যেরকম একটা পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে হল তারপর আমরা থাকতে শুরু করলাম যেভাবে, তাতে সম্পর্কটা ভাসমান বললেই চলে। প্রথম দিকে আমরা দুজনেই তো অনিচ্ছুক ছিলাম তাই না? একপর্যায়ে দূর থেকে তোমার কথা শুনেছি, তোমার ক্ষুদ্র খুশি-দুঃখগুলো চোখে রেখেছি, কিন্তু মুখ খুলিনি। তৃতীয়ত… আমি ঈর্ষা করেছি। যখনই তোমার কাছাকাছি কাউকে দেখতাম আমার রাগ হত। কিন্তু নিজে কাছাকাছি আসার কথাটা কখনো বলতে পারিনি। এটাও আমার আরেকটা ভুল। আরেকটা কথা, আমি চেয়েছি তোমার আশেপাশে ছোটো ছোটো জিনিস ছড়িয়ে রাখি। যখন তোমার একা থাকার মুহূর্তগুলো খুব কঠিন হবে তখন সেগুলো তোমায় বলবে, ‘দেখো, কেউ আছে যে সর্বক্ষণ তোমায় নজরে রাখছে’। তারপর একসময় আমি উপলব্ধি করতে পারলাম সময় নয়, আমায় উপস্থিতি দরকার। আমি চাই প্রতিদিন সকালে তোমার কাছে ফিরব বলে ভেবে ঘুম ভাঙতে; চাই তোমার মনের জায়গায় একটু বাড়তি জায়গা করে নিতে।”
সামিরের বলা প্রতিটি কথা নাবিলা গিলে নিচ্ছিল নিঃশব্দে। যতটুকু আক্ষেপ ছিল এতদিনের জন্য, তার সাথে মিশে যাচ্ছিল প্রশান্তি।
ওর চোখে জল জমে উঠল, ঠোঁট কেঁপে উঠল সামান্য। অনেকক্ষণ পর ধীরে, দম আটকানো স্বরে বলল,
— “তুমি জানো, আমি কতবার ভেবেছি তুমি আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ। কতবার মনে হয়েছে, তোমার কাছে আমি কিছুই না।”
সামির ধীরে কাছে ঝুঁকে এল। নাবিলার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দুগুলোকে সে আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে মুছে দিল। চোখের কোণে আটকে থাকা শেষ ফোঁটাটাও আলতোভাবে সরিয়ে দিয়ে সামির গভীর দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। হাসি-গম্ভীর মিশ্র কণ্ঠে বলল,
— “এইবার আমি জানি এই কান্না, এই অভিমান… সবকিছুর ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভালোবাসা। কিন্তু বলো তো, কবে থেকে ভালোবেসে ফেললে আমায়? সেই প্রথম দেখা থেকে নাকি যখন আমি তোমার থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম?”
নাবিলা সামিরের চোখের দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল,
— “অন্তর্দ্বন্দ্বে যেদিন থেকে ভুগছিলাম।”
— “নিজের ভালোবাসা কবে বুঝেছ?”
— “যেদিন তোমার ভালোবাসা বুঝেছিলাম।”
— “তারপর?”
— “অপেক্ষার প্রতিটি ক্ষণেই লিখেছি তোমার নাম,
হৃদয় ভরা ব্যথা নিয়ে বুঝেছি ভালবাসার দাম।
তুমিও আসবে, ফিরবে, থাকবে দিবানিশি
কতটুকু ভালোবাসো, তা প্রতি নিঃশ্বাসে জানি!”
সামির আলতো করে নাবিলার কপালের মধ্যভাগে গাঢ় চুমু খেল। নাবিলা চোখ বন্ধ করে সেই স্পর্শ অনুভব করল, হৃদয়টা তাকে আরও কাছে টানল।
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]