প্রিয়াঙ্গন পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
17

#প্রিয়াঙ্গন❤️ [অন্তিম পর্ব]
~আফিয়া আফরিন

৭ বছর পর, বসন্তের এক সুন্দর বিকেলে…
বাড়ির উঠোনে রোদে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চা ছুটে বেড়াচ্ছে, হাসছে, একে অপরের পিছনে দৌড়াচ্ছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলেটা সবচেয়ে ছোট মেয়েটার হাত ধরে দৌড়াচ্ছে, মাঝে মাঝে গিয়ে একে অপরকে ধাক্কা দিচ্ছে আবার কোনো কারণে কথা কাটাকাটিও হচ্ছে। আরিয়া ছোট্ট পায়ে ধীরে ধীরে বড় ভাই-বোনদের মত খেলা শেখার চেষ্টা করছে; ছোট্ট দুহাত চড়িয়ে দৌড়ায় আর হেসে উঠে, কখনও কখনও মাটি ছুঁয়ে পড়ে, কিন্তু তাতে মনখারাপ হয় না। আর একদম পাশে ছোট্ট বারান্দায় পড়শী বসে আছে, আয়ান পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা খেলার বল, আয়ান বল দিয়ে দেখাচ্ছে কিভাবে দূরে ফেলে দৌড়ে ধরতে হবে। মূলত পড়শী এখানে বসে আছে বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্যই। খারাপ লাগছে না, বাচ্চাদের কলকাকলি বরাবরই ভালো লাগে। তারমধ্যে বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ, পাখির কিচিরমিচির, আবহাওয়ায় আনন্দের সুর মিশে আছে।
রুম্ভার মতো মাটি ধুলো উড়ছে, হেসে ওঠা মুখগুলো আলো ছড়াচ্ছে। কখনও কেউ মাটিতে বসে পড়ে, কেউ আবার লাফিয়ে উঠে, ওদের একটামাত্র উদ্দেশ্য: খেলা, হাসি, আনন্দ।
আয়ান একটু এগোতেই আরিয়া ছোট্ট পায়ে হেঁটে আলো বুলিতে ‘বাবা! বাবা!’ করে এগিয়ে এলো। মেয়েটার চাহনিতে খুশির ঝিলিক, হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে বাবা-স্নেহ খুঁজছে। এরপর ওর দেখাদেখি অন্য সব ছেলেমেয়েরাও এগিয়ে এলো। কেউ বলল ‘কাকা’, কেউ ‘মামা’। সবাই কোলে উঠার জন্য হাত উঁচু করে ছুড়ে দিচ্ছিল। আয়ান চমকে বলল,
— “আমি এতগুলোকে কীভাবে কোলে নিব, বাপ?” কিন্তু বাচ্চারা তো কথা শুনে না, একঝাঁকে এসে আয়ানের চারপাশে ঘিরে ধরল। আয়ান পড়শীর দিকে তাকিয়ে বলল,
— “এদের সামলাও, ওখানে বসে আছো কেন?” পড়শী হাসিমুখে বসেই রইল। বাচ্চারা আয়ানকে বরাবরই খুব পছন্দ করে। ছোটোবেলা থেকে এমন হয়ে আসছে। ওরা বাবা-মায়ের কাছে বকা খেলে আয়ানের কাছে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আয়ানও ওইরকমই, ওদের সাথে ওদের মত করেই মিশে যায়। তবে এই যাত্রায় বাচ্চাপার্টির হামলা থেকে আয়ানকে রক্ষা করল ইয়াসমিন, রেশমা আর অন্বেষা। ওরা বড় গেট পেরিয়ে উঠোনে আসতেই বাচ্চারা নানু-দাদুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা ওদের নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। উঠোনে শুধু একলা দাঁড়িয়ে রইল, সারাহ। আয়ান কাছে গিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— “ঘরে যাবে না মা?”

সারাহ মুখ ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বলল,
— “উঁহু। আম্মু-আব্বু আসে না কেন?”

আয়ান অবিলম্বে বাচ্চাটাকে কোলে নিল, মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেল। হাসিমুখে বলল,
— “এইতো এক্ষুনি চলে আসবে। মন খারাপ করে না মা। এরপর আব্বু এলে আমরা সবাই বেঁধে রাখব, যাতে কোথাও যেতে না পারে। ঠিক আছে?”
সারাহ’র কাকার প্রস্তাব পছন্দ হলো। তাই মাথা হালকা নাড়িয়ে সায় জানাল। আব্বু এলে কীভাবে বেঁধে রাখবে, সেটার পরিকল্পনাও সাজিয়ে ফেলল।
.
বোধ করি, সাতটা বছর এক ঝটকায় উড়ে গেছে। চোখের পলকে অতীতের সব মুহূর্ত সাথে নিয়ে সবাই এইসময়ে এসে পৌঁছে গিয়েছে। ফিরিয়ে তাকালে মনে হয়, “সত্যিই কি এতগুলো দিন পেরিয়ে এসেছি, নাকি টাইম মেশিনে ভবিষ্যৎ ভুবনের এইমুহূর্তে এসে ঠেকেছি?”
নাবিলার শখ পূরণ হয়েছে, সামিরের পরিবার এখন পূর্ণতা পেয়েছে। সাইরার পর আরও দু’জন ছোট্ট প্রাণের বাবা-মা হয়েছে তারা। দ্বিতীয় মেয়েটার নাম সারাহ ইহসানাত, বয়স চার। আর তৃতীয়টা ছেলে, নওশাদ ইয়াকিন। কোলের বাবু, বয়স মাত্র একবছর।
শুধু নাবিলা নয়, বাকিদেরও পরিবারের পরিসর বড় হয়েছে। অন্বেষাও আরেক সন্তানের মা হয়েছে। শান্ত স্বভাব আর জ্বলজ্বলে চোখ দেখে নাম রাখা হলো শান্ত। রায়হানেরও আরেকটা ছেলে হয়েছে, রিজওয়ান। আয়ানের একমাত্র মেয়ে, আরিহা। সবাইকে নিয়ে বাড়িটা পরিপূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে এ-বাড়ি ও-বাড়ি সর্বদা বাচ্চাদের চঞ্চল হাসি, ছোট ছোট পা পড়ার শব্দ, বড়দের নজরদারিতে মুখোরিত।

ঢাকার বিকেলটা আজকে আরও ব্যস্ত, আরও ভিড়ভাট্টার। বিমানবন্দরের রাস্তা ধরে নাবিলা এগোচ্ছে। নাবিলার সাথে নাদিম আছে। ও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়াশোনা করছে। নাদিমের কোলে নওশাদ গুটিসুটি মেরে বসে আছে। মাঝেমধ্যেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আধো বুলিতে ‘বাবা, বাবা’ ডাকছে। বাবা, ঠিক কী জিনিস সেটা ওর বোঝার কথা নয়; তবুও সর্বক্ষণ শব্দটার মায়া জিভে লেগে থাকে।
এয়ারপোর্টে পৌঁছেই নাবিলা অস্থিরচিত্তে আশেপাশে তাকাল। দুই মাসের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে আজ। ভোর থেকেই মন কেমন কেমন করছিল। রাস্তা জুড়ে বৃষ্টিভেজা বিকেলের আবহ, বাতাসে কেমন একটা বুনো গন্ধ, মনটাকে আরও নরম করে তুলছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্যপটে চোখ রাখলেও আসলে মনটা বারবার চলে যাচ্ছিল সেইমুহূর্তে; যখন সামিরকে আবার সামনে দেখবে, কাছে পাবে, ছুঁতে পারবে।
দীর্ঘ দুটোমাস সামির দূরে ছিল। কাজের প্রয়োজনে কানাডা যেতে হয়েছিল। কত দিন, মাস বছর, একটা যুগ পেরিয়ে গেল; তাও সামিরের শূণ্যতা নাবিলার কাছে সেই আগের মতই তাজা। তিন তিনটে বাচ্চা থাকার পরেও সেই একই দহনে দগ্ধ হয়, শিখায় নিঃশেষিত হয়, দহন-ব্যথায় অন্তঃস্থল বিলীন হতে হয়। সাইরা আর সারাহ’ও সারাক্ষণ আব্বু আব্বু করে। আর এখন তো নওশাদও অস্পষ্ট কণ্ঠে সারাক্ষণ বাবাকে আওড়ায়। নাবিলা মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
কিছুক্ষণ বাদেই সামিরকে দেখা গেল। টানা জার্নির ক্লান্তি মুখে থাকলেও প্রিয়জনদের দেখার আনন্দে সব কেটে গেল। এতগুলো বছর কেটে গেলেও মানুষটা একটুও বদলায়নি। এখনও সেই চেনা হাসি, সেই অদ্ভুত নিশ্চিন্ত ভরসার চোখ; যার পরশে আজও মুগ্ধ হতে হয়।
দূর ছেলেকে দেখে সামিরের ঠোঁটের কোণে এমন হাসি ফুটল, যা এতদিনের অপেক্ষার সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে দিল মুহূর্তেই। নওশাদ মায়ের কোলে ছটফট করতে লাগল। সামিরকে চিনেই দুই হাত বাড়িয়ে দিল,
— “বাবা, বাবা…” অস্পষ্ট স্বরে। সামির ব্যাগপত্র ফেলে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। তারপর নাদিমের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল। নাদিম যখন নওশাদকে কোলে নিয়ে খানিকটা দূরে এগিয়ে গেল তখন চোখ গেল নাবিলার দিকে। নাবিলার মুখে হাসি, কিন্তু চোখে টলটল জল। সামির এক পা এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল,
— “মনে হচ্ছে না, শুধু দু’মাস ছিলাম দূরে। মনে হচ্ছে কয়েক যুগ কেটে গেছে।”

নাবিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— “হ্যাঁ, সত্যিই যুগ কেটে গেছে।”
একহাতে নাবিলার হাত চেপে ধরে চারপাশে কোলাহল থেকে বেরিয়ে পড়ল।
সামির বাড়ি ঢুকতেই পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল আনন্দের হইচইয়ে। সারাহ আর সাইরা দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে এলো। “আব্বু, আব্বু এসেছে!” দু’জন একসাথে চিৎকার করল। সাইরা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার গলায়, গলায় ছোট্ট হাত পেঁচিয়ে ধরে বলল,
— “আব্বু, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আমার অনেক গল্প জমে গেছে।”

পাশ থেকে সারাহ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
— “আমারও। তবে তোমার সাথে আমি আগেই কথা বলব না। তুমি সেদিন আমাকে বকেছ। আমি দাদুভাইকে বিচার দিয়েছি, সে এলে তোমার বিচার করবে তারপর কথা বলল।” সামির এগিয়ে এসে আগে ছোটো মেয়েকেই কোলে নিল। কতভাবে বোঝাল, আহ্লাদ করল; মেয়ের মন গলল না, মেয়ে কিছু মানল না। সাইরা খুব শান্তশিষ্ট, ছোটো থেকেই। ওকে বড় করতে নাবিলা বা সামিরের যুদ্ধ করতে হয় নাই। কিন্তু সারাহ জন্মানোর পর থেকে প্রতিদিনই যুদ্ধের মত গেছে। মানুষ ঠিকই বলে, ছোটো মরিচের ঝাল সর্বদা বেশি। এই মেয়ে বাবা-মাকে চোখের ইশারায় নাচায়। নওশাদের কথা এখনও বলা যাচ্ছে না। মাঝেমাঝে খুব কান্নাকাটি করে আবার খুব গম্ভীর হয়ে থাকে। মা-বাবা দুজনের বৈশিষ্ট্য যথাযথভাবে পেয়েছে বোধহয়।
সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি এলেন রাতে। ঘরে ঢুকেই সারাহ দৌড়ে গিয়ে তার হাত ধরল। মনে করিয়ে দিল, আব্বু ফিরে এসেছে এখন তার বিচার করতে হবে। সাখাওয়াত হোসেন থমকে দাঁড়ালেন। কপাল কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করলেন, কীসের বিচার? ওহ হ্যাঁ, মনে পড়তেই সামিরকে চেঁচিয়ে ডাকলেন। বাচ্চাদের বকাবকি তিনি একদমই সহ্য করবেন না। এমন ছোট্ট একটা পরীর মত মেয়ে, কোন সাহসে ওই দামরা ছেলে ওকে ধমক দেয়? সামির হকচকিয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। মুখে বিব্রত হাসি। তিনি এবার কড়া কণ্ঠে বললেল,
— “শোনো, আমি বাচ্চাদের বকাঝকা একদমই পছন্দ করি না। আমার নাতনিকে ধমক দেয়ার দুঃসাহস করেছ, এত বড় সাহস? জীবনের কতটুকু জানো? এখন বাচ্চাদের ধমক দিচ্ছ, না বুঝে বকা দিচ্ছ, পরে কী করবে? আমি যেন আর কোনোদিন না শুনি, তুমি ওদের বকাবকি করেছ। ছোটোবেলায় তুমিও কম দুষ্টুমি করোনি। তোমার মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তো, তোমার গায়ে কখনো হাত তুলেছিলাম কিংবা কোনোদিন বকা দিয়েছিলাম কিনা! এসব ধমকাধমকি দিয়ে খবরদার শাসন করবে না। ভুল করলে বোঝাবে।”

সামির তো একেবারেই চুপ। মেয়ে কি এমন বলেছে বাবাকে যে কোনোদিন বকা না দেওয়া ছেলেকে বকছেন? কপাল! তবে মনে মনে বলল, “তুমি তো এটা বুঝলে না বাবা, এই তিন বিচ্ছুকে সামলাতে আমার হিমশিম খেতে হয়। আমার ফাইলপত্রের অস্তিত্ব নষ্ট করে ফেলে। লুকিয়ে রাখলেও কীভাবে যেন খুঁজে বের করে। এতকিছু দিই, তাও যেসব ধরতে মানা করি সেসবে তাদের আগ্রহ। যাইহোক, আমাকে এত রাগারাগী করে লাভ নেই। জীবনযুদ্ধে এই তিনটাকে নিয়ে আমিই এগিয়ে গেছি। হাহাহা!” মুখে এসব কিছুই বলল না। শুনলে বাবা আবার ধমক দিবে। এই বয়সে এসে ছেলে-মেয়েদের সামনে এত বকা খাওয়া মোটেও সম্মানজনক বিষয় নয়। তাই কোনোমতে মাথা চুলকে বলল,
— “আচ্ছা আচ্ছা, ভুল হয়েছে। আমার রাজকন্যাকে আর কোনোদিন বকাবকি করব না।”

হ্যাঁ—আর কী! বাবাকে বকা খাইয়ে দৌড়ে আবার বাবার কোলে চড়ে বসল; চোখে সজীব হাসি, গালভর্তি হাসি। দাদুভাইর তীব্র কথাগুলো ওর না-শুনা, না-জানা; ওর জগতটা একেবারে সরল। তবে এইটুকু বুঝতে পেরেছে বাবা মনখারাপ করেছে, বাবাকে এখন আদর করতে হবে। তাই করল, গালে চেপে একটা চুমু খেয়ে বলল,
— “সরি, আব্বু।”
সামির আর মুখ ফিরিয়ে রইল না। উপস্থিত সবাই একসাথে হেসে উঠল। এটা তো সামান্য ঘটনা মাত্র, তবে জীবনে প্রতিটা ক্ষেত্রে এইরকম বাচ্চাদের মত সহজ-সরলভাবে ভাবতে পারলে; ওদের মত একটা ছোট্ট আলিঙ্গনে, একটা চুমুতে সব ভুলে যাওয়ার জাদু জানলে কোনো দুঃখই ছুঁতে পারে না।

সামির কিংবা নাবিলা কি কখনো ভেবেছিল, জীবন তাদের এইমুহূর্তে পৌঁছে দেবে; যেখানে পূর্ণাঙ্গ পরিবার, যেখানে হাসি-কান্না, ছোট ছোট খুনসুটি একসঙ্গে মিলেমিশে অন্যরকম আনন্দের বুনন গড়ছে? নাবিলা নিজেকে আরও বেশি পরিপূর্ণ করার চেষ্টা করেছে সাইরা হওয়ার পর থেকে। ও চেয়েছে, মেয়েটার প্রতিটা দিন হোক নিরাপদ। মা হিসেবে উদ্দেশ্য একটাই, মেয়েটাকে এমনভাবে বড় করা যাতে সে স্বাধীনভাবে, ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। নাবিলা সতর্ক, ধৈর্যশীল, এবং প্রেমময় সংযমে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, স্বামী, সন্তানদের ক্ষতি, দুঃখ, আনন্দের সঙ্গে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। সাইরা জন্মের আগেই নাবিলা মাষ্টার্স শেষ করেছিল। পড়াশোনা, রেজাল্ট; সবকিছুতেই চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছিল। ইচ্ছে থাকলে চাকরিতে যোগদান করাও ওর জন্য কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু নাবিলা কখনোই চাকরির চেষ্টা করল না। সামিরের কাছে পেয়েছিল সেই নিশ্চয়তা। একদিন নাবিলা সামিরকে বলল,
— “এত পড়াশোনা পড়াশোনা করলাম, আমি কি করব এতকিছু করে? আমি কিন্তু চাকরি করব না, আগেই বলে দিচ্ছি।”

সামির শুধু হেসে বলল,
— “এটা তো তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
— “হ্যাঁ, কিন্তু তোমাকে বলে রাখলাম। পড়াশোনার জন্য প্রচুর জোর করেছ। এরপর আর করতে পারবে না।”
— “আমি তা করবও না। তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি রাণীর মত থাকো। আমি তো করছিই।”

নাবিলা মাথা হেলিয়ে বলল,
— “হুম। আমার অনেকগুলো বাবু হবে, আমি মা হব। মা হয়ে সব করব। সবসময় বাবুদের নিয়ে থাকব, ওদের সময় দিব, ওদের নিয়ে খেলাধুলা করব। আর তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে।”
— “আচ্ছা।” সামির হেসেছিল।

সামিরও বাবা হওয়ার পর নতুন ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আগে যে উদ্যম, রোমাঞ্চ আর কখনো কখনো খামখেয়ালিপনা তাকে আলাদা করে রেখেছিল, এখন তা আরও দায়িত্বশীল দিক পেয়েছে। বাচ্চাদের দায়িত্ব সর্বক্ষেত্রে ওদের মায়ের উপর গছিয়ে দিয়ে কখনো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে নাই। বরং কান্নাকাটি করলে নিজ দায়িত্বে সামলাতো। প্রত্যেকবার বাবা হওয়ার নতুন অভিজ্ঞতা সামিরকে নতুন মানুষে পরিণত করেছে।
তারপর আছে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। এই সম্পর্কগুলো তো জন্মগত নয়, হঠাৎ করে পাওয়া। এই সম্পর্ক নিয়ে কত মেয়ের মধ্যে টানাপড়েন থাকে, অস্থিরতা থাকে; ভাগ্যের একটা মোড় ঘুরে গেলেই বোঝা যায় কেমন হয় সেসব সম্পর্ক! নাবিলা যখন এই বাড়িতে এসেছিল তখন প্রথমদিকে একটু দ্বিধা ছিল, কীভাবে মানিয়ে নিবে, দিনগুলো কেমন কাটবে; কিন্তু দিন গড়াতে গড়াতে সেই সম্পর্ক রূপ নিল একেবারেই আপন বন্ধনে। প্রথমদিকে সামির যেমন বেখেয়ালি আর খামখেয়ালি স্বভাবের ছিল, শাশুড়ি ঠিক উল্টো। নাবিলার প্রতি যত্নে কোনো ঘাটতি রাখেননি। শ্বশুর আবার অন্যরকম। তিনি কথায় কম, কাজে বেশি। সামির যখন ছিল না, আবার থাকাকালীন সময়ে, গর্ভাবস্থায়ও তারা নাবিলাকে মেয়ের মতোই আগলে রেখেছেন। প্রায় সারাক্ষণ পাশে থেকেছেন। সকালে কী খেয়েছে, দুপুরে বিশ্রাম নিয়েছে তো, রাতে ওষুধ খেল কি না; নিজের মা-বাবার মত সবই খেয়াল রাখতেন। কোনো কাজে হাত লাগাতে দিতেন না বরং বলতেন,
— “আমার নাতি-নাতনির মা এখন বিশ্রামে থাকবে, বাকিটা আমরা সামলাব।”

ধীরে ধীরে নাবিলা টের পেল, এই সম্পর্কগুলো হঠাৎ করে পাওয়া হলেও কতটা দৃঢ় আর গভীর হয়ে উঠেছে। জন্মগত সম্পর্কের মতোই আপন হয়ে উঠেছে কিংবা তারচেয়েও বেশি। সর্বক্ষণ ওর নিজের ভেতরে কৃতজ্ঞতার ঢেউ উঠতে থাকে; আল্লাহ ওকে শুধু একজন ভালো স্বামীই দেননি, সাথে একেবারে পরিপূর্ণ একটা পরিবারও উপহার দিয়েছেন।
সামিরের থেকে থেকে মনে হয়, তার মা আর শ্বাশুড়ি ছোটোবেলার বান্ধবী ছিলেন না। মা আর নাবিলা একে অপরের সই ছিল! সবমিলিয়ে
এই সংসার তাদের কাছে শুধু ছাদ-দেয়াল নয়, বরং ভালোবাসা, হাসি আর যত্নে গড়া আশ্রয়। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের শক্তি; তাই সুখটা গুনে গুনে নয়, ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে আছে।
.
আজ বাড়িটা হঠাৎ করেই উৎসবের রঙে ভরে উঠল। আসলে কোনো বিশেষ উপলক্ষ নেই, কিন্তু প্রিয়জনেরা একসাথে হলে অকারণেও আনন্দের ছড়াছড়ি হয়।
সামির অনেকদিন পর ফিরেছে, তাকে ঘিরে সবার গল্প আর হাসাহাসি। রায়হানের আজ অফ ডে। এক হাতে চা নিয়ে আড্ডা জমাচ্ছে। আয়ান মজা করে একটার পর একটা ঠাট্টা ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর তার হাসিতে বাচ্চারা সব মুখরিত। শাহিদ ভাইও কোণায় বসে সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে যাচ্ছেন। ওহ হ্যাঁ, বলতেই ভুলে গেছি… এখন‌ শাহিদ ভাই আর রায়হানের সম্পর্ক স্বাভাবিক। এটার একটা হাস্যকর ঘটনা আছে। বছর দুয়েক আগের এক বিকালবেলা…
সবাই মিলে ক্রিকেট খেলার প্ল্যান হলো। ব্যাট হাতে নিলেন শাহিদ ভাই। বড়দের ক্রিকেট মানেই একটু সিরিয়াসনেস; বল মারতে গিয়ে তিনি এমন এক শট দিলেন যে, সরাসরি গিয়ে লাগল রায়হানের মাথায়।
রায়হান আহ বলে চিৎ হয়ে পড়ল। সবাই দৌড়ে গেল তার দিকে। শাহিদ ভাই প্রায় দৌড়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
— “ইচ্ছা করে তো মারিনি। খুব লাগল নাকি?”

রায়হান চোখ কুঁচকে গম্ভীর গলায় বলল,
— “চোরের মন সবসময় পুলিশ পুলিশ। তোকে কে জিজ্ঞেস করেছে ইচ্ছে করে মেরেছিস? তোর কথায় এখন তা স্পষ্ট। শালা, প্রতিশোধ নিচ্ছিস?”

সবাই আতঙ্কিত। শাহিদ ভাই তো প্রায় অস্থির। বলল,
— “ছিঃ, সমন্ধীর সাথে কীসের প্রতিশোধ? তুই এখানে ছিলি আমি দেখি নাই। অনেক ব্যথা পেয়েছিস? আহারে, কপালের কাছটায় গোল আলু হয়ে গেছে। মাফ করে দে ভাই!”

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। রায়হান খানিকটা বিরক্তির ভান করে বলল
— “তুই একেবারেই অসহ্য। শুধুমাত্র ছোটোবোনের পেয়ারের স্বামী বলে তোকে কিছু বলি না। নাহয় এতদিনে…” রায়হান পুরো কথা শেষ করল না। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাটটা হাতে নিয়ে দৌড়ে শাহিদকে বল ছুঁড়ে দিল। শাহিদ ক্যাঁচ করতেই রায়হান বলল, “আচ্ছা চল ম্যাচটা জিতি। আমার মাথার দায় মাফ করে দিলাম।”
শাহিদ ভাই প্রথমে একটু ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই হেসে ফেললেন। সেই একটা বলেই সব অভিমান ধুয়ে গেল। খেলাটা আবার নতুন করে শুরু হলো। খেলায় জিতে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হতেই মেয়েদের সাজগোজের ব্যস্ততা শুরু হলো। নাবিলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওসিয়ান ব্লু রঙের শাড়ি জড়াতে গিয়ে বিপাকে পড়ল। অনেক চেষ্টা করেও কুঁচি সামলাতে পারছে না। কপাল কুঁচকে গজগজ করতে করতে হঠাৎ জরুরী ভঙ্গিতে সামিরকে ডেকে উঠল,
— “এই তাড়াতাড়ি এসো তো… আমার কুঁচি ধরে দাও না।”

সামির ঘরে ঢুকেই এই দৃশ্য দেখে হেসে ফেলল,
— “কুঁচি নাকি কেঁচো? এমনভাবে ছুটে গেছে যে মনে হচ্ছে, খুব দ্রুত তাদের বাংলাদেশ পেরোতে হবে।”

নাবিলা চোখ রাঙিয়ে বলল,
— “ফাজলামি করো না। তাড়াতাড়ি ধরো।”

সামির তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে ধরে দিল। কাছাকাছি দাঁড়ানোয় তার গায়ে নাবিলার সুগন্ধি মিশে এলো। বলল,
— “দিনদিন তুমি যা হচ্ছো না! ইচ্ছে করছে এখনই আরেকবার পালিয়ে যাই তোমাকে…”

নাবিলা ধমক দিয়ে বলল,
— “অসভ্য। বয়স বাড়ছে না কমছে?”

সামির গম্ভীর গলায় বলল,
— “বয়স বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তোমাকে দেখলে আবার যৌবনে নেমে যাই।” তারপর ভ্রু নাচিয়ে যোগ করল, “এই যৌবন মানে কিন্তু ১৮–১৯ না। সেই ২৬-২৭, ওই যে যখন তোমার আমার উত্তাল প্রেম ছিল; সেই সময়টা মনে পড়ে? অন্ধকারে আমরা দুজন একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে আমাদের ভবিষ্যৎ সাজাতাম, রাত পোহাতে চুপচাপ বসে থাকতাম, তোমার কণ্ঠে আমি হারাতাম।”

নাবিলা সামিরের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
— “খুব মনে আছে।”
— “আর এখনও তাই। উত্তালতা কমতে পারে, কিন্তু প্রেমের আঁচ নেভে নাই। সেই উত্তাপেই তো আমরা পুরোদস্তুর সংসার গড়েছি।”

নাবিলা চোখ গোল করে তাকাল,
— “হ্যাঁ এখন এইসব রোমান্টিক কথা বাদ দাও। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে আছে। কথাবার্তা, কাজকর্ম হিসেব করে করো। এইভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেখি, সরো। সারাহকে মামণির কাছে পাঠিয়েছি‌, এক্ষুনি চলে আসবে।”

সামির সরলো না উল্টো আরও কাছে এসে মজা করে বলল,
— “তাহলে তো হলেই গেল। ওদের আর আলাদা করে শিখাতে হবে না। বাবা-মাকে দেখেই বাবার মতো এমন পাগল স্বামী খুঁজে নিতে পারবে।” নাবিলা আর কিছু বলল না। চোখ রাঙিয়ে চলে গেল।

কামিনী আজও অপরাধবোধের বোঝা বয়ে চলছিল। এতগুলো বছর কেটে গেছে, কিন্তু সামিরের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার সৎ সাহস করতেই পারেনি। আজকের দিনে হঠাৎ মনে হলো, ক্ষমা চাইলেই তো মিটে যায়। কয়েকদিনের জীবন মাত্র, এত দ্বিধা আর কষ্ট কেন? এই চিন্তাই মনে শক্তি জোগালো। তাই সামিরকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে গেল। পেছন থেকে ডাকল,
— “সামির, শোনো…”

সামির ঘুরে তাকায়। একটু অবাক হয়। কামিনী হঠাৎ? অবাক হলেও, ও কি বলবে তা শোনার জন্য চুপচাপ ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কামিনী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— “অবাক হয়েছ? আসলে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। জীবনটা খুব ছোট। ধীরে ধীরে অনেককিছুই উপলব্ধি করতে পারছি। একসময় অনেককিছু করেছি, বলেছি। সবকিছুর জন্য সরি।”

সামির সামান্য মাথা নাড়ল,
— “ইটস ওকে। আমি ওসব মনে রাখি নাই।”

কামিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “জানি। কিন্তু একবার হলেও আমি সৎ হতে চাই, ভুল স্বীকার করতে চাই। নাবিলাকেও বলেছি। ও খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছে। এমনভাবে আমাকে বলেছে যেন আমি কোনো দোষই করি নাই।”
— “ঠিক আছে, ঠিক আছে। নিজের ভুল বুঝতে পারাই অনেক বড় ব্যাপার।”
— “তাহলে ক্ষমা করেছ?”
— “হুম।”
— “ওকে। আগের মত ভাবিজান বলে ডাকতে পারো আমাকে। ডাকটা খুব সুন্দর ছিল কিন্তু।”

সামির আচমকা হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল,
— “আচ্ছা… ভাবিজান।”
অবশেষে দীর্ঘদিনের মেঘ কেটে সূর্যের দেখা মিলেছে। ওদিকে নাবিলাও ওদের দেখল, ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি ফুটে উঠল। তারপর পারিবারিক আবহে সময়টা কেটে গেল। বাচ্চাদের হাসি আর বড়দের উচ্ছ্বলতায় কোমল, উষ্ণ বৃত্ত বুনছে চারপাশে। ভালোবাসার নিঃশ্বাস আর একত্বের আনন্দের বন্ধনে একে অপরকে জুড়ে দিয়েছে। রাতে যে যার ঘরে ফিরে এলো। প্রত্যেক ঘরের আলো নিভে গেছে, শুধুমাত্র চাঁদের মৃদু আলো বারান্দায় ছায়া ফেলছে। রায়ান ওর দাদীর কাছে ঘুমায় এখন। কামিনী রিজওয়ানকে ঘুম পারিয়ে, বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রায়হানও সেখানেই ছিল। কামিনী হঠাৎ বলল,
— “তোমাকে একটা কথা কোনোদিন বলা হয় নাই। আজ মনে হয়, বলা উচিত।”

রায়হান অবাক হয়ে বলল,
— “বলো।”
— “আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”

রায়হান হেসে ফেলল। অনেকবার কামিনীর মুখ থেকে এই কথাটা শুনতে চেয়েছে, কিন্তু কেন যেন ও কখনো বলে নাই। কোনো কথা না বলে রায়হান কামিনীকে টেনে আনল, কোমলভাবে জড়িয়ে ধরল। কামিনী হালকা কণ্ঠে বলল,
— “অনেক দেরি করে ফেললাম না তো?”
— “একদম না।”
— “ভালোবাসি বুঝেছ। ততটা ভালোবাসি, যতটা ভালবাসলে নিজেকে ভালো রাখা যায়।”
বারান্দায় হালকা বাতাস বইছে, চাঁদের আলো দু’জনের মাঝে পড়ছে। তারা একে অপরের দিকে চোখ রাখছে, নিঃশ্বাস মিলছে নিঃশব্দে। তাদের এইমুহূর্ত অদৃশ্য প্রিয়াঙ্গনে ঘেরা; সেখানে কোনো শব্দের দরকার নেই, শুধুই অনুভূতির কোমলতা, অদৃশ্য বন্ধনের শক্তি আর নিঃশব্দ ভালোবাসার আবরণ। এই প্রিয়াঙ্গন সম্পর্ককে দেয় স্থায়ীতা, যেমন একটি ছোট অথচ অমলিন পলক চিরকাল হৃদয়ে লেগে থাকে।

পড়শী এখন শুধু ঘরের বউ নয়, ঘরের প্রাণের অংশও বটে। আরিয়া হওয়ার পর থেকে সে আরও অঙ্গঙ্গভাবে শাশুড়ির কলিজার টুকরো হয়ে গেছে, নিশ্ছল ভালোবাসা আর অনির্বচনীয় যত্নের সঙ্গে। যেদিন প্রথম এই বাড়িতে এসেছিল সেদিনই নরম গলায় শ্বাশুড়িকে বলেছিল, “মা, আমি কিচ্ছু চাই না। আপনি শুধু আমাকে মেনে নিন। আমার জীবনটা খুব কঠিন ছিল। ওই জীবন পেরিয়ে এসে এই জীবনে আমার বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই। আমি শুধু সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। আমার কাজ হবে আপনার বিশ্বাস ও ভালোবাসা জিতা, যাতে এই বাড়ি আমার জন্য শান্তির ঠিকানা হয়।”
আরিয়াকে কোলে নিয়ে সেই কথাই ভাবছিল পড়শী। তারপর কতকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। মা যেই অবহেলা দিয়েছিল তারচেয়ে হাজারগুন ভালোবাসা দিয়ে সেই ক্ষতস্থান পূরণ করে দিয়েছেন। ভাবনার মাঝখানে হঠাৎ আয়ান পেছন থেকে এসে পড়শীকে জড়িয়ে ধরল। পড়শী চমকে বলল,
— “ইশশশ, মেয়েটা সামনে!”

আয়ান আরও চেপে কাঁধে হেলান দিয়ে বলল,
— “তো? ও এখনও তো ছোটো।”
পড়শী লাজুক হেসে আয়ানের হাত ধরে টেনে আবার একটু দূরে সরল। কিন্তু চোখে চোখ রাখল, নিঃশব্দে মধুর যোগাযোগ স্থাপন হলো। আরিয়া তখন বাবা-মায়ের মাঝখানে বসে বিছানায় জুড়ে হাপ্পুড় দিচ্ছিল। পিতৃ-মাতৃ স্পর্শে ভর করে ওর ছোট হাত, আর বাবা-মায়ের চুম্বনে মিশে যায় খুশির মুহূর্ত। ঘর জুড়ে আলো-ছায়ায় মিশে গেছে তাদের প্রিয়াঙ্গন। এই প্রিয়াঙ্গনেই আঁকা হচ্ছে জীবনের শান্তি, হাসি, আর পরিপূর্ণতার ছবি।

শাহিদ আর অন্বেষা নিজেদের বাড়ি ফিরে এসেছে। দুই ছেলেকে ঘুম পারিয়ে এসে শাহিদের গা ঘেঁষে বসে ধীরস্বরে বলল,
— “এই তুমি কি আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না?”

শাহিদ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অন্বেষার চোখে হালকা ক্ষোভ। বলল,
— “কই? বাসি তো।”
— “তাহলে জড়িয়ে ধরছ না কেন? কত কাছে এসে বসেছি।”

শাহিদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— “ইয়ে মানে, এখন আমরা দু’জনে দুই ছেলের বাবা-মা হয়েছি।” অন্বেষা কটমট দৃষ্টিতে তাকাতেই শাহিদ আচমকা ওকে কোলে তুলে নিল। তার বুকের গরম স্পর্শ অন্বেষা মুখ গুঁজে দিল। বলল,
— “শুধু ছেলেদের জন্যই সময়, তাইনা? এখন আমাকেও দেখো।”

শাহিদ হেসে বলল,
— “অন্বেষা, আমি তোমাকে সেই প্রথমদিনের মতই ভালোবাসি আর সবসময়ই কাছে চাই।” অন্বেষা লজ্জা পেয়ে আরও শক্ত করে তাকে চেপে ধরল। তাদের দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেল। শাহিদ আর অন্বেষার এই মুহূর্তটা তাদের জীবনের নিজস্ব প্রিয়াঙ্গন। এই প্রিয়াঙ্গন হাজিরা দিচ্ছে তাদের ঘরোয়া সুখ, ভালোবাসা ও অন্তরঙ্গতার আবাসস্থল।

নাবিলা‌ নওশাদকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখল। কাল সকাল সকাল নাটোর যাবে। নওশাদ হওয়ার পর সাইরা আর সারাহ ওদের দাদুভাই আর দাদীর সাথেই থাকছে। সামির ঘুমন্ত ছেলের সাথে দুষ্টুমি করছিল। পেটে নাক ঘঁষে দিচ্ছিল। নাবিলা কাজ শেষ করে ফিরে এসে সামিরের দিকে কড়া গলায় বলল,
— “কি দুষ্টুমি করছ? কত কষ্টে ঘুম পারিয়েছি। সরো তো।”

সামির তখন নওশাদকে ছেড়ে দিয়ে, তার বদলে নাবিলার দিকে ঝুঁকল। নাবিলা আচমকা তাল সামলাতে না পেরে পাশের দিকে চিৎ হয়ে পড়ল। সামির তৎক্ষণাৎ ঝুঁকে এসে ওকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। কোমড় চেপে গালে গাল ঘষে হালকা বলল,
— “তবে আসো, তোমার সাথে দুষ্টুমি করি।”

নাবিলা কিছু বলার আগেই সামির ঠোঁটের আগ্রাসী স্পর্শে চুপ করিয়ে দিতে বাধ্য হলো। নাবিলা সরে গেল, কিন্তু সামির থামল না, সে আরও বেসামাল হয়ে উঠল। নাবিলা হেসে হাত ছাড়তে চাইলে সামির ঠাট্টা করে বলল,
— “ইশশশ, দুষ্টুমি দেখবে না? দেখো না, আমি কত দুষ্টুমি করতে পারি!”
— “ধুর, তুমি যে খুব বাজে একটা মানুষ তা জানো?”
— “জানলাম।”

নাবিলা হঠাৎ খানিক‌ আবেগে ভেসে গিয়ে বলল,
— “তুমি জানো, আমি তোমার কাছ থেকে কখনো দূরে থাকতে চাইনি।”
— “আমি তো দূরে রাখতেও চাইনি।”
আজ জোৎস্না রাত। জোৎস্নার আলো‌ সারা ঘরে ঠিকরে পড়ছে। নাবিলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সামিরকেও নিয়ে এলো। ওরা একে অপরের চোখে চোখ রাখে, চুপচাপ একরাশ অনুভূতি ভাগাভাগি করে। নাবিলা সামিরের হাতে হাত রাখে, সামির গায়ে ভর দিয়ে তার গায়ের ঘ্রাণ নেয়। এই নিঃশ্বাস, উষ্ণ স্পর্শ, ছোট্ট হাসি সবকিছুই শক্তিশালী প্রেমের সাক্ষ্য। নাবিলার চোখে লাজ, আনন্দের মিশ্রণ। সামির বলল,
— “আমার হৃদয় প্রতিক্ষণে তোমার নামে, তোমার জন্য ধুকপুক করে।”

নাবিলা সামিরের হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলল,
— “আমার হৃদয়ও প্রতিক্ষণে তোমায় খোঁজে, তোমার কাছাকাছি থাকতে চায়।”
— “তাহলে আমাদের হৃদয় এক হয়ে গেছে… কখনো আলাদা হবে না।”

নাবিলা সামিরের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,
— “আমরা একসাথে মিলেমিশে; প্রতিক্ষণ আর চিরকাল।”
— “আজ এই রাতে আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। দূরে কোথাও গিয়ে হারিয়ে যেতে মন চাচ্ছে। বেশি দূরে না, ততদূরে যেখান থেকে খুব সহজেই ফিরে আসা যায়।”
— “তাহলে আজও সেই সময়টার মতো করে আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে?”

সামির সুন্দর করে হেসে বলল,
— “নেব। তবে এইবার আর অবধারিত রুটিনে না, একেবারে ওই উত্তাল প্রেমের জোয়ারে একটু আলস্য মিশিয়ে, কারণ তুমি আর আমি দুজনেই জীবনের মানে বুঝেছি। কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা একই থাকবে, ভালোবাসার মানেটাও।”

নাবিলা বাতাসের মতো ফিসফিসিয়ে সামিরের চোখে চোখ রেখে বলল,
— “আচ্ছা, আচ্ছা।”
প্রকৃতির রং, ঘরের মৃদু আলো, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া ভালোবাসার অনুভূতি; সবকিছু মিলিয়ে ওরা নিজেদের ছোট্ট বিশ্বে হারিয়ে গেছে, যেখানে শুধুই একে অপরের জন্যই সময় আছে। ওদের সেই ছোট্ট বিশ্বের নাম হচ্ছে প্রিয়াঙ্গন। যেখানে সবাইকে ঘিরে রয়েছে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং একে অপরের প্রতি মমতা। আর এই প্রিয়াঙ্গনে নিজেদের জন্য রয়েছে ভালোবাসার গভীরতা, আত্মবিশ্বাস, নিরাপত্তা, হৃদয় ছোঁয়া কথা, পরিবেশের প্রতিফলন, স্নেহময় স্পর্শ, সময়কে থামিয়ে দেওয়ার অনুভূতি, ছলনাময় এবং পাগলামির সমন্বয়তা।

নোট: “প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। একে অপরকে ভালোবাসা, সমঝোতা, এবং স্নেহ দিয়ে আমরা নিজেদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে পারি। জীবন সবসময় জটিলতায় ভরা কিন্তু একসাথে থাকলে সমস্ত জটিলতা দূর হয়ে যায়। ভালোবাসা থাকলে এবং ভালোবাসার মতো করে ভালবাসতে জানলে সবকিছু পার করা সম্ভব।”
.
.
.
সমাপ্ত।
পড়াশোনা করা অবস্থায় দু’জন ছেলেমেয়ে যদি বিয়ে করে, তাহলে কী হতে পারে? স্বপ্ন, দায়িত্ব আর সম্পর্কের টানাপোড়েন; সবকিছুর মাঝেই কি তারা টিকে থাকতে পারে? নাকি ভেসে যায় অনিশ্চয়তার স্রোতে?
এই ভাবনা থেকেই গল্পের শুরু। তারপর কতটুকু কি করতে পেরেছি কিংবা কি লিখেছি তা আপনারাই জানেন। যাইহোক, অনেক ভুল-ত্রুটির পর যারা শেষ পর্যন্ত এসেছেন তাদের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা। ভালো থাকবেন সকলে।

[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ৩৭০৫