প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই পর্ব-১৭+১৮

0
407

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-১৭

সকালের শুরুটা হয়েছে প্রিয়াঞ্জনার অভূতপূর্বভাবে। প্রিয় মানুষটা কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আলতো করে ডাকছে।
“প্রিয়াঞ্জনা, উঠবেনা?”

আজ ঘুম বোধহয় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে প্রিয়াঞ্জনাকে। ঘুম জড়ানো কন্ঠেই উত্তর দেয়,
“হুম”
তারপর আবার ঘুমে তলিয়ে যায়। শাহবাজ আর ডাকেনি। থাক, ঘুমাক। শাহবাজ ফ্রেশ হয়ে নেয়। বাজার করা দরকার। ডায়েরি থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে চিরকুট লিখে,
“বাজারে যাচ্ছি। ভয় পেয়ো না। ভালোবাসি।”
পড়ার টেবিলে রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। ছাদের অর্ধেকই খোলামেলা। রেলিং এর পাশে বেশ কিছু গোলাপ ফুলের টব। পাখির কিচিরমিচির ভেসে আসছে দূর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় হঠাৎ করেই কারো সাথে ধাক্কা লাগে শাহবাজের। তাড়াহুড়োয় শাহবাজ খেয়াল করেনি। মেয়েটি দ্রুত সিঁড়ির রেলিং ধরে ফেলে। সি গ্রীণ রঙের টি-শার্ট, কালো টাউজার পরনে একজন সুদর্শন পুরুষ নাদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,
“তুমি ঠিক আছো, খুকি?”

ধ্যাঁত! খুকি? নাদিয়াকে কি ছোট মনে হয়? নাদিয়া এখন কলেজে পড়ে। লোকটারও কোনো দোষ নেই। ও তো এখন ফ্রক পরে আছে। হালকা গোলাপি রঙের একটি ফ্রক। তাই হয়তো ছোট ভাবছে। নাদিয়া মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়,
“আমার নাম খুকি নয়। নাদিয়া।”

বাচ্চা মেয়েটির কথার ধরণ দেখে হেসে দেয় শাহবাজ। একদম প্রীতির মতো মেয়েটা।
“ঠিক আছে, নাদিয়া। তুমি ঠিক আছো তো?”
“জ্বি। আপনি কি আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া?”
“হ্যাঁ”
“মা ডাকছে আপনাকে। বলেছে আজকের নাস্তা আমাদের এখানে খেতে।”
“আমি তো এখন বাজারে যাচ্ছি। ফিরে এসে খেতে যাবো।”
“আচ্ছা”

শাহবাজ নিচে নেমে যায়। বাজার সামনেই। পাঁচ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। নাদিয়া এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটার কন্ঠ এত সুন্দর! কিশোরী মনে হঠাৎ করেই নতুন অনুভূতি জাগ্রত হয়। শাহবাজ চলে গেলেও সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে নাদিয়া। ও বেশ চঞ্চল ধরনের মেয়ে। হলদে ফর্সা। একেবারে পুতুলের মতো। আদুরে। পরিবারের ছোট মেয়ে হওয়ায় সবাই তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। শাহবাজের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেনা সে। গত এক সপ্তাহ খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। শুধু জানে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ব্যস। নাদিয়া বিড়বিড় করে,
“নাদিয়া তবে কি তোর লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয়ে গেলো! ও মাই গড! ভয়াবহ ব্যাপার!”

আর নিজের গোলাপ গাছ দেখা হলোনা ওর। মোহগ্রস্তের মতন সে নিজের ঘরে চলে আসে। শুয়ে পড়ে বিছানায়। হৃদপিণ্ড খুব দ্রুত লাফাচ্ছে। কি আশ্চর্য!

প্রিয়াঞ্জনা বেশ কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে উঠে। দু’হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভাঙে। এলোমেলো কোমড় সমান চুলগুলো খোঁপা করে নেয়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে শাহবাজ নেই। কোথায় গেলো? ঘুমের ঘোরে তখন কিছুই বুঝতে পারেনি। তখনই টেবিলে নজর যায় তার। চিরকুটে চোখ বুলিয়ে হাসি ফুটে উঠে ঠোঁটের কোণায়। ফ্রেশ হয়ে নেয় প্রিয়াঞ্জনা। ঘরে সাদা রঙ করা। বিছানা গুছিয়ে ঘরের বাইরে বারান্দায় বেতের সোফায় বসে প্রিয়াঞ্জনা। হাতে একটি বই। জহির রায়হানের শেষ বিকেলের মেয়ে। আপাতত করার কিছুই নেই। তাই সে বই পড়বে। স্বপ্নের মত লাগছে সবকিছু। বই পড়া হয়ে উঠেনা ওর। খালি পায়ে ছাদে বেরিয়ে পড়ে। আকাশটা কি যে সুন্দর লাগছে। শরতের আকাশ এমনিতেও অনেক সুন্দর থাকে। রেলিং এর কাছে টবে বেশ কিছু গোলাপ ফুলের গাছ লাগানো। কি সুন্দর ঘ্রাণ! এখানে পুকুর রয়েছে। প্রিয়াঞ্জনার বারান্দা থেকে যেমন শ্যাওলাঘন পুকুর দেখা যেতো ঠিক তেমনই। প্রিয়াঞ্জনা ভাবে শাহবাজকে নিয়ে যাবে পুকুর পাড়ে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরে। প্রিয়াঞ্জনা পিছন দিকে মাথা এলিয়ে দেয়।
“কই ভাবলাম চমকে উঠবে!”
“আমি আপনার পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম।”

প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের মুখোমুখি হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। আহ্লাদী সুরে বলে,
“কি এনেছেন আমার জন্য? চিপস্ এনেছেন?”

এই মুহূর্তটা শাহবাজ কত মিস করতো! বসুন্ধরার ফ্ল্যাটে ক্লান্ত শাহবাজ যখন ফিরতো তখন এমনই ভাবে গলা জড়িয়ে ধরতো প্রিয়াঞ্জনা। আবদারও করতো ঠিক এভাবেই। পুরো আহ্লাদী একটা! শাহবাজের আদুরে বউ। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার নাকে নাক ঘঁষে বলে,
“এনেছি তো। মিষ্টি এনেছি। এখানে দিবো নাকি ঘরে গিয়ে?”

বলেই চোখ টিপে দেয়। ইঙ্গিত যাচ্ছে ঠোঁটের দিকে। প্রিয়াঞ্জনা একছুটে ঘরে চলে আসে। কি বেহায়া পুরুষ! শাহবাজ হা হা করে হেসে উঠে। বাজারের ব্যাগ নিয়ে ঘরে চলে আসে। টুকটাক যা প্রয়োজন সবই কিনে এনেছে। প্রিয়াঞ্জনার রান্নার হাত বেশ ভালো। আজ ভাবছে কোথাও ঘুরতে যাবে প্রিয়াঞ্জনাকে নিয়ে। কাল থেকে তো কাজে যোগ দিবে। তখন হয়তো প্রিয়াঞ্জনাকে আর বেশি সময়ও দিতে পারবেনা। প্রিয়াঞ্জনার হাতে বেশ কিছু চিপস, চকলেট তুলে দেয় শাহবাজ। অর্ধাঙ্গীর মুখের মিষ্টি হাসিটা বুকে শান্তি এনে দিচ্ছে তার।
“চাচি আমাদের খেতে ডেকেছে। চলো নাস্তা খেয়ে আসি।”
“হ্যাঁ, ফিরে রান্নার প্রিপারেশন শুরু করবো।”
“আজকে কোনো রান্না-বান্না নয়। আজকে আমরা বাইরে ঘুরবো। বাইরে খাবো।”

প্রিয়াঞ্জনা মলিন হেসে বলে,
“শাহ্, টাকা নষ্ট করাটা কি ঠিক হবে?”
“টাকা ভবিষ্যতে আসবে প্রিয়াঞ্জনা। আজকের দিনটা হয়তো আর আসবেনা। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী। বিগত চার বছরের সংসারে আমরা প্রতিটি দিন যেভাবে কাটিয়েছি এখনও ঠিক সেভাবেই কাটাবো। হয়তো তোমাকে আগের মতো সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড নিয়ে যেতে পারবো না। ভালো শপিং মল থেকে কিছু কিনে দিতে পারবো না। ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়াতে পারবো না। কিন্তু আই প্রমিস আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আমি সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করবো। তুমি আমার অনেক সাধনার প্রিয়াঞ্জনা।”

শেষের দিকের কথাটা কেমন ভিজে যাওয়া কন্ঠে বললো শাহ্! বুকটা ছেৎ করে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। শক্ত করে শাহবাজকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার কিছু চাই না তো। কেবল আপনি হলেই চলবে। আপনি যদি আমাকে নিয়ে গাছতলায়ও থাকেন শাহ্ আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার কেবল আপনাকে দরকার।”

বেশ কিছুক্ষণ চললো আবেগঘন মুহূর্ত। অতঃপর দুজনে নেমে এলো নিচে। বদরুজ্জামান সাহেব কলেজে চলে গিয়েছেন। নাজমা রুটি, আলুভাজি আর গরুর গোশত খেতে দিলেন। নাজমাকে দেখলে নিজের মায়ের কথা মনে হয় প্রিয়াঞ্জনার। বুকের কোথায় যেন হু হু করে উঠে। সুমনাকে একটা ফোন করা প্রয়োজন। প্রীতম যে সুমনার উপর অ ত্যা চা র চালাবে তা তার জানা। কিন্তু যদি পুলিশি ঝামেলা করে তার পরিবার! যদি সিম অন করলে জায়গা ট্রেস করে ফেলে! ভয় হয় প্রিয়াঞ্জনার। এই সুন্দর মুহূর্তগুলো সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না।

(চলবে)…..

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-১৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

“প্রাপ্তি মাত্র এসএসসি দিবে ফাহিম ভাই। ওর তো এখনও আঠারো বছরও হয়নি। ওকে কি করে বিয়ে দেই?”
“মেয়েরা আঠারোর আগেই ম্যাচিউর হয়ে যায় প্রীতম। তাছাড়া এখনই তো আমি ওকে উঠিয়ে নিবো তা বলছিনা।”
“কিন্তু বাবা-মা..
” তুমি রাজি করাবা। দেখো প্রীতম এই জগতে কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তুমি বলছো আমেরিকা যেতে চাও। আমি এর বদলে প্রিয়াকে চেয়েছিলাম। প্রিয়া তো পালিয়ে গেলো। তোমার দিকটা ভেবে দেখলাম। তুমি এত করে যেতে চাচ্ছো। আমারও ইচ্ছা তোমাকে নেওয়ার। এখন আমি তোমার দিকটা দেখবো তোমার কি উচিত না আমার দিকটা দেখা?”
“তা তো উচিত ভাই”
“তাহলে ভেবে দেখো। আমি আর বেশিদিন দেশে থাকবো না। মেয়ের তো অভাব পড়ে নাই। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয়না। আমি ভালো মেয়েই পাবো। তুমি কিন্তু সুযোগটা আর দ্বিতীয়বার পাবা না। আজ আসি। পরশুর মধ্যে জানিয়ো।”
“বসেন ভাই। মায়ের সাথে দেখা করে যাবেন। চা খান।”
“না, প্রীতম। জরুরি কাজ আসে। আজ উঠি।”

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঐদিনের ফাহিমের সাথে কথোপকথনটা স্মরণ করছিলো প্রীতম। বাবা-মাকে এখনো সে কিছু বলেনি। তাদের তো অভাব নেই যে মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হবে। এদিকে সুযোগটাও হাত ছাড়া হয়ে যাবে। স্বর্ণা আপেল খাচ্ছিলো খাটে বসে। প্রীতম কে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবো এত?”
“প্রাপ্তির বিয়ের ব্যাপারে ভাবতেছি। কাজটা কি ঠিক হবে কিনা!”
“ঠিক আর বেঠিক কি! আমি বিয়ে করছিনা অল্প বয়সে? মাও তো হয়ে যাবো কিছুদিন পর।”

স্বর্ণার কথাটা বেশ ভাবালো প্রীতমকে। ঠিকই তো! স্বর্ণা তো ইন্টারে পড়াকালেই ওর সাথে প্রেম করেছে। তারপর বিয়ে। এখন বাচ্চা হবে। অন্যের মেয়ে দেখেই হয়তো প্রীতম এতকিছু ভেবে দেখেনি। অথচ নিজের বোন বলে কতকিছু ভাবছে! এটা ঠিক প্রাপ্তিকে সে অন্য বোনদের তুলনায় বেশি স্নেহ করে। স্বর্ণার এলোমেলো চুল কানে গুঁজে দিয়ে প্রীতম বলে,
“ধন্যবাদ, বউ।”

প্রীতমের বুকে মাথা রাখে স্নেহা। দরজা খোলা ছিল, ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে সুমনা। এত বছরের অভ্যাস। নিজের ঘর বলে কথা। নক করার ব্যাপারটা মাথায় ছিলোনা। স্বর্ণাকে প্রীতমের বুকে দেখে কেমন স্তব্ধ হয়ে যায় সে। প্রীতম প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খায়। তবে স্বর্ণা তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাই সে আর স্বর্ণাকে সরিয়ে দেয়নি। সুমনার চোখে অশ্রু নেই। সাদা একটা থ্রি-পিস পরনে। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে আছে তার মুখখানি। চোখে কোনো অনুভূতি নেই। একেবারে অনুভূতিহীন। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে। দূরে ডাকছে কিছু দাঁড়কাক। বাতাস বয়ে গেলো শনশন শনশন। নিরবতা ভাঙে প্রীতম। শুধায়,
“কি চাই?”

হয়তো কোনো এক সময়ের ভালোবাসা থেকেই ধমকে প্রশ্ন করেনি। করেছে নমনীয় সুরে। প্রথম স্ত্রীর সামনে গর্ভবতী অপর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করছে ‘কি চাই!’। কত নি কৃ ষ্ট !
সুমনা উত্তর দেয়,
“কিছু জিনিস নিতে এসেছি। একেবারে নিয়ে চলে যাবো। যেন দ্বিতীয়বার আর এই ঘরে না আসতে হয়।”
“গুড ডিসিশন। যা করবে তাড়াতাড়ি করো। আমরা পার্সোনাল টাইম স্পেন্ড করছি।”

তড়িঘড়ি করে ওয়্যারড্রোব হতে নিজের সমস্ত জিনিস নিয়ে নেয় সুমনা। নিজে টিউশনি করিয়ে স্বর্ণের দুল, গলার চেন করেছিলো। তা অবশ্য শরীরেই আছে। হাতের স্বর্ণের চুড়ি দু’খানা প্রীতমের দেওয়া। সেগুলো খুলে রাখে ড্রেসিং টেবিলের উপর। নিজের সমস্ত সার্টিফিকেট রাখা ফাইলটাও নেয়। কেমন যেন হু হু করে উঠে অন্তর। মানুষটাকে শুধু ভালোবাসেনি সুমনা। ভালোবেসেছিলো এই ঘরের প্রতিটি আসবাবকেও। নারীর মায়া জড় বস্তুতেও হয়। কথাটা একশত ভাগ সত্য। এত বছরের সংসার। মায়ায় জড়িয়ে গেছে সুমনা। তীব্র ব্যথা হচ্ছে অন্তরে। অথচ বলার মতো কেউ নেই। তারা দুজন জড়াজড়ি করেই বসেছিলো পুরোটা সময়। সুমনা যখন বেরিয়ে যাবে তখন পিছু ডাকে প্রীতম। সুমনা পিছনে না ফিরেই বলে,
“বলো”
“নক না করে আর এসো না ঘরে”

সুমনা পাঁচ সেকেন্ডের জন্য পিছু ফিরে চায়। প্রীতম ভরকে যায়। কি অদ্ভুত দৃষ্টি! ঘৃ ণা? হৃদয়ের কোথাও একটু হলেও খটকা লাগে। তবে চাকচিক্য, লোভের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় প্রীতমের সে আবেগ।

মা-বাবার ঘরে এসেছে প্রীতম। জোহরা আসরের নামাজ সেরে তসবিহ নিয়ে বসেছেন। প্রবীর খাটে বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন।
“আম্মা কিছু কথা ছিল আপনাদের সাথে।”

জোহরার মন মেজাজ খারাপ থাকে এখন। অনেক সময় মানুষ জেদ করে। আর জেদ পূরণ না করতে পারলে মনে ক্ষোভ জন্মে। তেমনি ক্ষোভ জন্মাচ্ছে জোহরার মনেও। প্রিয়া কিংবা শাহবাজ যে কোনো একজনকেও সামনে পেলে তিনি আ ঘা ত করে ফেলবেন। এটা তিনি ভালো জানেন। তাই নামাজে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছেন। যেন আল্লাহ তার মাথাটা ঠান্ডা রাখেন।
“কি বলবি?”

ফ্লোরে জায়নামাজে বসেই জিজ্ঞেস করলেন জোহরা। প্রীতম খাটে বসতে বসতে বললো,
“বাবা আপনাকেও বলার আছে।”

প্রবীর ম্যাগাজিন রাখলেন।
“বলো, কি বলবে।”
“ফাহিম ভাইয়ের সাথে তো প্রিয়াকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা আমরা সবাই করছিলাম। কথা অনুযায়ী প্রিয়ার ডিভোর্স হওয়ার কয়েকমাস পরই তাদের বিয়ে হতো। কিন্তু প্রিয়া পালিয়ে গেলো। এটা কথার খেলাপ হইলো না?”
“প্রীতম, আমি তো আগেই বলেছি এ ব্যাপারে যেন আর কথা না হয় ঘরে। এখন তুমি কি চাচ্ছো?”

জোহরা মাঝে বলে উঠলেন,
“কি আবার থানায় জিডি করার কথাই ভাবতেছে।”
প্রীতম মায়ের পানে তাকিয়ে বললো,
“না, মা। তেমন কিছু না। এগুলা করলে মানসম্মান যা আছে তাও থাকবেনা। আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। প্রাপ্তির সাথে ফাহিম ভাইকে বেশ মানাবে।”

প্রবীর অবাক হওয়া সুরে বললেন,
“মানাবে মানে? ও তো ছোট বাচ্চা।”

বাবার কথাকে তেমন পাত্তা দিলো না প্রীতম। মাকে রাজি করাতে পারলে বাবা এমনিতেই রাজি হবেন।

“আকদ করিয়ে রাখলাম। আমরা তো ফাহিম ভাইকে কথা দিছিলাম। তাই না বাবা?”

তারপর মায়ের দিকে ফিরে বললো,
“আম্মা, আপনিই ভাবেন প্রিয়া কি কাজটা করলো! এই এক কাজ যদি প্রাপ্তি-প্রীতি করে? ছোট থাকতে নিজেদের পছন্দের পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে পারবেন।
ফাহিম ভাই তাদের পরিবারের একমাত্র ছেলে। আমেরিকাতে সেটেল্ড। আত্মীয়ের মাঝে আছে। বয়স না হয় কিছুটা বেশি। এটা কোনো সমস্যাই না। আমার মনে হয় প্রাপ্তি ভালো থাকবে।”

জোহরা মনোযোগ দিয়ে কথাটা শুনলেন। সবকিছু ছাপিয়ে একটা কথাই তার মস্তিষ্কের মাঝে ঘুরঘুর করছে। যদি প্রাপ্তি-প্রীতিও এক কাজ করে! প্রিয়ার মতো করে! তিনি বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর প্রবীর কে বললেন,
“প্রীতমের কথাই ঠিক। প্রাপ্তিরে ফাহিমের সাথেই বিয়া দিবো প্রীতমের বাপ।”
“কিন্তু জোহরা এত ছোট মেয়েটাকে!”
“ছোট ছোট কইরো নাতো। এসএসসি দিবো। এই বয়সে বাচ্চার মা হইছিলাম আমি। তুমি কি চাও একটার পর একটা কলঙ্ক হইতে থাকুক? আর প্রীতম শুধু প্রিয়ারে দোষ দিস না। তুইও কোনো দুধের ধোঁয়া তুলসি পাতা না।”

প্রীতম মাথা নিচু করে। বলে,
“না, মানে আম্মা…
” হইছে, বুঝছি। ফাহিম রে কল দে। রাতে যেন মাকে নিয়া আসে। কথা-বার্তা বলি।”
“আচ্ছা, আম্মা।”

প্রবীর আর কিছু বলেন নি। জোহরার উপর এমনিতেও তিনি বেশি একটা কথা বলেন না।

___________________

আজ ঘুরেছে শাহবাজ আর প্রিয়াঞ্জনা। সকালের নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পরেছিলো। নরসিংদীর সোনাইমুড়ী টেকে সারাদিন ছিলো।
শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের কুন্দারপাড়া বাজারের পাশেই সোনাইমুড়ি টেক বা পাহাড় অবস্থিত। লাল মাটির পাহাড়ি টিলা এবং পাহাড়ের উপর সমতল ভূমিতে বসতবাড়ী সমৃদ্ধ সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সোনাইমুড়ির এ এলাকাটি। লাল পাহাড়ি টিলাগুলো কি যে সুন্দর লাগছিলো! সবুজে ঘেরা চারপাশ। তারা একটি বেঞ্চে বসেছিলো। মাথার উপর ছিলো বাগান বিলাস গাছ। চোখের সামনে বহমান বিল। তাতে ফুটে আছে কতশত শাপলা। শাহবাজের কাঁধে প্রিয়াঞ্জনার মাথা। কত নাম না জানা পাখির কূজন! সবচেয়ে বেশি অভূতপূর্ব ছিলো খঞ্জন পাখির উড়ে বেড়ানো। বন খঞ্জন, সাদা খঞ্জন, বড় পাকড়া খঞ্জন, পাকড়া খঞ্জন, ধূসর খঞ্জন, হলুদ খঞ্জন, হলদে মাথা খঞ্জন, কালো মাথা খঞ্জন। পাখিগুলো চমৎকার ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিলো! নিরব এই পরিবেশে প্রিয় মানুষটার সাথে বেশ সময় কেটেছে প্রিয়াঞ্জনার।
খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে দুজনে। রিকশা চলছে।
“প্রিয়াঞ্জনা, ভিষণ মিষ্টি লাগছে।”
“পঁচিশ বার।”
“কি পঁচিশ বার?”
“আপনি এই একই কথা এই নিয়ে পঁচিশ বার বললেন জনাব?”
“কি করবো বউ? নীল শাড়ি, খোলা চুল, হাতে চুড়ি। কিউট একখানা মুখ! এত সুন্দর লাগছে তোমাকে! আমার মুখে বারবার একই কথা চলে আসছে!”

লাজুক হাসে প্রিয়াঞ্জনা। আজ তারা নীল পরেছে। আকাশের মতো স্বাধীন নীল। প্রিয়াঞ্জনা লজ্জায় বলতে পারেনা, ‘আপনাকেও নীল পাঞ্জাবিতে খুব সুদর্শন লাগছে শাহ্!’

পাকা সড়কে রিকশা চলছে। প্রিয়াঞ্জনা আঁকড়ে ধরে আছে তার শাহ্ এর হাত। শরতের স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। রাস্তার দুপাশে কাশফুলগুলো দুলছে সে বাতাসের তালে। জীবন এত সুন্দরও হয় বুঝি!

(চলবে)….