#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-২৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
অধ্যক্ষ মোশতাক সরকারের কক্ষে দুজন ব্যক্তি বসে আছেন। দুজনেই শেখের চড় অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। সরু বারান্দা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর এই কক্ষটি চোখে পড়ে। মেইনগেটের সাথে লাগোয়া কামড়া। শাহবাজ শুধায়,
“স্যার, আসবো?”
ভারী চশমা পরেন মোশতাক সরকার। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন সুদর্শন, ভদ্র ছেলেটার পানে। উনার ছেলের বয়সী। মুখে বললেন,
“আসুন, স্যার।”
অধ্যক্ষ স্যারের কাঁচের বড় টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার রাখা। সেখানে বসে আছেন কাপড় ব্যবসায়ী আকরাম খাঁ এবং সুঁতো ব্যবসায়ী ছলিমুদ্দীন। আকরাম খাঁ শাহবাজের চেয়ে বড়জোর বয়স পাঁচেকের বড় হবে। কালো দীর্ঘাকার শরীর। রাগী চোখ। স্বাভাবিকভাবে তাকালেও মনে হয় রেগে আছেন। গলার সুর বেশ মোটা। একসময় বেশ প্রতিযোগিতা দিতো শাহবাজের সাথে। আজ ভাগ্য কোথায় এনে দাঁড় করালো শাহ্কে! ছলিমুদ্দীন বয়স্ক মানুষ। লাল দাঁড়ি মুখে। পরনে পাঞ্জাবি। শাহবাজ পাশে এসে দাঁড়ায়। সময় দেওয়া হয়েছিলো দুভাবে। এই দুজন সময় দিয়েছিলেন তিন মাসের। কারণ তাদের টাকার অংক কম। পঞ্চাশ লক্ষ। আর বাকি তিনজন সময় দিয়েছিলেন ছয় মাসের। মনে হচ্ছে না তারা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবেন। তাছাড়া তিনমাসও তো এখনো হয়নি। আরো বেশ কিছুদিন বাকি আছে। অধ্যক্ষ স্যার বললেন,
“উনারা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আপনি চিনেন?”
শাহবাজ খুব লজ্জা পাচ্ছে। তার মুখটা লালবর্ণ হয়ে উঠেছে। উত্তর দিলো,
“জ্বি”
তারপর আকরামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাই, বাইরে চলেন। এটা আমার কর্মক্ষেত্র।”
আকরাম ধমকে উঠলেন।
“কেন? যা বলার স্যারের সামনেই বলেন।”
“চাচা, বাইরে চলেন। এখানে হাঙ্গামা না করি।”
ছলিমুদ্দিন নরম হলেন। আকরামকে বললেন,
“ভাতিজা, চলো বাইরে গিয়াই কতা কই। হের একটা মান সম্মানের ব্যাপার আছে।”
“রাখেন তো চাচা, বাটপারের আবার মান-সম্মান!”
শাহ্ এর কথাটা লাগলো খুব।
“আকরাম ভাই, কথাবার্তা সামলে বলবেন। আপনিও জানেন আমিও জানি আসল ঘটনা কি। আমি যে টাকা নেইনি এটা মনে হয় পুরো মাধবধী, শেখের চড় বাসীরাই জানে। হাতি বিপদে পড়লে চামচিকাতেও লাথি মা রে।”
আকরাম দাঁড়িয়ে গেলেন। অনেকটা তেড়েই গেলেন শাহ্ এর দিকে। উঁচু গলায় বললেন,
“তুমি মুখ সামলে কথা বলো।”
মোশতাক অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন,
“থামেন। এভাবে একজন মানুষের কাজের জায়গায় এসে ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করা ঠিক না। এটা শাহবাজের কাজের জায়গা। আপনারা কথা বললে বাইরে কোথাও বসে বলুন।”
ছলিমুদ্দিনও একই কথা বললেন। বাধ্য হয়ে আকরামকেও তা মানতে হলো। শাহ্কে সে এবার খেল দেখিয়ে ছাড়বে। খুব তেজ ছিলো একসময়। শাহবাজ চৌধুরীর নাম ডাকে চায়ের দোকানে বসা যেতোনা। এত সুনাম হতো তার। আর আজ! মাঝেমধ্যে হাসি আসে তার। কলেজের বাইরে টং দোকান। শাহবাজের সাথে মোশতাকও এসেছেন। ডানপাশের বেঞ্চিতে বসলো শাহবাজ আর মোশতাক স্যার। বামপাশের বেঞ্চিতে ওরা দুজন। আকরাম বললো,
“আমাদের টাকা কবে দিবা?”
“সময় তো শেষ হয় নাই এখনো। আরো তো কিছুদিন সময় আছে। সালিশে তো তাই কথা হয়েছিলো।”
“রাখো, তোমার সালিশ। টাকার পোড়ানি বুঝো তুমি?
স্যার আপনে তো জ্ঞানী মানুষ। আপনে বলেন পঞ্চাশ লাখ টাকা কি হাতের মোয়া? টাকা যদি সময় মতো না পাই!”
মোশতাক অবাক হলেন। শাহবাজ বললো,
“আপনারা একবারও কি আমার অনুমতি নিয়েছিলেন টাকা দেওয়ার আগে?”
ছলিমুদ্দিন মুখ খুললেন,
“পুরানা কতা উঠাইয়ো না মিয়া। স্ট্যাম্পে তোমার সাইন আছিলো। তোমার চাচায় বললো তুমি বলছো টাকার কতা। তাছাড়া তোমার জামাল চাচা আছিলো তোমার ডাইন হাত। এটা তো আমরা সবাই জানতাম। সে আইসা বললো টাকা দেন। সাইনও আছে। এরপরে কি আর না আছে?”
আকরাম বললেন,
“এসব কথা থাক। আমরা আসছি হুঁশিয়ার করার জন্য। আগামী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে টাকা চাই শাহবাজ। নয়তো খুব খারাপ হইবো। ভাইবো না
মা র ধো র হইবো। ডাইরেক্ট একশনে নামবো আমরা। কিছুদিন জেলের ভাত আর রিমান্ডের সিদ্ধ ডিম ভিতরে ঢুকলে টাকা আপনাআপনি বের হইবো নে।”
এত লজ্জা পেলো শাহবাজ। তার মাথা নিচু হয়ে গেলো। তারা চলে গেলেন। মোশতাক শাহবাজকে কি বলবেন বুঝে পেলেন না। উঠে চলে এলেন। ছেলেটাকে দেখে যা বুঝেছেন খুবই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। হয়তো তার সামনে এসব কথা হওয়ায় লজ্জা পেয়েছে।
সন্তান হওয়ার খবরে ঠিক যতটা খুশি হয়েছিলো শাহবাজ এখন যেন ঠিক ততটুকুই মুষড়ে পড়লো। সে টাকা দিতে পারবেনা। এটা তো নিশ্চিত। এত টাকা কোথায় পাবে সে! সব তো শেষ। নিজের বাসস্থান পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। আর কি করবে শাহ্! দু’হাতে মুখ ঢেকে বেঞ্চিতে বসে রইলো শাহ্। তার ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে যদি জেলে চলে যায় প্রিয়াঞ্জনার কি হবে! কিছু ভাবতে পারছেনা শাহবাজ। কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। এখন সময় প্রায় সাড়ে চারটা। চিন্তায় চিন্তায় সাড়া শরীর ঘামছে তার। সাদা শার্ট ঘামে ভিজে চুবচুবে। শাহবাজ বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
‘আমার দুঃখগুলো সযত্নে মুছিয়ে দিও তোমার সুখেরও পরশে’
প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলো। যদিও সকালবেলা সব রান্না-বান্না করেই শাহবাজ কলেজ গিয়েছে। তারপরও প্রিয়াঞ্জনারও তো মন চায় প্রিয় মানুষটাকে এটা-সেটা করে খাওয়াতে। ঘরে ঢুকেই প্রিয়াঞ্জনাকে রান্না ঘরে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো শাহবাজের। বাড়ির পাশে বাজারে একজন ডাক্তার আপা বসেন। প্রিয়াঞ্জনাকে সেখানে দেখিয়ে এনেছে শাহবাজ। আপা বলেছেন একবার যেন জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখিয়ে আসে। আর বলেছেন খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করতে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে।
হাতে তেমন টাকা নেই। বেতন পেলে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে মনস্থির করেছিলো শাহবাজ। কিন্তু মেয়েটা ওর একটা কথাও শুনেনা।সারাদিন এইকাজ, ঐকাজ। মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিলো। রান্না ঘরে ঢুকেই প্রিয়াঞ্জনাকে একটু উচ্চ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি করছো তুমি?”
“আপনি এসে গেছেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আলুর চপ করেছি। মুরগির ঝোল দিয়ে খাবেন। আপনার অনেক পছন্দ তো শাহ্। প্লিজ, বকবেন না। মুরগীর ঝোল তরকারি করলে সবসময় আপনাকে চপ করে দেই। আজ তাই মনটা মানলো না শাহ্।”
মৃদু সুরে বললো প্রিয়াঞ্জনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাহবাজ। এরপরে আর কি বলার থাকে তার। অসহায় কন্ঠে বললো,
“সবসময় আর এখন কি এক প্রিয়াঞ্জনা!”
“সেসব বাদ দিন। আজ কিন্তু আপনি বলেছিলেন আমাকে মেলায় নিয়ে যাবেন। না করতে পারবেন না কিন্তু!”
প্রিয়াঞ্জনার উৎফুল্ল কন্ঠ শুনে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা আর তার কাছে প্রকাশ করেনি শাহবাজ। প্রিয় খাবারও যেন গলা দিয়ে ভালো করে নামলো না শাহবাজের। মুখে হাসি বজায় রেখে প্রিয়াঞ্জনাকে বলেছে,
“ভিষণ মজা হয়েছে।”
আসলে অনেকেই বলে পুরুষেরা অভিনেতা। তারা ভালো অভিনয় করতে জানে। সত্যি তাই। মনের মাঝে হাজারো কষ্ট, মাথায় এক আকাশ চিন্তা রেখেও দিব্যি তারা পরিবারের সামনে হেসে যায়। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করলেও হাসিমুখে পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প করে। পুরুষ হওয়া এত সহজ নয়। শত কষ্ট, চিন্তার মাঝে থাকলেও প্রিয় মানুষদের বলতে হয় ‘আমি ভালো আছি’। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে তাদের এই আত্মত্যাগ।
নীল আকাশ। তুলতুলে মেঘেরা আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশাল বিলের পাশে মেলা জমেছে। মানুষজনের ভিড় প্রচুর। প্রিয়াঞ্জনার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে শাহবাজ। যদিও এই সময় প্রিয়াঞ্জনাকে মেলায় নিয়ে আসার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলোনা। কিন্তু এমন ভাবে আবদার করলো! জানে তো কিভাবে তার শাহ্ মানবে। নিজ থেকে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলেছে, ‘মেলা জমেছে নিয়ে যাবেন না শাহ্?’ আর না বলার উপায় ছিলো মহারাণীকে!
হরেকরকম দোকান বসেছে। কসমেটিকস, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, জিলাপি, ফুচকার দোকান আরো কত কি! দুজনে বিলের পাশ ঘেঁষে হাঁটলো অনেকটা সময়। বিলের পানি সবুজ রঙা। শাপলা ফুল নেই। তবে পাতা আছে অনেক। শো শো করে বাতাস বইছে। প্রিয়াঞ্জনা কোনো কিছুর বায়না করছেনা। আসলে তেমন কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও শাহবাজের নেই। যে টাকা হাতে আছে তাতে আরো কিছুদিন চলতে হবে। খাবারে এখন ভালো জিনিস রাখতে হয়। ফল রাখা লাগে ঘরে। বাবু আর বাবুর মা উভয়ের জন্য তা প্রয়োজন। খুব সুন্দর একটি পায়েলের দোকান বসেছে। লাল, নীল, সবুজ পাথর দেওয়া একটা পায়েল পছন্দ হয়ে গেলো শাহ্ এর। প্রিয়াঞ্জনার পায়ে বেশ মানাবে। জিজ্ঞেস করলো,
“দাম কত চাচা?”
“একদাম পঞ্চাশ”
প্রিয়াঞ্জনা মানা করছে।
“আমার পায়েল লাগবেনা শাহ্”
“আমার যে লাগবে! আমার প্রিয়ার পায়েল পরা পা।”
আস্তে করে প্রিয়াঞ্জনার কানে কানে বললো শাহ্।
দোকানদারকে বললো,
“চাচা, কম হয় না?”
“না। একদাম।”
শাহবাজ কিনলো পায়েলটি।
“আপনিও না শাহ্! ছোট বাচ্চাদের মতো করেন। পাগল একটা।”
শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার ডান হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“পাগল তাইনা? পাগলেরা কিন্তু কামড়ে দেয়। তা তোমার কোথায় কামড় চাই?”
“বেশরম”
হাসছে শাহবাজ। একটু হলেও যেন সেসময়ের কথাগুলো মন থেকে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছে সে। এই মুহূর্তটা তো আর আসবেনা! নাগরদোলা থেকে কিছুটা দূরে বড় চিংড়ি মাছের মাথা ভাজা হচ্ছে। এটা আবার প্রিয়াঞ্জনার পছন্দের খাবার। শাহবাজ জানে। এখন তো জীবনেও মুখ ফুটে বলবেনা। শাহবাজ দুটো নিলো বিশ টাকা দামের। কিন্তু এরপরই নাগরদোলার এখান থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এলো। যা শোনা গেলো, একটি পাঁচবছরের ছোট বাচ্চা নিচে পড়ে গেছে। মাথা ফেটে মস্তিষ্ক বেরিয়ে গেছে। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান থেকে বেশ দূরেই নাগরদোলা। খোলা বড় মাঠ হওয়ায় দূরে দূরে সবকিছু। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনা কে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। প্রিয়াঞ্জনার শরীর কাঁপছে রীতিমতো। সেদিনের ভেলানগরের
এক্সি ডেন্টটার কথা মনে পড়ে গেলো তার। এক পর্যায়ে বুকের মাঝে প্রিয়াঞ্জনাকে টেনে নিলো শাহ্। দূরত্ব কম তাও রিকশা নিলো শাহবাজ। একেই হয়তো বলে, ‘অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়’।
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহবাজ। খুশি কখনোই তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শাহবাজ চৌধুরীর জীবন বড্ড অন্যরকম।
(চলবে)…
#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৮
আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোৎস্না সর্বত্র। ‘চন্দ্রবিলাস’ ঘরটি সত্যিকার অর্থেই নামের মান রক্ষা করেছে। যিনি তৈরি করেছেন তিনি যে যথেষ্ট শৌখিন তা এক জ্যোৎস্নারাত ঘরে কাটালেই বোঝা যায়। খোলা বারান্দায় পাটি পেতে নিচে বসে আছে শাহবাজ চৌধুরী। তার বুকে চুপচাপ মাথা রেখে বসে আছে প্রিয়াঞ্জনা। বাম হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শাহ্। অপর হাতে চায়ের মগ। জ্যোৎস্নারাতে সকল আলো নিভিয়ে প্রিয় মানুষটাকে বুকে নিয়ে চা ভাগাভাগি করে পান করার অনুভূতি স্বর্গীয়। হালকা মৃদু ছন্দে বাতাস বইছে। পড়ন্ত বিকেলে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে কানে একরকম শব্দ আসে। সমুদ্রের ঢেউ আর হাওয়ার সংমিশ্রণে শব্দটি তৈরি হয়। এখানে অবশ্য আশেপাশে সমুদ্র নেই। তবে শব্দটি আসছে। সাথে ঝিঁঝি পোকার দল তাল মেলাচ্ছে। শাহবাজ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় প্রিয়াঞ্জনার কপালে।
“এখনো ভয় লাগছে?”
প্রিয়াঞ্জনা নিজের শাহ্ এর বুকে মুখ ঘষে। শাহ্ এর শরীরে এত প্রাণ কাড়া ঘ্রাণ! প্রতিটি নারীই বোধহয় স্বীয় পুরুষের শরীর হতে এমন ঘ্রাণ পায়। যা তাকে আকর্ষণ করে নিজস্ব পুরুষের আরো নিকটে যেতে। মুখে বলে,
“ভয় পাচ্ছিনা, শাহ্। আপনার বুকে মাথা রাখলে পৃথিবীর কোনো ভয় আমাকে স্পর্শ করতে পারেনা।”
ঠোঁটের কোণা প্রশস্ত হয় শাহবাজের। তার অর্ধাঙ্গী তাকে অনেক ভরসা করে। সে জানে। শাহবাজ ভরাট কন্ঠে গেয়ে উঠে,
“হামে তুমছে পেয়ার কিতনা
এ হাম নেহী জানেতে…
মাগার জী নেহী ছাকতে তোমহারে বিনা
হামে তুমছে পেয়ার……
নিস্তব্ধ রাতে প্রতিধ্বনি তুলে গানের সুর।
রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। সুমনা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। এত দ্রুত গাড়িগুলো যায়! রাস্তা পাড় হওয়ার সুযোগ নেই। আশেপাশে ব্রিজও নেই। চারটা পর্যন্ত স্টোরে কাজ করেছে। তারপর টিউশনি করিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে সুমনা। মিরপুর ২ এ একটা ছেলেকে পড়ায়। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এত দুষ্ট! সেখান থেকে আবার যায় মিরপুর ১০ এ। সেখানে পড়ায় মিতুল নামের একটি মেয়েকে। সারাদিন কাজের উপরেই থাকতে হয়। এখন শরীরটা এত ক্লান্ত লাগছে! বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিবে। তারপর আবার ব স্তির বাচ্চাগুলো চলে আসবে। ঘরের বাইরে ছোট উঠানের মতন আছে। সেখানে একটি ব্ল্যাক বোর্ড টানিয়েছে সুমনা। নিচে বড় পলিথিন পেতে দেয়। বাচ্চাগুলো বসে সেখানে।
রাস্তা পাড় হয়ে ওপাশে গেলে বাস পাওয়া যাবে। কি এক ঝামেলা। অন্ধকারের মাঝে আচমকা লাইট সহ্য করা যায় না। বড় বড় বাস, ট্রাকের আলো এত লাগছে চোখে! মাথাও ঘুরছে। আশেপাশে আরো মানুষজন আছে। সবাই রাস্তা পাড় হওয়ার জন্যই দাঁড়িয়েছে। একসময় খানিক ফাঁকা হয় মেইন রোড। সবার সাথে রাস্তা পাড় হয় সুমনা। ঢাকা শহর কখনোই শান্ত হয় না। এত রাতেও কত মানুষ আশেপাশে। বাসে উঠা আরেক সংগ্রাম। ঠেলাঠেলি করে উঠতে হয়। তারউপর আবার সিট নেই। সুমনার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হয়ে এলো,
“ধ্যাঁত!”
যেই সিটের পাশে দাঁড়িয়েছে সেখানে বসা কালো হিজাব, নেকাব পরা একজন মহিলা। জানালার পাশে পুরুষ মানুষটি বসা। সুমনা চেনার চেষ্টা করলো। মইনুল সাহেব না? ইংরেজি শিক্ষক? তার ভাবার মাঝেই মইনুল জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু মনে করবেন না। আপনি কি সুমনা?”
থতমত খায় সুমনা। নিজেকে সামলে হাসি মুখে উত্তর দেয়,
“জ্বি, ভালো আছেন?”
“ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“আছি, আলহামদুলিল্লাহ।”
মহিলাটিকে দেখিয়ে বলেন,
“আমার স্ত্রী। পনেরো দিন হয় বিয়ে করেছি। ও বললো ঢাকা ঘুরবে। তাই নিয়ে আসা।”
বোরকা-নিকাবে আসলে মেয়ে মানুষের বয়স বোঝা যায় না। সুমনাকে মেয়েটি সালাম দিলো। কন্ঠ একেবারেই তরুণীদের মতো। বেশ অনেকক্ষণ গল্প করলো তারা। সুমনার ইচ্ছে করছিলো বাড়ির খোঁজ নিতে। কিন্তু মনকে বোঝালো অতীতের কোনো স্থান তার জীবনে নেই। বাস আজিমপুর আসতেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লো সুমনা। রাস্তায় অনেক মানুষজন। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। কেউ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে, কেউ দোকানদারি করছে, কেউ হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে। সুমনা বুঝতে পারলো তার হৃদয়ের সুপ্ত একস্থানে আ ঘা ত লাগছে। সে তো মইনুলকে প্রত্যাখানই করেছিলো। মইনুল তো নিজের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জানান দিয়েছিলো। সে বুঝিয়েছিলো সুমনাকে চায়। সুমনা সায় দিলে হয়তো সেও তাকে কাছে টেনে নিতো। সুমনা নিজেই সুযোগ দেয়নি। তার অনেক খুঁত। কি করে একজন অবিবাহিত, ভালো চাকরি করে এমন ছেলেকে ঠকাবে সে। ভালোই হয়েছে মইনুল নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছেন। একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর কথাগুলো ভাবছে সুমনা। আকাশে আজ তেমন আলো নেই। গতকালের জ্যোৎস্না আজ মিলিয়ে গিয়েছে। দু একটা তারার অবশ্য দেখা মিলছে। হঠাৎ সুমনা অনুভব করে এত বড় জগতে সে আকাশের ঐ তারাগুলোর মতোই একলা।
মানব মন বড়ই বিচিত্র। কষ্টের মাঝে থাকলে কেউ যদি খানিক সমবেদনা, সহানুভূতি দেখায় তাকেই আপন ভেবে বসে থাকে। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে যখন পাহাড়সম আ ঘ ত পায় সুমনা তখন সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো মইনুল।
আ ত্ম হ ত্যার হাত থেকে রক্ষা করেছিলো তাকে। হয়তো সুমনা হাত আঁকড়ে ধরলে তা ভালোবাসায় পরিণত হতো। তাহলে আর প্রীতম আর তার মাঝে কোনো পার্থক্যই থাকতো না। সেখানে কোনো আত্মসম্মানও থাকতো না। একসময় হয়তো মইনুলও তাকে খোঁটা দিতো। কিছুক্ষণ ভাবার পর সুমনার মনে হলো সে এখন যেমন আছে অনেক ভালো আছে। বেঁচে থাকার মতো বেঁচে আছে। কষ্ট হয়, বিরক্ত লাগে। তারপরও দিনশেষে সে ভালো আছে।
প্রতিদিন এই সময়টায় নাদিয়াকে পড়াতে আসে শাহবাজ। আরো তিনটি টিউশনি পেয়েছে। একটা সকালে করায়। বাকি দুটো কলেজ শেষ করে। নাদিয়াকে তাই মাগরিবের পর পড়ায়। সে যেহেতু বাড়িতেই থাকে তাই এই সময়টা বেছে নেওয়া। নাদিয়া আজকাল বেশ জ্বা লা চ্ছে শাহবাজকে। শাহবাজের রাগ হলো সুপ্ত রাগ। সহজে উঠেনা। কিন্তু একবার যদি রাগ উঠে তাহলে নিজেকে কোনোভাবেই সে ক্ষান্ত করতে পারেনা। পর্যাবৃত্ত গতি পড়াচ্ছে শাহবাজ। আজকাল তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। প্রিয়াঞ্জনার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়! টাকা দেওয়ার তারিখও আসছে। কি যে করবে শাহবাজ। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও চলতে হয়। ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে হয় জীবন নামক চক্রে। সরল দোলক এর সম্পূর্ণ বিষয়টা নাদিয়াকে বুঝালো শাহবাজ। সে চাইলেও টিউশনিটা ছাড়তে পারছেনা। বদরুজ্জামান সাহেব তাকে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন। তাছাড়া টাকাও তো দিচ্ছেন। নাদিয়াকে পড়ানোর বদৌলতে সে ভালো অংকের টাকাই পায়। এত জটিল পরিস্থিতি! চাইলেও সব সম্ভব হয় না। বুঝানো শেষে জিজ্ঞেস করলো,
“বুঝেছো?”
নাদিয়া কোন ধ্যানে ছিলো সেই জানে। ঠোঁট প্রশস্ত করে বললো,
“জ্বি, স্যার”
‘স্যার’ বললো টেনে টেনে। বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না শাহবাজ। গণিত করতে দিলো। একটা গণিতও করতে পারলো না নাদিয়া। শাহবাজ ধৈর্য্য সহকারে আবার বুঝালো। নাদিয়া তারপরও পারলোনা। আস্তে আস্তে রাগ প্রশস্ত হচ্ছিল শাহবাজের। হঠাৎ নাদিয়া এমন একটি অভাবনীয় কাজ করে বসলো! পা দিয়ে শাহবাজের পায়ে স্পর্শ করলো। এবারে রাগের মাত্রা হুট করেই বেড়ে গেলো শাহবাজের। ধমকে উঠে বলে,
“নাদিয়া, এনাফ।”
শান্ত মানুষটার এমন ধমকে চমকে যায় নাদিয়া।
“তোমার কার্যকলাপ খুবই জঘন্য,নাদিয়া। তুমি জানো আমি বিবাহিত। তারপরও এসব কেন কর? জীবনটাকে কি তোমার মুভি মনে হয়? নাকি আমাকে দুশ্চরিত্র মনে হয়? আমার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা নিজ চোখেই তো দেখেছো। তারপরও এসব কেন? সুযোগ নিচ্ছো? আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছো? জবাব দাও?”
মাথা নিচু করে রেখেছে নাদিয়া। চোখে তার ঘোর বরষা।
“আমি তোমাকে আর পড়াবো না। ফাইজলামির একটা সীমা আছে। তুমি সেসব সীমা বহু আগেই অতিক্রম করেছো। আমি কি দুশ্চরিত্র, খারাপ চরিত্রের? আমাকে কি তোমার মেয়েবাজ, ল ম্পট মনে হয়?”
এবার কেঁদেই দিলো নাদিয়া।
“একদম কাঁদবেনা। আনসার মি। আজকে আমার জবাব চাই।”
নাদিয়া কেঁদেই চলেছে। উপরে চলে আসে শাহবাজ। মেয়েটাকে অনেক বুঝিয়েছে সে। তারপরও এসব করছিলো। তাই আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। কথাটি একদম সত্য,
“Life is Not a Bed of Roses, but rather a Bed of Thorns”
(চলবে)….