#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-৩৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
প্রীতির বিয়ে হয়ে গিয়েছে মাস তিনেক আগে। প্রীতি বিয়ে নিয়ে খুবই ভয় এবং শঙ্কায় ছিলো। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে এসে আবিষ্কার করলো মানুষগুলো ভিষণ অমায়িক। তার স্বামী কখনো তাকে কোনো কিছুতে জোর করেনা। সত্যি বলতে বড়আপার প্রতি শাহবাজ ভাইয়ার ভালোবাসা দেখে তারও ইচ্ছে জাগতো এমন কেউ আসুক তার জীবনে। আল্লাহ তা পূরণ করেছেন। তবুও মায়ের প্রতি একটা সুপ্ত অভিমান তার আছে।
প্রাপ্তির পেটে বেড়ে উঠছে অনাগত সন্তান। ফাহিম বলে দিয়েছে এই সন্তান তার নয়। এই সন্তানের কোনো দায়ভারও সে নিতে পারবেনা। মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছিলো প্রাপ্তি। মা তাকেই দোষ দিচ্ছেন। কেন এসব সে আগে জানায়নি! বাইরে জানাজানি হলে তারা মুখ দেখাতে পারবেন না। ফাহিমের সাথে কথা বলেছেন তিনি। ফাহিম তাকে জানিয়েছে বহু আগে থেকেই প্রাপ্তি অন্য সম্পর্কে ছিলো। বিয়ের পরও ফাহিম এবং তার মা বাসায় না থাকলে প্রেমিক বাসায় আনতো প্রাপ্তি। এসব শুনে প্রাপ্তি স্তব্ধ, বাক শূন্য। ফাহিমকে জোহরা এসব জিজ্ঞেস করায় সে মনোকষ্ট পেয়েছে। এই উছিলায় প্রীতমকে জানিয়েছে সে তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবেনা। প্রীতম যখনই সুযোগ পাচ্ছে যা নয় তাই বলে প্রাপ্তিকে অপমান করছে। জোহরা বেগমও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রবীর এসব কিছুই জানেন না। তাকে এসব জানাতে নিষেধ করেছেন জোহরা। তিনি চাচ্ছিলেন বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে। তা সম্ভব হয়নি। তিনি যতদিনে জেনেছেন প্রাপ্তির পেটে বাচ্চা বড় হচ্ছে ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। বাসায় এসব কথা জানানোতে ক্ষুব্ধ হয়ে যায় ফাহিম। ভিডিওটি ছড়িয়ে দেয় ইন্টারনেটে। দ্রুত গতিতে তা ছড়িয়ে পড়ে। প্রবীর সাহেবকে মানুষজন সরাসরি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন। ছিঃ, ছিঃ হচ্ছে চারপাশে। জোহরা প্রাপ্তির ঘরে ঢুকেই তার গালে
চ ড় বসিয়েছেন। প্রীতমও তার গায়ে হাত তুলেছে। ইচ্ছে মতো কথা শুনিয়েছে প্রাপ্তিকে। রাগে, ক্ষোভে ছাদে চলে আসে প্রাপ্তি। খা খা রোদ উঠেছে আজ। জোহরের আজান দিচ্ছে। আকাশ পানে তাকিয়ে প্রাপ্তি শুধায়,
“আমার দোষটা কোথায়, আল্লাহ? আমার জীবন কেন এত অভিশপ্ত!”
কান্নায় ভেঙে পড়ে রেলিং ঘেঁষে বসে পড়ে। পেটে বাড়ন্ত বাচ্চার প্রতি অনেক মায়া হয় তার। আজ একটা জীবন কেড়ে নিবে সে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পৃথিবী ছাড়তে হবে তাকে। পেটে হাত রেখে ক্রন্দন সুরে বলে,
“আমাকে ক্ষমা দিও ময়না। আমার আর কোনো উপায় ছিলোনা।”
ঠিক যেখানে সুমনা দাঁড়িয়েছিলো কাকতালীয় ভাবে সেখানে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস নেয়। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। মায়ের প্রতি, ভাইয়ের প্রতি, বাবার প্রতি খুব অভিমান হয় তার। ফাহিমের প্রতি হয় রাগ। তবে একটা জিনিস সে উপলব্ধি করেছে, বড় আপা যা করেছে ঠিকই করেছে। ভালোবাসার জন্য করেছে। বড়আপার প্রতি আজ তার কোনো রাগ, ক্ষোভ নেই। কিছু কাক তীক্ষ্ণ শব্দে কা কা করছে চারপাশে। না, আজ কোনো মইনুল আসেন নি। তীব্র এক শব্দে কেঁপে উঠে চারপাশ। কাকের দল গলা ছেড়ে কা কা করছে এবার। একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে প্রাপ্তির। জাগতিক সব মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমায় সে।
বেশ কিছুক্ষণ পর এক ভাড়াটিয়া বাড়ির পিছনে
মৃ তদেহ আবিষ্কার করলেন। থেঁতলে গেছে মা থা। র’ক্তে ভরে গিয়েছে মেঝে। দ্রুত উপরে গিয়ে স্বর্ণাকে এই খবর জানান তিনি। স্বর্ণা, প্রীতম, প্রবীর, জোহরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন নিচে। জোহরা গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলেন। পুলিশ এলো। লা শ নিয়ে গেলো। বাড়িতে আহাজারি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রীতিও স্বামী সমেত ছুটে আসে। শাহবাজকে ফোন দেয় বারবার। তবে নাম্বার বন্ধ পায়। কারণ এই নাম্বার অনেক আগেই ব্যবহার করা বন্ধ করেছে শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনারও নাম্বার বন্ধ। প্রবীর সহ্য করতে পারলেন না এইসব। বারবার চোখের সামনে প্রাপ্তির মুখ ভেসে উঠছে। বাবা বলে ডাকছে তাকে। ব্রেইন স্ট্রোক করলেন তিনি। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। আফসোস বাঁচানো যায়নি। জোহরা জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলেন। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আজ তার কারণেই সাজানো-গোছানো সংসারটা শেষ হয়ে গেলো। চোখের সামনে নিজ হাতে সবকিছু শেষ করেছেন তিনি। অপরাধবোধে রাতের ঘুম হয়না তার। এদিকে শুনেছেন জায়গা জমি বিক্রি করে সব টাকা জু য়া খেলায় লাগিয়ে দিচ্ছে প্রীতম। জমিজমার কাগজ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখলেন সকল সম্পত্তি প্রীতমের নামে। প্রীতমের সাথে তার ঝগড়া, ঝামেলা চলছে। বিভিন্ন সময় তার এবং প্রবীর সাহেবের সিগনেচার নিয়ে সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে প্রীতম। ঘরের সব কাজ এখন তাকে করতে হয়। একসময় সুমনাকে তিনি কত কষ্ট দিয়েছেন। কাপড় ধোয়া মনমতো না হলে বারবার ধোয়াতেন। যাবতীয় রান্না-বান্না, ঘর পরিষ্কার সব করাতেন। সময় পাল্টেছে। স্বর্ণা কোনো কাজই করেনা। সারাদিন নিজের মতো থাকে মেয়েকে নিয়ে। ছেলেটা সব সম্পত্তি শেষ করে দিচ্ছে। নিজে খাটছেন কলুর বলদের মতো। এই হয়তো তার প্রাপ্য শা স্তি। কিছুদিন পর থাকার ছাদটাও মাথার উপর থাকবে কিনা সন্দেহ।
প্রিয়াঞ্জনা এবং শাহবাজের ঘর আলো করে মেয়ে সন্তান এসেছে। শাহবাজ নাম রেখেছে আলো। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে সবকিছুতেই দ্বিগুণ বরকত হচ্ছে। হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি এই নিয়েই সময় কাটছিলো তাদের। বাড়ির ফেরার পর এক পরিচিত ভাইয়ের মাধ্যমে প্রাপ্তি এবং বাবার খবর পেলো তারা। মন মানেনি প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ, আলোকে নিয়ে নিজ গাড়িতে চড়ে ছুটে এলো নরসিংদী। প্রিয়াঞ্জনাকে দেখামাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠলেন জোহরা। ক্ষমা চাইলেন বারবার। শাহবাজের কাছেও ক্ষমা চাইলেন। প্রীতম কোনো কথা বলেনি। স্বর্ণাও না। প্রীতির সাথেও দেখা হয় প্রিয়াঞ্জনার। বোনকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে প্রীতি। দুবোন মিলে বাবা-বোনের কবর জিয়ারত করে। মায়ের প্রতি যা অভিমান ছিলো তা শেষ হয়ে যায় প্রিয়াঞ্জনার। মায়ের ক্রন্দনরত মুখটা দেখার পরপরই মাকে ক্ষমা করে দেয় সে। শত হোক মা তো। তিনি যে অনেক কষ্টে দিনযাপন করছেন তা তার চেহারায় স্পষ্ট। প্রিয়াঞ্জনা চেয়েছিলো নিজের সাথে গাজীপুর নিয়ে যাবে। তবে জোহরা এত বছরের সংসার ছেড়ে যেতে চাননি। শুকিয়ে চিকন হয়ে গেছেন, চোখের নিচে কালো দাগ। আজও প্রাপ্তিকে দেখতে পান তিনি। অভিযোগ শুনতে পান। অনুতপ্ত হোন। তার অন্তরে ব্যথা হয়। অসহনীয় ব্যথা।
রিমনকে গাজীপুরে নিজের অফিসে ভালো পজিশনে বসিয়েছে শাহবাজ। রিমন, সুফিয়া এবং রাতুল তাদের সাথেই থাকে এখন।
(চলবে)….
#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-৩৪
“আপনি এভাবে আমার পিছনে পড়ে আছেন কেন বলুন তো?”
সুমনা ভিষণ রাগ নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ক্যামেরা হাতে আগন্তুক কে। সোহরাব হোসেন। বর্তমানে নামকরা একজন ফটোগ্রাফার। বিভিন্ন মডেলদের ছবি তুলেন তিনি। তাছাড়া প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসেন। ঘুরে-বেড়ান বিভিন্ন স্থানে। ক্যামেরায় বন্দী করে নেন প্রকৃতির নৈসর্গিক রূপ। একদিন দীর্ঘ যানজটে গাড়ি আটকে অতিষ্ঠ হয়ে বসেছিলেন। তখনই দেখলেন সবজি বিক্রেতার সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছে এক শ্যামবর্ণের তরুণী। কি মায়া তার মুখে! ড্রাইভারকে বলে তিনি নেমে পিছু নিলেন তরুণীর। আজিমপুর ব স্তিতে মেয়েটির বাসা খুঁজে পেলেন। সেই থেকে সুমনাকে তিনি বারবার বুঝিয়ে যাচ্ছেন মডেলিং এ অংশ নিতে। পোর্টফলিও তৈরি করতে। ‘কৃষ্ণকলী’ শিরোনামে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘স্মার্ট লেডি’ তে কভার পেজের জন্য নতুন মুখ দরকার। সুমনা এরজন্য একদম মানানসই। সুমনার এসবে কোনোকালেই আগ্রহ ছিলোনা। এখন হুট করে এমন প্রস্তাব পেয়েও তার মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না। সে তার জীবনে বেশ সুখেই আছে। প্রীতমের সাথে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে তার। টিউশনি করাচ্ছে, দোকানে চাকরি করছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝুম বৃষ্টিতে ব স্তির বাচ্চাদের সাথে ভিজছে। সেই ভিজা শরীরে আবার বারান্দায় বসে চা পান করছে। এতটা আনন্দ! এতটা স্বাধীনতা কখনোই আগে পায়নি সে। একসময় বাঁচতে ইচ্ছে করতো না। আজকাল বাঁচতে ইচ্ছে করে। নিজেকে ভালোবাসতে শিখে গেছে সুমনা। এখন সে নিজের মতন বাঁচে। কাচুমাচু মুখ করে সোহরাব বললেন,
“একবার একটা ফটোশুট করে দেখুন। আপনারও ভালোলাগবে।”
সুমনার বেশ হাসি পাচ্ছে এবার। মানুষটা অনেকদিন যাবতই ঘুরছে তার পিছনে। মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই সুমনা বলে,
“ঠিক আছে। কবে কোথায় যেতে হবে?”
সোহরাব খুবই সুন্দর একটি হাসি দেয়। তারপর ঠিকানা বলে। আগামীকালই যেতে হবে। গাড়ি আসবে সুমনাকে নিতে।
পরদিন বিকেলে গাড়ি সমেত সোহরাবও আসে। সুমনা অবশ্য একা যায়নি সাথে নিয়ে নিয়েছে জাবেদাকে। গুলশানে সোহরাবের স্টুডিও। প্রথমে লাল পেড়ে সাদা জামদানি শাড়িতে কিছু ছবি তোলা হয়। শ্যামবর্ণ সুমনাকে লাল, সাদা শাড়িতে চোখ ধাঁধানো লাগছিলো। ছবি তোলার সময়ই চোখ ফিরাতে ভুলে যায় সোহরাব। বিরবির করে,
“কি আশ্চর্য তার রূপ! আমি কি তবে প্রেমে পড়লাম! অদ্ভুত!”
স্মার্ট লেডি ম্যাগাজিনে ‘কৃষ্ণকলি’ হিসেবে ছবি তুলে সুমনা এক প্রকার ভাইরালই হয়ে যায় বলা চলে। সকলেই তার প্রশংসা করছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মডেলিং, বিজ্ঞাপনের ডাক আসছে। আশ্চর্য না? কোথ থেকে জীবন সুমনাকে কোথায় নিয়ে আসলো!
আস্তে আস্তে সোহরাবের সাথেও ভালো একটা সম্পর্কে জড়াচ্ছে সুমনা। ভালোবাসার মতন সাহস হয়তো দ্বিতীয়বার তার নেই। তাদের সম্পর্কটা হলো বন্ধুত্বের। সুমনা তাই মনে করে।
আলোকে কোলে নিয়ে বারান্দায় হাঁটছে শাহবাজ। মেয়েটা তার কলিজার টুকরো। পুরোই তার মতো দেখতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য প্রিয়াঞ্জনার কিছুই আলো পায়নি। এ নিয়ে প্রিয়াঞ্জনার আক্ষেপের শেষ নেই। আজ চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণিমার রাত। চাঁদের পানে তাকিয়ে অন্তর হু হু করে উঠে শাহবাজের। সেই ভ য়ং কর রাতের কথা মনে পড়ে। এই তো কিছু মাস আগে,
আগামীকাল শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা হাসপাতালে চলে যাবে। ডেলিভারি ডেট এর পরদিন। হাত,পায়ে পানি নামার দরুন ঠিক মতো চলাচল করতে পারেনা প্রিয়াঞ্জনা। আকাশে বিশাল চাঁদ উঠেছে। ঝকঝকে আলো বাইরে। জ্যোৎস্নার আলো। প্রিয়াঞ্জনা বায়না করে বলে,
“আমাকে বারান্দায় নিয়ে চলুন না,শাহ্। চা খাবো দুজনে। তারপর আপনি আমাকে গান শোনাবেন।”
অসহায় চোখে তার পানে চায় শাহবাজ। অতঃপর বলে,
“আমাকে এখনই একটা জরুরী মিটিং এ যেতে হবে। ওয়াদা করছি জলদি ফিরবো। তারপর সারারাত দুজনে বারান্দায় বসে থাকবো।”
মুখ ফুলায় প্রিয়াঞ্জনা।
“আপনি আমাকে সময় দেন না। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।”
প্রিয়াঞ্জনাকে বুকে জড়িয়ে শাহবাজ শুধায়,
“কার জন্য এত কষ্ট করি?”
“জানিনা”
অভিমান হয় প্রিয়াঞ্জনার।
“তাহলে যাবো না। চলো বারান্দায়।”
“হয়েছে। ঢং করতে হবেনা। যান। আমরা অপেক্ষা করবো।”
মুচকি হেসে প্রিয়াঞ্জনার পেটে চুমু খায় শাহবাজ। তারপর বেরিয়ে পড়ে। মিটিংটা সত্যিই অনেক জরুরী। ওদের ঘরটা হলো দুতালার পূর্ব দিকে। ঘরের সাথে বিশাল বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়ালে দূরে কৃষ্ণচূড়ার গাছের সারি দেখা যায়। পাশে বিরাট এক পুকুর। উপরতলায় আর কেউ থাকেনা। নিচতালায় জামান সাহেব এবং রিমন, সুফিয়ারা থাকেন একপাশে। অপর পাশে গৃহকর্মীগণ।
প্রিয়াঞ্জনা ঘুমিয়েই গিয়েছিলো। হঠাৎ করেই প্রস্রাবের বেগ আসায় বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে যায় সে। কিন্তু বের হওয়ার কালে বিপত্তি বাঁধে। প্রিয়াঞ্জনা অনুভব করে তার পানি ভাঙছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে প্রিয়াঞ্জনা। বসে পড়ে ফ্লোরে। শরীর অবশ হয়ে আসছে। কোনো শক্তি সে পাচ্ছে না। জামান সাহেব উপরে এসেছিলেন প্রিয়াঞ্জনার খোঁজ নিতে। হঠাৎ করে এমন চিৎকারে দরজার কাছে ছুটে যান তিনি। বেডরুমের দরজা লক হয়ে গিয়েছে। খোলা যাচ্ছেনা। তিনি উচ্চ গলায় ডেকে উঠলেন,
“প্রিয়াঞ্জনা, মা। কি হয়েছে তোমার?”
সে সাথে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। ভিতর থেকে কেবল প্রিয়াঞ্জনার চিৎকার ভেসে আসছে। রিমন, সুফিয়াসহ অন্যান্য গৃহকর্মীরাও উপরে ছুটে এলো। সুফিয়া ফোন করে সব জানালো শাহবাজকে। রিমন, জামান সাহেব দরজা ভেঙে ফেললেন। প্রিয়াঞ্জনা জ্ঞান হারায়নি। তবে অচেতনের মতো পড়ে আছে। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। শাহবাজ পৌঁছায় হাসপাতালে। তারপরের কতক্ষণ ভয়ং কর
কাটে শাহবাজসহ সবার। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে দুনিয়ায় আসে শাহবাজ আর প্রিয়াঞ্জনার ‘আলো’। সেই রাতের কথা কখনোই ভুলতে পারবেনা শাহবাজ।
“শাহ্!”
প্রিয়াঞ্জনার ডাকে বাস্তবে ফিরে শাহবাজ। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কোলে। বারান্দায় বেতের চেয়ার টেবিল পেতে রাখা পাশাপাশি। প্রিয়াঞ্জনা চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে বসে চেয়ারে। গলার আওয়াজ কমিয়ে শুধায়,
“কি ভাবছেন?”
“নাহ্। তেমন কিছু না।”
“আলোকে ঘরে দোলনায় রেখে আসেন। ঘুমিয়ে পড়েছে।”
ঘরে আলোকে রেখে এসে প্রিয়াঞ্জনার পাশে বসে শাহবাজ। নিশুতি রাত। মৃদু ছন্দে বাতাস বইছে। সর্বত্র জ্যোৎস্নার আলো। শাহবাজের কাঁধে মাথা রাখে প্রিয়াঞ্জনা। এককাপ চায়ে বিনিময় হয় ভালোবাসার মহাকাব্য। প্রিয়াঞ্জনার ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁয়ায় শাহবাজ। তীব্র আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ পরম আবেশে স্পর্শ করে প্রিয়াঞ্জনার অধরে। চোখ বুজে সে ভালোবাসা গ্রহণ করে প্রিয়াঞ্জনা। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার। মানুষটাকে সে ভালোবাসে। অনেক বেশি ভালোবাসে। প্রেম বিনিময়ের কিছুক্ষণ পর প্রিয়াঞ্জনা নরম কন্ঠে বলে উঠে,
“আপনি আমার অনেক সাধনার শাহ্।”
“তুমি আমার সব প্রিয়াঞ্জনা। আমাকে পরিপূর্ণ করার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
শাহবাজ আবারো জড়িয়ে ধরে তাকে। তাদের উন্মুক্ত গভীর ভালোবাসা দেখে পূর্ণিমার চাঁদ লজ্জায় মুখ ঢাকে।
পরপর তিনটি খবর চোখের সামনে পড়েছে আজ। দুটো খবর নিউজে দেখেছে। আর বাকি একটা ফেসবুকে। প্রিয়াঞ্জনা তড়িঘড়ি করে শাহবাজকে ফোন করে। শাহবাজ কাপড়ের আড়তে ছিল। ইদের সময় আসছে। প্রচন্ড চাপ এখন।
“শাহ্, নিউজ দেখেছেন?”
“না, আমি আড়তে আছি।”
“শিবপুরে নাদিয়া নামের এক মেয়েকে কে বা কারা যেন রে প করে চিনিশপুর ফেলে গিয়েছিলো।”
“বদরুজ্জামান চাচার মেয়ে নাদিয়া?”
“হ্যাঁ।”
বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস আসে শাহবাজের। মেয়েটার প্রতি তার রাগ ছিলো এটা সত্য। তবে কিছুদিন পরই তাকে ক্ষমা করে দেয় শাহবাজ। বয়সের ভুলে করে ফেলেছে। প্রিয়াঞ্জনাকেও বোঝায় সে যেন ক্ষমা করে দেয়। নিজের শাহ্ এর কথায় কখনো না বলেনা সে। ক্ষমা করে দিয়েছে। সত্যি বলতে প্রিয়াঞ্জনা অনেক নরম মনের। নয়তো জোহরা যে সকল কাজকর্ম করেছেন অন্য কেউ হলে তাকে ক্ষমা করতো না। শাহবাজ এখনও তাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারেনি। প্রাপ্তির কথা মনে পড়লে তার খারাপ লাগে। নিজের বোনের মতোই দেখতো তাকে। আজ একটা মানুষের ভুল সিদ্ধান্তে পুরো সংসারটাই শেষ হয়ে গেলো।
“শাহ্, শুনছেন?”
“বলো”
“ফাহিম ভাইকে আমেরিকায় দুর্বৃত্তকারীরা হ ত্যা করেছে।”
“প্রাপ্তির হাসবেন্ড না?”
“হুম।”
উচিত বিচার হয়েছে। শাহবাজ পুলিশের সাথে কথা বলে জেনেছিলো একটা ডায়েরিতে প্রাপ্তি তার সাথে হওয়া সব অন্যায় নোট করে রেখে গিয়েছে। যেখানে স্পষ্ট ফাহিম তার সাথে অন্যায় করেছে তা উল্লেখ্য করা আছে। ফাহিমের দুই বন্ধু পলাতক। তাদের ধরতে পারেনি পুলিশ। আল্লাহর বিচার বড় কঠিন বিচার।
“শরীর থেকে মা থা নাকি আলাদা করে ফেলেছে শাহ্।”
“আল্লাহর বিচার অনেক কঠিন প্রিয়াঞ্জনা। কেউ কাউকে অশান্তিতে রেখে নিজে শান্তিতে থাকতে পারেনি। অন্যায় করে কেউ যতই উপরে উঠুক না কেন তাকে নিচে পড়তে হবে। আর একবার যদি নিচে পড়ে তাহলে আর থেঁতলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
“ঠিক বলেছেন শাহ্।”
“এসব বাদ দাও। আলো কি করে?”
“আপনার গুণধর মেয়ে খাওয়া নিয়ে আজ খুবই জ্বালিয়েছে শাহ্। এখন ঘুমাচ্ছে।”
“আর কিছু বলবে? এখন রাখি জান?”
“আচ্ছা, জলদি আসবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
আরেকটা কথা শাহ্কে বলতে গিয়েও বলেনি প্রিয়াঞ্জনা। আজ অনেকদিন পর আবার ফেসবুকে লগইন করেছিলো প্রিয়াঞ্জনা। ‘স্মার্ট লেডি’ ম্যাগাজিনের কভার পেজ স্ক্রোল করার সময় চোখে পড়ে তার। সেখানে সুমনাকে দেখে অবাক হয়ে যায় প্রিয়াঞ্জনা। সুমনা ভাবীকে সে অনেক ভালোবাসে। ভাবী বাড়ি ছেড়েছে কথাটা প্রীতির মুখে শুনে কি যে খারাপ লাগছিলো প্রিয়াঞ্জনার! সুমনার পুরানো আইডিতে এড ছিলো সে। এতদিন ডিয়েক্টিভ ছিলো সুমনার একাউন্ট। এখন এক্টিভ করেছে। আজ ইনবক্সে কথা হলো। প্রিয়াঞ্জনা বলেছে একদিন যেন সময় করে তাদের বাসায় আসে সুমনা। সুমনা বলেছে আসবে। মনটা হালকা হালকা লাগছে প্রিয়াঞ্জনার।
(চলবে)….