প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-০২

0
238

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২

অরিন কোচিং সেন্টারে এসে অফিস-রুমে ঢুকলো। সেখানে রুটিন দেখে জেনে নিলো এখন তার কাদের ক্লাস নিতে হবে। নবম শ্রেনীর ক্লাস নিতে হবে এখন তার। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ক্লাস রুমে প্রবেশ করলো। সবাই তাকে দেখে সালাম দিলো। সে ক্লাস নিয়ে বাইরে বের হলো। বাইরে বের হতেই জাহিন নামক পুরুষটির সাথে দেখা হলো তার। সে মাথা নিচু করে চলে যেতেই চাইছিলো তবে জাহিন পেছন থেকে ডেকে বসলো। ভদ্রতার খাতিরে পিছু ফিরে চাইলো সে।

“এড়িয়ে যেতে চাইছিলে অরিন?”

অরিন জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“না না ভাইয়া তেমন কিছু না। আমার আরেকটা ক্লাস আছে। সেটা নিয়েই বাড়িতে ফিরবো দ্রুত তাই।”

“আচ্ছা ঠিক আছে যাও”

অরিন দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো। জাহিন নামক ছেলেটি অরিনের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে সে পছন্দ করে। তবে বলে উঠতে পারেনি। বলেও লাভ কি সে কি চাকরি করে যে মেয়েটাকে বিয়ে করতে পারবে। তাই গোপনই থাকুক তার অনুভূতিগুলো। ভালোবাসলে যে পেতেই হবে তার কোনো মানে নেই। অরিন ক্লাস নিয়ে কোচিং সেন্টার থেকে বের হলো। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। মাথায় দেওয়া ওড়নাটা আরো ভালো করে টেনে দাঁড়িয়ে রইলো রিকশার অপেক্ষায়। আশেপাশে নিচু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে রইলো বখাটেগুলো আছে কি না।

তবে দেখতে পেলো না অরিন। এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। বড্ড জ্বালাচ্ছিলো তাকে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিছু কথা ভেবে।পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় এনে দাঁড় করায়। মাথার উপর বাবা নামক বটগাছ না থাকলে কত কিছু সহ্য করা লাগে তা যাদের জীবনে ঘটেছে একমাত্র তারায় জানে। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই রিকশা পেয়ে গেলো অরিন। রিকশায় চড়ে বাড়িতে চলে আসলো। বাড়ি আসতে আসতে তার সাতটা বেজে গিয়েছে। কলিংবেল বাজাতেই তার ছোট বোন হায়াত এসে দরজা খুলে দেয়।

“কি রে আপু তোর দেরি কেনো হলো আজ? দে ব্যাগটা আমার হাতে দে। তুই বস আমি পানি দিচ্ছি”

অরিন ওড়না দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে সোফায় এসে বসলো। হায়াত পানি এনে বোনকে দিলো। অরিন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলে পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অরিন নিজের প্রিয় বান্ধবীদের বাড়ির সামনে এসে থামলো। কলিংবেল বাজিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। কিছুক্ষণ বাদে অরিনের প্রিয় বান্ধবী তাইবা এসে দরজা খুললো।তাইবা অরিনকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটার এতো কষ্ট তার সহ্য হয় না।

“আরেকটু পর আসতি। কোচিং থেকে তো মনে হয় আধা ঘন্টাও হয়নি ফিরেছিস এখন আবার চলে আসলি পড়াতে। কষ্ট হয় না?”

অরিন হাসলো। তাইবা লক্ষ্য করলো এই হাসিতে জড়িয়ে আছে কিছু বিষাদ। তাইবার দুঃখ হয় মেয়েটাকে এই অবস্থায় দেখে। যদিও তার করার কিছু নেই। প্রিয় বান্ধবীকে এতো কষ্ট করতে দেখতে কারই বা ভালো লাগে। অরিন ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল,,,

“সমস্যা নেই বাড়িতে তো আম্মা আর হায়াত একা থাকে তাই বেশি রাত করতে চাই না। দ্রুত পড়িয়ে বাড়ি ফিরবো বুঝেছিস। তোহা কোথায়?”

তাইবা ইশারায় বুঝালো রুমে। অরিন সেদিকে পা বাড়ায়। তাইবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে আসে। নুডলস রান্না করার জন্য জোগাড় করতে থাকে সব। অরিন তোহার রুমে প্রবেশ করে দেখে তোহা আগে থেকেই টেবিলে বসে আছে। অরিন তোহার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। দশম শ্রেনীর ছাত্রী তোহা। হায়াতের সাথে একই ক্লাসে পড়ছে। গনিত বইটা বার করতে বলে অরিন বিজ্ঞান বইরের কিছু অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দাগাতে লাগলো। তোহাকে পড়ানোর শেষের পথে তাইবা রুমে প্রবেশ করলো।

বিছানার উপর চার বাটি নুডলস রেখে জানালা দিয়ে হায়াতকে ডাকলো। অরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়ের কান্ড। প্রায়শই এমন পাগলামি করে তাইবা। অরিন তোহাকে পড়ানো শেষ করে বলে,,

“তোর এই পাগলামি কবে যাবে?”

“পাগলামি! পাগলামি কোথায় করলাম আমি বলতো।”

“তুই বুঝেও না বোঝার ভান কেনো করছিস তাইবা। তোকে হাজার বুঝিয়ে বলার পরও কেনো করিস? তুই তো জানিস সব”

“অরিন তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড। বন্ধুত্বের মানেটা আমার কাছে অনেক বেশি। তুই আমার সেই বান্ধবী যাকে ছাড়া আমি এক মুহুর্তও চলতে পারি না।তোর সুখে যেমন আমার সুখ, তোর কষ্টে ও তেমনি আমারও কষ্ট”

হায়াত রুমে প্রবেশ করে বলল,,
“তাইবা আপু ডাকছিলে?”

তাইবা বা অরিন কেউই কথা বাড়ালো না। সবাই বিছানার উপর গোল হয়ে বসে পড়লো। চারজন কিছুক্ষণ বসে আড্ডা দিলো। আজ তাইবার মা বাড়িতে নেই। তিনি গিয়েছেন নিজের বোনের বাড়িতে। যদিও তিনি অতন্ত্য ভালো মানুষ। তবুও অরিন বান্ধবীর বাড়ি হলেও একজন শিক্ষিকার মতো এসে,পড়িয়ে চলে যায়। তবে তাইবা মাঝে মাঝে পাগলামি করে বসে। এটা ওটা বানিয়ে খাওয়াবেই।

“আচ্ছা তাইবা এখন উঠি আমরা। আম্মা বাড়িতে একা রয়েছে। অনেক রাত হলো তো। আন্টি কখন আসবে?”

“আম্মু হয়তো এখনই চলে আসবে। আচ্ছা তাহলে তোরা যা এখন আন্টি অনেক সময় ধরে একা রয়েছে।”

অরিন ও হায়াত দু বোন বাড়িতে আসলো। ততক্ষণে অরুনি শেখ রাতের খাবার গুছিয়ে ফেলেছেন। মেয়েদের দেখতে পেয়ে বলে,,
“দ্রুত যা ফ্রেশ হয়ে আয়। অনেক রাত হলো। খেয়ে পড়তে বসবি দু’জনই”

দু’জন মাথা নাড়িয়ে নিজেদের রুমে চলে যায়। অরিনদের বাড়িটা একতলা বিশিষ্ট একটি দালান। বাড়িটাতে চারটা রুম রয়েছে আর একটা ড্রয়িংরুম। অরিনের আব্বু ইমরুল শিকদার বাড়িটা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মধ্যবিত্ত সুখী পরিবারটা ভালোই চলছিলো, তবে ৩ বছর আগেই তাদের সুখী পরিবারটা এক নিমেষে বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। চঞ্চল, প্রতিবাদী,ঝগরুটে তরুনীটি হঠাৎ কেমন ভদ্র,নম্র চুপচাপ হয়ে গেলো। বাবার ছায়া সরে গিয়েছে মাথার উপর থেকে তখন থেকেই অরিন পাল্টে গেলো। বাস্তবতা বুঝে নিলো।

“কত সময় ধরে ফোন করছি? ফোন কোথায় থাকে তোর? এরপর থেকে ফোন রিসিভ না করলে তোর ওই ফোনটাই কিন্তু থাকবে না”

ধূসরের শান্ত কন্ঠের হুমকি শুনে উমেদ দ্রুত উঠে বসলো। তন্দ্রা ততক্ষণে ছুটেছে তার। আজ ছেলেটা তাকে আস্ত রাখবে না মোটেও। সে ভয়ে ঢোক গিললো কয়েকবার। ধূসর আবারও শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,,,
“তুই কথা বলবি না কি আমি আসবো এখন উপরে?”

উমেদ লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বলল,,“দোস্ত ৫ মিনিট দে আমি আসছি। ঘুমিয়েছিলাম তো”

ধূসর কল কেটে পকেটে হাত গুজেঁ বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। নিবেদিতার কথা ভাবতে ভাবতে আনমনে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিলো। উমেদ দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে আসলো। ধূসরকে দেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো। ধূসর ভ্রু কুঁচকে দেখছে উমেদের কাজ। উমেদ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,,

“দোস্ত আর বলিস না! বাসায় এসে আম্মার বকা খেয়ে ঘুমায় পড়ছিলাম। এর জন্য ফোন ধরতে পারিনি।”

ধূসর বাইকে উঠতে উঠতে উমেদকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
“বাইক বের কর দ্রুত। দ্বিতীয় বার এই কাজ করবি তাহলে তোর ফোন আর থাকবে না”

উমেদ বাইক বের করে ধূসরের পাশে এনে দাঁড়ায়। ধূসরকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,“কোথায় যাবো এখন?”

“কথা কম বলে পিছু পিছু আয়”

ধূসর বাইক নিয়ে চলে গেলো। উমেদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে নিজেও ধূসরের পিছু নিলো। ধূসর সোজা চলে আসলো বখাটেগুলোর আড্ডা খানায়। ধূসরকে বাইকে থামাতে দেখে সবগুলো যুবক দাঁড়িয়ে পরলো। উমেদ বুঝে গেলো কোনো একটা ঘাপলা আছে। ছেলেগুলো কিছু তো একটা করেছে। ধূসর বাইক পাশে রেখে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠে,,

“ভাই আপনি এখানে? কোনো সমস্যা? সমস্যা হলে বলতেন আমরা চলে যেতাম”

ধূসর শান্ত গলায় বললো,,
“সমস্যা তো হয়নি। তবে তোরা সমস্যা তৈরি করছিস”

ছেলেটি ভয় পেলো। ধূসরের শান্ত কন্ঠে উচ্চারণ করা কথাগুলো শুনে সবাই ভীরু দৃষ্টিতে তাকালো ধূসরের দিকে। ছেলেটি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,,,
“ভাই আমরা কি সমস্যা করেছি যদি বলতেন?”

শান্ত ধূসর হঠাৎ ই অশান্ত হয়ে গেলো। ঝড়ের গতিতে ছেলেটির কাছে এসে কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। বাকি ছেলেগুলো ভয় তে পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। এমপির ছেলের সাথে কি পারা যায়। ধূসর ছেলেটিকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বলে,,,

“প্রথমত তোরা এলাকায় মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করছিস, দ্বিতীয়ত আমার প্রিয় নারীর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিস। কিভাবে ছাড়ি তোদের বল তো!”

উমেদ যা বোঝার বুঝে গেলো। সেও প্রচন্ড রেগে গেলো। মেয়েদের অসম্মান করা বিষয়টা তার খুব অপছন্দের। উমেদ ধূসরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ধূসর মৃদু চিৎকার করে বলল,,,
“তোদের বাড়িতে মা বোন নেই? ধর তোদের মা বোনের দিকে কেউ খারাপ নজরে তাকালো সহ্য করতে পারবি?”

সবাই মাথা নিচু করে নিলো। ধূসর সব ক’টার ব্যবস্থা করে উমেদকে নিয়ে নিজের প্রিয় একটা জায়গায় চলে আসলো।শান্ত হয়ে লেকের কিনারা ঘেঁষে বসে পরলো। রাত এগারোটা পেরিয়েছে আরো অনেকক্ষণ আগে। উমেদ ও এসে বসে পরলো ধূসরের পাশে। উমেদ হুট করে জিজ্ঞেস করলো,,,

“কি পেয়েছিস অরিনের মাঝে?”

ধূসর মৃদু হেসে শান্ত কন্ঠে শুধালো,,
❝সৃষ্টিকর্তা আমায় এক জোড়া চোখ দিয়েছিলেন ধরনীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে, তবে আমি তাহার অপূর্ব মুখখানা দেখার পর সে চোখে যে অন্য কিছু দেখিনি।❞

#চলবে~