প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-০৩

0
208

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩

রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। নির্জনতায় ঘেরা চারপাশ। শীতল হাওয়া বইছে। ধূসর আর উমেদ এখনো লেকের পাশটায় আছে। উমেদের ঘুম আসছে,অনেক বার বলা হয়ে গিয়েছে তার বাড়িতে ফেরার কথা। তবে ধূসর নির্বিকার। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে লেকের দিকে। উমেদ এবার বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধূসর তবুও তাকালো না উমেদের দিকে। উমেদ ধূসরকে টেনে তুলল।এরপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে শুধালো,,

“তুই কি বাড়ি যেতে চাচ্ছিস না? বারোটা বেজে গিয়েছে। আন্টি টেনশন করছে হয়তো। চল এখন বাড়িতে”

ধূসরও এবার আর নিষেধ করলো না। আজ সারাদিন বাড়িতে যায়নি সে। আর না মায়ের কল রিসিভ করেছে। নির্ঘাত তার মা এখনো ঘুমায়নি। তার অপেক্ষায় বসে আছে। ধূসর আর উমেদ বেরিয়ে পরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। উমেদ নিজের বাড়িতে চলে গেলো আর ধূসর তার। ধূসর বাড়ির সামনে আসতেই দারোয়ান তাকে দেখে গেট খুলে দিলো। ধূসর বাইক রেখে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই ধূসরের বাবা আসাদ আহসান মৃদুস্বরে শুধালেন,,

“দাঁড়াও ধূসর”

ধূসর দাঁড়িয়ে পরলো। অনামিকা ইসলাম ও ছুটে এলেন ছেলের কাছে। ছেলের কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনামিকা ইসলাম অস্থির হয়ে বললেন,,
“কোথায় ছিলিস তুই ধূসর? সারাটা দিন খবর নেই। বাড়িতে আসিসনি একবার ও। তুই কি শান্তিতে থাকতে দিবি না আমায়?”

ধূসর কিছু বলতে যাবে তার আগেই আসাদ আহসান বলে উঠেন,,“তুমি আজকে কেনো মেরেছো ছেলেগুলোকে?”

ধূসর নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,,
“মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করেছে! মেয়েদের উত্তপ্ত করে ওরা। যে পুরুষ নারীকে সম্মান করতে পারে না তাকে আমি পুরুষ বলেই গন্য করি না।”

“তুমি এমপির ছেলে ধূসর। এরকম ব্যবহার মানায় না তোমার”

ধূসর এবার মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলো,,“তাহলে কি চুপ করে থাকতাম। মেয়েগুলো যদি রাফা, রাহিয়ার হতো তুমি চুপ করে থাকতে উত্তর দেও?”

আসাদ আহসান কিছুক্ষণ নিরব থেকে উত্তর দিলেন,,“তুমি আমায় বলতে আমি ব্যবস্থা করতাম ওদের নিজে কেনো গিয়েছো?”

ধূসর উত্তর না দিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে আসে। অনামিকা ইসলাম ও ছেলের পিছু পিছু রুমে আসেন। ছেলের রাগ সম্পর্কে অবগত তিনি। ধূসর বিছানায় বসে আছে। অনামিকা ইসলাম এসে ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।ধূসর মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। সে তার জীবনে দু’টো নারীকে ভয়ংকর রকম ভালোবাসে। এক তার আম্মু আরেক তার নিবেদিতা। মায়ের পর অরিনই সেই নারীকে যাকে সে ভালোবেসেছে। ধূসর ভয়ংকর রকম ভালোবাসে তার নিবেদিতাকে। ধূসরের ভাবনার মাঝে অনামিকা ইসলাম বলে উঠেন,,

“আব্বু কেনো করিস এমন। আম্মুকে চিন্তায় রাখতে ভালো লাগে তোর? একটু সাবধানে কি থাকা যায় না?”

ধূসর ঘুম ঘুম কন্ঠে শুধালো,,
“আম্মু ওরা আমার প্রিয় নারীর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। আমি কিভাবে ওদের এমনি এমনি ছেড়ে দেই বলো। তার সম্মান রক্ষা করা যে আমার দায়িত্ব। ভালোবাসি যাকে তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব ও যে আমার”

অনামিকা ইসলাম হাসলেন। ছেলে যে একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসে সে সম্পর্কে সে অবগত। ধূসর অনেক আগেই তাকে সে কথা জানিয়েছে। যদিও সপ মেয়েটিকে দেখেনি। তবে তার ভরসা আছে ছেলের উপর। অনামিকা ইসলাম ধূসরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে কন্ঠে বললেন,,,“আমি বুঝেছি আব্বু। ভালোবাসার মানুষের অসম্মান যে সহ্য করা যায় না তা খুব ভালো করেই জানি আমি। তবে তোর এই রাগটা যে কমাতে হবে ধূসর।”

“আমি চেষ্টা করছি আম্মু। তবে হয় না তো। আর নিবেদিতার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেও আমার সহ্য হয় না সেইখানে ওই বখাটে ছেলেগুলো ওকে বাজে কথা বলেছে”

“আচ্ছা শান্ত হ তুই এখন আব্বু। খেয়েছিস রাতে?”

ধূসর মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে খায়নি। অনামিকা ইসলাম দ্রুত খাবার আনতে চলে গেলেন। ধূসর উঠে বসলো। মায়ের মতো হয়তো কেউ কখনো সন্তানকে ভালোবাসেন না। অনামিকা ইসলাম খাবার এনে নিজ হাতে নিজের একমাত্র পুত্রকে খাইয়ে দিলেন।

“আচ্ছা এখন ঘুমা তুই আব্বু। আমি যাচ্ছি তুই লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পর। অনেক রাত হয়েছে”

অনামিকা ইসলাম লাইট বন্ধ করে দরজা টেনে বের হয়ে গেলেন। ধূসর দরজা আটকে গিটার এনে বারান্দার এক কোনায় বসে পরলো। সে টুকটাক গান গেয়ে থাকে। রাতে ঘুম আসে না তার নিবেদিতার কথা মনে করে। প্রায়শই বারান্দায় বসে গিটারে সুর তোলার চেষ্টা করে। ধূসর আনমনে গেয়ে উঠে,,

“আমার বেঁচে থাকার প্রার্থনাতে,
বৃদ্ধ হতে চাই তোমার সাথে”

ধূসর হাসলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,,
“ভালোবাসি নিবেদিতা, ভয়ংকর রকম ভালোবাসি। তোমাকে পেতে হলে যা করার দরকার আমি তাই করবো। ”

“হায়াত এই হায়াত উঠ পড়তে বসতে হবে”

হায়াত চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। ঘড়িতে ঠিক সাতটা বাজে। স্কুল দশটা থেকে। প্রতিদিনই সে এই সময়ে উঠে পড়ে। তার সাথে অরিনও পড়ে। অরিন তাকে পড়াগুলো বুঝিয়ে দেয়। অংকও অরিনই করিয়ে দেয়। তার জন্য কোচিং করা লাগে না তার। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো আজ, না হয় প্রতিদিন নিজে থেকেই ওঠে। ছোট মেয়েটাও বাস্তবতা বুঝে গিয়েছে। চুলগুলো হাত খোঁপা করে উঠে মুখ ধুয়ে নিলো। এরপর সোজা অরিনের রুমে চলে আসলো। অরওন ততক্ষণে পড়তে বসে পরেছে। হায়াত ও বই নিয়ে বিছানায় বসে পরলো।

সকাল নয়টা বাজে। দু’জন এতো সময় পড়েছে। এখন দু’জনই উঠে তৈরি হতে গিয়েছে। কলেজে যেতে হবে অরিনের আজ। গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস আছে আজ। অরিন এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আর হায়াত দশম শ্রেনীর ছাত্রী। দু’জন এসে খাবার টেবিলে বসে। অরুনি শেখ খাবার বাড়তে বাড়তে বলেন,,
“আজ কখন ফিরবি অরিন?”

অরিন খেতে খেতে উত্তর দিলো,,
“কেনো আম্মু? তোমার কিছু লাগবে?”

“না রে আর কত করবি তুই। ভাগ্যিস তোর বাবা বাড়িটা করে গিয়েছিলো। না হয় কি যে হতো। তোর কয়টা ক্লাস আছে আজ মা?”

অরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মা যে তার জন্য খুব বেশি চিন্তা করে। হায়াতটাও আগের মতো বায়না ধরে না। অরিন হায়াতের দিকে তাকালো এতো ছোট বয়সে মেয়েটার কত কিছু বুঝে নিতে হচ্ছে। অরিনের মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে, বোনটার শখের বয়সে কিছু দিতে পারছে না। আর হায়াতটাও সব কেমন যেনো বুঝে নিয়েছে। অরিনের ভাবনার মাঝে অরুনি শেখ আবার বলে উঠলেন,,

“কি রে অরিন খাচ্ছিস না কেনো?”

“কিছু না আম্মা খাচ্ছি। আজকে ক্লাস দুইটা আছে।”

অরিন আর হায়াত খেয়ে বেরিয়ে পরলো। অরিন যাবে তাইবার সাথে আর হায়াত যাবে তোহার সাথে। অরিন তাইবা হেঁটেই রওনা দিলো কলেজের উদ্দেশ্যে। অরিনদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে না কলেজ। তাই অরিন আর তাইবা প্রতিদিন গল্প করতে করতে হেঁটেই চলে যায়। তাইবা কথার মাঝে অরিনকে জিজ্ঞেস করলো,,

“ধূসর আহসান কি তোকে গতকাল বিরক্ত করেছে অরিন?”

অরিনের মুখটা মলিন হলো। ধূসর লোকটা তাকে শান্তি মতো থাকতে দিলো না আর। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,,
“হ্যাঁ গতকাল রাস্তায় দাঁড় করিয়ে অনেকগুলো কথা বললো। কাল চুপ থাকিনি। আর কত সহ্য করবো বল তো। উনি দিন দিন সহ্যের সীমা অতিক্রম করছেন”

“অরিন আমার কি মনে হয় জানিস ধূসর ভাইয়া তোকে সত্যিই অনেক ভালোবাসেন। যদিও কোনো দিন বলেননি তোকে। তবে আমার মনে হয় সে তোকে খুব বেশি ভালোবাসেন। না হয় বর্তমান যুগে কি চলছে দেখছিস তো। পাত্তা না দিলে পরের দিন সেই মেয়ের দিকে কেউ তাকায় না তবে ধূসর ভাইয়া গত সাত মাস ধরে তোর পিছু পরে আছে।”

অরিন বিষাদময় কন্ঠে শুধালো,,“ভালো হয়তো সে বাসে আমায়। তবে আমাদের কি এক সাথে যায় বল। সে হলো আমাদের এমপির ছেলে আর আমি সেখানে একজন সাধারণ বাবাহীন মেয়ে। যার কাঁধে মা বোনের দায়িত্ব।”

অরিন থেমে আবারও বলল,,
“বুঝলি তাইবা সবার জন্য ভালোবাসা জিনিসটা না। তেমনি আমার জন্যও ভালোবাসা জিনিসটা না। আমার মাথার উপর এখন অনেক দায়িত্ব। হায়াতকে বড় উকিল বানাবো। আম্মাকে একটা হাসি খুশি রাখার জন্য সব করতে রাজি আমি”

তাইবা বুঝলো এখন কথা বাড়ালে অরিনের মনটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাই সে এসব নিয়ে কথা বাড়ালো না। কথা ঘুরাতে বলল,,

“আচ্ছা শোন আজ একটু ঘুরবো বুঝেছিস। সামনের লেকে যাবো। সকালের দিকে ফাঁকা থাকে। আর আজ রোদ ও নেই ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ”

“কিন্তু আম্মাকে যে বলে আসলাম দু’টো ক্লাস আছে তাড়াতাড়ি চলে আসবো?”

“প্রথম ক্লাসটাই তো গুরুত্বপূর্ণ পরেরটা খুব একটা না। ওটা করবো না আজ। আজ দু’জন মিলে ঘুরবো বুঝেছিস”

অরিন মাথা নাড়ায় সে জানে তাইবাকে হাজার বললেও শুনবে না। তাই সম্মতি দেওয়াই ভালো। অরিন তাইবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ভাবে,,

“বন্ধু থাকুক একজন তবে সেই একজন যেনো বন্ধুর মতো বন্ধু হয়। হাজার জন লাগবে না একজন সত্যি কারের বন্ধু থাকলেই জীবন সুন্দর। বন্ধুত্ব সুন্দর যদি তা হয় স্বার্থ ছাড়া।”

#চলবে~