প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-০৪

0
175

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৪

সকাল এগারোটা বেজে দশ মিনিট। ধূসর হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে বাইক নিয়ে। গন্তব্য তার নিবেদিতা। মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে যা তার উষ্কখুষ্ক চুল, ফোলা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভালোবাসা বোধ হয় এটাই প্রিয় মানুষটিকে দেখার নেশায় ছুটে আসতে হয়। যেমন ধূসর আহসান এসেছে। যে কোনো নারীকে পাত্তা দেয়নি। সেই ধূসর আহসানও এক নারীতে দুর্বল। ধূসর অরিনদের কলেজের নিকটে এসে বাইক থামিয়ে চায়ের দোকানে যায়। কিছু খেয়ে আসেনি সে। এক কাপ চা নিয়ে খেতে থাকে এবং নিবেদিতার অপেক্ষা করতে থাকে।

তাইবা আর অরিন সবে মাত্র ক্লাস শেষ করে বের হলো কলেজ থেকে। ক্লাসটা মোটামুটি ভালোই করেছে দু’জন। দু’জন হেঁটে পার্কে চলে আসে। পার্কের পাশটায় আজ মানুষের সমাগম খুব অল্প। পার্কের বেঞ্চে দু’জন বান্ধবী এসে বসলো। অরিনকে হঠাৎ করেই তাইবা জিজ্ঞেস করলো,,
“তুই কি ধূসর ভাইয়াকে ভালোবাসিস অরিন?”

অরিন মলিন হাসলো। মেয়েটা কিভাবে যেনো বুঝে যায় তার মনের খবর। কি করবে মনের উপর জোর করতে তো সে পারে না। ধূসরকে সে ভালোবাসে। তবে মুখে প্রকাশ করা হয়নি। করবে কিভাবে তার কাঁধে যে মা বোনের দায়িত্ব। মা বোনকে কিভাবে ভালো রাখবে এটা ভেবেই দিন যায় তার। সেখানে প্রেম বিষয়টা তো সে মাথাতেও আনেনি। অরিনকে উত্তর দিতে না দেখে তাইবা আবারও বলে উঠে,,
“কি রে উত্তর কেনো দিচ্ছিস না?”

অরিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,,
“কি উত্তর দিবো বুঝতেছি না। তোকে মিথ্যা বলতে পারবো না। তবে সত্য বলাটা যে অন্যায়”

তাইবা চমকে উঠলো। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। এই অরিনও কাউকে ভালোবাসে। হ্যাঁ বাসতেই পারে। এখন সময়,মানসিকতা না থাকলেও মনটা তো আগের ন্যায় আছে। তাইবা বুঝলো সব। এরপর বললো,,,

“শোন অরিন ধূসর ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ। সে তোকে প্রস্তাব দিলে তুই একটা সম্পর্কে জড়াতে পারিস। ভাইয়া তোকে নিশ্চয়ই অসম্ভব ভালোবাসেন। যা তার চোখের দিকে তাকালে তুই বুঝতে পারবি।

“হ্যাঁ আমি জানি রুষ্ট পুরুষ আমায় অসম্ভব ভালোবাসে। তাকে কি আমার সুযোগ দেওয়া উচিত?”

“অবশ্যই। আমার বিশ্বাস ভাইয়া তোকে কখনো কষ্ট দিবেন না”

তারা দু’জন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলল। ধূসর দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিজের নিবেদিতাকে দেখলো কিছুক্ষণ। সে অরিন এবং তাইবাকে কলেজ থেকে বের হতে দেখে নিজেও তাদের পিছু নিয়েছিলো। পিছু নিয়ে এখানে এসেছে। তবে আজ আর সামনে যায়নি। নিবেদিতা খুব একটা হাসে না। আজ হাসছে কাছে গিয়ে হাসিটা গায়েব করতে চাইছে না সে কিছুতেই। তাই দূর থেকে দেখে চলে গেলো। তাইবা অরিন বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বৃষ্টি নামতে পারে আজ। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না।

ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির তেজ এতোটাই যে আশেপাশের কিছু স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না। সকালে শীতল আবহাওয়া থাকলেও এখন প্রচন্ড পরিমানে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি দিনে মানুষের হৃদয়ে আনন্দের সমাগম হয়। হায়াতের কিশোরী হৃদয়ও আনন্দ অনুভব করছে। একদল কিশোরী ঝাঁক ধরে স্কুল মাঠে বৃষ্টিতে ভিজছে। তারও ইচ্ছে করছে খুব যাবে কি না তা নিয়ে দ্বিধা দন্তে রয়েছে। তোহা একটু ক্লাস রুমে গিয়েছিলো। দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এগিয়ে আসলো বেস্টফ্রেন্ডের নিকট।

“কি রে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? চল দ্রুত বৃষ্টি না হয় থেমে যাবে। আর ভিজতে পারবো না তখন।”

তোহা হায়াতের হাত ধরে টেনে নেমে পরলো মাঠে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজছে দুই বান্ধবী। আশেপাশের কিছু খেয়াল নেই তাদের। তারা ব্যস্ত বৃষ্টিতে ভিজতে। ভিজতে ভিজতে রাস্তায় এসে পড়েছে। খুব একটা লোক নেই বললেই চলে। যারা আছে তারা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন। রাস্তায় গাড়ি চলছে দুই একটা। দুই বান্ধবী হাত ধরে ভিজছে। হায়াত মন খুলে হাসছে। সাথে তোহাও। এ দৃশ্য দেখে এক বলিষ্ঠ পুরুষের হৃদয়ে যে প্রেমের আগুন লাগলো। পুরুষটি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভেজা মুখটির পানে চেয়ে আছে।

ধূসর উমেদকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,
“কি দেখছিস ওদিকে?”

উমেদের হুশ ফিরলো। নিজের চিন্তা ভাবনায় নিজেরই বেশ লজ্জা লাগলো। ইশ সে বাচ্চা একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। ধূসর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে উমেদের দিকে। উমেদের হঠাৎ কি হলো বুঝে উঠতে পারলো না ধূসর। উমেদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,,
“কি দেখবো বৃষ্টি হচ্ছে তাই দেখছি। চল দু’জন একটু ঘুরে আসি দূরে কোথাও?”

ধূসর সম্মতি জানালো। উমেদ বাইকে উঠার পূর্বে আর একবার দেখতে চাইলো সেই কিশোরীকে। তবে দেখা মিললো না। ততক্ষণে হয়তো চলে গিয়েছে সে তার গন্তব্যে। উমেদ নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। তবে সেই ভেজা মুখ খানি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ভেজা মুখ খানি। উমেদ নিজের নিষিদ্ধ ইচ্ছের কথা চিন্তা করে বেশ লজ্জিত হলো। কত মেয়ে দেখেছে মিশেছে তবে এমন তো হয়নি। আজ একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়েকে দেখে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা সব বের হয়ে আসছে।

ধূসর বড্ড বিরক্ত হলো। উমেদের দু মিনিট পরপর এমন গভীর চিন্তায় মগ্ন হওয়ায়। ধূসর মৃদু চিৎকার করে বলল,,
“উমেদ কোথায় হারাচ্ছিস তুই দু মিনিট পর পর? কি হয়েছে কি তোর”

উমেদ হাসতে হাসতে বলল,,
“ঘুম পাচ্ছে বড্ড তার জন্যই। আচ্ছা ফাহাদ আর নাফিজকেও ডেকে নেই। চল চারজন মিলে এই বৃষ্টিতে ছোট খাটো একটা টুর দিয়ে আসি”

ধূসর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করে। উমেদ ফোন করে বাকি দু’জনকে ডেকে নেয়। চারজন এক সাথে হয়ে অজানা গন্তব্যে রওনা হয়। উদ্দেশ্য তাদের কিছুটা সময় একান্তে কাটানো বন্ধুদের সাথে। চারজন দুটো বাইক নিয়ে ছুটছে অজানা গন্তব্যে।

বৃষ্টি থেমেছে বেশ কিছুক্ষণ। রাত নয়টার মতো বাজে। সারাদিনই বৃষ্টি হয়েছে আজ। বৃষ্টি হওয়ায় মুহুর্ত থেকে বৃষ্টির পর মুহুর্ত বেশি সুন্দর। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। শীতল করে দিচ্ছে অরিনের ছোট্ট রুমটা। ক্লান্ত শরীরটা টেনে রুমে প্রবেশ করলো অরিন। পরনের জামাটা সামান্য ভিজে গিয়েছে। অরিন বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে। লোডশেডিং হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় কারেন্ট গিয়েছে এখনো আসেনি। ঘরে ছোট্ট মোমবাতি জ্বালানো। তার আলোতেই আলোকিত চারপাশ। অরিন চোখ বন্ধ করে আছে।

অনেক লুকিয়ে রেখেছে নিজের অনুভূতি। আজ আর পারছিলো না। কাউকে বলার দরকার ছিলো নিজের অনুভূতিগুলো। তাইবাকে বলে আজ কিছুটা শান্তি পেয়েছে। তাইবার বলা কথাগুলোই ভাবছে। তার অবশ্যই উচিত ধূসরকে একটা সুযোগ দেওয়া। অরিনের ভাবনার মাঝেই হায়াত বই হাতে রুমে প্রবেশ করে। হায়াত অরিনের পাশে বসে বলে,,

“আপু একটু অংকটা বুঝিয়ে দিবি। আসলে অনেক সময় ধরে নিজেই চেষ্টা করছিলাম তবে পারিনি”

অরিন দু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো। মাথাটা যন্ত্রণা করছে। তবুও কিছু বলল না।হায়াত মোমবাতিটা বিছানার কিছুটা কাছে এনে রাখে। অরিন ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিলো অংকটা হায়াতকে। হায়াত অংকটা বুঝে চলে গেলো। অরিন আবারও চুপ করে শুয়ে পরলো। মাথা যন্ত্রণাটা বাড়ছে কমছে না। হায়াত কিছুক্ষণ এর মাঝে আবারও ফিরে আসলো। হাতে চায়ের কাপ। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে অরিনের মাথার পাশে বসে হাত দিয়ে একটু মালিশ করে দিলো মাথাটা। অরিন ধপ করে চোখ খুলল। অরিনকে চোখ খুলতে দেখে হায়াত বললো,,

“আপু তুই আগে চা টা খেয়ে নে। আমি আদা দিয়ে লাল চা করে এনেছি। খা মাথা ব্যাথা কমতে পারে। এরপর শুয়ে পর আমি মালিশ করে দিচ্ছি”

অরিন উঠে বসে বললো,,“তোর পড়া নেই? এসব কে করতে বলেছে তোকে?”

“আপু তুই তো আমাদের জন্য সারাটা দিন খাটিস। এখন আমি একটু তোকে সাহায্য করতে চাচ্ছি তুই এমন করছিস কেনো?”

অরিন বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,,
“দেখিস আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। আমি তোকে আর আম্মাকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিব। আমি তুই আর আম্মা এক সাথে খুব সুন্দর একটা জীবন কাটাবো”

“হ্যাঁ আপু। আমাদেরও সুখ আসবে। দুঃখের পরই সুখ আসে। অপেক্ষার ফল তো মিষ্টিই হয় তাই না? আমরাও না হয় অপেক্ষা করলাম। পরিশ্রম করলাম। আমাদের ও সুখ আসবে”

অরিনের চোখ জ্বলতে শুরু করলো। তার ছোট্ট বোনটাও কত বড় বড় কথা বলছে। সে ভাঙা কন্ঠে জবাব দিলো,,
“হ্যাঁরে হায়াত আমাদেরও সুখ আসবে। আমরা আবারও সুখে থাকবো। দুঃখ আমাদের ছুঁতে পারবে না”

#চলবে~