প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-১১

0
170

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১১

প্রথম রোজা। বাইরে আবহাওয়া মোটামুটি শীতল। ব্যস্ত দিন। অরিন ছাতা মাথায় হেঁটে ছাত্রীর বাড়িতে আসলো। রোদ থাকলেও দমকা হাওয়া বইছে। হুটহাট বৃষ্টি আসতে পারে। রোজার মাসটাতে তার একটু বেশিই কষ্ট করতে হয়। সারাটা দিন রোজা রেখে কোচিং, টিউশনি সামলিয়ে উঠা দায়। আজ যদি এই টিউশনিটার বেতন পায় তবে বেশ সুবিধা হবে তার জন্য। রোজার মাসের বাজারটা সেরে ফেলতে পারবে। রোজার মাস বিধায় সে নয়টায় পড়াবে পুরো রোজার মাস। ছাত্রীকে পড়িয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই ছাত্রীর মা বেতনটা তুলে দিলো অরিনের হাতে। অরিনের আঁখি জোড়া আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ বাদে হায়াতকে নিয়ে বাড়িতে থেকে বের হবে বাজারের উদ্দেশ্যে।

কড়া রোদ্দুরে নাজেহাল সে। ঘামার্ত মুখমণ্ডল ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে নিলো। হঠাৎ ই মুঠোফোনটি শব্দ তুলে বাজতে শুরু করলো। কাঁধে থাকা ব্যাগটি থেকে মুঠোফোনটি বের করলো। স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করতে থাকা নামটি দেখে ঠোঁটজোড়ায় অজান্তেই হাসির রেখা দেখা গেলো। রুষ্ট পুরুষ! এই একটি মাত্র পুরুষের মধ্যে তার সুখপাখি নিহিত। বড্ড ভালোবাসে পুরুষটিকে। তাদের প্রণয়ের খুব বেশি দিন হয়নি। তবে মনে হয় সম্পর্কটা যেনো হাজার হাজার বছরের। কল কেটে গিয়েছে। দ্বিতীয় বার আবার কল করেছে। অরিন আর সাত পাঁচ না ভেবে কল রিসিভ করলো। অপর পাশ থেকে পুরুষালী কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।

“নিবেদিতা! কি করছো? বাসায় ফিরেছো?”

অরিন মিহি কন্ঠে শুধালো,,,“রাস্তাতে। বাড়ি ফিরছি। টিউশনিতে গিয়েছিলাম”

অপর পাশ থেকে অস্থির কন্ঠস্বর শোনা গেলো।পুরুষটি অস্থির কন্ঠে বলল,,,“এই রোদে? ছাতা নিয়েছো তুমি? আমি আসবো?”

“নাহ মোটেও না। বোকা পুরুষ। এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি ছাতা এনেছি আর বাড়ির কাছাকাছি চলেও এসেছি। আচ্ছা শুনুন রাখি। আবার বাজারে যেতে হবে”

“আচ্ছা সাবধানে যেও”

দু’জন কল কাটলো। তাদের মাঝে খুব একটা কথা হয় না, আর না দেখা হয়। ধূসর দূর হতে তার প্রিয় নারীকে দেখে। তবে কথা বলার সুযোগ পায় না। এ কথা সে এখনো উমেদকে জানায়নি। অরিন বলেছে তাইবাকে। তাইবা শুভ কামনা জানিয়েছে দু’জনকে। তাইবা ভীষণ খুশি এ সম্পর্ক নিয়ে। সে চায় অরিন সুখে থাকুক। ভালো থাকুক। যা একমাত্র ধূসর আহসানই পারবে। তার ভরসা আছে ওই পুরুষটির উপর। সে জানে ধূসর খুব ভালো করে আগলে রাখবে তার প্রিয় নারীকে। অরিন দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। হায়াত বসার ঘরে বসে বই পড়ছে। অরিন ততক্ষণে সোফায় বসে পড়েছে। হলদে বর্ণ মুখখানা গরমে লালবর্ণ ধারণ করেছে। অরিন হায়াতের উদ্দেশ্যে বলল,,

“যা একটা ভালো জামা পড়ে আয় মার্কেটে যাবো। ইদের যাবতীয় বাজার করতে। দেখি তোর জন্য জামা পছন্দ হলে কিনে নিয়ে আসবো।”

হায়াতের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো না সে খুব একটা খুশি হয়েছে। এই বয়সের কিশোরীরা সাধারণত ইদের জামা, জুতো এইসব কিনতে খুবই আগ্রহ দেখায়। তবে জামা কেনার কথা শুনেও হায়াতের চোখে মুখে কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না। সে মাথা নাড়িয়ে নিজের রুমে এসে এক খানা কামিজ পড়ে নিলো। ওড়না গলায় ভালো করে পেচিয়ে নিলো। চুলগুলো ঝুঁটি করে নিলো। মুখ খানা শুকিয়ে গিয়েছে। হায়াতের গায়ের রঙ অরিনের থেকে বেশ উজ্বল। ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে। দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। যে কেউ এক দেখাতেই তাকে সুন্দরী বলে আখ্যায়িত করবে।

হায়াত রুম থেকে বের হতেই দেখলো তার আপু মায়ের সাথে কথা বলছে। হয়তো কি কি লাগবে তাই নিয়েই কথা বলছে। হায়াতকে দেখে অরিন কথা থামালো। মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

“আম্মা তাহলে যাই বাজার করে আনি। হায়াতের জন্য ভালো কামিজ পেলে কিনে আনবো আম্মু?”

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অরিন তাকালো মায়ের দিকে। অরুনী শেখ মৃদু হেসে বললেন,,
“যা ভালো বুঝিস তাই কর আম্মা”

অরিন মাথা নাড়ালো। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ইশারায় হায়াতকে পিছু পিছু আসতে বলল। আগের মাসে সে খুব কষ্টে কিছু টাকা বাঁচিয়ে ছিলো। সে থেকেই বোনকে আজ জামা কিনে দিবে। সে না হয় বড় হয়েছে, তবে বোনটা যে এখন ও অনেক ছোট। তারও তো শখ আহ্লাদ আছে। তার পক্ষে সব তো পূরণ করা সম্ভব নয়। কিছু কিছু না হয় করলো। হায়াত মাথা নিঁচু করে রিকশায় বসে আছে। তার মাঝে মাঝে খুব করে ইচ্ছে হয় মা বোনের সব কষ্ট দুঃখ দূর করতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। চাইলেও সে পারবে না কিছু করতে। অরিন কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো বোনকে। সে বুঝতে পারছে বোনের মনের খবর। হাসলো সে। ছোট্ট মেয়েটা কতটা বুঝদার। এই তো তিন বছর আগেও বাবার কাছে হাজারটা আবদার খুলে বসতো। সেই সবই এখন স্মৃতি।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস অরিন। বোন ততক্ষণে ওড়না মাথায় দিয়েছে। অরিন মুগ্ধ হলো তার ছোট্ট বোনের রূপ দেখে। স্নিগ্ধতা যেনো ছড়িয়ে পড়ছে মুখখানি জুড়ে।মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,,

“আমার রূপবতী বোন পৃথিবীর সব সুখ তোর হোক!”

রিকশা গন্তব্যে পৌঁছালো। হায়াত ও অরিন দু’জনে নামলো রিকশা থেকে। ভাড়া মিটালো অরিন। বোনের হাতজোড়া শক্ত করে চেপে ধরে সবজি বাজারের দিকে রওনা হলো অরিন। তবে কিছু মাথায় আসতেই সেদিকে না গিয়ে জামা কাপড়ের দোকানে আসলো। দোকানদার থ্রি পিস দেখাচ্ছে একটার পর একটা। হায়াত নিঃশব্দে সব দেখে চলেছে। এতো আলো রঙচঙ তার খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। অরিন বেশ কিছুক্ষণ দেখে একটা নীল রঙা থ্রি পিস বোনের গায়ে ধরে দেখলো। বাহ! বেশ মানাচ্ছে হায়াতকে রঙটাতে।

অরিন দাম শুনলো। অনেক দাম। তাদের মতো মানুষের কাছে তিন হাজার টাকা ও অনেক। সে দামাদামি করলো অনেকক্ষণ। এরপর সতেরোশো দিয়ে কিনলো। হায়াত দোকান থেকে বের হতে হতে বলল,,,

“কি প্রয়োজন ছিলো এগুলোর?”

অরিন ব্যাগটা বোনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বলল,,,“অবশ্যই প্রয়োজন ছিলো। হায়াত তোর বয়সটা এখন এসবের। আবদার করার বয়সে বাস্তবতা শিখেছিস, এই যে দেখ এখন তোর চোখে আগ্রহ নেই। তুই ঠিকমতো জামাটার দিকে তাকাস ও নি। এর মানে তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস। আমার বড্ড খারাপ লাগে।”

“আপু তুই কষ্ট পাস না। আমার আসলেই এগুলো ভালো লাগে না। তুই আম্মা পুরোনো জামা পরবি আমি সেখানে কিভাবে নতুন জামা পরি বল তো? আম্মাকে তো কিনে তুই দিবি আমি জানি তবে নিজে! নিজের দিকে কখনো তাকিয়েছিস? তাকাসনি, এই তিন বছর নিজেকে কতবার আয়নায় দেখেছিস একটু মনে কর। হাতে গোনা কয়েকবার। আর সেই আমি সাজবো! রঙচঙ মেখে ঘুরে বেড়াবো? আমার দ্বারা অন্তত এসব হবে না। আমি আমার আপার সারাদিন পরিশ্রম করা টাকা নষ্ট করতে চাই না”

অরিনের চোখের কোণে পানি জ্বলজ্বল করছে। চোখ জ্বলছে তার। কিছু বলল না সে। হায়াত ও বোধ হয় উত্তরের আশা করেনি। দু বোন নিজেদের স্বাভাবিক করে সবজি বাজারে প্রবেশ করলো। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সব কিনলো। অতঃপর রিকশায় চড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। দু’জন ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে।
গন্তব্যে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে যায় দু বোন। হাত ভর্তি বাজার। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দু’জন বাড়িতে প্রবেশ করলো। অরুনী শেখ মেয়ে দুটোকে দেখে দ্রুত পায়ে কাছে আসলেন। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিলেন। তিন জন মিলে রান্নাঘরে রেখে আসে সব। বসার ঘরে বসে পরে অরিন। শরীর আর চলছে না। রোজা রেখে এতো কিছু করা খুব কঠিন। অরুনী শেখ বুঝলেন মেয়ে ক্লান্ত জোড় করে রুমে পাঠিয়ে দিলেন দু’জনকে।

তিনিও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবেন। তিন জন তিনজনের রুমে চলে গেলো। অরিন রুমে এসে দরজা আটকে নিলো। মুঠোফোনটি হাতে নিলো। দশটার বেশি কল করেছে ধূসর তাকে। তবে সে তো বাজার করায় ব্যস্ত ছিলো। টের পায়নি কখন কল করেছে ধূসর। সে কল করলো। তবে রিসিভ হলো না কেটে দিলো অপর পাশের পুরুষটি। সেকেন্ড যেতে না যেতে নিজেই কল করলো। অরিন বিছানায় শুয়ে পড়েছে ততক্ষণে। রিসিভ করতেই অপর পাশের পুরুষটি গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,

“এতো সময় লাগে? তুমি কেনো বুঝো না নিবেদিতা তোমার অনুপস্থিত আমায় বড্ড পোড়ায়। একটু ফাঁকে একটা মেসেজ করে দিতে”

“রুষ্ট পুরুষ ক্ষমা করবেন আমায়। বাজার করাতে প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম তাই ধরতে পারি নি। শান্ত হন আপনি। আমি ঠিক আছি তো নাকি।”

ধূসর শান্ত হলো। দুজন কিছুক্ষণ কথা বললো। ধূসর অরিনের কন্ঠ শুনেই বুঝে ফেলেছে অরিন ক্লান্ত খুব বেশিক্ষণ কথা বলল না সে। নিবেদিতাকে ঘুমুতে বলল। সে নিজেও একটু ঘুমাবে। সে নিজের পরিবর্তে খুব অবাক। আগে বাড়ি ফিরতো না বললেই চলে। তবে এখন আগের তুলনায় কিছুটা বাড়ি থাকছে। নিবেদিতা তাকে পাল্টে দিচ্ছে। ধূসরের খুব করে অরিনকে নিজের কাছে আনতে ইচ্ছে করছে যদিও তা সম্ভব নয়। সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,,

“অপেক্ষা বড্ড যন্ত্রণা দায়ক নিবেদিতা, আমার হয়ে যাও না। দুঃখ তোমায় ছুঁতে পারবে না কথা দিলাম আমি”

#চলবে~