প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-১৯

0
171

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১৯

গভীর রাত। নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারপাশে। অরুনী শেখের দাফন সম্পন্ন হয়েছে আসরের আযানের পর। বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে হায়াত। পাশেই তাইবা ঝিমাচ্ছে। তোহাও হায়াতের পাশে শুয়ে আছে। অরিন দরজার বাইরে থেকে বোনকে এক পলক দেখে এলোমেলো পায়ে ছাদে আসলো। তার অবস্থা ভীষণ খারাপ। চোখ মুখে মলিনতা স্পষ্ট। অরুনী শেখকে বাড়ির আঙ্গিনায় কবর দেওয়া হয়েছে। ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। দমকা হাওয়া বইছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে অরিন।

ধূসর হাত মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই অরিনকে দেখতে পায় না। অজানা ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে তার। কোনো মতে ভেজা মুখখানা মুছে হায়াতের রুমে উঁকি দেয়। অরিনকে না দেখে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ছাদে উঠে অরিনকে দেখতেই সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে তার নিবেদিতার কাছে। নিবেদিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। অরিন হঠাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে হকচকিয়ে উঠে। ধূসর ছেড়ে দেয় অরিনকে। অরিন পিছু ফিরে চায় তার একমাত্র আস্থা করা মানুষটার দিকে। তার এখন আপন বলতে দু’জন মানুষ রইলো। তার তো তবুও নিজের স্বামী আছে, তবে হায়াত ওর কি থাকলো জীবনে! ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছে। এখন মাকে। যখন জীবনটা উপভোগ করবে ঠিক সেই সময়টা সে বুঝদার মেয়ের মতো কাটিয়েছে।

অরিন ক্ষীণ কন্ঠে বলল,,
“দেখুন না ধূসর আমার মা নেই। আমার হায়াতের কেউ নেই আমি ছাড়া। আমার আপনি আছেন কিন্তু ওর? ওর তো কেউ রইলো না আমি ছাড়া। আপন মানুষ বলতে আমি একা রইলাম। তবে আমিও তো বউ আপনার। আপনার বাড়ি যেতে হবে। কিন্তু ওর কি হবে। মেয়েটার বয়স ঘুরে বেরানোর দুষ্টুমি করার আর সেই ও বুঝদার মেয়ের মতো আচরণ করে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বলুন না কিভাবে কমাবো এই কষ্ট আমি”

ধূসর সহ্য করতে পারলো না প্রিয় নারীর চাপা আর্তনাদ। নিজের বক্ষ পিঞ্জিরায় আগলে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তার প্রিয় নারীকে। এরপর বলল,,,

“হুসস! আমি আছি তো। হায়াত তোমার একার বোন নয় নিবেদিতা। ও আমারও বোন। ওর বড় ভাই আছে ওর পাশে। ওর আপু আর ভাইয়া থাকতে আর কাউকে কি লাগে না কি”

অরিন কিছু বললো না। সেভাবেই ধূসরের বুকে মাথা গুঁজে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে রইলো দু’জন। ধূসর কোলে তুলে নিলো অরিনকে হুট করে। অরিন তাকালো ধূসরের পানে একবার। এরপর গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশে রইলো। ধূসর অরিনকে নিয়ে অরিনের রুমে আসলো। মেয়েটার শরীর চলছে না বুঝতে পারছে সে। অরিনের ছোট্ট শরীর খানা আসলেই চলছে না। ধূসর বিছানায় শুইয়ে দিলো। লাইট বন্ধ করে পাশে বসলো। অরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,,

“আমি আছি নিবেদিতা তুমি কিছুক্ষণ ঘুমাও। মধ্যরাত এখন। একটু না ঘুমালে অসুস্থ হয়ে পরবে। এরপর হায়াতকে কে সামলাবে বলো? তাই ঘুমাও”

অরিন মাথা নাড়ালো। চোখ বন্ধ করলো। ধূসর পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরিন ঘুমালো বেশ কিছুক্ষণ পর। ধূসর অধর স্পর্শ করলো তার প্রিয় নারীর কপালে। বেশ কিছুক্ষণ বসে তাকিয়ে রইলো তার নিবেদিতা। ধূসর দরজা পেছন থেকে আটকে ছাদে আসলো। সূর্য মামা উঠতে শুরু করেছে। সারাটা রাত ঘুমায়নি ধূসর। কি ভাবে ঘুমাবে সে এই পরিবারের যে সে ছাড়া আর কেউ নেই। ধূসর উমেদকে কল করলো। কল করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। হয়তো উমেদও ঘুমায়নি। উমেদ অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,,,

“ওদিকের অবস্থা কেমন? সবাই ঠিক আছে? হায়াত অরিন ওরা ঠিক আছে”

“রিলাক্স উমেদ সব ঠিক আছে। এখন বল ওদিকের কি খবর। সবাই তো জেনে গিয়েছে সব। বাবার কি খবর? কিছু জানিস”

“আমি তো তোদের বাড়িতে যায়নি। তবে মনে হয় না আঙ্কেল মেনে নিবে। সে তো জানিস কেমন! আবার না জানিয়ে বিয়ে করেছিস”

“মানলে মানুক না মানলে কোনো সমস্যা নেই। আমি ধূসর আমার বউ শালিকে খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখি। আর ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম না টিকে গিয়েছি। সামনের মাস থেকে জয়নিং”

“বাহ বেশ ভালো খবর। আমিও তো দিলাম। তবে এখনও কোনো খবর পায়নি। আঙ্কেল না মানলে কি তুই আলাদা থাকবি অরিনকে নিয়ে?”

“হ্যাঁ কারণ ওকে ছাড়তে আমি পারবো না। আমার অস্তিত্ব ও। আমার নিবেদিতা, আমার ভালোবাসা। আমার প্রাণভোমরা। সব ও। ওকে ছাড়া কীভাবে থাকবো বল”

উমেদ আমতা আমতা করে বলল,,,
“হায়াতের খবর কি বল তো! ও ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ তবে মেয়েটা ভেতর থেকে বাজে ভাবে ভেঙে পরেছে। একটার দিকে অরিন অনেক বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে। উঠে আবার কি পাগলামো করে কে জানে!”

ফোন রাখার আগে উমেদ ধূসরকে বলে দিয়েছে হায়াতের একটু খেয়াল রাখতে দেখে শুনে রাখতে। ধূসর সম্মতি জানিয়েছে। সে বুঝতে পারছে উমেদের ছটফটানিটা। উমেদ যে হায়াতকে ভীষণ ভালোবাসে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধূসর ভাবছে আরেক কথা। যদিও এ সময় তা তুলবে না। তবুও হায়াতের ভালোর জন্য কাজটা করতে হবে। আর সে জানে উমেদ কখনো হায়াতকে কষ্ট দিবে না। হায়াতকে আগলে রাখবে সে।

সকাল নয়টা। অরিন লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে। গতকালের কথা মনে পরতেই আঁখি জোড়ায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো অশ্রুকণার দেখা মিললো। বৃষ্টির মতো ঝপঝপ করে গরিয়ে পরলো গাল বেয়ে। অরিন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তার বোনকে সামলাতে হবে। এতো ভেঙে পরলে চলবে না। বোনকে সে ছাড়া কে দেখবে। তাকে এখন শক্ত হতে হবে। অরিন দু হাত দিয়ে গাল মুছে নেয়। ধূসর তখনই প্রবেশ করে রুমে। অরিনকে উঠতে দেখে এগিয়ে আসে অরিনের কাছে। ধূসরকে দেখে অরিন বলে উঠে,,,

“ হায়াত কোথায়? ও উঠেছে। রান্না হয়েছে? মেয়েটা তো খেলো না কিছু সেই রাতে।”

“অরিন অরিন রিলাক্স। হায়াত এখনো ঘুমাচ্ছে। আর রান্নার দরকার নেই তাইবার আম্মু খাবার দিয়ে গিয়েছে। উমেদ ও এসেছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। খেতে হবে। কাল তুমিও খাওনি কিছু”

“আমার আর খাওয়া। আমার দুনিয়া থমকে গিয়েছে একদিন আগেই ধূসর। আমার আম্মু সুস্থ মানুষটা আর নেই এ কথা ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে”

“অরিন মানুষ চিরস্থায়ী নয়। একদিন না একদিন মারা যেতেই হবে। মেনে নাও। কিছু কি করার আছে বলো। কিছু করার নেই। আমার মনে হয় আন্টি ঘুমের ঘোরে হার্ট অ্যাটাক করেছেন। এখন এসব বাদ দাও যাও ফ্রেশ হয়ে আসো”

অরিন মাথা নাড়িয়ে চলে যায় ফ্রেশ হতে। ধূসর রুম থেকে বের হয়ে উমেদকে দেখতে পায়। সোফাতে বসে আছে উমেদ। ধূসর এসে ওর পাশে বসে। উমেদ চিন্তিত গলায় বলে,,,
“তোদের ব্যাপারটা নিয়ে বাইরে অনেক চর্চা হচ্ছে। হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে পরেছে ব্যাপারটা। এমপির একমাত্র ছেলে হওয়ায় এই সমস্যা হচ্ছে। আর পাবলিক তো কেমন বুঝিস। ওরা এখন অরিন হায়াতকে খারাপ বানাচ্ছে”

“তুই চিন্তা করিস না উমেদ কিছু হবে না। আমি আছি তো। আমি সব ঠিক করে দিবো। এখন আপাতত অরিন আর হায়াত একটু নিজেদের সামলে নিক। এরপর আমি সবটা সামলে নিবো”

উমেদ কিছু বললো না। অরিন ততক্ষণে বসার রুমে চলে এসেছে। উমেদকে দেখলেও কিছু বলতে পারলো না ঠোঁট নাড়িয়ে। সেই ক্ষমতা তার নেই। সে ধীর পায়ে হায়াতের রুমে গেলো। মেয়েটা শুয়ে আছে। মলিন মুখখানা দেখে অরিনের বুকটা কেঁপে উঠলো। চোখের কার্নিশে পানির চিহ্ন স্পষ্ট। অরিন বসলো হায়াতের পাশে। কপালে অধর স্পর্শ করলো।

“আমি আছি তো হায়াত। কেনো ভেঙে পরেছিস? আমি আছি না। তোর আপু সব সময় তোর পাশে আছে। ভেঙে কেনো পরেছিস হায়াত। আম্মু তো আছে আমার আর তোর মাঝে আছে”

#চলবে~