প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-২১

0
172

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#পর্ব_২১

চাঁদনী রাত। আকাশে চাঁদের উপস্থিতি বিদ্যামান। চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ। অন্ধকার রুমে জানালার ফাঁকা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পরছে। দু’জন সদ্য বিবাহিত নারী পুরুষ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। ধূসর আর দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। বিছানায় দু’জনের মাঝে মাত্র এক হাত দূরত্ব। অরিন দু’হাতের উপরে মাথা রেখে তাকিয়ে আছে। ধূসর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,,,

“নিবেদিতা বাবা ফোন করেছিলো”

অরিন চমকালো, আশ্চর্য হলো। এমপি আসাদ আহসান তার ছেলেকে ফোন করতেই পারে এটা বিষয় না। তবে এখন বিষয়টা একটু অস্বাভাবিক। কারণ তাদের বিয়ের বিষয়টা জানাজানি হওয়ার পর আসাদ আহসান ফোন করে ধূসরকে অনেক কথাই বলেছেন। অরিনকে মেনে ও নেয়নি। অরিন নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,,,
“কি বলেছেন তিনি?”
“তোমাকে নিয়ে ও বাড়ি ফিরতে। রাফার বিয়েটা আটকে আছে। আমাদের জন্য বিয়ের তারিখ পেছানো হয়েছে। এখন বাবা আর বাড়ির সবাই চাইছে তোমাকে নিয়ে আমি ও বাড়ি ফিরে যাই”

অরিন থমকালো। সে যদি ধূসরের সাথে যায় তবে হায়াতের কি হবে। সম্ভব না হায়াতকে একা রাখা বা হোস্টেলে রাখা। সে হায়াতকে সাথে করে নিয়েও যেতে পারবে না। তার একটা আত্মসম্মান আছে। বোনকে কেনো শ্বশুর বাড়িতে রাখবে। তবে তার তো যেতেই হবে। সে তো ধূসরের বউ। আর ধূসরই বা কত দিন শ্বশুর বাড়িতে থাকবে। ব্যাপারটা ভীষণ দৃষ্টি কটু লাগে। অরিন ক্ষীণ কন্ঠে বলল,,,

“তবে হায়াত?”

“অরিন আমি জানি তুমি না ওকে একা রাখবে না ওকে আমাদের বাড়িতে নিবে। তাই আমি কিছু কথা বলছি আগে শুনবে তারপর ভেবে চিন্তে বলবে”

অরিন মাথা নাড়ায়। ধূসর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,
“হায়াতকে উমেদ ভীষণ পছন্দ করে। পছন্দ না ভালোবাসে, ভীষণ ভালোবাসে বলতে গেলে। এখন তুমি আমার বউ, তোমার আমার বাড়িতে যেতেই হবে। আর আমিই বা আর কত দিন শ্বশুর বাড়িতে থাকবো। তুমি হায়াতকে আমাদের সাথে নিবে না জানি। তাই আমি বলছি শুনো আগে হ্যাঁ। মাথা গরম করো না। ব্যাপারটা কেমন হয় তবুও আমার মনে হয় হায়াতের জন্য এটাই ভালো হবে।”

ধূসর থেমে আবার বলে,,,“উমেদ ভালো ছেলে তুমি চাইলে ও হায়াতকে বিয়ে করবে। হায়াত ভালো থাকবে তুমি আমায় বিশ্বাস করো”

অরিন শোয়া থেকে ধপ করে উঠে বসলো। ধূসর ও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো। সে কল্পনা ও করে না হায়াতকে এই সময়ে বিয়ে দেওয়ার কথা। মেয়েটা ছোট। সবে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। এখন কিছুতেই বিয়ে সে দেবে না। যতই উমেদ ভালো ছেলে হোক না কেনো। হায়াতের বয়সটা পড়াশোনা করার। এখন সে বিয়ে দিবে না হায়াতকে। হায়াতকে বড় ডাক্তার বানাবে সে। তার বোন বড় ডাক্তার হবে এটা তার মায়ের স্বপ্ন। সে পূরণ করেই ছাড়বে। অরিন বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললল,,,

“আমি জানি উমেদ ভাইয়া নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। আমার বোন সুখী ও হয়তো থাকবে। তবে আমি চাইছি না ওকে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করতে। আমি ওকে হোস্টেলে রাখবো। আর ওর পড়াশোনার খরচ নিয়ে অসুবিধা নেই ওপাশের ফ্লাটটা ভাড়া দিবো। এ পাশটা এমনই থাক। আর যাই হোক ওকে আমি এখন বিয়ে দিবো না।”

ধূসর বুঝলো অরিনের কথা। দু’জনের দিক থেকে দু’জন ঠিক। ধূসর তবুও বলল,,,
“ওর তবুও একজন গার্ডিয়ান প্রয়োজন। ওকে আগলে রাখার জন্য হলেও একজন মানুষ দরকার নিবেদিতা”

“কেনো ধূসর আমি আপনি আছি না? মেয়েটার এসএসসির মাত্র কয়েক মাস বাকি। ও একটা ধাক্কা খেয়েছে এটা সামলে উঠতেই হিমশিম খাচ্ছে, এখন আবার আর কোনো ধাক্কা দিয়ে ওকে শেষ করতে চাইছি না। আপনার কথাগুলো ঠিক তবে এখন কোনো মতেই আমি ওকে দ্বিতীয় ধাক্কা দিতে চাইছি না। মেয়েটা আগে নিজেকে সামলাক। ও এমনিতেই অনেকটা শক্ত। নিজেকে সামলে নিবে। তবুও বিয়ে নামক বন্ধনে আমি ওকে আটকাবো না। এসএসসি পরীক্ষা দিক এরপর উমেদ ভাইয়ার ব্যাপারটা আমি বলবো ওকে। ও সম্মতি দিলে বিয়ে দিবো। কিন্তু এখন নয়। এখন এই সব সম্ভব নয়”

ধূসর অরিনের প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো। আসলেই মেয়েটাকে এই সময় এতো মানসিক চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ধূসর মৃদুস্বরে বলল,,
“দুঃখিত আমি বুঝিনি। তুমি ঠিকই বলেছো। মেয়েটা ছোট এতো মানসিক চাপ নিতে পারবে না। এমনিতেই অনেক ঝড় গিয়েছে। এর থেকে বরং তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করো আমার সমস্যা নেই। তবে এটুকু জানিয়ে রাখলাম উমেদ ভালোবাসে হায়াতকে”

অরিন মিহি কন্ঠে বলল,,
“ভালো যখন বাসে তখন অপেক্ষা সে করতে পারবে। করুক অপেক্ষা। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”

“আচ্ছা এগুলো এখন বাদ দাও। আসো তোমায় একটু আদর করি। আদর আদর পাচ্ছে ভীষণ”

অরিনের গাল গুলো লজ্জায় রাঙা হলো। আঁখি জোড়া নামিয়ে নিলো। ধূসর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তার ভীষণ আনন্দ লাগে তার নিবেদিতাকে একটু লজ্জায় দেখতে। লজ্জায় রাঙা হলে যে কি ভীষণ সুন্দর লাগে তার বউকে, তার নিবেদিতাকে। সে বলে বোঝাতে পারবে না। অরিন লাজুক গলায় বললো,,,
“আপনি দিন দিন ভীষণ রকম অসভ্য হচ্ছেন রুষ্ট পুরুষ“
“বউয়ের কাছে কে সভ্য থাকে নিবেদিতা?”
“তবুও আপনি দিন দিন অনেক বেশি অসভ্য হচ্ছেন”
“বউয়ের কাছে সভ্য হলে দুনিয়া চললললললে ননননা”

ধূসর শেষের টুকু টেনে বললো। অরিন অসভ্য বলে উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পরলো। ধূসর হাসলো। অরিনের গা ঘেঁষে শুয়ে পরলো। অরিন মুচকি হাসলো তার রুষ্ট পুরুষের কাজ দেখে। অরিনের মায়ের কথা মনে পরলো। সারাদিন নিজেকে একেক কাজে ব্যস্ত রাখলেও রাতের সময়টাতে হয় না। মায়ের করা প্রতিটা কাজ মনে করে। মাকে ভীষণ মনে পরে তার। মায়ের কথা মনে পরতেই আঁখি জোড়া ভিজে গেলো। মুছলো না হাত বাড়িয়ে। ততক্ষণে ধূসর ঘুমিয়ে পরেছে। ঘুমের ঘোরে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। এই মানুষটা না থাকলে কি যে হতো তার কে জানে! মানুষটাকে ভীষণ ভালোবাসে সে। অরিন ধূসরের দিকে ফিরে অদর ছোঁয়ালো ললাটে।
এরপর ধূসরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। ধীর পায়ে উঠে শব্দহীন ভাবে দরজা খুলো। নিঃশব্দে দরজা হালকা করে চাপিয়ে হায়াতের রুমে আসলো। হায়াতের পাশে বসে পরলো। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। চোখ ভেজা দেখে বুঝলো ঘুমানোর আগে কেঁদেছে। অরিন হাত বাড়িয়ে মুছে দিলো। বোনের কপালে অধর ছোঁয়ালো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তার কি যেনো হয়েছে। ঘুম আসে না রাতের বেলায়। সে রোজ নিয়ম মাফিক ধূসরের সাথে ঠিক সময়ে ঘুমাতে যায় তবুও ঘুম আসে না। ধূসর ঘুমিয়ে পরার পর হায়াতকে দেখে যায় এসে। ঘুমাতে ঘুমাতে সেই দুইটা পার হয়ে যায়।

কি ভীষণ বাজে অভ্যাস হয়েছে তার গত এক মাসে। কলেজে যাওয়া হচ্ছে না। এক মাস বাড়ি থেকে বের হয় না। বিকালের দিকে তোহা তাইবা এসে ঘুরে যায়। তাদের মন ভালো করার চেষ্টা করে। কোনো দিন জোর করে লুডু খেলতে বসায় তো কোনো দিন সবাই মিলে লেবু চোর, চোর পুলিশ এসব খেলে। হায়াত তখন একটু হাসে এ ছাড়া পুরোটা সময় বইয়ের পাতায় ডুবে থাকে। মেয়েটার চোখ মুখ শুকিয়েছে। ঠিক মতো খায় ও না। ধূসর জোর করে যদি একটু খাইয়ে দেয়। সেও চেষ্টা করে তবুও হায়াত খেতে চায় না। সে বেশ কিছুক্ষণ বোনকে পরক্ষ করলো। এরপর ধীর উঠে নিজের রুমে চলে আসলো। রুমে এসে ধূসরকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

ছেলেটা যদি জানে সে না ঘুমিয়ে জেগে থাকে খুব বকবে তাকে। ধূসর অনেক চেষ্টা করছে তাদের স্বাভাবিক করার। ছেলেটার সাধ্য মতো চেষ্টা করছে। তবুও মা তো। কিভাবে ভুলে থাকবে। প্রতিটা মুহুর্তে মনে পরছে। বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় তার মায়ের স্মৃতি কিভাবে ভুলবে সে। সম্ভব নয়! অরিন সাবধানে শুয়ে পরলো এসে ধূসরের পাশে। ধূসরকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরলো মেয়েটা।

অরিনের সারা শব্দ না পেয়ে চোখ খুললো ধূসর। সে জানে অরিন প্রতিদিন এমন করে। সেও কিছু বলে না। সে জানে এসব ভোলা অসম্ভব। তার এখন আপাতত শুধু হায়াতকে নিয়ে চিন্তা। মেয়েটা একা হোস্টেলে থাকবে কীভাবে। সে তার প্রিয় নারীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আওড়ালো,,,
“তোমায় আমি ভীষণ ভালোবাসি নিবেদিতা। তোমায় আমি আমার মৃত্যুর আগ অব্দি আগলে রাখবো, রক্ষা করে যাবো”

#চলবে~