প্রিয় নিবেদিতা পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0
255

#প্রিয়_নিবেদিতা🖤
#লেখিকাঃ #ইশা_আহমেদ
#অন্তিম_পর্ব

নব্য দিন। নতুন জীবনের সূচনা। ঘন কালো আকাশখানা পরিষ্কার হয়ে সূর্য মামার দেখা মিলেছে। ব্যস্ত শহরী প্রতিদিনের ন্যায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে। যে যার যার কাজে ব্যস্ত। টানা দু’দিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ যেনো প্রকৃতি সতেজ হয়েছে। অরিনদের বাড়িতে তুমুল গোছগাছ চলছে। বাড়ি ছাড়ার সময় যে এসেছে। নতুন জীবনে পা দিতে চলেছে দু’জন এতিম মেয়ে। একজন তার স্বামীর হাত ধরে, তো আরেকজন তার আপুর হাত ধরে। দেখা যাক কি হয়!
অরিন সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। আজ যাবে ও বাড়িতে। মাঝের একটা দিন সব কিছু গুছিয়েছে। হায়াত তো প্রথমে যেতে চাইছিলো না তবে অরিন, ধূসর বুঝিয়েছে তাকে। এরপর হায়াত রাজি হয়েছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছে। দুপুরে আর রান্না করতে হয়নি। আসলে ধূসর দেয়নি রান্না করতে। বাইরে থেকে বিরিয়ানি কি এনেছে। তিনজন খেয়ে বিকালের দিকে রওনা দিবে। অরিন গোসলে গিয়েছে। ধূসর আগেই গোসল সেরে নিয়েছে। পরনে তার লাল খয়েরী রঙের পাঞ্জাবি। অরিন ওয়াশরুম থেকে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে ওড়না পেছিয়ে বের হয়। ওড়না খুলে শাড়ি পড়ায় মনোযোগ দেয়। শাড়ি পড়ার মাঝে বিরক্তিতে চোখ মুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকায় অরিনের। কুচিগুলো ঠিক হচ্ছে না। হায়াতকে ডেকে আসলে পারতো। তবে এখন তাও সম্ভব নয়।

এখন হায়াতকে ডাকলে ধূসর আগে এসে দুষ্টমি করবে। এরজন্য নিজেই চেষ্টা করতে লাগলো। ধূসর বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার নিবেদিতার কাজ দেখছিলো। নিবেদিতার অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হেসে পা বাড়ালো নিবেদিতার কাছে। হঠাৎ কুঁচিতে টান পরতে অরিন নিচের দিকে তাকালো। ধূসরকে দেখে থতমত খেলো,ভড়কালোও। সে ভেবেছিলো দরজা আটকানো কিন্তু দরজা যে সামান্য চাপানো ছিলো এটা তার ধারনা ছিলো না। লজ্জা পেলো অরিন অনেক। ধূসর কুঁচি গুলো ঠিক করে গুঁজে দিলো। পেটে পুরুষালি স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলো অরিন। তবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। লাল খয়েরি রঙা জামদানী শাড়িটায় ভীষণ মানিয়েছে অরিনকে। ধূসর মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার প্রিয় নারীর এ রূপ দেখছে। অরিন ধূসরকে পাত্তা না দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পরে।

অরিনের পাত্তা না পেয়ে ধূসরের মুখ খানা গম্ভীর হয়ে গেলো। অরিন অধর জোড়ায় মেরুন রঙা লিপস্টিক লাগিয়ে নিলো। চোখে কাজল। চুলগুলো হাত খোঁপা করলো। হাত খোপা করতেই পেছন থেকে এক জোড়া হাত তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। অরিন চমকে গেলো। ধূসর খোঁপা খুলে দিলো। চুলে নাক ডুবালো। এরপর অরিনকে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। দু’জনের চোখ একে ওপরে আবদ্ধ। ধূসর অরিনের কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে আরো কিছুটা মিশিয়ে নিলো। হালকা করে অরিনের অরিনের অধর জোড়া স্পর্শ করলো। এরপর ছেড়ে দিলো।

“আপনার আঁখি জোড়া এখন খুলতে পারেন বউ”

অরিন চোখ খুললো। লজ্জা পেলো বেশ। ধূসর হেসে অরিনক উদ্দেশ্য করে বলল,,,“আম্মু তোমার জন্য কিছু পাঠিয়েছে। এদিকে এসো পরিয়ে দেই আমি”

ধূসর তার বউকে টেনে বিছানায় বসালো। ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে সোনার হার পরিয়ে দিলো। এরপর সামনে এসে কানে, হাতে সোনার জিনিসগুলো পরিয়ে দিলো। এবার আরো বেশি রূপবতী লাগছে তার নিবেদিতাকে। অরিনের চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বলে,,,

“আমার রূপবতী, আমার রূপশী এতো মায়াবী কেনো তুমি। দেখলে মন চায় সারা জীবন সামনে বসিয়ে রেখে দেখি তোমায়।”

অরিন লজ্জায় আড়ষ্ট। এই পুরুষ তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে। এতো কেনো লজ্জা দেয়। অরিন দ্রুত উঠে বলল,,,
“চলুন খেতে হবে। আবার ও বাড়িতেও যেতে হবে। এখন খাবেন চলুন। অনেক দুষ্টমি হয়েছে চলুন এবার”

ধূসর ও সম্মতি জানালো। তিনজন মিলে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকালো। এরপর সেই বিষাদময় মুহুর্ত আসলো। অরিন আর হায়াত দেখে নিলো বাড়ি খানা ভালো করে। চোখ বুলিয়ে নিলো পুরো বাড়ি। কতশত স্মৃতি জমে আছে এ বাড়িতে। শৈশব থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তাদের এখানেই কেটেছে। এতো বছরের আবাস স্থল ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে, যন্ত্রণা হবেই। তবুও মানিয়ে নিতে হবে। অরিন নিজ হাতে তালা লাগালো বাড়ির দরজায়। মায়ের কবর খানা আরেকবার দেখে নিলো। হায়াত কাঁদছে না আজ একটুও। হৃদয়টা পুড়ছে, বিষাদে সিক্ত হচ্ছে হৃদয়খানা তবুও নিশ্চুপ সে। নিজেকে সামলাতে বুঝেছে। ধূসর এসে মাথায় হাত রাখলো হায়াতের। হায়াত চোখ তুলে তাকালো। এরপর মৃদু হেসে অন্য দিকে তাকালো। তিনজন মিলে রওনা হলো। অনামিকা ইসলাম আগে থেকেই গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির বউ রিকশা বা অন্য কিছুতে আসলে ব্যাপারটা বাজে দেখায়। এ জন্যই তিনি আগে থেকে গাড়ি পাঠিয়েছেন। গাড়ি তার গন্তব্যে এসে পৌঁছালো। তিনজন গাড়ি থেকে নামলো। সবাই অপেক্ষা করছিলো নতুন বউয়ের। রাহিয়া রাফা দু’জন খুবই আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কখন দেখবে তাদের নতুন ভাবিকে।

তারা দু’জন আবার উমেদের সাহায্যে আরো একটা কাজ করে রেখেছে। রাহিয়া উপরে নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো ধূসরদের দৌড়ে নিচে নেমে জানালো সবাইকে। অনামিকা ইসলাম আগে থেকেই সব কিছু তৈরি করে রেখেছিলেন। কলিংবেল বাজতেই রাহিয়া দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। অরিনকে ঝাপটে ধরলো। অরিন বেচারি হঠাৎ এমন হওয়ায় ভড়কালো। পরে যেতে নিলে ধূসর পেছন থেকে ধরলো। অনামিকা ইসলাম দ্রুত এগিয়ে আসলেন। রাহিয়াকে সরিয়ে অরিনকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে আসলেন। বাড়ির সবাই নতুন বউয়ের মুখ দেখে এটা ওটা দিলো। অনামিকা ইসলাম হায়াতকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। হায়াত ও মিশে আছে তার সাথে। হায়াতের মনে হচ্ছে সে তার মাকে জড়িয়ে ধরেছে। মা মা গন্ধ আসছে কেমন জানি! অনামিকা ইসলাম হায়াতকের সাথে গল্প জুড়ে দেন।
অরিন দেখছিলো হায়াতকে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনামিকা ইসলামের সান্নিধ্য পেয়ে বেশ খুশি। অনামিকা ইসলাম তো হায়াত পুতুলের মতো রাখবে ভেবে নিয়েছেন। মেয়েটা দেখতেও পুতুলের মতোই। কি সুন্দর দেখতে। তার ছোট একটা মেয়ের শখ এবার পূরণ হলো।

রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। অরিনকে সবেমাত্র রাহিয়া রাফা ছেড়েছে। এতো সময় সবাই ঘিরে গল্প করছিলো। এমনি আসাদ আহসান ও তার সাথে কথা বলেছে, তাকে এক জোড়া বালা ও দিয়েছেন। অরিন এতেই ভীষণ খুশি। রাহিয়া রাফা মিলে ধূসরের রুমের সামনে তাকে রেখে চলে গিয়েছে। অরিন ধীর পায়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলো রুমে। বেলী রজনীগন্ধা, গোলাপের গন্ধে মো মো করছে চারপাশ। অরিন খুঁজে লাইট জ্বালালো। লাইট জ্বালাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফুলের সমাহার। টাটকা ফুল দিয়ে বিছানা সাজানো। কিছু মোমবাতি ও জ্বালানো। বেশ দামি দামি ফার্নিচার দিয়ে রুমটা সাজানো। অরিন বুঝলো এগুলো সব রাফা আর রাহিয়ার কাজ। তবে এখন কি করবে সে লাগেজ কোথায় তাও জানে না। শাড়ি পরেও বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। ধূসর ও আশে পাশে নেই যে তাকে বলবে। এ জন্য চুপ করে বিছানায় বসলো। কিছুক্ষণ বাদে রুমের লাইট বন্ধ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে মৃদু হাওয়া বইছে। অরিন দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো।

ধূসর রুমে প্রবেশ করতে অবাক। বাড়ি আসার পর এখনই সে প্রথম রুমে আসলো। এ অবস্থা দেখে অবাক হলো। লাইট জ্বালাতে গিয়েও জ্বালালো না। বারান্দায় আসতেই তার প্রিয় নারীকে আবিষ্কার করলো। ধূসর পেছন থেকে গিয়ে বলল,,,

“এই যে নতুন বউ আপনি এখানে দাঁড়িয়ে যে?”

অরিন ভড়কালো। দ্রুত পিছনে ফিরলো। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,,,
“এমনিতেই ঠান্ডা বাতাস হচ্ছে তাই এখানে এলাম”

“মন খারাপ?”

“উহু না। কিছুটা খারাপ লাগছে তবে ঠিক আছে সমস্যা নেই”

“মন খারাপ করো না নিবেদিতা। তুমি হায়াত এখানে ভালো থাকবে। ভীষণ ভালো থাকবে। আম্মু বাবা সবাই ভালো। বাবা উপরে উপরে একটু শক্ত দেখায় নিজেকে তবে ভেতরটা নরম।বুঝেছো?”

অরিন মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে বুঝেছে। অরিন নিজ থেকে মাথা রাখলো তার প্রিয় পুরুষের বক্ষে। এই পুরুষ তার শেষ ভরসার স্থান। তার ভালোবাসার মানুষ। ধূসর আগলে নিলো তার নিবেদিতাকে। এরপর মৃদু কন্ঠে শুধালো,,,

“প্রিয় নিবেদিতা,

আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা তুমি। গত কয়েক বছর ধরে ভালোবাসি তোমায়। তুমি আমার সেই ভালোবাসা যাকে এক পলক দেখার তৃষ্ণায় আমি ঝড় বৃষ্টিতেও ছুটেছি। তুমি আমার সেই ভালোবাসা যার জন্য আমি দুনিয়ার সবার বিরুদ্ধে যেতেও পিছু পা হবো না। তবুও তোমাকে আমার চাই, চাই মানে চাই। ভালো যখন বেসেছি তোমার আগলে রাখার দায়িত্ব ও আমার। তোমাকে খুশি করার দায়িত্ব ও আমার। আমার থেকো নিবেদিতা। বড্ড ভালোবাসি, পাগলের মতো ভালোবাসি তোমায়”

অরিন শুধু দু শব্দে উচ্চারণ করলো,,“আমিও ভালোবাসি”

পরিশিষ্টঃ

“আব্বু আম্মু আমায় বকেছে। আমায় চকলেট খেতে দেয়নি”

মেয়ের কাঁদো কাঁদো কন্ঠস্বর শুনে হাসলো ধূসর। কোলে তুলে নিলো তাদের চার বছরের মেয়ে তেজাকে। ধূসর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,
“আম্মু তোমায় দেয়নি তো কি হয়েছে আমি দিবো। চলো এখন নিচে যাবো। তোমায় হায়াত মামনি আসছে, রাফিয়া, রাফা ফুপিমনি আসছে। চলো চলো”

ধূসর মেয়েকে নিয়ে নিচে নামলো। ততক্ষণে সবাই চলে এসেছে। হ্যাঁ রাহিয়ার সাথে বিয়ে হয়েছে তার ভালোবাসার মানুষের। জাহিন মেনেছে তার ভালোবাসা। মুভ অন করেছিলো জাহিন। এখন সে ভালোবাসে রাহিয়াকে। তবুও প্রথম ভালোবাসা হৃদয় কোঠায় কোথাও না কোথাও কিছুটা হলেও রয়ে গিয়েছে। তবে এখন মনে পরে না আর অরিনকে সেভাবে। সে সুখী আছে তার এক বছরের ছেলে আর বউকে নিয়ে। উমেদ দেবদাসের ও বিয়ে হয়েছে তার প্রিয় মানুষের সাথে। বছর খানেক হলো বিয়ের। হায়াত এখন সেই ছোট্ট হায়াত নেই সে এখন যুবতী নারী। পাঁচ বছরে সব পাল্টেছে। অরিন খাবার টেবিল সাজাতে সাজাতে সবাইকে খেতে আসতে বলল। সবাই খেয়ে নিলো। এরপর নিজেদের বরাদ্দকৃত রুমে চলে গেলো। তাইবা আসতে পারিনি কারণ সে নাফিজের সাথে সাজেক গিয়েছে। তোহা এখন মেডিকেলে পরছে হায়াতের সাথেই। রাতে পিকনিক আছে ছাদে সবাই মিলে করবে। সবাই সুখে আছে। ধূসর তার প্রিয় নিবেদিতাকে সুখ দিয়েছে। পৃথিবীর যত সুখ দেওয়া যায় সে তার সাধ্য মতো দিয়েছে।

সবার সুখে থাকার মাঝেও কেউ একজন এক তরফা ভালোবাসায় ভুক্তভোগী হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ভালো তো সেও বেসেছিলো ভীষণ তবুও তাকে পায়নি। এক তরফা ভালোবাসা হয়েই রয়ে গেলো সব। স্নিগ্ধা এখন কানাডায় আছে। স্নিগ্ধা তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মনে মনে আওড়ালো,,

“ভীষণ ভালোবাসি আমার না পাওয়া ভালোবাসা। আমি দূরে থেকেই তোকে ভালোবাসলাম। দোয়া করি সব সুখ তোর আর তোর নিবেদিতার হোক। সুখী হ তুই। আমি না স্মৃতি গুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে রইলাম।
ভালোবাসলে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তাই আমিও চাই না তোকে। তুই যাকে ভালোবাসিস তাকে নিয়েই সুখী থাক। আর আমি! তোর ছবিখানা বুকে জড়িয়ে আজীবন পার করলাম না হয়।

#সমাপ্ত~