প্রিয় নীড়হারা পর্ব-০১

0
75

#প্রিয়_নীড়হারা
লেখনীতে: #অক্ষরময়ী
পর্ব: ০১

আমিরাহ আহমেদ কোমরে হাত রেখে চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। দুশ্চিন্তায় তার মাথার ভেতর মস্তিষ্ক ভনভন করে ঘুরছে কিন্তু বাইরে থেকে মাথা স্থির দেখাচ্ছে। চায়ের পানিতে উতাল এলো। সে জ্বাল কমিয়ে দিয়ে আদা কুচি করে কেটে বাটনায় মিহি করে বেটে নিল। মিহি আদা বাটা চায়ে দিলে ঝাঁঝালো একটা স্বাদ আসে। খেতে ভালো লাগে। মশলার পট খুলে হাতের কাছে যতো মশলা পেল চায়ের পানিতে দিয়ে দিল। সাদা এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা সবগুলো দিয়ে আবার পানি জ্বাল করতে থাকল। ঘরে দুধ নাই। রঙ চা বানাতে হবে। প্রতি কাপের জন্য এক চিমটির একটু বেশি চা-পাতা দিতে হবে। তবেই চায়ের ঠিকঠাক রঙ আসবে।

পাখির মত কিচিরমিচির করে রান্নাঘরে এলো দোয়েল। একগাছি চুল ডান হাতের তর্জনিতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,

‘মা, বাবা নাস্তা দিতে বলল।’

কোন কুক্ষণে ছোট মেয়েটার নাম দোয়েল রেখেছে তা ভেবে আজও আফসোস হয় আমিরাহ আহমেদের। পাখির নামের মতোই ছটফটে স্বভাব হয়েছে মেয়েটার। শেষভাগে চায়ের মধ্যে পরিমাণ মতো চিনি দিয়ে আমিরাহ আহমেদ বলল,

‘তুই যা, আমি নিয়ে আসছি।’

‘নাহ, আমাকে নিয়ে যেত বলল।’

‘তুই পারবি না। গরম অনেক। চায়ের কাপ ফেলে দিবি।’

‘আমি পারব। দেও দেখি আমার হাতে।’

‘বললাম না, পারবি না। যাহ এখান থেকে।’

কলেজ থেকে ফিরে সোজা রান্নাঘরে এসেছে দৃতী। দোয়েলের মাথায় হাত বুলিয়ে একটি আইসললি ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘অর্ধেকটা দৌলতের।’

আইসললি পেয়ে চায়ের কথা ভুলে দৌড় দিল দোয়েল। দৃতী তার মাকে বলল,

‘কি হয়েছে? ওকে ধমকাচ্ছিলে কেনো?’

‘ঘরে কোনো নাস্তা নাই। তোর বাবাকে কখন থেকে ডাকছি। সেই লোক ইশারাও বুঝে না। সোফায় বসে আছে তো আছেই। মনে হচ্ছে, তার পাছায় কেউ সুপার-গ্লু লাগিয়ে দিয়েছে। সে উঠতে পারছে না।’

‘বাবার কাছে টাকা নেই। মাসের শেষে হাত ফাঁকা। তাই আসছে না।’

‘তাহলে বারবার লোক পাঠিয়ে নাস্তা চাইছে কেনো? আমি কোথা থেকে নাস্তা এনে দিব?’

‘কি নাস্তা লাগবে বলো, আমি এনে দিচ্ছি।’

‘তোর কাছে টাকা আছে?’

‘রিক্সা ভাড়া রেখেছিলাম।’

‘তোর যেতে হবে না। দৌলতকে পাঠিয়ে দে। এক প্যাকেট ফিট বিস্কুট আর বোম্বে চানাচুর আনতে বল।’

‘ভর দুপুরবেলা কার জন্য নাস্তার আয়োজন করছ?’

পাঁচ বছরের দৌলতকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হলো ফিট বিস্কিট, বোম্বে চানাচুরের নাম। দৌলত অতি উৎসাহে আইসললিতে কামড় বসাতে বসাতে পাড়ার মোড়ের দোকানের দিকে ছুটল।

কাঁধের ব্যাগটি সবজির ডালার উপর রেখে চায়ের কাপে চা ঢালছে দৃতী। আমিরাহ আহমেদ মেয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী এসেছে। কীভাবে যেন খুঁজে খুঁজে একদম বাড়িতে এসে হাজির। আমি দরজা খুলে অবাক হয়ে গেছি। প্রথমে চিনতেই পারিনি। ও আমাকে এক দেখাতে চিনে ফেলল, জানিস!’

দৃতী ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের কিশোরীসুলভ হাসি দেখল। বন্ধু-বান্ধবের সাথে সম্পর্কগুলো সর্বদা সজীব থাকে। তাদের সামনে দাঁড়ালে ফিরে আসে হারিয়ে যাওয়া শৈশব, কৈশোর, যৌবন।

অতিথির সামনে নাস্তার ট্রে নামিয়ে রাখল দৃতী। মেলামাইনের ট্রে-র একটি কোণা ভেঙে গেছে। ওড়নার দিয়ে ভাঙ্গা অংশটি আড়াল করার যথেষ্ট চেষ্টা করছে সে। মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আমিরাহ আহমেদ বলল,

‘আমার বড় মেয়ে দৃতী। ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। আরও দুজন আছে। দুনিয়া, দোয়েল। একজন এবার এইচএসসি দিবে, আরেকজন এসএসসি। তখন থেকে যার সাথে গল্প করলি, সে আমার ছোট ছেলে দৌলত।’

বান্ধবীর এক হাত জড়িয়ে ধরে সকলের উদ্দেশ্যে আমিরাহ আহমেদ বলল,

‘এ আমার বান্ধবী রেশমি। আর ওর পাশে তোদের রেশমি আন্টির পরিচিত আরেকজন আন্টি। উনার নাম তানিয়া।’

মেয়েরা সবাই একযোগে অতিথি দুজনকে সালাম দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। রেশমী বলল,

‘তোর মেয়েরা দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। কী সুন্দর বড়সড় পরিবার।’

আমিরাহ কিছু বলার আগে মুস্তাফা আহমেদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,

‘তিন মেয়ের পর হঠাৎ করে ছেলেটা এলো। আমিরাহ কিছুতেই বাচ্চাটা রাখবে না। মেয়ে বড় হয়ে গেছে, দৃতী তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। লোকে কি বলবে এই ভেবে সে বাচ্চাকে নষ্ট করে ফেলতে চাইল। আমি বললাম, আল্লাহর সৃষ্টি একটা জীবনকে হত্যা করা ঠিক না আমিরাহ। কিন্তু সে মানবে না। আমার সাথে অনেক চোটপাট করে শেষমেষ বাচ্চাটা রাখল। এখন দেখেন, এ বাড়ির সবার চোখের মনি হয়ে গেছে বাচ্চাটা।’

মুস্তাফা আহমেদের সরলতায় মুগ্ধ রেশমি। এ যুগে এমন দিলখোলা মানুষ দেখা যায় না।

‘সবই আল্লাহর ইচ্ছা ভাই। তার লীলাখেলা বুঝা মুশকিল। আমি যখন কুমিল্লায় এলাম তখনো কি জানতাম, আমিরাহর সাথে আমার এভাবে দেখা হয়ে যাবে!’

আমিরাহ তরুণীর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চাইল,

‘হ্যা রে বললি না তো, কীভাবে আমার খোঁজ পেলি?’

‘সেদিন বাজারে একপলক দেখেছিলাম তোকে। কথা বলার জন্য ছুটে আসার আগেই তুই রিক্সায় উঠে চলে গেলি। বাড়ি ফিরে তানিয়াকে বললাম। ওর চাচা শ্বশুর কীভাবে যেনো খুঁজে বের করল।’

তানিয়ার কাছে আমিরাহ আহমেদ জানতে চাইল,

‘আপনি এখানে থাকেন?’

‘নাহ। আমার চাচা শ্বশুরের বাড়ি এখানে। উনার মেয়ের বিয়েতে এসেছি।’

‘কোথায় থাকেন উনি?’

‘জিলা স্কুলের পাশেই বাড়ি।’

চোখের পলকে বিদায় বেলা এসে যায়। ‘আজ উঠি।’ বলতেই আমিরাহ আহমেদ এর মুখে আঁধার নামে।

‘আরেকদিন আয় বাড়িতে।’

‘পরশু ফিরতে হবে।’

‘কোথায় আছিস এখন?’

‘শ্বশুরবাড়ি পুরান ঢাকায়। আমার হাসবেন্ড আবার তিতুমীর কলেজের টিচার। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের ওদিকে কোয়ার্টারে আছি। ঢাকায় এলে অবশ্যই দেখা করবি।’

রেশমি চলে গেলেও সারাদিন আমিরাহ আহমেদের মুখে তার কথা শুনা গেল। এটা ওটা কাজের পাশাপাশি নিজের কৈশোরের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের।

‘তখনকার দিনে মানুষ এতো আধুনিক ছিল না। মেয়েরা কলেজে যাবে পড়তে, এমন কথা শোনাও যেন পাপ। হাইস্কুলে পড়াকালীন প্রায় সকল মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো৷ এমন সময়ে দাঁড়িয়ে আমি আর রেশমি কলেজে ভর্তি হলাম। বাড়ি থেকে কলেজ পাঁচ কিলো দূর। এতোদূরে যাওয়া আসা কি করে হবে? বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে কোনো পয়সা দিবে না। রেশমি আর আমি মিলে বুদ্ধি করে প্রতিদিন সকালে আব্বার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরতাম। কোনোদিন রেশমি সাইকেল চালাত, আমি পেছনে বসে থাকতাম। আবার কোনোদিন আমি চালাতাম, রেশমি বসে থাকত।’

দৃতী গালে হাত দিয়ে মায়ের কথা শুনছিল। অবাক হয়ে বলল,

‘তুমি সাইকেল চালাতে পারো?’

‘কেনো? বিশ্বাস হচ্ছে না?’

‘না মানে কখনো দেখিনি তো।’

‘সেই সুযোগ তোর বাবাকে আমাকে দিয়েছে? বিয়ে করে নিয়ে এসে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছে। নতুন বউয়ের মাথা থেকে ঘোমটা নামানো যাবে না, শব্দ করে হাসা যাবে না, জোরে হাঁটাচলা করা যাবে না। কতো কতো নিয়ম!’

মুস্তাফা আহমেদ সোফায় বসে পেপার পড়ছিল। স্ত্রীর কথা শুনে পেপারটি ভাঁজ করে রেখে বলল,

‘তুমি এখনও হো হো শব্দ করে উচ্চস্বরে হাসো, আমিরাহ।’

‘হাসলে হাসি। একশবার হাসব, হাজারবার হাসব। নতুন বউ আছি নাকি এখনও! বুড়াতি বয়সে ঢংয়ের কথা।’

এঁটো প্লেট নিয়ে আমিরাহ আহমেদ রান্নাঘরে চলে গেলে তিন মেয়েসহ মুস্তাফা আহমেদ আড়ালে হাসল।

*****

তৃতীয় দিন রেশমির চলে যাওয়ার কথা থাকলেও দেখা গেল, তানিয়াকে সঙ্গে নিয়ে আবার চলে এলো আমিরাহ আহমেদের বাসায়। দরজা খুলে রেশমিকে দেখে আমিরাহ আহমেদ ভীষণ খুশি হলো। সকালবেলা বাড়িতে কেউ নেই৷ বাচ্চারা সবাই যার যার স্কুল-কলেজে। মুস্তাফা আহমেদ গিয়েছে অফিসে৷ বাড়িতে সে একাই রান্নাবান্না করছে। এমন সময়ে বান্ধবীর উপস্থিতি একাকিত্ব দূর করে দিয়েছে।

সোফায় আরাম করে বসে রেশমি বলল,

‘চা-নাস্তার কোনো ব্যবস্থা করার দরকার নাই। তুই আমার পাশে একটু বস। জরুরি কথা আছে৷’

‘অন্তত এক কাপ চা করে আনি।’

‘প্রয়োজন নেই। আমরা নাস্তা করেই বের হয়েছি। কথাগুলো বলে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে। দুপুরের বাসে আমরা ঢাকা ফিরব।’

‘কি কথা? বল শুনছি।’

‘তানিয়া ভাবীর সাথে সেদিন তোকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, মনে আছে? কথাগুলো উনার সম্পর্কে।’

আমিরাহ আহমেদ তানিয়ার দিকে তাকাল৷ ভদ্র মহিলা চুপচাপ বসে আছে। প্রথমবার যখন এলো তখনো এভাবেই বসে ছিল। কথাবার্তা কম বললেও আচার-আচরণে বেশ বিনয়ী। আজও রেশমির পাশে হাসি মুখে বসে থেকে তাকিয়ে আছে আমিরাহ আহমেদের দিকে। আমিরাহ আহমেদ কৌতূহলী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রেশমির দিকে তাকাল৷

‘তানিয়া ভাবির স্বামী আমার স্বামীর কলিগ। দুজনে তিতুমীর কলেজে দীর্ঘদিন যাবৎ একসাথে চাকরি করছে। সেই সুবাদে আমাদের পরিচয়। ভাবির চাচা শ্বশুরের মেয়ের বিয়েতে আমাকে জোর করে সাথে নিয়ে এলেন। তাহলে বুঝ আমাদের সম্পর্ক কতোটা গাঢ়।’

বান্ধবীর সাথে অন্যের ঘনিষ্ঠতার কথা শুনে এই বয়সেও সামান্য হিংসা তৈরি হলো আমিরাহ আহমেদের মনে৷ রেশমির সাথে উনার যোগাযোগ থাকলে তানিয়া নিশ্চয়ই মাঝখানে ঢুকে পড়তো না।

‘তোকে সেদিন বলেছিলাম না, আমরা মহাখালীর ওদিকে থাকি? আমরা ভাড়া বাসায় থাকলেও ওরা কোয়ার্টারে থাকে। উনার ছেলে কাস্টমস অফিসার৷ কাস্টমস এর কোয়ার্টারেই ওরা থাকে।’

রেশমি কেনো তানিয়ার পারিবারিক ইতিহাস শোনাচ্ছে বুঝতে পারছে না আমিরাহ আহমেদ। ভদ্রতার খাতিরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘মাশাআল্লাহ। বেশ ভালো।’

এ পর্যায়ে তানিয়া সোজা হয়ে বসে প্রথমবার আলোচনায় অংশ নিল।

‘এক ছেলেকে নিয়ে আমাদের খুব ছোট সংসার৷ সকালবেলা উঠে স্বামী কলেজে যায়। ছেলে অফিসে, বাড়িতে আমি একলা। ধানমন্ডিতে আমাদের একটা ফ্ল্যাট কেনা আছে। কিন্তু সেখানে থাকার মত লোক নেই৷ ছেলে যেহেতু কোয়ার্টার পেয়েছে এবং কাজের সুবাদে সেখানে থাকে তাই আমরাও কোয়ার্টারেই আছি।’

মুখের হাসি বিস্তৃত করে আমিরাহ আহমেদ ইতস্ততভাবে বলল,

‘আমি আসলে জরুরি আলোচনাটা এখনও বুঝতে পারছি না।’

তানিয়া একবার রেশমির দিকে চেয়ে নিয়ে বলল,

‘আসলে আমার ছেলে অর্ণিতের জন্য আমরা মেয়ে খুঁজছি। সেদিন আপনার বড় মেয়েকে দেখে আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি কি দৃতীর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবছেন?’

মেয়ে বড় হলে বিয়ের প্রস্তাব আসবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে হঠাৎ করে! আমিরাহ আহমেদ বেশ চমকাল। তানিয়া নিজ উৎসাহে অর্ণিত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে দিল।

‘মেয়ে যুবতী হলে বিয়ে দিতেই হবে৷ চাইলেই কি আর ঘরে রেখে দেওয়া যায়! কিন্তু এভাবে হুট করে কী জবাব দেই বলুন তো। দৃতীর বাবা আসুক৷ কথা বলে তারপর জানাই।’

‘রেশমির মোবাইল নাম্বার আপনার কাছে আছে। ওকে জানিয়ে দিলেই হবে। আমি অপেক্ষা করব।’

মুস্তাফা আহমেদ বাড়ি ফেরা মাত্র ঘরে ঢুকে দোর দিল আমিরাহ আহমেদ৷ ফিসফিসিয়ে জানাল সকালে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনার কথা। সব শুনে মুস্তাফা আহমেদ বলল,

‘এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ছেলে সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।’

‘রেশমি আমার মেয়ের জন্য যেমনতেমন ছেলের প্রস্তাব আনবে?’

‘তুমি যেহেতু ঠিক করেই ফেলেছো, তাহলে আমাকে বলছ কেনো?’

‘আমি কি ঠিক করে রেখেছি? শুধু কথার কথা বললাম। ওমনি শুরু হয়ে গেল তোমার ত্যাড়ামি। যা ইচ্ছে করো গে। আমি আর কিছু বলব না।’

‘যার বিয়ের কথা হচ্ছে, আগে তার অনুমতি দরকার। মেয়ের সাথে কথা বলে দেখো।’

মুস্তাফা আহমেদের কথায় যুক্তি আছে। দৃতীর থেকে অনুমতি নেওয়াটা জরুরি। তাই খাবার টেবিলে কথাটা তুলল আমিরাহ আহমেদ।

‘সেদিন তোর রেশমি আন্টি বাড়িতে আসল, মনে আছে?’

‘হ্যাঁ আছে। কেন কি হয়েছে?’

‘ও তোর জন্য একটা বিয়ের সমন্ধ এনেছে।’

দৃতী খাবার মুখে দেওয়া বাদ দিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রইল। পাশ থেকে দোয়েল বলল,

‘এই পাশের বাড়ির আন্টিগুলো শুধু আন্টি হয়ে থাকতে পারে না কেনো? একটুখানি পরিচয় হতেই মায়ের দায়িত্ব পালন করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। এসেছেন, বসেছেন, খেয়েছেন, এবার বিদায় হোন। মাঝখান থেকে বিয়েশাদির আলাপ কেনো!’

‘তুই চুপ কর। বেয়াদব একটা। সারাজীবন তোদেরকে ঘরের পিলার করে রাখব নাকি? বিয়েশাদি দিতে হবে না? বয়স কি কম হয়েছে?’

মায়ের কথা শুনে দৃতী মুখ গোমরা করে বলল,

‘আমার কি খুব বয়স হয়ে গিয়েছে, মা?’

‘বিয়ের বয়স অন্তত হয়েছে। অনার্স শেষ হতে চলল। ছোট খুকিটি তুমি আর নেই।’

‘তাই বলে এভাবে বয়সের খোঁটা দিবে? বাবা, আমাকে কি বুড়ো মানুষের মতো দেখায়?’

‘তোর মায়ের চোখে সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার দেখাতে হবে। আমার কিশোরী মেয়েকে সে বুড়ি দেখতে পাচ্ছে।’

মুস্তাফা আহমেদের কথা শুনে আমিরাহ আহমেদ আবারও ভাতের গামলা তুলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

‘আমার দায়িত্ব ছিল বলার, বলে দিলাম। এখন বাবা-মেয়ে মিলে ঠিক করো কি করবে?’

দোয়েলের এখনও খাওয়া শেষ হয়নি। আজকে রাতে হাঁসের মাংস রান্না হয়েছে। তার খুব পছন্দের তরকারি। আরেকটু ভাত নেওয়া যেত। কিন্তু মায়ের রাগ দেখে কিছু বলার সাহস পেল না৷ দৃতীকে ফিসফিস করে বলল,

‘যাহ! মা এভাবে রাগ করে ভাতের বোলটা নিয়ে চলে গেল!’

দৃতী নিজের প্লেট থেকে খানিকটা ভাত তুলে দিল দোয়েলের প্লেটে। আমিরাহ আহমেদ রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে স্বামীকে বলল,

‘তুমি মেয়ের বিয়ে দিতে চাও কিনা বলো?’

‘অবশ্যই চাই। কিন্তু এভাবে বললেই তো বিয়ে দেওয়া যায় না। খরচের একটা ব্যাপার আছে। যা বেতন পাই তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চলছে। বিয়ের খরচ, মেয়ের গয়না, যৌতুক- এতোসব কি করে সামলাবে? কিছু ভেবেছো? মেয়ের বিয়ে দিবো বললেই বিয়ে দেওয়া যায় না।’

বাবার কথা শুনে তিন মেয়ের মুখে আঁধার নামল। মেয়ে হয়ে জন্মানো কাল হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের ভরসা হওয়া তো দূরের কথা উল্টো চিন্তার কারণ হতে হচ্ছে। এঁটো প্লেট হাতে উঠে দাঁড়াল দৃতী।

‘যৌতুক দিয়ে আমি বিয়ে করব না, বাবা।’

আমিরাহ আহমেদ সে কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘তোর কোনো পছন্দ আছে?’

‘এটা কেমন কথা মা? তুমি জানো, তোমার মেয়ে কেমন? আজ পর্যন্ত বাইরের কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখছো আমাকে? তবুও এমন কথা কীভাবে বলছ!’

‘জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল বলেই জিজ্ঞেস করেছি। বিয়ের আগে এসব ব্যাপার ক্লিয়ার হয়ে নেওয়া ভালো।’

মায়ের কথা শুনে দানিয়া মুখ বাঁকাল। পৃথিবীতে সব মায়েরা বুঝি একইরকম। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে অন্যায় করেছ কিনা জানতে চাইবে৷ কিন্তু তুমি ভুল করেও স্বীকার করে ফেললে দেখতে পাবে মায়ের আসল রূপ। হাঁড়ির খবর পাওয়া মাত্র মমতাময়ী মা হয়ে যাবে রণচণ্ডী।

খানিকটা অবহেলা করে দানিয়া বলল,

‘যেনো, আপু হ্যাঁ বললেই তুমি নাচতে নাচতে সেই ছেলের সাথে আপুর বিয়ে দিয়ে দিতে।’

‘কেনো? তোর কাউকে পছন্দ আছে নাকি?’

‘থাকতেই পারে।’

‘থাকলে কালকে বাড়িতে নিয়ে আয়। দৃতীর আগে তোর বিয়ে দিয়ে ঝামেলা বিদায় করি।’

‘সত্যি! আগে বললে না কেনো, মা? একটা ভালো ছেলে দেখে প্রেম করে ফেলতাম! ইশ! কী ভুলটাই না হয়ে গেল!’

‘জুতা চিনিস? জুতা পিটা করে তোর প্রেম আমি বের করতেছি দাঁড়া।’

মুস্তাফা আহমেদ খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নিল। ঘরের দিকে যাওয়ার আগে দৃতীকে বলল,

‘এক কাপ চা নিয়ে আমার ঘরে আয়।’

বাবার হাতে চায়ের কাপ দিয়ে পাশে বসল দৃতী। মুস্তাফা আহমেদ নিজেও বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে গম্ভীরমুখে জানতে চাইল,

‘কি ভাবছিস বল?’

‘কোন ব্যাপারে, বাবা?’

‘বিয়ের প্রস্তাবটা নিয়ে। তোর মায়ের মুখে যা শুনলাম, ছেলে ভালো আছে। কাস্টমস অফিসার, ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। ছোটোখাটো পরিবার। আমার কাছে ভালোই মনে হয়েছে। তুই কি বলিস?’

‘এখনি বিয়ের কি দরকার বাবা? আমার ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিয়েছে। সপ্তাহখানেক বাদেই পরীক্ষা। অনার্স শেষ করে চাকরিবাকরি কিছু করি। তারপর না হয় বিয়ে করা যাবে।’

‘বিয়ে দিবো বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। বিয়ের আলোচনা করতে মাসখানেক পেরিয়ে যাবে। ততোদিনে তোর পরিক্ষাও শেষ হয়ে যাবে। চাকরিবাকরি করতে চাইলে বিয়ের পরেও করতে পারবি। এটা কোনো সমস্যা না।’

‘বিয়ের পরে চাকরি করলে তোমাদের কিছু দিতে পারব? শ্বশুরবাড়ির লোকজন দিতে দিবে? আমাকে লেখাপড়া করিয়ে তোমাদের কি লাভ হলো?’

‘লাভ ক্ষতি হিসেব করে বাবা-মা সন্তান লালনপালন করে না। তুই আয় করে আমাদের খাওয়াবি সেই চিন্তা করে তোকে লেখাপড়া করাইনি। এটা আমাদের দায়িত্ব ছিল, পালন করেছি। এখন মেয়ে বড় হয়েছে। তার বিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব, সেটা আমাদের পালন করতে দে।’

দৃতী কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে ভাবল। বাবার স্বল্প বেতনে ছয় সদস্যের টানাটানির সংসার। একজন সদস্য কমে গেলে বাবার বোঝা কিছুটা হালকা হবে। তাছাড়া বান্ধবীদের মধ্যে প্রায় সকলে বিবাহিত। বেশিরভাগই বিয়ে করে বাচ্চার মা হয়ে গেছে। দৃতীসহ আর একজন শুধু বাকি আছে। মাঝেমধ্যে দৃতীর মনেও সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন উঁকি দেয়। সৃষ্টিকর্তা যদি সেই স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছেন, তবে করুক। দৃতী বাঁধা দিবে না।

‘ঠিক আছে। তোমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখো। তবে বাবা আমার একটা শর্ত আছে।’

‘কি শর্ত?’

‘যৌতুক দিয়ে আমি বিয়ে করব না?’

‘সেকি! এ যুগে যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?’

‘কারো না হলেও আমার হবে।’

‘তুই ভাবছিস তোর বাবার যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য নাই?’

‘এতোগুলা টাকা কোথা থেকে দিবে তুমি?’

‘গ্রামের বাড়িতে তোর দাদুর অংশ থেকে যেটুকু ভাগ পেয়েছি, সেখান থেকে কিছুটা বিক্রি করে দিব। ওসব নিয়ে তুই ভাবিস না।’

‘না বাবা। এমন কিছু তুমি করবে না। ওই জমিটুকু দৌলতের ভবিষ্যৎ। ওটা তুমি নষ্ট করো না। আমার বাবার কষ্টে উপার্জিত টাকা জোরজবরদস্তি করে যেই ছেলে নিয়ে যাবে, তার সাথে আমি কীভাবে সুখে থাকব বলতে পারো? বিয়ের পরে আমার বারবার মনে হবে, এটা সংসারে আমার বাবার হাহাকার জড়িয়ে আছে। তোমার দেওয়া সোফায় বসলে মনে হবে, এটা আমার বাবার রক্ত জল করা আয়ে কেনা৷ তোমার দেওয়া টিভিতে সিনেমা দেখে আমি কীভাবে হাসব বলো তো? তোমার দেওয়া আলমারিতে কীভাবে দামী শাড়ি, গয়না তুলে রাখব? আমার বারবার মনে পরবে, এই আলমারিটা কিনতে আমার বাবার শার্ট ঘামে ভিজে গিয়েছিল।’

‘তুই অযথা ভাবছিস। মেয়ের বিয়ের সময় এগুলো সবাই দেয়। আমার কোনো কষ্ট হবে না।’

‘তোমার না হোক। আমার হবে। যৌতুক ছাড়া ওরা যদি ছেলের বিয়ে দেয়, তবেই আমি রাজি। না হলে আইবুড়ো হয়ে তোমার ঘাড়েই চেপে থাকব।’

পারিবারিকভাবে বিয়ের আলোচনায় বিয়ে সম্পন্ন হতে অনেকদিন লেগে যায় বললেও দৃতীর বিয়েতে অনেকদিন লাগল না। অনার্স পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের কনকনে ঠান্ডায় অর্ণিতের সাথে দৃতীর বিয়ে হয়ে গেল।

চলবে..