প্রিয় নীড়হারা পর্ব-০৩

0
63

#প্রিয়_নীড়হারা
লেখনীতে: #অক্ষরময়ী
পর্ব: ০৩

কাস্টমস অফিসার্স কোয়াটারের তিনতলার বারান্দায় বসে আছে দৃতী। আজ এক সপ্তাহ হলো সে কুমিল্লা ছেড়ে ঢাকায় এসেছে। নতুন মানুষ, নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশ। দৃতীর ঠিক কেমন লাগছে সে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। কুমিল্লা থেকে যেদিন রওনা দিয়েছিল সেদিন এ বাড়িতে পৌঁছাতে রাত গড়িয়ে গিয়েছিল। কোনোরকম দুমুঠো খেয়ে ঘুম।
এই যে বারান্দার সাথে অর্ণিতের ঘরটা, এটাকেও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার শক্তি ছিল না দৃতীর।

পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছিল অর্ণিতের সাজানো গোছানো ছোট্ট ঘরটি। খাট, আলমারি, সোফা, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, বুকশেলফ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ঘরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। ঘরের সাথে এ্যাটাচড বাথরুম, অন্যপাশে একটি বারান্দা। আজ প্রথম দৃতীর এই বারান্দায় এসে বসল। গত কয়েকটাদিন বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে করতে দৃতীর নাভিশ্বাস দশা। নতুন দম্পতিকে দাওয়াত দিয়ে একবেলা খাওয়ানোর যেনো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

অবশ্য এই দৌড়ভাগের মধ্যে দৃতীর খানিক উপকার হয়েছে বৈকি। ব্যস্ততার মাঝে অর্ণিতকে আরও কাছ থেকে চেনা হয়েছে দৃতীর। ফলে তাদের সম্পর্কটা আরও গভীর হয়েছে। পারিবারিক ভাবে আয়োজিত এই বিয়ে নিয়ে দৃতীর খানিকটা ভয় ছিল। না জানি অপরিচিত জীবনসঙ্গীটি কেমন হয়। বদমেজাজী, রগচটা কিংবা খুঁতখুঁতে স্বভাবের একজন মানুষকে কল্পনা করে ভেতরে ভেতরে কতোবার আতঙ্কিত হয়েছিল দৃতী! আজকাল সেই ভয়টা আর নেই। বরং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে একটি সুন্দর মনের মানুষ। যে ভীড়ের মাঝে দৃতীর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। গাড়িতে উঠার সময় গুছিয়ে দেয় দৃতীর শাড়ির আঁচল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দৃতী মনে করে চাদরটা নিয়েছে কিনা তা আড়াল থেকে লক্ষ্য করে। কখনো সখনো দৃতী চাদর নিতে ভুলে গেলে সে ঠিকই চাদর গুছিয়ে নেয়। ঠান্ডা বাতাসে দৃতী কেঁপে উঠলে পরম মমতায় জড়িয়ে দেয় সেই উষ্ণ চাদর। উষ্ণতার কল্পনামাত্র সুখের ছায়া দেখা দিল দৃতীর সারা অঙ্গে। গুনগুন করতে করতে সে বারান্দা ছেড়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

ভাতঘুম থেকে এখনো জাগেনি তানিয়া। দরজা থেকে উঁকি দিয়ে তানিয়ার ঘুমন্ত মুখটি দেখে দৃতী আর ঘরের ভেতর প্রবেশ করল না। চলে গেল রান্নাঘরে।

মাগরিবের আযানের শব্দে ধড়ফড় করে জেগে উঠল তানিয়া। সিরাজ সাহেবের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে অথচ সে এখনো চা নাস্তার ব্যবস্থা করেনি। স্বামীর হুংকারের আতংকে তানিয়ার ঘুম উড়ে গেল। ঝটপট বিছানা ছেড়ে ছুটল রান্নাঘরে। সেখানে ব্যস্ত দৃতীকে দেখে তানিয়া বলল,

“তুমি এতো তাড়াতাড়ি উঠেছো কেনো? নাস্তা বানানোর জন্য আমি আসছিলাম-ই।”

বাঁধাকপির পাকোড়াগুলো তেলে ছেড়ে দিতে দিতে দৃতী তানিয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

“ঘুম আসছিল না,মা । তাই উঠে পড়লাম।”

“ভাতঘুমের অভ্যেস নেই বুঝি?”

“আছে। কিন্তু এই কয়েকদিনে বোধহয় অভ্যাসটা বিগড়ে গিয়ে সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।”

“বিয়ের প্রথম কয়েকদিন এমন হবে। নতুন ঘর-সংসারে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগে। সংসারে থিতু হয়ে গেলে দেখবে সবকিছু আবার আগেরমতো হয়ে গিয়েছে।”

উত্তরে দৃতী কিছু বলল না। ধীরে ধীরে সে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। এই কয়েকদিনে এ বাড়ির বেশ কিছু নিয়মকানুন দৃতীর আয়ত্বে চলে এসেছে। সন্ধ্যায় চায়ের আড্ডায় ভাজাপোড়া চাই শ্বশুরমশাইয়ের। অর্ণিত শুধুমাত্র এক কাপ চা খেয়ে সারাদিনের ক্লান্তি মিটায়। সন্ধ্যায় চা খাওয়ার অভ্যাস দৃতীর ছিল না। এখন মনে হচ্ছে দ্রুত এই অভ্যাসটা গড়ে উঠবে দৃতীর।

কোমরে আঁচল গুঁজে তানিয়া বলল,

“সরো দেখি। বাকিটা আমি বানিয়ে নিচ্ছি। তুমি গিয়ে বসো।”

“পাকোড়া বানানো শেষ। এখন শুধু চা বানানো বাকি। আমি বানিয়ে নিচ্ছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, মা।”

সারাদিনের ক্লান্তি দূরীকরণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আড়চোখে দৃতীর দিকে তাকালো অর্ণিত। নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চোখের ইশারায় দৃতী জানতে চাইল, কি হয়েছে?

পাশে বসে থাকা দৃতীর দিকে খানিক ঝুঁকে অর্ণিত ফিসফিসিয়ে বলল,

“চায়ের স্বাদ অচেনা লাগছে। তুমি বানিয়েছো?”

বসার ঘরের সোফায় বসে আছে সকলে। বামপাশের সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে সিরাজ সাহেব। একটা পাকোড়া মুখে দিয়ে তানিয়া এখন স্বামীর জন্য পানির গ্লাসে পানি ঢালছে। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃতী মৃদুস্বরে জানতে চাইল,

“আমিই বানিয়েছি। ভালো হয়নি?”

“ভালো হয়নি কখন বললাম!”

“তাহলে জানতে চাইছ কেন?”

“আজকে চায়ের স্বাদ অন্যরকম লাগছে বলে কনফার্ম হয়ে নিলাম।”

“কী রকম লাগছে? বিদঘুটে?”

“বউ-বউ স্বাদ পাচ্ছি।”

দৃতী ঠোঁট চেপে হেসে অন্য দিকে মনোযোগ দিল। পাকোড়া খাওয়া শেষ হলে পানির গ্লাস হাতে নিল সিরাজ সাহেব। তা দেখে তৎক্ষণাৎ রান্নাঘরের দিকে ছুটল তানিয়া। গরম গরম এক কাপ চা হাতে তুলে দিতে হবে সিরাজ সাহেবের। শাশুড়ির এমন অস্থির জীবনব্যবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল দৃতী। নিজেও সোফা থেকে উঠে শাশুড়ির পেছন পেছন রান্নাঘরে উপস্থিত হলো।

______________

শীতের কুয়াশার চাদরে চারদিকে ঢেকে গেছে। রাত গভীর না হলে জাদুর নগরী ঢাকায় শীতের তীব্রতা বুঝা যায় না। রান্নাঘরের যাবতীয় কার্য সম্পন্ন করে মাত্রই ঘরে এলো দৃতী। বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছিল অর্ণিত। দৃতীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে একবার চোখ তুলে চেয়ে বলল,

“কাজ শেষ তোমার?”

“হুম।”

চাপাস্বরে জবাব দিল দৃতী। অর্ণিত আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে। অন্যদিকে দৃতী রাতের রুপচর্যার পাশাপাশি আয়নায় সৃষ্ট প্রতিবিম্বের সাহায্যে অর্ণিতের মনোযোগী চেহারাখানা দেখছে। ঘন কালো ভ্রু জোড়ায় নিচে বাদামী চোখ জোড়া, তীক্ষ্ণ নাক, পুরু ঠোঁট, শক্ত চোয়াল দেখতে দেখতে দৃতীর নারীসুলভ মনটা আরও লোভী হয়ে উঠে। বিয়ের একসপ্তাহ তো হলো। আর কতো অপেক্ষা!

লম্বা চুলে বেণী গাঁথতে গাঁথতে দৃতী নিজেই কথা শুরু করে।

“অফিসে দিন কেমন কাটল তোমার?”

ব্যস্ত অর্ণিত ল্যাপটপের স্ক্রীনে চোখজোড়া স্থির রেখে জবাব দিল,

“হুম, ভালো। বেশ ভালো।”

তারপর আবার নীরবতা। দৃতীর খানিক মন খারাপ হলো। সে যে মানুষটার সাথে কথা বলতে চাইছে, মানুষটা কি তা বুঝতে পারলো না? এতো বোকা কেনো মানুষটা? কথা খুঁজে না পেলে অন্তত প্রশ্নের বিপরীতে আরেকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারত। দৃতী তার দিন কেমন কেটেছে জানতে চেয়েছে, সেও কি একবার দৃতীর কথা জানতে চাইতে পারত না?

দৃতী মুখ ভার করে নিজের কাজ শেষ করে বিছানায় চলে গেলো। মোটা কম্বল গায়ে মুড়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।

দৃতীর মুখে মেঘের কালো ছায়া দেখে আড়ালে হাসল অর্ণিত। হাতের কাজটা তৎক্ষণাৎ বাকির খাতায় তুলে রেখে ল্যাপটপ বন্ধ করল। ওটাকে বেড টেবিলে রেখে দৃতীর দিকে ঝুঁকে বলল,

“ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?”

উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকা দৃতী বন্ধ জোড়া খুলে না। ওভাবেই জবাব দেয়,

“নাহ। কী হয়েছে?”

“অফিসের কথা জানতে চাইলে, অথচ পুরো কথা না শুনেই ঘুমাতে চলে গেলে। খুব টায়ার্ড?”

দৃতী পুরো কথা না শুনে শুয়ে পড়েছে নাকি অর্ণিত নিজেই পুরো কথা না বলে হেয়ালি করেছে? অর্ণিতের এমন মিথ্যে অভিযোগে দৃতীর ভীষণ রাগ হলো। ঝট করে চোখ খুলে পাশ ফিরে তাকাতেই অর্ণিতকে আবিষ্কার করলো নিজের মুখের উপর ঝুঁকে থাকা অবস্থায়। হকচকিয়ে গেলেও দৃতী নিজেকে সামলে নিয়ে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বলল,

“আমি তোমাকে এড়িয়ে গেছি নাকি তুমি আমাকে সময় না দিয়ে এই অসময়েও অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছো?”

অর্ণিত ঠোঁট চেপে হেসে হেডবোর্ডে হেলান দিল। বুকের উপর দু হাত ভাঁজ করে মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিয়ে বলল,

“কী আর করব বলো! বিয়ের ছুটির কারণে কতোগুলো কাজ জমে আছে! তার উপর আজকে এতোদিন পর অফিসে কাজই বা করতে পারলাম কই!”

“কেনো? কে আটকেছে তোমাকে? বসে পড়তে রাজ্যের কাজ নিয়ে। ঘাড়ে বয়ে বাড়ি পর্যন্ত তো নিয়ে এসেছো-ই।”

দৃতীর কপালে বিরক্তির ভাঁজ তখনো শিথিল হয়নি। অর্ণিত হাত বাড়িয়ে দৃতীর সূচালো নাকের অগ্রভাগ বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তর্জনি দ্বারা চেপে ধরে একটু টান দিল। অবাক দৃতী হতভম্ব হয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতেও ভুলে গেছে। শুধু চোখ বড় করে অর্ণিতের দুষ্টামি দেখল। নাক টেনে দিয়ে অর্ণিত বলল,

“তুমি আটকেছো।”

দৃতী অবাক হয়ে শুধালো,

“আমি? আমি কীভাবে তোমার কাজে বাঁধা দিয়েছি?”

“তোমাকে বিয়ে করে নতুন বর হয়েছি। দলে দলে অফিসের কলিগরা এসে মজা নিয়ে যাচ্ছে। কতো দুষ্টু দুষ্টু কথা, হাসি তামাশা! এসবের মাঝে কী কাজ হয়!”

রাগ হতে গিয়েও হেসে ফেলল দৃতী। লাজে রাঙ্গা হলো তার মুখ। দৃতীর হাসি মুখ দেখে অর্ণিত চেহারায় ছদ্ম উদাসীনতা ফুটিয়ে বলল,

“অথচ দুষ্টু জোকসে লজ্জা পাওয়ার মতো কোনোকিছুই ঘটল না আমার জীবনে। এই দুঃখ কোথায় রাখি? কাকেই বা বলি!”

চোখ নামিয়ে শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে দৃতী জবাব দিল,

“ঘটিয়ে ফেললেই হয়। বাঁধা দিয়েছে কে?”

অর্ণিত চোখ দুটো বড় বড় করে দৃতীর দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলল,

“ঘটিয়ে ফেলব? ভেবে বলছ তো?”

লজ্জায়, বিরক্তিতে মাখামাখি হয়ে দৃতী ধমকে উঠল অর্ণিতকে।

“ধ্যাত! জানি না আমি। সরো, ঘুমাতে দেও।”

অর্ণিতের ঘুম ছুটিয়ে নিজে ঘুমানোর পায়তারা! অর্ণিত তা হতে দিবে কেনো? চট করে দৃতীর উপর ঝুঁকে ওর মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

“ঘটিয়ে ফেলব? বলো, বলো।”

দৃতী চোখ রাঙিয়ে অর্ণিতের টিশার্টের কলার চেপে অর্ণিতের মুখটা নিজের মুখের কাছাকাছি নিয়ে আসে। নাকে নাক ছুঁয়ে শাসায়,

“আর একবার জিজ্ঞাসা করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”

অর্ণিত আর কিছু জিজ্ঞাসা করে সময় ব্যয় করে না। দৃতীর মোহনীয় রুপে ডুব দিতে দিতে বলে,

“ভালো কিছু ঘটার রাতে খারাপ কিছুর কথা মুখে কেনো, মিসেস? এ রাত শুধু স্বর্গীয় সুখের হবে।”

চলবে…