প্রিয় নীড়হারা পর্ব-০৫

0
55

#প্রিয়_নীড়হারা
পর্ব: ০৫

পুরো বাড়ি জুড়ে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। বসার ঘরে ভয়ে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে আছে দৃতী। কিছুক্ষণ আগে অর্ণিতকে কল দিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলেছে। এখনো আসছে না কেনো কে জানে!

দৃতীর চঞ্চল চোখজোড়া আবারও দরজার দিকে তাকালো। শোয়ার ঘর থেকে সিরাজ সাহেবের কণ্ঠ ভেসে আসছে। রাগে গড়গড় করেই যাচ্ছে৷ দৃতী আরেকবার উঁকি দিয়ে দেখল, তানিয়া কম্পিত হাতে এখনো ড্রেসিংটেবিলের নিচের ড্রয়ারগুলোর কাগজপত্র ঘেটে যাচ্ছে।

সাহায্য করার জন্য দৃতী গিয়েছিল। এরমাঝে সিরাজ সাহেব ধমকে উঠেছিল তানিয়ার উদ্দেশ্যে।

“একটা কাগজ ঘর থেকে উধাও হয়ে যায় কীভাবে? ঘর সংসারে তোমার মন নাই৷ মন থাকে কোথায়?”

দরাজ গলার সেই আওয়াজে কেঁপে উঠেছিল দৃতী। শাশুড়ির মতোন তারও হাত তখনো থরথর করে কাঁপছিল। তা দেখে তানিয়ে বলেছে,

“তুমি রান্নাঘরে যাও, আমি দেখছি৷ তরকারিটা বোধহয় হয়ে এসেছে।”

দৃতী কোনোরকম সেখান থেকে পালিয়ে এসে অর্ণিতকে কল করেছে। রান্নাঘরের চুলাটা আপাতত বন্ধ। এই মুহুর্তে তরকারির দিকে মনোযোগী হওয়া দৃতীর পক্ষে সম্ভব না।

অফিস আওয়ারের আগে রাস্তা ফাঁকা ছিল বলে দ্রুত পৌঁছে গেল অর্ণিত। লিফট তখন উপরের দিকে যাচ্ছিলো। দেরী করল না অর্ণিত। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে এলো।

অর্ণিতকে দেখে দেহে প্রাণ ফিরে পেল দৃতী। দ্রুত অর্ণিতের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“বাবা ভীষণ ক্ষেপেছেন। তখন থেকে মাকে ধমকে যাচ্ছেন। তুমি কিছু করো।”

সিরাজ সাহেবের এমন স্বভাবের সাথে অর্ণিত পরিচিত। দৃতী নতুন মানুষ তাই ভয় পেয়েছে। অর্ণিত ঘাবড়ালো না। দৃতীকে শান্ত থাকতে বলে ঘর্মাক্ত শরীরে ছুটল বাবা-মায়ের রুমে।

ছেলেকে দেখে কিছুটা সাহস পেল তানিয়া৷ শুষ্ক মুখে অর্ণিতের দিকে হতাশা মিশ্রিত চোখে চাইল।

সেদিকে একপলক তাকিয়ে অর্ণিত বলল,

“কী হয়েছে?”

গর্জে উঠল সিরাজ সাহেব৷ বলল,

“এই নির্বোধ মহিলাকে জরুরি কাগজপত্র রাখতে দিয়েছিলাম, সে এখন খুঁজে পাচ্ছে না৷ অথচ রাখতে দেওয়ার সময় আমি হাজারবার বলেছিলাম, ভালোভাবে রাখবে খুবই দরকারী কাগজ।”

তানিয়া ভয়ার্ত কণ্ঠে স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে বলল,

“ভালোভাবেই তো রেখেছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে এই নিচের ড্রয়ারেই কাগজগুলো রেখেছিলাম।”

সিরাজ সাহেব প্রায় মারমুখী হয়ে জানতে চাইলেন,

“তা হলে গেলো কোথায়? কাগজের ডানা গজিয়েছে? উড়ে গেছে?”

কাগজগুলো এভাবে হারিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তানিয়া৷ তাই মাথা নিচু করে ঠান্ডা মেঝেতে বসে রইল। স্ত্রীর এমন দায়িত্বহীনতায় সিরাজ সাহেব ভর্ৎসনা করে বলল,

“ঘর সংসারে মন নাই এই মহিলার৷ কাজের কাজ কিছু করতে পারে না, শুধু খাওয়াদাওয়া আর ঘুম৷ বসে বসে খাচ্ছে তো, কষ্ট কীভাবে বুঝবে। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। সংসার করতে ভালো না লাগলে বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন স্ত্রী লোক দিয়ে সংসার চলে না।”

সিরাজ সাহেব স্বভাবে বদরাগী। তার স্বল্প ধৈর্য, খিটখিটে মেজাজ দেখে বড় হয়েছে অর্ণিত৷ কিন্তু আজও অভ্যস্ত হতে পারল না। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমঝোতা করার চেষ্টা করল।

“কীসের কাগজ ছিল?”

সিরাজ সাহেব কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলল,

“ইনকোর্স এক্সামের কুয়েশ্চন পেপার।”

“ডক ফাইল নেই তোমার কাছে?”

“নাহ।”

“কার কাছে আছে?”

“অফিসের পিসিতে।”

“ওখান থেকে আবার প্রিন্ট আউট করে নিলেই তো হয়৷ এতো হল্লা করার কি আছে!”

“কেনো আবার প্রিন্ট করব? এক কাজ দ্বিতীয়বার কেনো করতে হবে? ওকে আমি কাগজগুলো রাখতে দিছি, ও সেটা যত্ন করে তুলে রাখল না কেনো?”

এমন জেদী, একগুঁয়ে লোকের সাথে অর্ণিত কখনো তর্কে যেতে চায় না৷ এজন্য বাবার সাথে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে চলে। বাবাদের জেনারেশনের কী এক আজব সমস্যা! নিজে যা বুঝে তাই সঠিক। অন্য কারো যুক্তিতর্ক কিছুতেই বুঝতে চায় না।

হারিয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রের জন্য ঝামেলা না করে আরেকবার ছাপিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অথচ সেই সহজ পন্থাটি অবলম্বন না করে সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি করা সিরাজ সাহেব এর নিকট উপযুক্ত মনে হচ্ছে।

কোনো মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। তানিয়াও একজন সহজ সরল মানুষ। না হয় ভুলবশত কাগজগুলো হারিয়ে ফেলেছে, তা নিয়ে তাকে আরও মানসিক চাপ না দিয়ে আপোষ করে ফেলা কি ভালো নয়?

তানিয়া কিছু বলছে না৷ নীরবে ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে৷ অথচ অর্ণিত মুখভরা বিরক্তি নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে আছে। ভুলেও মায়ের দিকে তাকাচ্ছে না। মায়ের সাথে তার নীরব যুদ্ধ সম্পর্কে সিরাজ সাহেব অভিজ্ঞ নয়৷ যদি জানত, তা নিয়েও বোধহয় তানিয়াকে ছোট করতে, অপমান করতে পিছপা হত না৷

সিরাজকে জানিয়ে বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়নি তানিয়া ও অর্ণিত। তাই মান অভিমানের অধ্যায়টি নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে।

অর্ণিত যতোই অভিমান করে থাকুক, বরাবরের মতো মায়ের বিপদে ঠিকই ঢাল হয়ে দাঁড়ালো।

বেশ শক্তভাবেই বাবাকে বলল,

“সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা বাড়িয়ো না। যা হারিয়ে গেছে তার পেছনে সময় ব্যয় করে লাভ নেই। আবার প্রিন্ট করে নেও।”

ছেলে সাবালক হয়ে গেলে বাবাও তাকে খানিকটা সমঝে চলে। তারপর যখন চাকরিবাকরি করে ছেলে আয় রোজগার করতে শুরু করে তখন বাবার বাবা হয়ে উঠে তার ছেলে। সিরাজ সাহেবও তার ব্যতিক্রম নয়। অর্ণিতের শান্ত কণ্ঠে বিরক্তি আভাস পেয়ে সিরাজ চুপ হয়ে গেল।

ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের দিকে একবার আড়চোখে তাকালো অর্ণিত। বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টি মেলে অর্ণিতকেই দেখছে তানিয়া৷

বরাবরের মতো মাকে এড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দৃতী৷ ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিল ঘরের ভেতরকার দৃশ্য।

অর্ণিতকে বের হতে দেখে সেও দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। নিজের ঘরে পৌঁছাতেই হাঁফ ছেড়ে দৃতী বলল,

“বাবার এতো রাগ! পুরো বাড়ি কাঁপছিল যেনো।”

বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসল অর্ণিত৷ হাত ধরে দৃতীকেও নিজের পাশে বসিয়ে জানতে চাইল,

“ভয় পেয়েছিলে তুমি?”

দৃতী অতিউৎসাহী হয়ে বলল,

“তা খানিকটা পেয়েছিলাম৷ হঠাৎ পাশের ঘর থেকে বাবার ধমক শুনে চমকে উঠেছিলাম৷ এমনিতেই বাবাকে আমার ভীষণ ভয় করে। সারাক্ষণ কেমন মুখ গোমড়া করে থাকে! দেখলে মনে হয়, এই বুঝি দিলো একটা ধমক।”

“স্টুডেন্টদের পড়াতে পড়াতে এমন কাটখোট্টা হয়ে গিয়েছে। কলেজে সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে থাকার অভ্যাসটা বাড়িতেও বহাল হয়ে গিয়েছে৷ তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে একই পেশায় থাকতে থাকতে খানিকটা খিটমিটেও হয়ে গিয়েছে৷ অবসর নিলে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”

দৃতী নিজ শিক্ষকদের কথা চিন্তা করল। পড়াশোনা চলাকালীন যত শিক্ষকের সাথে ওর পরিচয় হয়েছে, কাউকে ঠিকভাবে হাসতে দেখেনি ও। চেহারায় গাম্ভীর্যতার পর্দা ঝুলিয়ে চলত সবসময়। ওর কলেজের ইংরেজি বিভাগের এর বিভাগীয় প্রধানকে পুরো কলেজ ভয় পেতো। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, পিয়নসহ সর্বস্তরের কর্মচারীরাও উনাকে দেখলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে পড়ত। সেই তুলনায় শ্বশুরমশাই যথেষ্ট ভালো আছে, ভেবে খানিকটা স্বস্তি পেলো দৃতী।

পরক্ষণে কিছু মনে পড়ায় মুখে চিন্তার ছাপ দেখা গেলো৷ সরু চোখে অর্ণিতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

“তুমিও কি বাবার মতো রাগী?”

অর্ণিত আলতো হেসে বলল,

“আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়?”

“রাগী মনে হয় না। রাগী হলে এতোদিনে দু একটা ধমক দিয়েই দিতে।”

“আমার এতো সহজে রাগ আসে না। আমি বোধহয় মায়ের স্বভাব পেয়েছি। শান্ত, ধীর। সবকিছুতেই মানিয়ে নিতে পারি। জীবন যা দিচ্ছে তাই নিয়ে জীবনযাপন করার চেষ্টা করি। সন্তুষ্ট থাকি৷ দিনশেষে আনন্দে থাকা, প্রশান্তিতে থাকাটাই মূল লক্ষ্য।”

“আপনি এভাবে ভাবেন অথচ আপনার বাবা তার উল্টো ধরনের মানুষ। আপনি বাবাকে বুঝান না কেনো? মায়ের জন্য আপনার কষ্ট হয় না? মা সারাক্ষণ বাবার ভয়ে কেমন তটস্থ হয়ে থাকে।”

“প্রত্যেক মানুষ আলাদা, তাদের স্বভাব আলাদা। আমরা চাইলেও আরেকজনের স্বভাব বদলাতে পারব না। তাছাড়া নিজেকে বদলানোর মতো বয়সও আর বাবার নেই৷ শুধরানোর বয়স পেরিয়ে এসেছে। আর মা-ও নিজের জীবনে অভ্যস্ত। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এভাবেই সংসার করে আসছে। এসব ঝগড়া ঝামেলা তাদের জীবনের একটা অংশ৷ আমরা অন্যের দাম্পত্য জীবনে না ঢুকি৷ তারা যেভাবে ভালো থাকতে চায়, তাদেরকে থাকতে দেই৷ ঠিক আছে?”

অর্ণিতের কথায় সায় জানিয়ে দৃতী মাথা দুলালোও, তানিয়াকে নিয়ে দৃতীর দুশ্চিন্তা শেষ হলো না। চোখের সামজে একটা মানুষ এতোটা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে দেখে দৃতী কীভাবে চুপ থাকবে?

সপ্তাহখানেক ধরে দৃতী শুধু ভাবল। তারপর একদিন বিকালবেলা তানিয়ার ঘরে ঢুকে নিজের মতো করে খানিক গোছগাছ করল।

সন্ধ্যায় চায়ের আসরে সবাই বসলে দৃতী অনেকখানি সাহস সঞ্চার করে সিরাজের দিকে একটি চাবি এগিয়ে দিল। সেটি হাতে নিয়ে সিরাজ
সাহেব জানতে চাইল,

“এটার কীসের চাবি?”

দৃতী লম্বা শ্বাস টেনে অর্ণিতের আরেকটু গা ঘেঁষে বসে জবাব দিল।

“আপনাদের ঘরের ড্রেসিংটেবিলের নিচের ড্রয়ারের চাবী। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে ড্রয়ারটি আমি ফাঁকা করে দিয়েছি। আপনি আপনার জরুরি কাগজপত্র ওখানে রেখে তালা দিয়ে দিবেন। চাবী রাখবেন নিজের কাছে। তাহলে প্রয়োজনের সময় খোঁজাখুঁজি করতে হবে না।

তাছাড়া মায়ের বয়স হচ্ছে, স্মৃতিশক্তি দিনদিন কমে যাচ্ছে। কোথায়, কখন, কোন জিনিস রাখছে, তা মনে রাখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমনিতেই সংসারের হাজারটা জিনিসের খোঁজ রাখতে হয় উনাকে৷ কোথায় মশলা রাখা, কোনটা মরিচের পট, বস্তায় কতোটুকু চাল আছে, কোন কোন সবজি ফুরালো, পাউরুটির প্যাকেটের মেয়াদ আর কতোদিন বাকি, কোন জামাটা ধোয়া কোনটা ধুয়ে দিতে হবে, আজ কি রাঁধবো, কাল কোনটা রাঁধতে হবে- এতোকিছু মস্তিষ্কে ভরে আমাদের চলতে হয়৷ এর মাঝে দু একটা ঘটনা ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই বলছিলাম, আপনার জরুরি জিনিসপত্রগুলো আপনি নিজে হাতে একটু গুছিয়ে রাখলেন৷ তাহলে হারানোর সম্ভাবনাও রইলো না, মায়ের উপর থেকে চাপও একটু কমলো।”

এমন অভূতপূর্ব ঘটনায় তানিয়া ও অর্ণিত দুজনেই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। সিরাজ সাহেব নিজেও নির্বাক। সিরাজ সাহেবকে হাতের তালুতে পড়ে থাকা চাবিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে দৃতীর গলা শুকিয়ে এলো। রাগ করলো নাকি? জোরসে একটা ধমক দিলে দৃতী এখানেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করবে।

শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে দৃতী আবারও বলল,

“এতে আপনাকে এক কাজ দুইবার করতেও হবে না। আইডিয়াটা ভালো না, বাবা?”

সিরাজ সাহেব চাবিটি টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বলল,

“একটা চাবীর রিং-য়ে চাবিটা ভরে আমাকে দিও। এভাবে রাখলে চাবী হারিয়ে যাবে।”

কথাটি শুনে ঘরজুড়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল সবাই। তানিয়ার বুকের ভেতর থেকে যেনো বিশাল বোঝা সরে গেল।

মুখে খানিকটা হাসি দেখা দিতেই শুনল, সিরাজ সাহেব বলছে,

“চা কোথায়? ঠিকসময়ে এক কাপ চা-ও হাতে তুলে দিতে পারো না তুমি!”

চলবে…
#অক্ষরময়ী