প্রিয় নীড়হারা পর্ব -১০

0
61

#প্রিয়_নীড়হারা

১০

এ বাড়ির মানুষেরা শুক্রবার যাবতীয় কাজকর্মের দুয়ারে তালা ঝুলিয়ে অনেকবেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটায়। এই অলিখিত নিয়মে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে দৃতী। সকালবেলা ঘুমটা হালকা হয়ে এলেও মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থাকে।

আজও ভোর বেলা দৃতীর ঘুম ভেঙে গেছে। কিন্তু বিছানা ছাড়েনি। আধো ঘুমে, আধো জাগরণে দৃতী অনুভব করলো বেডটেবিলে অর্ণিতের মোবাইলটা কাঁপছে। অর্ণিতকে ডেকে দেওয়ার আগেই অর্ণিত হাত বাড়িয়ে মোবাইলটি টেনে নিয়ে কল রিসিভ করলো।

“এতো সকালে কেনো কল করেছো? বারণ করেছিলাম আমি।”

তন্দ্রাচ্ছন্ন দৃতীর কানে আবছা কিছু শব্দ এসে পৌঁছালো। কিন্তু ঘুমের কারণে দৃতী ঠিকঠাক বুঝতে পারল না৷ এরমধ্যে বিছানা ছেড়ে উঠল অর্ণিত৷ দরজা খুলে চলে গেল বাইরে৷ দৃতী খুব করে চেষ্টা করল ঘুম থেকে জাগার। কিন্তু কেনো যেনো ঘুমটা আরও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল।

দৃতীর যখন ঘুম ভাঙ্গল তখনও পুবের আকাশের সূর্যটার গায়ে ঠিকঠাক রঙ চড়েনি৷ বিছানার ওপরপাশটা এখনো ফাঁকা। অর্ণিতের এখনো কথা বলা শেষ হয়নি!

মাথা উচু করে দেয়ালঘড়ি দেখল দৃতী। বুঝল খুব বেশিক্ষণ ঘুমায়নি সে৷ বড়জোর দশ মিনিট হবে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে অর্ণিতকে খুঁজতে বের হলো।

____

শুক্রবারের দিন নামাজ পড়া শেষে কুরআন তেলাওয়াত করে আরেকটু ঘুমিয়ে নেয় তানিয়া। আজকে কেন যেনো ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ভার হয়ে আছে। এক কাপ চা বানিয়ে খেলে ভালো লাগবে।

ঘর ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়ে দেখল বসার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় অর্ণিত দাঁড়িয়ে আছে। এতো সকালে বারান্দায় কি করছে বুঝতে না পেরে সেদিকে এগিয়ে গেল তানিয়া৷

“তুমি কেনো বুঝতে চাইছ না নিদ্রা? আর কীভাবে বুঝালে তুমি বুঝবে! তুমি যা ভাবছ তা সঠিক নয়। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী৷ আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। তিনি সব ঠিক করে দিবেন৷ তুমি, আমি, আমরা নিশ্চয়ই সুখী হবো।”

“হ্যাঁ, আমি বলছি তো তোমাকে। আমার উপর ভরসা আছে না, তোমার?”

অর্ণিতের কথাগুলো শুনে রাগে থরথর করে কাঁপতে শুরু করল তানিয়ার সারাদেহ৷ অবাক বিস্ময়ে ডেকে উঠল,

“অর্ণিত?”

চকিতে পেছন ফিরে তাকিয়ে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল অর্ণিত। দ্রুত কল কেটে দিয়ে মোবাইল রাখল ট্রাউজারের পকেটে।

তানিয়া দ্রুত পায়ে বারান্দায় প্রবেশ করে থাই গ্লাস চাপিয়ে দিয়ে অর্ণিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,

“কার সাথে কথা বলছিলে?”

নিদ্রাকে নিয়ে ঝামেলা হওয়ার পর থেকে তানিয়ার সাথে কথাবার্তা বলে না অর্ণিত। ছেলে এড়িয়ে চলছে বুঝতে পেরে তানিয়াও নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। বহুদিন বন্ধ ছিল দুজনের কথাবার্তা। আজ অনেকদিন পর মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অর্ণিত। তবে রাগ, অভিমানে স্থানে জায়গা করে নিয়েছে ভয়৷
মায়ের প্রশ্নের কী জবাব দিবে সে?

অর্ণিতকে চুপ করে থাকতে দেখে তানিয়া আবারও ধমকে উঠল,

“কথা কানে যাচ্ছে না? কে ছিল ফোনে?”

অর্ণিত জানে, মা তার সমস্ত কথা শুনে ফেলেছে। সমস্তটা না শুনলেও কিছুটা তো নিশ্চয়ই শুনেছে। নিশ্চিত না হয়ে কখনোই অর্ণিতকে এভাবে জেরা করত না তানিয়া৷ অর্ণিত মাথা নিচু করে জবাব দিল,

“নিদ্রা।”

ঠোঁট নিঃসৃত বাক্যটি তানিয়ার কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র ডান হাতটি উঁচু করে ঠাস করে একটা চড় বসালো অর্ণিতের গালে। অর্ণিতের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না৷ সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘৃণা মিশ্রিত কণ্ঠে তানিয়া বলল,

“লজ্জা করে না তোমার? ঘরে বউ রেখে সাত সকালে অন্য একটি মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করে বেড়াচ্ছো! ছি! অর্ণিত। এতোটা অধঃপতন হয়েছে তোমার! বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়৷ কবে থেকে চলছে এসব?”

অর্ণিত দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের কথাগুলো হজম করে চুপ করে রইল। তানিয়া ওর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

“কবে থেকে চলছে? বিয়ের পর থেকে নাকি পুরোটা সময় তুমি আমাদের অন্ধকারে রেখেছো? অবশ্যই, আমাদের মিথ্যে বলেছো তুমি। ওই মেয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছ বলেছিলে৷ তবে এখনো মোবাইলে কথাবার্তা চলছে কী করে!
ইয়া খোদা! কী নির্বোধ আমি! অন্ধের মতো ছেলেকে বিশ্বাস করে একটা ফুলের মতো পবিত্র মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।
তুমি কীভাবে এতোটা নিচে নেমে গেলে অর্ণিত? একবারও আমার কথা ভাবলে না? আমি তোমাকে ভরসা করে নিজ দায়িত্বে দৃতীকে তোমার জন্য চেয়ে এনেছিলাম৷ ওই মেয়েটাকে আমি কী জবাব দিব? কিছু বলছ না কেনো? চুপ করে থাকবে না। কিছু বলো।”

অর্ণিত রক্তচক্ষু মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

“তুমি যা ভাবছ, তেমনি কিছু আমি করিনি মা। তোমাকে অসম্মান করার ইচ্ছে থাকলে আরও আগে করতে পারতাম। তোমার কথা অমান্য করে নিদ্রাকে বিয়ে করা খুব একটা কঠিন কাজ ছিল না।”

অর্ণিতের এমন শীতল কণ্ঠে কেঁপে উঠল তানিয়া। অবাক বিস্ময়ে বলল,

“যেটা তখন করতে পারোনি, সেটা কি এখন করতে চাইছ? শুনেছি ওই মেয়েটারও নাকি বিয়ে হয়েছে৷ তবে সে এখনো কেন তোমার সাথে যোগাযোগ রেখেছে? লোভী মেয়েমানুষ। কি চায় তোমার কাছে?”

“নিদ্রা ভালো নেই, মা।”

“কেনো? খুব তো বলেছিল তোমার আগে বিয়ে করে সুখী হয়ে দেখাবে। পারলো না স্বামীর সংসারে সুখী হতে? আমি আগেই বলেছিলাম, ওই মেয়ে সংসার ধরে রাখার মতো + মেয়ে না।”

“মা প্লিজ। নিদ্রাকে নিয়ে তুমি এভাবে কথা বলবে না৷ আমার কষ্ট হয়।”

ছেলের আহত কণ্ঠ স্বর শুনে গা জ্বলে উঠল তানিয়ার৷ ওই মেয়ের জন্য অর্ণিত এখনো কেনো কষ্ট পাবে? এখনো কেন সামান্যতম অনুভূতি অবশিষ্ট থাকবে? এমন অনাচারে শান্তশিষ্ট তানিয়া গর্জে উঠতে চাইল৷ কিন্তু তার আগেই থাইগ্লাসের ওপাশ থেকে আসা বিকট শব্দে থেমে যেতে হলো। কম্পিত বুকে বিমূর্ত দাঁড়িয়ে রইল তানিয়া৷ অর্ণিত দ্রুত হাতে থাই গ্লাস সরিয়ে দেখল, ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে দৃতী। নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভেঙে যাওয়া ফুলদানিটা।

________

ঘুম ঘুম চোখে বসার ঘরে প্রবেশ করে অর্ণিতকে দেখতে পেল না দৃতী। এতো সকালে মানুষটা গেল কোথায়? রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে চোখ পড়লো বারান্দায়। তানিয়ার শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে৷ শাশুড়িকে এতো সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেখে অবাক হলো দৃতী। শুক্রবারে আরও দেরীতে বিছানা ছাড়ে তানিয়া। আজকে হঠাৎ কি হলো? বিচলিত দৃতী দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ালো বারান্দার সামনে।

দ্রুত গ্লাস লাগিয়ে দিতে গিয়ে পুরোটা লাগাতে পারেনি তানিয়া। কিছুটা ফাঁকা রয়ে গিয়েছে। সেখান দিয়ে তানিয়ার মৃদু কণ্ঠশোনা যাচ্ছে৷

“লজ্জা করে না তোমার? ঘরে বউ রেখে সাত সকালে অন্য একটি মেয়ের সাথে প্রেমালাপ করে বেড়াচ্ছো! ছিঃ! অর্ণিত।”

থাই গ্লাস ধরতে যাওয়া হাতটি কেঁপে উঠল দৃতীর। এসব কী বলছে তানিয়া! নিশ্চয়ই ঘুমের ঘোরে ভুল শুনছে দৃতী। অর্ণিত অন্য কোনো মেয়ের সাথে প্রেমালাপ তো দূরের কথা স্বাভাবিক আলাপও জমানোর মানুষ নয়।

“আসলেই কি নয়? অর্ণিতকে তুমি কতোটুকু চিনো? ওর মনের ভেতর ঘুরে এসেছো কি?”

মনের গহীন থেকে শংকা জানান দেয়। দৃতী বলে,

“কারো মনের ভেতরটা পড়ে ফেলা অসম্ভব।”

“তবে এতো নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে?”

“এতোদিনের চেনাজানা, এতোদিনের সম্পর্ক। এতোটুকুও কি চিনতে পারিনি? এতোটা ভুল হবে?”

“তুমি শুধু বাহিরটা দেখেছো দৃতী। যতটুকু তোমাকে দেখানো হয়েছে ততটুকুই দেখেছো। চোখ খুলো, অনুসন্ধান করো, সত্যটা জানো। মুখোশের আড়ালে কতো চেহারা লুকিয়ে আছে!”

দৃতীর মাথার ভেতর ভনভন করতে শুরু করল। ঢিপঢিপ বুক নিয়ে দৃতী ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। একে একে সবটা শুনলো। প্রতিটি বাক্য দৃতীর হৃদ স্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে।
কিন্তু অর্ণিত যখন বলল, “আমার কষ্ট হয়” দৃতীর পায়ের নিচের মাটি দুলে উঠল। অবশ হয়ে এলো পা দুটো। নড়বড়ে হয়ে গেল দৃতীর অবস্থান। দৃতীর বিশ্বাস, ভরসা, সরলতা একনিমিষেই ঝুরঝুর করে ঝরে গেল।
মাথাটা দুলে উঠতেই সাহায্য খুঁজতে হাত বাড়ালো দৃতী। পাশের টেবিলে হাত লেগে পড়ে গেল ফুলদানিটা৷

ওটার পতনের ঠাস শব্দ দৃতী আরেকবার কেঁপে উঠল। হৃদপিণ্ডে বাড়ল চাপ। বড় বড় শ্বাস নিয়ে দৃতী দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণিত ও তানিয়া৷ ওদের পাংশুটে মুখমণ্ডল বলে দিচ্ছে, দৃতী ভুল কিছু শুনেনি।

নিদ্রা আছে, ওই ফোনটা ওপারে৷ যার সাথে মিলে প্রতিনিয়ত দৃতীকে ধোঁকা দিয়ে গিয়েছে অর্ণিত।

দৃতীর চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। হতবাক তানিয়া কী করবে বুঝতে পারছে না৷ এমনকিছুর কল্পনাও সে করেনি৷ কী থেকে কী হয়ে গেল!

অর্ণিত বুঝদার ছেলে। আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলেও পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে নিল দ্রুত। দৃতীর সাথে কথা বলতে হবে। ভুল বুঝার আগেই জানাতে হবে পুরো ঘটনা। দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে চাইল দৃতীর নিকট।

কিন্তু দৃতী চট করে এক পা পিছিয়ে গেল। দূর্বল পা দুটো নড়াচড়া করতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেয়ে পড়ে যেতে ধরেও পাশের টেবিল ধরে নিজেকে সামলে নিল।

অর্ণিত আর এগিয়ে গেল না। নিজেকে সামলানোর সময় দিল দৃতীকে। দৃতী গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে সোফায় বসল। তানিয়া নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল অর্ণিতের পাশে। কি বলে সান্ত্বনা দিবে মেয়েটাকে? ওকে কিছু বলার মুখ কি আছে তানিয়ার? নেই তো। কতো বড় মুখ করে দৃতীর বাবা-মায়ের থেকে ওকে চেয়ে নিয়ে এসেছিল! যথাযথ মর্যাদা রাখতে পারল কই!

সোফায় বসে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে দৃতী। মুখমণ্ডল অস্বাভাবিক রকম লাল হয়ে গেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এতো খারাপ অবস্থা দেখে বিচলিত বোধ করল অর্ণিত। দৃতীর সাথে আলোচনার তাগদা অনুভব করল। বলল,

“লিসেন দৃতী, এতোটা হাইপার হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ অর্ধেক কথা শুনে আকাশ কুসুম ভাবতে শুরু করে দিও না। নিদ্রার ব্যাপারে আমাদের বিস্তারিত কথা বলা দরকার।”

অর্ণিতের ঝরঝরে বক্তব্য শুনে বুকে চাপ বাড়ল দৃতীর। একটা মানুষ অন্যায় করার পরেও এতো সাবলীলভাবে কী করে কথা বলে! কী করে এতো স্বাভাবিক হয় তার আচরণ!

দৃতীর বুকে তীব্র একটা ব্যথা পাক খেতে শুরু করল৷ ডান হাতে চেপে ধরল বুকের বাম পাশ। তানিয়া দ্রুত এগিয়ে এসে জানতে চাইল,

“এই দৃতী, কি হলো তোমার?”

জ্ঞান হারানোর আগে দৃতী নিভু নিভু কণ্ঠে অস্পষ্টভাবে জানালো,

“শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।”

চলবে…
#অক্ষরময়ী