প্রিয় পৌষমাস পর্ব-০১

0
5

#প্রিয়_পৌষমাস ১.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

“আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয়,
চাঁদ হয়ে রবো আকাশেরও গায়।”

‘অটো টিউনের জননী, নেহা কাক্করের রিপ্লেসম্যানের জব পেয়েছিস? বেচারী নেহা কাক্কর তো ভাতে মরবে। তুই এইভাবেই ওর চাকরিটা খেয়ে দিলি! তুই এত নিষ্টুর কেনো’রে পৌষমাস? তোর মনে কি একটুও দয়ামায়া নেই।’

বারান্দায় দাঁড়ানো বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইংল্যান্ড, এই তিন’দেশের আদলে গঠিত এক পুরুষ অবয়ব। মুখের গঠন বাংলাদেশী, অথচ শরীরের গঠন ও গায়ের রঙ পাকিস্তানী আর চুল ইংরেজদের মত কিঞ্চিৎ লালচে। তিন দেশের আদলে সুগঠিত দৃঢ় কাঁধের সুউচ্চ লম্বা পুরুষ। সৌন্দর্যে সুদর্শন, সুপুরুষ হলেও তার প্রতিটা বাক্যে বিষাক্ত তীরের মত। সব তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মূল অভিসন্ধি। কিন্তু সেও দমার পাত্র নয়। পাল্টা জবাব দেয়ার মত অ’স্ত্র সবসময় তোলায় থাকে তার। দু’জনের দূরত্ব শুধুমাত্র কয়েক গজের। দখিনা বারান্দায় দাঁড়ানো সেই পুরুষকে দেখেও না দেখার অদৃশ্য ভান করল পৌষী। তার বেসুরা গলায় উঁচুস্বরে গেয়ে উঠল,

‘ছাগলে কি’না বলে?
পাগলে কি’না খায়?
সে কথা কানে নিলে
তবে যে চলা দায়?’

নৈশব্দে নিজের ঝাঁঝ মিটালো পৌষী। আরাভ এখনো সঠান দাঁড়িয়ে আছে। মতিগতি লক্ষ্য করছে পৌষীর। মুখের কোণে তার কুটিল হাসি। দু’ঠোঁট উলঠে বলল,

‘হ্যাঁ রে পৌষমাস, তোর রেজাল্ট কার্ড দেখিয়েছিলি ছোট পাপাকে?’

আরাভের কথায় কর্ণপাত করল না পৌষী। আবারও বেসুরা গলায় গেয়ে উঠল,

‘না শুনি কারো কথার দ্বার,
চোখে কি সর্ষে পাতা তার।’

গাইতে গাইতে নিজের রুমে প্রবেশ করল সে। কিন্তু বারান্দার দরজা লক করেই ফোৎ ফোৎ নিঃশ্বাস ছাড়ল। রেজাল্ট কার্ড! ইয়া আল্লাহ! যদি তার বাবা দেখতে চায় এখন? তখন কি হবে? রেজাল্ট খারাপ দেখলে প্রফেসর বাপ তার গেইম খেলা, কার্টুন দেখা সব বন্ধ করে দিবে। যদি ঐ সংকর জাতী তার বাপকে বলে দেয়। তবে তো কেল্লাফতে!

হায় হায়! তার কি হবে? ভয়ে বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অস্থিরতায় বুক কাঁপছে তার। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে, আজকের মত মাফ করে দাও ইয়া রাহমানুর রাহিম। পরের বার আমি সত্যি সত্যি পড়াশোনা করব। প্রমিস। রাতে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল। কিন্তু ঘুম নামক চিড়িয়া তার চোখে ধরায় দিল না। শেষে বিছানা থেকে নামল পৌষী। নিজের রেজাল্ট কার্ডকে কি করা যায় তাই ভাবছে। আর মাত্র দু’মাস পর তার নবম শ্রেনীর ফাইনাল এক্সাম। এখন তার ক্লাস টেস্ট এত খারাপ হয়েছে দেখলে তার আম্মাজানের গালি আর আব্বাজানের কড়া হুমকি ধামকি খাবে। কি যে করবে সে। কিন্তু ঐ আরাভ ভাই কেমনে যে টের পায় আগে আগেই। তার জীবনটাই ত্যানা ত্যানা করে দিচ্ছে। এত এত চিন্তা মাথা ভর্তি। ভোর রাতে গিয়ে সে ঘুমের অতলে ডুব দিল।

সকালে ঘুম ভাঙল তার দশ বছরের বোন পূর্ণির চেঁচামেচিতে। দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে সে অবাক। মাত্র ভোর সকাল পাঁচটা এখন। এত তাড়াতাড়ি কেন তাকে জাগালো। মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে। উঠে রক্তিম চোখে তাকালো পূর্ণির দিকে। চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘পূর্ণীর বাচ্চা পূর্ণী, তোর সমস্যা কি? আমারে না জ্বালাইলে তোর ভালা লাগে না। বেয়াদবের বেয়াদব।’

পূর্ণীও চেঁচিয়ে জবাব দিল তার,
‘আম্মু দেখ, তোমার মেয়ে আমারে গালি দিছে।’

প্রিয়া হনহনিয়ে পৌষীর ঘরে ঢুকল। পৌষীকে বিছানায় দেখে হুংকার ছুঁড়ল,
‘জলদি সূর্য উঠার আগে নামাজ পড়। দ্বিতীয় বার আমি ডাকতে আসব না কিন্তু। এরপর রামধোলাই চলবে, বলে দিলাম।’

পৌষী মুহুর্তে চুপসে গেল। মা’কে ভয় লাগে বেশি। পাপা তাকে একটু বেশি আদর করত তবে আজকাল আদরের থেকে শাসন করে বেশি। বড় পাপা, বড় আম্মু ছাড়া তাকে কেউ আদর করে না। মনের দুঃখ নিয়ে বিছানা ছাড়ল।

সকালের নাস্তার জন্য সকাল সাড়ে ছয়টায় ডাকা হল। নাস্তা খেয়ে বাবার কাছে পড়তে হবে তাকে। তাই দ্বিরুক্তি করার উপায় নেই। সে টেবিলে বসল মাত্রই। এর মধ্যে আরাভের রুম থেকে চেঁচামেচি শোনা গেল। সবাই নাস্তা ছেড়ে ছুটে গেল। আরাভ সাপ দেখে ভয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। যেনো তেনো সাপ নয়, বড্ড এক বিষাক্ত সাপ, রাসেল ভাইপার। ফণা তুলে বার বার জ্বিহ্বা বের করছে। সৌরব, গৌরব লাটি-সোটা নিয়েই আরাভের রুমে হাজির। সাপকে মারতে গিয়েই পড়ল বিপদে। সাপ তার ফণা তুলে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। কিছুসময় ভালো করে খেয়াল করতেই সৌরব মিটমিট করে হেসে উঠল। আরাভ অদ্ভুত করে সৌরভকে দেখল।

‘ছোট পাপা, এমন সিরিয়াস মুহুর্তেও তুমি এমন করে হাসছো কেন?’

সৌরভ ভ্রুকুঞ্চন করে জবাব দিল,
‘বাবাজী আগে তো জিনিসটা ভালো করে খেয়াল করবা। দেখতে পারছো না এটা ব্যাটারি চালিত একটা সাপ।’

আরাভ সূক্ষ্মদৃষ্টি দিল। মুহুর্তে তার ভয়ার্ত চোখে অগ্নিবর্ণ ধারণ করল। সে জানে এ কাজ কে করতে পারে? তার দ্বারাই সম্ভব!

খাওয়ার টেবিল পুরো শূন্য। পৌষী টপাটপ নিজের মুখে খাবার পুরল। সাথে পানি আর কিছু খাবার নিয়ে নিজের রুমের দিকে ছুটল। দরজা মাত্র বন্ধ করতেই করাঘাতের শব্দ হল। ঊনিশ বছর বয়সী আরাভ যেন ক্ষ্যাপাটে বাঘ। সে চেঁচিয়ে উঠল,

‘এই পৌষমাস কয়দিন নিজেকে বন্ধ দরজায় রাখবি। বের তো তোকে হতেই হবে। তোকে যদি আমি তেলাপোকার স্যুপ না খাওয়াইছি তো, আমার নামও আরাভ ফায়াজ না। মনে রাখিস কিন্তু, আর সাবধানেও থাকিস।’

পৌষী রুম থেকে বিড়বিড় করল,

‘ঘোড়ার ডিম করবে আমার। সংকর জাতীর জন্য তার সারারাত ঘুম হয়নি। এই পৌষীকে ভয় দেখানো এত সোজা না’কি? এখন সেও শোধবোধ করেছে।

বর্তমান,,

সহসাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ল সেই পাঁচ’বছর আগের চঞ্চল পৌষীকে। যে একদিন ভীষণভাবে জ্বালিয়ে ছিল আরাভ নামের এক পুরুষকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে আজ দু’জন পৃথিবীর দু’প্রান্তে অবস্থিত। তাদের মধ্যেকার দেখা-সাক্ষাত নেই আজ পাঁচ বছর। তখন সে পনেরো বছরের কিশোরী আর তার আরাভ ভাই ছিল ঊনিশ বছরের তাগড়া যুবক।

শত মেয়েরা আরাভকে দেখে ক্রাশ নামক বাঁশ খেলেও সে ছিল তাদের বিপরীত। তার কাছে আরাভ ছিল নিছকই ঘরের শত্রু বিভীষণ। যে তার বাবার সর্বদা প্রিয় পাত্র ও ভীষণ আদুরে সুবোধ বালক। এজন্য তার দুঃখের অন্ত ছিল না। তার বাবা কেন এই আরাভকে এত বেশি আদর করে। সে রোজ ঈর্ষায় পুড়তো। কলিজা পুড়ে ছারখার হত তখন। তার বাবার আদরের কারণ কিন্তু সে আবিষ্কার করেছে অনেক বছর পর। তার বাবা মেয়ে জামাই হিসেবে আরাভকে সিলেক্ট করে রেখেছে তার জন্মের বহু আগেই। যেদিন জানল, সে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল তখন।

পৌষী নিজমনে বিদ্রুপ করল পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে। এই অতীত স্মৃতি গুলো আঁকড়ে আছে সে। মনে পড়লে ডুব দেয় নিজের অজান্তে।
__

রাতের খাবারের জন্য টেবিলে বসে আছে সৌরভ। অপেক্ষা করছে বাকী’রা আসার জন্য। প্রিয়ার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে তাকে ডাকল,
‘ও প্রিয়ারানী কই গো তুমি? এতক্ষণ ডেকে ডেকে আমার কান খেয়ে নিলে। এখন তোমার দেখা নেই কেন বউ?’

সৌরভের ডাক শুনে প্রিয়া রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে ছুটে এল। চোখমুখে ঈষৎ রাগের আভাস। বিদ্রুপের সুর তুলল সে,

‘কথায় বলে না, সারাদিনে মরে না, কিন্তু ক্ষণিকে মরে। আপনার হয়েছে এই অবস্থা প্রফেসর সাহেব। এতক্ষণ তো আসলেন না। আর এসেই তর সইছে না। বয়স হয়েছে কিন্তু আপনি এখনও বদলাননি।’

সৌরভের অধরকোণে প্রসন্ন হাসি। রগড় গলায় জবাব দিল প্রিয়ার,
‘আমি বদলাতে চাইও না প্রিয়ারানী।’

‘হইছে, বুড়া বয়সে এত ভীমরতি করতে হবে না। মেয়েরা বড়ো হয়েছে। এদের সামনে অনন্ত নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখুন।’

সৌরভ তখনও হাসছে। ইদানীং বউ তার বেশ গম্ভীর গলায় কথা বলে। ঘরকন্নায় বেশ পারদর্শী হয়েছে তার প্রিয়ারানী। বোটানি পড়েও নার্সিং পড়েছে শেষে। নার্স হিসেবেও বেশ সুনাম কুড়িয়ে যাচ্ছে। মা ও শিশু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন বিশেষজ্ঞ নার্স হিসেবে কর্মরত এখন। সেই সুবাদে মা ও শিশুর জটিলতা সম্পর্কে বেশ সচেতন। তার রণচণ্ডী বউ একজন দক্ষ নার্স আবার একজন দক্ষ মা। সে বরাবরই গর্বিত তার বউ নিয়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস তার চোখেমুখে। জবাবে বলল,

‘আমার মেয়ে’রা কোথায়? ডাকো তাদের।’
‘আমি ডেকে নিয়ে আসছি।’
সৌরভের জবাব দিয়ে মেয়েদের ডাকার জন্য ছুটল প্রিয়া।

প্রিয়া পৌষীর দরজায় করাঘাত করল কয়েক’বার। কিন্তু পৌষীর হুঁশ নেই। প্রিয়া অধৈর্য হয়ে বকাঝকা করল কিছুক্ষণ। মায়ের গলার তীক্ষ্ণ আওয়াজ পেয়ে পনেরো বছরের পূর্ণী দরজা খুলল দ্রুতই। ভেবেছিল নিজের দরজার সামনে তার মা। কিন্তু দেখল তার দরজায় নয়, তার বোনের দরজায় মায়ের এমন হুমকি ধামকি চলছে। ছোট্ট পূর্ণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘কি হয়েছে আম্মু? আপুরে এত চিল্লায়ও কেনো?’
প্রিয়ার চোখেমুখে আগুনের ফুলকি ছুটছে। কোপিত স্বরে জবাব দিল পূর্ণীর,

‘তোর বোন তো কানে শুনে না। বয়রা একটা, আমার হইছে যত জ্বালা। আমি গেলাম, তোর বোনরে ডেকে দু’জনে খেতে আয়।’

প্রিয়া যেতে নিজের বোনকে কল দিল। দু’ দুবার রিং হওয়ার পর তার কল রিসিভ হল। পূর্ণী চেঁচিয়ে উঠল,

‘জলদি বাইর হ আপু। তোর গর্দান নিব আম্মু আজকে। আমি গেলাম খাইতে। বাঁচতে চাইলে জলদি আয়।’

পৌষী এতক্ষন নিজের অতীতে এত ডুবে ছিল, মায়ের বজ্রধ্বনিও কানে পৌঁছায়নি। বেসিন থেকে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে তারপর বেরুলো সে। টেবিলে আসতে আরেক দপা প্রিয়া বকল তাকে।

‘তোর কানে কি আজকাল তুলা গুঁজা থাকে পৌষী। কয়বার ডাকছিলাম?’

পৌষী নিরুত্তোর। চুপচাপ মায়ের সব ধমক হজম করছে। নিচু মাথায় নিজের প্লেটে ভাত মাখছে। মুখে মাত্রই ভাত তুলবে তখন আকস্মিক আরেক কথায় থমকালো পৌষী। সৌরভ মুখে ভাত তুলতে তুলতে বলে উঠল,

‘ভাই কানাডা থেকে কল দিয়েছে। এই সপ্তাহে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান হবে আরাভ আর আকসার। ভাই আমাদেরকে কানাডা যেতে বলল।’

আচমকাই পৌষীর খাবার আটকে গেল গলায়। কাশি দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। সৌরভ পানি দিল মেয়েকে। ধীর গলায় বলল,
‘আস্তে-ধীরে খাও আম্মাজান।’

পৌষী জবাব দিল না কিছুই। শুধু ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকাল। তার বাবা কি তার চোখের ভাষা বুঝতে পারে না। তার বাবাই তো ডাকত, আরাভকে জামাই বাবাজী। কিন্তু এখন কি সব ভুলে গেছে। ছোট থেকে জামাই বাবাজী ডেকে এখন সেই জামাইয়ের সাথে কেন অন্য মেয়ের বিয়ে হবে? তার বাবা কেন নিষেধ করছে না। আর আরাভ ভাইও কি তাকে ভুলে গেছে। সত্যিই তাকে মনে রাখেনি। খাবারটুকু আর গিলতে পারল আর। আধা খাওয়া প্লেটের খাবার রেখে সে নিজের রুমের দিকে ছুটল। প্রিয়া শক্ত গলায় বলে উঠল,

‘আরাভের এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান হবে। তুমি তাদেরকে কিছু বলবে না। গৌরব ভাইও কিভাবে পারল নিজের ছেলের সাথে অন্য মেয়ের সাথে এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান করতে? আমার মেয়ের কি হবে?’
সৌরভ চুপচাপ খেয়ে গেল। জবাব দিল না কিছুই।

পূর্ণী বাবা-মায়ের অভিব্যক্তি বুঝার চেষ্টা করছে। আরাভ ভাইকে সে দশ বছর বয়সে দেখেছে। এরপর আর দেখা হয়নি কখনো। আরাভ ভাই, বড় পাপা, আরিবা আপু তারা এ বাড়িতে কেন আসে না তার জানা নেই। গত পাঁচ বছর ধরে দু’পরিবারের মধ্যে কি হয়েছে সেটাও জানে না। সে প্রতিদিন দোয়া করে তার বড় পাপা ফিরে আসুক। আবার আগের মত ঘর প্রাণবন্ত হোক। কিন্তু আদৌ হবে তো!

চলবে,,,