#প্রিয়_পৌষমাস (অন্তিম পর্ব)
#মেঘা_সুবাশ্রী
আজকাল যেন পৌষীর জৌলুশতা বেড়েই চলেছে। আগের থেকে কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্য বেড়েছে। তবে সৌন্দর্য, গায়ের রঙ, চেহারায় বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আরাভ মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন বউয়ের এমন রূপে। তার আবিষ্ট দু’চোখ পৌষীর দিকে নিবদ্ধ। মন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চাইছে। কিন্তু পৌষী আছে তার নিজস্ব জগৎ নিয়ে। তার মননশীল জগতে বসবাস তার ছোট্ট পুচকের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আরাভ মনঃক্ষুণ্ন কিছুটা। এখনো বাচ্চা আসেনি তার আগেই বউ তাকে পর করে দিল। এমনটা হলে সে বউ ছাড়া থাকবে কীভাবে? পুরুষালি সত্তা হাহাকার করে উঠল। আনমনে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে সে। নম্রসুরে ডেকে উঠল,
‘বউ এদিকে আসো তো।’
পৌষী আলমিরা গোচ্ছাছে। নিজের পুচকের জন্য জায়গা খালি করে রাখছে আগে থেকে। আরাভের এত নমনীয় সুরের মানে সে বুঝে। চোখ তুলে তাকাল একপলক। ফের নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। কাজ করতে করতে বলল,
‘কি হয়েছে?’
আরাভ আশাহত হল। গলার স্বর কিছুটা রুক্ষ, ভেজানো। বলল,
‘আজকাল তুমি আমার যত্ন নাও না। একটুও আমার সেবা কর না। এই যে আমার মাথা ব্যথা করছে, তুমি একটুও খেয়াল করলে না। বড্ড অবহেলা করছো আমাকে বউ।’
পৌষী মাথা তুলল। তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। স্বামীর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে সে। কিছুসময় অতিক্রান্ত হতেই নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে মাথা ব্যথার ওষুধের পাতা নিয়ে এসে আরাভের সম্মুখে ধরল। বলল,
‘মাথা ব্যথা করলে ওষুধ খেয়ে নাও।’
আরাভ নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিল। মুখের ভাব বড্ড অসহায়ত্ব। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হঠাৎই, তারপর শাহাদাৎ আঙ্গুল উঠিয়ে নিজের দিকে তাক করে নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করল,
‘আরাভ তুই কি ভেবেছিলি, বউকে মাথা ব্যথার কথা বললে সে চোখে জল এনে কেঁদেকুটে তোর কাছে ছুটে আসবে। মোটেও না। এত আশা রাখতে নেই বাছা। সেই দিন কি আছে এখন! বউ তোমায় ভালোবেসে জড়িয়ে ধরবে।’
পৌষী থ হয়ে আছে। আরাভের কান্ড দেখে আপনাআপনি দু’ভ্রু কুঞ্চিত হল তৎক্ষনাৎ। সে ভেবেই পাই না, এত নিখুঁত অভিনয় কীভাবে জানে মানুষ? মুখ বাঁকালো কিঞ্চিৎ। যা আরাভের দৃষ্টির আঁড়ালে। নিজের ডান হাত তুলে আরাভের কপালে মালিশ করতে করতে জবাব দিল সে,
‘তুমি ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে কিন্তু অভিনেতা হতে পারতে। খুব ভালো অভিনয় জানো?’
আরাভ বউয়ের কথায় কর্ণপাত করেনি। সে বিছানায় বসে আছে। পৌষী দাঁড়িয়ে থেকে তার কপালে মালিশ করছে। আরাভ পৌষীর কোমর চেপে ধরল। আলগোছে তার শাড়ির উপর মুখ গুজে আছে। পৌষীর মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। আরাভের পারফিউমের বিদঘুটে গন্ধও লাগছে তার নাসারন্ধ্রে। পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার উপক্রম হল সেই গন্ধে। সে আরাভকে বলল,
‘ছাড়ো, আমার বমি আসছে মনে হচ্ছে? বাথরুমে যাব।’
আরাভ ছাড়ল না। তার মন অন্যকিছু বলছে। পৌষী তার কাছ থেকে বাঁচতে হয়ত মিথ্যে বলছে ভাবল। না ছেড়ে হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে নিল। এতে ফলাফল হল হিতের বিপরীত ও ভয়াবহ। পৌষী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। গলগল করে নিজের পেটে থাকা সবকিছু আরাভের গায়ে ছাড়ল। বেচারা আরাভ তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে তো কস্মিনকালেও ভাবেনি বউ তার সত্যিই বমি করবে। নিজেকে অপরাধী সাব্যস্ত করল এমন ভুলের জন্য। বমি করেই পৌষী নিস্তেজ একদম। আরাভ ঝটপট বউকে একহাত ধরে বুকের মাঝে চেপে ধরল। মাথায়, পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘সর্যিই বউ, আমি বুঝতে পারিনি। তোমার সত্যি বমি আসবে।’
পৌষী কথা বলার অবস্থায় নেই। অসহায়ের মত কাতরাচ্ছে সে। তাকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে আসল আরাভ। পরিষ্কার করে দিল ভালো করে। তারপর নিজেও পরিষ্কার হয়ে নিল। এরপর থেকে ভুল করেও পৌষীর সাথে মজা করে না। ধীরে ধীরে সময় বাড়ল। তার সাথে পৌষীর মাতৃত্বের বিষয়গুলোও স্পষ্ট হচ্ছে ইদানিং। কনসিভ করার ছয়মাস হতেই তার পেট যেন বেশ ভারি হয়ে গেল। হাঁটতে, বসতে, ঘুমাতে সবকিছু যেন তার দিন দিন কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। কত কষ্ট একজন মায়ের। পৌষী হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে এখন। আসলে মা হওয়া এত সহজ নয়। আরাভ স্বামী থেকে একজন পিতা হয়ে উঠল হুট করে। স্ত্রীর প্রতি সর্বদা সর্তক নজর রাখছে। যাতে তার কষ্ট কম হয়।
আলিশবা বেশ চিন্তিত পৌষীকে নিয়ে। মাত্র ছ’মাসে তার পেট অতিরিক্ত বড় দেখা যাচ্ছে। দেখলেই মনে হবে ডেলিভারির সময় হয়ে গেছে। অথচ এখনো তিনমাস বাকি। এই বিষয়টা সে প্রিয়ার সাথে শেয়ার করতেই সে কেঁদেকুটে অস্থির মেয়ের জন্য। সে একজন দক্ষ নার্স হয়েও মেয়ের চিন্তায় বিভোর সারাক্ষণ। ডেলিভারির একমাস আগেই সে কানাডায় এসে পৌঁছাবে। মেয়ের ক্রান্তিলগ্নে মা হিসেবে পাশে থেকে সাহস দেবে তাকে। কিন্তু নাজমা ভাবছে অন্যকিছু। সে এই কথা প্রিয়াকে স্পষ্ট করে জানিয়েছেও। এই কথা শুনে তো প্রিয়া আরও বেশি উদ্বিগ্ন। এমনটা হলে তো মেয়ে তার ঝুঁকিতে আছে। কিন্তু নাজমা বেশ শক্ত আছে। তিনি বললেন, এত উথলা না হয়ে মেয়ের জন্য দোয়া কর। তাকে কিন্তু এসব বলতে যেও না আবার। তাহলে সে হীনমন্যতায় ভুগবে।
সময় যেন দ্রুত ঘনিয়ে এল। প্রেগন্যান্সির নয়মাস চলছে। প্রিয়া-সৌরভ এল বাংলাদেশ থেকে, মেয়ের কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়াতে। আর কিছুদিন মাত্র। মেয়ে মা হতে যাচ্ছে। ডেলিভারির সময়ও যেন ঘনিয়ে এল দ্রুতই। একদিন সন্ধ্যোবেলায় হঠাৎই পৌষী প্রসব ব্যথায় ককিয়ে উঠল। হাসপাতালে নেওয়া হল তড়িঘড়ি। আরাভ তখন অফিসে ব্যস্ত। শোনা মাত্রই সেও ছুটে এল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল ডেলিভারি করতে গিয়ে। পৌষীর দু’ব্যাগ রক্ত লাগবে। তাও অতি জরুরী। ওর রক্তের গ্রুপ বি-পজেটিব। সৌরভ এগিয়ে এল মেয়েকে রক্ত দান করতে। তার আর পৌষীর রক্তের গ্রুপ একই। অথচ আরও এক ব্যাগের সংকট তখনও। ব্লাডব্যাংকে এই রক্ত পাওনা যায়নি। রক্ত না পেয়ে সবাই যখই হতাশ বিমূঢ় প্রায়। তখন আলোর দিশারী হয়ে ছুটে এল পার্থ। তার রক্তের গ্রুপ বি-পজেটিব। আরাভ কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে গেল। হয়ত এজন্যই লোকে বলে বন্ধুত্ব কর সঠিক মানুষ নির্বাচন করে। দুঃসময়ে যে তোমার পাশে ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে পারবে। পার্থ’র সাথে নিবিড় আলিঙ্গন করল সে।
২৮শে ফেব্রুয়ারি, দিন সোমবার, রাত ৮টায় পৃথিবীর মুখ দেখল আরাভ পৌষীর প্রথম সন্তান। ১ মিনিটের ব্যবধানে এল তাদের দ্বিতীয় সন্তানও। জমজ দুই ছেলে। আরাভ তাজ্জব বনে গেল। তার জমজ ছেলে হয়েছে। সে তো বিশ্বাসই করতে পারছে না। অথচ প্রিয়া আলিশবাদের সবই জানা ছিল। পৌষীর জ্ঞান ফিরতে সেও আরাভের মত অবাক। তাকেও জানানো হয়নি তার জমজ বাচ্চা হবে। এখন দেখে সেও আবেগে আপ্লূত। দেখতে একদম আরাভের অবিকল দুই ছেলে। গায়ের রঙ গৌরবর্ণ ঠিক তাদের বাবার মতই। যেন এক খন্ড শুভ্র তুষার। সে আনমনে বিড়বিড় করল, আমার তুষার-শুভ্র।
হাসপাতালে তিনদিন থাকার পর বাসায় নিয়ে আসা হয় পৌষীকে। আরাভ যেন বাঁধন হারা। বার বার নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে বলে উঠে, এই পুঁচকো দুইটা আমার ছেলে। তার এমন আচরণ দেখে পৌষী ক্ষেপে যায়। তখন তিরিক্ষি মেজাজে সে জবাব দেয়, না অনলাইনে অর্ডার করছি। তোমার হতে যাবে কোন দুঃখে। আরাভ তখন বউয়ের কথায় খুশিতে হাসে।
গৌরবও যেন খুশিতে আত্মহারা। সৌরভকে খোঁচা মেরে বলে, দেখলি ভাই দু’টো দাদাভাই আসছে আমাদের। তুই যে ভাগ নিবি তা ওরাও জানত। এজন্য দু’জন আসছে এক সাথে। সৌরভও ভাইয়ের সাথে তাল মেলায়। সে ভাবতেই চমকে উঠে। তার মেয়েটার দুটো জমজ ছেলে। ঠিক যেন তাদের বিপরীত। নাজমা ভিডিও কলে নাতির ঘরের পুতিকে দেখে নিজের নয়ন জুড়ায়। আর সবাইকে দেখিয়ে বলে, এ যেন আরেক গৌরব সৌরভ। শুধু ব্যবধান তার ছেলেদের থেকে এই পিচ্চিগুলো বেশি সুন্দর।
পাঁচদিনের মধ্যে জাঁকজমকভাবে বাচ্চাদের নামকরণ করা হল। প্রথম জনের নাম আফরাদ তুষার এবং দ্বিতীয় জনের নাম রাখা হল আলফাজ শুভ।
সৌরভ দু’জনকে কোলে নিয়ে কিছুসময় চেয়ে থাকে। কালো মার্বেল পাথরের মত গোল গোল চার চোখ। নানাভাই বললে কেমন করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। নয়ত হাই তোলে ঘুমের ঘুরে। সে ভেবে পায় না, কোনটা তার মত শান্ত সভ্য। দু’জনই তো সারাক্ষণ চিকচিক করে মুরগীর বাচ্চার মত। আনমনে হাসে সে। তবে এর মাঝে তুষারকে কিছুটা শান্ত দেখা যায়। কিন্তু শুভ্র কিছুটা রাগী। সে সারাক্ষণ চিকচিক করে কোলে থাকার জন্য। পরম মমতায় সে বুকের মাঝে চেপে ধরে। কি এক সুখকর মুহুর্ত!
মাস দেড়েক সৌরভ প্রিয়া নাতিদের সাথে ছিল। এরপর ফিরে আসে নিজের মাতৃভূমিতে। পূর্ণীর বড্ড আফসোস, কবে দেখবে তাদের পুঁচকো দু’জনকে। আরাভ কথা দিয়েছে, বাচ্চাদের ছ’মাস পূর্ণ হলেই সে দেশে ফিরবে। কিন্তু তার আগে নয়। পূর্ণী অপেক্ষার প্রহর গুণে। ছ’মাস পূর্ণ হতেই আরাভ তার কথা রাখে। সে দেশে আসে এর মাঝে। এতে পূর্ণী সেই খুশি। সারাক্ষণ তুষার শুভ্রকে নিয়ে ঘুরঘুর করা, তাদের খাওয়ানো এবং কোলে নেওয়া সবই পূর্ণী করে। কিন্তু মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে আবার ফিরে আসে কানাডার উদ্দেশ্য।
পৌষীর ভার্সিটির পরীক্ষা চলছে। আলিশবা আর গৌরব মিলেই তুষার-শুভ্র দু’জনকে সামলায়। আট’মাসের বাচ্চা হওয়ায় এখন আধো আধো বুলি ফুটেছে। তা তা বলে বেড়ায়, আবার মাঝে প্যা প্যা ও বলে। আরাভ খুশিতে ডগমগিয়ে উঠে তখন। অবশেষে তার ছেলে’রা তাকে ডাকতে পারে। কিন্তু পৌষী হতবাক, মা না ডেকে সারাক্ষণই প্যা প্যা করে কেন এরা? সে বাচ্চাদের ইচ্ছেমত বকে। তোরা মা না ডেকে পা পা করিস কেন? তখন তুষার-শুভ দু’জনই চুপ করে শুনে মায়ের কথা। কিন্তু পরক্ষনেই আবার প্যা প্যা বলে চেঁচিয়ে উঠে।
__________সমাপ্তি __________