প্রিয় প্রত্যয় পর্ব-২১

0
40

#প্রিয়_প্রত্যয়
#পর্ব২১
#রাউফুন

ধীরে ধীরে বিকেলের আলো ম্লান হয়ে আসছে। গোধূলির আকাশে যেনো রঙের মেলবন্ধন ঘটেছে। বিউটি ঘরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে, সামনের গাছেদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে ধরা এক চায়ের কাপ, কিন্তু মন অন্য কোথাও। প্রেগন্যান্সির টাইমে হুটহাট কেমন মুড সুইং হয়ে যায় তার। এমন সময় তার ফোনে অজানা একটি নাম্বার থেকে কল আসে। নম্বরটি দেখে কৌতূহল হলেও রিসিভ করে।

বিউটি শান্ত কন্ঠে বললো, “হ্যালো? কে বলছেন?”

মিনহাজ ইতস্তত করছে। ওপাশ থেকে কেবলই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। বিউটি খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে,“ভাই কথা বললে বলুন না হলে রেখে দেন। এতো আজাইরা সময় আমার নাই।”

মিনহাজ তড়িঘড়ি করে বললো,“আরনাজ, আমি মিনহাজ।”

বিউটি চমকে ওঠে। হঠাৎ মিনহাজের ফোন কেন? তাও অন্য একটা নাম্বার থেকে। কি কারণ?
বিউটি কিছুটা থেমে, “মিনহাজ? এতদিন পর? হঠাৎ কি মনে করে?”

মিনহাজ তীব্র অস্বস্তিতে বিমূঢ় হয়ে বললো,”আমি… আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। এটা খুব জরুরি। প্লিজ আরনাজ না করবেন না।”

বিউটি ভ্রুকুটি করে শুধায়,“ফোনে বলা যাবে না?”

“প্লিজ, আরনাজ। একবার দেখা করুন। অনেক কিছু বলা দরকার। এটাই শেষ আর কখনোই বলবো না দেখা করতে।”

বিউটি কিছুক্ষণ ভাবল। হঠাৎ কেনো এই মানুষটি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে, তা বুঝতে পারছিল না। তবে অজানা এক তাগিদে সে রাজি হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর বিউটি নির্ধারিত জায়গায় এলো। মিনহাজ আগেই অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে বিউটি থমকে যায়। মিনহাজের চেহারায় কেমন যেনো ক্লান্তির ছাপ, কিছুটা অন্য রকম, এলোমেলো। অথচ লোকটা খুবই গোছালো, এর আগে যতবার দেখা হয়েছে সব সময় পরিপাটিই দেখেছে। আজ এমন ছন্নছাড়া কেন? বুঝতে পারে না বিউটি। কিছুক্ষণ নীরবতা, এরপর মিনহাজ এগিয়ে এলো।

”ধন্যবাদ আরনাজ। আমার কথা রাখার জন্য।”

বিউটি ঠান্ডা কণ্ঠে জানতে চাইলো,”বলুন, কী বলতে চান? সুপ্রিয়কে না জানিয়ে এসেছি তো। আসলে এই সময়ে ও আমাকে কোনো ভাবেই জার্নি করতে দিতে প্রস্তুত না।”

মিনহাজ অদ্ভুত ভাবে তাকায়, অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,“এই সময় মানে? জার্নিতে কি প্রব্লেম?”

বিউটি অনেকটা অস্বস্তি, আর লজ্জায় পড়ে গেলো। হুট করেই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে কথাটা। ইতিউতি করে মাথা নিচু করে বলে,“আমি, আমি মা হতে চলেছি।”

মিনহাজের কেমন যেনো অনুভব হয়। অনুভব করলো, ওর ভীষণ খুশি লাগছে। একদমই খারাপ লাগছে না৷ ও উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,“কংগ্রাচুলেশনস মিসেস সুপ্রিয়।”

বিউটি তাকায় মিনহাজের দিকে। ওর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। যাক মানুষ টা কষ্ট পায়নি তবে। বিউটি তাড়া দিয়ে বললো,“বেশি সময় নেই মিনহাজ।”

খুশিটা মিলিয়ে গেলো মূহুর্তেই। মিইয়ে গিয়ে মাথা নত করে ভাবলো, বিউটি এই বিষয় টা কিভাবে নেবে? ওকে কি খুব জোরে একটা চ’ড় বসাবে? হুটহাট রেগে যাওয়া তো তার ধাতে আছে। মিনহাজ তার চোখে চোখ রাখতে পারছিল না। তার মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছিল না। অবশেষে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে সত্য প্রকাশ করল।

“চার বছর আগে… আপনার জীবনে যা ঘটেছিল, তার জন্য আমিই দায়ী। আমি এই চার বছর থেকে এর ভাড় বয়ে বেড়াচ্ছি, এখন আমি ক্লান্ত আরনাজ। মনে হলো আপনাকে সত্যিটা জানানো উচিত। আপনি আমাকে যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো। কেবল বন্ধুত্বটা রাখলে খুশি হবো।”

বিউটি বিস্ময়ে নিয়ে বলে,“আপনি কোন ঘটনার কথা বলছেন? পরিষ্কার করে বলুন!”

বিউটির শরীর অদ্ভুত ভাবে কাঁপছে৷ মিনহাজ তখনও মাথা নিচু করে আছে বলে বিউটির কম্পন বুঝতে পারলো না৷ ধীর তব ম্লান কন্ঠে বললো,”আপনার মুখে এসিড পড়ার ঘটনা… সেটা আমার ভুল ছিল। আমি ল্যাবে কাজ করছিলাম। তখন অসাবধানতায় এসিডের বোতল আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, আর…

বিউটির চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে। সে কোনো কথা বলতে পারছিল না।
কাঁপা কণ্ঠে বলে,“এটা এতদিন পরে বলছেন? কেন? আপনি, আপ, আপনি জানেন, আমি কত তাকে খুঁজেছি। আমি তাকে শাস্তি দিতে খুঁজি নি, শুধু মাত্র এটা দেখাতে যে দেখুন, আপনার করা ভুলে আমার জীবনটা কেমন অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে। কি নরক যন্ত্রণা আমাকে পোহাতে হয়, প্রতিটি মূহুর্তে, প্রতিটি সময়। প্রত্যেকটা জায়গায় গেলেই, সবার বাকা দৃষ্টি, কাণাঘুষা, সবার বিদ্রুপ। কতকিছু সহ্য করতে হয়েছে। কত কিছু। সবকিছু কিন্তু সহজ ছিলো না৷ একদম সহজ ছিলো না।”

মিনহাজের কেমন অসহায় বোধহয়। কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। কোনো রকমে বলে,“আমি জানি, আপনাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমার নেই। কিন্তু, কিন্তু আমি আর এই বোঝা বহন করতে পারছিলাম না। হইতো আপনার মুখের দাগটার মতোই সারা জীবনই অপরাধবোধে ভুগবো, বয়ে বেড়াবো নিজের করা ভুলের ভাড়। তবে মনে হলো একবার অন্তত সত্যিটা আপনার কাছে স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া দরকার। আমি জানি এটা এতো সহজ না, ক্ষমা করা না করা সম্পুর্ন আপনার ব্যাপার। ক্ষমা না করার অধিকার আপনার আছে। তবে সত্যিই আমি অনুতপ্ত বিশ্বাস করুন।”

বিউটি মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার চোখ থেকে টুপটুপ করে অশ্রু পড়ছে। একদিকে ক্ষোভ, অন্যদিকে দুঃখ—মনে যেনো ঝড় বইছে। বিউটি চোখ মুছে,”মিনহাজ, যা হয়েছে, হয়ে গেছে। যেটা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো যাবে না। তবে আমি আপনাকে ক্ষমা না করার কোনো কারণ দেখছি না। যা কিছু কপালে লেখা ছিলো তাই হয়েছে। আমার ভাগ্যে এর চাইতেও খারাপ কিছু হতে পারতো। কিন্তু তা ত হয়নি, আল্লাহ আমাকে এখন অনেক সুখ দিয়েছেন। দুঃখের পরেই তো সুখ আসে তাই না। তবে ক্ষমা আমি আপনাকে করবো, একটা শর্তে।”

মিনহাজ উৎসুক হয়ে তাকায়। বলে,”কী শর্ত?”

“আপনি বিয়ে করুন। মারিয়াম আমাকে বলেছিলো কোনো একটা কারণে আপনি বিয়ে করতে চান না। সেই কারণ টা আমার কাছে এখন স্পষ্ট। মারিয়াম আপনাকে অনেক ভালোবাসে, আমি তার চোখে আপনার জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখেছি। একজন মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের অনুভূতি বুঝতে ভুল করবো না নিশ্চয়ই।”

মিনহাজ গভীর কণ্ঠে বললো,”যদি এটাই আপনার ইচ্ছে হয়, তবে আমি রাজি, তাকে আমি বিয়ে করবো। আপনি আমাকে এতো সহজে ক্ষমা করবেন এটা ভাবিইনি।”

“ক্ষমা আমি করলাম, কারণ আপনি ইচ্ছে করে তো আর আমাকে এসিড মা”রেন নি। আমি অবুঝ নয়৷ আপনার একটা ভুলকে আঁকড়ে ধরে থাকার মতো বোকা অন্তত আমি নয়।”

“আমি তো অন্যায় করেছি আপনার সঙ্গে তাই না? যা আপনাকে সারাজীবন বহন করে যেতে হবে।”

“ভুল আর অন্যায়ের পার্থক্য না বোঝার মতো বোকা তো আপনি নন মিনহাজ। এটা অন্যায় হতো যদি আপনি ইচ্ছে করে আমাকে এসি’ড নিক্ষেপ করতেন। ওটা একটা এক্সি’ডেন্ট ছিলো। যা আমার জীবনের কালো অধ্যায়। আমি এখন আর সেসব মনে করে আমার বর্তমান নষ্ট করতে চাই না। আপনি সেসব ধরে রেখে নিজের জীবনটা নষ্ট করবেন না৷ নিজেকে এবং নিজের জীবনকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিন। আনন্দে থাকুন, তাকে নিয়ে যে আপনাকে ভালোবাসে, খুব করে চায়!”

বিউটি চলে আসে। ওর শরীর টা ভালো লাগছে না। মিনহাজ তাকে এগিয়ে দিতে চাইলেও বিউটি বাধ সাধে। পাছে যদি সুপ্রিয় ওকে ওর গাড়ি করে যেতে দেখে ভুল বুঝে? না না এটা হতে দেওয়া যাবে না। আজকের ব্যাপারটা সে আলগোছে সুপ্রিয়কে সত্যি টা জানাবে।

বিউটির মুখভর্তি উদ্বেগ। বিয়ের এতদিনেও সুপ্রিয়র রাগ টাগ দেখেনি সে। প্রেগন্যান্সির সময়টা ওর খুবই যত্নে থাকার কথা, অথচ আজ নিজের ভুলে স্বামীর রাগের মুখোমুখি হয়েছে। মিনহাজের সঙ্গে দেখা করার কথা সুপ্রিয়কে বলা উচিত ছিল।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সুপ্রিয় অফিস থেকে ফেরার পর বিউটিকে বাড়িতে দেখতে পায়নি। সে ড্রয়িংরুমে অগোছালো ভাবে বসে আছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, ভেতরের অশান্তি লুকানো সম্ভব হয়নি। ঠিকই স্পষ্ট হয়েছে মুখাবয়বে। বিউটি সবে বাড়িতে পা রেখেছে। তক্ষুনি গম্ভীর স্বর কানে বাজে তার। সে থেমে যায়। সুপ্রিয়ের কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা স্পষ্ট টের পায় সে।
“কোথায় গিয়েছিলে, বিউটি?”

“আমি… বাইরে মানে একটা জরুরি কাজে গিয়েছিলাম।” বিউটির চোখ নিচের দিকে।

সুপ্রিয় ভ্রু কুঁচকে বলে, “বাইরে মানে, ডাক্তারের কাছে তো যাওনি। তাহলে কোথায়?”
বিউটি চুপ। তার নীরবতা সুপ্রিয়কে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
“এই অবস্থায় তোমার জার্নি করা বারণ, তুমি জানো না? আমাকে কি এতটাই দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়, যে তোমাকে নিজের মতো চলতে দিতে হবে?”

বিউটি মাথা নিচু করে শোনে। তার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। সুপ্রিয় তার দিকে তাকিয়ে রাগ নিয়ে বলে,
“তুমি কি নিজে থেকে আমায় বলবে নাকি আমি অন্য উপায় অবলম্বন করবো?”

বিউটি আস্তে আস্তে মাথা তোলে। তার চোখে অশ্রু জমেছে।
“বিশ্বাস কর, সুপ্রিয় কাজটা জরুরিই ছিলো। আমি তোমায় ধীরে সুস্থে জানাতাম কথাটা। ভেবেছিলাম নিজে সামলে নিয়ে পরে জানাবো তোমাকে।”

“নিজে সামলাতে চেয়েছিলে? তোমার আর আমার মধ্যে গোপনীয়তার কোনো জায়গা নেই, বিউটি। অথচ তুমি গোপনীয়তা রাখছো। শোনো, তুমি যা করছো, তা শুধু নিজের ক্ষতি করছো না, আমাদের সন্তানকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছো। ডক্টর স্পষ্ট বলেছিলো তিনমাস বেড রেস্টে থাকতে, অথচ কথা শুনলে না। আসলে তোমার তো নিজের বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তায় নেই। ঐ মিনহাজের সঙ্গেই দেখা করাটা যদি তোমার জরুরি কাজ হয় তবে তুমি তাকে নিয়েই থাকো।”

সুপ্রিয় দম নিয়ে বলে, “আমার সবকিছু অসহ্য লাগছে। সবকিছু সহ্য হলেও সম্পর্কের মধ্যে এমন দোলাচল সহ্য হচ্ছে না। কিসের এতো গোপনীয়তা যে আমাকে একটা বার জানিয়ে যাওয়া গেলো না মিনহাজের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছো? বলো?”

কেঁপে উঠলো বিউটি। এমন কর্কশ গলায় সুপ্রিয় কখনোই কথা বলেনি। মিনিট সময় পেরিয়ে গেলেও যখন বিউটি নিশ্চুপ থাকে তখন ভীষণ রেগে দমদমিয়ে পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সুপ্রিয়। বিউটি পেছন থেকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ঠোঁটে কোনো শব্দ আটকে যায়। সুপ্রিয় দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে তাকে উপেক্ষা করে। বিউটি থম মে’রে ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। পেটের এক কোণে চিনচিন করে উঠে। পেটে কেমন যেনো চিরচিরে ব্যথা অনুভব হয়৷ ঠোঁট কামড়ে সহ্য করে বিউটি। আস্তে করে পেট চেপে ধরে উঠে বসে সোফায়। কল লাগায় সুপ্রিয়র ফোনে। কিন্তু রিসিভ হয় না।

#চলবে