প্রিয় প্রেমানল পর্ব-০৩

0
11

#প্রিয়_প্রেমানল
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৩

অনুষ্ঠানের চারপাশে হাসি, আলোর ঝলকানি, আর মানুষের ভিড়। তবু মেহেরের চোখে সবকিছু ঝাপসা লাগছিল। সাজের ভারে ক্লান্ত, মুখে লাজুক একটুকরো হাসি। কিন্তু চোখজোড়া কেবল কারও অপেক্ষায়। একটু পরেই দরজার ফাঁক গলে ভেতরে ঢোকেন মাহফুজ হক। মেহেরের বাবা।

বাবাকে দেখেই বুকের গভীর কোনো কোণে জমে থাকা আবেগ হঠাৎ গলগলিয়ে উঠে আসে। চোখের কোণে জল জমে। ঠোঁটে উঠে আসে হালকা কম্পন। কিন্তু মেহের নিজেকে সামলায়। উঠে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকায় চোখদুটো ছলছল করছে। কিন্তু মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। কাছে গিয়ে একটিবার বাবার হাত ধরে যেন অনেক কিছু বলতে চায়, আবার যেন কিছুই নয়।

মাহফুজ হক মাথায় হাত রাখেন মেয়ের। কিছু বলতে চায় কিন্তু মেহের একটু দূরে সরে যায়।

“চলুন বাবা, একটু বাইরে যাই।”

উৎসবের ভিড় পেরিয়ে দুজনে গিয়ে দাঁড়ায় এক কোণায়। কেক-ফুলে ঢাকা সেই বাগানঘেরা জায়গায়। বাতাসে হালকা শীত। আর সন্ধ্যার আকাশে লালচে আভা।

মেহের মুখ তুলে বাবার দিকে তাকায়। স্বরটা নিচু কিন্তু তাতে জমে থাকা অভিমান, কান্না, আর ক্ষোভ স্পষ্ট

“কেন এই বিয়ে দিলেন আমাকে? আমি নাকি ছয় মাসের বউ এই বাড়ির?”

মাহফুজ হক মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। মুখে কোনো উত্তর নেই, শুধু দীর্ঘশ্বাস। তারপর চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন

“বাবা হিসেবে আমি তো চাইনি এমন কিছু হোক মেহের। কিন্তু কখনো কখনো জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হয় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে। তোমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো এই বোঝাটা তোমাকে দিতে হতো না।”

মেহের ফিসফিস করে, কণ্ঠে চেপে রাখা কান্না

“কিন্তু ছয় মাস? ছয় মাস ধরে আমি একটা চুক্তির বউ? আপনি জানতেন?”

মাহফুজ হক মাথা নিচু করে ফেলেন। কণ্ঠটা এবার কাঁপছে তাঁরও

“জানি। সব জানতাম। কিন্তু আমি জানতাম, তুমি অযথা ভেঙে পড়বে না। তুমি মেহের। যার ভেতরে নিজের জায়গা করে নেওয়ার সাহস আছে।”

মেহের চোখ সরিয়ে নেয়। নরম কণ্ঠে, প্রায় ফিসফিস করে বলে

“এই সাহস তো চাইনি বাবা। শুধু একটু ভালোবাসা, একটু নিরাপত্তা চেয়েছিলাম… আপনি তো জানেন না, সেই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল আমাকে যেন বলে আমি অতিথি, চুক্তির পাতায় লেখা এক মেয়েমানুষ!”

তার গলার শব্দটা ভেঙে যায়। দূরে বাজছে বিয়ের গানের শব্দ, কিন্তু এখানে যেন নীরবতার চাদর।

মেহেরের চোখ তখনও বাবার দিকে। চোখে জমে থাকা হাজারো প্রশ্ন, অভিমান আর কষ্টের ভার। সে আবারও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই মাহফুজ হকের শরীরটা হঠাৎ হেলে পড়ে। এক হাতে বুক চেপে ধরে কাঁপা কণ্ঠে বলেন

“মেহের… একটুখানি… একটু বসি…”

চোখমুখ বিবর্ণ, কপালে ঘাম। মেহের দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ধরে। আতঙ্কে কেঁপে ওঠে তার হৃদয়।

“বাবা! আপনি ঠিক আছেন তো? কেউ একজন… পানি আনুন! চেয়ার দিন!”

চারপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে আসে। মাহফুজ সাহেবকে একটি চেয়ারে বসানো হয়। পাশেই থাকা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় কেউ। মেহের নিজে হাতে পান করায়। চোখে তখন আর কোনো অভিযোগ নেই। শুধু উদ্বেগ আর ভালোবাসা।

“আপনি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন, তাই না? আমি আর কিছু বলব না বাবা, প্লিজ… আপনি শুধু ঠিক থাকুন।”

মাহফুজ হক ম্লান হাসি দেন, মাথা নাড়েন আস্তে করে। বলেন

“তুই রাগ করিস না মা। আমি ভালো আছি। কেবল একটু মাথাটা ঘুরে গেল বুঝি…”

ততক্ষণে অনুষ্ঠানের কেউ এসে মেহেরকে অনুরোধ করে ভিতরে ফিরতে। মাহফুজ হকও মাথা নাড়িয়ে বলেন

“তুই যা মা, অনুষ্ঠানে থাক। আমি ঠিক আছি।”

অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেহের ফিরে আসে ভিতরে। তাকে ইলহামের পাশে বসানো হয়, বর-কনের একসাথে ছবি তোলার পর্ব চলছে তখন।

ইলহাম কেবল চোখের কোণ দিয়ে একবার তাকায় মেহেরের দিকে। কোনো কথা না বলে। মেহেরও চুপচাপ বসে থাকে
মুখে মুখোশের মতো হাসি, কিন্তু ভিতরে ঝড়।

হঠাৎ করেই পাশে এসে দাঁড়ায় এক তরুণ। হাসিখুশি চেহারা, পরনে চকচকে শেরওয়ানি। ইলহামের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন।

“ও ভাই, একটা কথা বলি? ভাবি, আপনি তো জানেন না ইলহাম কিন্তু এক সময় ওর এক্স-গার্লফ্রেন্ডের জন্য পাগল ছিল! সেই মেয়েটার নাম ছিল অরিন উফ, কী পাগলামি করত ও তখন!”

ইলহাম কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে তাকায় বন্ধুর দিকে। ঠোঁট আঁকড়ে ধরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহেরের চোখের পলক কাঁপে। ভেতরের কষ্টটা যেন আবার মুখে চলে আসে।

বন্ধুটি নির্বিকার ভঙ্গিতে হাসতে থাকে

“তবে এখন তো সব পুরনো কথা! আজকের দিনটা একদম নতুন শুরু, তাই না ভাই?”

মেহের নিঃশব্দে তাকায় ইলহামের দিকে। কোনো প্রশ্ন করে না, কিন্তু চোখদুটি বলে” আরো একটা চমক?”

মেহের চুপচাপ তাকিয়ে থাকে ছেলেটির মুখের দিকে। অরিণ এই নামটা যেন হঠাৎ করেই এক মেঘলা বিকেলের মতো আকাশে ভেসে উঠে এসেছে। অথচ এখানে কারো চোখে কোনো মেঘ নেই। বিশেষ করে ইলহামের চোখে।

ইলহাম হালকা হেসে বন্ধুর পিঠে চাপড় দেয়

“ওই পুরনো কথা মনে করিয়ে আবার ছবি তোলার মুড নষ্ট করিস না! এখন তো দেখিস না, আমি কী ভাগ্যবান মেহেরকে পেয়েছি।”

বলতে বলতে সে মেহেরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে মিষ্টি একটা হাসি দেয়। পাশে বসে থাকা মেহেরের হাতটা ধরে নেয় জনসম্মুখে, আঙুলে আলতো চাপ দেয়।

“বলো না মেহের, তুমি তো আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত?”

চারপাশে থাকা অতিথিরা হাসে। কেউ কেউ তালি দেয়। ক্যামেরা ক্লিক করে চলেছে অবিরাম। কেউ একজন বলে

“আহা, কী দারুণ কেমিস্ট্রি!”

মেহের ঠোঁটে হাসি আঁকে। মুখে বলার মতো কিছু নেই, শুধু ভেতরের এক অসমাপ্ত দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে ছটফট করতে থাকে। সেই সঙ্গে অজানা এক অনুভূতি ইলহামের স্পর্শে।

ইলহাম এবার তার মুখের দিকে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে

“সবাই দেখছে, একটু হাসো না, প্লিজ। তোমার এই মুখে রাগ ভালো লাগে না।”

তারপর হঠাৎ করেই মেহেরের কানে চুল সরিয়ে দিয়ে বলে

“আর একটা কথা—তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে আজ। আমার বউ হিসেবে একদম পারফেক্ট।”

তার কথার ভেতরে এক ধরনের কৃত্রিম কোমলতা থাকে। মেহের বুঝে। এই মুহূর্তে তার কোনো কথাই শুধু মেহেরের জন্য না, বরং দর্শকের জন্য। এই ছেলেটা ভীষণ স্মার্ট একটা নাটক মঞ্চস্থ করছে। আর সে? সে যেন কেবল একটা চরিত্র, যার সংলাপ বলা বারণ। মেহের মুচকি হেসে কেবল মাথা ঝাঁকায়।
.

রাত নেমে এসেছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। ঘরটা এখনও নতুন ফুলের গন্ধে ভরা। বাসর ঘরের সাজ। অথচ আবহটা যেন ঠান্ডা বরফের মতো।

মেহের বিছানার এক পাশে বসে আছে। হালকা গোলাপি শাড়ি। খোলা চুল। সাজগোজ না থাকলেও মুখে যেন এক ধরনের অভিমানী সৌন্দর্য। তবুও চোখের গভীরে ক্লান্তি, একরাশ না বলা প্রশ্ন।

দরজাটা খুলে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢোকে ইলহাম। তার চোখে-মুখে কোনো আবেগ নেই। গলায় নেই কোনো উষ্ণতা। কেবল ক্লান্ত, কড়াভাবে বলে

“তোমার হয়তো কিছু ভুল ধারণা হয়েছে অনুষ্ঠান দেখে। মানুষ যা দেখে, তাই বিশ্বাস করে। আমিও সেটা জানি। তাই অভিনয়টা করলাম। যাতে কেউ কিছু না বোঝে।”

সে সামান্য থামে। তারপর আবার বলে

“আর হ্যাঁ, অরিণের কথা যে উঠে এসেছিল। ও আমার জীবনের একটা অধ্যায় ছিল। যা আমি চাইলেও মুছতে পারি না। তবে আমি তা নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে রাজি না। কারণ এই সম্পর্কটা এমনিতেই চুক্তিভিত্তিক, অনুভূতির ভিত্তিতে না।”

মেহের স্তব্ধ। তার ঠোঁট নড়ে না, চোখ শুধু কিছু বোঝার চেষ্টা করে। ইলহাম এবার বিছানার মাঝখানের ফুলগুলো এক এক করে সরিয়ে ফেলে। ঠাণ্ডা গলায় বলে

“এই সাজানো মঞ্চে অভিনয়টা বাইরের জন্য যথেষ্ট। ভেতরে সেটা চালিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।”

আলমারি থেকে একটা সাদা চাদর টেনে আনে সে। বিছানার এক পাশে বিছিয়ে নেয়। তারপর বলে

“তোমাকে আমি আজ রাতে এখানে থাকার জন্য বলবো না । ছয় মাস, এই সময়টা শুধু একটা নিয়ম। তুমি চাইলে আজই তোমার আলাদা ঘরে চলে যেতে পারো।”

বলেই সে রিমোট হাতে নেয়, লাইট অফ করে দেয়। ঘরটা নিঃসঙ্গ অন্ধকারে ভরে যায়।

কিন্তু মুহূর্ত পরেই “টিক” করে লাইট আবার জ্বলে ওঠে।

ইলহাম চোখ তুলে দেখে মেহের চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সুইচ বোর্ডের পাশে। সে পুনরায় রিমোট টিপে লাইট অফ করলে মেহের আবারও জ্বালিয়ে দেয়। ইলহামের ভ্রু কুঁচকে যায়। সে কিছু বলার আগেই মেহের টেবিল থেকে তার ফোনটা নিয়ে গটগট করে হেটে যায় গেস্ট রুমের দিকে। মুখে স্পষ্ট রাগ। লাইটাটও অফ করেনি সে। ইলহাম উঠে বসে। মাথা নাড়িয়ে বিরবির করে

” মানে…. ডাল ভাত। ক্ষুদার জন্য সহ্য হজম করলাম শুধু। ”

একথা বলেই ইলহাম রাগ সমেত এগিয়ে যায় সুইচ বোর্ডের দিকে। তখনই খেয়াল হয় সে উঠে এলো কেন? হাতেই তো ছিল রিমোট।

চলবে….