#প্রিয়_প্রেমানল
#আলিশা_আঞ্জুম
পর্ব ৪
কিভাবে যেন কাটলো পাঁচ দিন।এই পাঁচটা দিন এক ছাদের নিচে থেকেও যেন দুজন ছিল দুই ধ্রুব তারার মতো।অভিমানে, নির্লিপ্তিতে ঘেরা। কথার বদলে নীরবতা ছিল। স্পর্শের বদলে শীতল বাতাস। তবে তবুও, তাদের নীরব যুদ্ধ, ঠাস ঠাস করে দেখানো রাগের ভেতরে ভেতরে কিছু একটা যেন জমছিল, কুয়াশার মতো, অপার ব্যাখ্যাহীন কিছু।
সেদিন সকালটা ছিল অন্যরকম। রান্নাঘরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর হাঁড়ির সাঁই সাঁই শব্দে যখন দিন শুরু হচ্ছিল। তখন ইলহাম রান্নাঘরের ফ্রিজে পানির খোজে গিয়ে ভুল করে পেছনে ঘুরতেই মেহেরের হাতে ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কায় মেহের দ্রুত হাত সরিয়ে নিতেই ইলহামের হাত পরে গরম হাড়িতে। গরম ভাতের ভাপ ছুঁয়ে যায় হাত।
“আহ্!”
শব্দটা বেরিয়ে আসে আপনাতেই।
“সাবধানে থাকলেই তো হয়!”
মেহের বলে ওঠে, মুখে কেমন এক চেপে রাখা উদ্বেগ।
তাদের চোখ দুটো এক মুহূর্তে জড়িয়ে যায়।
ইলহাম প্রথমবার দেখল এই চোখদুটোতে শুধুই অভিমান নয়, একটা শূন্যতা আছে। কষ্ট জমেছে বৃষ্টির মতো।সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেহের পেছন ফিরেই বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।
এভাবে যেন কেটে যেত আরও পাঁচটা দিন।
কিন্তু সেই সন্ধ্যায় নেমে আসে অজানা অন্ধকার।
হঠাৎ বাজে ফোন। মেহের নিজ ফোনের কাছথেকে দ্রুত পৌছায়। এহানের সঙ্গে বসে গল্প করছিল সে। সে তাড়াহুড়ো করে ধরে
অপর প্রান্তে আত্মীয়ের কাঁপা কণ্ঠ, আর একটা বাক্য
“তোমার বাবা… নেই।”
শব্দটা যেন আকাশ ফুঁড়ে পড়ে মেহেরের মাথায়। একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সে কোনো শব্দ করতে পারল না। ফোনটা পড়ে গেল হাত থেকে, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চোখ দুটো বিস্ফারিত, ঠোঁট কাঁপছে।
ইলহাম তখন ড্রইংরুম থেকে এসে দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে যায় থমকে।সে কখনো মেহেরকে এভাবে দেখেনি।
“মেহের?”
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। মেহের কিছু বলে না। শুধু হঠাৎই ধপ করে পড়ে যায় মেঝেতে। ইলহাম ছুটে গিয়ে ধরে ফেলে তাকে। তার নিঃস্পন্দ মুখটা নিজের বুকে চেপে ধরে সে চিৎকার করে ওঠে
“মেহের! চোখ খুলো! প্লিজ!”
তাকে সেই রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ডাক্তার বলে
“চরম শকে গেছে মেয়েটা। এখনই মানসিকভাবে পাশে থাকা দরকার। খুব ইমোশনালি ভেঙে পড়েছে।”
ইলহাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল কাচের দরজার ওপারে। মেহের চোখ খুলেই এলোমেলো শাড়িতে দৌড়ে বেরিয়ে যায় হসপিটাল থেকে। ইলহাম পেছনে ছোটে। মেহের বাবা বাবা বলে চিৎকার করতে থাকে। ইলহাম কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে দ্রুত ব্যাস্ত শরক থেকে মেহেরকে ফিরিয়ে এনে গাড়িতে বসায় জোর করে। ইলহামের হৃদয়টাকে কেমন মোচড় দিয়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে মেহেরের কান্না। মনে পড়ছে মেয়েটার হাসিমাখা মুখ। বাগানের খুনশুটি এহানের সঙ্গে যা সে প্রায়ই দেখতো অনিচ্ছা নিয়ে।
মেহের তার বাবার নিথর দেহ দেখে পাগল প্রায় হয়ে যায়। সেদিন নেমে আসে একটা শোকাবহ ক্ষণ। ইলহাম কাঁপা হৃদয় ও কাঁপা হাতে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনো ঠিক করে দেয় শাড়ির আঁচল। পাশেই বসে থাকে। তার দাদা দাদি আসে। ওনারা কান্নায় ভেঙে পরেন।
.
রাত গভীর। নিঃস্তব্ধতার মাঝে একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল ইলহামের কানে। দরজার ফাঁক গলে চোখ রাখতেই তার দৃষ্টিতে পড়ে মেহেরের দিকে। বাবার একটা ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদছে। নিঃশব্দে, ভাঙা কণ্ঠে যেন নিজের অস্তিত্বকে ছেঁড়াফেঁড়া করে দিচ্ছে।
ইলহাম দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখে ভেসে ওঠে সেই পুরোনো দৃশ্যগুলো। কেন এই বিয়ে?
কেন সে এই সম্পর্কের বন্ধনে জড়াল?
ইলহাম মেহেরকে বিয়ে করেছে শুধুমাত্র তার দাদার চাপের কারণে। দাদা স্পষ্টভাবে বলেছিল, “এবার যদি বিয়ে না হয়, তাহলে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে এবং কোম্পানিও চলে যাবে।” তাছাড়া, ইলহাম প্রেমের ব্যাপারে ভয় পায়। একসময় সে গভীরভাবে প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সেই সম্পর্কের পরিণতি ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, যা তাকে ভেঙে দেয়। সেই থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রেমের প্রতি তার আর কোনো আস্থা নেই।
তাহলে, মেহেরকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের মাধ্যমে বিয়ে করা ছিল তার জন্য একমাত্র উপায়। মেহেরের বাবা ইলহামের কাছ থেকে বিশ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিল, আর সেই ঋণ শোধ করার জন্য এই বিয়েটি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। প্রথমবার যখন ইলহাম মেহেরকে দেখেছিল, তার মধ্যে কোনো বিশেষ অনুভূতি জাগেনি, তবে মেহেরের শান্ত, গম্ভীর স্বভাব তার কাছে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল। সে বুঝতে পারে, মেহেরের প্রতি তার অনুভূতি কেবল একটি চুক্তির ফলাফল, কিন্তু মেহেরের নির্লিপ্ত আচরণে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
.
কেটে যায় তিনদিন। মেহের অসুস্থ হয়ে পড়ে বাবার মৃত্যুর কারণে। উপরন্তু তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত। তবে এরইমাঝে ইলহামের কিছু পরিবর্তন চোখে পরে। তবে তা কি? সহানুভূতি কিনা কে জানে। দুপুরে যখন নিজ ঘরে শুয়ে ছিল মেহের তখন ইলহাম দেখতে আসে তাকে। পানির জন্য মেহের হাত বাড়ায় পাশের টি টেবিলের দিকে।
ইলহাম নিজ হাতে মেহেরকে পানি খাওয়ায়। যেন মনে মনে চায় মেহেরের বোবা কান্নার সঙ্গী হতে।
ইলহাম অফিসে গেলেও ফোন করে জানতে চায় “সময়মতো ওষুধ খেয়েছো?”
মেহের ছোট করে উত্তর দেয়
“হ্যাঁ।”
কিন্তু অজান্তেই তার কণ্ঠে থাকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যা কোনোদিন ছিল না এ বাড়িতে।
.
এক সন্ধ্যায়, মেহের বারান্দায় বসে।হাতে এক কাপ চা, চোখে নির্লিপ্ত অন্ধকারের দৃষ্টি। পেছন থেকে ইলহাম আসে, তার পাশে বসে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হঠাৎ বলে
“ প্রথম দিকের ব্যাবহার গুলোর জন্য সরি।”
মেহের চমকে তাকায়। তবে কিছু বলে না। ইলহাম আবার ইতস্তত নিয়ে বলে
“ যে কোন কিছু… দরকার হলে আমাকে জানাবে। “
.
দুপুরবেলা। বারান্দায় বসে মেহের চা বানাচ্ছে দাদি শাশুড়ির জন্য।মেঘলা রোদ, নরম বাতাস সবকিছুতেই এক ধরনের বিষণ্নতা।
কথার ফাঁকে হঠাৎ দাদি গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“ইলহাম তো খুব ছোটবেলায় প্রেম করেছিল জানিস? তখন কলেজে পড়ে।
মেহের যদিও জানে এসবের একটু একটু। তবুও চুপ রইলো সে।
“ খুব সুন্দর আর শান্ত একটা মেয়ে। ইলহাম ওকে চোখের মণির মতো ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায় হঠাৎ করে, হঠাৎ। ইলহামের এক বন্ধুর সঙ্গে। সেদিন থেকে ওর ভেতর কিছু একটায় তালা পড়ে যায়। আর কেউ তাকে ভালোবাসতে পারেনি, এমনকি সে নিজেকেও না।”
মেহের থমকে যায়।
চায়ের কাপের চামচটা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যায় ট্রেতে।
“তোর শ্বশুর মারা যাওয়ার পর, এই এক ছেলেই তো ছিল আমার শক্তি। কিন্তু সে যে কতটা একা হয়ে গেল, তা বুঝতে পারিনি। শক্ত হয়ে গেল, চুপসে গেল। ভালোবাসা যেন ভুলেই গেল!”
দাদি চা হাতে নিয়ে চলে যান।
মেহের বসে থাকে একা, নিস্তব্ধ বারান্দায়।
এক অদ্ভুত অনুভূতি জমে উঠতে থাকে বুকের গভীরে। তবে কেন এই খারাপ লাগা? তাকে তো ইলহাম কোনোদিন ভালোবাসে না।
তাদের তো এই বিয়ে একটা চুক্তি ছিল!
হ্যাঁ… মেহের যেন হঠাৎ ভুলেই গিয়েছিল সেই কথাটা। তাদের এই এক ছাদের নিচে থাকা, কথা বলা, হঠাৎ দোখা হলে আজকাল দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়া সবকিছুই একটা চুক্তির শর্ত পূরণের জন্য।
তবুও কেন এত খারাপ লাগছে আজ?
কেন মনে হচ্ছে… ইলহাম যদি কাউকে ভালোবাসে, তাহলে সেটা সে না হয়ে, অন্যকেউ
এই বেদনার কারণ?ঘরে ফিরে আসে মেহের।
ইলহামের টেবিলে রাখা বই, কলম, ফাইল দেখে বুকটা ধ্বক করে ওঠে।
.
সেই রাতটায় মেহের ঘুমাতে পারে না।বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু ভাবতে থাকে পাশের ঘরে থাকা মানুষটা সে কি সত্যিই তার হবে না কখনো? কোনো উত্তর নেই।
শুধু প্রশ্ন, কষ্ট, আর একটা নীরব ভালোবাসা… যেটার জন্ম হতে যাচ্ছে শুধু একপাক্ষিক নয়, বরং এক অস্পষ্ট অসম্পূর্ণতায় ভরা প্রেমের ভেতর।
চলবে…