#প্রিয়_প্রেমানল
#আলিশা_আঞ্জুম
শেষ পর্ব
ইলহাম অফিসে গিয়েও মনটাকে কাজে বসাতে পারছিল না। সবার চোখ এড়িয়ে বারবার ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছিল সে। শেষে আর নিজেকে আটকাতে না পেরে ফোন করেই বসে
“এহান কি করে?”
ওপাশে খানিক নীরবতা। মেহেরের গলা মনে গেথে থাকে এক টুকরো অভিমান। তবুও বলে
“ওর রুমে আছে মনে হয়। কথা বলবেন?”
“ হুহ! নাহ, ঠিক আছে।”
এরপর আর কথা খুঁজে পায় না ইলহাম। অনেক্ক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। মেহের বলে জড়তা নিয়ে
“ আর কিছু… বলবেন?”
“নাহ।”
জবাব দেয় ইলহাম। অতঃপর ফোন কাটে মেহের। ইলহামের বুকের ভেতর হালকা এক খচখচে ব্যথা জন্ম নিল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায়। অথচ সে বুঝতেই পারল না কেন এতটা আনুষ্ঠানিক হয়ে উঠল কথাগুলো।
অন্যদিকে, মেহের ফোন রেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। বুকের ভিতর কোথাও যেন চেপে বসেছে অদৃশ্য কিছু। ভেবে নেওয়া অবহেলার আর অভিমান তাকে আর টিকতে দিল না।
সে ঠিক করল আজই সে চলে যাবে এই বাড়ি থেকে। কারো কিছু বলবে না। নিজের মতো করে হারিয়ে যাবে।
একটা ছোট্ট চিঠি লিখল সে
“ চুক্তির সম্পর্ক, এটা এখানেই শেষ করা উচিত। আমি চলে যাচ্ছি। খুঁজবেন না আমাকে কোথাও। আমি আসলে কারো বোঝা হতে শিখিনি। আপনি কি উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিলেন জানি না। কিন্তু আমি এই সল্প দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক চাই না।”
চিঠিটা সে ইলহামের ঘরে টেবিলে রেখে আসে। অতঃপর চলে যায় এহানের ঘরে। মাঝে মাঝে এহান তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। একটা ভাই-বোনের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক ভাবাবে মেহেরকে।
মেহের এহানের পাশে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। কিছু গল্প হলো। পরিশেষে আদর করে এহানের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল
“ভালো থেকো, এহান। খেয়াল রেখো নিজের।”
এহান হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ভাবির দিকে। কিন্তু বোঝে না কিছু। তবুও প্রশ্ন করে
“ কেন? তুমি কোথাও যাবে?”
“হুম।”
“কোথায়?”
“দেখি কোথায় যাওয়া যায়।”
তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় মেহের। নিজ ঘরে পা বাড়ায়। দুপুরের সময় হলে এক কাপড়েই সে বেরিয়ে যায় বাবার বাড়ির দিকে। যদিও হবে বাড়িটা ফাঁকা। শুধু শুকনো পাতার সন্ধান মিলবে।
.
সন্ধ্যাটা আজ একটু অন্যরকম। অফিস থেকে ফেরার পথে ইলহাম হঠাৎ থেমে গেল এক ফুলের দোকানে। হাতে তুলে নিল একটা ছোট্ট ফুলের তোড়া গোলাপ, বেলি আর হালকা নীল জারবেরা। নিজেই হাসল মৃদু করে। বিরবির করলো
“আজ বলে দেব সবটা… আর না চাপা থাকুক কিছু।”
ফুলটা যত্ন করে হাতে ধরে ঘরে ঢুকল সে।
কিন্তু দরজার গা ঘেঁষে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ঘর নিস্তব্ধ। একটা অদ্ভুত খালি খালি অনুভূতি ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মেহের কোথায়?
সে এহানকে খুঁজতে গেল। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। ইলহাম ফিরে যায় নিজ ঘরে। আর তখনই দেখা মেলে একটা ভাজ করা কাগজের। ইলহামের
.
মেহের নির্জন ঘরে বসে ছিল বহুক্ষণ। চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর যেন বৃষ্টি পড়ে থেমে থেমে। একটু পর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। আয়নার সামনে গিয়ে তাকিয়ে রইল নিজেকেই
“এই আমি… কেন আমি বারবার ভেঙে পড়ি? না, এবার আর না। এবার নিজেকে নতুন করে গড়তে হবে।”
বাইরে বের হয়ে এল সে। তাদের এই বাড়িটা যেন গ্রামের মতোই। উঠোন, পাশে সবুজ ক্ষেত, মৃদুমন্দ বাতাস সর্বক্ষণ। উঠোনে আছে দুই একটা ফলের গাছ।
পেয়ারা গাছটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেল মেহের। স্মৃতির পাতায় বাবার হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠল। ছোটবেলায় বাবা নিজ হাতে এই গাছটা লাগিয়েছিলেন।
তারপর সে হাত বাড়িয়ে একটা মাঝারি আকারের কাঁচা-পাকা পেয়ারা পেড়ে মুখে তুলে নিল।
চিবোতে চিবোতে চোখের কোণে জল জমলো তার।
মেহের মনে মনে ঠিক করল সে আর ফিরে তাকাবে না। নিজের জন্যই তাকে বাঁচতে হবে।
.
নিশুতি রাত। চারদিকে ঘন নীরবতা। দূরের কুকুরের একঘেয়ে ডাকে মাঝেমাঝে ছেদ পড়ছে। মেহের বিছানায় ঘুমুতে পারছিল না। বড় চাচি একটু আগে এসে বলে গেলেন ওনার ছোট মেয়ে দিন কয়েক থাকবে মেহেরের সঙ্গে , এই ভেবেই তার মনটা অকারণে খুশি খুশি লাগছিল। একা এক বাড়িতে থাকতে একটু ভয়ই লাগে।
হঠাৎ ইচ্ছে হলো উঠোনে গিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়াটা একটু গায়ে মেখে আসা যাক। চুপচাপ পা টিপে টিপে সে চলে এলো উঠোনে। আকাশের তারা গোনা শুরু করেছে ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা মৃদু শব্দ। কে যেন গেইট খুলে এগিয়ে এলো। মেহের ঘুরে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোয় আবছা একটা ছায়ামূর্তি দেখা যায়। ছেলেমানুষ। আত্মাটা শুকিয়ে গেলো।সে চিৎকার করতে যাবে এমন সময় ছায়ামূর্তিটা মুখে হাত চেপে ধরে।
“চুপ! আমি ইলহাম।”
মেহেরের চোখ বিস্ফারিত, ধরা গলায় বলে,
“আপনি কি পাগল! এইভাবে কেউ আসে?”
ইলহাম ফিসফিস করে,
“ আর কিভাবে আসবো? তুমি যেভাবে এসেছো চুপচাপ আমিও সেভাবে আসলাম।”
মেহের ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
“ আমি কিভাবে এসেছি?”
“বাদ দাও। এটা বলো তুমি স্বামীকে রেখে এখানে কেন?”
মেহের অবাক হয় কিছুটা। খুবই সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে ইলহাম। মেহের মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, রাগ বা দুঃখ থেকে চোখের কোনা ভিজে যাচ্ছে অজান্তেই।
পেছন থেকে ইলহাম ধীরে ধীরে বলল
“মেহের… আমি জানি, শুরুটা ভুল ছিল।
এই সম্পর্কটা চুক্তির ছিল কাগজে কলমে, নিয়মে বাধা। কিন্তু কিছু অনুভব নিয়ম মানে না, বুঝো?
তোমার চুপ করে থাকা, হঠাৎ রাগ, হাসি সব কিছুতেই আমি জড়িয়ে গেছি। আমি কখন যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি, বুঝতেই পারিনি।”
মেহের ধীরে ধীরে মুখ ঘোরাল। চোখে ভেসে উঠেছে বিস্ময় আর কিছুটা অবিশ্বাস। ইলহাম এক পা এগিয়ে এসে বলল
“তুমি একটুর জন্য উধাও হয়েছো তাতেই আমার মনে হয়েছে, তুমি না থাকলে আমি অপূর্ণ।
আমি চাই, চুক্তি থাক বা না থাক, এখন থেকে প্রতিটি সকাল শুরু হোক তোমার পাশে। চলো মেহের, নতুনভাবে শুরু করি। এইবার ভালোবাসা দিয়ে শুধু ভালোবাসা।”
মেহের কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ইলহাম ধীর গতিতে মেহেরের হাতটা ধরে। খুবই আলতো করে। বলে পুনরায়
“ফিরিও না আমাকে। আমি তেমাকে বুকে রেখে জীবন পার করতে চাই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
মেহের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বারান্দায় বসে। চোখের পানি মুছে সেখান থেকেই বলে
“কখনো আমাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আমাকে হৃদয় ভাঙা যাবে না। আমার বাবা যেভাবে যত্ন করে আমাকে মানুষ করেছে সেভাবে আমাকে যত্ন করে রাখতে হবে। পারবেন?”
ইলহাম এগিয়ে যায় মেহেরের নিকট। পাশে বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে
“ ওয়াদা করলাম। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে আগলে রাখবো।”
মেহের অতঃপর ইলহামের হাত ধরে কাঁপা হাতে। বলে চোখটা বন্ধ হয়ে ফিসফিস করে
“ আমিও ভালোবাসি আপনাকে।”
রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। চারদিকে নিঃশব্দ ছায়া নেমে এসেছে। আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছিল উঠোনে। মেহের এসে বসে ছিল একা, নিঃশব্দে। ইলহাম অনেকদিন পর বুক ভরে শ্বাস নেয়। মেহেরের মাথা রাখে নিজ কাঁধে। অতঃপর
সে বলতে থাকে নিজের গল্প। তার শৈশব, কষ্ট, প্রথম স্কুলের দিন, মায়ের চোখের অশ্রু, বাবার অনুপস্থিতি, একা একা বড় হওয়া, বুকের ভেতর জমে থাকা শত শব্দহীন কথোপকথন।
মেহের চুপচাপ শুনে যায়। বাতাসে শুধু পাতার মৃদু শব্দ, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসা রাতজাগা পাখির ডাক।
তারার নিচে দুইটা ছায়া পাশাপাশি বসে থাকে। আর প্রকৃতি চুপচাপ সাক্ষী হয়ে থাকে, নিঃশব্দ ভালোবাসার।
সেই রাতে, দুটো মানুষ, দুইটা কাঁধ, আর একটা চাঁদ। সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অসম্ভব সুন্দর নীরবতা, যেটা কোনো শব্দে লেখা যায় না।
সমাপ্ত