#প্রিয়_প্রেমানল
#আলিশা_আঞ্জুম
সূচনা পর্ব
“বিয়েতে কিছু শর্ত জুড়ে দিলাম আমি। এই বিয়েটা শুধুমাত্র নামে বিয়ে। তাছাড়া তুমি তোমার মতো আর আমি আমার মতো থাকবো। কেউ কারো ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না।”
সকালের খাবার টেবিলে ইলহাম যখন মেহেরকে এমন কথা বলল, তখন মেহের শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে।
কিন্তু সত্যি কথা বলতে, সে অবাক হয়নি। কারণ এই বিয়ে যে ছিলো একটা চুক্তি—সেটা আগেই জেনেছে। গত রাতে। যদিও মেহেরের বাবা কিছুই জানাননি তাকে, এক কথায় বলেছিলেন,
“ছেলেটি ভদ্র, দায়িত্ববান। তুমি ভালো থাকবে।”
ভালো থাকার সংজ্ঞা যে এমন হয়, সেটা মেহেরা জানতো না।
বসর রাতের নাম করে যখন সবাই সরে গিয়েছিল, তখনই ইলহাম বলেছিল
“আমাদের এই সম্পর্কটা কাগজে-কলমে থাকবে। শুধু দায়িত্বের খাতিরে। কিছু আশা কোরো না, কারণ আমার জীবনে ভালোবাসা বলে কিছু নেই।”
সে শুধু মাথা নেড়েছিলাম। হয়তো কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু সেটা দেখানোর মতো অধিকার তার ছিল না।
চেয়েছিল একটা নতুন জীবন। কিন্তু সেটা শুরুই হলো এক গাদা নিয়ম আর শর্তের দড়িতে বাঁধা পড়ে।
.
মেহের ধীর পায়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। মুখে কিছু বলল না, চোখেমুখে কোনো অভিব্যক্তিও ফুটে উঠল না। যেন সব স্বাভাবিক, অথচ ভেতরে চলছিল ঝড়। তার পেছনে কানে এলো ফিসফিস শব্দ
“বউমার তো বেশ গোঁসা মনে হচ্ছে।”
“এইসব মেয়েই তো এখন চুক্তিতে বিয়েও করে, আবার ভালোবাসারও আশা রাখে।”
“ইলহাম সাহেব তো খামোখা ঝামেলায় জড়ালেন!”
মেহের থেমে গেল এক মুহূর্ত। কিছু বলল না। শুধু একবার পিছন ফিরে চাইল।তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।
তার চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর জমে উঠছে কথার পাহাড়। বাবার দেওয়া সেই আশ্বাসভরা মুখটা ভেসে উঠল মনে
“তুই সুখে থাকবি মা।”
সুখ? এটাই যদি সুখ হয়, তবে কষ্ট কাকে বলে?
সে বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিচে নামতেই হঠাৎই তার পথ রোধ করল এক টিনএজ ছেলে। হাসিমুখে বলল
“ভাবি…”
মেহের থমকে দাঁড়াল। ছেলেটার চোখে কৌতূহল আর কাঁচা সারল্য।যেন কোনো গল্পের চরিত্র হয়ে সামনে এসেছে।
“তুমি কে?”
ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলল
“আমি এহান। এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট আর সবচেয়ে স্মার্ট সদস্য। আর আপনি এখন থেকে আমাদের ভাবি, তাই না?”
মেহের প্রথমবারের মতো হালকা হাসল। এমন একজনের সঙ্গে দেখা, যে অন্তত হাসি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে তাকে।
এহান দুষ্টু-মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
“চলেন ভাবি, আপনাকে আমাদের বাগানটা দেখাই। ওইদিকটা একদম রাজপ্রাসাদের মতো। আমি সারাদিন ওখানেই খেলি। কিন্তু বেশি না। ইলহাম ভাইয়া বকে।”
মেহের এক মুহূর্ত দ্বিধায় পড়ে গেল। এই বাড়িতে কেউ এখনো তাকে মন থেকে গ্রহণ করেনি। অবশ্য মেহের শুনেছে ইলহামের মা বাবা নেই। দাদা-দাদির নিকট বড় হয়েছে। পরবর্তীতে দাদার ব্যাবসা সামলাচ্ছে সে সফলভাবে। তারপরও এতো এতো কাজের মানুষের ভীরে এহান ছেলেটিই প্রথম যে ‘ভাবি’ বলেই স্বাভাবিক আচরণ করছে। কিন্তু মেহের কি সঙ্গে যাবে এখন? কিন্তু না করতেও মন সায় দিচ্ছে না। ছেলেটা যেভাবে আঁকড়ে ধরেছে মেহেরের শাড়ির আঁচল যেন মনে হয় বহুদিনের বন্ধনের সুর বোনা আছে।
একটু নরম গলায় মেহের বলল
“আচ্ছা, চলি তাহলে।”
বাড়ির পাশ দিয়ে একটা লম্বা কাঠের পথ গিয়ে মিলেছে এক বিলাসবহুল বাগানে। যেন কেউ মুঠো ভরে প্রকৃতিকে সাজিয়ে রেখেছে সেখানে।জারুল ফুলের গাছে হালকা বেগুনি ছায়া। নিচে ঝরে পড়া পাঁপড়িগুলো যেন স্বপ্নের কার্পেট। শিউলি ফুলের ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যা ভোরের মতো কোমল। বেলি ফুলের লতাগুলো ছাদের পাশে জড়িয়ে আছে, যেন কানে কানে কিছু বলছে।
মেহেরের পা হঠাৎ থেমে গেল।
সে এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎই চোখের কোণে জমে উঠল অশ্রু। তিন মাস আগে তার মা চলে গেছেন নিঃশব্দে, ক্যান্সারের সঙ্গে হার মেনে।
তখন এই বেলি ফুলই মা’র চুলে গুঁজে দিতেন, বলতেন
“তোর চুলে বেলির গন্ধ থাকলে, মনটা ভালো লাগে রে।”
মেহেরের ঠোঁট কেঁপে উঠল।
সে চোখ মুছল, যেন কেউ কিছু বুঝতে না পারে।
এহান পাশে এসে বলল
“ভাবি, আপনি কাঁদছেন? আমি কিছু বলেছি কি?”
মেহের হালকা মাথা নাড়ল, “না, এমনিই… মনে পড়ে গেল কিছু কথা।”
তখন এহান আর কিছু না বলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গেল। হয়তো ছেলেটা বুঝে গেছে—সব হাসির আড়ালেই একটা না বলা কান্না থাকে।
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া যখন ধীরে ধীরে বাগান ছুঁয়ে ঘরে ফিরে এল, মেহের তখনো কিছুটা ভারমুক্ত মন নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল।
ইলহাম বসে আছে সোফায়, হাতে কিছু ফাইল। তার চোখে মুখে স্থিরতা, ঠোঁটে একটুও কোমলতা নেই—যেন এই বাড়ির প্রতিটি দেয়ালই তার মতো কঠিন।
মেহের চুপচাপ পেছনের দিকে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কী এক অদ্ভুত সাহসে থেমে গেল। গলায় চাপা কাঁপন নিয়েই বলল,
“বিয়েটা কেন করা হয়েছে আমাকে?”
ইলহাম ধীরে চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। যেন এমন প্রশ্ন আশা করেনি সে। অথবা, খুব স্বাভাবিকভাবে, এই প্রশ্নের মূল্য নেই তার কাছে।
মেহের দাঁড়িয়ে রইল এক অদ্ভুত দৃঢ়তায়।
গতরাতে সে প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল। হয়তো আতঙ্কে, হয়তো অবিশ্বাসে।
ইলহাম অবশেষে বলল,
“আমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য?”
মেহেরের চোখে এক ঝলক কষ্ট ঝলকে উঠল,
“না, বাধ্য না। আমিও তো এই বিয়েতে রাজি ছিলাম না। শুধু… একটা ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম।”
ইলহাম আবার ফাইলের দিকে ফিরে তাকাল। যেন এই প্রশ্ন কোনো গুরুত্বই রাখে না তার জীবনে।
তবুও, তার কণ্ঠে এবার একটুখানি শীতল রাগ মেশানো ছিল
“তোমার বাবা আমার বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছেন। এই বিয়েটা ছিল একটা রফার অংশ।
তুমি সেই চুক্তির অংশ।আর কিছু না।”
মেহেরের মুখ এক মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে আর কিছু বলল না। শুধু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, খুব নিঃশব্দে, কিন্তু ভেতরে হাহাকার নিয়ে।
.
বাড়িটা ছিল বিশাল।দেয়ালে দামি পেইন্টিং, মেঝেতে বিদেশি কার্পেট, আর একেকটা ঘর যেন ছোটোখাটো রাজপ্রাসাদ।
তবুও এত ঐশ্বর্যের ভেতরে, মেহের নিজেকে যেন এক চুপচাপ কারাগারে আবদ্ধ মেয়ের মতো লাগছিল।
সে ধীরে ধীরে একটা ফাঁকা ঘরে গিয়ে বসে পড়ল। নরম সোফায় শরীর এলিয়ে দিলেও মনটা যেন পাথরের মতো ভারী।
তার চোখ থেকে টুপটাপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কোনো শব্দ নেই, শুধু কান্নার এক নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ঘরটাকে ভার করে তুলল।
এমন জীবন তো সে চায়নি।
বিয়ের মানে সে শিখেছিল মায়ের কাছে—ভরসা, ভালোবাসা আর সম্মানের বন্ধন। আর বাবার নামে ছিল তার অগাধ বিশ্বাস।
“তুই ভাবিস না মা, আমি তোর ভালো ছাড়া কিছুই চাই না।”
কথাগুলো বারবার কানে বাজছিল, কিন্তু বাস্তবতা যেন ছুরি হয়ে বিঁধছিল হৃদয়ে।
মেহের ধীরে ফোনটা বের করল। স্ক্রিন জ্বলজ্বল করছে, কল লিস্টে শুধুই একটি নাম “আব্বু”
সকাল থেকে সে অনেকবার ফোন করেছে, কিন্তু একবারও কল তোলা হয়নি।
আবারো ডায়াল করল সে। কান পাতল…
“এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দয়া করে আবার চেষ্টা করুন। ”
মেহেরের কণ্ঠে তখন ফিসফিস করে বেরিয়ে এলো—
“আপনি তো বলেছিলেন, আমার কিছু হবে না… তাই না আব্বু?”
সে ফোনটা বুকের ওপর চেপে ধরল। কান্না আর অভিমানের এক বিষাদঘন নীরবতা ভর করে রইল ঘরজুড়ে।
চলবে….