প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০১

0
96

#প্রিয়_বিকালফুল
#তানিয়া_মাহি
#সূচনা_পর্ব

মেজর মুবতাসিম ফুয়াদ উৎস বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ গাড়ির সামনে নববধূ সাজে লাল টকটকে জামদানি শাড়ি পরিহিতা নারী ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় ছিঁটকে পড়ল।

রাস্তা থেকে তাড়াতাড়ি করে উঠে মেয়েটি ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর বারবার শুকনো ঢোক গিলছে। চোখে মুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তাকে অস্থির দেখাচ্ছে ভীষণ। অনেকটা সময় দৌঁড়ানোর ফলশ্রুতিতে মাথায় করে রাখা শক্ত খোপাটা খুলে লম্বা, ঘন কেশ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে। কপাল থেকে ঘাম বেয়ে গলা অবধি ঝরছে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়ার দরুণ বুক উঠানামা করছে। মেয়েটির নাম ক্যামেলিয়া কায়নাত নিতু। বয়স অনুমান করা ভীষণ কঠিন৷ দেখে যতটুকু বোঝা যায় তার বয়স একুশ-বাইশ হয়তো হবে কিন্তু তার সঠিক বয়স কত হতে পারে তার ধারণা করা মুশকিল। পূর্ণ যৌবনা সে। গায়ের রঙ দুধে আলতা। গালে, চোখে মেকাপের প্রলেপ পড়ায় সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। ভয়ের কারণে মুখটা রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। সে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি থেকে দুজন ব্যক্তি সাথে সাথে নেমে এসে তার সামনের দিকটায় দাঁড়িয়েছে সেটা সে খেয়ালই করেনি।

মেজর মুবতাসিম ফুয়াদ উৎস মাত্রই ছুটিতে বাসায় ফিরছিল৷ গতকাল নিজ বাসা থেকে তার সাথে যোগাযোগ করে জানানো হয়েছে তার মা ফরিনা বেগম রীতিমতো খুব বেশি অসুস্থ। মায়ের আরোগ্য লাভের কোন খবর সারাদিন না পেয়ে বিকেলের ফ্লাইটে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল সে। বহির্দেশীয় সেনাদের সাথে তিনদিনের একটা আলোচনা সভার প্রয়োজনে দেশের বাহিরে যেতে হয়েছিল তাকে। এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পর থেকে যতটুকু সময় বাড়ি পৌঁছতে প্রয়োজন তারও অধিক সময় লেগে গিয়েছে। সন্ধ্যা পরপর বাসায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল তার জন্য। মাঝপথে গাড়ি একবার খারাপ হয়ে যাওয়ায় মেকানিক ডেকে ঠিক করে মিনিট পনেরো হলো চলতে শুরু করেছিল। রাস্তাটা দূর্ঘটনাপ্রবণ এলাকার হওয়ায় ড্রাইভার ধীরে ধীরেই ড্রাইভ করছিল। মাঝে আরও একবার গাড়ি বিট্রে করায় থেমে যেতে হয়েছিল। গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই অকস্মাৎ কান্ডটি ঘটে গেল। উৎস মাত্রই নিজের সিটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছিল। হঠাৎ সামনে উপস্থিত হয়ে যাওয়া লাল শাড়ি পরিহিত নারীতে চোখ আটকে যায়। এই অসময়ে তারই গাড়ির সামনে এরকম বিয়ের সাজে কোন মেয়েকে আসতে হলো?

“শুনছেন, আপনার কোথাও লাগেনি তো?”

সামনের দিক থেকে অপরিচিত কণ্ঠস্বর পেতেই সেদিকে তাকালো নিতু। ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকল হাতের ডানদিকের পুরুষটিকে। সামনে দাঁড়ানো উঁচু লম্বা, বিশালদেহী ব্যক্তিটি সাদা রঙের শার্ট পরিহিত। মৃদু ঘামে বুকের সাথে শার্ট লেপ্টে আছে। গলার দিকটায় দুইটা বোতাম খোলা। হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করে রাখা। হাতে সোনালি রঙের ক্যাসিও ঘড়ি। সুগভীর দুটো চোখে কালো ফ্রেমের পাওয়ার-গ্লাস। দুই গাল ভরতি খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়ি। দেখতে এক কথায় পরিপূর্ণ জেন্টেলম্যান। নিতুর হঠাৎই মনে হলো এই মানুষটা তার চেনা, ভীষণ চেনা। বিশেষ করে মানুষটার কপালের কা*টা দাগটা।

নিতুকে বিচ্ছিন্ন চোখে এভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেখে উৎস আবারও শুধালো,“আপনি ঠিক আছেন? কোথাও কি চোট পেয়েছেন? আমার গাড়িতে ফার্স্টএইড বক্স রাখা আছে।”

সৎবিৎ ফিরে পেল নিতু। পুনরায় পিছের দিকে দেখে শুকনো ঢোক গিলে বলল,“আমাকে প্লিজ বাঁচান। ওরা আমাকে মে*রে ফেলবে।”

অস্থির হলো উৎস। দু কদম এগিয়ে এসে ব্যস্ত গলায় শুধালো,“কে আপনাকে মা*রতে চাইছে? আমাকে বলুন সবটা। আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারব।”

মেজর মুবতাসিম ফুয়াদ উৎস’র পাশেই তার গাড়ির ড্রাইভার রতন মিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সে একজন বিজ্ঞ লোক। তার বিজ্ঞ চেহারায় ফুঁটে উঠল অজানা এক আশঙ্কা। মনে হলো খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। সে উৎসকে ছেলের মতোই দেখে। বয়স হলেও তাকে কাজ থেকে এখনো ছাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সে একজন বিশস্ত কর্মী। রতন মিয়া উৎসকে হাত ধরে টেনে একটু দূরে নিয়ে এসে চাপাস্বরে বলল,

“আব্বা, এসব ঝামেলায় না জড়ালে হয় না? মনে হচ্ছে সামনে বড় একটা বিপদ আসতে চলেছে।”

উৎস রতন মিয়াকে আশ্বস্ত করে বলল,“চিন্তা করবেন না, চাচা। কিচ্ছু হবে না। মেয়েটা বিপদে আছে। সাহায্য করা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য। পুরো দেশ আমাদের ওপর ভরসা করেই চলছে।”

উৎস নিতুর দিকে এগিয়ে আসতেই নিতু জিহ্বা দিয়ে শুকনো খড়খড়ে ওষ্ঠজোড়া ভিজিয়ে বলল,“পানি হবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।”

উৎস রতন মিয়াকে ইশারা করতেই গাড়ি থেকে পানির বোতলটা এনে নিতুকে ধরিয়ে দিল। রতন মিয়ার হাত থেকে তাড়াতাড়ি করে বোতলটা নিয়ে হাফ লিটারের পানির বোতলের সম্পূর্ণ পানি শেষ করল৷ পানি খাওয়া হলে উৎসকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আমাকে একটু দূরে কোথাও নামিয়ে দেবেন গাড়ি করে? কোন বাজার বা স্টেশন হলে ভালো হয়।”

উৎস কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,“আসুন।”

অনুমতি পেতেই নিতু আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আগে আগে গাড়ির পিছন সিটে গিয়ে বসল। উৎস রতন মিয়াকে গাড়ি ড্রাইভ করতে বলে নিজেও নিতুর পাশের সিটে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল। উৎস সেই প্রথম থেকে একটা কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে নিতুকে। তাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে তার কাছে। নিজের আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

“আপনি কি দেশে বা দেশের বাহিরে কোথাও দেখেছি হয়তো। সম্ভবত দেশের বাহিরে। আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। মনে করতে পারছি না।”

নিতু এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। কিছুক্ষণ পরপর জানালা দিয়ে গাড়ির পিছনে কোন গাড়ি আসছে কি না সেটা দেখছে। উৎসের প্রশ্নটা কানে যেতেই ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

“হ্যাঁ। দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়া, নেপাল চার দেশে গিয়েছি। বাংলাদেশে খুব একটা থাকা হয়নি গত দশ, বারো বছরে। আমি ফ্যাশন ডিজাইনার, মডেলিংও করা হয় টুকটাক। এসএসসি পাশ করে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাই। ওখানেই থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি। ন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া হয়।”

“গত বছর নেপালে গিয়েছিলেন?”
“জি।”
“ইয়েস! ওখানেই হয়তো দেখেছি।”
“আপনি?”
“আমি উৎস, মেজর মুবতাসিম ফুয়াদ উৎস।”

‘উৎস’ নামটা কর্ণকুহরে আসতেই চমকে উঠল নিতু। চোখ আটকে গেল উৎসর পুরো মুখে। এই লোকটাকে প্রথম দেখাতেই চেনা চেনা লেগেছিল তার। নামটা শুনে নিশ্চিত হলো। এই মানুষটা আবারও সামনে আসবে এটাও হওয়ার ছিল! ভুলেই তো গিয়েছিল সে পুরোনো আবেগ, অনুভূতি তাহলে সৃষ্টিকর্তা কেন আবার তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল? কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল সে মানুষটাকে। এই মানুষটা তার হতে পারত। মনে মনে প্রশ্ন জাগে তার- উৎস’র বয়স তো কম হলো না। বিয়ে করেছে সে? করবে না-ই বা কেন? নিশ্চয়ই ছোট একটা ফুটফুটে বাচ্চাও আছে। যে কি না অস্পষ্ট গলায় ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকে!

“আপনার নাম?” উৎস’র প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল নিতু। নিজের অতীতের সত্যিকারের নাম বললে কি উৎস তাকে চিনবে? তখন তো এরকম স্বাভাবিক তার সাথে না ও থাকতে পারে কিন্তু সেই পনেরো, বিশ দিনের ক্যামেলিয়াকে তার মনে আছে? যাকে সে ‘বিকাল ফুল’ নাম দিয়েছিল? মনে থাকার কথা না। সময় তো কম কেটে যায়নি। দশ বছর! নিশ্চয়ই মনে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া তার চোখে তো পরবর্তীতে ‘বিকালফুল’ হয়ে অন্যকেউ ধরা দিয়েছিল। অন্যকেউ তার জীবনের ফুলের সুবাস ছড়িয়েছিল।

নিতু সংক্ষেপে বলল,“নিতু।”
“বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছেন?”

নিতু না বোধক মাথা নেড়ে বলল,“শহরে বড় একটা কোম্পানির সাথে চুক্তিতে দেশে এসেছিলাম। ব্রাইডাল শ্যুট ছিল। আমার বাবা কোনভাবে আমার খোঁজ পেয়েছে হয়তো। আমাকে নিয়ে যেতে কয়েকজন লাফাঙ্গাকে পাঠিয়েছে। আমি পালিয়েছি।”

উৎস বলল,“বাবা? বাড়িতে যাবেন না? যাবেন কোথায় এখন?”

নিতু মুখ মলিন করে উৎস’র দিকে তাকিয়ে বলল,“জানি না। সৃষ্টিকর্তা যেখানে গন্তব্য হিসেবে লিখে রেখেছেন সেখানেই যাব তবে বাবার বাড়িতে যাব না। এখানে বান্ধবীর বাসায় উঠেছিলাম। ও বলল বাবা ওখানকার খবরও পেয়ে গেছে। মেইবি আমার ফোনের লোকেশন ট্র‍্যাক করা হিয়েছিল।”

“এখন ফোন কোথায় সাথেই রেখেছেন?”
“বন্ধ আছে।”

গাড়ি হঠাৎ করে ব্রেক কষে থেমে গেল। রতন মিয়া উৎস’র দিকে দেখে ব্যস্তগলায় বলল,“আপনি বসেন, আব্বা। আমি দেখছি।”

রতন মিয়া বেশ কিছুক্ষণ সময় ইঞ্জিন, এটা ওটা চেক করল৷ নিজে কোনকিছু বুঝতে না পেরে উৎস’র দিকে এগিয়ে এসে মৃদু গলায় বলল,“আবার নষ্ট হয়ে গেছে। কাছেপিঠে মেকানিক আছে কি না দেখতে হবে।”

বিরক্ত হলো উৎস। কড়া গলায় বলল,“এমন গাড়ি নিয়ে বের হতে কে বলেছে আপনাকে? বাড়িতে নতুন গাড়ি পড়ে আছে তবুও এই পুরোনো গাড়ি নিয়ে টানাটানি কেন করতে হবে? যান গিয়ে দেখুন কোথায় মেকানিক আছে।”

রতন মিয়া কিছু না বলে গাড়ির ভেতর থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। গ্রাম এলাকা। এখানে কোথায় গাড়ির মেকানিক পাওয়া যাবে কে জানে?
উৎস’র মেজাজ খারাপ দেখে বাহিরে বের হওয়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করল নিতু। সে বলল,

“বাহিরে ভালো হাওয়া বইছে। বাহিরে গিয়ে দাঁড়ালে আপনার হয়তো ভালো লাগবে।”

উৎস ভ্রু সটান বিস্তৃত করে শুধালো,“এখন ভয় লাগছে না আপনার?”
“আমার ওপর আক্র*মণ হলে আপনি বাঁচাবেন আমি এটুকু নিশ্চিত।”

দুজনে বের হয়ে এলো গাড়ি থেকে। রাত নয়টার মতো বেজে যাচ্ছে। জায়গাটা গ্রাম এলাকা হওয়ায় দূর দূরান্তে সেরকম মানুষ দেখা যাচ্ছে না তবে রাস্তার পাশ দিয়েই বাড়িঘর। বাল্ব জ্বলছে। কথাবার্তার আওয়াজও সময় সময় পাওয়া যাচ্ছে। দুজনে গাড়িতে হেলান দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সেকেন্ড কয়েকের জন্য ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল। বাতাসে যত ধুলোমাটি ছিল সব যেন ক্যামেলিয়ার চোখে প্রবেশ করল। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করতে থাকল সে। উৎস নিতুকে শান্ত হতে বলে বলল,

“শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ থেকে ময়লা বের করে ফেলুন।”

নিতু চিকন গলায় বলল,“শাড়ির আঁচল তো খসখসে। ব্যথা লাগবে। আপনার কাছে রুমাল হবে?”

উৎস পকেট থেকে রুমাল বের করে নিতু হাতে দিতে গিয়ে ভাবল সে একা একা কীভাবে ময়লা বের করবে তাই বলল,
“আমি বের করে দিচ্ছি। আপনি শুধু ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে ধরে রাখুন।”

উৎস সযত্নে নীতুর চোখ থেকে ময়লা বের করে দিচ্ছিল। সামনের দিক থেকে কয়েকজন ছেলে হেঁটে আসছিল রাস্তার পাশ দিয়ে। তার একত্রে ব্যঙ্গ করে বলে উঠল,

“এহ হে হে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুইজন চুমু খাচ্ছে ছি ছি লজ্জা নেই এদের।”

তাদের গলা শুনতে পেয়ে রাস্তার অন্যপাশে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুই তিনজন রাস্তা পার হয়ে এপাশে এসে দাঁড়ালো। উৎস আর নিতু তখন স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই আশেপাশের মানুষের ব্যবহারে অবাক। একজন তো বলেই উঠল,

“রাস্তা কি বে*শ্যাখানা মনে হয়? রাত দুপুরে চুম্মাচাটি করতেছেন? ঘর ভাড়া নিলেই তো পারেন। এইখানে তো আর কাপড় খুলতে পারবেন না। নাকি কু*ত্তার মতো স্বভাবও আছে।”

চলবে…