প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০৫

0
59

#প্রিয়_বিকালফুল(০৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

রাত প্রায় দুটো। নিতুর চোখে ঘুম নেই। চারদিক থেকে দুশ্চিন্তা যেন ঘিরে ধরেছে তাকে। মাঝেমাঝে এটা ওটা ভেবে দম বন্ধ লাগছে। কিছুক্ষণ পরপর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলছে। রাতে শোয়ার আগে সে ফোনটা দুই মিনিটের জন্য অন করেছিল। ফটোশুটের চুক্তি যে কম্পানির সাথে হয়েছিল তাদের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়েছে কাজটা সে সম্পন্ন করতে পারবে না। এডভান্স যা নিয়েছিল সেটা ফিরিয়ে দেবে এবং যা ছবি উঠানো হয়েছে তা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনভাবেই না যায়। পোশাক, গহনা যা সাথে এনেছে সবকিছু হিসেব করে কুরিয়ার করে দেবে। ওপাশ থেকে তারা নিতুকে আশ্বস্ত করেছে সবকিছু নিতুর কথা মতোই হবে। একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেও ঘুমুতে পারছে না সে। শাড়ি পরে রাতে ঘুমোনো তো দূর শাড়ি পরে বেশিক্ষণ থাকারই অভ্যাস নেই তার। অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে সর্বদা। এপাশ ওপাশ হচ্ছে শুধু। উৎসকে ডেকে সমস্যার কথা জানাবে কি না সেটা ভাবছে সে। শেষমেশ নিতুকে আর কষ্ট করে উৎসকে ডাকতে হলো না। নিতুর নড়াচড়া টের পেয়ে বলে উঠল,

“খাটে এমন লাফালাফি কেন করছেন? ভেঙে যাবে তো।”

নিতু মুখ ফুলিয়ে বলল,“মেজর সাহেবের খাট এত কমদামি কাঠ দিয়ে বানানো নাকি যে আমার মতো চিংড়ি লাফালেই ভেঙে যাবে?”
“কী হয়েছে সেটা বলুন। এত নড়চড় করছেন কেন?”

নিতু এবার গম্ভীর গলায় বলল,“আমি শাড়ি পরে থাকতে পারি না। তখন খুব কষ্টে ছিলাম। শাড়ি পরে রাতে ঘুমোনো আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার।”

“তো বিয়ে করেছেন, শাড়ি পরবেন না? বউরা তো শাড়ি পরেই থাকবে তাই না?”

“শুনুন একদম খোঁটা দেবেন না। বউরা দিনে শাড়ি দিনে পরলেও রাতে বর ঠিকই শাড়ি খুলে ফেলে বউকে স্বস্তি দেয় আর তাছাড়া বিয়ে আপনার মানসম্মান বাঁচাতেই করেছি৷ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের সামনে আপনার আর আপনার মাকে ছোট হতে হতো। সুতরাং আমার ভালো-মন্দ দেখার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনার।”

“নিতু, আমাদের দুজনের সমস্যাকে সামনে রেখে দুজনের মতেই বিয়ে হয়েছে। ভুলে যাচ্ছেন কেন?”

নিতু মুখ গোমড়া করে বলল,“হয়েছে হয়েছে। এত মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি শাড়ি পরে ঘুমুতে পারছি না। আমার জন্য টিশার্ট আর প্যান্টের ব্যবস্থা করুন। হাফ প্যান্ট হলেও চলবে।”

চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে উঠে বসল উৎস। থতমত খেয়ে শুধালো,“কী! আপনি আমার সামনে হাফ প্যান্ট পরে ঘুমাবেন?”

নিতু চাপাস্বরে বলল,“কেন? আপনি ঘুমোবেন না? সারা রাত তাকিয়ে তাকিয়ে আমার পা দেখবেন? ছি মেজর সাহেব, ছি! আপনার চরিত্র এত খারাপ? এই তো বিয়ের আগেই নিজের চরিত্রের প্রশংসা করছিলেন। কবুল বলার পরই আসল রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে দেখছি। একটা মেয়েকে আপনি ওভাবে দেখবেন! লজ্জা করবে না? মান-সম্মান থাকবে আপনার? সকালে আমাকে এত সুন্দর মুখটা দেখাবেন কীভাবে বলেন তো?”

উৎস খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্পটা অন করল। নিতুকে ধমক দিয়ে থামতে বলে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াড্রবে এটা ওটা ঘেটে একটা কালো টিশার্ট আর নিজের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এনে নিতুকে ধরিয়ে দিল। নিতুর যে উচ্চতা তাতে এই প্যান্ট নিশ্চিন্তে ফুলপ্যান্ট হয়ে যাবে। টিশার্ট আর প্যান্ট এনে নিতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“নিন, এগুলো পরে আসুন।”

নিতু মিটিমিটি হেসে বলল,“হাফ প্যান্ট পেলেন না? আপনার দেখতে সুবিধা হতো। ফর্সা, আবেদনময়ী, ইংরেজিতে সেক্সি নরম পা। এরপরও আপনি কীভাবে চরিত্রবান থাকেন সেটাও দেখতাম। সাহস করে এনে দিয়ে দেখুন, আপনার চরিত্রে হৃষ্টপুষ্ট দাগ পড়ে যাবে, মেজর সাহেব।”

উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“ কয়েক ঘণ্টায় এত পরিবর্তন! এত কথা কীভাবে আসতে শুরু করেছে পেট থেকে? শুনুন, মুখ দিয়ে যদি আর একটা কথা বের হয় তাহলে মুখ বন্ধ করে দিব।”

নিতু দাঁড়িয়ে গেল। উৎসর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,“কীভাবে? চুমু দিয়ে? এসবও আপনি পারবেন? বিবেকে বাঁধবে না? একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিজের রুমে, নিজের খাটে, নিজের পাশে থাকতে দিয়েছেন বলে এভাবে সুযোগ নেবেন? এসব করতে পারবেন আপনি?”

উৎস নিতুর এসব কথাবার্তায় অবাক হচ্ছে। এই মেয়ে এভাবে, এরকম, এত কথা বলতে পারে আইডিয়া ছিল না তার। আর এত রাতে এসবই বা কেন বলে তার মেজাজটা গরম করছে কে জানে? একে ভয় দেখাতে বড় চোখ, ধমক কিছুই কাজ করছে না দেখে ড্রয়ার থেকে রিভালবার এনে মাথার বালিশের পাশে রেখে শুয়ে পড়ল। চোখের ওপর হাত রেখে বলল,

“কারও মুখ দিয়ে আর একটা কথা বের হলে এতরাতে আজ রুমে গু*লি চলবে বলে দিলাম।”

উৎসের উক্ত বাক্যের পর নিতুর আর সাঁড়াশব্দ পাওয়া গেল না অনেকক্ষণ। নিতু চেঞ্জ করে এসে চুপচাপ শুয়ে আছে। প্রায় পাঁচ মিনিট তারপর দশ মিনিট, বারো মিনিট, পনেরো মিনিট এভাবে কেটে যাওয়ার পর উৎস কী ভেবে পাশ ফিরে নিতুর দিকে তাকালো। সাথে সাথে চোখ পড়ল কাজলে ডুবিয়ে রাখা দুটি চোখে। নিতু এক পলকে তার দিকে চেয়ে আছে। উৎসকে তার দিকে তাকাতে দেখে ফিক করে হেসে ফেলল সে। বলে উঠল,

“আপনি চাইছেন আমি কথা বলি, আপনাকে বিরক্ত করি অথচ সেটা করলে রাগ দেখাচ্ছেন। শুনেছি মেয়ে মানুষই শুধু ন্যাকামি করে, মেকি রাগ দেখায়, আহ্লাদ করে এখন দেখছি বুড়ো গোছের পুরুষ মানুষও বাদ নেই।”

ভ্রু কুঁচকালো উৎস। চাপা শ্বাস ফেলে বলল,“আমাকে দেখে কোন দিক দিয়ে বুড়ো গোছের মনে হলো?”
“আপনার আম্মা বলেছে আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সে কেউ কচি তো আর থাকে না।”

উৎস নিতুর এহেন কথাবার্তার জবাবে বলে উঠল,“ত্রিশ পেরিয়ে গেলে পুরুষ তার প্রেয়সীকে রাজরানী করে রাখতে পারে৷ ভালোবাসায় কোন কমতি থাকে না। তারা নিব্বাদের মতো মুখ ফুলিয়ে প্রেয়সীর হৃদয়ে দহন ঘটায় না। তারা হয় সঠিক পুরুষ।”

নিতু এবার হঠাৎই নিস্তেজ গলায় বলে উঠল,“কিন্তু আপনি তো শপথ করে বসে আছেন, আপনি আর কাউকে ভালোবাসবেন না।”

উৎস আর কোন কথা বলল না। নিতু মনে মনে বলল,“বিয়ের আগে আমার অসহায়ত্ব দেখিয়েছি ঠিক কিন্তু বাবার জন্য না আপনাকে দেখার পর আপনাকে না পেয়ে আমার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল। আপনি যতই বলুন না কেন যে, আপনি সহজে কাউকে ভালোবাসবেন না, বিশ্বাস করতে পারবেন না, আমি সেই কঠিন কাজটাই করে দেখাব। আপনি আমাকে ভালোবাসবেন। এগারো বছর আগের সেই সত্যিটা জানার পর তো চোখে হারাবেন।”

নিতু জবাবের আশায় কিছুক্ষণ উৎসর দিকে চেয়ে রইল। জবাব পাবে না বুঝতে পেরে আস্তে করে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। মনে মনে চাইল, এইক্ষণেই ঘুম নেমে আসুক। প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলার স্পৃহা এত রাতে আর না জাগুক। যদি পুনরায় দুঃখ পাওয়ারই হয় তবে মন থেকে দূরত্ব বাড়ুক।

ভোর ছয়টায় এলার্ম বেজে উঠল। ঘুমঘুম চোখে এলার্ম বন্ধ করে কিছুক্ষণ ওভাবেই চোখ বন্ধ করে রইল উৎস। ছুটিতে বাড়ি এলেও এই রুটিনের অন্যথা হয় না তার কোন সময়। ছয়টা থেকে আটটা অবধি এক্সারসাইজ চলে। বাড়ি ফিরে গোসল সেরে তারপর নাশতার টেবিলে গিয়ে বসে সে। আজকেও তার অন্যথা হলো না। চোখ না খুলেই নড়বে তখনই বুকের দিকটায় ভারি কিছু বাঁধলো মনে হলো। চোখ খুলতেই নিজের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা আরও একটি শরীর আবিষ্কার করল। পরক্ষণেই যখন মনে হলো নিতুর কথা তখনই ছিটকে দূরে সরে গেল সে। বিছানার এদিক ওদিক দেখে বুঝতে পারল নিতু নয় রাতে সে নিজেই নিজের জায়গা ছেড়ে নিতুর দিকে সরে গিয়েছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল সে। নিজের কর্মকান্ডে সে নিজেই হতাশ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল আগামী রাত থেকে বিছানায় সে কিছুতেই ঘুমোবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ঠিকঠাক করে নিল। উঠে বসে নিতুর দিকে চোখ যেতেই আরেক দূর্ঘটনার শিকার হতে হলো। নিতুর পোশাকের ঠিক নেই। কালো টিশার্ট খানিকটা উঠে যাওয়ায় নীতুর মেদহীন, ধবধবে সাদা উদর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কালো রঙে শরীরের রঙ যেন আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নিল উৎস। একদিনে এতকিছু কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না সে। নিজের ওপর কী পরিমাণ রাগ হচ্ছে সেটা শুধু সে নিজেই জানে। পায়ের নিচের দিক থেকে কম্ফোর্টার তুলে জলদি নিতুকে মুখ অবধি ঢেকে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এলো। এক্সারসাইজের জন্য তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়েও গেল।

নিতুর ঘুম ভাঙলো সাড়ে সাতটার পর। ফরিনা বেগম নিজে এসে তাকে ডেকে গিয়েছেন। অনেক রাত করে ঘুমুতে যাওয়ার কারণে চোখ থেকে ঘুম কিছুতেই হটছে না। সে ছোটবেলা থেকেই দেখেছে বিয়ের পরদিন বউ সকাল সকাল উঠে বাড়ির সবার সাথে কাজে হাত লাগায়৷ উঠতেও ইচ্ছে করছে আবার চোখও খুলতে পারছে না। অবস্থা বেগতিক বুঝে নিজেই মনের সাথে যুদ্ধ করে উঠে বসল। বিছানায় কম্ফোর্টার দেখে মনে পড়ল এটা রাতে নেওয়া হয়নি সুতরাং হিসেব মতো উৎস এটা দিয়েছে। উৎসর কথা ভেবেই মুচকি মুচকি হাসলো নিতু। নিজের শরীরে পরিচিত এবং প্রিয় মানুষের পোশাক দেখে সেটায় মুখ ডুবালো। কী অসম্ভব সুন্দর সুবাস! চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ টিশার্টের সুবাস নিল নিতু। কী অদ্ভুত মোহ। কী অসম্ভব মায়া!

নিতু টিশার্টে মুখ গুজেই বলে উঠল,“আপনার জন্য আমি জীবনের অন্যসব লক্ষ্য ভুলে বসেছি, উৎস। কবুল বলার পর আমার একমাত্র লক্ষ্য আপনাকে পাওয়া। আমার জীবনে আর দ্বিতীয় কোন লক্ষ্য নেই। আমাকে যে এবার আপনার ভালোবাসা পেতেই হবে। পূর্বের মতো ভুল আর আমি করব না৷ আপনার জীবনে আর কাউকে আসতে দেব না, কাউকে ফিরতেও দেব না। আপনি শুধু আমার হবেন।”

“কিছু বললেন?”

কথাটা কানে পৌঁছতেই নিতু সামনে দিকে তাকালো। উৎস ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিতু মুচকি হেসে বলে উঠল,

“আপনাকে হট লাগছে, উৎস সাহেব। আপনি এভাবে সামনে এলে যে আমার চরিত্রে দাগ পড়ে যাবে। আমার চরিত্রে দাগ পড়ার মতো ঘটনা ঘটলে সেটা আপনার জন্য একদম সুখকর হবে না।”

চলবে…..