প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০৬

0
54

#প্রিয়_বিকালফুল(০৬)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“আপনাকে হট লাগছে, উৎস সাহেব। আপনি এভাবে সামনে এলে যে আমার চরিত্রে দাগ পড়ে যাবে। আমার চরিত্রে দাগ পড়ার মতো ঘটনা ঘটলে সেটা আপনার জন্য একদম সুখকর হবে না।”

উৎস তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছিল। নিতুর এমন কথায় যেন তাজ্জব বনে গেল সে। ওর দিকে তেড়ে এসে বলল,

“কী বললেন?”

নিতু বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে পা নাড়াতে নাড়াতে বলল,“বললাম, আপনি এভাবে আমার সামনে এলে আমি ভুলে যাব আমি আপনার ভালোবেসে বিয়ে করা বউ নই। আমি কিন্তু আপনার চরিত্রে যখন তখন কালি মাখিয়ে ফেলতে পারি। আপনি চরিত্রবান হলেও আমি কিন্তু চরিত্র নিয়ে পড়ে থাকব না।”

“ছি! টিজ করছেন আপনি আমাকে? কালকের সেই অসহায় মুখের সাথে আজকের কিছুই মিলছে না। নিজের আসল চেহারা দেখিয়ে দিচ্ছেন। অজানা, অপরিচিত, পর পুরুষের সাথে কীভাবে কথা বলছেন, ছি!”

“কালকে তো আর আমি আপনার বউ ছিলাম না। আজ হয়েছি। আপনি ভদ্র মানুষের মতো সামনে না এলে আমি অভদ্র হতেই পারি।”

“কী করবেন? কী করতে পারবেন আপনি? খুব তো বুলি ছুড়ছেন। মেয়ে মানুষ মেয়ে মানুষের মতো থাকবেন।”

নিতু উঠে এসে উৎসর টিশার্ট এক প্রকার খামচি দিয়ে তাকে খানিকটা নিচু করে মুখ বাঁকিয়ে নিয়ে হেসে ঠোঁটের দিকে দুষ্টু নজরে তাকিয়ে বলে উঠল,“এই ধরুন, যখন তখন চুমু দিয়ে বসতে পারি, শক্ত করে জড়িয়েও ধরতে পারি, আপনার চরিত্রে দাগ ফেলার জন্য যা যা করতে হয় সে সবকিছু করতেই পারি। শুনবেন আর? শুনবেন কী কী করতে পারি আর?”

উৎস নিজেকে নিতুর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের দুই গালে চড় দিতে দিতে বলল,“নাঊজুবিল্লাহ। আল্লাহ কার সাথে যে কী করিয়ে দিলে! বাঁচিয়ে নাও এবারের মতো।”

উৎস ওয়াশরুমে ঢুকবে তার আগে আগে নিতু গিয়ে সামনে দাঁড়াল। উৎস ভ্রুকুটি করে নিতুর দিকে চাইল। মেজাজ দেখিয়ে বলল,

“এখন আবার কী চাই?”

“গোসলে যাব। বিয়ের পরদিন সকালে গোসল না করলে সবাই টের পেয়ে যাবে আমাদের মধ্যে যে কিছুই হয়নি। তাছাড়া রাতে আপনার মা বিয়ের প্রমাণ চেয়েছিল আজ যদি আমার কাছে বাসরের প্রমাণ চায়? আমি কি আপনাকে সবার সামনে অন্যভাবে প্রকাশ করতে পারি বলুন? আমাদের বাসর রাতে যে কিছুই হয়নি সেটা আমি, আপনি জানলে ক্ষতি নেই। অন্যদের তো জানাতে হবে আমরা হ্যাপি কাপল। বাসরও আমাদের হয়েছে, কিচ্ছুটি বাদ যায়নি।”

“বড্ড নির্লজ্জ আপনি। এই কয়েক ঘণ্টায় অতিষ্ঠ করে তুলেছেন আমায়।”

“আমাকে তো সহ্য করতেই হবে বর সাহেব।”
“দূর হন চোখের সামনে থেকে।”

“আপাতত যাচ্ছি, আবার আসব। ডোন্ট ও্যরি।” বলেই উৎসর সামনে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিল নিতু।

উৎসর গোসল দিয়ে বের হতে হতে নয়টা বেজে গেল। নিতু ইচ্ছে করে অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করেছে। অপেক্ষা করিয়েছে ইচ্ছেমতো। উৎসকে এ বাড়িতে বিরক্ত করার মতো কেউ নেই। ছোট বোনটাও এবরোডে থাকে পড়াশোনার জন্য। মাঝেমধ্যে কথা হয় শুধু। কাজের ক্ষেত্রেও তার কথার ওপর কথা বলার মতো কেউ নেই। এতদিন পর কেউ বিরক্ত করছে, সময় অপচয় করাচ্ছে, বারবার উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা গরম করিয়ে দিচ্ছে ভাবতেই পুরো শরীর রাগে কিরমির করে উঠছে।

গোসল শেষ করে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এদিক ওদিকে খুঁজে নিতুকে পেল না উৎস। নিজের দিকে তাকিয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল সে। নিতু এখানে থাকলে নিশ্চিত বডি শেমিং, উল্টাপাল্টা কথাবার্তা চলতো কিছুক্ষণ।

উৎস তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলো। খাবার টেবিলে কেউ নেই৷ আশেপাশেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কাজের মেয়েটি এদিক ওদিক ঘুরছিল৷ উৎস তাকে ডেকে শুধালো,

“বউমনি কোথায়? দেখেছ তাকে? আম্মার রুমে আছে নাকি?”

মেয়েটা মাথা চুলকে ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,“আম্মার রুমে যাইতে দেখি নাই। খুঁইজা দেখেন কই গেল! ”

কপালে ভাজ পড়ল উৎসর। এমন সময় কোথাও যাওয়ার তো কথা না। মায়ের রুমের সামনে গিয়ে কান পেতে কারও সাঁড়াশব্দ পেল না। দুশ্চিন্তা যেন গাঢ় হলো৷ মনটা ভাবতে বাধ্য করল- নিতু কি পালিয়ে চলে গেল? তার তো যাওয়ার কথা ছিল না! কোথায় সে?

উৎস হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির সামনে, পিছনের দিকে এবং ছাদে খুঁজে দেখল, কোথাও নেই নিতু। মনে একটু ভয় জন্মালো যেন। সে কি সত্যি সত্যি চলে গেল? কিন্তু কেন?

আশা করতে ইচ্ছে করছে না তবুও যেন এক টুকরো আশা বুকে বেঁধে মায়ের রুমের দিকে গেল সে। মুখের অবস্থা তার করুণ। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেও নিতু এভাবে চলে যেতে পারল ভাবতেই পুরো শরীর যেন শিউরে উঠছে তার। আর কোন উপায় না পেয়ে মায়ের রুমের দরজায় নক করল। দরজা খোলা। দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই দেখল নিতু এবং ফরিনা বেগম একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে গল্প করছে। দেহে যেন প্রাণ ফিরে এলো উৎসর। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

দরজার সামনে উৎসকে দেখে উঠে বসল নিতু। তার অবস্থা দেখে সে হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পারল। মাত্র গোসল করে বের হওয়া মানুষের ঘর্মাক্ত শরীর যেন কোন কিছুর আভাস দিল।

ফরিনা বেগমও উঠে বসলেন। নিতু মুচকি হেসে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,“আম্মা, দেখুন দেখুন আপনার ছেলে বউকে চোখে হারাচ্ছে। ইশ! কী ভাগ্য আমার!”

উৎস প্রত্যুত্তরে বলে উঠল,“মোটেও না। খাবার টেবিলে কাউকে দেখলাম না যে!”

ফরিনা বেগম বললেন,“সবার নাশতা করা শেষ। তুমি জানো না, আমাদের বাসায় নাশতা কখন করা হয়?”

“স্যরি, আম্মা।”

নিতু বিছানা থেকে নামতে নামতে উৎসকে উদ্দেশ্য করে বলল,“আপনি রুমে যান। আমি আপনার জন্য গরম গরম চা করে নিয়ে আসছি।”

উৎস চোখ কপালে তুলে শুধালো,“আপনি চা করতে পারেন? কই বলেননি তো?”

ফরিনা বেগম পাশে রাখা চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন,“চা ঠান্ডা হয়ে গেছে তবুও কত মজা! কত কাল এত ভালো চা কপালে জোটে না! এই মেয়ে আমাকে আবার চা লোভী বানিয়ে ছাড়বে।”

নিতু মৃদু হেসে বলল,“আমি আপনাকে প্রতি বেলা চা করে খাওয়াব, আম্মা। আর আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? রুমে যান, আমি আসছি।”

উৎস বাধ্য ছেলের মতো প্রস্থান করল। প্রায় দশ মিনিটের মাথায় চা আর সকালের নাশতা নিয়ে রুমে প্রবেশ করল নিতু। নিতুর হাতে একসাথে অনেককিছু দেখে উৎস এসে চায়ের কাপ আর নাশতার প্লেটটা নিজে নিয়ে বলল,

“এতকিছু একসাথে আনতে হবে কেন?”

বাকি জিনিসগুলো সাইড টেবিলের ওপর রাখল নিতু। চা ছাড়া উৎসর হাতে থাকা প্লেট নিজে নিয়ে বলল,“চা খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে?”

উৎস চায়ে চুমুক না দিয়ে হাতে ধরে রইল। নিতুর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,“আম্মার রুমেই ছিলেন এতক্ষণ?”
“তাছাড়া কোথায় থাকব? আপনি খুঁজেছিলেন আমাকে?”
“না।”
“আপনার কপালের প্রতিটা ঘামের ফোটা তখন অন্যকিছু বলছিল, উৎস।”
“আসলে..”
“আপনি ভেবেছিলেন, আমি পালিয়ে গেছি। তাই তো?”

উৎস নিরব রইল। নিতু আবার বলল,“ আপনি তো আমাকে এখানে জোর করে রেখে দেননি। আমি কেন পালাতে যাব? এখানে থাকার তো একটা উদ্দেশ্য আছে তাহলে চলে কেন যাব? সময়ের সাথে বাবা শান্ত হলেই আমি সম্ভব হলে এদেশ ছাড়ব। আর এই সময়ে পালিয়ে চলে গিয়ে আমার লাভ কী? সেই তো আপনার স্ত্রী হয়েই বাঁচতে হতো আজীবন। ”

উৎস চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,“কী উদ্দেশ্য?”
“আপনি।”
“আমি?”
“হ্যাঁ।”
“মানে?”

নিতু মৃদু হেসে উৎসর পাশে বসল। তার দিকে তাকিয়ে বলল,“গতরাতে যদি ওরা আমাকে ধরতে পারত তাহলে হয়তো আমার জীবনের শেষ ওখানেই হতো। আপনাকে আমার আল্লাহ পাঠিয়েছেন। আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন। এখানে আসার পর কোন কিছু চিন্তা না করে আপনাকে বিয়ে করে নেওয়ার উদ্দেশ্য একমাত্র আপনি। আপনার মায়ের অসুস্থতা, আপনাদের সম্মান রক্ষা যদিও আমারও ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, এই প্রাণের দখলদার আপনি। যেভাবে ইচ্ছে আপনি আমাকে ব্যবহার করতে পারবেন৷ আমি আপনার, পুরোটাই আপনার।”

উৎস মৃদু হেসে বলল,“ভালো কথা বলতে পারেন। আ’ম ইমপ্রেসড্।”

নিতুর গাল দুটো উৎসর এটুকু কথাতেই লাল হতে শুরু করল। কানের পিঠে চুল গুজে বলল,“আজ মুগ্ধ হচ্ছেন, কাল প্রেমে পড়ে যাবেন।”

উৎস এবার আহত দৃষ্টিতে নিতুর দিকে চাইল। এই মেয়ে একটা কথাও সোজাভাবে নেয় না। যেকোন কথাকেই অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে ঠিক নিয়ে যাবে। কথায় পেরে ওঠা মুশকিল। বুদ্ধিমানের কাজ হবে নিতুর সাথে একই বিষয়ে বেশিক্ষণ কথা না বলা সুতরাং উৎসও সেটাই করল। বলল,

“আমি একটু বাহিরে যাব। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই আবার ফিরে আসব। এলাকার ছোট এক ভাই কল করেছিল কয়েক মিনিট আগে। তাকে নাকি সামনেই একটা পার্কের দিকে কয়েকজন ছেলে মিলে আটকে রেখেছে।”

নিতু ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীরস্বরে শুধালো,“আমার হিরো কি তাকে বাঁচাতে যাবে?”

উৎস চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। স্বর দৃঢ় করে বলল,“প্রতিটা পুরুষ নাকি ঘরে বউয়ের কাছে নির্যা*তিত হয় রাত থেকে তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাচ্ছি।”

উৎস বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেকের মাঝেই নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে গেল৷ গাড়ি একপাশে রেখে এদিক ওদিক খুঁজে খুঁজে এক জায়গায় ভিড় দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল উৎস। সেদিকে এগিয়ে যেতেই উৎস বুঝল যে পরিচিত ছোট ভাই তাকে কল দিয়েছিল তাকে কয়েকজন মিলে কী কী যেন বলছে আর কানে ধরে উঠবস করাচ্ছে।

উৎস একদিকের ভিড় ঠেলে সামনের দিকে ছুটে গেল। হুড়মুড়িয়ে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেখে কয়েকজন তার দিকে তাকালো। উৎসকে দেখে তাকে ফোন করা ছেলেটা অর্থাৎ সাইম দাঁড়িয়ে গেল। হড়বড়িয়ে বলল,

“ভাই, এরা আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করাচ্ছে, আমাকে মা*ইরও দিছে। আমারে বাঁচান, ভাই।”

উৎস শুধালো,“কী হয়েছে এখানে?”

পাশে থেকে একটা অপরিচিত ছেলে বলে উঠল,“ও আপনাকে ডেকেছে বাঁচাতে? আপনি এই অমানুষরে বাঁচাতে আসছেন? এই কু*ত্তা আমার বোনরে টিজ করছে। শিস বাজিয়েছে, উল্টাপাল্টা কথা বলছে। বডিশেমিং করছে। ভাই হয়ে কীভাবে সহ্য করব আমি? ওকে আমি পুলিশে দেব।”

উৎস সাইমকে উদ্দেশ্য করে বলল,“উনি যা বলছে তা সত্যি?”

সাইম তড়িত বলে উঠল,“ভাই, ওই মাইয়ার জামাকাপড়ের ঠিক নাই।”
“তুই বলার কে?” উৎসের সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।

“ওর পোশাকের ঠিক নেই। যা তা পোশাক পরে রাস্তায় বের হলে তো মানুষ দেখবেই তো, ভাই। বলবেও।”

উৎস সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল ছেলেটার গালে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেই ওর পোশাক এখানেই ঠিক হয়ে যাবে?”

সাইম গালে হাত দিয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই, আপনাকে ডেকেছি আমাকে হেল্প করার জন্য। আপনি এসে উল্টো আমাকেই ঝাড়ছেন!?”

“আমিও এসেছিলাম তোকেই বিপদ থেকে সাহায্য করার জন্য। আমি কি জানতাম নাকি যে তুই নিজেই নারী জাতির জন্য আস্ত একটা বিপদ?”

উৎস নিজেকে ঠিক রাখার খুব চেষ্টা করল তবুও ভেতর থেকে কেউ যেন ডেকে ডেকে আদেশ দিয়ে বলছে- উৎস ন্যায়ের পক্ষে থেকে নড়বি না। অন্যা*য় করা অমানুষ কখনো আপন হয় না।

“মেয়েটাকে দেখে শিস বাজিয়েছিস কেন? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নোংরা কথা বলেছিস কেন?”

ছেলেটা জবাবে বলল,“ভাই, আপনে এখানে এসে শুধু আমারই দোষ দেখতেছেন। মেয়েটা যে ওড়না ছাড়া বের হইছে এটা দেখেন না কেন?”

চড় আরেকটা পড়ল গালে। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে উৎসের দিকে ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিভাব নিয়ে তাকিয়ে রইল। উৎস বলে উঠল,

“কোন মেয়ের ইচ্ছে হলে উ*লঙ্গ হয়ে ঘুরুক, তুই কেন দেখতে যাবি? মেয়ে তোর সামনে এসে দাঁড়িয়ে তোকে প্রেশারাইজ করেছে? বলেছে যে, আমাকে দেখ প্লিজ আমাকে দেখ? বলেনি তো তাই না? তুই কেন দেখতে গেছিস?”

ছেলেটা এবার চুপ মে*রে গেল। চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে এখন উৎসের ব্যবহারে বিরক্ত। হবে না-ই বা কেন? যার কাছে থেকে সাহায্য নেবে বলে ডাকল সেই যদি এসে এভাবে শা*স্তি দেয় তাহলে মেজাজ খারাপ তো হবেই।

আশেপাশের মানুষ এবার উৎসের দিকে এগিয়ে এসে পুরো ঘটনা বলল। আগে যে কয়েকজন মানুষ জড়ো হয়ে ছিল এবার ধীরে ধীরে তার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ চারদিকে এসে দাঁড়াল।

উৎস হঠাৎ সাইমকে বলে উঠল,“তোর বোনের নম্বর দে।”

সাইম জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো উৎসের দিকে। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

উৎস তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ধমকের স্বরে বলে উঠল,“সেঁজুতির নম্বর দে কু*ত্তার বাচ্চা।”

সাইম কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “ভাই, এবারের মতো মাফ করে দেন। আমি এমন কাজ আর কোন মেয়ের সাথে করব না। আমার বাড়িতে জানাবেন না, ভাই।”

উৎস চোখ রাঙিয়ে পুনরায় বলে উঠল,“নম্বর দিতে বলেছি, নম্বর দে।”

সাইম উৎসের পায়ে পড়ে গেল। ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বলল,“ভাই, সেঁজু এই কথা জানলে আমার সামনেই আসবে না, ভাই। আমার ছোট বোনটা আমাকে ঘৃণা করবে, ভাই। পায়ে পড়ি, ভাই এমন কইরেন না। আমি ম*রে যাব, ভাই। আমার মাও আমার সাথে কথা বলবে না, ভাই।”

উৎস এবার স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল,“তোর মতো ছেলে ম*রলে কারো কোন বা*ল ছেঁড়া যাবে না। তুই ম*রলে তোর বাড়ির দায়িত্ব আমি নেব। দে নম্বর দে।”

আর কোন উপায় না পেয়ে সাইম প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে টলমল চোখে বোনের নম্বর বের করে উৎসের সামনে ধরল। উৎস নম্বরটা নিজের ফোনে টাইপ করতে করতে সামনের দিকে একজনের হাতে ক্যামেরা অন করা ফোন দেখে সেটা এক নিমিষেই কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কঠোরভাবে বলে উঠল,

“তোদের হাতে ফোন দেয় কে? রাতভোর ফোনে চ্যাটিং, নোংরামি আর বাহিরে কারো কোন বিপদ হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে ভিডিয়ো করা? আবার সেই ভিডিয়ো আপলোড দিয়ে ভিউ কামানো। ভিউ পা*ছার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেব। ভাগ এখান থেকে। একজনের হাতে যেন ফোন না দেখি আমি। যার হাতে ক্যামেরা অন করা ফোন দেখব তার ফোনই পানিতে যাবে আজ।”

উৎস সেঁজুতিকে কল করল। ফোন হয়তো হাতে থাকায় তাড়াতাড়িই রিসিভ হলো। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা অসহায় চোখে উৎসের দিকে চেয়ে আছে।
ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে সালাম ভেসে এলো। উৎস সালামের জবাব দিয়ে বলল,

“সেঁজু, আমি উৎস ভাইয়া বলছি রে।”

উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনতে পেল উৎস।
“ভাইয়া! হ্যাঁ বলেন। কেমন আছেন?”

“ভালো আছি। তুই, খালাম্মা ভালো?”
“হ্যাঁ, ভাইয়া। আমরা সবাই ভালো। হঠাৎ ফোন করলেন!?”

“একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে।”
“কী প্রশ্ন, ভাইয়া?”
“আচ্ছা ধর, তোকে কোন ছেলে টিজ করল, জানিসই তো এখন দিন দুনিয়ার অবস্থা তাহলে তুই যদি তাকে শা*স্তি দেওয়ার সুযোগ পাস কী করবি? মাথায় রাখিস ছেলের কথা অনুযায়ী, মেয়েদের পোশাক খারাপ তাই টিজ করে এমনকি এসবের কারণেই রে*প হয়।”

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ রইল তারপর বলে উঠল,“ সুযোগ যদি পেতামই তাহলে অমানুষকে বাঁচিয়ে রাখতাম না, ভাইয়া। জানে মে*রে দিতাম।”

উৎস এবার সাইমের দিকে তাকিয়ে সেঁজুতিকে বলল,“ওহ জানে মে*রে দিতি? এটা তো আইন হাতে তুলে নেওয়া হলো। এটা বাদে কী করতি?”

“ছেলেকে বস্ত্রহীন করে ছেড়ে দিয়ে বলতাম- এভাবে বেরিয়ে দেখ তোকে দেখে মেয়েরা টিজ করে কি না!”

উৎস হাসলো। বলল,“আচ্ছা শোন, পরে কথা হবে। বাসায় আসিস একদিন। ”

উৎস ফোন রাখল। সামনের তাকিয়ে বলল,“প্যান্ট খোল, শার্টও খোল”

সাইম অবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে আবার চারপাশের মানুষকে দেখল। ভাঙা ভাঙা ভাঙা শব্দে বলল,“ ম মা মানে? আ আমি প প্যান্ট খুলব কেন?”

উৎস হাতের ইশারায় সবাইকে একটু সরে যেতে বলে ছেলেটাকে বলল,““চল তুই ন্যাং*টা হয়ে বের হ’ আমিও দেখব কোন মেয়ে তোর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তোরা যেমন একটু সুযোগ পেলেই মেয়েদের শরীরের ভাজ, বিভিন্ন অঙ্গের সাইজ আন্দাজ করে ফেলিস সেই তোদেরই যদি উল*ঙ্গ করে বের করে দেওয়া যায় রাস্তায় তাহলে মেয়েরা তোদের দেখে কী করে সেটা দেখতে চাই আমি।”

চারপাশের মানুষজন পুরো চুপ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ পরিবেশে কারো মুখে কোন কথা নেই আছে শুধু চোখে মুখে আশ্চর্যের ছাপ।

সাইম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। উৎস হাতে ঘড়িতে সময় দেখে বলল,“ আমার হাতে সময় নেই, প্যান্ট খোল বাই*ঞ্চোদ।”

অশ্লীল গা*লির ধমক শুনে কাঁপা কাঁপা হাতে প্যান্টে হাত দিল সাইম। সাথে সাথে ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে আশেপাশে একজোট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো সরে যেতে থাকল। হাতেগোনা হয়তো একজনের রুচি হলো না কোন একজন ছেলেকে বস্ত্রহীন দেখার। ছেলেগুলোর মধ্যে কেউ কেউ সরে গেল কেউ নজর নামিয়ে নিল।

উৎস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাইমকে থামিয়ে দিল। তার মাথার নিচের অংশ অর্থ ঘাড় ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলল,

“তোরা ওড়না ছাড়া মেয়েকে তো চোখ দিয়ে মন দিয়ে ধর্ষ*ণ করিসই আবার সামনে দিয়ে কোন মেয়ে বোরখা পরে হেঁটে গেলেও খুঁটে খুঁটে দেখিস যদি কোনভাবে কোন উঁচু নিচু জায়গা দেখা যায় কি না, শাড়ি পরে কেউ বের হলে চেষ্টা করিস ব্লাউজের নিচে কোন রঙের ব্রা পরেছে, কোমরের একটুখানি দেখা যাচ্ছে কি না অথচ তোকে ন্যাং*টা হতে দেখে সবাই চলে গেল, নজর নামিয়ে নিল, দেখার রুচি হলো না। তোরা কিছু ছেলেরা কোন জাতের সেটা ভেবে দেখ একটু।”

উৎস থেমে আবারও বলল,“তোর মতো ছেলের ঘরে মা-বোন ঠিক কতটুকু সেফ সেটা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে আমার মনে। কথায় বলে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো। তুই নিজে আগে নজর নামিয়ে রাখবি। কোন মেয়ে ইচ্ছে হলে উল*ঙ্গ হয়ে ঘুরুক, রাস্তায় শুয়ে পড়ুক তোর কী হে চ্যাটের বা*ল আমার। দুনিয়ার সব মেয়েকে নিয়ে তোদের ভাবতে বলছে কে?”

আশেপাশে সবগুলো ছেলের মাথা নিচু হয়ে এলো। কেউ কেউ এখনো নিরব হয়ে অবাক চোখে উৎসকে দেখছে।
উৎস হঠাৎ সাইমের কানের ওপর আরেকটা সজোরে থাপ্প*ড় দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,“যা ভাগ আমার সামনে থেকে। কোনদিন বিপদে পড়ে আমাকে ডাকা তো দূর আমার সামনেই আসবি না কোনদিন।”

সাইম আর এক মুহূর্ত দেরি না করে মাথানিচু করে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল। উৎস নিজেও সেখান থেকে চলে আসবে ঠিক তখনই টিজ হওয়া মেয়েটা এবং তার ভাই এগিয়ে এলো। মেয়েটা ইনিয়ে বিনিয়ে ধন্যবাদ জানাতেই উৎস মেয়েটার ভাইয়ের দিকে তাকালো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,

“নাম কী তোমার?”

ছেলেটা মৃদু গলায় বলল,“নাঈম হাসান।”
“মুসলিম?”

ছেলেটা ওপর নিচ মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে মুসলিম। উৎস এবার কড়া গলায় বলল,

“বোনকে ওড়না ছাড়া বাহিরে নিয়ে এলে? ধর্মে পর্দা করার কথা বলা হয়নি? সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার হলেও শালীনতা বজায় তো রাখাই যায় তাই না? অন্তত একটা ওড়না দিয়ে বুক ঢাকা যায় না? বোনকে অসামাজিক করে গড়ে তুলছ কেন? এখন তো ভাই, পোশাকের দিকে কথা নিয়ে গেলেই মেয়েদের একটা কথা- বোরখা পরেও নারী রে*প হয়। ভাই, বোরখা পরলেও রে*প হয় বলে কি অশালীন এমন টাইট ফিটিং ড্রেস পরে বের হতে হবে? এটা পশ্চিমের দেশ নয় যে তুমি ন্যাং*টা হয়ে ঘুরলেও কেউ দেখবে না, ভাই এ দেশের ছেলেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মাথায় রাখতে হবে। দুইদিকেই কিছু কিছু অমানুষ থাকবেই। কাকে কী বলব! বিবেক যতদিন নাড়া না দেবে ততদিন অশালীনতাকেই মানুষ স্মার্টনেস ভাববে। অন্যদের কিছু শেখাতে গেলে নিজেদেরও একটু শিখতে হয়।”

উৎস আর সেখানে দাঁড়াল না। ছেলেটা একবার তার বোনের দিকে তাকাতেই মেয়েটা মাথানিচু করে নিল। উৎস হয়তো বুঝিয়ে দিয়ে গেল, এ দুনিয়াকে টিকিয়ে রাখতে উভয়পক্ষকেই মানুষ হতে হবে, মানুষ, অমানুষ বা বিবেকহীন নয়।

#চলবে…