প্রিয় বিকালফুল পর্ব-০৭

0
59

#প্রিয়_বিকালফুল(০৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

আষাঢ় মাস। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি নামছে আর থামছে। চারদিকে আঁধার নামিয়ে মেঘ জানান দিচ্ছে এই কাল বর্ষাকাল। এ সময়ে শুধু বৃষ্টির রাজ চলবে। না রোদ আর না রোদের আলো নিজের উপস্থিতি জানান দিতে পারবে৷ গত তিনদিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলছে পুরো শহরে।
সকাল থেকে পরিবেশটা থমথমে। একবার সূর্য উঁকি দিচ্ছে তো আবার কালো মেঘ। এভাবেই সকাল থেকে সূর্য আর মেঘের খেলা চলছে বিরামহীনভাবে।

বেশ কিছুক্ষণ আকাশ মেঘলা থাকার পর দুপুরের দিকে যেই না একটু সূর্য দেখা দিল পরক্ষণেই আকাশ থেকে দলবেধে বৃষ্টি ফোটা নামতে শুরু করল। এ যেন নিজের এলাকায় অন্য কাউকে অধিকারে আসতে না দেওয়ার লড়াই। দোতলা বড় বাড়িটার ছাদের ঠিক মাঝখানে কাক ভেজা ভিজছে এক নারী। পরনে কালো রঙের পাতলা সুতি কাপড়। অনেকটা সময় বৃষ্টিতে ভেজার নিমিত্তে শাড়ি ভিজে শরীরের প্রতিটা অঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। উক্ত নারীটি একমনে ছাদে বসে আকাশের দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। থেকে থেকে বৃষ্টি ফোটা এসে চোখের পাতায় পড়ছে। চোখের পানির সাথে বৃষ্টির পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানির যেন এই অসীম ক্ষমতাটা আছে। লোকচক্ষুর আড়ালে চোখের পানিকে বৃষ্টির পানিতে মিলিয়ে নিতে পারে।

এই বৃষ্টিতে আশেপাশে সব বাড়ির মানুষগুলো হয়তো দরজা-জানালা বন্ধ করে বৃষ্টি উপভোগ করছে অথবা ঘুমোচ্ছে অন্যদিকে নিতু প্রায় ঘণ্টাখানেক হলো ছাদে বৃষ্টিতে ভিজছে। শাশুড়িকে দুপুরের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে। সে এই কয়েকদিনে বুঝে গিয়েছে এই একটা মাত্র মানুষটাই তাকে চোখে হারায়। এতগুলো দিন বাড়ির বাহিরে সে নিজেও মাকে একটা সিঙ্গেল ফোনকল করার সাহস করে উঠতে পারেনি আবার তার মাও একবার কল করেনি৷ চোখ বন্ধ করলে নিতু বেশ অনুভব করতে পারে এই পৃথিবীতে তার কেউ নেই, কেউই নেই, কোথাও কেউ নেই। যে মানুষটাকে এই সময়ে এসে আঁকড়ে ধরতে চাইছে সেই মানুষটাও সবসময় পালাই পালাই করে। কত দূরত্ব তাদের মাঝে! নিতু আগের মতোই মজা চালিয়ে গেলেও মাঝেমাঝে আর এনার্জি পায় না। উৎসকে বলতে ইচ্ছে করে,

“আমি বড্ড ক্লান্ত। আমাকে একটু বুকে জড়িয়ে নেবেন? অনেক রাত নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাই না। অনেকদিন কেউ একটু ভালোবেসে বুকটা শীতল করে দেয় না। এই জীবনটা যে খুব ভারি ভারি লাগে। আর বয়ে বেড়াতে পারি না।”

ডুকরে কেঁদে উঠল নিতু৷ সে জানে এ সময়ে তার কান্না কেউ শুনতে আসবে না৷ লুকিয়ে লুকিয়ে, বুকের ভাঙা ভাঙা অনুভূতিপূর্ণ শব্দ লুকিয়ে আর কত কান্না করা যায়? একটু তো চিৎকার করে কেঁদে হালকা হতে ইচ্ছে করে। প্রায়ই এত মানুষের ভিড়ে কোন একটা বিশ্বস্ত মানুষের হাত ধরতে ইচ্ছে করে। কারো হাতে হাত রেখে জীবনভর একই পথে চলতে ইচ্ছে করে কিন্তু চারপাশ তো ফাঁকা। কেউ হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেই তার জন্য। চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিতু। কেউ নেই,কেউ নেই। সে যাকে পুনরায় চাওয়ার সাহস করছে তাকেও তো সে পায় না। বড্ড একা একা লাগে নিতুর।

নিতু চিৎকার দিয়ে কান্না করে বলে উঠল,“এত সময় ধরে যাকে চেয়ে চেয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে একা একটু ভালোভাবে বাঁচতে চাইলাম তুমি তখন তাকে মেঘহীন বৃষ্টির মতো আমার জীবনে আবার পাঠিয়ে দিলে। আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলে। হঠাৎ করে বিয়ের মতো সম্পর্কে কেন জড়িয়ে দিলে তুমি? এ সম্পর্কের যে কোন শক্ত খুঁটি নেই। আমি শক্ত করে ধরে রাখতে পারব না। আবার হারিয়ে ফেলব তাকে। আল্লাহ, এবার তুমি আমাকে নিয়ে নিও সে আমার কাছে থেকে চলে যাওয়ার আগে, হারিয়ে যাওয়ার আগে, অন্যকারো হওয়ার আগে। আমি আর সহ্য করতে পারব না।”

মনে প্রশ্ন জাগে নিতুর,“মানুষ ঠিক কতদিন একা একা ভালো থাকার অভিনয় করে যেতে পারে? তার মতো কি সবাই ক্লান্ত হয়ে যায়? দুনিয়া কি তখন সত্যিই অর্থহীন লাগে!?”

বিকেলের দিকে চারদিক পরিষ্কার হলো। কড়া রোদও দেখা দিল। চারপাশ ভেজা ভেজা অবস্থা থেকে শুকনো হতেও শুরু করল। মাটির সোঁদা গন্ধ দূর হতে থাকল। নিতু দুপুরে প্রায় পুরোটা বৃষ্টির সময় ছাদে ছিল। বৃষ্টি কমলে নিচে এসে গোসল করে ভালো না লাগায় বিছানায় এসে শুয়ে পড়েছে।

উৎস বিকেলের দিকে বন্ধুদের সাথে বাহিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। অনেকদিন সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয় না। আজ সুযোগ মিলতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সবাই একসাথে কিছু সময় কাটাবে। সে তৈরি হচ্ছিল আর বারবার নিতুকে দেখছিল। ঘড়ি জানান দিচ্ছে এখন বিকেল বেলা। এ সময় নিতু ঘুমায় না। এটা ওটা নাশতা বানিয়ে মায়ের রুমে বসে আড্ডা দেয়। এই অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে একটু খটকা লাগছিল উৎসর। তবুও ডাকলো না এটা ভেবে যে, হয়তো ঘুম পেয়েছে অনেক তাই ঘুমোচ্ছে।

উৎস যখন তৈরি হয়ে বের হবে তখনই ফরিনা বেগম নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
“নিতু কোথায়? আর তুমিই বা এখন কোথায় যাচ্ছ?”

উৎস শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,“আম্মা, নিতু ঘুমোচ্ছে। আমি বন্ধুদের সাথে একটু বের হব। সন্ধ্যা পর ফিরে আসব।”

“বিয়ের পর থেকে মেয়েটা এই বাড়িতে আটকে পড়েছে। কই তাকে তো একবারও ঘুরতে নিয়ে যেতে দেখলাম না? জামাকাপড় অবধি কিনতে নিয়ে যাওনি। মেয়েটা ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার করে সব আনিয়ে নিয়েছে। একটু তো স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারো তাই না?”

উৎস তাড়া দিয়ে বলল,“আম্মা, কাল বের হওয়া যাবে। আজ কিছুতেই পারব না।”

ফরিনা বেগম মুখ গোমড়া করে বললেন,“কাজের মেয়েটা ছুটিতে আছে। আমি তোমার খালার বাড়ি যাব ড্রাইভারকে নিয়ে। কয়েকদিন ওখানেই থাকব ভেবেছি। মেয়েটা ঘুমোচ্ছে, ঘুমাক। তুমি পারলে সন্ধ্যার আগেই চলে এসো।”

“তুমি কখন ফিরবে?”
“বললাম যে, দুইদিন থাকব ওখানে।”
“আমি নামিয়ে দেব?”
“না। তুমি যাও। আমি ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যাব।”
“ঠিক আছে।” বলেই বেরিয়ে গেল উৎস।

ফরিনা বেগমও নিজের ব্যাগটা বের করে ড্রাইভারকে ডাক দিলেন। সকাল সকাল যেতে হবে। সন্ধ্যা হতে হতে হয়তো আবার বৃষ্টি নেমে পড়বে। বৃষ্টির আগেই ও বাড়িতে পৌঁছতে হবে।

নিতুর ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা পর। মাথাটা ব্যথাও করছে। শরীরটা বড্ড দূর্বল লাগছে। ঠিকমতো পা ফেলে হাঁটতেও পারার শক্তিটুকুও নেই যেন। নিজেই নিজের কপালে হাত দিয়ে বুঝল কপাল গরম হয়েছে। রুমের এখানে ওখানে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে দেখল কিন্তু পেল না। থার্মোমিটার কোথায় কে জানে?
নিচে নেমে এলো সে। ফরিনা বেগমের রুমে উঁকি দিয়ে দেখল রুমে কেউ নেই। খুব কষ্টে এক কাপ চা বানিয়ে আবার রুমে গেল সে। ফোনটা বের করে শাশুড়িকে ফোন দিয়ে জানলো তিনি বাড়িতে নেই। উৎসর কথা জিজ্ঞেস করায় নিতু বলল,

“সে হয়তো তাড়াতাড়িই চলে আসবে।”

ফরিনা বেগম নিতুকে আদেশ করলেন উৎসকে ফোন করে বাসায় আনতে। নিতু কোনভাবে কথা শেষ করে ফোন রাখল। ফোন ঘাটাঘাটি করতে করতে মনে হলো সে তো উৎসর নম্বরটিই নেয়নি।

মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে তার৷ বসে থাকার শক্তিও যেন আর নেই৷ চা শেষ করতে পারল না সে। ওভাবে রেখেই বিছানায় আবার শুয়ে পড়ল। তারপর কখন সে ঘুমিয়ে গেল কে জানে!

উৎস বাড়ি ফিরল রাত নয়টায়। রুমে ঢুকে নিতুকে আগের মতোই শুয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেল তার দিকে। কাছাকাছি যেতেই বুঝল নিতু দুই হাত দিয়ে নিজেকে নিজে জড়িয়ে, গুটিসুটি মেরে শুয়ে প্রচন্ড কাঁপছে। অস্বস্তি নিয়ে নিতুর কাছে বসল সে। কপালে হাত দিতেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

“জ্বর এসেছে!”

তাড়াহুড়ো করে নিচে এসে ড্রয়িং রুম থেকে থার্মোমিটার আর জ্বরের ওষুধ নিয়ে ফিরে এলো রুমে। শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখল জ্বর অনেক বেশি৷ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। আজকেই বাসায় কেউ নেই আর আজকেই জ্বর আসতে হলো নিতুর। আপাতত জ্বর যেন একটু কমে যায় তাই অনেক কষ্টে নিতুকে তুলে বসিয়ে ঘুম ভাঙালো উৎস। নিতু সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না। টলছে বারবার। জ্বরের ওষুধটা এক প্রকার যু*দ্ধ করে খাইয়ে দিল উৎস। পুনরায় শুইয়ে দিল সে নিতুকে। আর কী করলে জ্বর কমবে ভাবতে ভাবতে কপালে জলপট্টির কথা মাথায় আসতেই একটা ছোট সাদা কাপড় ভিজিয়ে এনে নিতুর কপালে বসিয়ে দিল৷ নিতু হঠাৎ করেই উৎসর দিকে ফিরে তার হাতটা চেপে গালের নিচে এগিয়ে নিল। বারবার আরেকটা হাত ধরে নিজের দিকে টানতে থাকলো উৎসকে। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“আমার কাছে একটু থাকুন না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। আপনিও দূরে দূরে থাকেন। বুঝতে পারেন না আপনাকে ভালোবাসি৷ আর কত কষ্ট দেবেন, উৎস? গত কয়েক বছরে তো কম কষ্ট দিলেন না আমায়। আমি যে এখন আর সইতে পারছি না।”

নিতুর চোখ দিয়ে দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। উৎস থমথমে মুখে নিতুর দিকে চেয়ে রইল। ঘুমের মধ্যে কী বলছে মেয়েটা! ভালোবাসে? গত কয়েক বছর কষ্ট পেয়েছে? মানে? নিতু কি জ্বরে উল্টাপাল্টা বলছে! উৎস ভাবল, নিতুর তো মোহে আটকে যাওয়ার বয়সও নয়। তাহলে? দূরত্ব কি তবে আরও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া উচিৎ? সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলো উৎস।

চলবে…..