#প্রিয়_বিকালফুল(০৮)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
সকাল সাতটার দিকে নিতুর ঘুম ভাঙলো। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো ভেতরে আসছে। রাতে জানালা আটকে দেওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল সে। আলো একটু পর বিছানায় এসে হয়তো লুটোপুটি খাবে। আড়মোড়া ভেঙে পাশে তাকাতেই ঘুমন্ত উৎসর নিষ্পাপ মুখখানা চোখে পড়ল। নিজের জায়গা থেকে কিছুটা তার দিকে এগিয়ে গেল নিতু। উৎসের গাল আদরে স্পর্শ করে বিড়বিড় করে বলল,
“এই লোকের বয়স নাকি পয়ত্রিশ হবে! কে বলবে তার বয়স এত? আমার চেয়েও তো ছোট ছোট মনে হয়। সেই এগারো বছর আগের উৎসের চেয়ে শরীর স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নত হয়েছে, চেহারায় ম্যাচুরিটির ছাপ এসেছে তবে বয়স কিছুতেই ধরা যায় না। এখনো ঠিক আগের মতোই তরুণ আপনি।”
নিতু মিষ্টি হেসে উৎসের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,“আমার বর। আপনি শুধু আমার। আমি যেমন নিজেকে আপনার করে দিয়েছি, খুব তাড়াতাড়ি সেই সময় আসবে যেদিন আপনিও নিজেকে আমার করে দেবেন, শুধু আমার।”
প্রিয় মানুষটার কপালেও একটা চুমু দেওয়ার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারল না নিতু। বরের ঘুমের সুযোগ নিয়ে আলতো করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিতে অতীত ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই কেমন মাথাটা ঘুরে উঠল তার। শব্দ করে বসে পড়ল বিছানায়। শব্দে ঘুম ভেঙে গেল উৎসের। তড়িৎ গতিতে উঠে এসে নিতুর পাশে বসল। কপালে হাত দিয়ে জ্বর মেপে দেখল কপাল ঠান্ডা। জ্বর এখন নেই। নিতু জোরপূর্বক হেসে বলল,
“আমি ঠিক আছি।”
“কতটুকু ঠিক আছেন সেটা নিজেই দেখতে পাচ্ছি। জ্বর নেই কিন্তু শরীর দূর্বল। একা বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না। কোথায় যাচ্ছিলেন?”
নিতু চুপ করে রইল। উৎস আবার জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছিলেন বলুন? কোন প্রয়োজন?”
নিতু বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল উঁচু করে উৎসকে দেখিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,“এক এ যাব।”
“এক এ মানে?”
পরক্ষণেই নিতুর ইশারা বুঝতে পেরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিল উৎস। বলল,
“চলুন আমি এগিয়ে দিয়ে আসি ওয়াশরুমের দরজা অবধি। একেবারে ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি রতন চাচাকে দিয়ে নাশতা আনিয়ে নিচ্ছি।”
নিতু হাঁটতে হাঁটতে বলল,“আমি নাশতা বানাতে পারব।”
“পারবেন না।”
“পারব। আমার বাহিরের নাশতা খেয়ে অভ্যাস নেই। সেই তো ডাল, সবজি আর পরোটা।”
“আজ কষ্ট করে খেয়ে নিন।”
“আপনি গিয়ে আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকবেন৷ অন্তত চা তো বানাতেই পারি। ”
“সে দেখা যাবে। এখন যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
একে একে দুজনে ফ্রেশ হয়ে নিল। উৎস রতন ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু নাশতা আনিয়ে নিল। রতন গতকাল ফরিনা বেগমকে রেখে রাতেই বাড়ি ফিরেছে।
উৎস নিতুকে বিছানা থেকে আর নামতে দেয়নি। সবগুলো খাবার যখন নিয়ে রুমে এলো নিতু একে একে সব দেখে বলল,
“চা ছাড়া নাশতা ইনকমপ্লিট।”
উৎস কোমরে দুই হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইশারায় বলল,“চলুন। আজ আমি আপনাকে চা করে খাওয়াব। আপনি আমাকে শুধু শিখিয়ে দেবেন যে, আপনি কীভাবে চা করে খান।”
নিতু মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বলল,“সাধারণ মানুষ ভেবেই এত যত্ন, বউ ভাবলে না জানি কী করবেন!”
উৎস নিজেই সাবধানে নিতুকে রান্নাঘর অবধি নিয়ে গেল। কী কতটুকু পরিমাণে লাগবে সব শুনে নিজেই নিতুর কথামতো চা বানিয়ে ফেলল। দুজনে আবার নিজেদের রুমে ফিরে এলো। উৎস নিতুকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসলো। নিতু প্রথমে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে নিল। কী মনে করে নিজের কাপটা উৎসর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার বানানো চা আপনিই প্রথমে টেস্ট করে দেখুন তো মিষ্টি, স্বাদ ঠিকঠাক আছে কি না?”
উৎস প্রথমে জুস মুখে নিচ্ছিল। নিতুর কথায় তার দিকে তাকিয়ে বলল,“আপনারটা আপনিই দেখুন। আমি আমারটা দেখছি।”
নিতু জোর করে উৎসর মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,“আরে দেখুন তো! এটাই দেখুন।”
নিতুর জোরাজুরিতে উৎস চায়ের কাপে চুমুক দিল। টেস্ট ভালো বুঝে নিতুকে কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বলল,
“আপনার বানানো চায়ের মতো ওরকম সেরা হয়নি কিন্তু আমারটাও খুব একটা খারাপ না খেতে।”
নিতু এবার খুঁজে খুঁজে বের কর করল উৎস কাপের কোথায় ঠোঁট স্পর্শ করে চুমুক দিয়েছে। সেখানেই নিজেও চুমুক দিয়ে বলল,
“অথচ পৃথিবীর সেরা চা আমি আজ পান করছি। চা ও এত প্রাণ জুড়ানো হয়! বরের হাতের বানানো চা বলে কথা!”
উৎস নিতুর কথায় শুধু মৃদু হাসলো। সে এই কয়েকদিনে বেশ বুঝে গেছে নিতু একাই পরিবেশ মাতিয়ে রাখতে পারে। কথা দিয়েই কারও মন ভালো করে দিতে পারে আবার নিজেকেও ভালো রাখতে জানে। বিড়বিড় করে বলল,“ অসুস্থ অবস্থায় ফ্লার্ট করা কমবে না এই মেয়ের।”
দুজনে নাশতা শেষ করল৷ জ্বর যেন আবার নিতুকে কাবু করে না ফেলে তাই উৎস আগে থেকেই ওষুধ এনে পাশে রেখেছিল। উৎস যখন ওষুধগুলো নিচ্ছিল নিতুকে দিতে তখন হঠাৎ নিতু বলে উঠল,
“অসুস্থতার একটা সুবিধা আছে জানেন? বরের সেবা পাওয়া যায়, ভালোবাসা পাওয়া যায়, আদর পাওয়া যায়। এই যেমন আমি এখন পাচ্ছি। আহা সারাজীবন যদি এমন সেবা পাওয়া যেত!”
উৎস ওষুধ নিতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,“আমি আপনার সেরকম বর নই, নিতু। এই যত্নটা একমাত্র মনুষ্যত্ব থেকে।”
“মনুষ্যত্ব না দেখিয়ে প্রেমিক অথবা বরের মতোই ব্যবহার করুন। আমি বাহিরে কোথাও গিয়ে বলব না যে মেজর উৎস আমাকে রে*প করেছে। যেই কয়েকদিন এখানে থাকার ভাগ্য আছে সেই কয়েকদিন নাহয় বরের মতোই রইলেন আর এরপর কখনো দেখা হলে নাহয় অচেনা হিসেবেই ট্রিট করবেন।”
উৎস এবার পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,“আপনার কথাগুলো মজা হলে ঠিক আছে কিন্তু আপনি প্লিজ আমার সাথে ইমোশনালি কানেক্ট হবেন না বা হতে চাইবেন না এখনই আর আমাকেও বাধ্য করবেন না। আমি যতদূর সম্ভব আপনার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। আপনি বারবার সেই দূরত্ব কমিয়ে কাছে আসার চেষ্টা করেন। এসব করবেন না।”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“আমি মানুষ হারানোর শোক সহজে কাটিয়ে উঠতে পারি না। ভালোবাসতে পারা মানুষগুলোই কীভাবে কীভাবে যেন ঠকে যায়। মানুষ মারা গেলে তো কিছুদিনে সহ্য হয়ে যায় কিন্তু হারিয়ে গেলে সহ্য হয় না। আমি অন্তত আর মানুষ হারানোর শোকে তলিয়ে যেতে চাই না।”
নিতু আচমকা উৎসর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। উৎস তাকালো নিতুর দিকে। নিতু উৎসর চোখে চোখ রেখে বলল,
“আপনি চাইলে আমি থেকে যাব। আমার ভূত-ভবিষ্যৎ সব আপনি। আমি এই ছন্নছাড়া জীবন বয়ে বেড়াতে পারছি না। ক্লান্ত লাগে ভীষণ। একবার শুধু আমাকে রেখে দিন। দুনিয়ার কেউ আপনার কাছে থেকে আমাকে নিতে পারবে না। ”
উৎস জোরপূর্বক হেসে নিতুর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিতুর মাথায় হাত রেখে বলল,
”আপনার ভবিষ্যৎ অনেক ব্রাইট হবে। অনেক ভালো একটা মানুষকে আপনি ডিজার্ভ করেন।”
নিতু আর কিছু বলল না। সব কথার পৃষ্ঠে আসলে শব্দরা এক হয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে না। কিছু সময় নিজেরা গুটিয়ে গিয়ে সামনের মানুষটার সামনে নিজেকে চুপ করিয়ে দেয়। থাকুক না কিছু কথা আড়ালে, চুপ করে।
বিকেলের দিকে নিতুর জ্বর আবার বাড়ল। উৎস এবার বাড়তি কিছু চিন্তা না করে বাড়িতেই ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলো। ডাক্তার নিতুর চেক-আপ করে কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে তৎক্ষনাৎই বিদায় নিল। রতনও বিকেলে বাড়িতে নেই। নিজের বাড়ি থেকে কল আসায় উৎসকে জানিয়ে ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছে। এখন ওষুধ নিয়ে আসতেই হবে আবার নিতুকে একা রেখেও বাহিরে যেতে মন টানছে না উৎসর। ওষুধ আনতে গেলে তবুও পনেরো বিশ মিনিটের ব্যাপার। এই সময়ে যে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে ভেবে উৎস বলল,
“বাহিরে যাবেন? শরীরটা ভালো লাগবে। আপনাকে একা বাসায় রেখে ওষুধ আনতে যেতে পারছি না।”
নিতু মুখ মলিন করে বলল,“সেই তো গাড়িতে বসে থাকতে হবে। হাঁটতে তো পারব না।”
“সমস্যা নেই। গাড়িতেই নাহয় বসে রইলেন। চলুন। আলাদা করে তৈরি হতে হবে?”
নিতু মৃদু হেসে বলল,“শুধু চুলটা আচড়ে নিতে হতো।”
“পারবেন?”
“না পারলে কি আপনি আচড়ে দেবেন নাকি? ”
“সাহায্য করতেই পারি।”
“থাক, আমিই পারব।”
“আচ্ছা দশ মিনিটে তৈরি হয়ে নিন।”
মিনিট পনেরো, বিশেকের মধ্যে দুজনে বেরিয়ে ওষুধ কিনে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তার পাশে ফুসকার দোকান দেখে গাড়ি থামাতে বলল নিতু। উৎস গাড়ি থামাতেই সে বলল,
“ঝাল ঝাল করে ফুসকা খেলে আমার মাথা একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে। জ্বরও আর আসবে না দেখবেন।”
নিতুর এই ছোট্ট কথায় হঠাৎ প্রাক্তন স্ত্রীর কথা মনে পড়ল উৎসর। তখন তো সে স্ত্রী ছিল না, প্রেমিকাও সেভাবে ছিল না। প্রথম প্রথম কথা বলায় যেভাবে তাকে চিনেছিল উৎস তার কোনটাই ভবিষ্যতে সে খুঁজে পায়নি। প্রথম যখন তার জ্বর হয়েছিল এবং উৎসকে জানিয়েছিল তখন কিঞ্চিৎ চিন্তা হয়েছিল উৎসের। তখনই এই অনুভূতি অনুভূত হয়েছিল যে মেয়েটার শরীর খারাপে উৎসের মন খারাপ হয়, চিন্তা হয়। তার জ্বর নিয়ে যখন উৎস দুশ্চিন্তা করেছিল, সাবধানে থাকতে এবং ঠিকমতো ওষুধ খেতে বলেছিল তখন ওপাশের মেয়েটি বলেছিল,
“আমাকে নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না, ঝাল ঝাল করে একপ্লেট ফুসকা খেলেই আমার জ্বর, মাথাব্যথা একেবারে গায়েব হয়ে যাবে।”
যদিও প্রেম চলাকালীন বা বিয়ের পর উৎস প্রাক্তন স্ত্রীকে সেভাবে ফুসকা খেতে দেখেনি। মানুষের পরিবর্তন কত সহজেই হয়ে যায়!
নিতুর ডাকে সৎবিৎ ফিরল উৎসর। নিতু আবারও বলল
“যাবেন না? এক প্লেট অন্তত খাওয়ান। আমি আপনাকে এটার পরিবর্তে একদিন আপনার পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াব, প্রমিস।”
উৎস মৃদু হেসে বলল,”একপ্লেটই কিন্তু মনে যেন থাকে।”
নিতু মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। উৎসের দিকে একপলকে চেয়ে মনে মনে বলল,
“আপনার কাছে কোনকিছু চাওয়ার সাথে সাথে যদি পাওয়া যায় তবে আমি বারবার, প্রতিবার আপনাকেই চাইব, উৎস।”
চলবে….