#প্রিয়_বিকালফুল(১২)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বউভাতের অনুষ্ঠানে উৎস আর নিতু পৌছে গিয়েছে অল্প সময় হলো। এর মাঝেই উৎস আর নিতুকে দেখে অনেকেই এগিয়ে এসে পরিচিত হয়ে নিচ্ছে। উৎসের নতুন বউ বলে কথা! মজার ব্যাপার হলো এখানকার অনেকেই নিতুকে নিতুর পুরোনো পরিচয়ে চেনে। দেশের এক প্রকার গর্ব বলে কথা! যার কাজই বেশিরভাগ অনলাইন নির্ভর তাকে মানুষ চিনবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অন্যান্য দিনের মতোই নিতুকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে সবার কাছে। এখানে বিশেষ করে যারা বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে আছে তারা নিতুর সাথে ভাব জমাতে আসছে।
উৎস নিতুর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়ে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। যখন মেয়েগুলোর সাথে সাথে দুই একজন ছেলেও এসে নিতুর সাথে কথা বলছে তখন উৎসের অন্যরকম এক অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, বাহিরের মানুষের সাথে হেসে হেসে এত কথা কেন বলতে হবে? কই তার সাথে তো এভাবে বলে না! কথায় কথায় তাকে লজ্জায় ফেলা ছাড়া এই মেয়ের অন্য কোন রূপ সে দেখেইনি। এদিকে নিতু নিজের সাথে যু*দ্ধ করে একা একা অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে কথা বলছে। কিছুক্ষণ পরপর উৎসের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে। মনে মনে যেন বলছে- আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান।
উৎস হঠাৎ নিতুর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। জোরপূর্বক হেসে কিছু বুঝাতে চাইল। উৎস কিছু বুঝল কি না কে জানে! সে এগিয়ে এসে হাতের ওয়াচের দিকে তাকিয়ে নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এবার খাবারের দিকে যাওয়া যাক? বিয়ে বাড়ির মূল আকর্ষণ খাবার। খাবারের চেয়ে নেশালো প্রেমিকা এই দুপুর বেলা খালি পেটে আর কাউকে মনে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি আমার সাথে আসলে বড্ড উপকার হয়।”
নিতু সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে উৎসের সঙ্গে হাঁটা ধরল। কী মনে করে এদিক ওদিক দেখে নিতু আজ প্রথমবারের মতো উৎসের হাত ধরার সাহস দেখালো। আলতো করে হাতের মধ্যে হাত দিয়ে বলল,
“আমার ওখানে বড্ড অসহায় লাগছিল। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওতক্ষণ কথা বলা যায়!”
উৎস হাতের দিকে তাকাতেই নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে রইল। উৎস হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“পরিচিত মুখ বলে কথা। মানুষ তুলো তুলো করে রাখবে এটাই স্বাভাবিক।”
“আপনার বউকে সবাই এত পছন্দ করছে, আপনার ভালো লাগছে না?”
“হ্যাঁ, খুব ভালো লাগছে। গান বাজলে খুশিতে নেচে উঠতাম, এতটা ভালো লাগছে!”
নিতু মুচকি হেসে বলল,“খুশিতে গান বাজিয়ে সবার সামনে নাচের বিষয়টা আপনার সাথে ঠিক যায় না। আপনি চাইলে মৃদু আলোতে আমরা বিভিন্ন ধরণের কাপল ডান্স দিতেই পারি। শুধু আমি আর আপনি থাকব। না থাকবে দেখার কেউ আর না থাকবে বলার কেউ৷ ভালো হবে না?”
উৎস চোখমুখ শক্ত করে বলল,“আপাতত খেয়ে উদ্ধার করুন।”
“কাকে?”
“মানে?”
“খাব!”
“বড্ড অসভ্য মেয়ে তুমি।”
“অসভ্য মেয়ে না অসভ্য বউ।”
উৎস আর কোন কথা না বাড়িয়ে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে, পুনরায় সবার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করেছিল উৎস। হঠাৎ একলোক হাতে ক্যামেরা নিয়ে তাদের দুজনের সামনে এসে দাঁড়াল। বিনয়ের সাথে নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপু, আপনার কিছু ছবি তুলে দেই? আপনার ফটোশুট করার খুব ইচ্ছে আমার সেটা তো পূরণ হওয়ার ছিল না। হাতেগোনা তিন, চারটা ছবি তুলে দেই? আমি খুব খুশি হব আপনি অনুমতি দিলে। আমি আপনার অনেক কাজ দেখেছি।”
নিতু কিছু না বলে উৎসের দিকে তাকালো। উৎসের মুখ দেখে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে উৎস এসবে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। উৎসের দিকে তাকাতেই উৎস কোন কথা না বলে পাশে সরে গিয়ে দাঁড়াল। নিতুও ভেতরে অস্বস্তি নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল নিজের।
নিতু খেয়াল করল লোকটা থামার নাম নিচ্ছে না, ছবি তুলেই যাচ্ছে তখন সে নিজে থেকেই বলে উঠল,
“ভাইয়া, আমার বোধ হয় ছবি অনেকগুলোই তোলা হয়েছে।”
লোকটা মুচকি হেসে বলল,“আপু, আপনার মতো কাউকে পেলে কী আর ছবি তোলায় ইতি টানতে ইচ্ছে করে! আচ্ছা যাই হোক, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর বা কিছু দেন আমাকে। আমি ছবি এডিট করে পাঠিয়ে দেব। ছবিগুলো মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর এসেছে। আপনার এমনিতেই কোন তুলনা হয় না।”
নিতু আধো আধো গলায় বলল,“নম্বর!”
লোকটা ওপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“জি। ছবি পাঠিয়ে দেব।”
নিতুকে কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইল। পরক্ষণেই উৎসকে ডেকে নিল। ফটোগ্রাফারকে বলল,
“আমাদের দুজনের একসাথে কয়েকটা ছবি তুলে দেওয়া যাবে?”
লোকটা প্রথমে কিছুক্ষণ উৎসকে দেখে নিল তারপর জোরপূর্বক হেসে বলল,“জি, অবশ্যই।”
নিতু উৎসকে শিখিয়ে শিখিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল। ফটোগ্রাফার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল হয়তো কিছুটা। তার জানামতে, নিতু আনম্যারিড। হঠাৎ এমন কিছু দেখে সে হজম করতে পারছে না। সে কোন কথা না বলে চুপচাপ ছবি তুলল।
ছবি তোলা শেষ হতেই নিতু মৃদু হেসে উৎসকে বলল,“তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা উনাকে একটু দাও। উনি আমাদের ছবি পাঠিয়ে দেবে।”
লোকটা আগ্রহ দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসল,“ম্যাম, উনি কে হয় আপনার?”
নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় বলে উঠল,“ আমার বর৷ আমরা নিউলি ম্যারিড কাপল।”
লোকটার মুখটা হয়তো চুপসে গেল নিতুর কথায়৷ মনে কী ছিল কে জানে! নিতু উৎসের হাতটা পুনরায় ধরল। উৎস এবার আর ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করল না। নিতু লোকটার থেকে বিদায় নিয়ে বলে উঠল,
“যাওয়া যাক!?”
উৎস শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
___
কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। উৎসের ছুটির মেয়াদ অর্ধেকের বেশিতে পৌঁছে গেছে। দুজনের মধ্যাকার দূরত্ব অনেকখানি ঘুচলেও কাছাকাছি আসা হয়নি দুজনের কারও। উৎস আজকাল নিতুর প্রতি টান অনুভব করে। যেটা দিনকে দিন মেয়েটা নিজ দায়িত্বে বাড়িয়ে নিচ্ছে। নিতু কখনোই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ে না। সবকিছুতে নিজের কর্তৃত্ব ফলাতে ব্যস্ত। উৎসও নিজেকে অভ্যস্ত করে নিচ্ছে।
নিতু স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে সে আর বাহিরের কোন দেশে যেতে চায় না আপাতত। উৎসের যদি কখনো মনেও হয় নিতুর সাথে আর থাকা যাচ্ছে না, তাকে সহ্য করা যাচ্ছে না তাহলে সে নিজে থেকেই কোথাও চলে যাবে। উৎস এ ব্যাপারে নিতুর সাথে কোন কথা বলেনি এরপর। ফরিনা বেগম ছেলেকে বুঝিয়েছেন, এবার উৎসের সংসারে মন দেওয়া উচিত। নিতুকে তিনি মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছেন। ছেলের বউ হিসেবে নিতু একদম পারফেক্ট।
নিতু নিজের তাগিদে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। উৎসও যেন মনের অজান্তেই নিতুর সাথেই মানিয়ে নিতে ব্যস্ত।
ফরিনা বেগমের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে কয়েকদিন হলো। নিতু আজ নিজেই উনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। উৎস নিতুকে যেতে না দিয়ে নিজেই মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে চেকআপে গিয়েছে। বিকেলে বেরিয়েছে মা, ছেলে। ওদিকে ডাক্তারের কাছে থেকে ফরিনা বেগম একটু বোনের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবেন বলে জানিয়েছেন বের হওয়ার সময়।
বাসায় কেউ নেই। নিতু ভাবলো রুমটা একটু অন্যভাবে গুছাবে। ভাবনা অনুযায়ী এটা ওটা করতে করতে নিজের কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আলমারির ড্রয়ারে রাখতে ড্রয়ার খুলতেই একটা খামের দিকে চোখ গেল তার। বাম হাতে খামটা নিয়ে নিজের কাগজগুলো ভেতরে রেখে বিছানায় এসে বসল।
খামের বাহিরে উৎসের নাম এবং ঠিকানা লেখা। সম্ভবত কাগজটা হাতে হাতে না এসে কোনভাবে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। নিতু জানে কারও অনুমতি ছাড়া কোনকিছুতে হাত দিতে নেই কিন্তু খামটা দেখার পর থেকে সে ইচ্ছে দমন করতে পারছিল না। শুকনো ঢোক গিলে খামের ভেতরে থাকা কাগজখানা বের করল সে। ভাজ করে রাখা একটা মোটা কাগজ হাতে নিয়ে ভাজ খুলল।
নিতু চোখ বুলিয়ে যেতে শুরু করল। লাইনের পর লাইন পড়ে বুঝতে পারল এটা ডিভোর্স পেপার। উৎস এবং তার প্রাক্তন স্ত্রীর নামও সেখানে লেখা। নিতু সম্পূর্ণ কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চোখের সামনে থেকে কাগজ নামাতেই বুঝতে পারল সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখের বর্ণ তার রক্তা*ভ। চোখ দুটো যেন এখনই বেরিয়ে আসবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে মুখে ক্রোধ স্পষ্ট।
নিতু কাগজখানা হাতে নিয়েই দাঁড়াল। সামনে থাকা ব্যক্তি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে নিতুর হাতে থেকে কাগজটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠল,
“তোমার সাহস কী করে হলো আমার ব্যক্তিগত ড্রয়ারে হাত দেওয়ার? আমার ব্যক্তিগত জিনিস তুমি দেখছ? কারও অনুমতি ছাড়া তার কোনকিছুতে হাত দিতে হয় না সেটা জানো না তুমি? এত ম্যানারলেস মেয়ে তুমি এটা জানতাম না।”
উৎসের এতগুলো কঠিন কঠিন কথা অসহায়ের মতো গিলে নিল নিতু। উৎসের কথায় জবাব না দিয়ে ভারিকণ্ঠে শুধালো,
“ আপনি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছেন, উৎস? আপনি ডিভোর্সি নন, আমাকে বিয়ে করার আগে থেকেই বিবাহিত!”
#চলবে…..