প্রিয় বিকালফুল পর্ব-১৫

0
66

#প্রিয়_বিকালফুল(১৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“তুই নিতুকে সত্যিই বাড়িতে রেখে আসবি? এটা ঠিক হচ্ছে না, উৎস। তুই আমার ছেলে হয়ে ওই মেয়েটাকে এমন একটা শা*স্তি দিবি? মেয়ে মানুষ কখনোই চায় না তার স্বামী ভাগাভাগি হোক। একটা মেয়ে তার মা,বাবা, ভাই, বোন সবাইকে অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারলেও স্বামীকে পারে না। ও একটা ভুল করেছে এবারের মতো মাফ করে দে। তোরও তো দোষ আছে।”

মায়ের কথা ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎস। আগ্রহ নিয়ে শুধালো,“আমার কী দোষ?”
“তোর সব জিনিসে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নিতুর আছে। আলমারি থেকে ওই কাগজটা পেয়ে নাহয় একটু ভুলই বুঝেছে তাই বলে তুই কেন মাথা গরম করলি? তুই কেন সব কথা ক্লিয়ার করে বললি না?”

উৎস মায়ের পাশে এসে বসল। মাথানিচু করে কিছুক্ষণ মৌন রইল৷ ফরিনা বেগমও আর কিছু বলছেন না৷ উৎস এবার মাথা তুলে মায়ের দিকে চাইল। মাথা চুলকে বলল,

“তুমি দেখছি একটু কথা আড়াল করতেও দেবে না। ”

ফরিনা বেগম নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি ফেলে শুধালেন,“কোন কথা আড়াল করতে চাইছিস? মেয়েটা গত দুইদিনে কী পরিমাণ কষ্ট পেয়েছে আর এখনো পাচ্ছে তুই জানিস?”

উৎস মুখ মলিন করে বলল,“খারাপ তো আমারও লাগছে, আম্মা। ”

ফরিনা বেগম ছেলের দিকে কিছুটা এগিয়ে এলেন। উৎসের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শুধালেন,
“একটা সত্যি কথা বলবি, বাপ?”
“হুম?”
“নিতুকে তুই এই দুই মাসে একটুও ভালোবাসতে পারিসনি?”

মায়ের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল উৎস। ধীরপায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল সে। বাহিরে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠল,

“জানি না, আম্মা৷ হয়তো ভালোবাসি আবার হয়তো বাসি না। তবে এসব উনার কাছে প্রকাশ করতে ভয় লাগে। দেখো না, সবসময় দূরত্ব রেখেই চলি। আমার এখনো মনে হয়, আমি আবারও ঠকবো। নিতুও আমাকে ঠকাবে। ”

“নিতুর ব্যবহারে খুব কষ্ট পেয়েছিস তাই না?”

উৎস মায়ের দিকে ফিরে জোরপূর্বক হাসলো। মৃদু গলায় বলল,“চরিত্র নিয়ে কথা বললে কার খারাপ লাগবে না বলো? যেখানে আমি জানি আমি ঠিক কতটা সঠিক!”

ফরিনা বেগম কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে বললেন,”আচ্ছা বাপ, যা হয়েছে এবারের মতো মাফ করে দে। ওকে নিয়ে যেতে হবে না।”

উৎস দুই ধারে মাথা নাড়ল। স্থীর দৃষ্টি ফেলে বলল,“না আম্মা। এটুকু তার প্রয়োজন তবে এর ভেতরে অন্যকিছু আছে।”
“আমাকে বলবি না?”
“বলতে চাইছি না। তোমাকে একদম নিশ্চিন্ত দেখলে নিতু সন্দেহ করবে। ফিরে এসে বলব।”
“কিন্তু…”
“চিন্তার কোন কারণ নেই, আম্মা। ভরসা রাখো। আসছি।”

পরদিন সকাল সকাল চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করল কাজের নতুন মেয়েটা। উৎস যাকে আনতে গিয়েছিল সে এবারও ফিরতে পারেনি৷ কয়েকদিন আগে একজনকে পাঠিয়েছিল তাকে পছন্দ করেননি ফরিনা বেগম তাই উপায় না পেয়ে নতুন কাউকে বাসায় আনতে হয়েছে। মেয়েটা চায়ের কাপ হাতে উৎসের দিকে এগিয়ে গেল। মুচকি হেসে বলল,

“স্যার, আপনের চা।”

উৎস ল্যাপটপে মুখ গুজে ছিল। চায়ের অফার পেতেই মুখে হাসি ফুটল তার৷ এক মুহূর্ত দেরি না করে বিনা দ্বিধায় চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক বসালো। সাথে সাথে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিল সে৷ বিরক্তির সাথে বলে উঠল,

“এটা কোন চা হলো? সামান্য চা বানাতেই পারো না, রান্না কীভাবে করবে?”

মেয়েটা আমতা আমতা করে বলল,“ভালো হয় নাই?”

উৎস পিরিচে চায়ের কাপটা রেখে জবাব দিল,
“একটুও না।”
“আরেকবার বানাইয়া আইনা দেই? ভাল্লাগবো।”
“লাগবে না যাও।”

মেয়েটা আর কোন কথা না বলে চায়ের কাপটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুহূর্তেই রুমে প্রবেশ করল নিতু। তার হাতে দুই কাপ চা। কোন আগাম বার্তা ছাড়া উৎসের ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল সে। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“আমার হাতের শেষ চায়ের কাপটা নিন। এরপর তো আর আমার হাতের চা খেতে পারবেন না। এবার সবার হাতের সব রকম চা খাওয়ার অভ্যাস করুন, উৎস। আমি আপনাকে চা করে খাওয়ানোর জন্য থাকব না। এ বাড়িতে আমার আয়ু শেষ। ”

উৎস নিতুর মুখের দিকে তাকাতেই দেখল নিতুর মুখ মলিন। অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো হয়তো অনুনয় করে বলছে- আমি থেকে যেতে চাই প্লিজ আমাকে রেখে আসবেন না।

উৎস পাত্তা দিল না। চায়ের কাপটাও নিল না সে। নিতুকে শুধু একবার দেখে আবার কাজে মন দিল। উৎসের এমন ব্যবহারে বুক ভেঙে কান্না এলো নিতুর। নিজেকে সামলে চায়ের কাপটা রেখে স্থান ত্যাগ করল শুধু।

সকালের খাওয়া শেষ করে উৎস রুমে প্রবেশ করে দেখল নিতু আয়নার সামনে বসে সাজছে। উৎস এক পলক দেখেই বিছানায় গিয়ে বসল৷ পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল,

“কতক্ষণ লাগবে?”

নিতু বসা থেকে উঠে উৎসের পাশে এসে বসল। হঠাৎই উৎসের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

“প্লিজ আমাকে বাড়ির এক কোণায় রেখে দিন না। আমার এই দুই মাসে আপনি অভ্যাস হয়ে গেছেন। আমি আপনাকে ছাড়া কীভাবে থাকব বলেন? আমি পারব না। তাছাড়া আমি নিজের বাড়িতে যেতেও চাই না। বাবাকে চরম ঘৃণা করি আমি।”

উৎস নিতুর দিকে চোখ তুলে চাইল না। মসৃণ গলায় সংক্ষিপ্ত আকারে শুধু বলল,

“এখন তোমার বিয়ে হয়েছে। তোমার বাবা এখন তো আর জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারবে না। আর চিন্তাও নেই।”
“আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
“যখন তোমার নজরে আমার চরিত্রে দাগ ছিল তখন তুমিই চলে যাওয়ার কথা বলেছিলে আর যখন দেখলে আমার দোষ নেই তখন আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। মানুষ সবসময় স্বার্থপর হয়।”

নিতু মাথা নিচু করে অনুনয় করে ফের বলল,“এটুকু ভুলের জন্য এত বড় শা*স্তি দিচ্ছেন। পস্তাবেন আপনি।”
“ঠিক আছে পস্তালাম।” সংক্ষিপ্ত জবাব উৎসের।

নিতু উঁঠে দাঁড়াল। হাতের উলটোদিক দিকে চোখ, গাল মুছে নিজের জায়গায় পুনরায় ফিরে গেল।

বের হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। নিতুও রেডি। যদিও সে রেডি হতে অনেকটা সময় নিয়েছে। ভেবেছিল উৎস হয়তো যেকোন সময় বলবে- থাক, যাওয়া লাগবে না। মাফ করে দিলাম।

“এসো, বের হওয়া যাক।” নিতুকে সম্পূর্ণ তৈরি দেখে উৎস নিতুকে তাগাদা দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে যেই বের হবে ওমনি নিতু আচমকা এসে উৎসকে জড়িয়ে ধরল।

বুকের ঠিক বামপাশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। উৎস হঠাৎ এমনকিছু ঘটে যাবে বুঝে উঠতে পারেনি। হাতের ব্যাগটা সাথে সাথে মেঝেতে ধপ করে পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাসটাও থেমে গেল। সমস্ত শরীর অসার হলো। হাত দুটো নিজেদের পূর্ববর্তী অবস্থানেই স্থীর রইল। পরম যত্নে সামনের মানুষটাকে সে নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হলো।

নিতু যখন উৎসেত বুক থেকে মাথা তুলল তখন তার চোখে পানি আর উৎসের চোখে অবাকভাব। নিতু সামনে দাঁড়ানো পুরুষটার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে চাইল। অশ্রুসিক্ত চোখ আর হাসিমাখা মুখে বলে উঠল,

“আপনাকে পাওয়া আমার হলো না। খুব ইচ্ছে ছিল এই বুকটা আজীবনের জন্য আমার আশ্রয়স্থল হোক। আপনি সেটা হতে দিলেন না। আমি আবারও আপনাকে হারালাম আমার দোষে আর আপনার কঠোরতায়। আর ফিরব না আমি আপনার কাছে৷ নিজেকে ভালো না বেসে আসলে অন্য কাউকে ভালোবাসতে নেই।”

উৎস মৌন রইল। নিতু পরনের শাড়ি ঠিক করে উৎসের দিকে চেয়ে মৃদু গলায় বলল,

“আমাকে একটা বার ভালো করে দেখে নিন, উৎস। এই মেয়েটা আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। আমাদের আর হয়তো কখনো দেখা হবে না। এ বাড়ি থেকে আমার বের হওয়া, আপনার কাছে থেকে দূরে যাওয়া মানে আমার ম*রে যাওয়া। আমি আর আপনাকে ভালোবাসতে বেঁচে উঠব না, উৎস। নিজের খেয়াল রাখবেন।”

#চলবে…..