প্রিয় বিকালফুল পর্ব-১৭

0
51

#প্রিয়_বিকালফুল(১৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

প্রায় ঘণ্টা খানেকের মাথায় নিতুদের বাড়ির সামনে পৌঁছলো উৎস। এতটা পথ কী যে দুশ্চিন্তায় কেটেছে তা পরিমাপ করার মতো নয়। বাড়ি থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে সে৷ ড্রাইভ করতে করতে সমানে নিতু এবং নিতুর মাকে কল করেছে। কেউই ফোন রিসিভ করেনি৷ আজকের পথ যেন শেষ হতেই চাইছিল না। দূর্গম পথেও স্বাভাবিকের চেয়ে গতি অনেকটা বেশি ছিল গাড়ির। এতটা পথ কীভাবে সে এসেছে সেটা সে জানে না।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির দিকে ছুটলো। বাড়ির মেইন গেইট বাহির থেকে আটকানো। উৎস ভালো করে খেয়াল করে দেখল গেইটে তালা ঝুলছে। মুখে হাত দিয়ে ব্যস্তপায়ে পায়চারি করে ভাবতে থাকল কী করা যায় এখন? মা, মেয়ে দুজনের নম্বরে পুনরায় কল দিল। হতাশ হলো সে। ফোনের আশেপাশে বোধ হয় কেউ নেই। এখন কী করবে সে? এই পরিস্থিতিতে আসলে কী করা উচিত? পুলিশকে কল করবে? তারা আসতে আসতে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। যা করার তাকেই করতে হবে এবং সেটা খুব দ্রুত।

ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে গেইটটা ভালোভাবে দেখল উৎস। রঙচটা গেইটটা আকারে ছোট। একটু চেষ্টা করলেই লাফিয়ে ভেতরে প্রবেশ করা যাবে। আর কিছু ভেবে সময় ব্যয় করার মতো সময় নেই তার হাতে। ফোনটা পকেটে রেখে লাফিয়ে উঠল গেইট দিয়ে। অনেক কষ্টে স্বল্প সময়ে ওপরেও উঁঠে গেল। লাফিয়ে ওপাশে নিচে নামল। পুরো বাড়ি অন্ধকার। ফোন বের করে পুনরায় আলো জ্বালিয়ে নিতুর নাম নিয়ে ডাকাডাকি শুরু করল। পুরো বাড়ি ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই।

উৎস ঘামছে। অসহ্যকর লাগছে সবকিছু। নিতুর চিন্তায় সবকিছু এলোমেলো লাগছে। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল সে। অস্থির দেখাচ্ছে তাকে। কী করবে বুঝে উঁঠতে পারছে না।

হঠাৎই এক রুম থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে এলো। কান সজাগ হলো উৎসের। পুনরায় আওয়াজ শুনতেই সেদিকে দৌঁড়ে গেল। দরজা বাহির থেকে আটকানো। দ্রুত দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল সে। মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা গেল নুরজাহান বেগমকে। উৎস তাড়াতাড়ি করে উনার মুখের বাঁধন খুলে দিল। নুরজাহান বেগম হাঁপাচ্ছেন। উৎস হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে শুধালো,

“নিতু কোথায়? আপনার এই অবস্থা কেন?”

নুরজাহান বেগম হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,“নিতুকে তুমি বাঁচাও, বাবা।”

উৎস শুধালো,“ও কোথায়? আপনি তো বলেছিলেন আপনি ওকে দেখে রাখবেন। ওর কোন বিপদ হবে না। আপনি তো সবকিছু জানেন। আমি ওকে রেখে যেতে চাইনি শুধুমাত্র আপনার কথা ভেবে আমি ওকে এখানে রেখে গিয়েছি।”

নুরজাহান বেগম চোখ বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করার চেষ্টা করলেন। উৎসকে অধৈর্য্য হতে দেখে বললেন,

“তুমি সকালে নিতুকে রেখে গিয়েছিলে। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। সকালে রাগ দেখালেও দুপুরে আমার হাতে ভাতও খেয়েছে আমার মেয়ে। সন্ধ্যার দিকে ওর বাবা ফিরে এসেছে হঠাৎ করে। তার এখনো এক সপ্তাহ পর ফিরে আসার কথা ছিল। হয়তো বাড়ির আশেপাশের কেউ তাকে খবর দিয়েছে আর সকালেই রওয়ানা দিয়েছে তাছাড়া এতদূরের পথ তাড়াতাড়ি আসার কথা না।”

উৎস ব্যস্ত গলায় বলে উঠল,“নিতু কোথায় সেটা বলুন, আমি অন্যকিছু শুনতে চাই না।”

নুরজাহান বেগম ফুপিয়ে উঠলেন।কাঁদতে কাঁদতে বললেন,“ওর বাবা কয়েকজনকে সাথে করে এনেছিল। ওকে জোর করে কোথাও নিয়ে গেছে। আমি উনার নতুন রূপ দেখলাম আজ। কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”

উৎস অবাকচোখে নুরজাহান বেগমের দিকে তাকালো।
“কোথাও নিয়ে গেছে মানে? কোথায় নিয়ে গেছে আপনি জানেন না? ওকে কেন অন্য কোথাও নিয়ে যাবে?”
“কী একটা নাম বলছিল মনে করতে পারছি না।”
“মনে করুন জলদি। আমার হাতে সময় নেই। এক ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে মাফ করতে পারব না।”

নুরজাহান বেগম উৎসের ছটফটানি স্বভাব দেখে জোর করে মনে করার চেষ্টা করল। কিছু মুহূর্ত পর মনে হতেই নামটা জানিয়ে দিল উৎসকে। উৎস আর দেরি না করে নুরজাহান বেগমকে ওভাবেই একা ফেলে দ্রুত বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসে নাম অনুযায়ী সার্চ করে সব তথ্য খুঁজে বের করে মাথায় হাত পড়ার যোগাড়। নিতুকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! উৎস দ্রুত গাড়ি নিয়ে নিতুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। মনে এখন একটাই দুশ্চিন্তা, না জানি তার এখন কী অবস্থা! ভালো আছে তো সে!?

নুরজাহান বেগমের বলা জায়গায় পৌঁছতে উৎসের খুব বেশি সময় লাগল না। গাড়িতে বসেই সে পুলিশকে ইনফর্ম করে রেখেছে। গাড়ি এসে থামল একটা পুরোনো হোটেলের সামনে। গেইটের সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোক একটা সরু লাঠি হাতে উঁচু টুলে বসে আছে। কিছুক্ষণ পরপর ঘুমে সামনের দিকে ঢুলে পড়ছে।

উৎস গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে এলো। গেইটের সামনে বসা লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে নিজেই ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করল একবার। শব্দ হতেই চোখ মেলে তাকালো লোকটা। উৎসকে গেইট খুলতে দেখে সচকিত এগিয়ে গেল সেদিকে।

“এই এই কী করতাছেন? আপনে কেডা? এইখানকার কোন কাস্টমার? আমারে না কইয়া ভেতরে যাইতাছেন ক্যান? ”

উৎস নিজের ঠোঁটে আঙুল রেখে ”সসস” উচ্চারণ করে ইশারায় চুপ করতে বলল লোকটাকে। পরক্ষণেই প্রশ্ন ছুড়ল, “নুরুল ইসলাম এসেছে এখানে?”

লোকটা ওপর নিচ মাথা নাড়ালো।
“জি আইছে। ভেতরে আছে।”
“প্রায়ই আসে নাকি?”
“হ। তয় আইজ সুন্দর একখান মাইয়া আনছে। ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বইলা গেছিল। এই মেয়েরে দিয়া এবার সবুজ বাত্তি জ্বালাইবো ওই।”

“ওর বাত্তি আমি জ্বা*লাচ্ছি।” বলেই ভেতরে প্রবেশ করল উৎস।

গেইটের ভেতরে দূরে একটা বিল্ডিংয়ে মরিচবাতি জ্ব*লছে আর নিভছে। ঠিক কোনদিকে গেলে নিতুকে পাবে কিছুই বুঝে উঁঠতে পারছে না। বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে যেতেই একটা স্টল টাইপের দেখতে পেল উৎস। কয়েকজন লোক এবং মহিলা সেখানে বসে চা খাচ্ছে আর উচ্চস্বরে হাসিঠাট্টা করছে।

কোনকিছু না ভেবে সেদিকেই এগিয়ে গেল উৎস। দূর থেকে অন্ধকারে এতক্ষণ কাউকেই দেখতে পায়নি সে৷ কাছে আসতেই মুখগুলো স্পষ্ট হলো। এখানে অবস্থানরত সবগুলো মুখ অপরিচিত। চোখ বন্ধ করে নুরজাহান বেগমের ঘরে ঝুলানো নুরুল ইসলামের ছবির মুখখানা ভাবার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হলো কিন্তু এখানে সে নেই। অতিরিক্ত প্রেশারে মাথাটা ঘুরে উঁঠল। হয়তো কিছুক্ষণের জন্য অসহায়ও লাগল নিজেকে। আফসোস হলো -কেন যে সে নিতুর সাথে ওই বাড়িতে থেকে গেল না! বাড়ি ফেরার তো কোন তাড়া তার ছিল না। কাউকে মিছেমিছি শা*স্তি দিতে গিয়ে এ কী দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তার! নিতু ঠিক আছে তো? নিতুর কিছু হলে নিজেকে সে কীভাবে মাফ করবে? নিতুই বা কীভাবে মাফ করবে তাকে? সব গুলিয়ে যাচ্ছে উৎসের। হন্তদন্ত হয়ে বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটে গেল সে।

বিল্ডিংয়ের প্রবেশদ্বারের ঠিক ডানে একটা ছোট রুম। কয়েকজনের খুব আলাপ আলোচনা শোনা যাচ্ছে। উৎস এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল কথা শুনে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল যেন। কেউ একজন বলে উঁঠল,

“এই মেয়ের পেছনে কতগুলো বছর সময় পার করেছি আমি৷ নিজের শখ মিটিয়েছি আমি। ব্যবসা রমরমা চলবে। নিতু নিতু নিতু এখন একটা আধমরা চিংড়ি মাছ। আমি যা বলব তাই করতে হবে। টাকার ঘ্রাণ পাচ্ছি আমি।”

দরজা খট করে খোলার শব্দ শুনে চুপ হয়ে গেল সবাই। দরজায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটার দিকে তাকালো। আগন্তুককে এবারই হয়তো প্রথম দেখছে সবাই। তার নজর রুমের একজনের ওপর সীমাবদ্ধ। ব্যক্তিটি নুরুল ইসলাম। নড়ে চড়ে বসলেন উনি। উৎসকে ভয়ানক দেখাচ্ছে। চোখ বড় বড়। লালরং ধারণ করেছে। এক প্রকার ভেতরে ছুটে গিয়ে নুরুল ইসলামের শার্টের কর্লার চেপে ধরল উৎস। চোয়াল শক্ত করে নুরুল ইসলামের পুরো শরীর ঝাঁকিয়ে শুধালো,

“নিতু কোথায়? ওকে কোথায় রেখেছিস তুই বল?”

নুরুল ইসলাম এদিক ওদিক সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার উৎসের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। কপাল সটান বিস্তৃত করে জানতে চাইল,

“কে আপনি?”

উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“তুই যাকে নিয়ে এসেছিস তার জান হই আমি।”
“মানে?”
“তোর বউ তোকে বলেনি? নিতুকে বিয়ে করেছি আমি। ও আমার বউ হয়।”

নুরুল ইসলাম উৎসের হাতে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
“নিজের প্রাপ্য নিজেই পাইলাম না আবার আরেকজন এসে হাজির। ভালোয় ভালোয় এখানে থেকে বেরিয়ে যা নইলে ভালো হবে না বলে দিলাম। টাকা লাগলে বল, দিয়ে দিচ্ছি কিন্তু নিতুকে কিছুতেই ছাড়ব না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এখান থেকে তোর লা*শ বের হবে।”

উৎস এক হাতে পকেট থেকে নিজের রিভলবার বের করে নুরুল ইসলামের কপালে ঠেকালো। চোখ বড় বড় করে কপালে ঠেকানো রিভলবার দেখার চেষ্টা করল নুরুল ইসলাম। শুকনো ঢোক গিলতেই উৎস বলে উঠল,

“ফাঁকা আওয়াজ এখানে দিতে আসিনি আমি। আমার বউয়ের যদি কিছু হয় একেকটার লা*শ ফেলে দেব আমি। আমি তার চোখের এক ফোঁটা পানি বা তার শরীরে একটা আঁচড় সহ্য করব না। তার ভালো লাগা, খারাপ লাগায় আমি ছাড়া কেউ বা কিছু থাকবে না। তাকে ভালো রাখলেও আমি রাখব, খারাপ রাখলেও আমিই রাখব। তোর মতো কু*ত্তার বাচ্চা সামনে এলে ছিঁড়ে ফেলব জাস্ট।”

উৎস ধমকের স্বরে ফের বলে উঠল,“জান দিবি নাকি নিতুর খোঁজ দিবি? এই সময়ে যদি ওর কিছু হচ্ছে রে নুরুইল্লাহ, তোকে আমি ন্যাং*টা করে মহিলা কলেজের সামনে ফেলে আসব।”

নুরুল ইসলাম বাহিরের দিকে ইশারা করে বলল,“ওকে কাস্টমারের কাছে পাঠানো হইছে। দোতলায়, দুইশো চার নম্বর রুমে আছে।”

উৎসের চোখ থেকে যেন র*ক্ত ঝরার যোগাড়। রিভলবার দিয়ে চকিতে নুরুল ইসলামের মাথায় আঘা*ত করল সে৷ চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,

“আমার বউরে বাজারের মেয়ে মনে হয়? ওরে রুমে পাঠাইছিস তুই! তোর নোংরামি আমি বের করে দিচ্ছি দাঁড়া জানো*য়ার।”
#চলবে….