প্রিয় বিকালফুল পর্ব-১৮

0
57

#প্রিয়_বিকালফুল(১৮)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

[প্রাপ্তবয়স্ক মনস্কদের জন্য]

আবছা অন্ধকার রুম। মৃদু আলোয় সব ঝাঁপসা আর অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দরজায় শব্দ হতেই ভয়ে আরও জড়সড় হলো নিতু। পায়ের আওয়াজে মুখরিত হলো সামনে দিকটা। দরজা এতক্ষণ বাহির থেকে বন্ধ ছিল। হাজার চেষ্টা করেও এই কয়েদখানা থেকে বের হতে পারেনি। অতঃপর যখন বুঝল আর কোন পথ নেই নিজেকে বাঁচানোর তখন সবচেয়ে বড় আর মন্দ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে নিতুকে।

নিতু বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে। এতকিছুর সমাপ্তির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সে। নিতু জানে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে তবুও এই বিষাক্ত জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার লোভ তার পিছু ছাড়েনি। বিছানার সাথে লেপ্টে ধরে আছে ছোট একখানা ছুড়ি। নিজের প্রাণের নিশ্চয়তা না থাকতেই পারে জীবন থাকতে শরীরের নিশ্চয়তা দেওয়া নিজের দায়িত্ব।

বেশ লম্বা চওড়া গোছের লোক রুমে লাইট অন করল। হঠাৎ আলো জ্বেলে ওঠায় চোখ বন্ধ করে ফেলল নিতু। ছোট ছোট চোখে তাকাতেই সামনে দাঁড়ানো লোকটার মুখে ঠোঁট বাঁকানো বিশ্রি হাসিটা নজরে এলো তার। লোকটা নোংরা দৃষ্টিতে তাকে দেখছে।

নিতু কোমরে গুঁজে রাখা ফোনটা বের করল। মায়ের নম্বরে ছোট একটা মেসেজ টাইপ করল,
“তোমরা আমাকে মে*রে ফেলতে চাইলে আর আমিও শরীরের সাথে মনটাকে হনন করলাম। ভালো থেকো, মা। এই পৃথিবী অন্ধদের।”

নিতু ফোনটা পাশে রাখতেই খেয়াল করল লোকটা তার পাশ ঘেষে বসেছে। চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখছে। কী বিশ্রি নজর! ঠিক এই নজর তাকে একবার নয় বারবার মরে যেতে বাধ্য করে। জীবনটা বিষিয়ে যায়।

নিতু জানে, আজ এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক কতটা মুশকিল। এত মানুষ, এত কড়া পাহাড়া, এত গোলকধাঁধা পেরিয়ে নিজেকে রক্ষা করা আজ সম্ভব নয়। নিজের সম্মানের কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। এত অসহায় লাগছে যে, সে ধরেই বসে আছে এ পৃথিবীতে তার জন্য কেউ নেই। একটা মানুষ এতটা নিঃসঙ্গ হতে পারে!

লোকটা তার নোংরা নজরে নিতুকে গিলে খাওয়ার পর শরীরে হাত দিল। নিতুর বাহুতে হাত দেওয়ার সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঁঠল নিতুর। ইশ, কী বাজে অনুভূতি! একটা কাপুরুষই হয়তো শুধু একটা নারীকে তার সম্মতি বিনা এগভগত ছুঁতে পারে।

সরে গেল নিতু। শেষ সময়েও নিজের শরীরে যেন পুনরায় দাগ না বসে তার চেষ্টা করল। বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেল দরজা খোলার চেষ্টা করল। দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দেওয়া। আহ! নিজেকে রক্ষা করা এত কঠিন কেন!

নিতুকে ছুটোছুটি করতে দেখে লোকটা ঠোঁট বাঁকিয়ে উচ্চস্বরে হাসল৷ বলল,

“মোটা অংকের টাকা দিয়ে তবেই এসেছি। সুন্দরীকে ভো*গ না করে এমনি এমনি ছেড়ে দেব নাকি? সুন্দরীর প্রথম ফুলসজ্জা আমার সাথেই হবে। এই শরীর কি এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি? ভালো হয়, তুমিও এনজয় করলে। যা হওয়ার তা তো হবেই। জোর করে বা তোমার নিজ ইচ্ছায়। তুমিও একটু ভেবে দেখো, বিষয়টা খারাপ লাগবে না। আজ খুশি করে দাও, টাকা তুমিও পাবে। ”

ঘৃণায় চোখ বন্ধ হয়ে এলো নিতুর। দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে। শেষ পর্যন্ত জীবনের ইতি কি তবে এই কারাগারে হবে? বুক ভারি হয়ে এলো তার৷ দুটো হাত এক করে মিনতির স্বরে বলল,

“আমাকে প্লিজ যেতে দিন৷ আমার এমন সর্বনাশ করবেন না।”

নিতু পরক্ষণেই ঢোক গিলে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“আমার ক্ষমতা ছিল প্রয়োজনে আপনাকে খু*ন করে নিজেকে রক্ষা করার কিন্তু আমি বেঁচে থেকেই বা কী করব? নিজেকে রক্ষা করে কার জন্য নিজেকে সাজাব? কেউ নেই আমার। শুধু আমি আমার শরীরে আর দাগ ফেলতে চাই না।”

নিতুর কথা কানেও নিল না লোকটা। নোংরা হাসি হেসে নিতুর সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। নিতু পিছাতে শুরু করল। নিতুর এই অসহায়ত্ব যেন লোকটার পৈশাচিক আনন্দ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিতু শরীরে বল পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর দাঁড়িয়ে থেকেও টলছে সে।

শেষ পর্যন্ত লোকটা নিতুকে নোংরা হাতে স্পর্শ করল। দুই হাতে নিতুর দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দাঁত কেলিয়ে বলল,

“এত ছুটোছুটি আর ভালো লাগছে না। এবার কাছে এসো। এমন ফুলের থেকে আর কতক্ষণ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখব? এবার ফুলটা ছিঁড়তে চাই।”

নিতু নিজের সর্বোচ্চ শক্তিটুকু দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। চেষ্টাটা এবার ধস্তাধস্তিতে রূপ নিল। ঘরের এখানে ওখানের জিনিস দুজনের ধস্তাধস্তিতে এলোমেলো হতে থাকল। নিতু কিছুতেই পেরে উঠছে না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে রক্ষা করতে পারবে কি না কে জানে? বারবার চিৎকার করে বাঁচার আকুতি করছে৷ ঘরের ভেতরে যেন বিশ্বযু*দ্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ নিতুর ব্লাউজের দুইটা হাতার কিছু অংশ ছিঁড়েও গিয়েছে এতক্ষণে। নিজের ভবিষ্যত ভেবে কান্নায় জর্জরিত হচ্ছে নিতু। কোন আশার আলো নেই তার জন্য?

সব আশার আলো যখন একটু একটু করে নিভে অন্ধকারে বিলীন হবে ঠিক তখনই দরজায় অসম্ভব রকমের শব্দ হলো। বিদ্যুৎ গতিতে ভেতরে প্রবেশ করল উৎস।

উৎসকে দেখে লোকটা নিতুকে ছেড়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। নিতু আশার আলোর মতো অস্পষ্ট কাউকে দেখল৷ নিজেকে লোকটার থেকে বাঁচাতে দৌঁড়ে উৎসের বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অবিন্যস্তভাবে বলে উঠল,

“আমাকে বাঁচান প্লিজ৷ আমি নিজের এত বড় ক্ষতি সহ্য করতে পারব না।”

নিতুর অবস্থা দেখে উৎসের রাগ যেন তরতর করে বেড়ে গেল। চোখ জোড়া রাগে বৃহদাকার এবং রক্তাভ রং ধারণ করল৷ চোয়াল শক্ত হলো এবং হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। এক হাতে নিতুকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে পরপর কয়েকবার সজোরে লা*থি বসালো লোকটা বুকে, হাতে, পায়ে। বিপরীত দিক থেকে কোন কথাবার্তা ছাড়া আকস্মিক এমন আঘা*তে লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বলার চেষ্টা করল,

“এই মাইয়াকে আমি এক রাতের জন্য কিনে নিয়েছি।”

অস্পষ্ট শব্দে বলা কথাটা বুঝল উৎস। পকেট থেকে রিভলবার বের করতে দেরি হলো না তার। পিছনে দরজার বাহিরে কয়েকজন পুলিশ এসে উপস্থিত হলো। উৎসের হাতে রিভলবার দেখে একজন বলে উঁঠল,
“স্যার, এমন কিছু করবেন না।”

কে শোনে কার কথা? উৎসের কানেও কারও কথা পৌঁছল না। গু*লি বের হলো রিভলবার থেকে। সোজা গিয়ে লাগল লোকটার ডান হাতে। উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

“পরবর্তীতে কাউকে ছোঁয়ার আগে দুইবার নিজের কথা ভেবে নিবি। নেক্সট টাইম গু*লি এখানে ওখানে না মে*রে জায়গামতো বসিয়ে দেব। বউকেও সুখী করতে পারবি না।”

দুজন কনস্টেবল এসে লোকটাকে তুলে বাহিরে নিয়ে গেল। নিতু ততক্ষণে উৎসের বুকে ঢলে পড়েছে। চোখ বন্ধ। নিস্তেজ মেরে গিয়েছে। কোন সাড়াশব্দ নেই যেন। উৎস নিতুর মুখটা বাহুতে রেখে গালের এপাশে ওপাশে নেড়ে বারবার ডেকে তোলার চেষ্টা করল কিন্তু উৎস ব্যর্থ হলো। নিতু কিছুতেই জ্ঞানে এলো না। অতঃপর উপায় না পেয়ে নিতুকে চকিতে কোলে তুলে নিল সে৷ বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপনারা থানায় যান, আমি যোগাযোগ করে নিব৷ আমার হাতে সময় নেই।”

উৎস বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। উৎসের পিছন পিছন দোতলা থেকে নামল পুলিশগুলোও। উৎস এক হাতে একটা রুমের দরজা খুলে দিয়ে নুরুল ইসলামকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল,

“এই শু*য়ো*রের বাচ্চা এক্সট্রা খাতির যত্ন পাবে। কোন কমতি যেন না থাকে। এর শরীরের সব জায়গায় যেন মেহমানদারিতা চলে।”

উৎস দ্রুত নিতুকে নিয়ে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে এলো। সামনের বড় ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে গেইটের সামনে আসতেই দেখল গেইট আটকানো। বার কয়েক জোরে জোরে পা দিয়ে আঘা*ত করতে ওপাশে বসে থাকা লোকটা তাড়াতাড়ি করে গেইট খুলে দিল। উৎস নিতুকে নিয়ে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে নিজেও গিয়ে অতি দ্রুত নিজের সিটে বসল। নিতু সোজা হয়ে বসে থাকতে পারছে না। এদিকে ওদিকে হেলে পড়ছে। সিটবেল্ট বেঁধে দিল উৎস। নিতু হঠাৎ শ্বাস আটকে যাওয়ার মতো জোরে করে বুক উঁচিয়ে নড়ে উঁঠল।

উৎসের ভয় হলো এবার৷ নিতুর এমন অবস্থা দেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার আগে আরেকটাবার নিতুর এ গালে ও গালে থাপ্রে ডাকার চেষ্টা করল। নিতু হয়তো এবার চাইল খানিকটা। আবারও জোরে শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিল। সমানে শ্বাস, প্রশ্বাস চলছে দেখে উৎস কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে নিতুর কাছে নিজেকে এগিয়ে নিল। বারবার ডাকতে থাকল,

“নিতু, অ্যাই নিতু। কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? এখন আর কোন ভয় নেই৷ দেখো আমি চলে এসেছি। আমি আর কখনো একা তোমাকে রাখব না বিশ্বাস করো৷ তাকাও একবার, নিতু।”

নিতুর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নিঃশ্বাসের গতি বাড়ছে দেখে ভয় উৎসের। কিছু একটা ভেবে নিতুর মুখের দিকে এগোতেই কেন বিশ্রি, কটু গন্ধ লাগল নাকে। ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করল উৎস। হয়তো কিছু একটা বুঝেও গেল।

ভয়ে যেন অক্ষিকোটর থেকে সাদা অংশ বেরিয়ে আসার যোগাড় হলো উৎসের। শিরা, উপশিরায় জ্বা*লা দিয়ে উঠল কিছু।

ভয়ার্ত গলায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,“নিতু, কী খেয়েছ তুমি?”

নিতু জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল। মৃদু আওয়াজে স্বল্প ঠোঁট নেড়ে বলে উঠল,

“বি*ষ খেয়েছি আমি৷ জীবন থাকতে এই শরীরের দাগ আমি আর সহ্য করতে পারতাম না। আমি আমার কাছে চাঁদ হলেও এবারের দাগ আমাকে অমাবস্যা দেখাতো। এমনিতেই নিঃশেষ হতাম আমি। আমি দাগহীন চাঁদ নই তবে অমাবস্যাও আর হতে চাই না। চাঁদের গায়ে দাগ বেশি হলে তো অমাবস্যাই হয় না তাই না? যে দাগে চাঁদকে আর দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না সে দাগ যে চাঁদের অস্তিত্বও তলিয়ে দেয়। ”

#চলবে….