প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২০

0
95

#প্রিয়_বিকালফুল(২০)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

নিতু বিদেশ থেকে দেশে ফিরে বান্ধবীর সাথে যে বাসায় থাকত সেখানে ফিরতে ফিরতে সকাল সাতটা বেজে গেল। ভোরবেলা বের হলেও গাড়ি ঠিক সময়ে পায়নি সে। গাড়ি পেতেই অনেকটা সময় লেগেছিল।

গাড়ি এসে যখন বাসার সামনের রাস্তায় এসে থামল তখন নিতু গাড়ি থেকে নামতেই দেখল বন্যা বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিতুকে দেখতে পেতেই দ্রুত এগিয়ে এলো সে। কাছাকাছি এসে নিতুর দিকে ভালোভাবে চাইতেই দেখল নিতুকে বড্ড বিধ্ব*স্ত দেখাচ্ছে। মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।

বন্যা ভাড়া মিটিয়ে দিতেই গাড়িচালক গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বন্যা নিতুকে নিজের দিকে সোজা দাঁড় করিয়ে শুধালো,

“কী হয়েছে, নিতু? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

নিতু বিরসমুখে বলল,“বন্যা, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমাকে একটু ধরে ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবি? আমার মনে হয় না দোতলায় উঠতে পারব।”
“চল নিয়ে যাচ্ছি।”

বন্যা নিতুকে সযত্নে বাসার বাহিরে থেকে দোতলায় নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,

“আমি এখানেই তোর ব্রাশ আর পানি এনে দিচ্ছি শুধু ব্রাশ করে কুলকুচি করে নে। খাওয়া দাওয়া করে তারপর নাহয় ফ্রেশ হবি ভালোমতো।”

নিতু বলল,“হসপিটালে ছিলাম। গোসল করতেই হবে। তুই একটু পানিটা ছেড়ে দে। আমার জামাকাপড়গুলো একটু বের করে দে। শুধু গিয়ে পানি ঢালব।”

“ঠিক আছে। আমি তোর জন্য রান্না করে রেখেছি। গোসল দিয়ে এসে খেয়ে নে তাহলে। পরে তোর ভালো লাগলে নাহয় সবটা বলিস আমাকে। এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করব না।”

নিতু সম্মতি জানিয়ে চোখটা বন্ধ করে নিল। চোখ বন্ধ করতেই বুঝল মাথাব্যথা প্রকোপ আকার ধারণ করেছে, চোখটাও জ্বালা করেছে। এখন ভালোমতো একটু গোসল না করলেই নয়।

নিতু নিজের দূর্বল শরীরকে খানিকটা সুস্থ করতে গোসল শেষ করে যতটুকু সম্ভব ততটুকু খেয়ে নিল। বন্যাকে জানালো সে একটু ঘুমোতে চায়৷ সারা রাত ঘুম হয়নি। বিকেলে নাহয় তার সাথে সব কথা বলবে। বন্যাও নিতুর শরীরের অবস্থা দেখে আর জোর করল না। সে জানে নিতু তার কাছ থেকে অন্তত কিছুই লুকোবে না শুধু সুস্থ হতে তার একটু সময় দরকার। বন্যা নিজেই রুমের লাইট অফ করে, জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে নিতুর ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিল। বন্যার মনে শুধু কিছু প্রশ্নই জাগছে- উৎস কোথায়? তার সাথেই কি তবে কিছু হয়েছে? এভাবে বাড়ি ছেড়ে এখানে কেন এলো নিতু? তাদের সম্পর্ক কি এখনো ঠিক হয়নি? নিতু সবটা জানায়নি উৎসকে? সে হসপিটালেই বা কেন ছিল?

বন্যার এত এত প্রশ্নের উত্তর শুধু নিতুই দিতে পারবে। বন্যা নিতুর দিকে তাকাতেই দেখল নিতু এতক্ষণে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে চোখ বন্ধ করেছে।
___

উৎস নুরজাহান বেগমকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজেও বাসায় ফিরেছে। নুরজাহান বেগম মেয়ের জন্য অসম্ভব চিন্তা করছিলেন। উৎস আশ্বস্ত করে বলেছে- নিতু কোথায় গিয়েছে সে জানে। সে নিতুকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনবে।

উৎস বাসায় ফিরেছে এগারোটার দিকে। ফরিনা বেগম ভেবেছিলেন এবার হয়তো দুজনের মান অভিমানের পালা শেষ হলো তাই তিনি কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দুজনের জন্য বিভিন্ন রকমের রান্না করিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসবেন। এবার হয়তো বাড়ির পরিবেশ পরিবর্তন হবে। হলো তার উলটো। উৎস একা বাসায় ফিরল। সঙ্গে নিতু নেই। উৎসকে বাসার ভেতরে একা ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন ফরিনা বেগম। উৎসকে পাশ কাটিয়ে পেছন দিকে এদিক ওদিক দেখলেন কিন্তু নিতু সঙ্গে নেই। তিনি উৎসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“নিতু কোথায়?”
“আসেনি।” সংক্ষেপে জবাব এলো উৎসের দিক থেকে।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধালেন ফরিনা বেগম,“আসেনি মানে? সে কোথায়? এলো না কেন?”
“সম্ভবত সে তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে। আগে যেখানে ছিল দেশে ফিরে।”
“সেখানে কেন যাবে তার নিজের বাড়ি থাকতে?”
“অভিমান করে, আম্মা।”
“কী হয়েছিল গতকাল? সন্ধ্যায় বেরিয়ে গেলে, রাতে জানালে সকালে দুজন একসাথে ফিরবে আর এখন একা একা এসেছ।”

উৎস সেখানেই দাঁড়িয়ে সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায় ততটুকু বলল। ফরিনা বেগমের মেজাজের পারদ যেন তরতর করে বাড়ল। চোখে-মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
“সংসার, বউ, মা এগুলোর প্রতি এত উদাসীন কেন তুমি, উৎস? কই কাজের ব্যাপারে তো তুমি এমন নও! তবে ঘরের কথা যখন আসে তখন তুমি এমন গাধা কেন হয়ে যাও? মেয়েটা তোমাকে এত ভালোবাসে। দুইটা মাস এই বাড়িতে সময় ব্যয় করেছে শুধুমাত্র তোমার ভালোবাসা পেতে আর তুমি! তুমি পড়ে আছ সেই অতীত নিয়ে। তুমি এখনো এই মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারলে না অথচ ভালোবাসা নাকি এক মুহূতেই হয়ে যায়। মেয়েটা তোমার সাথে সংসার করতে চেয়েছিল, একসাথে থাকতে চেয়েছিল বিধায় পুরো দুনিয়া ভুলে এখানে পড়ে ছিল তুমি সেটারই সুযোগ নিয়ে তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছ। কথায় বলে না, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম মানুষ বোঝে না? তুমি হচ্ছ সেরকম।”

ফরিনা বেগম আফসোস করতে লাগলেন। ছেলেকে এখন মোটেও সহ্য হচ্ছে না তার। আরও কিছু কথা বলতে চেয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে বিরক্তি প্রকাশ করে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন। যাওয়ার সময় কাজের মেয়েটাকে ডেকে বললেন,

“রান্নাবান্না সব বন্ধ রাখ তো। আজ কিচ্ছু রান্না করতে হবে না। রতনকে বল গাড়ি বের করতে। আমি এ বাসায় থাকব না। যার বাড়ি সে একা একা আরাম আয়েশ করুক। মানুষ তো তার সহ্য হয় না।”

উৎস ত্রস্ত পায়ে মায়ের রুমের দিকে রওয়ানা দিল৷ যেতে যেতে বলল,“আম্মা, প্লিজ তুমি অন্তত আমাকে একটু বোঝো। আমি নিতুকে ফিরিয়ে আনব। কথা দিচ্ছি তোমায়।”

দাঁড়িয়ে গেলেন ফরিনা বেগম। পুনরায় উৎসের দিকে ফিরে কটাক্ষ করে বললেন,“মেয়েটা চলে গেছে ভালো হয়েছে। কতদিন আর ভালোবাসা ভিক্ষা চাইবে। কম সময় তো তোমার পিছনে ব্যয় করল না। তাকে তুমি ফিরিয়ে আনতেই বা যাবে কেন? সে এখানে ফিরে কী করবে? আমার সেবা? প্রয়োজন নেই। মেয়েটা কতবার তোমার কাছে মাথানত করে মাফ চেয়েছিল, তুমি নরম হওনি। ”

উৎস এবার অসহায়ের মতো বলল,“আম্মা, অবুঝের মতো কথা কেন বলছ? তুমি জানো আমি আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কাউকে ধরতে দেই না। সেদিন বাসায় ফিরে নিতুকে ডিভোর্সের কাগজ হাতে দেখে রাগ হয়েছিল ঠিকই নিতুও তো কম কথা বলেনি। ওসবের জন্য কিঞ্চিৎ খারাপ আমারও লেগেছিল তাই বলে মাফ করিনি এই কথা ভুল। আমি শুধু ওকে একটু বুঝিয়েছিলাম ও ভুল করেছে। আমার অভিমান, মন খারাপ হতে পারে না? চুপচাপ থাকাটাই আমার চরম অপ*রাধ ছিল। নিতুর মা নিতুকে দেখতে চেয়েছিল, তাকে নিয়ে যেতে বলেছিল অনেকবার। শেষমেশ রাজি হয়ে ওকে নিয়ে যাই। শুধু এই বিষয়টা লুকোনোই আমার ভুল ছিল। তোমরা সবাই মিলে আমাকে এমনভাবে দোষী সাব্যস্ত করছ যেন আমি অনেক বড় অন্যা*য় করেছি। হ্যাঁ, করেছি ওকে একা রেখে এসে। আমি নিজেই নিজেকে মাফ করতে পারছি না। ওর জন্য খারাপ লাগছে আমার। আমি জানি না এই খারাপ লাগা থেকে কবে বের হতে পারব। ওর কাছে আমি এই ভুলের জন্য মাফ চাইবো, আম্মা। আমি মাফ চাইবো।”

উৎস গড়গড় করে কথাগুলো বলে ওপরে নিজের রুমে চলে গেল। ফরিনা বেগম ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের রুমের সামনে। কী থেকে কী হচ্ছে, কার জন্য হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি।
___

নিতুর ঘুম ভেঙেছে বিকেলে। ঘুম থেকে উঠেই বেলকনিতে এসে বসেছে সে। বন্যা নিতুকে বেলকনিতে বসতে দেখে রান্নাঘর থেকে দুজনের জন্য দুই কাপ চা করে এনে নিতুর পাশের চেয়ারে বসল। নিতুর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“চা নে। তোর মতো তো আর বানাতে পারব না৷ আমার হাতের বিশ্রী চা টেস্ট কর আজকের মতো।”

নিতু মৃদু হেসে চায়ের কাপটা নিল। বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,“আজকের আকাশটা সুন্দর তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমার বান্ধবীর মন আকাশে তো মেঘ জমেছে। কেন জমেছে সেটা জানতে না পেরে আমার ভালো লাগছে না।”

নিতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের কাপের দিকে তাকালো। চায়ে একবার চুমুক দিয়ে সেটা হাতেই ধরে রইল। ঘটে যাওয়া সব ঘটনা একে একে বলল বন্যাকে। কথা শেষ করতে করতে চা ঠান্ডা হলো। বন্যা মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে জিজ্ঞেস করল,

“তাহলে এখন কী করতে চাইছিস?”
“আবারও দেশের বাহিরে যাব। আর ফিরব না।”
“পাগলামি করিস না।”
“আমার সিদ্ধান্তকে তোর পাগলামি মনে হয়?”
“হ্যাঁ। মনে হচ্ছে। সামান্য একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে তুই সম্পর্কটা তুচ্ছ করে দেশের বাহিরে চলে যেতে চাইছিস? দোষ তো তোর কম নেই। কথা লুকোনোতে তোরা দুজনই সেরা। ভাইয়া শুধু তোকে তোর বাড়িতে কেন নিয়ে যাচ্ছে সেটা জানায়নি আর তুই কী কী লুকিয়ে রেখেছিস ভেবে দেখ একবার। তুই তার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছিস যেখানে তোদের সবকিছু এখনো ঠিক হয়নি। তার রাগ করা স্বাভাবিক। উনি তোর মায়ের কথা রাখতেই তোকে না জানিয়ে ওখানে নিয়ে গেছে। তোর সাথে কী হতে পারে সেটা তুই উনাকে বললে এমন কিছুই হতো না। এতদিন উনার ব্যাপারে তুই যা যা বলেছিস তাতে বুঝেছি উনি তোর ভীষণ কেয়ার করেন৷ তোর জ্বরের কথাই একবার ভাব। তুই তোর বাবার ব্যাপারে সবটা উনাকে বললে উনি কখনোই তোকে ওখানে ওভাবে নিয়েও যেত না আর রেখেও আসত না। তুই কি বলেছিস উনি তোর সৎবাবা। অতীত বলেছিস? ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেটা বলেছিস? কিছুই বলিসনি তুই। উনাকে শুধু জানিয়েছিস যে তোর বাবা তোকে কাজ করতে দিতে চায় না। বিয়ে দিতে চায়। যেহেতু তোর বিয়ে হয়েই গেছে তাই উনিও হয়তো আর বিপদের আশঙ্কা করেননি। উনি তোর বাড়িতে যাওয়ার পরই বুঝতে পেরেছে তোর বাবা আসলে তোর নিজের বাবা নয়। তোকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার পরও বলছিস তোর মা জানিয়েছিল তোর বাবার বাড়ি ফিরতে চার, পাঁচদিন দেরি ছিল। তাহলে এত কিছু হয়ে যাবে উনি কীভাবে বুঝবে বল?”

বন্যা থেমে বলল,“শোন নিতু, একহাতে কিন্তু তালি বাজে না। তোরা দুজনই দোষী। আমি তো দেখতে পাচ্ছি সবটা লুকোনোর পর দোষ তোরই বেশি।”

নিতু চায়ের কাপটা ফ্লোরে রেখে বাহিরের দিকে তাকিয়েই বলল,“দোষ-ত্রুটি সব সাইডে রেখে শুধু একবার ভেবে দেখ উনি আমাকে ভালোবাসেন না, বন্যা। আম্মা আমাকে সবটা বলার পর বুঝেছিলাম উনার আসলে দোষ ছিল না। আমিই তো সব লুকিয়েছি। নিজের নোংরা, কালিময় অতীত কে জনসম্মুখে তুলে ধরতে চায় বল? আমি তো ভেবেছিলাম উনি সম্পর্ক শেষ করতেই আমাকে রেখে যাচ্ছেন তাই তো জীবনের এই হতাশায় আমি নিজেকে শেষ করতেও দ্বিতীয়বার ভাবিনি।”

বন্যা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,“যখন ভালোবাসবে, কাছে আসবে তখনই তো তুই চলে এলি।”

নিতুর ফোন বেজে উঠল। ফোনটা পাশেই রাখা ছিল নিতুর৷ ফোনস্ক্রিনে পরিচিত মানুষটার নাম জ্বলজ্বল করছে। নিতু স্ক্রিনে চোখ বুলালো। গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখা ‘সুপ্ত আবেগ’

ফোনটা হাতে নিতেই বন্যা শুধালো, “কে কল করেছে?”

নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে জবাব দিল,“উৎস।”

#চলবে…..

বাকি পর্ব পরবর্তীতে যোগ করা হবে।