প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২১

0
26

#প্রিয়_বিকালফুল(২১)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“আমি দেশের বাহিরেই চলে যাব, বন্যা। এই লোক আমাকে ভালোও বাসবে না আবার ছেড়ে থাকতেও দেবে না। যত কষ্ট শুধু আমারই হবে। আমি আর কত সহ্য করব বল তো?”

নিতুর কথায় বন্যা চায়ের কাপ দুটো নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“বা*লের কথাবার্তা আর ভাল্লাগছে না। বয়সে বুড়ি হচ্ছিস আর বুদ্ধিতে কচি বাবু। দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্তে গিয়ে চিল কর। তোদের আর কিছু করতে হবে না।”

বন্যা থেমে আবারও বলল,“তোদের কিন্তু রাগ, অভিমানকে বড় করে দেখার বয়স আর নেই, নিতু। দুজন কথা বলে সব ঠিক করে নে।”

বন্যা বেলকনি থেকে রুমে গেল। নিতুর ফোনটা বারবার বেজে চলেছে। নিতু কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কেউ মৃদু গলায় বলল,

“স্যরি।”
“ফোন করেছেন কেন?”
“মাফ চাইতে।”
“আমি বেরিয়ে আসার পর একবারও খোঁজ নিয়েছেন আমি কোথায় আছি, কীভাবে আছি?”
“যেভাবেই আছো, ভালো আছো, আমার চোখের সামনে আছো।”
“মানে?”
“রুমে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বিছানায় শুতে পারছি না তাই তোমার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি দুপুর থেকে।”

নিতু বসা থেকে উঁঠে দাঁড়ালো। বাহিরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল উৎস রোদের মধ্যে বাহিরে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। নজর তার দিকেই সীমাবদ্ধ। নিতু ফোন কানে নিয়ে বলল,

“এখানে এসেছেন কেন? আপনি বাসা চিনলেন কীভাবে?”
“তুমিই বাসার ঠিকানা বলেছিলে ভুলে গেলে?”
“এসেছেন কেন?”
“এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলব?”
“ইচ্ছে হলে রাস্তায় বসে পড়ুন। ভাঙা থালা পাঠাই।”
“তোমাকে পাঠালেই হয়ে যেত।”
“হবে না।” বলেই কল কেটে দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল নিতু।

উৎস পুনরায় ফোন করল৷ নিতু কল রিসিভ না করে ফোনটা হাতে নিয়েই জানালার ফাঁকা দিয়ে উৎসকে দেখতে থাকল। উৎস একভাবেই দাঁড়িয়ে কলের ওপর কল করে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর কল আসা বন্ধ হলো। ছোট একটা মেসেজ এসেছে অপরপক্ষ থেকে।

“ভালোবাসার ব্যাপার তোমার। আমি আমার অভ্যাস আর পরিবর্তন করতে পারব না। অভ্যাস হয়ে যাওয়া মানুষটা গত কয়েকদিনে বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিক কতখানি জায়গা সে দখল করে নিয়েছে। আমি তোমাকে না নিয়ে ফিরছি না, নিতু।”

নিতুর মুখে মুচকি হাসির আভা দেখা গেল। বন্যা রুমে ঢুকেই নিতুকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো কিছু বুঝল। বন্যা আলতো গলায় বলল,

“নারীকে এক পলক দেখে যে পুরুষ প্রেমে পড়ে সেই প্রেম নারীর সৌন্দর্যের প্রতি হয় আর যে প্রেম সময় নিয়ে বুঝ, অবুঝ ঘটনা, সময় নিয়ে গড়ে ওঠে সেটা ভালোবাসা হয়। উৎস ভাইয়া তোকে ভালোবাসে সেটা নিজের কাছেও নিজে স্বীকার করতে পারছে না। তুই উনাকে দীর্ঘ একটা সময় ধরে ভালোবাসিস উনি কিন্তু তোর মতো নয়৷ উনি মাত্র তোকে অনুভব করতে শুরু করেছে। তোর অনুপস্থিতি উনাকে হতবিহ্বল করে তুলছে। দূরে থাক আর দুটো দিন দেখবি উনার ভেতরের সব কথা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে। মানুষ যত চাপা স্বভাবেরই হোক না কেন কেউ তাকে ভালোবাসে জেনে নিজেও ভালোবেসে ফেললে সেটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারে না। উনিও পারবেন না। তোর কান স্বার্থক হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা। দুটো দিন দূরে থাক তবে একেবারে দূরত্ব বাড়াস না।”

নিতু জানালার ফাঁকা দিয়ে বাহিরে উৎসের দিকে তাকিয়েই বলল,“তুই হয়তো ঠিকই বলেছিস। ”

বন্যা একটা চেয়ার টেনে বসে বলল,“হয়তো না, আমি জানি আমি ঠিকই বলেছি। পৃথিবীর কোন মানুষই পারফেক্ট হয় না। দুজনের নিজেদের ত্রুটি মেনে নিয়ে দুই কদম করে নিজেদের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখ সবকিছু সহজ হয়ে যাবে। একটা কথা মাথায় রাখিস, আমি যতটুকু বুঝেছি উনি তোকে ভালোবেসে ফেলেছে। তোর খারাপ লাগা, বিপদ উনি সহ্য করতে পারেন না। সবাই সব কথা মুখ ফুটে তাড়াতাড়ি বলতে পারে না।”
_____

নিতু আর বন্যা অসময়ে ঘুমোনোর ফলে রাতের রান্নাটাও হয়নি। বন্যা বিছানা ছেড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,

“রাত হয়ে গেছে এখন আর রান্নাবান্নার কাজে কাউকে যেতে হবে না। চল বাহিরে খাই আজ।”

নিতু আড়মোড়া ভেঙে বলল,“অর্ডার দিয়ে দে কিছু।”

বন্যা ফোনের দিকে নজর রেখেই বলল,“সারাদিন বাসায়। খাবার বাহিরে অর্ডার না দিয়ে চল একটু হেঁটে আসি আর খেয়ে আসি।”

নিতুও অমত করল না। বিছানা থেকে উঠে বসে বলল,“ফ্রেশ হয়ে রেডি হই তাহলে। শুধু ড্রেসটা চেঞ্জ করব।”
“ঠিক আছে।”

দুজনে রেস্টুরেন্টের সামনে পৌঁছল ঠিক নয়টার সময়। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে দুজনে সিড়ি বেয়ে দোতলায় চলে গেল৷ কর্ণারের দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসল দুজন। বন্যা মেন্যু দেখতে দেখতে নিতুকে জিজ্ঞেস করল,

“কী খাবি?”

নিতু ফোনে ডুবে আছে৷ ওভাবেই বলল,“কিছু একটা নে।”
“বল তুই।”
“তোর আর আমার পছন্দের তফাৎ নেই খুব একটা। যা ইচ্ছে নে। আমি একটু ব্যস্ত আছি।”

বন্যা আর কিছু বলল না। ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিল৷ ওয়েটার যাওয়ার সময় মুখ থেকে মাস্কটা নামিয়ে দুইটা গোলাপ দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু হাসলো। বন্যা ফুলটা নিয়ে নিতুকে ডাকল। নিতু সামনে তাকিয়ে বলে উঠল,

“আপনি!? আপনি কী করছেন এখানে? সবখানে কেন থাকতে হবে আপনার?”

সামনে ওয়েটার বেশে দাঁড়ানো উৎস নিতুর দিকে ফুলটা বাড়িয়ে মুখটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“ভুল করেছিলাম বলে বউ অভিমান করেছে আর তাই আপাতত বউয়ের অভিমান সমাপ্তির মিশনে আছি। সাকসেসফুল হতে দেবেন না?”

নিতু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আপনার মিশনের কিছু বলছি। চলে যান এখান থেকে।”

উৎস মাস্কটা পরে নিল পুনরায়। নিতুর হাতে ফুলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,“ শিঘ্রই আবার আসছি।”

উৎস প্রস্থান করল। নিতু বন্যাকে বলে উঠল, “উনি এখানে কীভাবে এলো রে?”
“কে জানে? তবে যা করছে করতে দে। খাঁটিয়ে নে এই সুযোগে।”

নিতু মৃদু হেসে বলল,“লোকটা পুরো বেচারা টাইপ হয়ে গেল।”
“তোর জন্যই সুবিধা হচ্ছে৷ পরবর্তীতে বাহিরে কাজে যত গরমই থাকুক মাথা, বউয়ের কাছে এলে সব কুল।”

দুজনে হেসে উঠল। আবার উৎসের নজরে যেন না পড়ে তাই পরক্ষণেই চুপ হয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইল দুজন। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে আবার এলো উৎস। নিজেই সার্ভ করে দিল খাবার। উৎসের অবস্থা দেখে নিতু মুচকি হেসে মনে মনে বলল,

“আরও করুন বউয়ের সাথে পাকনামি। আমার জায়গায় নামিয়েই ফেললেন এবার নিজেকে৷ তবে এতটুকুতেই শেষ নয়৷ দুই মাসের পরিশ্রম, হতাশা আমি আপনাকে এই কয়েক দিনে পুরোপুরি পুষিয়ে দেব।”

_____
নিতু পুরো দুইদিন বাড়ি থেকে বের হয়নি৷ বন্যা শুধু নিজের কাজে সকালে বেরিয়েছে আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেছে। বাসায় একা একা দুই একটা বই, সিরিজ দেখেই সময় কেটেছে নিতুর। উৎসর কল, মেসেজ কিছুই কমেনি এই দুইদিনে। বরং আরও বেড়েছে। মানুষ যেমন নিজের কথা প্রতিদিন ডায়েরীতে লিখে যায় উৎসও আজকাল তাই করছে। নিয়ম করে নিতুর বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে।

এসবকিছু নিতুর মোটেও খারাপ লাগছে না। বরং উৎসের এমন কাজ যে এনজয় করছে। মাঝেমাঝে তো জানালার ফাঁকা দিয়ে উৎসকে দেখে মায়াও লাগে তার। পরক্ষণেই মনকে বুঝায়, এতগুলো দিন আমি চেষ্টা করেছি, আপনি চুপ ছিলেন এবার নাহয় আপনি কয়েকপদিন পরিশ্রম করলেন! আমি আপনার মনের এই আফসোস, আঘা*ত আরও তীব্র করতে চাই। আমি চাই, আপনি বুঝুন যে, আপনিও ভালোবাসার কঠিন রোগে ভুগছেন। আমাকে বোঝানোর সাথে সাথে নিজেও বুঝুন।

বন্যা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পূর্বে নিতুকে কল করে রেডি হতে বলেছে৷ জানিয়েছে, আজ দুজনে বাহিরে খাওয়া দাওয়া করবে, ঘুরবে৷ নিতুও অমত করেনি। পূর্বে নিতু দেশে ফিরলে দুজনে কত ঘুরাঘুরি করেছে! সেসবের কিছুই তো এখন হয় না।

নিতু ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি নিয়ে বেলকনিতে এলো। সামনে এবং আশেপাশে হয়তো কাউকে খুঁজল। দেখা মিলল না তার। হতাশ হয়ে রুমে ফিরে এলো সে। ওয়ারড্রব থেকে পছন্দের একটা শাড়ি বের করে নিজেকে পরিপাটি করে সাজাতে ব্যস্ত হলো নিতু।

বন্যা বাসায় ফিরল কিছুক্ষণ পরই। হাতে দুটো শাড়ির প্যাকেট৷ একটা নিতুকে দিয়ে বলল,

“আজ এই শাড়িটা পরবি।”

নিতু প্যাকেটটা নিল। ভেতরে নীল রঙের একটা সুন্দর শাড়ি। দেখেই মুখে হাসি ফুটল নিতুর। সে বলল,
“ম্যাডাম কি আজ স্যালারি পেয়ে বান্ধবীকে শাড়ি উপহার দিচ্ছেন?”

বন্যা ওপর-নিচ মাথা নেড়ে বলল,“জি৷ ঝটপট রেডি হয়ে নিন।”

দুজনে বের হলো সন্ধ্যাপর। বন্যা জানিয়েছে তাদের বাসা থেকে একটু দূরেই কলেজমাঠে আজ মেলা বসেছে। দুজন সেখানেও যাবে ঘুরতে। কথা অনুযায়ী দুজনে বের হলো। অন্ধকার নামতে শুরু করেছে৷ রাতে শহর যেন নতুন করে সাজায় নিজেকে৷ রাত, শহর, নিজেকে শাড়িতে সাজিয়ে নিতু অনুভব করল এভাবে প্রেমিক কিংবা বরের সাথে বের হতে হয়।

মেলায় ঢুকেছে দুজন বেশ কিছুক্ষণ হলো। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দুজন এটা ওটা দেখছিল আর পছন্দের ছোটখাটো জিনিস কিনছিল। হঠাৎ একটা দশ – এগারো বছরের পিচ্চি এসে একটা ফুলের তোড়া আর এক টুকরো কাগজ নিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আপামনি, এটা আপনার।”

নিতু ছেলেটার হাত থেকে নিতেই সে দৌঁড়ে চলে গেল সেখান থেকে। ফুলের তোড়াটা ভালোভাবে দেখে এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে কাগজটা খুলল।

“শাড়িতে খোঁপায় ফুলের তোড়া পরে নিও৷ এটা ছাড়া বেমানান লাগছে।” লেখাটা পরেই নিতু এদিক ওদিক তাকালো৷ কাউকে দেখা গেল না। হাতের লেখা দেখে যতটুকু আঁচ করতে পারল তা হচ্ছে এটা উৎসের কাজ। কিন্তু কোথাও তাকে দেখা গেল না।

পুরোটা সময়ে বেশ কয়েকটা এমন উপহার পেল নিতু। ফুলের তোড়া, পায়েল, কাচের চুড়ি, একগুচ্ছ গোলাপ জায়গা করে নিল নিতুর হাতে৷ বাহিরে বাহিরে বন্যার কাছে বিরক্তি প্রকাশ করলেও ভেতরে ভেতরে বেশ পুলকিত হচ্ছে সে। মনে মনে বলছে,

“দূরত্ব আপনাকে সত্যিকারের প্রেমিক বানিয়ে দিয়েছে, উৎস।”

দুজনে চা খেতে ছোট একটা স্টলে এসে বসতেই দুজনের জন্য চা চলে এলো। অবাক হলো দুজনে। অর্ডার করার পূর্বেই চা দেখে। নিতু এবার ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে মানুষটাকে একবার দেখার জন্য। চায়ের কাপটা টুলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়ালো নিতু। বন্যাকে বলল,

“তুই এখানে একটু বোস৷ আমি দেখছি উনি কোথায় থেকে এমন লুকোচুরি খেলছেন।”

বন্যা সাবধান করে বলল,“বেশি দূরে যাস না। খারাপ ছেলেপুলে থাকতে পারে৷ বিপদ ডেকে আনিস না।”

মৃদু হাসলো নিতু। বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“তোর কি মনে হয় চোখ জোড়া আমার ওপর থেকে সরেছে? আমাকে বিপদে সে পড়তে দেবে?”

বন্যা জবাব দিল না শুধু মৃদু হাসলো। নিতু উপহার পাওয়া জিনিসগুলো নিয়ে হাঁটতে শুরু করল৷ এদিক ওদিক উৎসকে খুঁজলো সে। মিললো না কিছুতেই। হতাশ হয়ে যখনই ফিরবে তখনই কেউ অন্ধকার হতে বলে উঠল,

“আমাকে খুঁজছো?”

কণ্ঠটা নিতুর চেনা। দাঁড়িয়ে গেল সে। পিছনে তাকাতেই উৎসের আবছা মুখটা দেখতে পেল। স্বস্তি ফিরল যেন এতক্ষণে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল উৎসেএ দিকে। উৎস একটা বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ দোকানপাট কিছুটা দূরে। আশেপাশে সেরকম কেউ নেই। নিতু এসে সামনে দাঁড়ালো। নিতু হাতের জিনিসগুলো দেখিয়ে বলল,

“কী হচ্ছে এসব?”
“পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দের ব্যাপারটা পরে৷ এগুলো কেন দিচ্ছেন? দাঁত থাকতে তো দাঁতের মর্ম বোঝেননি। এখন এগুলো কেন করছেন?”

সোজা হয়ে দাঁড়ালো উৎস। নিস্তেজ গলায় বলল,“এখন বুঝতে পারছি বলেই কদর করতে চাইছি।”

নিতু জিনিসগুলো উৎসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,“নেক্সট টাইম আমার আশেপাশে যেন না দেখি আপনাকে।”

কথাটা বলেই চলে যেতে পা বাড়ালো নিতু। উৎস নিতুর হাতটা ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,“আমাকে খুঁজতে একা একা এই ফাঁকা জায়গায় আসতে ভয় লাগল না? এখন যদি আমিই সুযোগটা নিই?”

নিতু কিছুক্ষণ উৎসকে দেখল তারপর বলল,“অতি ভদ্র পুরুষ আপনি৷ এক বিছানায় থাকতেই সুযোগ নিতে পারলেন না এখন আর কী নেবেন?”

উৎস যেন নিতুকে আরও একটু কাছে টানলো নিতুকে। এদিক ওদিক দেখে শুকনো ঢোক গিলল নিতু। উৎস বলল,

“পরিস্থিতি মানুষকে অনেককিছু করতে শেখায়, নিতু। অনেককিছু করতে বাধ্যও করে।”

নিতু উৎসের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,“হাত ছাড়ুন, আমি কিন্তু চিৎকার করে মানুষ ডাকব। ”

“মানুষ ডেকে কী বলবে? তোমার বর তোমাকে অন্ধকারে টেনে এনেছে নাকি তুমি এসেছ কী বলবে?”
“ছাড়ুন।”
“নিতু প্লিজ। এবার তো ফিরে এসো। তুমি আমাকে দেখে পূর্বের আমি’র সাথে একটুও পার্থক্য করতে পারো না? বুঝতে পারো না তুমি আমাকে? তোমার অনুপস্থিতি যে অনেককিছুর পরিবর্তন ঘটিয়েছে।”

“যখন আমি চাইতাম তখন কোথায় ছিলেন আপনি? এখন আর আমি ফিরব না। হাত ছাড়ুন।”

উৎস সাথে সাথে নিতুর হাতটা ছেড়ে দিল। অবাক হলো নিতু৷ উৎস নিতুর ফিরিয়ে দেওয়া জিনিসগুলো নিতুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“সময়ের মধ্যে অভিমানগুলোকে এবার একটু ছুটি দাও, নিতু। আমার হাতে বেশি সময় নেই। সদ্য তৈরি হওয়া আমার অনুভূতিগুলোকে অভিমানে ফানুশের মতো উঁড়িয়ে দিও না৷ আমি আবারও মুখ থুবড়ে পড়ব।”

___
বৃহস্পতিবার। মাঝরাত। উৎস আজও নিতুর বাসার সামনে থেকেই নিজের বাসায় ফিরেছিল। মায়ের সাথে খাবার খেয়ে রাতে ঘুমোতে গিয়েছিল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই উঠে বসল সে। আজকাল রাতে কিছুতেই ঘুম হতে চায় না। নিয়মে গড়া সবকিছু এলোমেলো হয়েই চলেছে। ক’দিন আগেও উঠতে, বসতে সব জায়গায় একজন অভ্যেস হয়ে গেছিল। তার কথা, হাসি ছাড়া আজকাল বাড়িটা পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। গত দুইরাত উৎস ঠিকমতো ঘুমোতেও পারে না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। এদিক ওদিক সবদিক অন্ধকার। কোথাও কারও সাড়াশব্দ নেই। দীর্ঘ ছুটির দিনগুলো যেন আরও দীর্ঘ হতে শুরু করেছে। সময় কাটতে চায় না। সবসময় মনে হয় কী যেন নেই।

নিতুর উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলা, চালচলন, সামনে সামনে থাকা সবকিছু যেন বেশি করে মনে পড়ে উৎসের। নিতুকে ছাড়া সবকিছুই খালি খালি লাগে।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই প্রতিদিনের নিতুকে কল দিল উৎস। রিং হতেই রিসিভও হলো। উৎস মৃদু গলায় বলল,
“ঘুমোওনি এখনো?”
“না।”
“কেন?”
“ কাজ করছিলাম।”
“খেয়েছ রাতে?”
“এত খবর আপনাকে কেন নিতে হবে?”
“নিতু তোমার মনে হচ্ছে না আমরা টিনেজারদের মতো ব্যবহার করছি? তোমার মনে হয় না আমাকে একটাবার সুযোগ দেওয়া উচিত?”

নিতু কিছু বলল না। নিতুকে চুপ থাকতে দেখে উৎস পুনরায় বলল,“তোমার কি একটুও মনে হয়নি তোমার প্রতি আমি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি? তোমার অনুপস্থিতিতে রুমে থাকতে ইচ্ছে করে না। তোমার কণ্ঠস্বর, উপস্থিতি প্রচন্ড মিস করি আমি তুমি না থাকাতে। আলাদা করে কেন ‘ভালোবাসি’ শব্দ বলেই একসাথে থাকতে হবে? এসব অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে ভালোবাসার কথা না বলে থাকা যায় না?”

উৎস থামল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের বলে উঠল, “আমি আবারও তোমাকে চাইছি, নিতু। আমি সংসার করতে চাই। আমার নিজেরও আর ইচ্ছে করছে না কাউকে সঙ্গী করার পর আবার সঙ্গীহীন থাকতে।”

নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ল্যাপটপ বন্ধ করে বলল,“আমার ঘুমোতে হবে তাড়াতাড়ি। আগামীকাল সকালে বের হতে হবে। পাঁচদিনের জন্য কুমিল্লা যেতে হবে কাজের জন্য।”

উৎসের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। পাঁচদিন! তবে কি সহজে সহজ হতে না পারার জন্য কঠিন শা*স্তি তার জন্য বরাদ্দ হলো!? সে বলল,

“নিতু, আমার ছুটি আর মোটে চারদিন৷ এরপর আমাকে কাজে ফিরতে হবে। দীর্ঘ একটা সময় সেখানে থাকতে হবে। আমাকে আর তুমি পাবে না অভিমান ভাঙানোর জন্য। এভাবে সবকিছু শেষ হতে দিও না। রাস্তাঘাটে তোমার পিছু নেওয়া, বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই কাজগুলো মোটেও আমার সাথে যায় না তবুও আমি করছিলাম। আমি এসব করছিলাম নিছকই মানবিকতা থেকে বলে তোমার মনে হয়? আর কত পরিমাণে বাড়বে শা*স্তির মাত্রা? এবার তো ট্রাজেডি শেষ হোক, নিতু।”

উৎসের এতগুলো কথায় চুপ হয়ে গেল নিতু। উৎসের তাকানোতেও পরিবর্তন দেখেছে সে। বুঝেছে এই কয়েকদিনের দূরত্বে উৎসের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনে ঠিক কী কী হয়েছে সেটাই শুধু সে বুঝতে পারছে না। নিতু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না উৎসকে সবটা এখনই জানানো ঠিক হবে কি না। সবকিছু জানালে হয়তো উৎসের এই সবে তৈরি হওয়া অনুভূতিটা গাঢ় হবে। কিন্তু সে বিশ্বাস করবে? নিজের ওইটুকু সময়ও যে উৎসের সামনে আনতে ভয় পাচ্ছে।

নিতু কিছু বলবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ওপাশে উৎস চুপ করে আছে। এমন সময় ফোন কেটে গেল। উৎস ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“নিয়মের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষটা তোমার জন্য আজকাল ফোনে চার্জ দিতেও ভুলে যায়, নিতু। যে বিছানায় দুইটা মানুষ একসাথে ঘুমিয়েছে সেই বিছানায় আর একা ঘুমায় না। কত কিছুর পরিবর্তন হয়েছে এরপরও তোমাকে যেতে দিতে হবে? কখনো না। আজই তুমি ফিরবে এ বাড়িতে।”

নিতু ফোনটা রেখে বালিশটা সোজা করে হেলান দিয়ে বসল। বন্যা পাশে বসেই অফিসের শেষ না হওয়া কাজ করছিল৷ নিতুকে হঠাৎ ফোন রেখে দিতে দেখে বলল,

“ফোন রেখে দিল?”
“জানি না, কথা শেষ না করেই কেটে দিল।”
“একবার কল দিয়ে দেখবি?”
“পাগল হলি নাকি?”
“কুমিল্লা তো যাচ্ছিস শুধু একদিনের জন্য। মিথ্যা বললি কেন?”
“ইচ্ছে হলো।”
“তবে কি স্যারের মতো ম্যাডামেরও দূরে থাকতে মন চাইছে না?”
“দূরে থেকে অভিমান, রাগারাগি ঠিক জমছে না। উনি যা করছেন বাহিরের পরিবেশে সেটে খাপ খায় না।”

বন্যা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। মৃদু হেসে বলল,“পুরুষ কোন নারীকে ভালোবাসতে শুরু করলে নিজের অবস্থান ভুলেও সব করতে পারে৷ উনিও সেটাই করছেন। অনেক তো হলো এবার দুজনে এক হ। উনাকে এবার সবটা জানাবি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু গোপন রাখতে নেই।”

“দেখা যাক।” সংক্ষেপে বলল নিতু।

বন্যা হাই তুলতে তুলতে বলুল,“একটা কথা মাথায় রাখবি। অন্তত মেয়েদের একটা সময়ে গিয়ে জীবনসঙ্গীর প্রয়োজন হয়৷ মানুষ চিরকাল একা থাকতে পারে না। অল্প বয়সে শোধ, প্রতিশোধ চললেও একটা সময় গিয়ে আফসোস করতে হয়। যে সুযোগ চাইছে তাকে একটাবার সুযোগ দিয়ে দেখ। মানুষটা তোকে হতাশ করবে না।”

#চলবে……