প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২২

0
22

#প্রিয়_বিকালফুল(২২)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

সকাল সকাল বিয়ের কার্ড নিয়ে উৎসের রুমে প্রবেশ করলেন ফরিনা বেগম। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। এই সময়ে উৎসকে গোসল শেষ করে রেডি হতে দেখে একটু অবাক হলেন তিনি। বিয়ের কার্ডটা বিছানার ওপর ফেলে বললেন,

“সকাল সকাল কই যাওয়া হচ্ছে?”

উৎস শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,“তোমার বউমাকে আনতে। কেমন লাগছে দেখো তো? পছন্দ করার মতো লাগলে কাজ এক ধাপ এগিয়ে যাবে।”

ফরিনা বেগম অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
“নিতুকে আনতে যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ। ”
“ফিরবে সে?”
“ফিরতে তো হবেই।”
“নিয়ে এসো তাকে। এই যে বিয়ের কার্ড। প্রতিবেশীর বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত পড়ল। বউমাকে ছাড়া আমি কিছুতেই ও বাড়িতে যাব না বলে দিলাম।”

উৎস মৃদু হেসে মায়ের পাশে এসে বসল। মায়ের দিকে ফিরে বসে বলল,“নিতু আসবে তো, আম্মা?”

ফরিনা বেগম ছেলের মাথায়, মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,“সে যদি কোনভাবে এই কয়েকদিনের আমার ছেলের অবস্থা দেখত তাহলে হয়তো তাকে ফিরিয়ে আনতে যেতে হতো না। সে নিজেই ছুটে চলে আসতো।”

উৎস মাথানিচু করে বলল,“আমি তো আসলেই ভুল করেছিলাম, আম্মা। আমি মাথায় তুলে রাখা ভালোবাসা পায়ে ঠেলেছিলাম। আমার এটুকু শা*স্তি প্রয়োজন ছিল৷ জুইয়ের অনুপস্থিতিতে আমি প্রতারণার গভীরতা বুঝেছিলাম আর এখন নিতুর অনুপস্থিতিতে ভালোবাসা বুঝে চলেছি। আমি ওকে অনুভব করতে পারি, আম্মা। বুঝতে পারি ওকে ছাড়া আমার চলছে না কিন্তু আমার দিকটা ওকে বোঝাতে ব্যর্থ আমি।”

ফরিনা বেগম ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,“সব বুঝবে। বাড়ির বাহিরে অন্য জায়গায় থেকে আর কতটুকু বুঝবে বল? ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মেয়েরা অভিমান করে থাকলেও ব্যক্তিগত পুরুষকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেয় না। তোর বাবার আর আমার ঝগড়া হলে নিজের ক্ষ*তি চাইলেও তার ক্ষ*তি ভুলেও মন চাইতো না। তুই যা বাপ, তাকে নিয়ে আয়। মেয়েটাকে ছাড়া এ বাড়িতে আর ভালো লাগে না। এই অল্প সময়ে সব নিজের করে নিয়েছে মেয়েটা।”

উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। ঘড়ি দেখে বলল,

“সেদিন তোমার রান্না করা খাবার খাওয়ার মানুষ আসেনি, আজ কিন্তু সে আসবেই। নিজের ইচ্ছেতে না আসলে প্রয়োজনে তুলে আনব।”
“তুলে আনবি!?” অবাক হয়ে শুধালেন ফরিনা বেগম।

উৎস ওপর-নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,“আর কতদিন ওর পিছনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব আমি? বাড়িতে নিয়ে আসি। বেডরুম, ড্রয়িংরুম, কিচেন, ছাদ, বাগান সবখানে ঘুরব সমস্যা নাই।”

ফরিনা বেগম হেসে উঠলেন। বললেন,“যা যা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”
“হ্যাঁ থাকো, আসছি।”
“যা। আল্লাহ ভরসা। ”

উৎস নিজের ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ফরিনা বেগমও উঁঠে দাঁড়ালেন। প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বললেন,

“তোরা দুটি এবার সব বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে এক হয়ে যা। মান-অভিমান শেষ হোক তোদের। আমি একটা ভরা সংসার দেখে যেতে চাই।”
____

প্রথমে বাসে যাতায়াতের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ট্রেনের সিটসহ টিকেট পাওয়ায় ট্রেনে যাওয়ার কথা ভেবেছিল নিতু। সেই মোতাবেক সকাল সকাল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যাগটা নিয়ে প্লাটফর্মে বসে আছে। পরনে কালো সালোয়ার, সাদা রঙের কুর্তি, সাদা ওড়না, চুলে বেণী করে পিঠে ফেলে রাখা, চোখে পাওয়ার গ্লাস। চুপচাপ বসে ফোন ঘাটছিল আর কিছুক্ষণ পরপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল। ট্রেন আসতে খুব বেশি দেরি নেই। যাত্রী এসে স্টেশনে ভিড় জমিয়েছে।

নিতু বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে আর দেখছে আশেপাশের মানুষগুলোকে। আশা করছে খুব শিঘ্রই পরিচিত মুখটা সে দেখতে পাবে। মনের ভেতর খচখচানিটা বাড়ছে, আদৌ উৎস আসবে তো?

চারদিকে লোক সমাগম। উৎস প্লাটফর্মে প্রবেশ করেছে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এত এত মুখের ভিড়ে একটা মুখ কোথায় লুকিয়ে আছে, আদৌ আছে কি না কে জানে?

এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে এক কোণায় সেই পরিচিত মানুষটাকে দেখতে পেল উৎস। হাঁটুতে ভর দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইল সে। বুকে এখনো একটাই ভয়- নিতুকে সে নিয়ে যেতে পারবে তো?

সোজা হয়ে কয়েকবার প্রলম্বিত শ্বাস নিল উৎস। নিতু ফোনের স্ক্রিনে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে। উৎস সেদিকে পা বাড়ালো। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দাঁড়াল নিতুর। সামনে কারো উপস্থিতি বুঝে ফোন রেখে সেদিকে তাকালো সে। উৎসকে দেখে বলে উঠল,

“আপনি এখানে?”

নিতুর পাশে জায়গা করে নিয়ে সেখানে বসল উৎস। মুখ উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আসার প্রয়োজন বোধ করলাম।”
“কেন?”
“আম্মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।”
“মানে?”
“বলেছে বউমাকে না নিয়ে গেলে আমার নাকি সেখানে জায়গা হবে না। কতদিন গৃহছাড়া থাকব বলো? নিজের জন্য হলেও তোমাকে নিয়ে যাওয়া জরুরি।”

নিতু মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি যাব না ওই বাড়িতে। কখনো যাব না। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে গিয়ে আমি কী করব?”

উৎস মৃদু গলায় বলল,“পূর্বে ভালো লাগা ছিল এখন ভালোবাসাও আছে।”
“বিশ্বাস করি না আমি।”
“না গেলে, না দেখলে বিশ্বাস করবে কী করে? সত্যিটা জানতে হলেও তো একবার যেতে হবে। ক’টা দিন একসাথে থাকতে হবে।”
“প্রয়োজন নেই। যখন চেয়েছিলাম তখন তো ছিলেন না আপনি আমার জন্য”
“এখন চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ। ”
“চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ। ”

উৎস নিতুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,“সত্যিই আমাকে চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?”

নিতু অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা করল। উৎস আবারও নিতুর থুতনি স্পর্শ করে নিজের দিকে ফেরালো।

“বলো নিতু। সত্যি করে বলো।”
“কী বলব?”
“আমাকে সত্যিই চাওয়া বন্ধ করে দিয়েছ?”
“ বললাম তো হ্যাঁ। ”
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।”
“ছাড়ুন।”
“তুমি আমাকে চাওয়া শেষ করলে সেখান থেকেই নাহয় আমি তোমাকে চাওয়া শুরু করলাম। ব্যাপার না, একজন চাইলেই ধীরেধীরে দুজনেরই চাওয়া এক হয়ে যাবে।”

নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে শুধালো,“এখন যখন আমি দূরে যেতে চাইছি তাহলে আপনি কেন আবার কাছে আসতে চাইছেন? এতকিছু কেন করছেন?”

“জানি না। আমার এই কয়েকদিন কীভাবে কেটেছে আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমার নিজের ছোট রুমটাও যেন বিশাল অন্ধকার মাঠ মনে হয়। কোথাও যেন কেউ নেই। সবখানে তোমার স্পর্শ অথচ তুমি নেই।”

উৎস থেমে ফের বলল,“নিতু আমি মনের কথা সেভাবে এক্সপ্লেইন করতে পারি না। একটু মানিয়ে নাও প্লিজ। আমাকে একটু সময় দাও আমি তোমার মনের মতো হয়ে উঠব। একটুও অভিযোগ করার ওয়ে রাখব না। বিশ্বাস করে দেখ একবার শুধু।”

ট্রেনের শব্দ শোনা গেল। দুজনের নজর সেদিকে। মানুষজন বসা থেকে উঁঠে ছুটলো সামনের দিকে। তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠতে হবে। দেরি করলেই আর সিট পাওয়া যাবে না বা ট্রেনই মিস হয়ে যাবে। উৎস সেদিক থেকে নজর সরিয়ে নিতুর দিকে চাইল। নিতুও ধীরে ধীরে উৎসের দিকে ফিরে উঁঠে দাঁড়াল। নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল,

“ভালো থাকবেন।”

উৎস নিজেও উঁঠে দাঁড়াল। মলিন মুখে বলল,“এই ট্রেন আজ তোমাকে নিয়ে গেলে আমি আর তোমার সামনে কোনদিন আসতে পারব না। আমি আফসোস করি এটা ভেবে যে, আমাকে একজন এত ভালোবাসলো আর তাকে ভালোবাসতে, তাকে অনুভব করতে এত দেরি করলাম! তুমিও আফসোস করবে এটা ভেবে যে, একজন নিজের ভুল বুঝে তোমাকে ফিরিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঁঠেছিল কিন্তু তুমি ফিরোনি।”

নিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উৎসের দিকে তাকাতে পারছে না। খুব করে চাইছে উৎস তাকে আটকাক। রেখে দিক তার কাছে অথচ ভেতরের ইগো বারবার জেগে উঁঠছে।

নিতুকে চুপ থাকতে দেখে উৎস নিজেও দিশেহারা হয়ে উঁঠছে। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আজ না আটকালে, সে আর সুযোগ পাবে না, দুজনের পথ ভিন্ন হবে সেটাও বুঝতে পারছে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ রইল। পরক্ষণেই কী ভেবে নিতুর হাত থেকে ব্যাগ আর ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলল,

“অনেক হয়েছে। আর বোঝাতে পারছি না। তুমি কোথাও যাবে না। যদি কোথাও যাও সেটা আমার বাড়িতে। ওখানেই এখন তোমার ফিরতে হবে, অন্য কোথাও না। আমি বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি, তাড়াতাড়ি চলে এসো।”

উৎস নিতুর ব্যাগ আর ফোন নিয়ে পা বাড়াতেই নিতু বলে উঠল,
“উৎস, আমার জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিন জলদি। ট্রেন চলে যাবে। ওগুলো তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিন।”

উৎস কিছু একটা ভেবে দাঁড়িয়ে গেল। নিতুর কাছে ফিরে এসে সামনে দাঁড়ালো। পরক্ষণেই নিতুর হাত ধরে বলে উঠল,
“আজ কিছু দেওয়া বা ছাড়াছাড়ি নেই। বাসায় চলো। যত রাগ আছে বাসায় গিয়ে দেখব।”

#চলবে…….