প্রিয় বিকালফুল পর্ব-২৩

0
190

#প্রিয়_বিকালফুল(২৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

উৎস কিছু একটা ভেবে দাঁড়িয়ে গেল। নিতুর কাছে ফিরে এসে সামনে দাঁড়ালো। পরক্ষণেই নিতুর হাত ধরে বলে উঠল,
“আজ কিছু দেওয়া বা ছাড়াছাড়ি নেই। বাসায় চলো। যত রাগ আছে বাসায় গিয়ে দেখব।”

নিতু অবাক হলো উৎসের কান্ডে। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“হাত ছাড়ুন। এত মানুষের মধ্যে সিনক্রিয়েট কেন করছেন? অসভ্য লোক কোথাকার!”

উৎস জবাবে বলল,“হাতই তো ধরেছি তাও আবার বউয়ের। জড়িয়ে ধরলেও এসব মানুষের কিছুই করার নাই।”

নিতু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“এই কয়েকদিনে কিছু হোক আর না হোক, আপনি অসভ্য ঠিকই হয়েছেন।”
“বউ যেখানে অসভ্য, বর সভ্য হওয়ার সুযোগ কীভাবে থাকে? অসভ্যতা ছোঁয়াচে রোগ। আমিও তোমার থেকেই আক্রান্ত হয়েছি।”
“বাজে কথা বলবেন না। হাত ছাড়ুন। ট্রেন ছেড়ে দেবে। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। যেতেই হবে।”
“বউয়ের কাছে বরের চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট কোন কাজ নেই। থাকতেও পারে না। তুমি বাজে কথা বলবে না।”
“হাত ছাড়বেন না?”
“আমি চার-পাঁচদিন পর চলে যাব তারপর যত ইচ্ছে কাজ কোরো। এখন বরের সাথে বাড়ি চলো।”
“যাব না।”
“যাবে না?”
“না।”
“ভেবে বলছো?”
“বলছি।”
“বেশি বাড়াবাড়ি করলে পা ভেঙে কোলে করে নিয়ে যাব। উৎসের খারাপ রূপ এখনো কিছুই দেখোনি।”
“অনেক দেখেছি।”

“তাহলে আরেকটু দেখো।” বলেই নিতুকে আরেকটু অবাক করে দিয়ে কোলে তুলে নিল।

আশেপাশের মানুষজন নিজেদের ব্যস্ততার মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। যেন এরকম কোন ঘটনা কখনো ঘটেনি, এরকম পরিস্থিতিতে তারা কখনো পড়েনি। কেউ কেউ তো ফোন বের করে ছবিও তুলে নিল।

উৎসের এমন কান্ডে হতবাক নিতু। সে যেন কথা বলতেও ভুলে গেল। এক পলকে চেয়ে রইল উৎসের দিকে আর উৎস সামনে নজর স্থির রেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলল। নিতুর এক পলকে চেয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল,

“বাড়ি গিয়ে দেখবে। এখন তুমি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার হাঁটতে সমস্যা হবে।”

নিতু চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,“অশ্লীল!”

প্লাটফর্ম থেকে রাস্তা বেশ খানিকটা দূরে। পুরো রাস্তা নিতুকে কোলে করেই গাড়ি অবধি আনতে হলো উৎসের। আশেপাশের মানুষগুলো এমনভাবে এখনো দেখে যাচ্ছে যেন তারা অবাস্তব কিছু দেখে নিয়েছে। নিতু সমানে নামিয়ে দেওয়ার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে খুব এনজয় করছে ব্যাপারটা। মনে মনে যেন চাইছে এই পথটা তাড়াতাড়ি শেষ না হোক। এভাবে আরও কিছুক্ষণ থাকতে রাজি সে।

গাড়ির সামনে এসে নিতুকে কোলে নিয়েই বলে উঠল, “এখন নামার জন্য জিদ করছ না কেন? কোলে থাকতে ভালো লাগছে? তুমি থাকতে চাইলে আমার সমস্যা নেই। আমি এই ছোটখাটো বডি সারাদিন কোলে করে রাখতে পারব যদি তুমি চাও।”

উৎসের এমন কথা কানে পৌঁছতেই জোর করে নামতে চাইল নিতু। উৎস শক্ত করে ধরে রেখে বলল,“আরেকটু থাকো।”

নিতু চোখ গরম করে বলে উঠল,“মানুষকে ফ্রিতে নাটক দেখাতে হবে না। আপনার লজ্জা না থাকলেও আমার আছে। নামিয়ে দিন জলদি৷ ট্রেনটা চলেই গেল। কত টাকা লস করালেন জানেন আপনি?”

“কত টাকা চাই আমার বউয়ের?”
“আপনার থেকে টাকা নিতে যাব কেন? ওখান থেকে পারিশ্রমিক পেতাম।”
“বর কাছে থাকাকালীন কাজকে ‘না’ বলুন শুধুমাত্র বরকে ‘হ্যাঁ’ বলুন। কাজ গেলে কাজ পাওয়া যাবে, বর চলে গেলে বরকে সহজে আর পাবেন না, জনাবা।”
“আমি শুধু আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি।”
“তোমারই বানানো নতুন চরিত্র। বিয়ের পর নাকি বর-বউয়ের চেহারাও অনেকটা মিলে যায়, চরিত্র মিললে সমস্যা কোথায়?”

নিতু উৎসের মুখের দিকে চেয়ে রইল। উৎস এদিক ওদিক চেয়ে বলল,“রুমে গিয়ে না হয় আবার কোলে নিব, এখন এত মানুষের সামনে অস্বস্তি হচ্ছে। দেখো, ভিডিয়ো করছে। আজ হয়তো ভার্চুয়াল আমরা দুজনই গরম করব।”

নিতু জোর করে নেমে গেল। উৎস গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ইশারায় ভেতরে গিয়ে বসতে বলল নিতুকে। নিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। উৎস নিতুর ব্যাগ, ফোন নিজের হাতে রেখেই বলল,

“নিতু প্লিজ। আম্মা তোমাকে খুব মিস করে। অন্তত তার কথা ভেবে চলো। আমার ওপরের রাগ কমাতে হবে না। সেটা আমিই কমিয়ে দেব। এখন তো চলো। একটাবার প্লিজ।”

নিতু চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসল। উৎস উচ্ছ্বসিত হয়ে গাড়ির দরজা আটকে নিজের সিটে গিয়ে বসল। পিছনের দিকে একটু হেলে পিছনের সিট থেকে দুটো গোলাপ নিয়ে নিতুর দিকে বাড়িয়ে দিল। নিতু ভ্রু কুঁচকে তাকালো উৎসের দিকে।

উৎস বলল,“একটা বাচ্চা মেয়ে বিক্রি করছিল। ভাবলাম তোমার জন্য নিই।”

নিতু মুখ গম্ভীর করে বলল,“আপনার সাথে যেতে রাজি হয়েছি, যাচ্ছি তার মানে এটা ভেবে নেবেন না যে আপনাকে মাফ করেছি বা আপনার প্রেমে আগের মতো হাবুডুবু খাচ্ছি।”

উৎস ফুলগুলো নিতুর কোলের ওপর রেখে গাড়ি ড্রাইভ শুরু করল। ড্রাইভের ফাঁকে বলল,“আমি একদমই সেটা ভাববো না বিশ্বাস করো। তুমি যে কখনো আমাকে ভালোবাসতে সেটাও ভুলে যাব।”

নিতু আঁতকে উঠল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,“সেটা কেন ভুলে যাবেন? সেটা ভুলবেন না। আমি আপনাকে এক সময় ভালোবেসেছি তখন আপনি বাসেননি আর এখন আমি সরে আসতে চাইছিলাম আর আপনি আঠার মতো লেগে আছেন।”

“তুমি যেহেতু বলেছ তাহলে এটাই সঠিক। বউ যেটা বলবে সেটাই ঠিক। ”
“হুম।”

উৎস গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। নিতুকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পথটা সে দ্রুত শেষ করতে চায়। অনেক তো হলো এবার নাহয় দূরত্ব তাড়াতাড়িই শেষ হোক।

দুজনে বাড়ি ফিরল খুব তাড়াতাড়িই। ফরিনা বেগম সকালের নাশতা নিয়ে দুজনের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। অতঃপর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো উৎস এবং নিতুর উপস্থিতিতে। দুজনকে একসাথে দেখে চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো ফরিনা বেগমের। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঁঠে নিতুর দিকে এগিয়ে গেলেন। নিতুও এগিয়ে এলো ফরিনা বেগমের দিকে। এই মানুষটার প্রতি তার কোন অভিমান, অভিযোগ নেই। এ বাড়িতে না ফেরায় কতবার যে কল দিয়ে বাড়ি ফিরতে বলেছেন তিনি তার কোন ইয়ত্তা নেই।

নিতুকে নিজ বাড়িতে পুনরায় দেখে খুশিতে চোখ দুটো টলমল করে উঠল ফরিনা বেগমের। নিতুর কপালে চুমু দিয়ে বললেন,

“আমার ঘর আবারও আলোকিত হলো। তুই ছাড়া বাড়িটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে রে, মা।”
“মাঝেমাঝে চারপাশ আলোকিত করতে নিজেকেও আলোর দারস্থ হতে হয়, আম্মা।”
“তুই চলে এসেছিস এবার সব ঠিকঠাক হবে।”

নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে বলল,“কে জানে কতটুকু ঠিক হবে সবকিছু!”

ফরিনা বেগম উৎসকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“যা বাপ, নিতুকে এবার রুমে নিয়ে যা। দুজনে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি। জলদি আসবি দুজনে।”

“হুম।” বলেই ইশারায় নিতুকে আসতে বলে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো উৎস। নিতুও উৎসের পিছে পিছে দোতলায় চলে এলো। একটা করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এসেছে আর সেই পুরোনো অনুভূতি ফিরে পেয়েছে নিতু।

এই বাড়িতেই সে জীবনের সবটা সময় ব্যয় করতে চায়, সাথের এই মানুষটাকে নিয়ে। মাঝেই এই মানুষটাকে কত দূরের লাগত আর এখন!

উৎস এক হাতে রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। নিতুও ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলো। রুমের এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিল একবার। কেমন যেন ঠেকলো নিতুর কাছে। বিছানায় চোখ যেতেই বিছানায় রাখা ছোটখাটো কিছু জিনিসপত্রের দিকে নজর গেল তার। নিতুর নজর অনুসরণ করল উৎস। মৃদু গলায় বলল,

“তুমি তোমার রুমটা যেভাবে রেখে গিয়েছিলে ঠিক সেভাবেই আছে। যে জিনিস যে জায়গায় রেখেছিলে সবটা আগের মতোই আছে। আমি শুধু রাতে ডিভানটা ইউজ করেছি। বিছানায় যেতেই ইচ্ছে করেনি। দমবন্ধ লেগেছে।”

নিতু কিছু বলল না শুধু নজরটা বিছানা থেকে সরিয়ে উৎসের দিকে পড়ল। অনিমেষ চেয়ে রইল সে উৎসের মুখের দিকে।

#চলবে……