#প্রিয়_বিকালফুল(২৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“এক কাপ চা হবে, প্লিজ?”
উৎসের আবদারে নিতু কিছুক্ষণ তার দিকে রইল উৎস আবারও বলল,“বউয়ের হাতে এক কাপ চা চাই, প্লিজ।”
ফরিনা বেগম মুচকি হেসে চায়ে চুমুক দিলেন। নিতু কোন কথা না বলে নিজের চায়ের কাপটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুখে মেকি রাগের ছাপ স্পষ্ট। উৎস নিতুর মুখের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে মায়ের কাছে গিয়ে বসল।
নিতু রান্নাঘরে ঢুকতেই দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। তাক থেকে মরিচের গুড়ো বের করে একটা চায়ের কাপে নিয়ে সাথে গরম পানি মেশালো রঙটা একটু বেশিই টকটকে হয়েছে। রঙ পাল্টানোর জন্য খানিকটা চকলেট পাউডার মেশালো তাতে। তবুও বোঝা যাচ্ছে। বেশি পাত্তা না দিয়ে উৎসকে ডাকল সে। নিতুর গলা পেয়ে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে এলো উৎস। রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বলে উঠল,
“কী হয়েছে, বউ?”
নিতু কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,“আপনার চা। চায়ের কাপে উঁকিঝুঁকি না মেরে চা-টা খেয়ে নিন।”
উৎস নিতুর দিয়ে তাকিয়ে চায়ের কাপটা নিল। একপলকে তার দিকে তাকিয়ে থেকেই চায়ের কাপে ফু দিয়ে চুমুক দিল। জিহ্বা ভিন্ন স্বাদ বুঝে জ্বলে উঠলেও মুখ-মন্ডলে তার ছাপ পড়ল না। নিতু উৎসের দিকে চেয়ে আছে উৎসের মরিচের গুড়ো খাওয়ার পরের অবস্থা দেখার জন্য কিন্তু উৎসের ভঙ্গিতে কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আরাম করে সে চা খাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে।
উৎস দুই তিনবার চুমুক দিতেই নিতু আর সহ্য করতে পারল না। উৎসের হাত থেকে কাপটা এক প্রকার ছিনিয়ে নিল। উৎস নিতুর দিকে চেয়ে হাত ঝেড়ে মুচকি হাসলো। নিতু বলল,
“আপনি রুমে যান, আমি চা করে আনছি। এটা দিলাম মজা করে আর উনি উজবুক সেজে খেয়েই যাচ্ছেন। যতসব! ”
উৎস এবার উচ্চশব্দে হাসল।
“আমার সাথে খারাপ করে যদি নিজেই সহ্য করতে না পারো তাহলে সেটা করতে যাও কেন?”
“আমি দিলেই সেটা আপনার সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে কেন খেতে হবে?”
“আমার তো এখন এমন অবস্থা যে, তুমি আমাকে একটু ভালোবেসে বি*ষ দিলে সেটাও চোখ বুজে গলাধঃকরণ করে নিব।”
“খুব ভালোবাসা দেখাচ্ছেন!”
“ভালোবাসা দেখতে পাও?”
“ফেইক সবকিছু। লোক দেখানো।”
“লোক দেখানো নয়। নিতুকে দেখানো।”
“যান এখান থেকে।”
“একসাথেই যাই?”
“যেতে বলেছি।”
“ভালোবাসি।”
নিতু আর কোন কথা বলল না। কাপটা নিয়ে এগিয়ে গেল চুলার দিকে। উৎসকে চা করে দিয়ে সে নিজের জন্য একটা ডিম ভাজি করে নেবে। নাশতা যদিও বানানো হয়ে গিয়েছে কাজের মেয়েটার তবে নিতু টেবিলে খেয়াল করেছে কোন ডিম ভাজি নেই। রুটি সে ডিম ছাড়া খেতে পারবে না বলে নিজেই ভেজে নেবে।
চা বানানো শেষ হতেই এক কাপ গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে উৎসকে দিয়ে এলো। অনেকদিন পর চায়ের কাপে ঠোঁট স্পর্শ করতেই তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো উৎসের।
___
“বউ, ও বউ….”
নিতু নিজের জন্য ডিম ভাজি করছিল। উৎসের এমন ‘বউ, বউ’ ডাক শুনে হাতের খুন্তি নিয়েই বাহিরে উৎসের দিকে তেড়ে এলো। কড়া মেজাজ দেখিয়ে বলল,
“নির্লজ্জের মতো সবসময় এত এত বউ বউ কেন করেন?”
উৎস ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“বউকে বউ বলব না?”
“না বলবেন না।”
“ বউকে বউ বলব না তো কি আপা বলব?”
“ইশ! এত অসহ্যকর মানুষ আপনি! কী চাই এখন?”
উৎস মৃদু হেসে বলল,“চায়ের কাপটা দিতে এলাম।”
নিতু উৎসের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। উৎস হেসে শান্তস্বরে বলল,
“পাশের বাসায় দুপুরে দাওয়াত আছে। তুমি আর আম্মা রেডি হয়ে থেকো। আমি নাশতা করে বের হব একটু।”
নিতু কোন জবাব দিল না৷ উৎসের ওপর মেজাজ বিগড়ে আছে তার। এখন কথা বলা মানেই মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া। সুতরাং চুপ রইল সে।
____
বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান থেকে ফিরে শাড়িও খোলা হয়নি, সাজও নষ্ট করা হয়নি নিতুর। ফরিনা বেগম নিতুকে নিয়ে ড্রাইভারকে সাথে করে আজ সারা বিকেল ঘুরেছেন। কারও বাড়িতে তিনি নিয়ে যাননি। ফরিনা বেগমের শহরের কয়েকটা পছন্দের জায়গায় ঘুরিয়েছেন এবং শেষে দুজন চলে গিয়েছিল সোজা গোলাপগ্রামে। সেখানটায় বেশ এনজয় করেছে নিতু। মাঝেমাঝে মনে হয়েছে এখানে উৎস থাকলে হয়তো আরও কিছু সুন্দর হতো।
বউ, শাশুড়ির বাসায় ফেরা হলো সন্ধ্যার অনেক পর৷ হাতে একগাদা ফুল। বাসায় ঢুকে শাশুড়ির কাছে থেকে বিদায় নিয়ে রুমে গেল সে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার উৎস বাসায় নেই। সারা বিকেল একটা কলও করেনি, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তবুও বাসায় ফিরেনি। যতটুকু ভালো মেজাজে বাসায় এসেছিল তাও যেন খারাপ হলো নিতুর। ফুল, ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে উৎসকে কল করল সে। সারাদিন ফোন করার মতো ফুরসত না পেলেও নিতু কল করতেই রিসিভ করল উৎস।
নিতু বিছানায় গিয়ে বসল।
“কোথায় আপনি?”
ওপাশ থেকে জবাব এলো,
“বাহিরে আছি একটু।”
“আপনি যে বাহিরে আছেন সেটা বাসায় ফিরেই বুঝেছি। দুদিন পর চলে যাবেন অথচ এখনো এত কীসের ব্যস্ততা আপনার?”
“বন্ধুদের সাথে আছি, নিতু। এক ঘণ্টার মধ্যে বাসায় ফিরছি।”
নিতু ঘড়িতে সময় দেখল। মাড়ি শক্ত করে বলল,
“সাড়ে আটটা বাজে। তার মানে আপনার দশটা বেজে যাবে। বাসায় ফিরতে হবে না। বাহিরেই থাকুন। পারলে একটা বিয়েও করে নিয়েন।”
“বউ অনুমতি দিচ্ছে আরেকটা বিয়ের?”
নিতু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রাগে যেন পুরো শরীর কা*টা দিয়ে উঠল। কিছু না বলেই ফোন কাটল সে। রুমের লাইট বন্ধ করে ওভাবেই শুয়ে পড়ল।
রাতে উৎসের ডাকে ঘুম ভাঙলো নিতুর। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বুঝতে পারল পুরো রুমে মোমবাতি জ্বা*লিয়ে রাখা হয়েছে। আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারল না সে। উৎসের দিকে ফিরতেই উৎসের মৃদু হাসিতে চোখ আটকে গেল নিতুর। সবকিছু ভুলে সামনে থাকা পুরুষটির দিকে চেয়ে রইল সে। উৎস হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে নিতুর দিকে খানিকটা নিচু হয়ে বসে আছে।
“কী হলো? উঠে বোসো একটু।”
উৎসের কথায় উঠেও বসল সে। নিতু বসতেই উৎস পিছন দিকে ফিরে একটা কেক সামনে নিয়ে এলো। ছোট ছোট মোমবাতিও জ্বল*ছে সেখানে। উৎস নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“শুভ জন্মদিন, বউ।”
নিতু সাথে সাথে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন চাপলো। ফোনস্ক্রিনে সময় আর তারিখ দেখে ঘুমোতে যাওয়ার পূর্বের রাগটা মাটি চাপা পড়ে গেল। চাপাস্বরে বলে উঠল,
“আপনি জানলেন কী করে?”
“সেটা জানা মুখ্য এখন?”
নিতু ডানে-বামে মাথা নাড়ল। উৎস কেক কাটার জন্য একটা ছুড়ি নিতুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কাটতে বলল। কেক কাটা হলে উৎস কেকটা সাইডে রেখে নিতুর হাতটা ধরল৷ একটু অপ্রস্তুত হলো নিতু। উৎস বলল,
“নেমে এসো।”
রুমের লাইট অন করল উৎস। নিতুর পাশে এসে দাঁড়ালো সে। দেয়ালের একদিকে ইশারা করতেই দুজনের একসাথে ফ্রেমে বাঁধাই করা কিছু ছবি দেখতে পেল নিতু। বিদ্যুৎ গতিতে সেদিনের ঘটনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নিতুও তো এই ছবিগুলো বাঁধাই করে এনেছিল৷ তারপর যা হয়েছিল মোটেও ভালো কিছু হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে৷ নিতুর মুখের অবস্থা দেখে হয়তো উৎস বুঝল সবকিছু। সে আলতো গলায় বলল,
“কিছু জিনিস ভাঙলে জোড়া তো দেওয়া যায় না কিন্তু নতুন রূপে ফিরিয়ে আনা যায়। আবার সবকিছুতে আঘা*ত করলে সাময়িক কষ্ট হলেও ভেঙে কিন্তু যায় না।”
“আমার ভালো লাগছে না, উৎস।” চকিতে বলে উঠল নিতু।
এক মুহূর্ত দেরি করল না বিছানায় গিয়ে বসতে। বারবার সবকিছুতেই কেন মন খারাপ হতে হবে? কেন এত অভিমান জমাতে হবে? বেশি ভালোবাসায় কি তবে বেশি অভিমান জন্মে? মনে মনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেদিনের মতো আজ সে ছবিগুলোর ফ্রেম ভাঙতে পারলে মনে শান্তি মিলতো।
উৎস নিতুর পাশে এসে বসলো। মাথানিচু করে এক বুক ভয় নিয়ে শুধালো,“তোমার কি ওগুলো এখন ভাঙতে ইচ্ছে করছে, নিতু? ওগুলো ভেঙে যদি তুমি স্বাভাবিক হতে পারো তাহলে তুমি ওগুলো ভেঙে ফেলো। ”
নিতু চমকালো উৎসের কথায়। তার দিকে ফিরে এক পলকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ আগে ভাঙার ইচ্ছে পোষণ করলেও এখন সেটা ইচ্ছে করছে না। মানুষটাকে বড্ড অসহায় লাগছে। কী ভেবে নিতু নিজেই উৎসের হাতখানা স্পর্শ করল। মাথা উঁচু করে নিতুর দিকে চাইলো উৎস। ভারি গলায় বলল,
“হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা নিঙড়ে দেওয়ার পরও ঠকে যাওয়ার যন্ত্রণা তুমি বুঝবে না, নিতু। দ্বিতীয়বার ভয় পেয়ে কাউকে ভালোবাসব না বলেও কাউকে হঠাৎ করেই নিঃশ্বাসের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার মতো লজ্জাজনক অনুভূতি কাকে বলে তুমি বুঝবে না। তোমার কথা, তোমার হাসি, তোমার ছটফটে স্বভাব, আমাকে পাওয়ার জন্য তোমার পাগলামি, তোমার অনুপস্থিত তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। আমি শুধু তোমার মতো জানাতে পারি না। যখন নিশ্চিত হয়ে জানাতে এলাম তখন আমার প্রতি নাকি তোমার আর কোন অনুভূতি নেই, ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই। আমারও কষ্ট হয়, নিতু। শুধু তোমার মতো অভিমান করতে পারি না, কাঁদতে পারি না।”
নিতুর কান্না পেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। এই কথাগুলো, ঠিক এভাবেই ভালোবাসার কথা শুনতে চেয়েছিল সে। এগারো বছরে হৃদয়ের ছটফটানি উৎস দেখেনি। পুনরায় কাছে পাওয়ার পর যে ঠিক কীভাবে দিন গিয়েছে, উৎসের মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শুনতে ঠিক কতটা উন্মুখ হয়ে বসে থেকেছে সেটা সে ছাড়া কেউই জানে না।
নিতু ছলছল চোখেই পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলো উৎসের দিকে। নিচুস্বরে বলল,
“কতটুকু ভালোবাসেন?”
“যতটুকু তুমি সহ্যও করতে পারবে না ততটুকু।”
“আপনি জানেন আমি আপনাকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি?”
“জানি।”
নিতু প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“মাত্র এই কয়েকদিনই সহ্য করতে পারছিলেন না, আমি কীভাবে ছিলাম ভাবুন একবার!”
উৎস নিতুর চোখে চোখ রাখল। অনুনয় করেই বলল,“জড়িয়ে ধরি?”
“না। জড়িয়ে ধরার অধিকার শুধু আমার কারণ আমার হৃদয় দীর্ঘ সময় ধরে তৃষ্ণার্ত।” বলেই উৎসের বুকে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল নিতু।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরল উৎস। হৃদয়ের গতি দুজনেরই বেড়েছে। নিতু যেন এতগুলো বছর পর ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেয়ে বুকের পাহাড়সম দুঃখকে ছুটি দিতে কেঁদে নিল কিছুটা।
কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে, উৎসকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসল৷ উৎস নিতুর চোখ মুছে দিতেই নিতু বলে উঠল,
“আপনাকে আমার অনেক কথা বলার আছে, উৎস।”
উৎস কিছুক্ষণ নিতুর দিকে চেয়ে রইল।
“আজ সব কথা ভুলে গেলে হয় না, নিতু?”
“না মানে…”
নিতুকে কিছু বলতে দিল না উৎস। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে দিল তাকে। অস্পষ্টস্বরে বলে উঠল,
“ভালোবাসি।”
নিতু নিজের ঠোঁট থেকে উৎসের আঙুল সরিয়ে বলল,
“ভালোবাসি না।”
“ভালোবাসি।”
“বাসি না।”
নিতুকে টেনে নিজের সাথে প্রায় মিশিয়েই নিল উৎস। নিঃশ্বাসের গরম বাতাসটাও যেন একে অপরের মুখের ওপর পড়ছে। উৎস নিতুর দিকে এক পলকে চেয়ে থেকে বলল,
“চোখে চোখ রেখে বলো।”
“ভালোবাসি না।”
“আমার দিকে তাকিয়ে বলো।”
উৎসের চোখে চোখ রাখল নিতু। মৃদুস্বরে বলল,
“ভালোবাসি।”
নিতুর মুখটা আঁজলা করে ধরল উৎস। চোখে পূর্বের ন্যায় ডুব দিয়েই বলল,
“ক্যান আই কিস ইয়্যু?”
#চলবে……